আমি সবসময়ই বলি, বাংলাদেশের সেরা তিনটা লিটলম্যাগ ছিল পেঁচা, গাণ্ডীব এবং ছাঁট কাগজের মলাট। লেখার মান বিচারে এদের চেয়ে ভালো লিটলম্যাগ হয়তো পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এদের শক্তি ছিল ভিন্ন জায়গায়। এই তিনটা লিটলম্যাগ তাদের স্বতন্ত্র চারিত্র্য তাদের লেখকদের প্রত্যেকের মধ্যে সঞ্চার করতে পেরেছিল। এসব পত্রিকাগুলো ছিল গোগলের ওভারকোটের মতো, যার পকেট থেকে তাদের নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী বের হয়েছিলেন। এই ইউনিফর্মিটি আর কোনো লিটলম্যাগের মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
ফয়জুল ইসলাম ছিলেন পেঁচার লেখক। তখন তার নাম ছিল ফয়জুল ইসলাম সুমন। পেঁচা যে বিষণ্ণ ল্যান্ডস্কেপ ইমাজিন করেছিল, যেখান থেকে আমরা পেয়েছিলাম ভোরের মন্দির-এর বিষ্ণু বিশ্বাসকে, ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থান-এর অসীম কুমার দাসকে — ফয়জুল ইসলাম সেই ল্যান্ডস্কেপ থেকেই উঠে এসেছিলেন। পরে তিনি যখন প্রতিষ্ঠিত লেখক হলেন, সেই বিষাদের অনেকটাই মিইয়ে গিয়েছিল। তাকে তাড়া করেছিল হাসান আজিজুল হক। তবু তিনি পেঁচার পরিচয় গা থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারেননি।
আমার সাথে ফয়জুল ইসলামের পরিচয় হয়েছিল ১৯৮৮ সালের দিকে। ভীষণ আন্তরিক একজন মানুষ। পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসেছেন। ক্যারিয়ার এবং সাহিত্য তাকে দুদিক থেকে টানছে। সেই টানাপোড়েনের চেহারা আমরা অনুভব করতাম পিজির পেছনের আড্ডায়। সাহিত্য নিয়ে তখন প্রায়-সবারই ব্যাপক রোমান্টিসিজম ছিল। ফলে, ক্যারিয়ার ও সাহিত্যের এই দ্বৈরথ আমাদের কাছে চিত্তদৌর্বল্য বলে প্রতিভাত হতো।
সেই রোমান্টিক মহারথীদের অনেকেই কালে কালে বিলোপ হয়ে গেছেন। প্রবল শক্তি নিয়েই তারা সাহিত্যে এসেছিলেন। বাস্তবতা এবং অতিকল্পনা তাদের চাবকে নিয়ে গেছে বহুদূর। আশির দশকের ফয়জুল ইসলাম সে-তুলনায় পেরিফেরিতে ছিলেন। কিন্তু তিনি ঘুরে ঘুরে সাহিত্যের কাছে ফিরে এসেছেন। বই লিখেছেন। স্বীকৃতিও পেয়েছেন।
তার মৃত্যু ভীষণ বেদনার। অদ্ভূত ব্যাপার। তাদের প্রজন্মের সবচে শক্তিশালী কবি বিষ্ণু বিশ্বাস বহু বছর নিখোঁজ ছিলেন। আমরা তাকে মৃত বলে ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক যুগ পরে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের কোনো গ্রামে। জীবনের নানান কশাঘাত খেয়েও বিষ্ণু বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছেন। হয়তো লিখছেন। বা লিখছেন না। তুলনায় ফয়জুল অনেক শান্ত জীবনের সাধনা করেছিলেন। নিজের জীবন নিয়ে অন্যদের মতো খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি। তবু জীবন তাকে দ্রুত ছুটি দিয়ে দিলো!
২২ জানুয়ারি ২০২৫
- কথাসাহিত্যিকের প্রস্থান : ফেয়ারোয়েল টু ফয়জুল ইসলাম || সুমন রহমান - January 26, 2025
- হালুমহুলুমভালুমবাসা, ব্রাত্য রাইসু! || সুমন রহমান - November 23, 2024
- শেখশাহি, সাংবাদিকতা ও স্বাধীন বাংলা || সুমন রহমান - August 23, 2024
COMMENTS