নয় থেকে দশটা সিনেমা বানিয়েছেন হুমায়ূন, স্বহস্তে, গুনে দেখলে আটটা সাকুল্যে। এর বাইরে আছে হুমায়ূনকাহিনি ভিত্তি করে বানানো অন্যদের সিনেমা। তা, সেগুলোও কম নয়, আটের চেয়ে বেশিই হবে অন্যান্য ডিরেক্টরের বানানো হুমায়ূনাখ্যান অবলম্বনে সিনেমা। আমরা এই নিবন্ধে ইয়াদ করছি সিনেমাকার, এবং গীতিকার, হুমায়ূন আহমেদকে।
কেমন ছিলেন তিনি সিনেমাকার হিশেবে? সেই হিসাবনিকাশের লোকলস্কর আলাদা। তা, তাঁকে কি বিশেষ বিবেচনায় পাশ দেয়া যায়? এর উত্তরে একজন বললেন, মহাকালে বিশেষ বিবেচনা বলে কিছু নাই। বিলক্ষণ। তবে দেখতে তো মন্দ লাগে নাই, নিবন্ধকারের স্বীকারোক্তিটুকু সরল, তিনটে অন্তত এই নিবন্ধকারের নয়নে বেশ লেগেছে। সেগুলো ক্রমশ যথা ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ এবং প্রস্থানের অব্যবহিত পূর্বে রিলিজ-পাওয়া ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। আপনি যদি সিনেমাজাগতিক নতুন-পুরানা নানান তরঙ্গের ম্যুভিচিত্রগুলো সম্পর্কে একাধটু ওয়াকেফহাল ও থোড়াথুড়ি রসাস্বাদনকারী হয়ে থাকেন, তবুও বলবেন কি সিনেমাত্রয় একেবারে মন্দ হয় নাই? ফিল্মি দুনিয়ায়, যেমন কবিতায়, ভালো-মন্দ বিচারসালিশের বাইরে যেয়েও রসাস্বাদন করা যায় এবং সেই আস্বাদনোত্তর অভিজ্ঞতা আলবৎ প্রকাশও করা যায়। এই কথাটায় আস্থা রাখতে পারলে মানুষ হিশেবে আমাদের অপরাধ ও অর্জনসমূহ অনেক উন্নয়নশীল ও উদযাপনযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
এই প্রসঙ্গ, তথা হুমায়ূনের চলচ্চিত্রিক বোধ ও বাসনার খবরাখবর তালাশ, আপাতত স্থগিত রাখা যাক। এরচেয়ে বরং কয়েকটা আশপাশকথা ব্যক্ত করা যাইতে পারে। যেমন একটা কনফেশন তো জরুর যে, এই নিবন্ধকারের সমবয়সী বিভাগীয়-মফস্বল শহুরে বাসিন্দাদের যৌবন ফিকে হয়ে যেত বান্ধবী-সমভিব্যহারে প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে একটাও বই না-দেখে। সেই সুযোগটি নিয়ে আসে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, সেই প্রথম এবং সেই-ই শেষ, ছারপোকাদষ্ট সিটের সিনেমাহ্যল থেকে বেরিয়েই আমাদের বান্ধবীরা আলতারাঙা রাতুল পায়ে সুরমা-কুশিয়ারা খালনালানদীবিল লোহিতবর্ণিল বানিয়ে একে একে বিদায় নিতে থাকে আমাদের জীবন থেকে, এবং আমরাও মতি মিয়ার মতো বৈঠা ফেলে দেই ঝপাৎ করে মাঝগাঙে, সেই দিন আর আসে নাই ফিরে।
এইটা ঠিক যে, সহপাঠী ব্যাটাবন্ধুদের নিয়ে এর আগে ও পরে আমরা ময়ূরী ও মুনমুনের বই নির্মদ্য উইকেন্ডে প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে দেখলেও মেয়েবন্ধুদের নিয়ে ওই-ই ছিল প্রথম ও শেষ অভিযান। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রায়ন হিশেবে নাসিরুদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’ ও তারেক মাসুদের ‘নরসুন্দর’ ম্যুভিনিচয়ের পূর্ব পর্যন্ত ‘আগুনের পরশমণি’ তো অদ্বিতীয় ছিল নানা কারণেই, ‘ওরা এগারোজন’ মনে রেখেও বলা যায়, এখনও এবং সম্ভবত অনেকদিন-আরও উল্লেখযোগ্যতা থাকবে এই সিনেমাটার। ঠিক চলচ্চিত্রিক চোখ দিয়ে দেখতে গেলে এর অনেক অসঙ্গতি-বিসঙ্গতি ধরা যাবে না তা নয়, বিস্তর ধরা যাবে, সে-তো হুমায়ূনের যে-কোনো চলচ্চিত্রকাজে এবং নাট্যাদি নির্মাণে ঢের অসঙ্গতি ছিল, ফিল্ম হিশেবে এদের ফ্রেম খুবই নিশ্চরিত্র, সর্বোপরি সিনেমাগুলোর অকহতব্য মন্তাজদারিদ্র্য, সবই ঠিক আছে। টেক্নিক্যালিও খুব সাউন্ড তো নয় তাঁর সিনেমা একটাও। তবে আকালের দিনে, মঙ্গাকালে, ঘেঁচুকচুও তো সহাগা। আকালের জাউভাত অবশ্যই ইতিহাসে চিরস্মর্তব্য, তা আপনি দিনফেরা দারুণ বসন্তসময়ে ফেস্টিভ্যালে যেয়ে যতই স্বর্ণভল্লুক লভুন আর পলান্ন ভক্ষণ করুন-না-কেন।
সবকিছু মিলিয়ে দেখলে দেখব হুমায়ূন ছিলেন গল্পবলার দিকে মনোযোগী, সিনেমায় অন্তত, ঢিসুমঢিসুম মারদাঙ্গা আর চাক্কুমচুক্কুম নাচাগানা কাটপিসের ভুবনে এইটুকুই ছিল আমাদের জন্য মরুদ্যান, ওয়েসিস, মায়াবী সিমুম, ভুলি ক্যাঙ্কা করে! এবং চলচ্চিত্রে হুমায়ূনের এই-রকম খুঁটিনাটি কিছু কন্ট্রিবিউশনের ভিড়ে যে-ব্যাপারটি নির্দ্বিধায় কুর্নিশযোগ্য, সেটি হলো চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে হুমায়ূনের কিছু অনবদ্য গীতপঙক্তি রচনা। খানবিশেক গান তিনি লিখেছেন মোটমাট, ফিরিয়ে এনেছেন একঝলক বাংলা ছায়াছবির নস্ট্যালজিক সোনালি দিনের স্মৃতি। কিছু টিভিফিকশনে, বেশকিছু স্বপরিচালনায় সিনেমার প্রয়োজনে, সেই গীতিকাগুলো তৈরি হয়েছে। ‘আমার আছে জল’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘চন্দ্রকথা’ ইত্যাদি সিনেমার গানগুলো স্মরণ করা যায়।
গীতিকার হুমায়ূন তুরীয় ফুর্তির কয়েকটা গানপদ যেমন বেঁধেছেন, অল্পকথায় বেদনাগাথার শিল্পী তিনি, সুখফুর্তির পাশাপাশি বিষাদেরও তেমনি। দুইটা গান তো বলতে গেলে রবীন্দ্রসংগীতের মর্তবায় নিয়ে গেছেন, লিরিক্যাল ইন্টেন্সিটির দিকটি বিবেচনায়, এদের একটির মুখ এমন : “বরষার প্রথম দিনে / ঘন কালো মেঘ দেখে / আনন্দে যদি কাঁদে তোমার হৃদয় / তখন তাহার সাথে করো পরিচয়…” ইত্যাদি। কিংবা আরেকটা গান ওই বৃষ্টিদিনেরই বিষণ্নতামাখা, হাহাকারব্যাপ্ত বর্ষাঋতু মন্দ্রিত সংগীতযোজনা ও আবহ, মুখড়ার বাণী গিয়াছি ভুলিয়া। গানটার শুরু সম্ভবত ঠাকুরপদ ছুঁয়ে : “বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদেয় এল বান / বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান …” এবং এরপরে গানের দেহখানা। বা, কেমন করে ভুলি, সেই “ও আমার উড়াল পঙ্খি রে / যা যা তুই উড়াল দিয়া যা…” গানটা! বাংলা গানে হুমায়ূনের অবদান, যদি জিগান, দুইটা লাইন গুঞ্জরিয়া উঠিলেই কাফি : “সবুজবরন লাউডগায় দুধশাদা ফুল ধরে / ভুল-করা কন্যার লাগি মন আনচান করে” — এই একটা গানের ছোট্ট কয়েক স্ট্রোকে যে-নিসর্গমায়া আমরা দেখি, বিরল এর তুলনা।
না, ভুল-করা কন্যার লাগি মন হয়তো উচাটন হয় না আমাদের এ-বয়সে আর, একসময় হতো কি না তা-ও মনে পড়ে না, মাগার সব্জিবর্ণা লাউডুগিতে দুগ্ধধবল ফুল আমরা একদিন ফুটতে দেখেছি অনেক, আজ আর নেই তারা কেউ খবরে, নিখিলেশও তো কবরে, ইত্যবসরে আমাদেরও চোখ সর্ষেফুল দেখতে দেখতে সেই চিলতে-লম্বাটে উঠোনের দূর কোণে কেবলই শান্তিস্নিগ্ধা লাউফুলগুলো খুঁজে ফেরে। নেইরাজার দেশে এসে পৌঁছেছি এদ্দিনে, নেই সেথা ক্ষণপরিত্রাণ। কথাটা জাজমেন্টাল শোনালেও বলতেই হচ্ছে, কেননা নাচার এছাড়া, সমগ্র বাংলাসাহিত্যে এই পিকচারটা, লাউডুগিটা আর তার ফুলটা, আগে হেরিয়াছি বলে মনে তো পড়ে না। তা, বিপুলা এ-ভবশ্রেষ্ঠা বাংলাসাহিত্যের আমরা কতটুকুই-বা জানি, বিশেষত বঙ্গপ্রভাষণাব্যাদিত ধরাধামে এই জমানায়, ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেলুম। অদৃশ্য একটি ইমোটিকন ধর্তব্য ঠিক এইখানে, সমবেত হাসাহাসির, ভেংচানো মুখাবয়বের। আনন্দম্!
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- মাধবী, বিপ্লব ও অন্যান্য মদন প্রসঙ্গ - January 24, 2025
- জানালাবায়োস্কোপ - January 23, 2025
- প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে - January 4, 2025
COMMENTS