একজন মানুষের জীবনে এমন কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যা সারাজীবনের সুখস্মৃতি হয়ে থাকে। আজীবন শেকড়সন্ধানী সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুরের সঙ্গে আমার যৎসামান্য পরিচয় ছিল এটা ভেবে খুব গর্ববোধ করি। পরিচয়ের ক্ষণটা আমার জন্য এক সুখকর স্মৃতিই বটে। এত অমায়িক, আন্তরিক আর সহজ-সরল মানুষ খুব কমই দেখেছি। বাংলা একাডেমি চত্বরে যেদিন পরিচয় হয়েছিল, সেদিনই তিনি স্বাক্ষরসম্বলিত তাঁর লেখা ‘মহররম উৎসব’ বইটি আমাকে ভালোবেসে উপহার দিয়েছিলেন। এই অনন্য স্মারকটি আমি সযত্নে তুলে রেখেছি।
পরিচয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন জানতে পারলেন আমি সুনামগঞ্জের মানুষ — তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলে উঠলেন, ‘সুনামগঞ্জে করিমভাইয়ের বাড়িতে কতবার গিয়েছি। করিমভাইকে চেনেন?’ তাঁর প্রশ্ন শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। তাৎক্ষণিক আমার পরিচিত করিমভাইদের একটা তালিকা মনে মনে খুঁজে বের করছিলাম। সম্ভবত এটা বুঝতে পেরেই তিনি আরেকটু সহজ করে বললেন, ‘আরে, উজানধলের বাউল করিমের কথা বলছি।’এরপর তিনি শাহ আবদুল করিমের গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার পাশাপাশি তাঁর বাড়িতে একাধিকবার যাওয়া, দুজনের ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিচারণা এবং করিমের বেশকিছু গণমুখী গানের বিশ্লেষণ করলেন।
মোহাম্মদ সাইদুরের কথা শুনে আমি আনন্দে উদ্বেলিত হই। আমার সারা শরীরে মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়ে। পুরো হাওরাঞ্চল জুড়ে যে শাহ আবদুল করিমের গানের দাপট। গান ও কথায় মন্ত্রমুগ্ধ করার কারণেই করিমকে ভালোবেসে মানুষেরা উপাধি দিয়েছিলেন ‘বাউলসম্রাট’। সেই শাহ আবদুল করিমের গানের যে অপূর্ব ব্যাখা আর বিশ্লেষণ করলেন মোহাম্মদ সাইদুর, তা এককথায় অসাধারণ। আজ শাহ আবদুল করিম এবং মোহাম্মদ সাইদুর দুজনের কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁদের দুজনের আন্তরিক অনুভবের মিলনসূত্র হিসেবে একটি স্মারক ঠিকই আমার হাতে রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে মোহাম্মদ সাইদুরের লেখা ‘মহররম উৎসব’। এই বইটি আমাকে উপহার দেওয়ার সময় প্রথমপৃষ্ঠায় তিনি ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লিখেছিলেন, ‘সুনামগঞ্জ মানেই করিমভাইয়ের গানের মায়াবী টান’।
শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে মোহাম্মদ সাইদুরের পরিচয় কতদিনের তা আমার জানা নেই। তবে খুব সম্ভবত ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে তিনি করিমের একটি সাক্ষাৎকার নিতে সিলেটে এসেছিলেন। আর সেখানেই প্রথমবারের মতো পরিচয়। এরপর মোহাম্মদ সাইদুর লোকসংস্কৃতির নানা বিচিত্র ধরনের সংগ্রহের কাজে অনেকবার সুনামগঞ্জে এসেছিলেন। আর সুনামগঞ্জ এলেই তিনি ছুটে যেতেন শাহ আবদুল করিমের গ্রামের বাড়ি দিরাইয়ের উজানধলে। সেই যোগাযোগ ধীরে ধীরে অনেকটাই ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিয়েছিল। শুনেছি শাহ আবদুল করিমের দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকারও তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারটি এখন পর্যন্ত কোনও সংকলন কিংবা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে কিশোরগঞ্জে নিজের বাড়িতে স্থাপিত লোকশিল্প জাদুঘরে এটি সংরক্ষিত রয়েছে কি না তা অবশ্য ঠিক জানি না।
বাংলা একাডেমির চাকরিজীবন শেষে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মোহাম্মদ সাইদুর ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মারক’ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বগাদিয়া গ্রামের এই লোকতত্ত্ববিদ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্ত। এর মধ্যে ‘উজানধল’ একটি উদাহরণ মাত্র। অনেকের মতো কাছ থেকে তাঁকে আমারও বেশ কয়েকবার দেখার সুযোগ ঘটেছিল বলেই গর্ববোধ করছি। এখনও দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে তাঁর সদাহাস্য মুখ।
আজ গোটা বাংলাদেশজুড়ে ফাঁকিবাজ গবেষক ও লোকসংগ্রাহকদের বড়ই দাপট। কিন্তু মোহাম্মদ সাইদুর সেখানে চিরনমস্য। তিনি লোকঐতিহ্য সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতেন সারাদেশ। অকপটে বলতেন, ‘বাঙালির সংস্কৃতিকে চিনতে হলে মানুষের কাছে যেতে হবে’। তাঁর সেই কথায় সংস্কৃতির প্রতি প্রচণ্ড আবেগ ও দরদ পাওয়া যায়। তাই তিনি আমাদের মতো অনেকের কাছে আদর্শ ও অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল নাম। এই লোকগুরুকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS