ঋতু গুহ প্রয়াণের আট বছর হয়ে গেল। রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী ঋতু ১৯৩৭ সালে কলকাতার বালিগঞ্জ প্লেসে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি গান শিখতে এবং গাইতে শুরু করেন। ঋতুর গাওয়া বেশকিছু রবীন্দ্রগান সমুজদার সংগীতশ্রোতাদের কানে এবং মনে এখনও অম্লান। সম্ভবত অম্লান রইবে এমন চিরকেলে রেন্ডিশনে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গান গেয়ে গেছেন ঋতু। ২০১১ সনের ২৪ ডিসেম্বর সত্তর বছর বয়সে এই শিল্পী ইন্তেকাল করেন।
রবীন্দ্র অথবা পাঁচকবির যে-কারো সংগীত/গানের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার হচ্ছে এমন যে এদের গানগুলো একেকজনের পরিবেশনায় ভিন্নতর দ্যোতনা-ব্যঞ্জনায় আবিষ্ট করে শ্রোতামাত্রেই। কিংবা আরও স্পষ্টোচ্চারে বলতে গেলে এইটা স্বীকার্য যে একেকটা গানে একেকজনের কণ্ঠ খাপ খেয়ে বসে যায়, একই গান অন্যের কণ্ঠে হাজার পার্ফেক্টলি রেন্ডার্ড হলেও শ্রোতা তাতে তেমন যুৎ পায় না। ঋতুর কণ্ঠেও অমন খাপে-খাপ গাওয়া গানের দেখা আমরা পাই। বিশেষ করে ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ গানটার কথা আলাদা উল্লেখের দরকার এখানে। এই গানেই ঋতুর কণ্ঠসৌষ্ঠব ও গায়নশৈলী লিস্নারদের হৃদয় হরণ করে নিয়েছিল। সংগীতশিল্পী হিশেবে ক্যারিয়ারের শুরুতেই ঋতুর এই গানটা তাকে এনে দিয়েছিল বিপুল জনপ্রিয়তা।
না, খুব যে মারমার-কাটকাট জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি তা-ও নয়। নিজে সেভাবে প্রচারমুখা ছিলেন তো না-ই, ছিলেন বরং প্রচারবিমুখ। রবীন্দ্রসংগীতজগতের বিখ্যাত গানকেন্দ্রী যে-কয়টা বাড়ি আছে সেগুলোর মধ্যে গুহঠাকুরতাদের বাড়ি বা ফ্যামিলি একটি। ঋতু এই পরিবারেরই জাতক, গুহঠাকুরতাবাড়ির সন্তান। যদি আরও স্পষ্ট বলতে হয় তাহলে একটি মিউজিক ইন্সটিটিউশনের নাম উল্লেখ করতে হবে। একটা প্রতিষ্ঠান সকলেই চেনেন ‘দক্ষিণী’ নামে, ঋতুদের পরিবার থেকেই এইটা চালানো হয়। ঋতু দক্ষিণীর অন্যতম। ১৯৫৬ সালে তিনি দক্ষিণী থেকেই স্নাতক হন। দক্ষিণীতে তিনি শুভ গুহঠাকুরতা, সুনীল রায় প্রমুখ বিশিষ্ট সংগীতশিক্ষকদের কাছে গান শেখেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তার প্রথম অ্যালবামটি রিলিজ হয়।
ঋতু পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন জনপ্রিয় উপন্যাসকার বুদ্ধদেব গুহ-র সঙ্গে। বুদ্ধদেব গুহ নিজেও রবীন্দ্রসংগীতানুরাগী, শিখেছেন গান রীতিমতো সংগীতবিদ্যালয়ে যেয়ে, ক্যারিয়ার না করলেও বন্ধুজমায়েতে বুদ্ধদেব গুহ-র গলায় গান শুনতে ব্যগ্র অনুরাগীদের খবর আমরা পেয়েছি বিভিন্ন বইপত্রে-স্মৃতিকথায়। ঋতু-বুদ্ধদেব মুলাকাত হয় ঋতুদের দক্ষিণীতে বুদ্ধ যখন গানের তালিম নিতে অ্যাডমিশন নেন; পরবর্তীকালে এই দুইজনের বিবাহ হয়। দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন তাদের। ‘খেলা যখন’ উপন্যাসে এই জুটির প্রণয়কাহিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন বুদ্ধদেব স্বয়ং, যদিও তখন পর্যন্ত বুদ্ধ-ঋতু জুটিটি বাস্তবে এত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন নাই।
মিউজিকের অ্যাম্বিয়্যান্সেই ঋতু বড় হয়ে উঠেছেন। শুরুর পর্বে শিখেছেন আপন কাকা শুভ গুহঠাকুরতার কাছে এবং পরবর্তী পর্বে শান্তিনিকেতনে যেয়ে সুবিস্তারে তালিম নিয়েছেন গানের। সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের পরে যে-কয়জন নারী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী এসেছেন, ঋতু গুহ তাদের মধ্যে একজন। শুধু রবীন্দ্রনাথের গানই নয়, ঋতু গুহ সংগীতের একাধিক শাখায় নিজের আগ্রহ দেখিয়েছেন। হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক, টপ্পা ও অতুলপ্রসাদী গানে এই শিল্পীর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান, বিশেষত ধ্রুপদাঙ্গ ও ভাঙাগান ছিল তার বিশেষত্ব। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ শিল্পীরা ছিলেন ঋতুকণ্ঠের গুণমুগ্ধ।
‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে’ গানটা ছাড়াও ঋতুর কণ্ঠে এবং গায়নে বেশকিছু রবীন্দ্রগান চিরকালিক আবেদনে ভাস্বর হয়ে আছে। এর মধ্যে যেমন ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’, ‘কাল রাতের বেলা’, ‘বাজিল কাহার বীণা’, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ ইত্যাদি লিরিকগুলো ঋতু গুহের ইউনিক এক্সিলেন্স প্রমাণ করে। বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী (১৯৯৮), আপন ভিতর হতে (২০০৫) এবং ত্রিধারা (২০১০) ইত্যাদি অ্যালবামে ঋতু গুহ-র কাজ ধরা আছে। এখন তো ইউটিউবে অ্যাভেইলেবল সবই প্রায়।
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
- ছোট ছোট লেখাগুলো || যুথিকা ঋতু - June 11, 2025
COMMENTS