প্রাপ্তবয়স্ক বিষাদের আভা || আহমদ মিনহাজ

প্রাপ্তবয়স্ক বিষাদের আভা || আহমদ মিনহাজ

আমাদের বেড়ে ওঠার সময়কে যারা ভাষা দিয়েছিলেন তারা একে-একে বিদায় নিচ্ছেন। দ্রুত মুছে যাচ্ছে দৃশ্যপট, যাকে আমরা অজান্তে আলিঙ্গন করেছিলাম! কৈশোর থেকে যুবক হওয়ার কালপর্বে যে-সাবকালচার আমাদের শাহরিক সত্তায় ছাপ ফেলতে শুরু করে সেখানে আরো অনেকের সঙ্গে খালিদ ছিলেন। নাতিখাতি বেলা গেল আর আশির দশকে ভার্সিটিপড়ুয়াদের জীবনে বিখ্যাত সেশনজটকে গানের কলিতে ধারণের ফ্লেভার নিয়ে চাইম সরব ছিল আপাদমস্তক। আমাদের কৈশোরটা ছিল সাদাকালোয় মহীয়ান। শাহরিক সংস্কৃতির বাতাবরণকে যেখানে শাসন করতেন রুচির প্রশ্নে মোটের ওপর প্রবীণ হতে থাকা প্রজন্ম। উনাদের কিতাব পড়ার ধরন, গান শোনা বা সিনেমা দেখার অভ্যাসে মধ্যবিত্ত আচার আশ্রিত যে-জগৎ ছলকে উঠত তার সঙ্গে গ্রামীণ ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির মেরুদূরত্ব ছিল বৈকি। লোকায়তজনের সংস্কৃতিকে উনারা নিতেন নিজ রুচির মাপে কাটছাট করে। বৈশ্বিক সংস্কৃতির তরঙ্গটাও সেন্সরড হয়ে ঢুকত বৈঠকখানায়। যে-কারণে দেখব, গ্রামের পটভূমিতে বানানো এরকম প্রচুর ঢাকাই সিনেমা, যেখানে সংলাপ আঞ্চলিক ভাষার বদলে মানভাষায় ভর দিয়ে চলছে। আরোপিত সব মধ্যবিত্ত ব্যাপারস্যাপার শাসন করছে ছবির গতিপথ। পটভূমি গ্রামীণ বা লোকায়ত কিন্তু ওসবের বিক্ষেপ ছবিতে বিশেষ একটা খুঁজে পাওয়ার নয়। অভিনয়, দৃশ্যায়ন, সংলাপের সবটাই শাহরিক মধ্যবিত্ত ছাদে বাঁধাই করা। আবার নগরজীবনকে সাবজেক্ট ধরে বানানো ছবিতে মানভাষার বাইরে কথ্যবুলিকে স্পেস দিতে কার্পণ্য করেছে সেকালের ঢাকাই সিনেমা। সিনথেটিক যত কাজকারবার গোটা ষাট থেকে আশির দশক অবধি বাংলা সিনেমায় দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে সেখানে বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বআরোপিত রুচি ও জল্পনার বাড়বাড়ন্ত ছিল।

খালিদরা ঠিক এই জায়গায় ঘা দিয়েছিলেন। কলোনিয়াল হ্যাংওভার-র মতো আরবান সাবকালচার শব্দটি এখন ডালভাত। গানের কথা ও পরিবেশনায় ভাষার পরিধি অনেকখানি উন্মুক্ত। হয়তো বিশৃঙ্খলও। খালিদ কিংবা উনাদের পথপ্রদর্শক আজম খানরা যখন মধ্যবিত্ত শাহরিক সংস্কৃতিতে পপগানের হল্লা নিয়ে এলেন, আলাল ও দুলালের মেটাফোর দিয়ে ভাষাকে মুক্ত করতে নামলেন, তখন বিষয়গুলো আজকের মতো সহজ বোধগম্য ছিল না। নব্বই থেকে পরবর্তী এক-দেড় দশক যথেষ্ট খাটতে হয়েছে উনাদের। গান গাওয়ার পশ্চিমা বনেদে দাঁড়িয়ে নিজের শিকড়কে জড়ানো, মানভাষায় থেকেও তার কাঠামোয় নীরব ভাংচুর, লোকায়ত সংগীতে ব্যাপক আকারে বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের তরঙ্গ বহানো, রোমান্টিক ও স্যাড সঙ গাওয়ার ঢংয়ে নতুনত্ব, গলার স্কেলকে সেই অনুপাতে পালটে ফেলা … এ-রকম অনেকানেক এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে উনাদেরকে যেতে হয়েছিল। এগুলো নিয়ে বলার যোগ্য কেউ হয়তো গোটা জার্নিটাকে কলমে ভাষা দেবেন একদিন। চাইম এবং পরে সোলো হিসাবে খালিদের যাত্রাকে আশা করি লেখক জায়গা দেবেন সেখানে।

আমাদের বালেগ হওয়ার দিনকাল, দুই বাংলা জুড়ে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করতে থাকা আধুনিক বাংলা গানের অতিকায় সব স্তম্ভের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখার মতো ঘটনা ছিল তখনো। যদিও সময়ের পালাবদলকে সেখানে আভাসিত বলে টের পাওয়ার উপায় ছিল না। খালিদ গংদের কামিয়াবিটা এখানে;—উনারা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তরুণদের তালিয়া আর ময়মুরুব্বিদের গালি হজম করে ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি তারা। আমাদের জন্য ওটা ছিল উল্লম্ফন। কেন উল্লম্ফন সেটা ব্যাখ্যা করতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে। এই আলোচনা সময় নিয়ে কেউ-না-কেউ করেছেন অথবা অচিরে করবেন আশা করি। শর্টকাট যদি বলতে হয় তাহলে মধ্য-নব্বই, যখন বিটিভির জামানা চলছে, আনিসুল হকের হাতের ছোঁয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা জলসার রেফারেন্সটি দিতে হয়। নব্য ব্যান্ডবাজদের সঙ্গে বাংলা গানের স্বীকৃত ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন এমন সব গুণীজনকে স্টুডিওতে একত্রে বসিয়েছিলেন তিনি। ব্যান্ড নামে নতুন ধারার সাংগীতিক উৎপাতকে উনারা কোন চোখে দেখছেন সেটি জানার উদ্দেশ্য ছিল আয়োজনের লক্ষ্য। এক পক্ষ আরেক পক্ষের গানও গেয়েছিলেন। জলসার ওই বাহাস, খেয়াল করলাম, গানপার  পুরোটাই (ব্যান্ডবাজদের সাফাই সহ) বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে সাইটে তুলেছেন। পাঠক ইচ্ছে করলে সেটি চেখে দেখতে পারেন। রুচি ও সাংস্কৃতিক আন্তঃসংঘাতের একটা ধারণা পাবেন।

বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের প্রসার ঘটার মহেন্দ্রক্ষণে বিনিময়ের সংস্কৃতি বস্তুটি কেমন তার প্রারম্ভিক দলিল হিসবে জলসাকে গণ্য করা যেতে পারে। হ্যাটস অফ আনিসুল হক নওয়াজিশ আলী খান। এ-রকম একটি আয়োজনের কথা উনারা ভাবতে পেরেছিলেন। চরিত্র বিচারে জলসা বাহাস ছিল না, গানপার  যেটা বলার কোশেশ করেছেন, কিন্তু বাহাসের প্রারম্ভিকা তো অবশ্যই। পরে একে কেউ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেননি। কেন করেননি তার মধ্যে বাংলাদেশে সংগীতের বিবর্তন ও জনমনে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাত বিষয়ে আলাপে গমনের খামতিটা বেরিয়ে আসে। যেমন এই আলোচনা আজো প্রাসঙ্গিক হলো না, আজম খানদের হাত ধরে গানের নতুন ধারাটি বাংলাদেশে আমরা বা পরবর্তী প্রজন্মকে মোটের ওপর দখলে নিলো, সেটা সত্যিকার অর্থে কি রকগান হয়ে উঠতে পেরেছে শেষতক? নাকি বিবিধ কারণে তার যাত্রা একবিংশ শতকে এসে অন্যদিকে মোড় নিতে বাধ্য হয়েছিল? সংক্ষুব্ধ বাস্তবতা পশ্চিম গোলার্ধে রক-পপ-হিপহপে অভিনব সব পালাবদল ত্বরিত করেছিল। জনমনে একে অকাট্য সাবকালচার গণ্য করার ঘটনাটি ওই সুবাদে সেখানে ঘটেছে। বিচিত্র বিক্ষেপের মধ্য দিয়ে অবিরত নতুন মোড় নিয়েছে এই গান। এখনো নিচ্ছে। সেই তুলনায় বাংলা ব্যান্ড গানের গতিপথ কতটা যুগান্তকারী? তার অভিঘাত যুগসংবেদি ও অভিনব বলে বিবেচিত হতে পারে কি? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বাংলা ব্যান্ড গানের প্রভাব বিচারে জরুরি মনে হচ্ছে।

যা-ই হোক, খালিদের প্রসঙ্গে ফেরত যাই। বড়ো কথা, বিচিত্র গানের তরঙ্গে পরিপুষ্ট বাংলায় খালিদরা সেই তরঙ্গ নিয়ে এসেছিলেন যেটি শাহরিক পরিসরে সাবকালচার ব্যাপারটির সঙ্গে আমাদের সংযোগকে ঘনীভূত করছিল। আজকে উনাদের গান শ্রোতা সমবেত কিংবা একাকী শুনতে ও ফিল করতে পারে। সরলতার প্রতিমা, যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে, যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে, কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে-র মতো গানগুলোয় খালিদ আইকনিক। কন্সার্টে কিংবা একান্ত নিরালায়…উভয় পরিসরে শ্রোতা এই গানগুলোর দেহে মর্মরিত বিষাদ ফিল করতে পারে। তার কানে গভীর হয়েই ঢোকে খালিদের গায়কি। ইমোশনকে তীব্র করতে ত্রুটি করে না।

সময়ের তুরন্ত পালাবদলকে খালিদও কি তাহলে সাদি মহম্মদের মতো মুঠোয় ধরতে নাকাল বোধ করছিলেন? তাঁর প্রায় দশক লম্বা নীরবতা, একাকিত্ব যাপন প্রশ্নটি মনে জাগায়। বব ডিলানের কথাই হয়তো সত্য, সময় শিল্পীকে দিয়ে একবার যেটা করিয়ে নেয় সেখানে ফিরে-ফিরে নতুন তরঙ্গ নিয়ে আসাটা তার জন্য সহজ নয়। এক বাতচিতে ডিলান বলেছিলেন, তাঁর পক্ষে চাইলেও সেই গানগুলো আর লেখা, গাওয়া সম্ভব নয় যেগুলো ষাট-সত্তরের সময়টানে তিনি অনায়াস পারতেন। জাদুকরি সময়, তাঁর ভাষায় ম্যাজিক মোমেন্ট, তাঁকে দিয়ে গানগুলো লিখিয়ে নিয়েছিল। এখন সেই রোমাঞ্চ নেই। দ্য থ্রিল হ্যাজ গন। ওটাকে ফেরত আনা নামুনকিন। খালিদের ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে পড়াটা এ-রকম কোনো কারণফেরে ঘটলেও ঘটতে পারে। সকল শিল্পের ক্ষেত্রে যারপরনাই বব ডিলানের গানের কলিতে মর্মরিত সত্য অমোঘ হয়ে কানে বাজে : The order is rapidly fadin’ / And the first one now / Will later be last / For the times they are a-changin’. তথাপি, খালিদ আপনাকে কৃতজ্ঞতা;—আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়কে বিষাদের নতুন আভায় মেদুর করে তুলেছিলেন আপনি। যদিও কখনোই জানা হবে না, কেন এতটা দুখী ছিল আপনার কণ্ঠ? কী কারণে এই বিষাদে নিমজ্জন? কেনই-বা কখনো বের হতে চাইলেন না সে-বৃত্ত ছেড়ে অন্য কোনোখানে!


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
ট্রিবিউট টু খালিদ

COMMENTS

error: