[ট্র্যানস্ক্রিপ্ট ফর্মে এই ভিশ্যুয়্যাল ম্যাটেরিয়্যালটা গানপারে আপ্ করবার প্ল্যান হচ্ছিল অনেকদিন আগে থেকেই। ইন-ফ্যাক্ট, ২০১৭ মে মাসের গোড়ায় এইটা আপ্লোড করার তোড়জোড় সত্ত্বেও প্রতিলিপিকালে বেশকিছু অনিবার্য কারণে ব্যাহত হচ্ছিল ট্র্যানস্ক্রিপ্টক্রিয়ার গতি। কারণগুলো প্রতিলিপিকার গানপারদলের অত্যন্ত ব্যক্তিগত, অত্যন্ত অমোঘ, অত্যন্ত প্রাকৃতিক। অনেকটা স্থবির হয়েই ছিল পড়ে এর দশা। আনিসুল হক ইন্তেকালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সেই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা গেল।
‘জলসা’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে অন্-এয়ার হয়েছিল ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের অব্যবহিত পরে। এরপরে এই অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচার হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। আর তখন পৌনপুনিক সম্প্রচারের সংস্কৃতি ছিল না আজকের মতো। গণমাধ্যম বলতেই ছিল সবেধন নীলমণি বিটিভি এবং সেইসঙ্গে নিউজপ্রিন্ট কয়েকটা কাগুজে ডেইলি। মিডিয়ার এই মোচ্ছবকালে কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না যে এত অল্প সম্পদ-সুবিধা সত্ত্বেও আইডিয়ার দিক থেকে সেই কৃশকায় রিসোর্সের দিনগুলো উজ্জ্বলতরই ছিল আজকের বলদ ভুঁড়িয়াল মিডিয়াতিশয্যের তুলনায়। কিছুটা সাক্ষ্য হয়তো লভ্য ‘জলসা’ ট্র্যানস্ক্রিপ্ট থেকে। এবং ইউটিউবে ইদানীং এইটার ভিডিও পাওয়া যায়, গানপারে সেই ভিডিও সংযুক্তি হিশেবে রইল, দেখে নিতে পারেন যদি পাঠে মন না বসে।
যে-ব্যাপারটা লক্ষণীয়, জলসার আদলে এর পরে এমন একটাও উদাহরণ সম্ভবত চয়ন করা যাবে না যেখানে একটা বাহাস হচ্ছে এভাবে। এখন যদিও রোজ রাতে গানের বাহারী স্টুডিয়োলাইভ টাইপের অনুষ্ঠান হচ্ছে দেদার, ডজন-দুইয়েরও অধিক টিভিচ্যানেল, জলসার স্মৃতি ম্লান-করিয়ে-দেয়া তো হনুজ দূর ধারকাছ দিয়াও কোনো অনুষ্ঠান নির্মাণে কেউরে ব্রতীট্রতি হইতে দেখলাম না। তা, গানের মানুষদের কথাবার্তায় এখন যদিও বোকাবাকশো ভরা আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায়, কিন্তু সেইসব সমস্তটুকু সংগীত-ব্যতীত দুনিয়ার যত পয়মালি নিয়া বাচালতা। আর এইভাবে জলসার কায়দায় একটা কার্পেটে ফ্ল্যাট বসে সেটের আতিশয্যহীন অনুষ্ঠান কই পাবেন এখন? মুটকো-বপু সোফার আড়ম্বর আর বক্তার মুখ দেখার আগেই নজর যায় ইয়া-জাম্বু কফিমগের সাইজের দিকে। আর বাহাস? যদি কালেভদ্রে কাউরে বলতেও দেখেন কথা দুইচাইরটা, পাণ্ডিত্যের বোঁটকা গন্ধে কিংবা রক্ আর মেটালের মফিজগিরির তজল্লায় পর্দা ছেড়ে পালাতে হয় অচিরাৎ।
‘জলসা’ নামীয় অনুষ্ঠানটার ইম্প্যাক্ট কেউ যদি স্টাডি করেন, তো দেখবেন যে ব্যাপক। তৎকালে পরস্পরবিরোধী ফিৎনায় ব্যান্ডসংগীতকে একেবারে কোণঠাসা রাখা হয়েছিল প্রথানুবর্তী মিউজিকের পাশে। সেকেলে ডেইলি নিউজপেপার বা অ্যাকাডেমিয়ায় এমনকি তারুণ্যের স্পর্ধাস্পন্দের প্রতীক হিশেবে মশহুর কথিত লিটলম্যাগাজিন ইত্যাদি কোথাও ব্যান্ডসংগীতের পক্ষে প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে দিয়েছে কেউ এমন হয় নাই। মেইনস্ট্রিম মোড়লদের হাতে অপদস্ত হচ্ছিল প্রতিনিয়ত তরুণ রক্তমজ্জার নয়া গানবাজনার উন্মুখর উদ্দীপনা। আনিসুল হক উপস্থাপিত ‘জলসা’ অনুষ্ঠানটা ব্যান্ড-ননব্যান্ড দুইটা ধারার বিভিন্ন বয়সী শিল্পীদের এককার্পেটে বসিয়েছিল এবং কথা কইয়ে নিয়েছিল ওইবারই পয়লা আর ওইবারই আখেরি। ওই একবারই। এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায়নাকো আর। ভাবতে অবাক লাগে, কেন পায় না। আজও তো প্রথানুবর্তনের বাইরে যেয়ে গানগাওয়া ব্যাহত হয় পদে পদে। কিন্তু কথাগুলো উঠাইবার যুতসই জমিজিরাত আমরা আজও করে নিতে পারলাম কই!
ভীষণ বড়মুখ করে যেইটাকে আমরা বলি কালচারাল এক্সচেঞ্জ, জলসা সেই বিনিময়ের কাজটা করতে পেরেছিল ওই টাইমে। জেনারেশন গ্যাপটাকে সাক্সেসফ্যুলি আইডেন্টিফাই করেছে, একটা অন্বয়ের রাস্তাও দর্শিয়েছে। তেইশ-চব্বিশ বছর আগের ঘটনা। আজ ইতিহাস। অন্তত অনেককে এমন পাওয়া যাবে যাদের জিন্দেগি-বন্দেগিতে এই অনুষ্ঠান একটা ছাপ রেখে গেছিল সুস্থায়ী যা তাদের পরবর্তী জীবনে হেল্পফ্যুল্ হয়েছে। এমন কিছু মহাডিস্কোর্স তো হয় নাই, নিছক সকলের জানা কিছু কথাই কিন্তু অনুষ্ঠানে হয়েছে। সেইটাই ভীষণ একটা ভাইব্ তৈয়ার করেছিল তৎকালিক তরুণদের দেহমনে। যেন জন্মের স্বীকৃতি। অ্যাট-লিস্ট দুই শিবিরের একতাঁবুতে সমানে-সমান সহাবস্থানের একটা হাজির নজির এই অনুষ্ঠান।
গাহি জলসার জয়গান। যদিও তর্ক-প্রতর্কের নামে এখন বাংলা মাতোয়ারা, খাড়া-বেইমানে আর শয্যাশায়ী-ইমানদারে মিলে এখন বাংলার নৌকা পাহাড় বাওয়ায় দিনে তেইশবার। কিন্তু জলসা কই? ইয়াদ রাখবেন জলসা বলতে কেবল আনিসুল হকের অ্যাঙ্কর-করা এই অনুষ্ঠানকেই বোঝানো হচ্ছে না, বাংলায় এই কিছুদিন আগেও জলসা মানে একটা কালচারাল ফেনোমেনা জানতাম, জলসায় একটাকিছু বড় স্বার্থে পরস্পরবিরোধী বহু তরফের লোকেরা একত্র হতো। ওয়াজ ম্যেহফিলের জলসা, উরসের জলসা, গানের জলসা, মার্গীয় সংগীতের জলসা, মালজোড়া বা আলকাপের বা কবিগানের জলসা। সেইসব জলসায় যা হতো, প্রযুক্তিস্ফীত জমানায় এসে এখন এই-যে এত কুতুবগিরি করে লজিক-অ্যান্টিলজিকের ঘণ্টি বাজাইয়া আগের কালের সেই জলসার একগাছি হিন্দিচুলও প্রোডিউস করতে পারছি কি? নিজেরে জিগাই, রিপ্লাই মেলে না। — গানপার]
জলসা
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা : আনিসুল হক
প্রযোজনা : নওয়াজীশ আলী খান
প্রচারকাল : ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪
প্রচারমিডিয়া : বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা
গানপার ট্র্যানস্ক্রিপ্ট : ডিসেম্বর ২০১৭
আনিসুল হক : স্লামালিকুম দর্শকমণ্ডলী! আজকে আমরা এখানে একটি গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। জলসা। এ-অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করছেন তাদের প্রত্যেকেই আপনাদের পরিচিত এবং প্রিয় বলেই আমার বিশ্বাস।
আজকের এই অনুষ্ঠানের একটু ভিন্নতা রয়েছে। অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যের যে-ভিন্নতা, আমরা যতই অনুষ্ঠানের মাঝে এগিয়ে যাব, সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর অংশগ্রহণেও একটু ভিন্নতা রয়েছে। আজকে এখানে যারা বসে আছেন আমার সামনে, যারা শিল্পী, এবং যারা শিল্পী ছাড়াও বসে আছেন, তারা প্রায় প্রত্যেকে এ-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের স্বামী অথবা স্ত্রী। আমরা শুরু করব অনুষ্ঠান নকিবের গান দিয়ে।
নকিব খান, আপনারা জানেন, রেনেসাঁর গান গা’ন। ‘রেনেসাঁ’ শিল্পীগোষ্ঠীর। জীবনে কখনো বোধহয় রবীন্দ্রসংগীত গাননি। আমরা আজকে তার কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীত শুনব। এবং তারপর সাদিয়া আফরিন মল্লিক, আমি জানি না উনি কখনো ব্যান্ডের গান গেয়েছেন কি না। তো, উনি ‘মাইলস’ ব্যান্ডগ্রুপের একটি গান গাইবেন। তারপর আমরা এই অনুষ্ঠানের কথায় ফিরে আসব। শুরু হোক গান। … নকিব খান।
[নকিব খান গাইছেন —]
ভালোবেসে, সখি, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি
তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
মনে করে, সখি, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী
তোমার কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো
তোমার অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো
তোমার ললাটচন্দনে॥
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো
তোমার অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো
তোমার অতুল গৌরবে॥
(কথা, সুর ও সংগীত : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
[সাদিয়া আফরিন মল্লিক গাইছেন —]
প্রথম প্রেমের মতো
প্রথম কবিতা এসে বলে
হাত ধরে নিয়ে চলো
অনেক দূরের দেশে
কত পথ প্রান্তর ঘুরে ফিরেছি
পাই না তো আজো তোমায়
সেই পথচলা শেষ হলে
কাছে এসে যেও বলে
এই তো আমি … এই তো আমি …
তোমারি আশায় বসে থেকেছি
নাম ধরে ডাক দিলে কে গো তুমি
ফিরে এলে আজ কাছে
ভালোবাসা যত আছে
দিলাম তুলে … দিলাম তুলে …
(মাইলসের গান। সামগ্রিক কম্পোজিশন : মাইলস)
আনিসুল হক : আমি বলেছিলাম, এ অনুষ্ঠানে আমরা কিছু গান গাইব, কিছু কথা শুনব। কথা শোনার জন্যে, কথা শোনানোর জন্যে, আমরা যাদেরকে এই, শিল্পী আমরা যারা আছি, তাদের বাইরে থেকেও যাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, আমাদের শ্রদ্ধেয় গুণীজন, বাঁপাশ থেকে বসে আছেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, জনাব মোস্তফা মনোয়ার, জনাব কলিম শরাফী, — যিনি একটি ব্যান্ডের গান গেয়েছেন, পরে শুনব, — এবং জনাব খাত আতাউর রহমান। তো, আজকে কিছু কথাবলার পালা শুরু হোক।
নকিবকে আপনারা দেখলেন রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন। নকিব কি আগে গেয়েছেন কি না কখনো, আমি জানি না, টেলিভিশনে আগে গেয়েছেন নাকি কখনো?
নকিব খান : না, আমি কখনো গাইনি।
আনিসুল হক : কি মনে হচ্ছে আপনার? ভিতরে কোনো …
নকিব খান : আমার সামনে আমার শ্রদ্ধেয় বন্যাআপা, শ্রদ্ধেয় কলিমভাই বসে আছেন। আমার কিন্তু অনেক পরীক্ষা দিতে হয়েছে এবং আমি জানি না পরীক্ষায় পাশ করেছি কি না, উনারা বলবেন …
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা : অবশ্যই, শুধু পাশ না, খুব ভালো গেয়েছে, আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে যে রবীন্দ্রসংগীতে একটি বিশেষ গায়কী আছে, তো আজকে নকিব প্রমাণ করল যে, ও-রকম কোনো বিশেষ গায়কী নেই। ও যখন গাইছিল, মানে, মনে হয়েছিল যে, ও সবসময় রবীন্দ্রসংগীতই গায়, এবং রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া ওর পক্ষে এমনকিছু জটিল ব্যাপার ছিল না।
আনিসুল হক : আপনারা দেখেছেন, সাদিয়া আফরিন মল্লিক গেয়েছেন ‘প্রথম প্রেমের মতো’। আমার মনে হচ্ছিল উনি প্রথম প্রেমের স্মৃতিতে বোধহয় হারিয়েই গেছেন। তো, আমি জানি না, উনার কি অনুভূতি।
সাদিয়া আফরিন মল্লিক : আসলে আনিসভাই, যে-গানটা করলাম, ‘প্রথম প্রেমের মতো’, এটা ‘মাইলস’-এর একটা আলোড়ন-সৃষ্টিকারী গান বলা যায়। কখনো স্মৃতি থেকে বা কিছু সেটা না, গানটা আমার সত্যিই পছন্দ হয়েছে।
আনিসুল হক : আমি প্রথম প্রশ্ন করব, ‘মাইলস’-র শাফিনকে। শাফিন, আপনারা নিজেদের ব্যান্ডগোষ্ঠী আখ্যা দিয়ে, ব্যান্ডের গান গেয়ে, নিজেদের একটু ভিন্নমাত্রায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন বা প্রতিষ্ঠিত করেছেন ব্যান্ডগোষ্ঠীকে। তো, ব্যান্ডগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য কি? আপনারা অন্যদের চেয়ে কেন আলাদা?
শাফিন আহমেদ : আলাদা এই কারণেই যে, আমার মনে হয়, ব্যান্ডে যারা পার্টিসিপেইট করে, তারা একটা গান তৈরি করতে যা যা এলিমেন্টস দরকার তার সবগুলোতে ডায়রেক্টলি ইনভল্বড থাকে। অর্থাৎ কম্পোজিশন, গানের অ্যারেঞ্জমেন্ট, গানের কথা লেখা, লেখার ব্যাপারে যথেষ্ট ইনভল্বড থাকে, অনেকেই নিজেরা লেখে। এবং বাইরের গীতিকার ব্যবহার করলেও সেখানে প্রতিটা ব্যান্ডের কন্ট্রিবিউশন যথেষ্ট থাকে। এবং সর্বোপরি ইন্সট্রুমেন্টগুলো বাজানো — এর প্রত্যেক ক্ষেত্রে এবং গান গাওয়া, প্রত্যেক ক্ষেত্রে ব্যান্ডের চারজন মেম্বার বা পাঁচজন মেম্বার সবাই ইকুয়্যালি পার্টিসিপেইট করে।
আনিসুল হক : হামিন, এদেশে ব্যান্ডসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন আজম খান। আমরা সবাই স্বীকার করি। উনি উনাদের গোষ্ঠীর নাম দিয়েছিলেন ‘উচ্চারণ’। আজকে আমরা দেখি প্রায় সব গোষ্ঠীরই নাম ইংরেজিতে। মাইলস, ফিডব্যাক, রেনেসাঁ, সোলস, লাইম্স — কেন? বাংলায় নয় কেন? আক্রোশ নয় কেন, প্রত্যাবর্তন নয় কেন, জাগরণ নয় কেন?
হামিন আহমেদ : এই ব্যাপারে আমার যেটা ধারণা সেটা হচ্ছে, আমাদের ক্ষেত্রে, মাইলসের কথা যদি বলা হয় তাহলে, সম্ভবত ব্যবহারের দিক থেকে মাইলসের ইংরেজি এবং বাংলার ব্যবহারটা একই। যা-ই হোক, অন্যান্য ব্যান্ডের যে নামকরণ আছে, সেটা আমার মনে হয়, আমরা ভাষাটাকে ঠিক মুখ্য করে দেখতে চাই না।
আনিসুল হক : (রেনেসাঁ-কে উদ্দেশ্য করে) বাংলা নাম নয় কেন?
পিলু খান : আমাদের নাম তো অ্যাকচুয়্যালি বাংলায়ই আছে, রেনেসাঁ। যদিও অরিজিন্যালি ফরাশি শব্দ। এখন বাংলাতে একই মিনিং হয় আর-কি।
আনিসুল হক : ফিডব্যাক?
মাকসুদুল হক : যখন আমাদের গোষ্ঠী ১৯ বছর আগে তৈরি হয়, তখন আমরা ভেবেছিলাম শুধুমাত্র ইংরেজি গান গা’ব, এবং কিছু বিশিষ্ট জায়গায়, যেমন কিছু হোটেলে আমরা ইংরেজি গান পরিবেশন করতাম। পরে সেই ’৮৭ থেকেই আমরা একটু দুঃসাহস করছি বাংলা গান করার। তাই ইংরেজি নামটাই থেকে গেল।
আনিসুল হক : উনাদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ আছে, যেমন উনারা তরুণদের উচ্ছৃঙ্খল করার, মানে তরুণরা উচ্ছৃঙ্খল হবার একটা প্রয়াস পায় উনাদের গান শুনে। সাধনাবিহীন গান গা’ন ওরা, যন্ত্রনির্ভর গান গা’ন, বিদেশের অনুকরণে পুষ্ট গান গা’ন, এবং বাণিজ্যিক গান গা’ন। এই প্রশ্নে আমরা ফিরে যাব। আমাদের পাশে গুণীজনরা আছেন, তারা তার উপর কথা বলবেন এবং আমরা আমাদের যে ঐতিহ্যগত সংগীত, আমাদের যে সংস্কৃতির পরিমণ্ডল সেটি নিয়েও কথা বলব। তার আগে দুইটি গান।
[পার্থ বড়ুয়া গাইছেন —]
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই
সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।।
সে যে দিনদুপুরে চুরি করে
রাত্তিরে তো কথা নাই।
ডাকাতিয়া বাঁশি
শ্রবণে বিষ ঢালে শুধু বাঁশি পোড়ায় এ প্রাণ গরলে
ঘুচাব তার নষ্টামি আজ আমি
সঁপিব তায় অনলে।।
সে যে দিনদুপুরে চুরি করে
রাত্তিরে তো কথা নাই।
ডাকাতিয়া বাঁশি
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।
বাঁশেতে ঘুণ ধরে যদি কেন বাঁশিতে ঘুণ ধরে না
কতজনায় মরে শুধু পোড়া বাঁশি কেন মরে না।।
চোরা দিনদুপুরে চুরি করে
রাত্তিরে তো কথা নাই।
ডাকাতিয়া বাঁশি
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।
সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে
রাত্তিরে তো কথা নাই।
ডাকাতিয়া বাঁশি
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।
(কথা : মীরা দেব বর্মণ । সুর : শচীন দেব বর্মণ)
[রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন —]
এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে
অজানা হাজার কত কাজের ভিড়ে
ছোট্টবেলার শত রঙ-করা মুখ
সুর তোলে আজও এই মনকে ঘিরে।
ঝিনুক-শামুকে ভরা বালুচরে
ঢেউয়ের সাথে নেচেছি
রঙিন স্বপ্নে গাঁথা স্মৃতির মালা
সৈকতে ফেলে এসেছি।
ওরে ছুটে চল সেই সাগরতীরে
ওরে খুঁজে নেই চল ফেলে-আসা মুক্তোহীরে।
এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে…।।
রাত্রিতে জোছনায় দাওয়ায় বসে
মজার গল্প কত শুনেছি,
ঢুলো-ঢুলো আঁখিতে আবির মেখে
স্বপ্নের জাল বুনেছি।
ওরে সেই তো ভালো চোখ দুটো বুঁজে ছিলে
ওরে সেই তো ভালো সবকিছু ভুলে ছিলে।
এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে…।।
(সোলসের গান । কথা : আব্দুল্লাহ আল মামুন । সুর : নকীব খান)
আনিসুল হক : পার্থ, আপনি একটু আগেই, বন্যার আগে আপনি, গান গেয়েছেন। শচীন দেব বর্মণের গান গাইতে যেয়ে আপনার কি ভয়টয় লেগেছিল?
পার্থ বড়ুয়া : শচীনকর্তার সমস্ত গানই আমি শুনেছি, তবে গাইতে গিয়ে প্রথমে খুব নার্ভাস ছিলাম, ভাবছিলাম যে কেমন হবে গানটা। তবে প্রিপারেশন নিয়েছিলাম ভালো, এখন কতটুকু ভালো হয়েছে …
আনিসুল হক : … সেটা ওরা বলবেন।
পার্থ বড়ুয়া : হ্যাঁ।
আনিসুল হক : তাহলে আমি ওদের কাছেই ফিরে যাই। খান আতাউর রহমান, শচীন দেব বর্মণের যে-গান পার্থ গাইলো, আপনি কিছু বলবেন?
খান আতাউর রহমান : আমি ওর গান শুনে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি, আমার এবং এমনকি শচীনকর্তার খোঁচখাঁচগুলো পর্যন্ত নকল এত সুন্দর করেছে ছেলেটি, কে বলে যে এই ব্যান্ডের ছেলেরা আমাদের দেশি গান গাইতে পারে না?
আনিসুল হক : জনাব মোস্তফা মনোয়ার বন্যার গানের উপর বলবেন।
মোস্তফা মনোয়ার : গানটি অত্যন্ত সুন্দরভাবেই গেয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তিনি সাধারণ আধুনিক গান যে-রকম করে গা’ন, তেমনভাবেই গেয়েছেন, কিন্তু ব্যান্ডমিউজিকে তো অনেক বেশি হৈহুল্লোড় না হলে ভালো লাগে না। ব্যান্ডমিউজিক হয় না। কারণ আমাদের দেশে তো দু-রকমই গান আছে। একটা হলো কান দিয়ে শোনা, আরেকটা হলো চোখ দিয়ে শোনা। তো, ব্যান্ডমিউজিকের গুরুত্ব এবং প্রাধান্য এবং ভালোলাগা এই কারণেই যে চোখ দিয়েও শোনা যায়।
আনিসুল হক : আপনারা কাদেরকে আপনাদের শ্রোতা ভাবেন? কাদের জন্যে আপনারা গান গা’ন?
মাকসুদুল হক : আমরা সবার জন্যই গান গাই। তো আমরা মোটামুটি পনরো থেকে ত্রিশ, ত্রিশোর্ধ্ব, এখন আমরা আমাদের যে দর্শকদের কাছ থেকে চিঠি পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে মানে আমাদের বয়সীও অনেকে আমাদের গান শুনছে। আমার বন্ধুবান্ধবরা আমার গান শোনে না।
আনিসুল হক : কিন্তু আপনারা বলছেন যে আপনার সবার জন্যেই গান গা’ন।
মাকসুদুল হক : আমরা সবার জন্য চেষ্টা করছি। সবার জন্য গান করার চেষ্টা করছি।
আনিসুল হক : আচ্ছা, আপনি একটি গান গেয়েছেন, আপনাদের দল ‘মেলায় যাই রে’, যেটি আপনাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান, ও-গানে আপনি বলেছেন যে ললনারা বাসন্তীরঙ শাড়ি পরে যায়, সুগন্ধি মেখে তরুণরা যায়, ললনারা থাকতে পারে না। এই গানটি আপনি কাদের জন্যে লিখেছেন? সবার জন্যে?
মাকসুদুল হক : এটা আমি সবার জন্য গেয়েছি, কেননা এইটা তো আমার মনে হয় কোনো মিথ্যা কথা বলিনি।
আনিসুল হক : না, আমার গ্রামে কোনো ললনা বাসন্তীরঙ শাড়ি পরে মেলায় যায় না, কোনো তরুণ সুগন্ধি গায়ে মেখে …
মাকসুদুল হক : না, দুর্ভাগ্যবশত আনিসভাই এখানে একটা মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে, মূল কথা হচ্ছে, আমরা মেলার, মেলাটাই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এবং দুঃখজনক এইখানেই যে, আমি তো শহুরে লোক, আমি শহরে থেকে, ঢাকা শহরের এই মেলা, যেটা আপনি, আপনার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি না, আমাদের ঢাকা শহরে যে-রকম একটা গ্রামীণ মেলার চেষ্টা করা হয়, আমি সেটাকেই কটাক্ষ করার চেষ্টা করেছি। আমি কিন্তু বলিনি বিদেশি সুগন্ধি মেখে …
আনিসুল হক : আপনি তাহলে বটতলার মেলার গান গেয়েছেন …
মাকসুদুল হক : হ্যাঁ, আমাদের ঢাকা শহরের বটতলায় যা যেগুলো হচ্ছে …
আনিসুল হক : হামিন, আপনারাও তো বোধহয় সবার জন্যেই গান গা’ন।
হামিন আহমেদ : জ্বি, চেষ্টা করি।
আনিসুল হক : আপনাদের একটি গান আমার মনে পড়ে, ঐ যে ‘রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টিতে’, সুর তুলবেন গিটার ছিঁড়ে গেছে, গিটারের তার, আপনারা একটা জায়গায় বলেন, ‘ও বেইব’! ‘ও বেইব’-টা কে? আমি তো দেখি না গ্রামের কোনো তরুণ অথবা গ্রামের কোনো কৃষক বাড়িতে যেয়ে বলে, ‘ও বেইব’! আমরাও বোধহয় খুব একটা বলি না। এই ‘ও বেইব’-টা কে, কাদেরকে আপনারা বলছেন?
হামিন আহমেদ : না, এটা, সবার কথা যদি ধরি তাহলে, অনেক ইংরেজি শব্দ যেটা আমরা সাধারণত কথায় ব্যবহার করি, যেটা গ্রামে অবশ্যই বলে না। সেটা নিশ্চয় আপনি স্বীকার করবেন। এই ক্ষেত্রে যেটা যেজন্যে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা আমার মনে হয় যে শহরে বা যারা ব্যান্ডের গান শোনেন তারা, তাদের মধ্যে এই ইংরেজি ভাষার প্রচলনটা আছেই।
আনিসুল হক : মানে যারা শুধু ব্যান্ডের গান শোনেন এরা কি অনেকেই ‘ও বেইব’ বলেন?
হামিন আহমেদ : না। ‘ও বেইব’ একটা ইংরেজি শব্দ, যেটার প্রচলন তরুণদের মধ্যে অবশ্যই আছে।
আনিসুল হক : আচ্ছা, যা-ই হোক, উনাদের বিরুদ্ধে আরো … আমরা আবার ফিরে আসব। এই ঝগড়ায় আবার ফিরে আসব। তার আগে দুটো গান শুনি।
[সুবীর নন্দী গাইছেন —]
চোখজলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে বালিশের উপর
শুয়ে কাটছে অনেক রাত
ধন্যবাদ হে ভালোবাসা
ধন্যবাদ এই দুঃখ দেয়া।
সুখে থেকো তুমি বলেছিলে
সুখেই আছি সবাই বলে
ঠোঁট-মুখে হাসি লেগে আছে
অন্তর কাঁদে কেউ না জানে।
পুরনো চিঠি পড়তে বসে
আজো মনে সন্দেহ জাগে
আদৌ কি ভালোবেসেছিলে
নাকি ছিল এ ছলনা অবলীলাক্রমে?
চলে গেলে অশান্ত সাগরে
জীর্ণ ভেলায় যাও তুমি অনিশ্চিতে
ভেসে যাও নেই কোনো আশ্রয়
ভেসে যাও নেই কোনো পিছুটানের সংশয়
আমি স্বর্গহীন পৃথিবী আঁকড়ে রবো
ভরাডুবির আশঙ্কাতে।
নিথর রাতে মিটমিটে জোনাকির আলো দেখে
জ্বলছে-নিভছে মনের আশা
ধন্যবাদ হে ভালোবাসা
ধন্যবাদ হে রসিকতা।
বিদায়বিহনে বলেছিলে
কষ্ট পেলে তুমি দুঃখ পাবে
পরাজয়ের এ জীবন আমার
এতটুকু তো মেনেই নেবে।
প্রেমের প্রলাপে প্রলেপ মেখে
বিলীন করলে মিথ্যাচারে
ধন্যবাদ হে ভালোবাসা
ধন্যবাদ হে মনভাঙা।
ঘৃণার কথা বলেছিলে
ঘৃণায় আমার জীবন চলে
ঘৃণাতে ভালোবাসা লাগে
এই সত্য কথা কেউ না মানে।
ভেসে যাও নেই কোনো প্রাপ্তি
ভেসে যাও নেই কোনো অকারণে শাস্তি
আমি সত্যহীন পৃথিবী আঁকড়ে রবো
চোরাবালির নিমজ্জনে।
যাও গো তুমি স্বপ্নকূলে
স্বপ্নভাঙার স্বপ্ন দেখে
দুঃস্বপ্ন ন-হয় আমি ভেবে
সান্ত্বনা দেবো অবুঝ মনে
চোখজলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে বালিশের উপর
শুয়ে কাটছে অনেক রাত
ধন্যবাদ হে ভালোবাসা
স্বাগতম, হে নিঃসঙ্গতা!
(ফিডব্যাকের গান । কথা : মাকসুদুল হক ।
[শাকিলা জাফর গাইছেন —]
খোলো খোলো খোলো গো দুয়ার
নীল ছাপিয়া এল চাঁদের জোয়ার।।
সঙ্কেত-বাঁশরি বনে বনে বাজে
মনে মনে বাজে।
সজিয়াছে ধরণী অভিসার-সাজে।
নাগরদোলায় দুলে সাগর-পাথার।।
জেগে ওঠে কাননে ডেকে ওঠে পাখি
চোখ গেল, চোখ গেল, চোখ গেল!
অসহ রূপের দাহে ঝলসি’ গেল আঁখি
চোখ গেল, চোখ গেল, চোখ গেল!
ঘুমন্ত যৌবন, তনুমন, জাগো!
সুন্দরী, সুন্দর-পরশন মাগো।
চল বিরহিণী অভিসারে বঁধুয়ার।।
(কাজী নজরুল ইসলামের গান)
আনিসুল হক : শাকিলা। শাকিলা, আপনি অনেকদিন থেকেই উচ্চাঙ্গসংগীতে সাধনা করেছেন, আমরা যদ্দুর জানি …
শাকিলা জাফর : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি চর্চা করছি এখনো পর্যন্ত …
আনিসুল হক : তাহলে আপনি কোনো বিশেষ ধারার সংগীতকে বেছে নেননি কেন?
শাকিলা জাফর : অ্যাকচুয়্যালি আমি বেছে নিয়েছি বলাটা ঠিক হবে না, আমি সবসময় নজরুলগীতি বা ক্লাসিক্যাল করে থাকি বেতারে, টেলিভিশনে যদি আমি সুযোগ পাই অবশ্যই করব। যেমন আজকে এখানে সুযোগ পেলাম। আজকে আমি নজরুলগীতি গাইলাম এবং আমার খুব ভালো লাগল গাইতে। আমি চেষ্টা করেছি অবশ্যই ভালোভাবে গাইবার এবং বিচার করবেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শ্রোতামণ্ডলী যারা আছেন তারা।
আনিসুল হক : আমরা যদি বলি শুধুই জনপ্রিয়তার মোহে আপনি আধুনিক গান গান?
শাকিলা জাফর : তাহলে তো আমি বলব যে, নীলাআপা, বন্যাআপা, বা সাদিয়াআপা, সুবীরদা … ইনারাও তো একটা পার্টিকুলার সাবজেক্টকে বেছে নিয়েছেন। যেমন নীলাআপা নীলাআপার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়, বন্যাআপা বন্যাআপার ক্ষেত্রে, সাদিয়াআপা সাদিয়াআপার ক্ষেত্রে। মানে, নজরুলগীতি-রবীন্দ্রসংগীত, যারা ব্যান্ডসংগীত করছে তারা তাদের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়, সেক্ষেত্রে আমি আধুনিক গানকে বেছে নেওয়াটা কি কোনো দোষের হলো?
আনিসুল হক : আমি দোষের বলিনি, বলছি যে, শুধুই জনপ্রিয়তার মোহে কি না?
শাকিলা জাফর : না না, সেটা ঠিক না।
আনিসুল হক : আমি কিছু অভিযোগের কথা বলছিলাম। যেমন বলা হয় আজকাল, ব্যান্ডসংগীত কারা গান? বিত্তবান বাবার বিত্তবান তরুণ কিছু ইন্সট্রুমেন্ট কিনে, একটি সংগীতগোষ্ঠী গঠন করে, গান গাইতে নেমে যান। ওদের যেসব আসর হয় সেখানে উদ্দাম তরুণরা আসে, উচ্ছৃঙ্খলতার প্রশ্রয় আছে। ওরা বিদেশি সুরে পরিপুষ্ট হয়ে গান গা’ন। গলার চেয়ে যন্ত্রের প্রাধান্য বেশি থাকে। এবং এ-ও বলা হয়ে থাকে যে, আজকের শুধুই আজকের সমাজের আবেদন, বাণিজ্যিক আবেদনে এই ব্যান্ডগোষ্ঠী গান গা’ন।
হামিন আহমেদ : এখানে উচ্চবিত্ত হোক বা মধ্যবিত্ত হোক কারো যদি ইচ্ছা থাকে আমি একটা ইন্সট্রুমেন্ট কিনব, বাজাবো বা আমি ওটা কিনে কিছু গানটান গাবো, সেটা অনেকটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর যদি মনে করেন যে, ব্যান্ডগোষ্ঠী যারা, আমরা যারা ব্যান্ড করছি তারা, যারা এর সাথে জড়িত তারা যে ঠিক এইভাবে শখবশত যন্ত্রপাতি কিনে ইচ্ছামতো গান গাচ্ছে তা না কিন্তু, এর পিছনে অনেক প্ল্যানিং আছে, অনেক প্রোগ্রাম আছে, আমাদের একটা গোল আছে, যে আমরা এটাকে এইভাবে করব, আমরা র্যাগে গাবো না বয়াতি গাবো, না আধুনিক গাবো, না হিন্দি গান গাবো, না বাংলা প্রোপার গাবো, সবগুলোকে কিন্তু আমরা আগেই ঠিক করে নেই। তারপরে গান গাই।
আনিসুল হক : আমার মনে হয় যে মিসেস শাফিন বোধহয় কিছু বলতে চাচ্ছেন।
মিসেস শাফিন : সাধনাবিহীনভাবে অবশ্যই নয়। কারণ আমি প্রতি সন্ধ্যায় দেখা পাই না।
আনিসুল হক : আপনি কি নিশ্চিত উনি গান গাইতে যান?
মিসেস শাফিন : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার সাথে অন্য সহধর্মিণীরাও একমত।
আনিসুল হক : আপনারা বিদেশি গানে বিদেশি সুরে পুষ্ট হয়ে গান গা’ন।
মাকসুদুল হক : বিদেশি আর স্বদেশি সুর বলে কিছু বুঝি না। সুর সুরই। আমি যতটুক বুঝি আর-কি সুর সম্পর্কে। আমার সাতসুরেই সবকিছু সাধা আছে।
আনিসুল হক : আপনাদের নিজস্ব কোনো স্বকীয়তা নেই।
মাকসুদুল হক : নিজস্ব স্বকীয়তা বলতে, … তাইলে এত লোকজন আমাদের গান কিনছে কেন? আমার মনে হয় ডেফিন্যাটলি একেকটা ব্যান্ডের নিজস্ব স্বকীয়তা আছে, এবং আমরা এই যে আলাপগুলো হচ্ছে, আমরা কোথায় পৃথক, সেটাই বোধহয় গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আনিসুল হক : আপনারা শুধুই বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গান গাইছেন।
মাকসুদুল হক : বাণিজ্য, আজকালকার পৃথিবীতে কোনো অশ্লীল শব্দ হতে পারে না। লক্ষ লক্ষ ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে, একটা বিশাল বড় ক্যাসেট-ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে গেছে, যেটা আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও ছিল না, এবং ব্যান্ডের একটা পজিটিভ কন্ট্রিবিউশন রয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, আমাদেরই কারণে, সেখানে আপত্তি কারো থাকতে পারে আমার মনে হয় না।
আনিসুল হক : আপনারা আমাদের সংস্কৃতিতে কোনোকিছু যোগ করছেন না।
মাকসুদুল হক : অনেককিছু যোগ করছি। আমার মনে হয়, আমরাই বোধহয় সবচেয়ে, সবচেয়ে বড় এক্সপেরিমেন্টেশন রিস্কগুলো নেওয়ার, এই-যে মানুষের গালাগলি শোনা, তারপরে ধরেন তালি শোনা, গালি শোনা, সব এগুলা আমরাই সহ্য করছি। এবং আমরা ধরেন এখন অনেক ব্যান্ডই আমরা মিলে আমাদের লোকজ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি।
আনিসুল হক : আপনারা নিজেরা কিছু নিজে থেকে করতে পারছেন না বলে আপনারা ফোক স্যং, আমাদের পল্লিগীতির কাছে ফিরে যাচ্ছেন একটা আশ্রয় খোঁজার জন্য।
মাকসুদুল হক : আমরা মনে করছি যে, আমরা যদি হালটা ছেড়ে দেই, ফোক সংগীতে যেটা আপনি গর্ব করছেন, সেটা আর থাকবে না আজ থেকে দশ বছর পর।
আনিসুল হক : আপনারা বেশিরভাগ হৈ চৈ গান গা’ন।
শাফিন আহমেদ : না না, এ পর্যন্ত আমরা যে-ধরনে গান শুনে এসছি, আজকে এ পর্যন্ত, তার মধ্যে একটু চিন্তা করে দেখেন, কয়টা গান হৈ চৈ ধরনের? শুধু হৈ চৈ হচ্ছে তা না।
আনিসুল হক : এখানে আমি দেখেছিলাম, মোস্তফা মনোয়ার সাহেব বলছিলেন যে, ওদের গান শুধু দেখা যায়, শোনা যায় না।
মোস্তফা মনোয়ার : গান মূলত দুই ধরনের। একটা হলো শোনা। অন্তরে প্রবেশ করে কান দিয়ে এবং ভালো লাগে, এবং সব বাঙালি ভালো গান শুনলে চোখ বন্ধ করেই বলে — আহ! এবং এর সঙ্গে অবশ্যই দৃশ্যমূলক অনেক গান আছে। সেগুলোর একটা দিক অবশ্যই আছে। তবে চিরন্তন সংগীত বলেও তো একটা নিশ্চয় কথা আছে। তার মধ্যে একটু আগে আমি রবীন্দ্রসংগীত শুনলাম, এবং আমাদের পল্লিসংগীতও হবে। তবে কতগুলো জিনিস পঞ্চাশ বছর আগে যেমন ছিল, আজও ঠিক তেমনি আছে, এবং পাঁচশো বছর পরেও রবীন্দ্রসংগীত ঠিক তেমনি থাকবে। এবং সকলেই শুনবে। তবে এই কালের প্রবাহে যেসব নতুন সংগীত আসছে সেগুলো আসবে, যাবে, আবার আসবে, আবার চলে যাবে, এটা কালের দাবিতেই আসবে।
খান আতাউর রহমান : না, আমি মোটেও একমত নই। আমি মনে করি আজকালকার তরুণরা যে নতুন ঢল এনেছে সংগীতে, এটা একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আমাদের সংগীতের সঙ্গে সংযোগ করেছেন ওরা, এর জন্য ওদের আমি সাধুবাদ জানাই। এবং ওদের যে, ওরা যেভাবে পরিবেশন করে গান, এটা নিয়ে আমাদের রক্ষণশীল লোকেরা বেশ একটু আপত্তি করেন, তা আমি তো মনে করি উদ্দাম তরুণরা উদ্দাম নাচানাচি করে গান গাইতে অসুবিধাটা কোথায়। আর দেশজ সংস্কৃতির কথা যদি বলি আমাদের কুদ্দুস বয়াতির গান শোনেন, আবদুর রহমান বয়াতির গান শোনেন, কবিগান শোনেন, সারিগান শোনেন, জারিগান শোনেন —প্রত্যেকটা জায়গায় দৃশ্যত তারা নাচানাচি করে, হাঁটাহাঁটি করে, কান্নাকাটি করে। সেগুলো যদি আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য হতে পারে, তো এই ছেলেদের নাচানাচি কেন ঐতিহ্যে পরিণত হবে না আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে?
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ : আমাদের দেশে তো আমাদের লোকজ সংগীতের মধ্যে নৃত্য আছেই, তাই না? আমাদের বাউলগান তো একেবারে নাচের গান। আর আতাভাই বাকিগুলা সবই বলেছেন। কিন্তু এইখানে একটা কথা হলো যে, গানের পরিবেশনায় নাচ আসতে পারবেই। এটা চিরকাল এসছে, এবং ভবিষ্যতেও আসবে, সবসময় আসবে। কিন্তু গানের যেটা চিরন্তন সম্পদ, চিরন্তন সত্য বস্তু যেটা, সেটা কিন্তু সুর। এবং সেটা অডিও। সেটা কানের এবং হৃদয়ের।
খান আতাউর রহমান : আমি বিশ্বাস করি না, কোনোকিছুই এসে চলে যায় না। এসে চলে যায়, কিন্তু কিছু রেখে যায়। রবীন্দ্রসংগীত যেহেতু তারা একদম ছকে বেঁধে দিয়েছে, এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না, সেজন্য ওটা ওই-রকমই থাকবে হাজার বছর। কিন্তু ক্লাসিক্যাল সংগীত, আমির খসরুর আমলের ক্লাসিক্যাল সংগীত, আজকের ক্লাসিক্যাল সংগীতে আকাশপাতাল বেশ-কম। পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং এরা যে নতুন ধারাটা এনেছে বাংলা গানে, এই গান … এদের ধারাটা হয়তো বদলে যাবে, এদের অবদান কিন্তু নিশ্চয়ই বাংলা গানে থেকে যাবে।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা : আতাভাই যেটা বললেন যে একেবারে বেঁধে দিয়েছে বলে এটা কোনো চেঞ্জ করা যাবে না এবং আজকে থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও এভাবেই লোকে শুনবে এটা ঠিক নয়। রবীন্দ্রসংগীত আজকে থেকে আগে যারা গাইয়ে ছিল, তারা যেভাবে গাইতেন, এখন আমরা যেভাবে গাই, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য হয়ে গেছে। কারণ সে-সময় মাইক্রোফোন ছিল না, ওদের অনেক চিৎকার করে গেতে হতো। এখন আমরা অনেক আস্তে করে গাই। এবং আরো পরে যখন আরো সাফিস্টিকেটেড ব্যাপার সব আসবে তখন এটা আরো চেঞ্জ হবে এবং এটা শুধু রবীন্দ্রসংগীত বলে নয়, এটা যে-কোনো সংগীতে চেঞ্জ হচ্ছে, হবে। যদি চেঞ্জ না হয় তাহলে সে-সংগীত মৃত। আমাদের যে-সংস্কৃতি আমাদের যে-ঐতিহ্য, এটা হচ্ছে নিজস্ব, একাকী, একাকিত্বের একটা ব্যাপার আছে এর মধ্যে, আর ব্যান্ডের যারা গান গাইছে এদের, এরা তো মূলত পাশ্চাত্য আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, ধরনটা মূলত পাশ্চাত্যের ধরন। পশ্চিমের গান হচ্ছে সেখানে অনেকের গান, আর পূর্বের গান, এ ভারতবর্ষের যে-গান সেটা হচ্ছে একার গান, একাকিত্বের গান। এখানেই পার্থক্য। এখানে যে-শিল্পী গান করেন তিনি গাইছেন কিন্তু যারা শ্রোতা তার সেখানে পার্টিসিপেইট করে না কিন্তু রসগ্রহণ করে।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ : বন্যা বলেছেন যে, আমাদের দেশের গান একার, আর পাশ্চাত্য সংগীত অনেকের। এটা আমাদের দেশের আর পাশ্চাত্যের নয়, এটা সামন্তযুগের গান হচ্ছে একার। রাজার সামনে বসে একজন গায়ক গান করছেন, রাজা শুনছেন, কেমন? আর এই গান একসময় পাশ্চাত্য দেশেও ছিল। এখন বুর্জোয়া সভ্যতা, সেই বুর্জোয়া সভ্যতা কিন্তু একা গানকে আর সমর্থন করছে না। এটা একটা সমবেত সংগীত হচ্ছে, এটা পাশ্চাত্যেরও হয়েছে, আমাদেরও হয়েছে। সুতরাং এটা সভ্যতার বা অর্থনৈতিক যে বিবর্তন মানবজাতির, তার সঙ্গে জড়িত।
আনিসুল হক : এখানে মিসেস কলিম শরাফী আছেন। কিছু বলবেন আপনি?
মিসেস কলিম শরাফী : আমি এইটুকু বলব যে, আমি যখন প্রথম শুনলাম যে উনি প্যপ্ বা ব্যান্ড মিউজিকে গান করবেন তখন আমি একটু নার্ভাস হয়েছিলাম। কেননা উনি খুব কম যন্ত্র নিয়ে গান করেন। কিন্তু এখন মনে হলো যে, সুর এবং কথার সমন্বয়টা এমন একটা জিনিশ যে উনিও এটা পেরে উঠেছেন।
আনিসুল হক : ধন্যবাদ। আমরা এবার আবার গানে ফিরে যাব। দুটো গান আমরা শুনব। একটি ‘মাইলস’ শিল্পীগোষ্ঠীর। ওরা গাবেন পুরনো দিনের একটি গান, হামিন এবং শাফিনের বাবার সুর-দেয়া, শ্রদ্ধেয় কমল দাশগুপ্তের সুর-দেয়া গান, আর তারপরে গাইবেন নীলুফার ইয়াসমিন।
[‘মাইলস’ গাইছে —]
কণ্ঠে আমার নিশিদিন যত সুরের নিঝর ঝরে
সে শুধু প্রিয়া সে শুধু তোমারই তরে
তুমি যবে রাখো আঁখি পরে আঁখি
মনবনে, মনবনে মোর কুহু ওঠে ডাকি
আমার ভুবনে কত গান কত গান
কত ফুল ফুটে ঝরে পড়ে
সে শুধু প্রিয়া সে শুধু তোমারই তরে
কুসুমের লাগি এ নহে ক্ষণিক ভ্রমরের ভালোবাসা
তোমারে ঘিরিয়া রচিয়াছি মোর সারাজীবনের আশা
মোর কাছে যবে ধীরে ধীরে এসে
শুধু ছুঁয়ে যাও মোরে ভালোবেসে
মনে হয় মনে হয় যেন স্বর্গ নেমেছে
আমার মাটির ঘরে
(কথা : প্রণব রায় । সুর : কমল দাশগুপ্ত)
[নীলুফার ইয়াসমিন গাইছেন —]
হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়
আঘাত দিলেই ভেঙে যাবে
মন উড়ন্ত কোনো বেলুন নয়
হুল ফোটালেই চুপসে যাবে
শুকনো মাঠে ফুল ফোটানো
সারাবেলার খেলা
শূন্যতার মাঝে গড়ি
বিনিসুতোর মালা
বুকের মাঝে ভালোবাসা
থাকবে জীবনময়
অন্তর্চক্ষু খোলা রাখি
সবই আমি দেখি
সাধ্যি কার এ-ভুবনে
দেবে আমায় ফাঁকি
বুকের মাঝে ভালোবাসা
থাকবে জীবনময়
হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়
আঘাত দিলেই ভেঙে যাবে
মন উড়ন্ত কোনো বেলুন নয়
হুল ফোটালেই চুপসে যাবে
(রেনেসাঁ-র গান)
আনিসুল হক : আমি কি বলব, আমি তো বাক্যহারা। আমরা বরং নীলুফার ইয়াসমিনের স্বামী খান আতাউর রহমানের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করব।
খান আতাউর রহমান : আমি কি বলব, বলবেন তো আপনারা। ভালোই তো গাইলো, এ-ধরনের গান …
আনিসুল হক : আপনি কিদশে দশ দিবেন না?
খান আতাউর রহমান : আমি দশে একশ দেবো।
মোস্তফা মনোয়ার : না, খুবই সুন্দর লেগেছে। কারণ, সেই আবার আমার কথায় ফিরে আসি যে সংগীত মানেই সুরে, লয়ে, অন্তর দিয়ে, ভাব দিয়ে গাওয়া। দেখা, না-দেখলেও এই গানটি আমার ভাল্লাগত। সুরে, সুন্দর গলায়, ভাব, অন্তরের ভাব, সবকিছু মিললেই সংগীত সুন্দর হয়।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ : আমার কাছে অতটা ভালো লাগেনি। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, আমগাছ থেকে তাল ফলানোর একটা চেষ্টা। আমগাছ থেকে তাল হতেই পারে, এবং সেটা উদ্ভিদের শক্তি আছে বলে, কিন্তু সেটা খুব ন্যাচারাল মনে হয় না। যেমন নীলুফার ইয়াসমিনের চেহার মধ্যে, সবজায়গার মধ্যে মনে হয় যেন উনি বেদনার জন্য তৈরি। ঠিক এই গান যখন গাচ্ছেন উনাকে মনে হচ্ছিল না যে ঠিক উনি সাবলীল জায়গাতে আছেন।
আনিসুল হক : আমরা এতক্ষণ ব্যান্ডসংগীতকে অনেক অভিযোগ করলাম, কিন্তু ব্যান্ডসংগীতকে ওরা কি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন, এটা জানতে চাইব।
খান আতাউর রহমান : এরা অ্যাফ্রিক্যান্ রিদম্, জ্যাজ্ রিদম, জ্যাজ পার্কাশন ইন্সট্রুমেন্টস এগুলো আমাদের দেশে নতুন আমদানি করেছে। ব্যান্ডের আগে এই বিগ ড্রামস, জ্যাজ্ ড্রামস্, ড্রামস্ সেট, বঙ্গ এগুলো ছিল না আমাদের দেশে। আমরা ঐতিহ্যগতভাবে এ-সমস্ত করতাম … শুধু তবলা, খোল আর ঢোল বাজত। এখানে এটা কিন্তু পজিটিভ কন্ট্রিবিউশন হচ্ছে বাংলাদেশের মিউজিকের প্রতি। ব্যান্ডের মিউজিককে আমি বলব ইট’স্ অ্যা পজিটিভ কন্ট্রিবিউশন টুয়ার্ডস্ রিভোল্যুশন্যারি প্রসেস থ্রু হুইচ আওয়ার মিউজিক ইজ গোয়িং থ্রু অ্যান্ড আই ওয়েলকাম দেম।
আনিসুল হক : ধন্যবাদ। জনাব কলিম শরাফী।
কলিম শরাফী : আমার একই কথা, আমি যে জিনিশটা বলেত চাচ্ছিলাম যে, তারা যে-যন্ত্র ব্যবহার করছেন, এই যন্ত্র আমরা দেখিনি বলে আমাদের এই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। যেমন ভায়োলিন, কোনোদিন আমাদের যন্ত্র ছিল না। কিন্তু আজ … হার্মোনিয়াম আমাদের যন্ত্র ছিল না, অর্গান আমাদের যন্ত্র ছিল না, পিয়ানো আমাদের যন্ত্র ছিল না। কিন্তু আমরা সেগুলোকে ব্যবহার করতে করতে এমন একটা অবস্থায় এনেছি যে এখন যদি একটা পিয়ানো না থাকে, তাহলে বলি এ দেখো পিয়ানো এখানে দিলো না বা ভায়োলিনের এটা শোনা যাচ্ছে না,
খান আতাউর রহমান : যাত্রাতেও ক্ল্যারিয়োনেইট বাজানো হয় …
কলিম শরাফী : যাত্রাতেও ক্ল্যারিয়োনেইট বাজানো হয়, এক্স্যাক্টলি। তো, এই যে জিনিশটা, কিছুদিন পর এই জিনিশগুলো সহজ হয়ে যাবে আমাদের কাছে। এখন তারা একটা এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বলেই আমরা এত, মানে, তাদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আনিসুল হক : জনাব মোস্তফা মনোয়ার?
মোস্তফা মনোয়ার : দুজনেই বাদ্যযন্ত্রের কথা বলেছেন, তবে এটা সত্যিই বলেছেন যে এখন কেবলমাত্র বাদ্যযন্ত্রগুলোই শোনা যায়, গলাটা আর শোনা যায় না। গলাটাও একটু শুনতে চাই আমরা। এবং আমার মনে হয় যে, এটা খুবই সত্যি কথা যে টিনেইজ গ্রুপের এখন পয়সা হয়েছে, তারা এখন রেকর্ড কিনছে। এটা পৃথিবীর সব জায়গায়। তারা কিন্তু প্রচুর রেকর্ড কিনছে। এবং রেকর্ডমার্কেটটা নির্ভর করছে টিনেইজ গ্রুপের উপরে। কালের একটা চাহিদা আছে, সেই চাহিদা এরা অবশ্যই মেটাচ্ছে। তবে চিরন্তন যে সংগীত আমাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে, আমাদের ধারায় রয়েছে, রক্তের ধারায় রয়েছে তার সঙ্গে তো ঠিক এর কম্পিটিশন চলে না।
আনিসুল হক : আপনি কিছু বলবেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : ব্যান্ডসংগীতকে আমার মনে হয় যে আজকের মানুষের গান। প্রত্যেক যুগই একটা নতুন অনুভূতি এবং চেতনা নিয়ে মানুষের হৃদয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং সেই কালের শিল্পীরা সেই হৃদয় দিয়ে সেই অনুভূতিগুলোকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথ তার যুগের অনুভূতিকে তুলে ধরেছেন, নজরুল তার সময়কার, তিনি যেভাবে ফিল করেছেন সেটাতে তুলে ধরেছেন। আজকে যে অনুভুতির জগৎ আমাদের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, আজকের সংগীতকারেরা সেটাকে তুলে ধরছেন।
আনিসুল হক : ধন্যবাদ। আমরা শুনি মাকসুদের গান, ফিডব্যাকের গান।
[ফিডব্যাক গাইছে —]
আমার দুখে-দুখে জনম গেল গো
সুখ কি আমার সইল না
জনমদুখী কপালপোড়া গুরু
আমি একজনা।।
গিয়েছিলাম ভবের বাজারে
ছয়জনাতে চুরি করে
গুরু ধরল আমারে।।
চোরায় চুরি করে খালাস পাইলো গো
আমায় দিলো জেলখানায়।।
শিশুকালে মইরা গ্যাছে মা
গর্ভে রাইখা পিতা মরলো
গুরু চোখেও দেখলাম না।
আমায় কে করিবে লালনপালন গো
গুরু গো …
আমায় কে করিবে লালনপালন গো
কে দিবে আমায় সান্ত্বনা
জনমদুখী কপালপোড়া গুরু আমি একজনা …
(বাংলার লোকগান । সংগ্রহপূর্বক কম্পোজিশন : ফিডব্যাক)
আনিসুল হক : আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, আমাদের পল্লিসংস্কৃতি, এগুলো আমাদের রত্নভাণ্ডার। আমাদের স্বর্ণসম্ভার। সেখানে কেউ সে-ঐতিহ্যকে নষ্ট করার দুঃসাহস করবে, সেখানে আমরা হাত দিতে দেবো না। তেমনি যারা নতুন প্রজন্ম উঠে আসছে, তাদেরকে নিশ্চয়ই, তাদের এগিয়ে চলার পথে, আমরা সহায়তা করব। আমাদের শেষ গানটি, নতুন প্রজন্মের জন্যে, নতুন মানুষ যারা আসছে, এ সমাজ যারা বদলে দেবে তাদের জন্যে, আমাদের শেষ গানটি উৎসর্গ করছি সেই নূতন প্রজন্মের জন্যে।
[কলিম শরাফীর সাথে সমবেতভাবে গাইছেন জলসায়-আগত অংশগ্রাহী সকলে —]
আজ যে-শিশু
পৃথিবীর আলোয় এসেছে
আমরা তার তরে
একটি সাজানো বাগান চাই।।
আজ যে-শিশু
মায়ের হাসিতে হেসেছে
আমরা চিরদিন
সেই হাসি দেখতে চাই
রেললাইনের পাশে নয়
অন্ধকার সিঁড়িতেও নয়
প্রতিটি শিশু মানুষ হোক
আলোর ঝর্ণাধারায়।
শিশুর আনন্দমেলায়
স্বর্গ নেমে আসুক।।
হাসি আর গানে ভরে যাক
সব শিশুর অন্তর
প্রতিটি শিশু ফুলেল হোক
সবার ভালোবাসায়
শিশুর আনন্দমেলায়
স্বর্গ নেমে আসুক।।
(রেনেসাঁ-র গান)
।। সমাপ্ত ।।
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS