শিশুমনে ভয় পাওয়ানোর ভুল গার্জেনগিরি || আহমদ মিনহাজ

শিশুমনে ভয় পাওয়ানোর ভুল গার্জেনগিরি || আহমদ মিনহাজ

বাচ্চাদের বিচিত্র কৌতূহল ও সংগোপন বাঁদরামির খোঁজ পেতে হলে হম্বিতম্বির পরিবর্তে তাদের সঙ্গে বাতচিতের জানালাটা খোলা রাখা জরুরি। গার্জেনরা খানিক সুবিবেচনার পরিচয় যদি দেন তাহলে কোন অভিজ্ঞতাটা কোন বয়সে বাচ্চার জন্য লাগসই তার পরিষ্কার ধারণা মনোবিদের সাহায্য ছাড়াই নিতে পারবেন। সেইসঙ্গে বাচ্চা পোলাপানরা কী করছে না করছে সেদিকে নেত্রপাত কঠিন ঠেকবে না। সমুচিত বয়সে পাবজির মতো খেলায় মেতে ওঠা মন্দ নয় কিন্তু অতিরিক্ত আসক্তি খারাপ; — ছোট্ট এই কথাটি বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলা গার্জেনের দায়িত্ব। হাবজি গাবজির মতো ছবি বানিয়ে একালের শিশুসমাজের মোবাইল ও ভিডিওগেম আসক্তিকে ভয়ানক বিকার রূপে তুলে ধরা ও তাদের মনে ভয়সঞ্চারের ঘটনা বোধ করি ভুল বার্তাই পৌঁছায় সমাজে।

স্বনির্মিত ছবিটির ব্যাপারে পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর কথাবার্তা বাঙালি দর্শককুলের প্রশংসা কুড়ালেও অধমের কাছে ক্লিশে মনে হয়েছে। ছবিতে মোবাইল ও ভিডিওগেমের কুফল ধরিয়ে দিতে সকলের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার  চিরাচরিত অস্ত্রকেই পরিচালক হাতিয়ার করেছেন। সদ্য উন্মুক্ত ছবিখানার খবর করতে যেয়ে মনে হলো বাচ্চাদের মনে একরাশ ভয় কীভাবে পয়দা করা যায় এই ভাবনা পরিচালককে জ্বালাতন করেছে। জ্বলুনিটা পর্দায় ভালোভাবে তুলে ধরতে পারায় বিস্তর প্রশংসা জুটেছে কপালে। রাজের বরাত থেকে দর্শক জানতে পাচ্ছে, — বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে যেসব বাচ্চা ছবিটি দেখেছিল তারা এখন ভিডিও গেম দূরে থাক, মোবাইল হাতে নিতেও ভয় পাচ্ছে! গার্জেনরা এই ঘটনায় যৎপরোনাস্তি দিলখোশ! ভয় দেখানোর কাজে রাতদিন চেষ্টা করে তারা সফল হতে পারেননি। তাদের হয়ে রাজ কাজটি করায় সকলে খানিক হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন মনে হলো।

পরিচালকের এমনধারা কথাবার্তা বুঝিয়ে দেয় উদ্দেশ্য মহৎ বা যৌক্তিক হলেও বাচ্চাদের মনে ভয়, আতঙ্ক ইত্যাদি ঢোকানো ছাড়া মোবাইল এবং গেমআসক্তিকে নিরোধ করা সম্ভব নয় বলে তিনি ধরেই নিয়েছেন। বাবা-মায়ের দিক থেকে বাচ্চাকে বেশি করে সময় দেওয়ার জরুরি প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে গেলেও ছবির আগাপাশতলা জুড়ে ভয় দেখানোর সপক্ষে তাঁর ওকালতি সব নষ্ট করে দিচ্ছে মনে হলো। ভাবছিলাম, রাজ চক্রবর্তীকে দোষ দিয়ে কী লাভ! বাঙালি জাতি শত হাজার ভয়ের গোলাম খেটে এদ্দুর বালেগ হয়েছে। রাষ্ট্র তাকে যখন-তখন ভয় দেখায়। ক্ষমতা ও টাকাওয়ালারা মওকা বুঝে ভয়ের ট্যাবলেট হাতে ধরিয়ে দিতে দেরি করে না। মোল্লা-পুরুতদের তো ভয়টাই আদি সম্বল। আর্মি-পুলিশ-গুণ্ডা-এমপি থেকে শুরু করে বুদ্ধি বিক্রেতা বিদ্যালয়ের মাস্টার, পাতি অথবা বোয়াল সাইজের নেতা কিংবা ত্যানা…সব্বাই এখানে এক বরাবর! এরকম হাজারবিজার ভয়ের খাঁচায় বন্দি বাংলার গার্জেনকুল নিজের অপোগণ্ড কাচ্চাবাচ্চাদের মোবাইল ও ভিডিও গেম থেকে বিরত রাখতে ভয়কে টোটকা ঠাউরাবেন সে আর বিচিত্র কি? রাজ চক্রবর্তী কাজটি সহজ করে দিলেন এই যা!

ঝরঝরে সিনেভাষায় বোনা ছবিটির ব্যাপারে বাঙালি গার্জেনকুলের গদগদ ভাব দেখে শিশুমনোবিদ্যায় (Child Psychology) একপাক ঘুরে আসার খায়েশ চেপেছিল। মনোবিদরা অধমের পছন্দের পাত্র না হলেও তাদের মানবমন বীক্ষণের আলাদা মূল্য রয়েছে সমাজে। সেই জায়গা থেকে নজর করলে হাবজি গাবজির সিনেভাষা একটা বাচ্চার ওপর দুভাবে ক্রিয়াশীল বলে ধারণা করি। মনে ভয় ঢুকে যাওয়াটা কোনো কারণে স্থায়ী মোড় নিলে দুর্বল স্নায়ুর বাচ্চা বাকি জীবন সেই ভীতি থেকে বেরিয়ে আসতে আপত্তি ও অপারগতা জানাতে পারে। তার মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ঘটনাটি মোটেও সুখকর কিছু নয়। অন্যদিকে সিংহভাগ বাচ্চা ভয়ের সাময়িক ধাক্কা দ্রুত সামলে নেবে আর মজাটা সেখানেই; — বাঁদরগুলো তখন মোবাইল ও ভিডিও গেম ব্যবহারের ঘটনায় খুল্লামখুল্লা হওয়ার পরিবর্তে ছুপা রুস্তমের ভূমিকায় নাম লেখাবে। লুকিয়েচুরিয়ে যত কাম তারা সারবে সেগুলো ভয়ভক্ত গার্জেনকুলের কাছে লাগাতার গোপন করতে থাকবে। হাবজি গাবজির সুবাদে এটা তাদের বেশ বোঝা হয়ে গিয়েছে বাপ-মায়ের কাছে মন খুলে কথা কইতে গেলে বিড়ম্বনা বাড়ে ছাড়া কমে না একটুও! ছুপা রুস্তমের পাঠশালায় নাম লেখানোটা এদিক থেকে বেশ সহজ ও নিরাপদ। রাজ তাঁর ছবিতে প্রাসঙ্গিক ভালো জিনিস তুলে ধরলেও বাচ্চা ও বাপ-মা দুজনেই খুশি হবেন এরকম বোঝাপড়া বা ভারসাম্যে গমনের সড়ক মনে হলো খোঁজার চেষ্টা করেননি।

মোদ্দা কথা, একটা বাচ্চা ফুটবলে লাথি মারবে, নিজেকে কর্মজীবনের যোগ্য করতে বিদ্যালয়ের সিলেবাস মন দিয়ে রপ্ত করার চেষ্টাও করবে, আবার তাকে সেই স্পেসটা সকলের দিতে হবে যাতে করে ভিডিও গেমের জগতে বানানো কল্পবিশ্ব সম্পর্কে অন্ধকারে পড়ে না থাকে। মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া বা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। এগুলোর ওপর অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ছে কি-না সেদিকে খেয়াল রাখা ও প্রয়োজনে খোলামনে তাকে বোঝানোটা বরং কাজ দিতেও পারে। স্মরণ রাখা উচিত মনে হয়, পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার জন্য রাতদিন একাকার করে বাচ্চার ওপর অকথ্য চাপ প্রয়োগ যেমন নৈরাজ্যের শামিল, লাগামছুট বকনা বাছুরের মতো ভিডিও গেম আর মোবাইল যন্ত্রের পিছনে পড়ে থাকাটাও সর্বনাশা। দুটোই সামাজিক উপযোগ থেকে জন্ম নিয়েছে বিধায় তাদের মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে স্থাপন করা যায় তার সূত্রটা গার্জেনকেই খুঁজে নিতে হবে।

বাচ্চা বয়সী ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় Bad Touch-র ঘটনা নিয়ে দুটো কথা বলে এই পর্বের আলাপে ইতি টানতে চাই। Bad Touch নামক ব্যাপারখানা গার্জেন ও বিদ্যালয়ের শিক্ষককুল কীভাবে সামলাবেন তার ওপর একটা বাচ্চার জীবনবোধের বনেদ ও বিকাশ নির্ভর করছে। ওটা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবেন নাকি অন্য পথে ফয়সালা করবেন ইত্যাদি নিয়ে ভাবনার সময় নজদিক হচ্ছে দিন-দিন। তুলকালাম বাঁধানোর পরিণাম কেমন হয়ে থাকে তার ধারণা পেতে পাঠক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় নির্মিত হামি  ছবিখানা ফাঁকতালে দেখে নিতে পারেন। হামি-র সিনেভাষা Bad Touch-র সমস্যাকে আমাদের দেশকালসমাজের সঙ্গে মিল করে বা সেখানে সক্রিয় মনোজগৎ মাথায় রেখেই পর্দায় তুলে ধরেছিল। বাচ্চাদের জগতে বড়োদের অনুপ্রবেশ (*আমরা অহরহ যেমনটা করে থাকি আর কী!) অত সস্তা নয়, বহুত খাটনি ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন রয়েছে সেখানে; — হামি   ছবির সারকথাটি বড়োদের উপলব্ধি করা জরুরি মনে হচ্ছে।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you