হিরো আলমকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা অসভ্যতা হলেও তাঁর কপালে দুর্যোগটা একপ্রকার অবধারিত ছিল। আজ নয়তো কাল ওটা ঘটতই! অনেকের কাছে তিনি হিরো গণ্য হতে পারেন কিন্তু পুলিশ মামাদের তাতে কিছু যায় আসে না। জনউপদ্রব (Public Nuisance) ঘটানোর অভিযোগে তারা তাঁকে থানায় ডেকেছিলেন শুনতে পাই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন জনউপদ্রব-র সংজ্ঞা কোন পথে সন্ধান করে জানি না, তবে এটা ঠিক, উত্থানের সময় থেকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু রূপে হিরো আলম জনমনে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা মাঝেমধ্যে মাত্রাছাড়া ঘটনায় মোড় নেয়। সাম্প্রতিক হুজ্জতকে যারপরনাই অস্বাভাবিক ভাবা যাচ্ছে না। হুজ্জতটা পুলিশ অবধি গড়ানোর কারণে দেশের সচেতন মহলে উদ্বেগ-উত্তেজনার পারদ খানিক চড়ায় উঠেছিল মাত্র।
অযাচিত এই চাপ অন্যদিকে হিরো আলমকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে মোলাকাতের সুযোগ এনে দিয়েছে। কনস্টেবলের পোশাক গায়ে চড়িয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সাজার পর তিনি দেখতে পেলেন ভ্যাপসা গরমে জর্জরিত এক সকালে রাষ্ট্র তাঁকে থানায় তলব করে বসেছেন। সুধীজনের কাছে বিষয়টি নিন্দনীয় হলেও হিরো আলমের ক্ষেত্রে একে শাপে বর ভাবা যেতে পারে। এই প্রথম বোধহয় তিনি বুঝতে পারলেন শিক্ষিত লোকজনকে কী কারণে অনেকে জটিল ধাঁধার সমতুল বলে মানেন। তাদের সংসারে একশো রীতি নয়শো কানুন। এরকম সংসারে যারা বিচরণ করেন তাদেরকে আমোদ বিলানোর চেয়ে নিজের সোজাসরল ডেরায় ফেরত যাওয়া হয়তো ভালো ছিল তাঁর জন্য!
চেনা ডেরায় আলম আর কখনো ফেরত যেতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। সে তিনি পারুন বা না পারুন, পুলিশ মামাদের হাতে ডলা খাওয়ার আজাব থেকে বাঁচতে ভালো Content বানানোর প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। এখন ভালো Content বলতে আলম স্বয়ং কী বোঝেন সেটা তাঁর ভক্তকুলের পক্ষেও আন্দাজ করা বোধহয় কঠিন। মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি Content বানিয়েছেন এতদিন। ইন্টারনেটে অবমুক্ত করার সময় ওগুলোর ফলাফল নিয়ে ভাবার ঠেকা তাঁকে তাড়িত করেনি। পুলিশকাণ্ডের পর থেকে সিনারিটা আগের মতো সোজা-সরল থাকার সুযোগ নেই। অবমুক্ত Content কী কারণে ভালো নয় অথবা কী করলে ভালো বলে লোকের বাহবা কুড়াবে…, ভালো-খারাপের এইসব ভজকট, ধারণা করি, হিরো আলমের নায়কজীবনে দুঃস্বপ্নে মোড় নিতে চলেছে।
মস্ত বড়োলোক অনন্ত জলিল শিক্ষিত লোকজনে বোঝাই এক সমাজে রাতদিন ওঠবস করেও অনেকের মনে জায়গা করে নিতে পারেননি। তাঁর Content-কে ভালো বলে স্বীকৃতি দিতে তারা বিমুখ বোধ করে। জলিল যাকে ভালো বলে প্রচার করেন তারা সেটাকে খারাপ বলে গাল পাড়ে আর হাসে। কোটি-কোটি টাকা খর্চা করে সিনেমা মুক্তি দিলেও জলিল ও বর্ষা জুটিকে বাহবা জানাতে কৃপণতা করে লোকগুলো। সিনেমা বস্তাপচা হইসে বলে দাঁত কেলিয়ে হাসে। জলিল ও বর্ষার অভিনয় নিয়ে ট্রল করতে ছাড়ে না। সফল ব্যবসায়ী ও পরোপকারী অনন্ত জলিলের দশা যদি এই হয় তাহলে হিরো আলমের ক্ষেত্রে ঘটনা আরো খতরনাক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
পুলিশ তাঁকে থানায় ডেকে জেরা করেছেন বলে নয়, জাতিকে ভালো Content খাওয়ানোর মুচলেকা দিতে বাধ্য করায় রাষ্ট্রের অতন্দ্র লাঠিয়ালদের অভিশাপে জর্জরিত করা উচিত। আলমের প্রতিশ্রুতিতে সারল্য রয়েছে কিন্তু এর আশু পরিণাম বোধ করি তিনি এখনো আঁচ করতে পারেননি। ভালো-খারাপের তোয়াক্কা না করে ইন্টারনেটে যেসব Content-সহ তিনি হাজিরা দিয়েছেন সেগুলো নিয়ে হট্টগোল হয়েছে বিস্তর! অনেকে ভালোবেসে বাহবা দিয়েছে আবার সবতাতে ছিদ্র খুঁজে বেড়ায় এমন কিছু লোক তাঁকে দুয়োধ্বনি দিয়েছে সমানে। দুই পক্ষের দড়ি টানাটানির মাঝে বিনোদনশিল্পীর ভূমিকায় তাঁর বিচরণ মোটের ওপর নিষ্পাপ ছিল। পুলিশ নাক গলানোর কারণে নিষ্পাপ থাকার পালাটা খতম হতে চলেছে বোধহয়!
Content ভাবতে বসে এখন থেকে প্রতি পদে ভালো নামের আজব ব্যাপারখানা তাঁকে জ্বালিয়ে মারবে। কিছু না বুঝে Content বানানো টাইপের সরলোক্তি দিয়ে পার পাওয়ার রাস্তা বদের হাড্ডি পুলিশ তাঁর জন্য কঠিন করে দিয়েছে। তাঁকে যারা পছন্দ করে না তারা এই সরলোক্তিকে আমলে নিতে চাইবে না। যারা পছন্দ করে তাদের পক্ষেও আগের মতো হৈ হৈ করে তাঁর হিরোগিরিকি সার্টিফাই করা সহজ থাকছে না আর। পুলিশি জেরা শেষে সাংবাদিক সমাগমে আলম যে-বক্তব্য রেখেছিলেন সেখানে তাঁর বিনোদন দানের পন্থাকে তিনি স্বয়ং খারিজ করে দিচ্ছেন মনে হলো। অতীতে বানানো Content-র ব্যাপারে সরল যে-আত্মবিশ্বাস তাঁর মধ্যে ছিল পুলিশিধাক্কায় সেটা বালির বাঁধের মতো ধসে পড়তে দেখাটা আলমভক্তদের জন্য নিশ্চয় সুখকর কিছু নয়।
শিক্ষিত সমাজে যারা তাঁকে ভালোবাসেন তারা সোজাসরল মানুষটির ওপর পুলিশের অযাচিত মাতবরির ঘটনায় খেপে উঠলেও ভালো Content-র বিষয়টাকে কেন জানি আমলে নিতে চাইছেন না। মানব সংসারে ভালো Content-র সংজ্ঞা কুহেলিকার নামান্তর বটে! তার মতো জটিল-কুটিল-খল জিনিস দুটো হয় না। আলমের ওপর এরকম গুরুভার চাপানোর পরিণাম সংগতকারণে সুখকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সমাজের যে-স্তরে নিজের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তিনি এতদিন লড়াই করেছেন এখন ভালো Content বানানোর চাপ তাঁকে সেখান থেকে পিছলে যেতে বাধ্য করবে। আলমভক্ত শিক্ষিত সুধীজনের বাদ-প্রতিবাদে বিষয়টি অনুপস্থিত মনে হচ্ছে। তাদের প্রতিবাদ জানানোর পন্থায় হুজুগ, ভ্রান্তি ও স্ববিরোধিতা অধিক চোখে পড়েছে। অধমের বক্তব্যে কারো দ্বি-মত থাকলে আওয়াজ দিবেন আশা করি।
বাংলাদেশের বিনোদনশিল্পে হিরো আলমের যাত্রা যেটুকু জানা যায় একলার চেষ্টায় ঘটেছিল। দেশে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে তাল দিয়ে ফেসবুক-ইউটিউব-টিকটক ইত্যাদি ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত না হলে তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত বলে মনে হয় না। স্যাটেলাইট টিভির ব্যবসায় বিজড়িত থাকার দিনকালে লোকে তাঁকে ডিশ আলম নামে চিনত আর এখন হিরো আলম নামে চিনেজানে। ডিশ থেকে হিরোয় উত্তরণের ফলে দেশের আপামর শিক্ষিত জনতা ও পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর কাছে তিনি আর সোজাসরল লোকটি নেই। তাঁকে লঘু ভেবে উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে সামাজিক আদাবের বরখেলাপ বৈকি। নিজের এই প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য যদি উদযাপন করতেই হয় সেক্ষেত্রে লোকের ভালোবাসা ও দুয়োধ্বনি হজম করে আলমকে সামনে আগাতে হবে। পুলিশ মামাদের অসভ্য মাতবরি সহ্য না করেও উপায় থাকছে না তাঁর। সকল ঝড়ঝাপটা সামলে আগামীতে কী খেলা তিনি দেখাবেন তার ওপর হিরো আলমের হিরোগিরির ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে মনে হয়।
…
সে যাকগে, দেশের স্বাধীন নাগরিককে বলাকওয়া নাই থানায় তলব করে জেরা ও ঝাড়ির এখতিয়ার পুলিশ কতটা রাখেন এই জিজ্ঞাসা আলমকাণ্ডের সুবাদে পুনরায় চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে। আলমের বাপ-মা যে-কাজটা করলে ঠিক ছিল তার দায়িত্ব যদি পুলিশ নিয়ে নেন তাহলে বিপদ! আপদ ও বিড়ম্বনা এতে বাড়ে ছাড়া কমে না একরতি। একুশের কোনো এক বইমেলায় জঙ্গি দমন, ধর্মের অবমাননা ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা প্রতিহত করার অজুহাতে দেশের লেখকগণ কে কী লিখছেন তার তত্ত্বতালাশ পুলিশ নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাঘা সাইজের ক্রিমিনালদের জেলের চৌদ্দ শিকেয় ঢোকানোর কাজকাম বাদ দিয়ে গরিব লেখকসমাজের ওপর মাস্টারির খবরে চিল্লাপাল্লার সুনামি উঠেছিল দেশে। কবি-লেখকদের দেখ লেঙ্গে টাইপের হাউকাউয়ের চোটে পাবলিকের মাথা ধরেছিল বেজায়। হিরো আলমকে থানায় হাজির হতে বলার তরিকার সঙ্গে উক্ত ঘটনার খানিক মিল চোখে পড়ছে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ বর্ণিত ধারা-উপধারার দোহাই দিয়ে সরকারের নাপসন্দ রাঘব-বোয়াল থেকে শুরু করে যাকে ইচ্ছা তাকে জেলের চৌদ্দ শিকেয় ঢোকানোর আপদ নিয়ে সুধীজনে বাকবিতণ্ডার অন্ত নেই। তার মধ্যে হিরো আলমকে তলবের ঘটনায় নতুন আপদ যুক্ত হলো দেশে। সরকারের সুমহান ইমেজ বিনষ্ট করার তালে আছেন এরকম অভিযোগে মশহুর বহু হযরতকে পুলিশ অতীতে থানায় ডেকে জেরা নয়তো চৌদ্দ শিকের ভিতরে চালান করেছেন। হযরতরা সকলে ধোয়া তুলসিপাতা ছিলেন সে-কথা বলা অধমের উদ্দেশ্য নয়। নিজের কিংবা দেশের জন্য বিপজ্জনক মনে করে সরকার হয়তো-বা তাদেরকে থানা-পুলিশ-আদালত অবধি দৌড়ঝাঁপ করিয়েছিলেন। হেনস্থার পন্থা কতখানি আইনসম্মত ও শালীন হচ্ছে এই প্রশ্নটি তখন উঠেছিল। হিরো আলমকে থানায় তলবের পন্থা সেদিক থেকে নিরীহ হলেও পুলিশ তাঁকে ভদ্র ভাষায় জুতাপেটা করতে কিছু বাকি রাখেনি।
জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভাষা নিয়ে ক্যারিকেচারের অন্ত নেই। আওয়ামী জামানায় রঙ্গটা কেবল ফুলেফেঁপে উঠেছে এই যা! অতীতরঙ্গের সঙ্গে এর তফাত বলতে এটুকুই। সরকারের বিবেচনায় সন্দেহভাজন হযরতদের পুলিশি পন্থায় জেরা ও রিমান্ডে ঢোকানোর প্রক্রিয়া যারপরনাই Minimum Courtesy-র তোয়াক্কা কভু করেনি। কোনো ট্যাঁ-ফোঁ করা যাবে না, যদি করেন তাহলে জেলের চৌদ্দ শিকে দেখতে হবে আবার;—এই মুচলেকায় সই দিয়ে হযরতরা একে-একে ছাড়া পেয়েছিলেন। তারপর থেকে তারা নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের জীবন বেছে নিয়েছেন। সাত চড়ে রা কাড়েন না আজকাল! মশহুর হযরতদের তুলনায় হিরো আলম চুনোপুঁটি হলেও তাঁকে থানায় ডেকে রাষ্ট্র বোধহয় আরেকবার সংকেতটা দিলেন,—জনউপদ্রব-র ঠিকা নিজের ঘাড়ে বহনের ব্যাপারে তিনি দিবানিশি সজাগ রয়েছেন। থানায় এসে কেউ অভিযোগ করে তো ভালো, না করলেও ক্ষতি নেই, সরকার যদি মনে করেন কোনো ব্যক্তি জনউপদ্রব সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তবে তাকে পুলিশ দিয়ে বেঁধে ডাণ্ডাপেটা করতে কসুর করবেন না।
কন্ধকাটা গণতন্ত্রের ঘাড়ে চেপে ফ্যাসিবাদ এভাবে যুগে-যুগে দেশে জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম কখনো ঘটেনি। হিরো আলমের ঘটনায় চাউর ফ্যাসিবাদী লক্ষণ নিয়ে যারা মহল গরম করে তুলেছেন তাদের উদ্বিগ্ন ও সংক্ষুব্ধ বোধ করার কারণ আন্দাজ করা যারপরনাই জটিল কিছু নয়। সকলে মনে-মনে তরাসে কাতর,—জনউপদ্রব সৃষ্টির অজুহাতে হিরো আলমকে থানায় ডেকেছে, কাল অথবা তরশু আমাকে ডাকবে না তার কোনো গ্যারান্টি আছে? সুতরাং সাধু সাবধান! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পুঁজি করে যদি শোরগোল তোলা না যায় তাহলে নিজের মরণ ঠেকানো কঠিন হবে! অনেকের হয়তো মনঃপুত হবে না তবু প্রশ্নগুলো করতে চাই…
হিরো আলমকে পুলিশি বিড়ম্বনায় ঠেলে দেওয়ার দায় কি কেবল তাঁর একলার ছিল? আলমের কাজকারবারে যারা চরম বিনোদিত হচ্ছিলেন, মারহাবা জানানোর ছলে রাষ্ট্রীয় জীবনে গুরুতর ঘটনায় মোড় নিতে বেচারাকে উসকানি দিয়ে গেছেন অবিরাম, এখন সোজা-সরল লোকটার মাথার ওপর বিনা মেঘে ঠাডা নামে দেখে নিজের দায় কি তারা টের পাচ্ছেন কিছু? নাকি হিরোর ওপর পতিত দুর্যোগকে তাঁর একলার নির্বুদ্ধিতা ভেবে মানে-মানে সরে পড়ার তাল করছেন?
হিরো আলমকে নিয়ে ট্রলের সূত্রপাত যতদূর স্মরণ হয় দেশের সচেতন মহলে বিচরণে অভ্যস্ত একদল শিক্ষিত লোকের হাতে ঘটেছিল। ট্রলকাণ্ডের সমুচিত জবাব দিতে গিয়ে তাঁকে মেহনতি মানুষের সমাজ থেকে উঠে আসা বীর প্রমাণে উক্ত মহলের কিছু লোক সক্রিয় হয়েছিলেন তখন। আলমকে ট্রল করতে ব্যস্ত ভদ্দরনোকদের উচিত শিক্ষা দিতে উনারা তাঁকে লাইমলাইটে নিয়ে আসেন। পক্ষে-বিপক্ষে সক্রিয় সুধীমহলের এহেন কোন্দলের জের ধরে হিরো আলমকে নিয়ে দেশের ম্যাঙ্গোপিপলদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও Hype জন্ম নেয়, সেইসঙ্গে মূলধারার গণমাধ্যমের নজর কাড়েন তিনি। এপার-ওপার দুই বাংলায় আলোচিত ঘটনায় মোড় নিতে যে-কারণে তাঁকে লম্বা সময় ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয়নি।
হিরো ও ভিলেন রূপে আলমকে হাজির-নাজিরের ডামাডোলে খাঁটি সত্যটি ফাঁকতালে উবে যেতে বসে। যে-সমাজ থেকে হিরো আলমের উত্থান ঘটেছিল সেখানকার মানুষজন বিনোদন নামক ব্যাপারখানার সঙ্গে কোন পথে সই পাতায় তার ময়নাতদন্তে শিক্ষিত সুধী সমাজের কাউকেই উৎসুক মনে হয়নি। কেন?—প্রশ্নটা সবিনয়ে তুলতে চাইছি এখানে। কেউ যদি উত্তর করেন তো ভালো হয়। অধমের মনে সৃষ্ট ধাঁধা তাতে প্রশমিত হতেও পারে।
…
সমাজের যে-গণ্ডি থেকে আলমের উত্থান সেখানে তাঁর মতো আরো বহু আলমের দেখা মিলবে। তাদের অনেকে সুরলয়তাল বজায় রেখে গান গাইতে পারে। নায়ক-নায়িকা বা ভিলেনের পার্টে জবরদস্ত অভিনয় জানে অনেকে। কবিতা ও গান লিখে এরকম লোকজন বিরল নয় সেখানে। গ্রামীণ সংস্কৃতির অলংকার লোকগানের অফুরন্ত বৈচিত্র্যে যাওয়া-আসার অভিজ্ঞতাও তাদের জন্য সহজাত মানতে হয়। ওদিকে শিক্ষিত সমাজের হাতে সৃষ্ট লোকপ্রিয় বিনোদনের বড়ো অংশের সঙ্গে তারা পরিচিত বা সেগুলো উপভোগ করতে সমস্যায় ভোগে না। চটজলদি উদাহরণ হিসেবে ঢাকাই বাংলা সিনেমার নাম নিতে হয়। ভারতীয় হিন্দি, বাংলা পারিবারিক সিরিয়াল তাদের মধ্যেও সমান জনপ্রিয়। অপরিচিত যে-সমাজ কাহিনিসুতোর টানে সেখানে নড়াচড়া করে বেড়ায় তাদেরকে তারা ভালোই ভক্ষণ করে মনে হয়। গানবাজনার ক্ষেত্রে মমতাজ বেগম, আসিফ আকবর, মনির খান থেকে আরম্ভ করে কোলাভেরি ডি বা মানিকে মাগে হিতে-র সমতুল লোকপ্রিয় আরমান আলিফের অপরাধী টাইপের গানগুলো অনেকে গুনগুন করে দিবানিশি।
বাংলা-হিন্দি-তামিল সিনেমা আর ওদিকে বিদেশ থেকে আগত বাহারি ফ্যাশনকে সাধ্য মোতাবেক নকলের প্রবণতা ওই সামাজিক স্তরে পড়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে ব্যাপক চোখে পড়ে। শিক্ষিত সমাজের পছন্দের আইকন রবি বা নজরুলের নাম শুনেছে বা তাঁদের গান গাইতে পারে এমন লোক কিন্তু বিরল নয় সেখানে। প্রশ্ন তাই ওঠে,—হিরো আলমের সমাজস্তরে বিরাজিত মানুষগুলোর শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সই পাতানোর বিচিত্র প্রবণতার নিরিখে আলমের Artistic Gesture থেকে উৎপাদিত Content-র শানমান বাজিয়ে দেখার ভাবনা কি কারো মনে উঁকি দিয়ে যায়নি কখনো? তাঁকে খোশ আমদেদ জানাতে উতলা শিক্ষিতজনরা কাজটি করেননি বোঝা যায়। ট্রল করে মজা নেবার বাসনায় আলমকে যারা বারবার টিভিপর্দায় হাজির করেছেন তারাই-বা কেন বিষয়টি চেপে গেলেন? নাজিম শাহরিয়ার জয় বা আরো অনেকে তাঁকে প্রশ্নবাণে জেরবার করেছেন এক সময়। নিচের কথাগুলো কি কখনো আলমকে জিগ্যেস করেছিলেন তাঁরা…
মিয়া ভাই, আপনে তো ভীষণ সাকসেসফুল একটা লোক। ওদিকে ভালো গাইতে পারে কিংবা ধরেন চান্স পাইলে নাচ-গান-অভিনয়ে সালমান শাহ, শাবনূর বা এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে এরকম ছেলেমেয়ে ফেসবুক-ইউটিউব-টিকটক আর টেলিভিশনে রিয়েলিটি শো-র পেছনে রাতদিন লেগে থাকার পরেও আপনার মতো সাকসেস পায় না! কারণটা কী মনে হয় আপনার? কোন শক্তির জোরে দেশ জুড়ে আপনাকে নিয়া এতো হইচই করে লোকজন? একটু যদি খোলাসা করেন তো ভালো হয়।
ট্রল করার অসৎ উদ্দেশ্য থেকে ছোড়া প্রশ্নের উত্তর আলম তাঁর নিজস্ব ঢংয়ে ভালোই দিতেন মনে করি। অশোভন প্রশ্নবাণের চাপে আয়নায় নিজেকে নিরিখ করার কথা তিনি হয়তো একবার হলেও ভাবতেন। লোকের লাথিঝাঁটা খাইতে-খাইতে এই জায়গায় পৌঁছাইতে পারসি ভাই;—তাঁকে যারা পছন্দ করে না তাদের ট্রলের জবাব দিতে বসে রূঢ় সত্যটা ভাঙা রেকর্ডের মতো স্থানে-অস্থানে বাজানোর বাতিক হিরো আলমের মধ্যে বেশ প্রবল দেখা যায়। ট্রলকারী নিন্দুকদের উদ্দেশে নিজের শিরদাঁড়া সোজা রেখে সত্যি কথাটা তিনি হয়তো ঝাড়তেন তখন…
দেখেন ভাই, আমার মনে নায়ক-গায়ক হওয়ার শখ ছিল। চেষ্টা করসি জানপ্রাণ দিয়া। আপনারা ভালোবাসছেন তাই নায়ক হতে পারসি। গুণ যদি না থাকত আমারে নিয়া আপনার কি হইচই করতেন? এতো লোক ইউটিউবে, ফেসবুকে ফলো করতেন? একটা কিছু ঘটাইতে পারসি তাই শিক্ষিত লোক আমার গান শুনে। তারা আমার ছবি দেখে। সাক্ষাৎকার নিতে টিভিতে ডাকে। আমি কিছু পারি না, কিছু জানি না, আমার কোনো গুণ নাই…এইসব অভিযোগ কেন করেন বুঝি না! স্বীকৃতি আপনারা দিসেন। আমি হিরো আলম কোন দুঃখে দায় নিতে যাবো? আপনারাই আমারে জনপ্রিয় করে তুলসেন। আমি কি ভাই সাধে নিজ হইতে জনপ্রিয় হইসি বলেন?
নিজের দিকে ধেয়ে আসা প্রশ্নবাণকে উল্টো ফেরত পাঠানোর চালাকি রপ্ত করা হিরো আলমের পক্ষে সম্ভব হয়নি। চালাকির বাও ধরিয়ে দিতে ভক্ত-আশেকানরাও বড়ো কোনো ভূমিকা রাখেননি। আলমের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জানানো যথেষ্ট ভেবে নিজের দায় মিটিয়েছেন সকলে। সহানুভূতিশীল অনেকে আবার হিরো আলমের জাতিকে বিনোদন দানের পন্থায় Sarcastic Pleasure-র বাড়বাড়ন্ত আবিষ্কার করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন এক সময়। দেশের আপামর জনতার সঙ্গে শিক্ষিত সমাজকে Content-র সাহায্যে বিনোদিত করার অপুট চেষ্টার প্রতীকী মূল্য তারা দাঁড়া করিয়েছিলেন। আলমের সপক্ষে তাদের কথাবার্তা প্রতীকী মূল্যটাকে এভাবে সামনে এনেছিল তখন :
শিক্ষিত সমাজে উৎপাদিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্তঃসারশূন্যতাকে হিরো আলম প্রতি পদে প্রকট করে যাচ্ছেন। সমাজের এই স্তরে জন্ম নেওয়া শিল্পবস্তুর ভাষা মোটাদাগে মেকি, অসার ও প্রাণহীন। আলমের সমাজস্তরে তারা যখন চুঁইয়ে পড়ছে তখন ফাঁকিটা বোঝা যায়। এগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে আলমের মতো লোককে যে-কারণে ভুগতে হচ্ছে।
এইসব শিল্পবস্তু এমন এক ভাষার সাহায্যে বোনা হয়ে থাকে যার কপিক্যাট বা সাক্ষাৎ অনুকরণ সম্ভব নয়। কাজটা করতে গিয়ে আলমকে বারবার বিপদে পড়তে হয়েছে। এর সঙ্গে তাঁর সহবত সুগম বা সহজ ছিল না। শিক্ষিত শ্রেণির লোকদের বানানো ঢাকাই সিনেমা থেকে শুরু করে লোকরঞ্জক শিল্পবস্তুর (Popular Art) ভাষা ও বয়ান এতটাই কৃত্রিম আর আড়ষ্টতায় মোড়ানো যে বিকৃতি ছাড়া এগুলোর অনুকরণ থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। জনবিচ্ছিন্ন, সামাজিক বাস্তবতা থেকে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত এবং নিজের প্রকৃত চেহারাকে আড়াল করতে তৎপর বয়নাগুলোকে যে-কারণে ভাঁড়ামি দিয়ে পরিহাসবিদ্ধ করা উচিত। শিক্ষিত সমাজ স্বয়ং কাজটা করতে পারেনি। তাদের হয়ে আলম সেটা করে দেখাচ্ছেন। কেবল এই একটি কারণে তাঁকে সাধুবাদ জানানো অন্তিম হয়ে ওঠে।
শিক্ষিত সমাজে উৎপাদিত ও সেখান থেকে আলমের সমাজস্তরে নামতে থাকা কতিপয় শিল্পবস্তুকে নিজস্ব ঢংয়ে পরিবেশনের নামে হিরো আলম অহরহ যে-ছেলেখেলাগুলো করেন তাকে এভাবে সারকাজম (Sarcasm) বলে মহিমা প্রদান কতটা যৌক্তিক ছিল? রোদ্দূর রায়ের (*উল্লেখ্য যে নিজের নামের বানান উদ্দেশ্যমূলক কারণে রোদ্দূর এভাবেই লিখে থাকেন বলে আনন্দবাজার পত্রিকার বরাতে অদ্য জানতে পেরেছি। নিজের নামের বেলায় প্রচলিত বানানের বিপর্যয় কী হেন কারণে ঘটে সেটা অবশ্য জানা সম্ভব হয়নি। বানানে বিপর্যাস ঘটিয়ে তিনি হয়তো বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, তাঁর কাণ্ডকারখানাকে রৌদ্রালোকিত না ভেবে রোদ থেকে দূরের কিছু বলে সকলে চিনে নিক। বাংলার আকাশ-বাতাসে সংস্কৃতি ও কলাচারের যেসব রোদ অহরহ ঠিকরে বের হয় সেগুলোর সঙ্গে জুড়ি বেঁধে থাকা তাঁর মোক্সা ওরফে মোক্ষ নয়। এই রোদকে আলিঙ্গনের চেয়ে একে তফাত যাও বলাটাই বরং স্বস্তির!) ক্ষেত্রে সারকাজম-র সারবত্তা বেশ বুঝতে পারা যায়। বাঙালি সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবীতার গলদ চিনিয়ে দিতে রোদ্দূরের ভাঁড়ামি একটা লক্ষ্যস্থল ঠিক রেখে অগ্রসর হয় ও সমাজকে প্রতি পদে বার্তা দিয়ে যায়। আলমের অপুট হাতে সৃষ্ট Content ব্যবচ্ছেদের পর সেরকম কিছুর সাক্ষাৎ মিলে কি? প্রশ্নটির উত্তর কেউ করলে ভালো হয়।
আলমভক্ত সুধীজনরা তাঁকে সারকাজম-র প্রতীক গণ্য করে থেমে থাকেননি। সমাজের তলানি থেকে শিক্ষিতজনের অন্দরমহলে তাঁর অনুপ্রবেশের প্রাণান্ত প্রয়াসকে অতুল সাহসিকতা বলে রায় দিয়েছেন সবসময় :
আহা কী সাহস! লোকটা নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত সমাজের ডাট মারা মানুষগুলার ডেরায় ঢুকে পড়েছে। তাঁকে ট্রল না করে বরং সাপোর্ট করা উচিত। তাঁর পক্ষে যদি দাঁড়াতে না পারি তাহলে বিবেকদংশনে ভুগতে হবে আজীবন!
সহানুভূতির রসে জবজবে এইসব বাক্য হিরো আলমের হিরোগিরিকে বিভ্রান্ত ও বিড়ম্বিত গন্তব্যে পা রাখতে বাধ্য করেছে শেষতক। নিজের শ্রেণিক অবস্থানের জটিলতা ও সেখানে উৎপাদিত শিল্প-সংস্কৃতির ভাষাকে ভাঁড়ামি দিয়ে আঘাত করার শক্তি বা সাহস কোনোটাই নেই বুঝে হিরো আলমকে তারা পুঁজি করেছিলেন। নিজে যে-কাজটা করে দেখানোর কথা (*রোদ্দূর রায় যেমনটা করে দেখিয়েছেন।) তার ভার ওই লোকের ঘাড়ে চাপিয়ে আলমভক্ত সুধীজন তাদের বুদ্ধিজীবীতার গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে গেছেন। সত্যি বলতে কী উনাদের একটা খেলনার দরকার ছিল। আলমকে মারহাবা জানানোর ছলে অভাবটি সকলে মিটিয়ে নিচ্ছিলেন। আখেরে এতে আলমের কি লাভ হয়েছে এই প্রশ্নটা কাউকে তুলতে দেখিনি। আজব বটে!
সমাজের তলানি থেকে ভদ্রলোকের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়া আদমসুরতের লড়াইকে পিঠ চাপড়ানোর পেছনে অনেকের মনে অন্য উদ্দেশ্যও কাজ করেছে। দেশ-বিদেশের উচ্চাঙ্গ শিল্পকলা উপভোগে অভ্যস্ত সুধীজন আলমের নাচ-গান-অভিনয় সত্যি কতটা কী দেখেছেন অথবা Sarcastic Pleaure-এ বিনোদিত হওয়ার বাহানায় সহ্য করেছেন ইত্যাদির একটা তদন্ত হওয়া উচিত। হিরো আলমের অভিনয় ও সাংগীতিক কসরত কী কারণে জনউপদ্রব নয় তার ব্যাখ্যাও ভক্তকুলের কাউকে করতে দেখিনি। তারা অন্য প্রসঙ্গে ত্যানা প্যাঁচিয়েছেন মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে। আলমের শিল্প সৃজনের প্রাণান্ত কসরত ও সেগুলাকে পুঁজি করে সমাজে জাতে ওঠার চেষ্টাকে মারহাবা জানানোর পন্থাকে যে-কারণে সৎ ভাবতে মনে বাধে।
ভক্তরা সম্ভবত হিরো আলমকে ট্রল করতে ব্যস্ত উন্নাসিকদের প্রতিরোধ করার হুজুগে মেতে তাঁর সকল কার্যকলাপকে বৈধতা দিতে শুরু করেছিলেন। বৈধতা দানের ক্ষণে এই পুলক তাদের মনে কাজ করেছে সন্দেহ করি,—আলমের মতো লোকের পাশে যদি কলম হাতে দাঁড়ানো যায় তবে নিজের ইমেজ স্বয়ং তারা যে-সমাজে ওঠবস করেন সেখানকার লোকজনের কাছে আরো Bright বা Shining হয়! শিক্ষিত সমাজে স্বীকৃত সকল প্রথা ও মানদণ্ডের বাইরে বসে হিরো হতে সচেষ্ট লোকটিকে ট্রল করা উচিত নয় ইত্যাদি ত্যানা প্যাঁচিয়ে পরিস্থিতিকে তারাই ঘোলাটে করে তুলেছিলেন। সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে শিক্ষিত সমাজের কতিপয় সুধীজনের হিরোদরদি রূপে আবিভূর্ত হওয়ার Activism-কে যে-কারণে মেকি ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। প্রশ্নগুলো ওঠে :
হিরো আলমকে কেন্দ্র করে সংঘটিত পুলিশকাণ্ডে কার দায় অধিক? যারা তাঁকে রাতদিন ট্রলে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল তারা? শিল্পের শুদ্ধতা রক্ষায় বেচইন আকাট কিছু মৌলবাদীকে দায়ী করে পার পাওয়া যাবে? থানায় ডেকে তাঁকে অপদস্থ করে যে-পুলিশ তাকে নাটের গুরু দাগিয়ে নিজেকে সকল দায় থেকে খালাস ভাবা কি সম্ভব? নাকি যেসব লোকের অতি উৎসাহী Activism-র কারণে ঘটনা পুলিশ অবধি গড়িয়েছে সেই মহারথিদের দায় সেখানে সর্বাধিক?
প্রশ্নগুলো এইবেলা টুকে রাখছি ফিরে ভাবার প্রয়োজনে।
…
সমাজের যে-স্তর থেকে হিরো আলম সোজা শিক্ষিত মহলের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়েন, তাঁর সেই সমাজে বিরাজ করতে থাকা মানুষগুলোকে আলমভক্তের একাংশ অতি উৎসাহের প্রাবল্যে মার্কামারা কিছু ইমেজে বন্দি করে নিচ্ছিলেন;—অভিযোগটা কি এইবেলা অবান্তর শোনায় কানে? আলমকে জাতে তুলতে গিয়ে ওইসব মানুষকে জাতির কাছে বাজেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। হিরো আলম যদি ওই সামাজিক স্তরটাকে পরিমাপের একমাত্র মানদণ্ড হয়ে উঠেন তাহলে ভাবতে হবে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সংসারে শিল্পরুচির বনেদ অপুট হাতে বানানো অনুকারসর্বস্ব ভাঁড়ামির মধ্যেই কেবল স্বস্তি খুঁজে মরছে! ঘটনা কি সত্যি সেরকম কিছু? প্রশ্নটির উত্তর প্রার্থনা আশা করি বাচালতা গণ্য হবে না।
মামলা যদি Artistry বা কোনো ব্যক্তির শিল্পকুশলতা নিয়ে হয়ে থাকে আর হিরো আলম তার সদাগরি করার অভিলাষে ইন্টারনেটে Content অবমুক্ত করেন সেক্ষেত্রে তাঁকে ছাড় দেওয়ার কী আছে? গরিব লোকে বোঝাই অনক্ষর সমাজ থেকে উঠে আসার অজুহাতে তাঁর নায়ক-গায়ক পরিচয়কে সকল প্রশ্ন ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে লোকে ভাবতে যাবে কোন দুঃখে? বড়োলোক অনন্ত জলিলের শিল্প সৃজনের পদ্ধতিকে যদি ট্রল করা বৈধ হয়ে থাকে তাহলে হিরো আলমকে ট্রল করলে গায়ে জ্বলুনি ধরবে কেন? তাঁর সাফল্য কি তাঁকে সমালোচনা ও প্রশ্নের লায়েক করে তোলেনি? বিফল লোককে সংসারে কে পোছে? যে-লোক সফল হতে পেরেছে তার মাঝেই তো সকলে ভালোমন্দটা খুঁজে বেড়ায়। ভালো মনে করলে আতিশয্যে মাতে আবার মন্দ ভাবলে আচ্ছা মতো ঝাড়তে দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর কথা ভাবে না। ভাঁড়ামি ও কুরুচির আখড়া বলেটলে বাংলা বিনোদনশিল্পের গোষ্ঠী উদ্ধারে কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীর তকমাধারী যেসব সুধীজন রাতদিন হেঁচকি তোলেন তাদের আকস্মিক হিরো আলম প্রীতি যে-কারণে মনে ধাঁধার জন্ম দিয়ে যায়!
হিরোভক্ত বাংলার কলমজীবীরা ওদিকে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। হিন্দি সিনেমা ও গানবাজনাও তাদের পছন্দের নয়। ঢাকাই বাংলা ছিঃনেমা তো দূর কী বাত ভাইজান! বাবু খাইছো বা লোকাল বাস টাইপের গানকে তাদের জুতাপেটা করতে মন চায়। এই উনারাই আবার হিরো আলমের কাঁচা হাতে বানানো ছবি আর পদ্মার চরে আরবি পোশাক গায়ে নাচানাচির মধ্যে সারকাজম থেকে ভানভণিতাহীন শিল্পভাষার হাজির-নাজির আবিষ্কার করে বসেন! ঘটনা কি স্ববিরোধী হয়ে গেল না?
শিক্ষিত লোকের হাতে বানানো বাবু খাইছো নিম্নমানের জিনিস হলেও হিরো আলমের নাচাগানার কসরতে ভরা Content-গুলোর চেয়ে বোধ করি অধিক সামাজিক গুরুত্ব ধরে। আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত টাকাওয়ালাদের স্থূলতাকে গানটি চিনতে সহায়তা করে। টাকার গরমে অস্থির বিত্তবান সমাজের ছেলেমেয়েদের ডেটিং–ডেটিং খেলার ন্যাকামিভরা ট্রেন্ড গানে উঠে এসেছে। ন্যাকামিটা নিয়ে ফান করার ছলে বিদ্রুপ সেখানে গোপন থাকেনি। বিদঘুটে ন্যাকামিভরা এইসব ডেটিং খেলার চল ঢাকা মহানগরীর টাকাওয়ালা উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ের জীবনে বিরল ঘটনা নয়। বাবু খাইছোর ভাঁড়ামি যে-কারণে অসহ্য হলেও তাকে বাস্তবতা বিবর্জিত ভাবার সুযোগ থাকে না।
ওদিকে হিরো আলমের নাচাগানা ও প্রেম নিবেদনের তামাশা শিক্ষিত লোকজনের হাতে বানানো ঢাকাই সিনেমার ধাঁচ অনুসারেই বনতে থাকে। কতিপয় শিক্ষিত হারামিরা ওগুলো বানায় খোদ আলমের সমাজস্তরে পড়ে থাকা মানুষগুলোকে শিকার বানিয়ে টাকা কামানোর আশায়। বিবিধ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কার্যকারণে লোকগুলো স্থূল জীবনবৃত্তে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সুতরাং ছবির ভাষায় স্থূলতার প্রতিফলন অনিবার্য;—বিগত শতাব্দীর শেষ আড়াই দশকের ঢাকাই সিনেমা এরকম এক অজুহাতে পাল্টে যেতে শুরু করেছিল। আলম এখন অপুটহস্তে সেই স্থূলতাকে Copy করতে গিয়ে নিজেকে শিক্ষিত হারামিদের দাস করে তুলেছেন। বাবু খাইছো আর ওদিকে আলমের মতো লোকদের স্থূল আখ্যা দিয়ে তাদের কাছে শিক্ষিত হারামিদের তৈরি বাজে মাল গছানো,—দুটো ঘটনাই জাতির জন্য লজ্জার! বিপজ্জনকও বটে! সমাজের একটি শ্রেণির আরেকটিকে ব্যবহারের এই প্রবণতা দেশে শিল্প-সংস্কৃতির ধারাবাহিক অবক্ষয়ের ছবি তুলে ধরে। সোজাসরল ব্যাপারখানাকে জিগস পাজল (Jigsaw Puzzle) বানিয়ে আলমভক্ত সুধীজনরা কী কারণে খাবি খেতে থাকেন তার উত্তর সম্ভবত তাদের নিজের কাছেও অধরা!
আলমের পক্ষে লড়াই করতে নেমে সুধীজনরা অবিরত তাঁর কাছে সত্য গোপন করেছেন। তাঁকে উপলব্ধি করতে দেওয়া হয়নি…
ভাই রে, ভাঁড়ামি দিয়া লোক হাসাইতে গেলেও এলেম লাগে। পারফর্মার হিসেবে তুমি আর এটিএন মাহফুজ এক মাপের হইলেও মাহফুজ ব্যাটা কিন্তু পার পেয়ে যাবে। লোকের ট্রলফলকে পাত্তা না দিতে যা লাগে তার সবটা হাতের মুঠোয় নিতে পারসে এই লোক। যারা তাকে ট্রল করে তাদেরকে বাল দিয়া পোছার ঠেকা বোধ করে না সে। কেকা ফেরদৌসী যেমন নুডলস দিয়া আজব সব রান্নায় লোকে কী বলে না বলে তার পরোয়া করে না। এখন তুমি যদি ক্ষমতাটা রপ্ত করতে না পারো তবে অন্য পথে হাঁটা ভালো। ইন্টারনেটের উসিলায় যে-খ্যাতি তুমি লাভ করস সেটা রক্ষার দায়িত্ব তুমি ছাড়া অন্য কেউ নিবে না।
নিচের তলা থেকে ওপরতলায় এন্ট্রি নিতে আকুল হিরো আলমের Activism-কে বিনা প্রশ্নে ছাড়পত্র দানে মরিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীরা আর কিছু না হোক এই পরামর্শ তাঁকে দিতে পারতেন :
ভাইডি, এইবেলা বোঝার চেষ্টা করো তুমি আর ডিশ আলম নাই। ডিশ আলম থাকার দিনকালে পদ্মার চরকে মরুভূমি ভাবছ তুমি। আরবি পোশাক গায়ে দিয়া আরবি গান হয়তো গাইছ। কিছু লোক সেটা দেখসে। মজা পেয়ে হাততালি দিসে তারা। মামলা খতম। ডিশ ব্যবসার বদৌলতে তোমার মনে হইসে চেষ্টা করলে নায়করাজ রাজ্জাক, রাগী নায়ক মান্না অথবা বুইড়াকালে পিরিত করতে ওস্তাদ শাহরুখ খান হওয়া কঠিন ব্যাপার না। বন্ধুদের সামনে মহড়াটা তুমি দিসো হাজারবার। তারা মজা পাইসে, তুমিও মজা পাইসো। মামলা ডিশমিশ। তুমি একখান স্বাধীন আদম ওই সময়। তোমার স্বাধীনতায় নাক গলাবে তেমন বাপের ব্যাটা তখনো ধরায় জন্ম নেয় নাই।
ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়ার দিনকাল হইতে পরিস্থিতি খারাপ বলতে পারো। লোকে তোমার কাজকারবার দেখে মজা পাইতে শুরু করসে। চড়চড় করে দাম বাড়তে আছে তোমার। শুনতে পাই চারশো মিলিয়নের বাজারমূল্য তৈরি হইসে Content-র। ঘটনা ভালো না ভাই। এখন থেকে একশো হাজার বায়না আর অভিযোগ নিয়া লোকজন তোমারে ফলো করবে। কেউ তাল গাছে উঠাবে আবার বদ ও হিংসুকরা পারলে ন্যাংটা করে ছাড়বে। দুই পার্টির লড়াইয়ের ফাঁক দিয়া সরকার ও পুলিশ একলগে তোমার উঠানে কেমনে ঢোকা যায় তার উপায় ঢুঁনবে। মনে রেখো, খেলাটা জমে ক্ষীর হবে তখন!
সংস্কৃতির একখান সরকারি সুরত দুনিয়া জোড়া আছে ভাই। নিজের বাড়িতে (*যেমন ধরো বাথরুমে বসে কাম সারতে সারতে হেড়ে গলায় বড়ো নায়ক-গায়ক-কবি-লেখকদের গোষ্ঠীনাশ।) বসে যা ইচ্ছা করতে পারো, হিটলার মামাও সহজে মাইন্ড খাবে না তাতে। ভাইরাল হলে কথা ভিন্ন। সরকার তখন ফলো করতে শুরু করবে।
তুমি কিছু টের পাইবা না কিন্তু পদে-পদে তোমায় ফলো করবে সে। তুমি এখন কয়েদি রে ভাই। যদি জানে বাঁচতে চাও তবে এটিএন মাহফুজ বা অনন্ত জলিল হও জলদি। মাহফুজ ও জলিল যদি হইতে না পারো তবে সেই কামে মন দিতে হবে যার ধাক্কায় লোকে খামোশ হবে। কথা বলার হিম্মত থাকবে না কারো। তোমার ক্ষমতাকে তারা সেলাম করবে বারবার। তুমি এখন যে-কাম করতেসো তা দিয়া কিছুদিন লোক হাসাইতে পারবা। তার দৌড় ওই পর্যন্ত। শিক্ষিত লোকগুলা সেয়ানা। তাদের মতো হইতে না পারলে তুমি টিকতে পারবা না বেশিদিন। শিল্প বইলা মানতে চায় না এমন লোক তোমার জিনা হারাম করে ছাড়বে।
তুমি কতটা দৌড়াইতে জানো তার ওপর তোমার হিরোগিরি নির্ভর করতে আছে। যদি বুঝো এটিএন মাহফুজ হওয়ার মতো পুঁঞ্জিপাট্টা নাই তবে পলিটিক্সকে হাতিয়ার করতে পারো। রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়া ইলেকশনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। কপালগুণে যদি এমপি হইতে পারো তবে পুলিশের সাধ্য নাই জনউপদ্রব-র মামলায় থানায় ডাকে। এমপি যদি না হইতে পারো ওয়ার্ড কাউন্সিলার বা উপজেলা চেয়ারম্যান হও অন্তত। লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই তাতে। তুমি এখন ক্ষমতার স্বাদ পাইসো! শখ পুরা করার মওকা নিজে করে নিতে পারবা। ওদিকে বদের হাড্ডি যে-লোকগুলা তোমারে ট্রল করবে তাদের বাল দিয়া না পোছার শক্তি মনে হবে গায়েবি উপায়ে দেহে ভর করসে।
হিরো আলম দরদিরা এইসব পরামর্শ তাঁকে না দিলেও মার্ক করা প্রয়োজন, মাজার জোর বাড়াতে আলম স্বয়ং বিগত নির্বাচনে এমপি পদে খেলতে নামার সাহস দেখিয়েছিলেন। নির্দলীয় হওয়ার কারণে তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি। সরকারি গুণ্ডারা পয়লা চোটে তাঁকে মাঠছাড়া করে। চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন শোনা যায়। এফডিসিতে চতুর ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ জায়েদ খান যে-হিংটিংছট মন্ত্রের জোরে চেয়ারে টিকে থাকে, বেচারা আলম সেই মন্ত্র না জানায় সেখান থেকে তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল।
হিরো আলমকে যারা সোজাসরল লোক বলে নাম্বার দিতে খেপে উঠেন তাদের বোধহয় স্মরণ রাখা উচিত হয়,—তাঁর এই সারল্য বোকামির নামান্তর ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। যে-সমাজ থেকে লড়াই করেটরে তিনি এতদূর উঠে এসেছেন, এখন তাঁকে যদি ওই সমাজের প্রতিনিধি ভাবি সেক্ষেত্রে আলমের আকাট সারল্য তলানিতে পড়ে থাকা মানুষগুলাকে ছোট করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপকার সাধন করেনি। শুনতে খারাপ লাগলেও তিক্ত সত্যটি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় দেখি না।
…
শিক্ষিত সমাজের সংস্কৃতিচর্চায় বিচিত্র প্রকারভেদ চোখে পড়ে। উচ্চাঙ্গের শিল্পকলা থেকে মেকি ও গড়পড়তা অনেক কিছুই সেখানে উৎপাদিত হয়। নিজের অভিরুচি অনুসারে তারা সেগুলো উপভোগ করেন। উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-সংগীত-নৃত্যকলা বা চলচ্চিত্র যেমন সেখানে উৎপাদিত হয়, সমাজের নিচেরতলায় সচল সংস্কৃতির বিচিত্র নমুনাকে নিজস্ব তরিকায় পরিশীলন ও উৎপাদনের কারবার চলে সমানে। রবি-নজরুল-লালন-করিম থেকে আপামর লোকসংস্কৃতিটাও আকসার ব্যবহৃত হয় সেখানে। ঢাকাই সিনেমা তো আছেই, তার সঙ্গে তাল দিয়ে নান্টু ঘটক, বাবু খাইছো বা অপরাধী টাইপের সংগীত এই সমাজবৃত্তে অবিরত জন্ম নিতে থাকে। উচ্চাঙ্গ, গড়পড়তা ও নিম্নমানের বুদ্ধিজীবীতার সঙ্গে বিচিত্র ভাঁড়ামি পরস্পরের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেখানে বাড়ে সবিরাম। শিল্পরুচি ও ভোক্তা-বৈচিত্র্যের কারণে মান যেমন হোক, জাতির কাছে তাকে অবমুক্ত করার ক্ষণে শিক্ষিতজনরা জটিল হিসাবনিকাশে ভর করে তবে আগে বাড়েন। এরকম এক সমাজে হিরো আলমের অনুপ্রবেশ চটকদার ঘটনা হলেও তিনি সেখানে হিরো নয় বরং দাসত্ব করতেই ঢুকেছিলেন। জটিল এই সমাজে Artistry-র নমুনা নিয়ে প্রবেশের ক্ষণে নিজের চিরচেনা সমাজস্তর থেকে কিছু ধার করার ভাবনা তাঁকে উতলা করেনি! কেন করেনি এই প্রশ্নের মধ্যে তাঁর আপাত সাফল্যের বীজ নিহিত ছিল।
সোজাসরল হিরো আলম শ্রেণিচরিত্র বিচারে পেটি বুর্জোয়া হতে চেয়েছেন;—কথাটা নিঃসঙ্কোচে টুকে রাখা প্রয়োজন। যুগের মতিগতি বিবেচনায় তাঁর এই চাওয়াটা কোনো অপরাধ নয়। শিল্পবিপ্লবের যুগ থেকে আপামর বিশ্বে ব্যাপারটা কমন বলা চলে। ডিশ ব্যবসায়ী রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ তাঁর জন্য সহজ ছিল না ধারণা করি। খাটনির সঙ্গে সামাজিক গঞ্জনা ও উপেক্ষার শিকার হয়েছেন;— কথাটি এখানে আর না তুললেও চলছে। টাকার মুখ দেখার কারণে পরের ধাপে গমনের স্বপ্ন তাঁকে হাতছানি দিতে শুরু করে। সেখানে গমনের সময় নিজের জীবনস্তরে সক্রিয় দারুণ সব সাংস্কৃতিক নজিরকে তিনি গা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলেন। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল এসব দিয়ে পরের ধাপের লোকজনের মন টানা যাবে না। সুতরাং খালি ঝোলা কাঁধে পরের তলায় তিনি এন্ট্রি নিলেন! ঠনঠনে ঝোলাটা বোঝাই করতে ওই তলার নিচের ধাপে যেসব জনপ্রিয় শিল্পবস্তু হামেশা উৎপাদিত হয় ও পাবলিক গোগ্রাসে গিলে সেগুলা টোকানোর মিশনে যোগ দিলেন এবার।
সমস্যা হলো টোকানোর কাজটা ভালো করে সারতে হলে কিছু এলেম থাকা জরুরি হয়। যেমন ধরা যাক, মানিকে মাগে হিতে-কে যদি কেউ নিজের গলায় তুলতে যায় সেক্ষেত্রে গায়কিশক্তি একটা মানের হওয়া প্রয়োজন। প্রাকৃতিক কিংবা খোদার দানে গানের গলা আর সুর ধারণের ক্ষমতা যদি কারো থাকে তো ভালো, না থাকলে খাটাখাটনি ও Knowledge Gain কাজে দিতে পারে। হিরো আলমের শিল্পযাত্রায় এসবের বালাই ছিল না। তাঁর কসরত তাই উদ্ভটরসের যোগান দিলেও লোকে একে ঠাট্টা-তামাশার খোরাক ভেবে মজাই নিয়েছে বেশি। সারকাজম-র সুধীজন-কল্পিত কিছু তারা সেখানে খুঁজে পায়নি।
ইন্টারনেটে অবমুক্ত এইসব Performing Artpiece-কে নিছক রগড় ভেবে উপভোগ করতে সমস্যা নেই। ইচ্ছে করলে সেটা যে-কেউ করতে পারে। মানুষের জীবনে উদ্ভটরস সময়-সময় অন্তিম হয়। এই রসে বিনোদিত লোকজন রসদাতাকে ট্রল ও রোস্টিং করে এক ধরনের নিষ্ঠুর মজা পায়। ট্রলটা উদ্ভটরসে নতুন মাত্রা যোগ করে সেখানে। রসদাতাকে জনপ্রিয় হতেও সাহায্য করে খানিক। আলমকাণ্ড এ-অবধি চলতে থাকলে অসুবিধার কারণ ছিল না। তাঁকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হুজুগ কিছুদিন বাদে আপনা থেকে বাসি হয়ে যেতো। নিজের দৌড় বুঝে ফেলার কারণে আলমও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়তেন। Artpiece থেকে কামানো টাকাপয়সায় ভদ্রসমাজে গাড়িবাড়িফ্লাট কিনে সাধারণ নাগরিকের জীবনধারায় ফেরত যাওয়া তাঁর কাছে শোভন মনে হতো তখন। বিধিবাম বলতে হয়, মোদের অতি-উৎসাহী হিরোদরদিরা সেটা হতে দেবেন না বলে পণ করে বসেছিলেন, যার ফলাফল এই পুলিশকাণ্ড! আলগা দরদটা হিরো আলমের উপকার না করে উল্টো সর্বনাশের কারণ হয়েছে;—মন্তব্যের আকারে কথাটা টুকে রাখছি ফিরে ভাবার প্রয়োজনে।
…
বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে হিরো আলমের সমতুল স্তর থেকে কাঠখড় পুড়িয়ে অনেকে চূড়ায় আরোহন করেছেন। তাদের সঙ্গে এইবেলা আলমের আসমান-জমিন ফারাক চোখে পড়ে। চূড়ায় আরোহনের লক্ষ্যে অগ্রসর লড়াকুরা তাদের ওপরতলায় বিরাজিত শিল্পবস্তুর বিশেষ পরোয়া করেননি। নিজের সমাজে যা-কিছু কুড়িয়ে পেয়েছেন সেগুলোকে হাতিয়ার করে সদর্পে পথ ভেঙেছেন তারা। লোকের নজর ও আদর কাড়তে সমস্যা হয়নি মোটেও। তবে হ্যাঁ, ওপরতলায় সক্রিয় Art-Form কাজে লাগানোর বিদ্যা রপ্ত করার আগে নিত্যনতুন উপায়ে সেগুলোকে হাজির-নাজিরের কথা লড়াকুদের কেউ ভুলেও ভাবেননি। হিরো আলমের সমস্যা এই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে গুরুতর মানতে হয়।
শিক্ষিত সমাজে জায়গা করে নিতে সব পারতে হবে সব করে দেখাতে হবে এরকম ভাবনার ফাঁদ থেকে নিজেকে বের করার তাগিদ তাঁর মনে কাজ করেনি। মাথা ঘোরানো জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাল দিয়ে চলতে থাকা ট্রলের মোকাবিলায় ময়ূরপুচ্ছধারী কাউয়ার বেশ ধরতে ভক্তজনরা তাঁকে কমবেশি উৎসাহ দিয়ে গেছেন! এখন লেজে আগুন লাগার বেলায় লোকটাকে বাঁচানোর মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার বোধ হচ্ছে। শিক্ষিত লোকের সমাজে না উঠলে তাঁর জাত খোয়া যাবে কোন দুঃখে?—চড়াই-উৎরাই পার হয়ে টাকাপয়সার মুখ দেখার পর থেকে প্রশ্নটা তিনি নিজেকে করার সুযোগ পাননি বলে ধরে নিতে হচ্ছে। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরাও তাঁকে সেটা ধরিয়ে দিতে কৃপণতা করেছেন।
রবিগানে গমনের ঘটনা আন্দাজ করি সব পারতে হবে-র নেশা থেকে হিরো আলমের মস্তিষ্কে গেড়ে বসেছিল। ট্রলকারীদের এক হাত দেখে নেবার বাসনা সেখানে ঘি ঢেলে থাকতেও পারে। ঘটনা বৈপ্লবিক হলেও এর ভার সহ্য করার মতো মাজার জোর পরখের কথা তিনি ভাবেননি। একজন রোদ্দূর রায় এখানে পৌঁছে মোদের হিরো আলমকে মাইল-মাইল পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন। রোদ্দূরের বড়ো সুবিধা, তাঁর জন্মকর্মের সবটাই শিক্ষিত সমাজে ঘটেছিল। মেধাবী ও শিক্ষিত। সমাজ-মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন শোনা যায়। পেশায় প্রযুক্তিবিদ ছিলেন এক সময়। জানাশোনার পরিধিটা তাঁর ক্ষেত্রে ব্যাপক। যে-সমাজকে নিয়ে তিনি রগড় করতে চাইছেন তার হাড়মাস চিনতে তাঁকে তাই সমস্যায় পড়তে হয়নি। তিনি কী করতে চাইছেন অর্থাৎ লক্ষ্যটা শুরু থেকে মস্তিষ্কে ছকে নিতে পেরেছিলেন। রবি-নজরুলসহ বাঙালি সংস্কৃতির ট্রেন্ডগুলোকে চাঁদমারি বানিয়ে তাঁর মোক্সাবাজি নিতান্ত ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক ছিল। বাংলাদেশের পাড় হিরোভক্তরা ছাড়া আবালও এখন সেটা বোঝে।
মার্কিন ও ইংরেজ সমাজে খেটে খাওয়া শ্রেণি থেকে আগত পাঙ্ক গানের দলে শামিল শিল্পীরা এক সময় হাড়হিম যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছিল তার সঙ্গে রোদ্দূরের মোক্সার খানিক মিল চোখে পড়ে। পাঙ্করা নিজের দেহ থেকে শুরু করে গান গাওয়ার রীতিনিয়মে ব্যাপক ভাঙচুর করেছিল তখন। সমাজের সঙ্গে সংলাপ ও গান গাওয়ার মাঝে যেসব দেওয়াল বিরাজ করে সেগুলো তুলে দিতে তারা মরিয়া ছিল। গানের কথায় কোনো আড়াল থাকবে না। সুর ও বাদনে রক গানের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করে আসুরিক দ্রুতলয় ও চিৎকার সংযুক্ত হবে। গান গাওয়ার সময় পোগো ডান্স-এ (Pogo Dance) মাতোয়ারা শ্রোতার সঙ্গে গায়কের হাতাহাতি, মারামারি সবটাই চলবে সেখানে। গানের পরিবেশনায় বিচিত্র নৈরাজ্য জুড়লেও কিমাশ্চর্যম উপায়ে মর্মঘাতি এক সংবেদন তারা সৃজন করে নিয়েছিল। যে-কারণে সাদা সায়েবদের দুনিয়ায় পাঙ্কটা যুগের অমানিশায় মৃত হলেও গভীর আবেদন রাখতে সক্ষম হয়েছিল সেই সময়। রোদ্দূর রায় বোধ করি বাঙালি ভদ্রসমাজকে খানিক সেই কায়দায় ডাণ্ডাপেটার কাজে নামেন এইবেলা।
নাগরিক সুধীজনের শিরদাঁড়ায় নৈরাজ্যের উৎপাত জুড়তে রোদ্দূরকে বেশি খাটতে হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে মোক্সা করায় জেল খাটছেন অদ্য। পুলিশ যখন তাঁকে চৌদ্দ শিকের ভিতর চালান করছেন তখন এই লোকের চেহারা বা হাভভাবে ডরভয়ের লক্ষণ দেখা যায়নি। কারাগারে ঢুকেছেন মাথা উঁচু করে। ভিক্টরি সাইন শো অফ করতে-করতে। কারাগার থেকে বের হওয়ার দিনে ঘটনার অন্যথা ঘটবে না সেটা নিশ্চিন্তে বলা যায়। হিরো আলম এই ভাগ্য করে ধরায় আসেননি। সুতরাং রবি ঠাকুরে গমনের পরিণাম তাঁর বেলায় অনুমিত ছিল। পুলিশকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যার আপাত সমাপতন ঘটেছে মাত্র!
হিরো আলম আবার সেফুদা-র মতো Raw বা সোজা বাংলায় চাঁছাছোলা টাইপের লোক নন। সেফুর শব্দবোমা শুনে লোকে কানে আঙুল দিয়ে আমোদে হাসে আবার ওইসব শব্দবোমার আবডালে নিহিত সত্যকে মেনে নিতে দ্বিধা করে না। যার ফলে বাংলাদেশের গলাপচা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গালে চড় কষানোর কামে সেফুর খিস্তিখেউড় সামান্য হলেও উপকার সাধন করে। তাঁর বড়ো সুবিধা তিনি অস্ট্রিয়ায় থাকেন। তাঁকে থানায় ডেকে টাইট দেওয়া সম্ভব নয়। হিরো আলম এদিক থেকেও দুর্ভাগা। এমতাবস্থায় রবি ঠাকুরকে নিজের গলায় তুলে আনার ব্যাপারে খানিক বিবেচনা বোধহয় তিনি করলে পারতেন।
কপিরাইটের খড়গ শিথিল হওয়ার সঙ্গে যুগবদলের হাওয়া মিলে রবিকে ইচ্ছামতো গাইতে বাধা নেই। বাথরুম থেকে ইন্টারনেটে সুরে-বেসুরো কাণ্ডটা অনেকে আজকাল করে থাকেন। বাথরুমে সমস্যা নেই তবে ইন্টারনেটের মতো খোলা ময়দানে কেউ যখন গাইতে যাবেন লোকে মাস্তি ও রাগ দুটাই সমান উগড়াবে সেখানে। মাস্তিকে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে এ্যালাউ করি তবে সংক্ষোভকে এ্যালাউ না করে গতি থাকছে না। নেটে হিরো আলমের রবিগানের কসরত শুনে যারা ভীষণ চটেছেন তারা হয়তো শুচিবাইয়ে আক্রান্ত লোক। তাদেরকে যুক্তি সহকারে খণ্ডন ও গালমন্দ করা যেতে পারে কিন্তু হিরো আলমকে তারা ট্রল বা আইনি নোটিশ পাঠাতে পারবেন না এই যুক্তিটা ভীষণ খোঁড়া শোনায় কানে। ঘটনা যদি আদালতে গড়ায় সেক্ষেত্রে বিচারককে প্রভাবিত করার প্রয়োজনে হলেও হিরো আলমকে আগে রবিগানের ব্যাপারে নিজের জানাশোনা ও চর্চার প্রমাণ দিতে হবে। যদি সেটা দিতে না পারেন, ধরে নিতে হবে ইন্টারনেটের মতো খোলা ময়দানে কী করে খেলতে হয় সে-ব্যাপারে তিনি ও তাঁকে সুরক্ষা দিতে তৎপর সুধীজন বিলকুল আনাড়ি আদম।
আবারো বলি, ইন্টারনেট কারো বেডরুম নয়। শয়নকক্ষ হিসেবে চাইলে ব্যবহার করা যায় কিন্তু সবাই দেখতে পারবে এই অনুমতি দিয়ে দিলে যেমন খুশি সাজার আগে চিন্তাভাবনা করা সুবুদ্ধির পরিচয়। হিরো আলম একুনে চারশো মিলিয়নের বাজারমূল্য যদি সত্যি ধারণ করে থাকেন সেক্ষেত্রে তাঁকে সহানুভূতি, দয়াদাক্ষিণ্য বা ক্ষমাঘেন্না করার কিছু নেই। রবির গানকে আর সবার মতো আলমও বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে নেটে উপস্থাপন করছেন। তাঁর গান দিয়ে টাকা কামাবেন আবার আমি ভাই না বুঝে গেয়ে ফেলসি বলবেন,—ফান্দে পড়ে ডুয়াল গেম খেলার চেষ্টায় রাবীন্দ্রিক মৌলবাদীরা গলতে যাবে কোন দুঃখে? মর্মান্তিক হলেও প্রশ্নটা নিয়ে ভাবনা করা প্রয়োজন।
…
রবিগানের ব্যাকরণ রপ্ত করে গাওয়া বা তার মধ্যে ভাঙচুর ঘটানো এক কথা আর ব্যাকরণ বোঝার আগে কালাপাহাড়ি কাণ্ডে নামা পৃথক ঘটনা। রবি-নজরুল থেকে এ-যাবত যত গান পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে তার কোনোটার ক্ষেত্রে কালাপাহাড়ি এ্যালাউড নয়। ব্যাকরণ জেনে ভাঙচুরের ঘটনায় খোদ রবিভক্তের কিছু মনে করার কারণ থাকে না। তবু কেউ মাইন্ড করে বসলে তাকে মোকাবিলার শক্তি আপনা থেকে নিজের মধ্যে জন্ম নেয়। জর্জ বিশ্বাস ওরফে দেবব্রতর নাম নিতেই হচ্ছে এইবেলা। এতো বড়ো মাপের একজন গায়ক ছিলেন তবু রবিগানকে স্বীকৃত ছকের বাইরে গাইতে থাকায় রাবীন্দ্রিক মৌলবাদীরা তাঁর ওপর খাপ্পা ছিলেন। গালিগালাজ ও শাপশাপান্ত সইতে হয়েছিল বিস্তর। বিজয়ীর হাসিটা অবশ্য দেবব্রতই হেসেছিলেন শেষতক।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো প্রখর শ্রেণিসচেতন সুগায়ক সংগীতবোদ্ধা দেবব্রতকে আপসপন্থী, উন্নাসিক ও রবিগানের ব্যাপারে সবজান্তা ইত্যাদি বলে কামান দেগেছিলেন এক সময়। অভিযোগের উত্তর করতে বসে দেবব্রত তাঁর স্বভাবসুলভ বাঙাল ভাষায় একখানা পত্র লিখেছিলেন। সেই পত্রের অংশবিশেষ উদ্ধৃতির লোভ সম্বরণ করা যাচ্ছে না। হেমাঙ্গের উদ্দেশে দেবব্রত লিখছেন :
আৎকা তুমারে এই চিঠিডা ল্যেখলাম — কারণডা পরে জানাইতাছি। বুধয় মাসখানেক আগে তুমি আমার ঘরে আইয়া দর্শন দিছ্লায়, কামপুচিয়ার ব্যাপারে কী উগলা কাগজে আমার সই লওনের লাইগ্যা। সইডা দেই নাই। তুমারে কইছ্লাম যে নিজের দ্যাশের লাইগ্যাই কুছতা করতাম পার্লাম না, কামপুচিয়া দিয়া কিতা কর্বাম্? বুঝছিলাম তুমি আমার উপ্রে ব্যেশ্ গুশা কইরা গেলায় গিয়া। তবে হেইদিন বুঝতাম পারি নাই যে তুমি কইলকাত্তার রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ময়দানে শহীদ মিনারের উপ্রে উইঠ্যা পরছ। অখনে আমার খুব ডর্ লাগতাছে, সইডা দিয়া দিলেই অইত ভালা—কারণ যদি ভবিষ্যতে সরকারী ক্ষেমতা কিছু তুমার কান্ধে আইয়া পড়ে তইলে আমার অবস্থা ভুট্টো সাহেব। তবে আমার একটু আশা আছে তুমি ক্ষেমতা পাওনের আগেই আমি ভবনদী পার হইয়া যাইবাম্।…
কয়েক বছর আগে তুমি আমার ঘরে আইয়া কইছ্লা যে নির্মলেন্দু চৌধ্রী তুম্রার লুকসংগীতের বারডা বাজাইয়া দিতাছে। তুমার নিশ্চয়ই মন আছে যে তুমারে কইছলাম্ যে নির্মলেন্দু ঠিক কর্তাছে। তার ত গান হুনাইয়া প্যেট্ চালানি লাগব—সিলেটের লুকসংগীত হুনাইয়া সুবিধা অইত না — হেই লাইগ্যা তারে ফোকো-জাজ্, ফোকো-ফক্সট্রট, ফোকো-পপ বানাইয়া শ্রুতাধারে খুশী কইরা প্যেট চালানি লাগব। তুমি যে লুকসংগীত গাও হেইডা যে অরিজিন্যাল্ এবং বিশুদ্ধ লুকসংগীত তার কুনু গ্যারান্টি তুমি দিতা পারবা? দুইশ বছর আগে তুম্রার দ্যাশের লুকসংগীত কি ভায়্ গাওয়া অইত তার কুনু রেকর্ড বা স্বরলিপি তুমার কী আছে?…
মন আছে তুমার? সংস্কৃতি সংসদ থেইক্কা আমারে উগলা বই পাঠানি অইছে। হেই বইয়ে দ্যাখলাম বিজনের স্মরণ-সভায় সভাপতি অইয়া বিরাট এক সুচিন্তিত ভাষণ দিছ। বিজনের স্মরণসভায় ত বিজনের কথাই তুমার কওন উচিৎ—কিন্তু দ্যাখলাম আমারে খুব গাইল্ল্যাইছ। সংস্কৃতি-সংসদে প্রকাশিত তুমার ভাষণ হাছা না মিছা আমি জানি না। তুমি কইছ্লায়—‘(১) জর্জদা খুব সিনিক্, (২) ভাবাও যায় না—যে লোকটা মোটর সাইকেলে দৌড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়ে প্রমাণ করতে চাইত যে রবীন্দ্রসংগীত লোকে বোঝে, শ্রমিকরাও বোঝে ও ভালবাসে, (৩) সে লোকটা আজ গণ-নাট্যের নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে।’
১ নং ব্যাপার—তুমি এ্যাংরাজী ভাষা কৎখানি হিখছ আমি জানি না। ‘সিনিক’ কথাডার অর্থ ডিকশনারিৎ পাইবায়—(ক)disinclined to recognise goodness, (খ)sneering fault-finder।…
খ) আমার নিজের দুষ্ ছাড়া অন্য কুনু মাইনষের দুষ্ ধরনের লাইগ্যা আমি লেকচার দেইনা। সুতরাং তুমি যে ক্যারে আমারে ‘সিনিক’ উপাধি দিয়া গাইল্ল্যায়লায়—বুঝলাম না।
২ নং ব্যাপার—আমি কুনুদিন প্রমাণ কর্তাম চাই নাই যে রবীন্দ্রসংগীত ব্যেবাকেই বুঝে এবং ভালবাসে—বরং আমি কই আমি নিজেই অনেক রবীন্দ্রসংগীতের গুপন অর্থ ও ভাব বুঝি না। তুমি কইত্থে এই তথ্য আবিষ্কার করলায় বুঝলাম না।
৩ নং ব্যাপার—গণনাট্য আন্দোলনে ভিড়্যা পর্ছিলাম উগলা ব্যাপার বিশ্বাস কইরা—হেইডা অইল—গণচেতনা উদ্বুদ্ধ কইরা দ্যেশে বিপ্লব আনন্। কিন্তু বহু বৎসর পরে দ্যেখলাম আম্রার subject matter made in Calcutta and Bombay লইয়া, গ্রামেগঞ্জে হাডেমাডে গান গাইয়া, ‘শহীদের ডাক’ দেখাইয়া জনগণের মধ্যে আধ ইঞ্চিও penetrate কর্তাম পারি নাই। তার কারণ আমার মন হইছিল নানান্ জিলার, নানান্ গ্রামের নানান্ ভাষা, আদব্ কায়দা, আচার ব্যবহার জানন লাগব—হেইডা করতে অইলে নানান্ গ্রামে গিয়া থাকন্ লাগে—গ্রামের জনগণের লগে থাইক্কা হিখন্ লাগে। কইলকাত্তায় চাকরী কইরা হেই সুযোগ পাই নাই। সুতরাং জনগণ যেইখানে আছিল হেইখানেই আছে। খামাখা ভুল পথে গিয়া পর্ছিলাম। নিজের ভুল স্বীকার করছি। গণনাট্যের নাম শুনলেই আমি ক্ষেইপ্যা উঠি কইয়া কী আমার উপ্রে সুবিচার কর্লায়? [উৎস : বাম পতনের শব্দ হয়, ইন্টারেনট]
রস-পরিহাস মাখানো দেবব্রতের পত্রাঘাত বাঙালি শিক্ষিত সমাজের বুদ্ধিজীবীতার মৌল সমস্যাকে আরেকবার যেন-বা চিনিয়ে যায়। কলকাতা মহানগরীর রবিপ্রেমিকদের তলায় সুড়সুড়ি দেওয়ার মিশনে রোদ্দূর রায় যবে প্রথম-প্রথম কাণ্ডটা শুরু করেন লোকে তাঁকে ধুয়ে দিতে বাকি রাখেনি। আঘাতের লক্ষ্যস্থল ও ফিলসফি পরিষ্কার করতে পারায় কতিপয় আকাট রবিভক্ত ছাড়া বাকিরা তাঁর ব্যাপারে এখন নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছেন। হিরো আলমের সেরকম কোনো লক্ষ্যস্থল বা ফিলসফি না থাকায় তাঁর গানবাজনার কসরত লোক হাসানো কাণ্ডের অতিরিক্ত কিছু Mean করে না। সত্যটা স্বীকার করে নিলে সকল ল্যাঠা চুকে যায়। লোক হাসানো কাণ্ডে আলমের বাজারমূল্য বেশ চড়া হলেও লোকজন এই টাইপের ভাঁড়ামিতে বেশিদিন আমোদ বোধ করে না। তারা অচিরে ক্লান্ত হবে ও নতুন ভাঁড়ের সন্ধানে নেটদুনিয়া চষতে থাকবে। কাঁচা বাদাম কাকুর মতো কেউ হয়তো হিরো আলমের জায়গাটি আস্তে-আস্তে দখলে নেবে।
এই জায়গা থেকে ভাবলে পুলিশ কাজের কাজ করেছে মানতে হয়। হিরোকে প্রথম কেউ বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ভাইরে, তুমি মানো আর না মানো সমাজে বিচিত্র কিসিমের লোক গিজগিজ করে। তোমার কাছে যাকে সারল্য বা ফ্রিডম মনে হচ্ছে আরেকজন সেটাকে উপদ্রব ভেবে খেপে লাল হতে পারে। দুই পক্ষের মান বজায় রাখা পুলিশের কাজ। হিরো আলমের Facial Expression ও কথাবার্তা থেকে বোঝার বাকি থাকেনি, যারা তাঁকে নানান সময় পুছতাছের নামে ত্যক্ত করেছে সেই লোকগুলোর চেয়ে পুলিশ বরং বাতচিতের সময় সিরিয়াস ছিল। বিষয়টি পাঠক খেয়াল করলে ভালো হয়।
আলমকে নিয়ে তারা মজা নিতে যায়নি। কী কারণে তিনি এইসব করে বেড়ান সেটা বোঝা শেষ হলে নিজের বয়ান পেশ করেছে। আলাপ চলাকালে ভয় ধরানোর কুৎসিত আবহ বিরাজ করলেও এই প্রথম বোধ করি হিরো আলম রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গকে সরাসরি মোকাবিলা করলেন। Very Professional Indeed;—আলাপের ধাঁচটাকে ইংরেজি বাক্যে দাগানো যেতেই পারে। আলমকে ব্যবহার করে টিআরপি বাড়ানোর ধান্ধা সেই আলাপে ছিল না। টিজ, ফান, মকারি এবং পুলিশসুলভ হুমকিধামকি মোটের ওপর অনুপস্থিত ছিল। যা ছিল সেটা অধিক কিছু। শুনতে খারাপ লাগলেও হিরো আলমের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা গেল পুলিশ তাঁর চোখকান খুলে দিয়েছে। নিজের সীমাবদ্ধতা ও বোকামিটা তিনি টের পাচ্ছেন। হিরোদরদি বাংলাদেশের সচেতন মহল থুড়ি কলমযোদ্ধারা কম্মোটা আগে করলে ঘটনা পুলিশ অবধি গড়ায় না।
নিজেকে বক্সার মোহাম্মদ আলীর মতো আমিই সেরা বলে ঘোষণা দিলেই তো আর হবে না। কেন সেরা তার প্রমাণ ঘোষণাকারীকে প্রতি পদে দিয়ে যেতে হয়। বক্সিংয়ের রিং ও তার বাইরে প্রমাণটা মোহাম্মদ আলী দিতে পারায় ঘোর নিন্দুকও তাঁকে কুর্নিশ ঠুকতে আপত্তি করেনি। হিরো আলম ও অনন্ত জলিল এই ব্যাপারে আকাট হওয়ার কারণে রাতদিন বিনোদন খুঁজতে মরিয়া কিছু লোকের শিকারে পরিণত হয়েছেন। এতে ইউটিউবের ভিউ বাড়ছে। টিভির টিআরপি লাফ দিয়ে ওপরে উঠছে। পত্রিকার কাটতিও হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছে খানিক! মাঝখান থেকে রবি ঠাকুর বিদ্বেষী কতিপয় বুদ্ধিজীবী তলে তলে অন্য ধান্ধায় ব্যস্ত আছেন। হিরো আলমকে অ্যানক্যাশ করে ঠাকুর নিধনের মিশনে তারা শান দিচ্ছেন এখনো। তার মাঝে আবার নিজেকে শ্রেণিদরদি কমরেড রূপে জাহির করার মওকা খুঁজছে কিছু লোক। সহজসরল হিরো আলম এইসব পলিটিক্সের কিছু না বুঝলেও জাতির সেগুলোকে ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।
রকমারি ধান্ধার আড়ালে সংবেদি গান সিনেমা কবিতারা ম্লানমুখে অস্ত যাচ্ছে। সেদিকে তাকানোর সময় কারো নেই। কেউ হয়তো চমৎকার গান বেঁধেছে, শোনার লোক নেই। হৃদয়হরা কবিতা বা ছবি এঁকেছে কেউ, আলাপের মানুষ কই? সিনেমা তৈরির জন্য খারাপ জায়গায় পরিণত বাংলাদেশে নতুন যুগের সিনেভাষা সৃজনে ক্যামেরা হাতে মরিয়া ছিল কোনো তরুণ, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার রাস্তা খোলা নেই। কত শত মকদ্দস আলম উদাসী আধপেটা খেয়ে না খেয়ে অধর মানুষকে ধরার সাধনায় নীরবে দেহ রাখছেন, তাঁদের খবর করার লোক নেই দেশে। হিরো আলম, অনন্ত জলিল, এটিএন মাহফুজ, সেফায়েত উল্লাহ সেফুর মতো বাজারকাটতি ট্রেন্ডের বাইরে বাংলাদেশে চর্চার কোনো বিষয় কি অবশিষ্ট আছে আর? পপুলার কালচার কি তবে এই একটা মার্কার মধ্যে খতম হবে বাংলাদেশে? ফ্যাসিবাদী সমাজে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যে যারা নিজের শ্রেণি ও সমাজকে পাঠ করে চলেছেন তারাও জনসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সোদর। তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে কেবল হিরো আলমদের আর কতো লাই দেবে সমাজ? প্রশ্নটা পাঠক সকাশেই রাখলাম না হয়।
অধমের কথায় অনেকের রাগ হতে পারে তবু বলা প্রয়োজন, হিরো হওয়ার নেশায় আলম টের পাননি সমাজের একদল শিক্ষিত লোক তাঁকে নিয়ে মজায় মেতে উঠেছে। এতে করে তাঁর বাজারমূল্য তৈরি হয়েছে কিন্তু নিজের সমাজবৃত্ত থেকে ধূমকেতুর মতো বাইরে ছিটকে পড়েছেন তিনি। সেখানে বিরাজিত খাঁটি প্রতিভা উঠে আসার পথ খানিক রুদ্ধও করেছেন বটে! পুলিশি হেনস্থা আপত্তিজনক হলেও তাঁকে নিজের আয়নার দাঁড় করানোর বিকল্প পথ কি খোলা ছিল দেশে? প্রশ্নটি রাখা গেল ফিরতি বক্তব্য শোনার আশায়। যদি ভুল কিছু বলে থাকি তবে নিজেকে শুধরে নিতে বিলকুল আপত্তি থাকবে না।
…
সাদামাটা চপ্পলের সঙ্গে শার্টপ্যান্ট পরিহিত হিরো আলম ভীরু পদক্ষেপে তেজগাঁ থানার চত্বরে ঢুকছেন, ছবিটা দেশের আপামর জনতা টিভিতে দেখেছেন। চোখেমুখে উদ্বেগ ও আতঙ্ক দেখে বুঝতে বাকি থাকেনি প্রায় চারশো মিলিয়ন বাজারমূল্য ধরে যে-লোক তার আত্মবিশ্বাস থানায় তলবের ধাক্কায় তলানিতে ঠেকেছে। জেরা শেষে যে-নায়ককে জনতা বেরিয়ে আসতে ও সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব করতে দেখে তার অবস্থা করুণ মনে হলো। রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনীর মোকাবিলায় কোনো ডিফেন্স লাইন লোকটার ছিল না। লাইনটা কীভাবে তৈরি করতে হয় সেই বিষয়ে তাঁকে কেউ গাইড করেনি। সবাই খালি মজাটা নিংড়ে নিয়েছে! হাওয়া খারাপ দেখে ছোবড়া ভেবে ত্যাগ করতে তাদের এখন আটকাবে না। জনপ্রিয়তা লাভের সুদিনে আলমের কোনো বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল না। রাষ্ট্রের হাতে অপমানিত হওয়ার দুষ্কালেও পাশে কেউ নেই। পুলিশকে ধন্য মানতে হয়, জরুরি আক্কেলজ্ঞানটা তারা হিরোর মগজে ঢুকাতে সক্ষম হয়েছেন।
পুলিশকাণ্ড শেষে দেশের সচেতন মহল নিজের নাকি হিরো আলমের অধিকার রক্ষায় তৎপর? প্রশ্নটি জোড়া যায় এখানে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয় নিজের ডিফেন্স লাইন তৈরির ঠেকায় সবাই হিরো বেচারাকে লাইমলাইটে রাখার তাল করছেন। হিরো আলম নিজের নামের আগে ‘হিরো’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন না;—নির্দেশনামাটি রদ করানোর মতো মাজার জোর প্রতিবাদে অনুপস্থিত। তাঁকে যারা রেনিগেড বা কাঁচা বাংলায় ছোটলোকের বৃত্ত থেকে উঠে আসা সাহসী পুরুষ ভেবে পরিতোষ লাভ করতে ইচ্ছুক, তাঁদের স্মরণ রাখা উচিত,—হিরো আলমে মোড় নেওয়ার দিন থেকে তিনি আর ছোটলোকের বৃত্তে বিরাজিত নেই। তাঁকে গরিব বলে দাগানোর কারণ অদ্য অবশিষ্ট আছে কি? ডিশ ব্যবসায়ী হিসেবে আয়-রোজগার মন্দ ছিল না। ইন্টারনেটের বায়বীয় ভুবনে হিরোগিরির সুবাদে রোজগার আরো বেড়েছে ধারণা করি। টাকাপয়সার সঙ্গে ক্ষমতার সিঁড়িতে পা রাখার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। এরচেয়ে বড়ো কথা, নিজের সমাজবৃত্তে ধুঁকতে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর সংযোগ অতীতে আলগা ছিল এবং এখনো আলগাই রয়েছে। সুতরাং বাড়তি করুণা তাঁর নিজের জন্যই উপকারী কিছু নয়।
অন্তে এসে তাঁর ওপর পুলিশি হেনস্থার জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে ক্ষোভ ও সমবেদনা জানাই। সমবেদনাটা হেনস্থার শিকার যে-কোনো নির্দোষ মানুষের জন্যই প্রযোজ্য বটে। ওদিকে শিক্ষিত সমাজের অন্দরমহলে পা রাখার দিন থেকে হিরো আলমের জাতে ওঠার প্রাণান্ত কসরতের পক্ষে-বিপক্ষে যেসব চিল্লাপাল্লা চলছে সেগুলোকে উপেক্ষা করা সমীচীন মনে করি। তাঁর সমাজের লোকগুলাকে চিনিয়ে দিতে পারছে এরকম খাঁটি জিনিস তিনি যেদিন উপহার দেবেন সেদিন নাহয় তাঁকে নতুন করে স্বাগতভাষে আলিঙ্গন করা যাবে।
ফুটনোট :
হিরো-ভণিতার বাইরে ফাউ হিসেবে আরো ‘দুটো একটা’ কথা টুকে রাখা প্রয়োজন। সঞ্চালক আশা করি ফুটনোটে সংযোজিত কথাগুলো এ্যালাউ করবেন। বলতে চাইছি, জ্বালানি সঙ্কট ও মূল্যস্ফিতির সঙ্গে আরো বহু গুরুতর অমানিশা দেশে মাথাচাড়া দিয়া উঠেছে। দিন আনে দিন খায় মানুষ তো আছেই, মাসকাবাড়ি মাইনের ওপর ভর দিয়ে যার দিন চলে সেই মধ্যবিত্ত আক্রার বাজারে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। অজগরের পেটে সেঁধিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রসংঘের মাস্তানিভরা গুলতানি। অজগরের আঠালো গহ্বরে পাক খাচ্ছে বিকট, বিদঘুটে, কুৎসিত মানুষের পাল। উদ্ধারের লোক নেই দেশে। চারিদিকে শিকে ঝুলানো পোড়া মাংসের বিকট গন্ধ! কিম্ভূতকিমাকার অজগরের পেটের ভিতরে মরণের প্রহর গুনছে সবাই। গানপার আর কিছু না পারুক, তার গলা দিয়ে যদি রক্ত ওঠে তবু মানুষের এই মরণদশাটা নিয়ে আকাশ ফাটানো আওয়াজ তুলুক একবার।
নৈরাজ্যে ফল মিলে না সে তো জানা কথা, তবু এই ঘোর নিদানে ওটা ছাড়া নিস্তেজ মানুষগুলাকে জাগানো সম্ভব নয়। তুমি কই হে মানুষ? কোথায় লুকালে এইবেলা? ‘সাড়া দাও, সাড়া দাও / উদাসীন থেকো না, সাড়া দাও।’ ওই দেখো, সাড়া দিতে গিয়ে কবেকার ইংরাজ ছোকরা ইয়ান কার্টিস কবর হতে উঠে এসেছে। দেহে খিঁচুনিভরা বিগার নিয়ে গান গাইতে মঞ্চে উঠেছে সে। সময়টা তার এবং তার গানের খিঁচুনি আক্রান্ত মেয়েটির মতো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে;—গানে কথাটা বলার ক্ষণে কার্টিস স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারছে না। তার দেহে খিঁচুনির বেগ প্রবল হয়েছে। বেশিক্ষণ পারবে না গাইতে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়া গায়কের হয়ে অন্য কেউ কথাটা গুলি করুক তবে।
কার্টিস ও তার গানের মেয়েটি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বারবার মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে! তাদের দেহে সাড়া নাই। দুজনেই মারা গেছে বোধ করি। খিঁচুনির বেগ ফের দেখা দিলে জাগতেও পারে। গানের মেয়েটি তখন কার্টিসকে বলবে হয়তো, ‘আমি মরি নাই তবে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতেসি না। চেষ্টা করতেসি কিন্তু পারি না!’ মেয়েটির কথা শুনতে-শুনতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কার্টিস গাইছে : Confusion in her eyes that says it all/She’s lost control…/ And she screamed out, kicking on her side,/ and said ‘I’ve lost control again’/And seized up on the floor, I thought she’d die/She said, ‘I’ve lost control.
বারবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাটা কেউ বলুক গানে অথবা কবিতায়। বলতে যদি না পারে তবে সিড ভিশাসের মতো আকাশ ফাটানো চিৎকার জুড়ুক, ‘God save the queen/The fascist regime’। নেশায় চুরচুর পাগলা সিড ভিশাস খেটে খাওয়া সমাজ থেকেই উঠে এসেছিল একদিন। পাঙ্ক ভিশাস হেজেমরে ভূত হয়েছে কবে! দ্য সেক্স পিস্তল নামের গানের দলটা এখন বেতো ঘোড়া। সিডের গানের কলি ধার করে কেউ অন্তত বলুক, — পৃথিবীর সকল রাজা-রানীকে আল্লা যেন বাঁচিয়ে রাখেন! রাজারানীদের প্রতি শুভাশিসটা গুলি করুক একালের গায়ক-লেখক। পুলিশ হয়তো শুভাশিসের অন্য মানে করে কবি বা গায়ককে জেলের চৌদ্দ শিকেয় ভরবে। ভরুক; তবু শুভাশিসটা সিডের মতো টলতে-টলতে গুলি করতে থাকুক…যতক্ষণ গলায় রক্ত উঠছে…ততক্ষণ।
গলা ফাটিয়ে কেউ তো আওয়াজ উঠাক, — ফ্যাসিবাদকে আল্লা কিয়ামত তক বাঁচিয়ে রাখুক। মানুষকে তারা হাঁদা গঙ্গারাম বানাতে পেরেছে এতদিনে। হাইড্রোজেন বোমার মতো যখন-তখন যেমন ইচ্ছা সামনে-পেছনে করে চলেছে। জগতের রাজারানীরা এটা করতে পারছে কারণ তারা আর মানুষ নেই। অলৌকিক কিছুতে পরিণত হয়েছে তারা! ফেরেশতা হতে পারেনি। শয়তানও না। ভূতপ্রেত কিচ্ছু না। ভাষা দিয়া বোঝানো সম্ভব নয় এমন কিছুতে পাল্টে গিয়েছে! রাজারানীর পাল্লায় পড়া হাঁদা গঙ্গারামরা ওদিকে ঢুকছে অজগরের পেটে। লোকগুলোর ভূতভবিষ্যৎ কিছু নেই! ভবিষ্যৎ না থাকায় তাদেরকে দিয়ে পাপপুণ্য চুরিচামারি খুনখারাবি আর ভালোবাসাবাসির মতো আকাম করানোর সুযোগ নেই। অজগরের পেটে গুম হওয়াটাই নিয়তি এখন!
এতগুলো মানুষকে হজমের চাপ অজগর নিতে পারছে না। বোমার মতো বমি করছে সব। যেন-বা অন্ধকার গহ্বর থেকে ধরণী আলোয় ফিরছেন। বমনের দৃশ্যটা গানে, কবিতায় ফুটিয়ে তুলুক কেউ-না-কেউ। তার যেমন খুশি, যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসে, হতে পারে গানপার অথবা অন্য কোনো বিশীর্ণ নদীর পারে বসে গাইতে থাকুক,—সব শেষ হয়ে যায়নি এখনো; শেষের পরে শুরুর গান গাইছে ধরণী। তার সঙ্গে আমিও গাইছি দেখো সুদিনে ফেরার গান!
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS