কথাশিল্পী খালেকদাদ চৌধুরীর জীবন ও সৃজনকর্ম || সরোজ মোস্তফা

কথাশিল্পী খালেকদাদ চৌধুরীর জীবন ও সৃজনকর্ম || সরোজ মোস্তফা

মহৎ পূর্বসুরিরাই উত্তর পুরুষের শক্তি ও আদর্শ। পূর্ব ময়মনসিংহের জ্ঞান ও ঐতিহ্যে বাংলার সারস্বত সমাজকে যাঁরা আলোকিত করেছেন — সেইসব ধীমান মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ খালেকদাদ চৌধুরী। ‘উত্তর আকাশ’ কিংবা ‘সৃজনী’ — এই দুটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে পূর্ব ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, নূরুল হক, শান্তিময় বিশ্বাস, মলয় ভৌমিক, হেলাল হাফিজ, প্রণব চৌধুরী, খালেদ মতিন — এইসব সাহিত্যরতœকে সযতেœ প্রাণিত করেছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের আয়োজন করে ছোট্ট মফস্বল শহরের রত্ন ও ঐশ্বর্যকে জাতীয়ভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সিদ্দিক প্রেসের ছোট্ট একটা ঘরে তাঁকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যের আড্ডা জমতো। সে আড্ডার মধ্যমনি হয়ে তিনি সাহিত্যচর্চা, রাজনীতি ও সময়ের পরিচর্যা করেছেন। এই সহজ-সরল, নিরহংকার মানুষটিই ষাট-সত্তর-আশির দশকে এই মহকুমা শহরটিকে আলোকিত করেছিলেন।

একাধারে গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সংগঠক মরহুম খালেকদাদ চৌধুরীর জন্ম  নেত্রকোণা জেলার অন্তর্গত মদন থানার চানগাও গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে। তার পৈতৃক নিবাস নেত্রকোণার আটপাড়া থানার সোনাজোড় গ্রামে। তাঁর পিতা মরহুম নওয়াব আলী চৌধুরী এবং মাতা মরহুম নজমুন্নেছা চৌধুরী। খালেকদাদ চৌধুরীর জন্ম ১৯০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি।

খালেকদাদ চৌধুরীর বংশ পরিচয় সম্বন্ধে তাঁর আত্মজীবনী ‘শতাব্দীর দুই দিগন্তে’ লিখেছেন, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রথমেই নিজ পরিবারের কথা, পিতৃপুরুষের কথা আসে। স্মৃতিধৃত বিবরণ মতে ‘আমরা বারভূঞা আমলে গাজীদের অন্যতম বংশতিবংশ’। এর বেশি তাঁর গ্রন্থে লেখা নেই। তবে তাঁর ছোট ভাই জনাব মোসলেহ উদ্দীন চৌধুরী নিজেদের বংশ পরিচয় সম্পর্কে আরো বিস্তারিত বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার আমলে কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁদের পূর্ব পুরুষরা ঢাকা গাজীপুর অঞ্চলে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে তাদেরই অধস্তন পুরুষ গাজী লস্কর ও গজী আসকর নামে দুই ভাই আলপ সিং পরগনায় চলে আসেন এবং এখানেই বসতি স্থাপন করেন। ছোট ভাই গাজী আসকর নেত্রকোণা অঞ্চলের আটপাড়া থানার সোনাজোড়ে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন। খালেকদাদ চৌধুরী এই গাজী আসকরেরই অধস্তন পঞ্চম পুরুষ।

১৯২৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলে যান কলকাতায়। পিতার ব্যতিক্রমী ব্যবসার সুবাদেই কলকাতায় লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। পিতা নওয়াব আলী চৌধুরী যুক্তপ্রদেশের দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলে চীন, হংকং ও মধ্য এশিয়ায় উদবিড়ালের চামড়া রপ্তানি করতেন। পিতার বন্ধুদের তত্ত্বাবধানে থেকেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। অবশ্য কিছুদিন পরে পরিচিতদের টানে চলে যান রিপন কলেজে। এই কলেজে দু’বছর সুনামের সাথে অধ্যয়ন সমাপন করে ১৯২৬ সালে আই.এ পাশ করে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে। পিতা নওয়াব আলী চৌধুরীর আয়ুষ্কাল দীর্ঘ ছিলো না। পিতা প্রয়াত হন ১৯২৭ সনের ৩০ অক্টোবর। ব্যবসাসূত্রে কলকাতা থেকে ফেরার পথে আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। সেই রোগেই মারা যান। পিতার আকস্মিক মৃত্যু ও নানারকম পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে তাঁর উচ্চশিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটে।

১৯২৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কাজ করতে গিয়ে তিনি এক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যান। ভাষার রাজনীতি একটা সমাজের ভেতরে কীভাবে বিভেদ ও দ্ব›দ্ব তৈরি করতে পারে এটা ছিল তার-ই দৃষ্টান্ত। সমাজের ভেতরে সুপ্ত থাকা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিভেদটাই রূপান্তরিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে দ্ব›েদ্বর কারণে বাংলাভাষী ও উর্দুভাষী দুটো প্যানেল হয়েছিলো। বিপুল উত্তেজনার মধ্য দিয়ে বাংলাভাষীদের প্যানেল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের ২৫ বছর আগেই বাংলা ও উর্দুর এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে তিনি মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। উর্দুভাষী প্যানেলের পরাজিত সহ-সভাপতি প্রার্থী ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

পরিবর্তিত কলকাতার নাগরিক পরিবেশে একটা বিচিত্র অভিজ্ঞানের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছিলো  লেখকের দৃষ্টি ও অভিযাত্রা। পড়াশোনা, সাহিত্যচর্চা, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও সাংগঠনিক কাজকর্ম মিলিয়ে খালেকদাদ চৌধুরী নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলেন। এক তুমুল, টালমাটাল জীবন কাটিয়েছেন কলকাতায়। প্রগতিশীত সংগঠন ও সামাজিক কাজেও এসময় যুক্ত হন তিনি। ১৯৩১ সালে ‘পরিশীলন সমিতি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক হন। এই সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডলি আহমেদ ও বেটি আহমেদ নামে দুই মুসলিম কিশোরী নৃত্যগীত পরিবেশন করে। পুরো  বাংলায় কোনো মঞ্চানুষ্ঠানে  এটাই প্রথম মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ। এতে করে কলকাতার প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই ঘটনার সূত্রেই খালেকদাদ চৌধুরী ও কবি আবদুল কাদির ভারাটে মাস্তানের দ্বারা হামলার শিকার হন। কিন্তু থেমে যাননি তাঁরা। নিজের আত্মজীবনী ‘শতাব্দীর দুই দিগন্তে’ লিখেছেন, “এই সম্মেলনের মাধ্যমে সেদিন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলিম মহলে যে পথ প্রদর্শন করেছিল তাই পরবর্তীকালে মুসলিম নারীসমাজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশের অনুপ্রেরণা যোগায়।”

এই সময়ে তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবেও গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত ‘দৈনিক কৃষক’ এবং কবি নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ‘দৈনিক কৃষক’ পত্রিকায় ‘মামা’ ছম্মনামে শিশুকিশোর বিভাগ পরিচালনা করতেন। ‘নবযুগ’-এর কিশোর বিভাগে ‘আগুনের ফুলকি’ পাতাটি ‘আতসবাজ’ ছদ্মনামে পরিচালনা করতেন। কবি নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপন্ন অভিঘাতে নেত্রকোণায় ফিরে আসেন। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের প্রচার বিভাগে চাকুরি গ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯২৮ সালে কবি আবদুল কাদিরের সান্নিধ্য লাভ এবং তার প্রেরণাতেই নিয়মিতভাবে লিখতে শুরু করেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীনও লেখালেখিতে তাঁকে প্রণিত করেছেন। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে ‘বিকাশ’ নামে কলকাতার একটি পত্রিকায়। ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত সওগাত, মোহাম্মদী, হানাফী, প্রদীপ, মোয়াজ্জিন, হিন্দু শীর্ষমহল, নব্যবাংলা, শান্তি ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে থাকেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে মাসিক ‘মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় অনেক ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও বিদেশী গল্পের অনুবাদ প্রকাশ করে সুসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। মাসিক মোহাম্মদীতেই  ‘বিশ্বসাহিত্য পরিচয়’ প্রবন্ধটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। অনুবাদেও খালেকদাদ চৌধুরীর কুশলতা ছিল। তাঁর অনূদিত মির্জা নাথানের ‘বাহারীস্তান-ই-গায়বী’ একটি বড় মাপের কাজ।

খালেকদাদ চৌধুরী লেখা উপন্যাসগুলো হচ্ছে — ‘চাঁদ বেগের গড়’, রক্তাক্ত অধ্যায় (গড় শঙ্করী), ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’, ‘অভিশপ্ত মসনদ’, ‘এ মাটি রক্তে রাঙা’।

অনুবাদ রচনাগুলো হচ্ছে — ‘মরু সাহারায়’, ‘বাহারী স্থান-ই গায়বী’, ‘আল বকর দ্বীপ’, ‘বেদুঈনের মেয়ে’।

অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে — ‘গল্প সংগ্রহ’, ‘সাপমারির অভিশাপ’, ‘বহ্নিশিখা’,  ‘বিশ্বসাহিত্য পরিচয় ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’।

এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও দায়িত্বের ভেতরে পরিচালিত করেছেন উঁনার জীবন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও দর্শনকে ধারণ করে নেত্রকোণায় আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত মহিষখোলা শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের অন্যতম পরিচালক। এই বিচিত্র কর্মভারে থেমে যায়নি উঁনার কলম। বরং দায়িত্ব নিয়ে লিখেছেন। মাটির ঐতিহ্য ও ইতিহাস কেন্দ্রিক মৌলিক কথাসাহিত্য লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসের ভাষা ও বিবরণে প্রত্যক্ষভাবে উঠে আসে পূর্ব-ময়মনসিংহের জনজীবন।

সৃজনশীলতার এক বিপুল জগৎ তাঁর। দায়িত্বের আয়োজনে লিখে গেছেন। লিখে গেছেন ভাটি-বাংলার কথা, হাওর-প্রকৃতি আর বন-পাহাড়ের মানুষের নিজস্ব-জীবন কথা। জল, অরণ্য এবং পাহাড়ের অন্তরজাত যে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ — মাটির সহজতায় খালেকদাদ চৌধুরীর সাহিত্যও অনেকটা একই উৎস থেকে উৎসারিত। জলচর বেদে আর মৎস্যজীবী প্রান্তিক মানুষজনের বাঁচা-মরার আখ্যানই তিনি লিখেছেন। লিখেছেন কৃষকচৈতন্যের অন্তর্দহন। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে চাঁদবেগ ও টিপু পাগলের মতো লোকনায়কদের বিদ্রোহ এবং স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের কথা উঠে এসেছে তাঁর কথাসাহিত্যে। ঔপনিবেশিক সরকারের ষড়যন্ত্র ও নিষ্ঠুরতায় এবং আপন মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে এই জননায়কদের পতন হয়েছিলো। ইতিহাসের এই নায়কেরাই স্থান করে নিয়েছে তাঁর উপন্যাসে। শিল্পীর প্রধান কাজ তাঁর চেনা সমাজ ও জীবনকে লেখা। লেখার টেবিলে বসে খালেকদাদ চৌধুরী কল্পনার জীবন নয়; চেনা-জানা ঐতিহাসিক কাল ও কালান্তরকেই নিংড়ে দিয়েছেন।

১৯৮৫ সালে এই ১৬ অক্টোবর তিনি লোকান্তরিত হন। তাঁর কর্ম, স্মৃতি ও উত্তরাধিকার-ই আমাদের শক্তি। এই শক্তিতে শক্তিমান হোক নতুন প্রজন্ম।

তথ্যসূত্র :
দরজি আবদুল ওয়াহাব বিরচিত ময়মনসিংহ চরিতাভিধান।
খালেকদাদ চৌধুরী: জীবনী গ্রন্থ; ইমামুর রশীদ।
খালেকদাদ চৌধুরী: প্রসন্ন অভিভাবক; গোলাম ফারুক খান।
‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’; আত্মজীবনীগ্রন্থ; খালেকদাদ চৌধুরী।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি 

COMMENTS

error: