মহান শ্রোতা

মহান শ্রোতা

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে কুড়ি শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, বলা যায়, ধ্রুপদ সহ অন্যান্য নানা অঙ্গের মার্গীয় সংগীতের স্বর্ণসময় ছিল। চট করে যে-ধারার গানবাজনাগুলারে আমরা বলি হিন্দুস্তানি সংগীত, বলি হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক, মোটেও অল্প কলেবরের কালপর্ব নয় এই মিউজিকের বিকাশ ও প্রসার-প্রভাবের ব্যাপ্তি। নিছক দুই-চাইরটা গানবাজনাধারা নয়, হিন্দুস্তান সহ গোটা উপমহাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ভূখণ্ডের সুর-স্বর ও সংগীতকাঠামো এসে মিলিত হয়েছে বেগবান প্রবাহে এই সময়ের মিউজিকে। এই সময়টায় বেড়ে-ওঠা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ক্যাপিট্যাল সিটি ছিল, বলা বাহুল্য, কলকাতা। আবদুশ শাকুর তার এই বইটিতে, এবং তার হাতবাহিত সংগীতসংক্রান্ত অন্যান্য বইপত্তরে, ক্ল্যাসিক্যালের মিউজিকের বহুবিধ ঘরানা-বাহিরানা নিয়া বৈঠকি কায়দায় লিখে গেছেন অনলস।

তখন চলটাই ছিল অমন যে ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতাসর আয়োজিত হতো সমুজদারদের গৃহে। এবং আয়োজক গৃহকর্তাদের সকলেই বিত্তবান থাকার সুবাদে কেবল আসরগুলজার নয়, মিউজিকের এবং মিউজিশিয়্যানদেরও সুরক্ষায় তারা ব্যয় করতেন নিজেদের সময়, নিষ্ঠা ও শ্রম। সমুজদার সংগীতায়োজনকারী গৃহপ্রধানের আমন্ত্রণে যারা হাজির হতেন রাতভর জলসায় গান শুনতে, এবং আসতেন যারা গাইতে বা বাজাইতে, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সংগীতসমুজদার তো বটেই, ছিলেন সংগীতগুণী তারা প্রত্যেকেই প্রায়। বিভোর সেই দিবসরজনী মিউজিকে মশগুল রইত কলকাতার আনাচকানাচ। কথাগুলো শুনলে এখনকার জেনারেশন বোধহয় সাস্পিশাস দৃষ্টি নিয়া তাকায়, বিশ্বাসই করে না, বাড়িতে বাড়িতে এসে নামজাদা মায়েস্ত্রো মিউজিশিয়্যানরা গানবাজনা করছেন এবং শ্রোতারাও মশগুল রইছেন এই কথা আজকের টিআরপি-উন্মাদ বেনিয়া সাংগীতিক আয়োজক চক্র দেখে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম অম্লান বদনে বিশ্বাস করবে এইটা ভাবা বাড়াবাড়ি না-হলেও কষ্টসাধ্য। কয়েকটা বইপত্র পড়লে এর সম্যক ছবিটা পাওয়া যায়। তেমনই একটা আবদুশ শাকুরের এই বই।

হিন্দুস্তানি মিউজিকের ঘরানাদার বিভিন্ন অঞ্চলের হলেও সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে এই মিউজিক তৎকালীন কলকাতায়। সেকালের পৃষ্ঠপোষক সংগীতগৃহগুলি ছিল সংগীতমন্দিরের মতো, সকাল-সন্ধ্যা-রাত্র অষ্টপ্রহর চলত সুর ও সংগীতের অর্চনা। বাবুয়ানি কালচার বা বাবুবিলাস ইত্যাদি ফিগার-অফ-স্পিচগুলি ভিন্নপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় ধর্তব্য হলেও সংগীত বিষয়ক আলোচনায় বা সাংগীতিক বিকাশের ইতিহাস খুঁজতে গেলে এইধারা ট্যাগটার্মগুলি ইরেইজ করে কথা চালাইতে হয়। বাবুসংস্কৃতি বলি কিংবা বাবুবিলাস, যা-ই হোক, সংগীতের শ্রীবৃদ্ধি ও ঋদ্ধিসাধনে বেচাল কিছু ঘটায় নাই লাভ করা ছাড়া।

আবদুশ শাকুর সংগীতসমুজদার, বিচিত্র বিষয়ে ভাবুক এবং স্বরচিত রচনাপত্তরে আশ্চর্য রসের সঞ্চার করতে সিদ্ধহস্ত রচয়িতা। রাগসংগীতের চর্চায়, এবং রবীন্দ্র ও অন্য চার গীতিকবির গান নিজের আনন্দে গাওয়ায়, তিনি নিজেও মনোনিবিষ্ট হয়েছিলেন জীবনের শেষদিকে। এইসব প্রত্যক্ষ সংগীত-অভিজ্ঞতার কারণে শাকুরের লেখাগুলো হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ, স্বাদু ও প্রফুল্ল। কলকাতার রাগসংগীত চর্চা ও প্রসার-পরিকল্পনা-উদ্যোগের সেই হীরকদ্যুতিপূর্ণ শতাব্দীর একখণ্ড উজ্জ্বল ইতিহাস এই বইটিতে অ্যাভেইলেবল।

বইটির গোটা আখ্যান গড়ে উঠেছে কিংবদন্তি গায়ক, সংগীতভাবুক ও সংগ্রাহক অমিয়নাথ সান্যালকে কেন্দ্র করে। এই বইটিতে মহান শ্রোতা অমিয়নাথ সান্যালই। কিংবা তা আবার পুরোপুরি ঠিকও নয়, শেষমেশ ইতিহাসের ধূসর ধূলিপৃষ্ঠা থেকে যে-অসংখ্য মানুষের মুখ ও মুখরতা আবদুশ শাকুর বইটিতে এঁটে উঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই মনে হয় একেকজন মহান শ্রোতা। ভারতের প্রাদেশিক শহর কলকাতার একশ বছরের মুজরা আর মাইফেলের আঁতিপাঁতি অনুসন্ধান চালিয়েছেন লেখক এই বইয়ের আওতায়। রিসার্চারের অ্যাকাডেমিক দৃষ্টি নিয়া নয়, শাকুর সন্ধানী হয়েছেন সাহিত্যিকের চোখ লগ্নি করে। এবং অনুসন্ধানজাত ফলপুঞ্জ অত্যন্ত বৈঠকি মিজাজে ডেলিভার করেছেন শব্দবর্ণে-বাক্যচিত্রে।

এই বইটা গানপ্রেমী মাত্রই ভালোবাসবেন সন্দেহ নাই। নিছক গানবাজনার ইতিহাসকপ্চানির কারণে নয়, এই বই পাঠকপ্রিয়তা দাবি করে এর সরস গদ্যভঙ্গি এবং বয়ান-ব্যাখ্যানে শাকুরের বিশিষ্ট উদ্ভাসনের কারণে। এই বইটায় আদতে একজন নয়, সেভাবে দেখতে গেলে এখানে দুই মহান শ্রোতা পাঠকের সামনে হাজির করেছেন লেখক। এক মহান শ্রোতা অমিয় সান্যাল এবং আরেক মহান শ্রোতা আগের সেই সংগীতকরোজ্জ্বল কলকাতা। সান্যালের মতো সংগীতসমুজদার, সংগীতশ্রোতা ও সংগীতবক্তার জমানা আর ফিরবে না, আবদুশ শাকুর এই বইটিতে তা-ই যেন বলতে চেয়েছেন। আজ আর সেই রাম নাই, সেই অযোধ্যাও বজরঙ্গা ভাইজানদের দখলে-সাফকবালায়। এখন উমাবৌদি আর দুপুরঠাকুরপো অচরিতার্থ যৌনবাসনায় ঝিকিমিকি শীৎকারে ভাসায়ে দেয় সিটি কলকাতার গলি-উপগলিগুলো। অগত্যা।

প্রতিবেদন / আতোয়ার কারিম

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you