মার্কিন মুল্লুকে র্যাপারদের লম্বা মিছিলে যত কালা ও ধলা আদমির দেখা মিলে তারা সকলে এভাবে জঙ্গে জারি থেকেছে বা এখনো আছে। বাণিজ্যের খতিয়ান বলে ওখানে র্যাপ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির শতকরা বত্রিশ ভাগ দখল করে রেখেছে এবং রক এন রোলকে পেছনে ফেলেছে বহু আগে। অতিকায় বাজারে র্যাপগায়ককে পুঁজি করে যত খেলোয়াড় টাকা কামায় তাদের সঙ্গে তাকে লড়তে হয়। নব্বইয়ের দিনগুলোয় এই অভিজ্ঞতা কমন ছিল, — টাটকা কোনো র্যাপারের গান রেডিও বা টিভিতে বাজতে শুরু করেছে আর ওদিকে সে তখন হাসপাতাল কিংবা সওদাগরি অফিসে ফ্লোর ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত। ঝাড়ু দিতে-দিতেই শুনতে পাচ্ছে রেডিওতে তার গান বাজছে, যদিও সে জানে না ঠিক কবে ওরা তাকে নিজের পাওনা ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেবে। আবার এই সত্যটা সে মানতে বাধ্য, তার জীবনে র্যাপ একমাত্র অবলম্বন যেটি তাকে নরকেও অনাবিল রাখে। নরকে বসে স্বপ্ন দেখে সে, — একদিন র্যাপ তার পরিবারের মুখে অন্ন জোগাবে।
যারপরনাই র্যাপের বেলায় মোদ্দা কথাটা সরল, — বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেপিলেরা এখানে ঘুরেফিরে গলা মশকো করে যাবে। পাতি মাস্তান থেকে পাড় মাস্তানের অভিজ্ঞতায় পোক্তরা র্যাপের তালে নিজেকে খুঁজবে। একখানা চাকরি বাগানোর আশায় উদয়াস্ত স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি শেষ করে সরকারি বা সওদাগরি অফিসের এগজামিন দিতে বসা লক্ষীমন্ত ছেলেমেয়ের গলায় ওটা সহজে উঠতে চাইবে না। ছেলে গোল্লায় গিয়াছে; — বাপমায়ের চিরচেনা ও আমাদের সমাজবাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক উদ্বেগ আর বকুনি সয়ে যেসব ছেলেমেয়ে আজো স্কুল পালায়, বিড়িতে সুখটান দিয়ে বসে, বালকবেলার ফিচলামিদোষে মেয়েদের পিছু নেয়, লুকিয়ে হয়তো নিষিদ্ধ যৌনসুখের অভিজ্ঞতায় আকস্মিক নিজেকে সেয়ান ভাবতে থাকে, মাদক ও গ্যাংবাজির খেলাকে রোমাঞ্চক ভেবে জড়ায় এবং ভুল ভাঙলে প্রতিবাদে লেলিহান হয়ে নিজেকে শোধরানোর মওকা খুঁজে মরে, আর অলিগলিতে মানুষ ক্যামনে চলেফিরে, খায়দায় ও কীভাবে কব্জির জোরে না পারলেও মুখবাজির তোড়ে দেশজাতিসরকারকে চাবকায় … এইসব খুঁটিনাটি যারা নজর করে এবং রপ্ত করার এলেম রাখে তাদের পক্ষে র্যাপের বুলি গলায় টানা সম্ভব। কারণ, ওটা জীবনের সরল সমীকরণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সবকিছু চেখে দেখার প্রলোভন জাগায়।
র্যাপগানের প্রেস্টিজিয়াস খেতাব এমসি (Master of ceremony) বলে র্যাপগায়ক নিজেকে জাহির করলে হবে না, দাবির সত্যতা প্রমাণে কঠিন সব পরীক্ষায় তাকে পাশ দিতে হয়। প্রমাণ করতে হয় প্রতিপক্ষ র্যাপারের সঙ্গে শব্দযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মঞ্চে তার হাতের মাইক্রোফোনটা পিস্তল এবং সেটায় মুখে লাগিয়ে কথার গুল্লি ছুঁড়তে হাঁটু একটুও কাঁপছে না। অনিশ্চিত ও ভয়ংকর বাস্তবতাকে আলিঙ্গনের তেতো অভিজ্ঞতা ছাড়া র্যাপারের পক্ষে সপাট উচ্চারণে দগদগে সত্যগুলো গলা দিয়ে বের করা সম্ভব নয়, যে-সত্যগুলোকে শিল্পের আরো বহু মাধ্যম পারফিউম দিয়ে ঢেকেঢুকে পরিবেশন করাকে কামিয়াবি বলে মানে। র্যাপ যার গর্ভ থেকে একদিন আলোর মুখ দেখে সেই হিপহপ এভাবেই মার্কিন দেশে কাউন্টার কালচার-এ মোড় ফেরার সাহস সঞ্চয় করেছিল। আমেরিকার র্যাপাররা যে-কারণে অহরহ এই কথাটা বলে থাকে :—
র্যাপ শক্তি কোথা থেকে পায় সেটা বুঝতে চাও, তাহলে কালা আদমিরা যেখানে সারবেঁধে বসবাস করে সেই ঘেটোয় গিয়ে ঢুকো। নিউইয়র্কে ব্রঙ্কসের বাস্কেটবল গ্রাউন্ড জুড়ে বিস্তৃত চত্বরটায় একপাক ঘুরান দিয়ে আসো বাপ। ওখানকার দেয়ালে গ্রাফিত্তিগুলার দিকে তাকাও। ফুটপাতে কেউ হয়তো মাত্র ব্র্যাক ডান্সটা দিচ্ছে আর পুলিশকে ভালো করে লক্ষ করতে থাকো … হিপহপের কোন পাতাল থেকে র্যাপ পয়দা হয় তার জবাব পেয়ে যাবে।
পৃথিবীর সকল নগরে স্থানিকতার নিজস্ব নিয়ম অনুসারে এক-একটা ব্রঙ্কস বিরাজ করে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। যারা দেখতে জানে তাদের গলায় র্যাপ আপনা থেকে চুলবুল করে। তামিম আলম সিতাব যেমন তাঁর র্যাপবীক্ষণে (দ্রষ্টব্য : Resistance of Rap: An Ever Struggling battlefield in Bangladesh) মিরপুরের শাহ আলীর মাজার চত্বর ঘিরে যেসব হাভাতে ও চালচুলোহীনরা র্যাপের মজমা বসায় সেইসব অজ্ঞাতনামা র্যাপারের গানের কলি টুকে নিয়েছিলেন। তারা সেখানে বলছে :—
একতলা পাঁচতলা সামনে আছে
মোহাম্মদপুর, জিমে গিয়া ডাম্বেল মাইরা খোমা বানাইছ কী সুন্দর!
বাপের টাকায় খোমা বানাও, বানাইয়া হোন্ডা চালাও,
নিজে টাকা কামাইতে গেলে প্যান্ট ভইরা মুইতা দাও।
র্যাপ তাই সামাজিক অসঙ্গতি আর শ্রেণিবৈষম্যে নারকীয় সমাজের পর্দা ফাঁস করার ভানভণিতাহীন অস্ত্রও বটে! বাংলা র্যাপে তার কিছু লক্ষণ ধরে-ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। তাবিব মাহমুদ ও গাল্লি বয় রানার যৌথ সংগতে গীত গান সমূহে লক্ষণটা কমবেশি প্রখর ধরা পড়ে। সাম্প্রতিক শুধু টাকার জন্য গানের বুলি শুনতে বসে ধারটা শ্রোতা ঠিক টের পায় :—
কথা কাজে মিল নাই দিল নাই
আমার গোজামিলে সব ঠিক ভুল নাই,
আরে ভুলভাল কথা বলে খবরের শিরোনামে
লাল চুল নায়িকার দুল নাই কানে…
থাকলে টাকা টাক মাথায় উঠে চুল
তাই মিথ্যা সত্য হয় সঠিকটা ভুল,
ফুলে ফুলে উড়ে মৌমাছি দুধের মাছি
এই হ য ব র লে আমিও আছি…
আমি তুমি বেচে আছি বাঁচবার প্রয়োজনে
অভাব মিটাই হেসে স্বপ্ন বেচে আরে,
লেগেছে আগুন দেখি আমার লেজে তাই
আখের গোছা সবাই সভ্য সেজে…
যায় ভেঙেচুরে যায় উড়ে দূরে যায়
আমার সাধের স্বপ্ন,
যায় আলো নিভে যায় বেলা ডুবে যায়
শুধু টাকার জন্য…
[শুধু টাকার জন্য; কথা : তাবিব মাহমুদ; গান : তাবিব মাহমুদ ও রানা]
তাবিবের গানটি ভারতীয় র্যাপার ডিভাইনের গান্ধী মানির র্যাপবুলিকে মনে করায়। দুনিয়া এখন আর রামকৃষ্ণের অমর বচন টাকা মাটি মাটি টাকার তাঁবে চলে না। মুদ্রা হচ্ছে বড়ো সন্ত আর মানুষ সেই সন্তকে ধরবে বলে দিনরজনি চরকিতালে ঘুরছে। বহু ঘাটের জল খেয়ে র্যাপার ডিভাইনের বুঝতে বাকি নেই লোকে টাকাকে সকল দিগদারির হোতা বলে গাল পাড়লেও টাকা জেবে না থাকলে জীবনটা মনে হয় বরবাদি। হিংসা-হানাহানি-অশান্তির নটরাজ কাগজের টাকায় শান্তি ও অহিংসার দূত গান্ধীর ছবি…মজাদার এই পরিহাস দিমাগে ঢোকার পর টাকার শক্তি টের পেতে বেতাব হওয়া লাগে না। তাবিবের মতো হাহাকারে বিদীর্ণ না হয়ে ডিভাইন বরং নতজানু সৈনিক। টাকাকে শান্তির খাঁটি মলম মেনে নতমস্তকে তাকে কুর্নিশ ঠোকে :— ভাই তুঝে মান লিয়ে মান লিয়ে মান লিয়ে / মান কো লাগতি শান্তি হ্যায়, জেব মে যব গান্ধী হ্যায় [দ্রষ্টব্য : গান্ধী মানি; কথা ও গান : ডিভাইন]।
যে-টাকার চক্করে পড়ে মানুষ দিনরাত খাবি খায় সে হলো সকল অনাচারের মূল। তার সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না তবু তাকে ধ্বংসের হায়দারি হাঁক ছাড়া একজন র্যাপ গায়কের কি করার থাকে? জেলের কুটুরিতে বসে আক্রোশে গর্জন করা ছাড়া সামাজিক বৈষম্য ও অনাচারকে খতম করার সাধ্য তার নেই। ফকির লাল মিয়া ও তৌহিদের যৌথ পরিবেশনা ধ্বংস-র র্যাপবুলিতে যারপরনাই তাবিবের ফুলকি ছুটতে দেখি :—
… যত কঠিন ভাবি তত কঠিন নয়
যেন মুখে ভাষা আছে আমি বধির নই
যদি রক্তক্ষরণ হয় রক্ত চাই
পৃথিবীটা কঠোর হবে বাঁচতে চাই…
সত্যি বাস্তব আজ কারাগারে বন্দি
নিজের অগ্নিতুষে আজ জ্বলেপুড়ে মরছি
উফ বলা মানা তাই হ হা করে হাসছি
সরাসরি অন্যায় অনিয়ম দেখছি…
কি শিখেছি আহামরি প্রাণ দিয়ে যুদ্ধে?
অসাধুতা জুয়াচুরি মিশে গেছে রক্তে
যার হাতে লাঠি থাকে সব তার পক্ষে
ঈশ্বরও মজা লয় আমাদের কষ্টে
বলে এই মগজটা দিলাম কি দুঃখে?
বারবার বাটপার কেন যায় কক্ষে?
শিয়ালের পায়ে ধরো বলো মামা পারবে?
আমার ওই মুরগিটা দেখে শুনে রাখতে?…
…
কোনো প্রশ্ন নয় আমি নীরব শান্ত
কেন বিষণ্ন আগুনে পুড়ে খণ্ড খণ্ড
হতাশ আমি আমি নির্বাক
আমি হবো আহবানের ওই শ্রেষ্ঠ দান
সংগ্রাম নয় ধরো জীবনবাজি
জানি রক্ত লাল চলো গর্জে উঠি
ধ্বংস হোক সেই ধ্বংসকারী!
মানব ধ্বংসকারী
সা গা মা রিতা নীতি
[ধ্বংস; কথা : ফকির লাল মিয়া; গান : ফকির লাল মিয়া ও তৌহিদ]
ফকির লালের কাছে তার শ্রোতারা যে-ধাঁচের গান আশা করে অনেকদিন পর সেই গুলিটা তাকে ছুঁড়তে দেখা গেল! এই ধারার র্যাপগানে তাবিব মাহমুদের সময়-প্রসঙ্গিকতা হয়তো ফকিরকে বিচার চাই-র র্যাপবুলিকে পুনরায় ফেরত আনার তাড়া দিয়ে যায়। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কিছু সিলেটি র্যাপারদের সঙ্গে অঘোষিত জঙ্গে নিজের শক্তির জায়গা ফকির অনেকটা হারাতে বসেছিলেন। ধ্বংস বোধ করি তাকে স্বকীয়তায় ফিরে আসার আত্মবিশ্বাস দিয়ে যায়।
ফ্রিস্টাইল র্যাপ গাইতে বসে মানুষ ক্যামনে সারাক্ষণ প্রেমের গান শোনে এই প্রশ্নটা লাল করেছেন সম্প্রতি। সেটা এ-কারণে যে, বাংলা ভাষায় র্যাপগানের প্রাথমিক দিনগুলোয় এর বাজার ও শ্রোতাপ্রিয়তার জন্য যারা লড়াই করেছে লাল তাদের একজন। রোমান্টিক গানে বাংলার চিরায়ত অভ্যাসের বিপরীতে র্যাপের কাট্টাখোট্টা বুলিকে শ্রোতার পছন্দনীয় করতে তাদের খাটতে হয়েছিল। যুব সমাজের বাইরে এখনো খুব অল্প শ্রোতাই র্যাপ শুনতে পছন্দ করেন। নারী শ্রোতার সংখ্যা আরো কম। বাংলা র্যাপের দাম নাই গানে লালের এই আক্ষেপ ইতিহাস হয়ে আছে।
তা-বলে র্যাপার প্রেমে পড়ে না এমন নয়। তার প্রেমে পড়ার ধাতটা জৈবিক। ওটা ভীষণ অর্গানিক। ছ্যাকা খাওয়ার বেদন জানাতে বসে ঘোরপ্যাঁচের তোয়াক্কা সে করে না। কবিতার স্বাদু বাকপ্রতিমা দিয়ে নিজের প্রেমানুভূতি আওড়ানো তার জন্য অবান্তর। প্রেমে সে অহরহ পড়ে এবং পড়তেও চায় এই শর্তহীন শর্তে, — দুটি দেহমনের মিলন ঘেমেনেয়ে একাকার জীবনের মতো করে ঘটুক সেখানে। রাগ-বীতরাগ-অভিমান-ছলচাতুরি বা প্রতারণার সবটা চলবে চারপাশের জীবন যেমন চলে তার মতো করে।
মানবজীবনে ভালোবাসার যত রং তার সবটাই অন্য মাধ্যমের মতো র্যাপের প্রতি অঙ্গে বহে। রকগুরু জেমসের মা গান শুনে শ্রোতা আকুল হয়। স্মৃতিকাতর বিষাদে বোনা গানের প্রতিটা উচ্চারণ হৃদয়ে শেল হয়ে বিঁধে। জেমসের গায়কির কারণেও বটে, মাকে তারায়-তারায় খুঁজে বেড়ানোর আর্তি শ্রোতাকে ব্যথা দিয়ে যায়। স্মৃতিকাতর এই বিষাদ র্যাপগানে অন্য রূপ ধরে প্রকাশিত হয়। টুপাক শাকুরের যবে এখনো জীবিত মায়ের কথা মনে পড়ে তখন সব ছাপিয়ে এই অনুভূতি তার মনে দুর্বার হয়, এ তো সেই মা যাকে প্রশংসায় ভাসানো ছাড়া দ্বিতীয় শব্দ তার পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব নয়! দুরন্ত ডানপিটে এক ছেলেকে গর্ভে ধারণ করেছে সে। তার সমাজবিরোধী শত কাণ্ড একাধারে বাপ ও মা হয়ে অকাতরে সইছে জীবনভোর। এখন তার ব্ল্যাক কুইনকে You are appreciated ছাড়া অন্য সম্ভাষণে ডাকা কঠিন। মারকাটারি এক পুরুষকে যে-নারী ডাঙ্গর করেছে তার বন্দনা গাইতে বসে গানের মধ্যস্থলে পৌঁছে টুপাক সত্যি কথাটাই বলে বসে :—
You always was committed
A poor single mother on welfare, tell me how you did it
There’s no way I can pay you back
But the plan is to show you that I understand
You are appreciated
[Dear Mama; Lyrics & Song: Tupac Shakur]
মাকে তো বটেই, সমগ্র মানবসমাজকে নিজদেহে বিজড়নের তিক্ত, মধুর অভিজ্ঞতা পেরিয়ে appreciated বলতে পারার হিম্মতটাই র্যাপ। সংগীতের এই ধারাটি চতুর! নিজের নির্যাতিত ও প্রবঞ্চিত স্বরূপ তুলে ধরার প্রতি পদে প্রতিশোধকামী হয় সে। সকলের থেকে বাহাদুর বলে জাহির করতে কৃপণতা করে না। হাঙ্কিপাঙ্কি বাতচিত শেষে একই র্যাপের অঙ্গে ঘনায় নির্বেদ, যেখানে You are appreciated কিংবা জীবন যা দিয়েছে তার সবটাই accepted ও appreciated বলে দাগাতে র্যাপার দুবার ভাবে না। র্যাপ তাই একইসঙ্গে ন্যাংটা ফকির ও গেরিলা হয়ে ওঠার শিল্পকলা। বাংলার র্যাপ গায়কদের এই অনুভবের জায়গায় এখনো ঘাটতি রয়েছে মনে হয়। সময়ের সঙ্গে তারা যত পোক্ত হয়ে উঠবেন এমিনেমের মতো তারাও সেদিন বলবেন :—
‘Cause I am whatever you say I am
If I wasn’t, then why would I say I am?
In the paper, the news, every day I am
I don’t know, it’s just the way I am
[The Way I Am; Lyrics & Song: Eminem]
কে কী বলছে তার পরোয়া এমিনেম বিলকুল করছে না। কারণ, র্যাপের দুনিয়ায় কালোদের একচেটে রাজত্বে সাদা চামড়ার এক ছোকরা যেদিন ভাগ বসাল সেদিন থেকে খেলা বদলে গেছে। এ তো চরম সত্য ছিল, শুরুয়াতের দিনগুলায় ডাকাবুকো কালো আদমির মুখ দিয়ে অনর্গল র্যাপের তুবড়ি ছুটছে আর তাদের ভিড়ে সে এক রেনিগেড! তার গ্রোত্রকুল চায় না সে ওই র্যাপের খিস্তি দিয়ে মানুষ হাসাক। ওদিকে যে-শ্বেতাঙ্গদের সুচতুর প্রতিরোধের মুখে পড়ে দেশটাকে যারা আজো নিজের করে নিতে পারল না সেই কালো মানুষের দঙ্গল র্যাপের ময়দানে পঙ্গা দিতে আসা শ্বেত ছোকরাকে একহাত দেখে নেওয়ার মজা ছাড়তে যাবে কোন দুঃখে?
উভয়সংকটে নিপতিত এমিনেম যখন নিজের বিজয়কেতন অবশেষে উড়াতে সফল হয় তখন তাকে ভাবতে হচ্ছে ঠিক কতটা বদলে গেছে সে? আগের সেই মাথাগরম ও মারদাঙ্গায় হাত পাকানো গ্যাংবাজ ছোকরাই আছে অথবা সময়ের টানে এক স্থিতধী প্রাণীতে মোড় নিয়েছে? নিজের মা ও বোনকে আলগে রাখার জন্যই না র্যাপকে একদিন বেছে নিয়েছিল সে! টুপাকের সঙ্গে তার মিল পদে পদে চোখে পড়ে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে র্যাপের মোক্ষম পাঞ্চলাইনটা ডেলিভারি দিচ্ছে একালের র্যাপঈশ্বর, — I don’t know, it’s just the way I am.
সোজা কথা, অত কিছু বুঝি না, কেবল এটা জানি বহুত জল গড়িয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এমিনেম এখনো এইট মাইলের চৌহদ্দিতে বেড়ে ওঠা এমিনেমই আছে! হিপহপের বাইবেলে এই কথাটা অমোঘ, — জীবনের হাতে চোদা খেতে-খেতে একসময় তাকে চুদতে পারার কৌশল হলো হিপহপ। ওই স্তরে যখন কোনো র্যাপার পৌঁছায় সে তখন এমিনেম হয়ে যায়। তার পক্ষে সহজ করে কঠিন কথা অনায়াস বলা সম্ভব :—
Sing with me, sing for the year (sing it)
Sing for the laughter, sing for the tear (come on!)
Sing it with me, just for today
Maybe tomorrow, the good Lord will take you away
[Sing for the Moment; Lyrics & Song: Eminem]
নিজেকে ডাকাবুকো বা মাচোম্যান প্রমাণ র্যাপের ভড়ং মাত্র। মঞ্চ দখলে রাখতে ওটা কাজে লাগে। আসল সত্যটি অন্যখানে লুকিয়ে থাকে। ভড়ংয়ের ভিতর দিয়ে আত্মবীক্ষণ অধিক জরুরি সেখানে, যেটি অবশেষে তোমাকে চিনতে সাহায্য করবে। বাংলা র্যাপ গানে এই বীক্ষণ বৃত্তবন্দি পায়রা হয়ে থাকবে যতদিন না র্যাপার তার স্থানিকতায় দাঁড়িয়ে নিজেকে সম্যক চিনতে শিখবে।
…
বাংলাদেশে র্যাপ-হিপহপের চর্চা গতি পেলেও তাকে নিয়ে আলোচনা বা লেখালেখির ধারাটি এখনো বেগবান নয়। হিপহপ নিয়ে লেখাজোকার খোঁজ পেতে গুগল মহাশয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র তামিম আলম সিতাব-র Resistance of Rap: An Ever Struggling battlefield in Bangladesh ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বীক্ষণ অনেক তালাশ করে পাইনি। স্কিবখানের সব চুপ গানটি নিয়ে গানপার-সঞ্চালক জাহেদ আহমদের মুখড়া সমেত ইমরান ফিরদাউসের সংক্ষিপ্ত লেখা চোখে পড়েছিল এবং সেটা দেখে নেওয়া গেল এই ফাঁকে। শামস বিন কাদের আর মোবাশর হাসান নামে আরো দুজনের খোঁজ পেলাম যাঁরা বাংলা গানের মূল স্রোতের বাইরে পোলাপানদের মহলে প্রবল জনপ্রিয় সংগীত মাধ্যমটির ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। নিজের অ্যাকাডেমিক পেপারে (দ্রষ্টব্য: Impact of the British Bangladeshi Musicians of London: A Brief Look at the Popular Musical Styles of Postcolonial Migrant Peoples by Shams Bin Quader) কাদেরকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী গাইয়ে-বাজিয়ে-সুরকারদের সঙ্গে আলাপ জমাতে দেখা যায়। আলাপের ছলে তাঁদের গানবাজনায় হিপহপ সহ অন্যান্য সাংগীতিক উৎসের প্রভাব তলিয়ে দেখতে তাঁকে বেশ উৎসাহী মনে হয়েছে।
অভিবাসী সংগীতকারদের গানবাজনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে জনপ্রিয় দ্রুতলয়ের সংগীত জ্যামাইকান রেগগে (reggae), পাঞ্জাবি ভাংড়া, আলজেরিয়ার লোকপ্রিয় গীত রাই ইত্যাদির প্রভাবকে কাদের তাঁর অনুসন্ধানের বিষয় করেছেন। লেখাটি পাঠ করতে বসে নিতিন সাহনি, শীলা চৌধুরী, কিশোন খান ও সিলেটি র্যাপ গায়কদের সংগীতভাবনা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞানযোগ হলো বলা যায়। অভিবাসী গায়ক ও সুরকারের মধ্যে বাঙালি জলহাওয়ায় সিক্ত নিতিন সাহনিকে অধম চিনতে পেরেছি। টেড টকস আর কোক স্টুডিও ইন্ডিয়ার সুবাদে তাঁর গান এবং বক্তৃতার সঙ্গে পরিচয়টা পুরোনো। বিয়ন্ড স্কিন অ্যালবামের গানগুলো আগে শোনা ছিল। কাদেরের লেখা পড়তে বসে স্মৃতিটা মনে উঁকি দিয়েছে বটে!
গানে কথা ও সুর বসানোর খেলায় নিতিন সাহনি নিরীক্ষাপ্রবণ। বিয়ন্ড স্কিন-র গানগুলায় নিরীক্ষার ছাপ বেশ প্রবল ছিল মনে পড়ে। অ্যালবামের সবকটা গান মোটের ওপর কানে দোলা দিয়ে যায়। ইংরেজ গায়িকা নিকি ওয়েলসকে দিয়ে নাদিয়া ও সানসেট গানটি তিনি গাইয়েছিলেন। নিজে ভালো গাইলেও নিকিকে দিয়ে সংস্কৃত, হিন্দি আর বাংলা ভাষায় গান করানোটা শ্রোতাদের কাছে তাঁকে আদরের করে তুলেছিল। মিউজিক ভিডিও ও চলচ্চিত্রে সুর করার পাশাপাশি ভিডিও গেমসের আবহসংগীত রচনায় তাঁর অবদান রয়েছে। সিলেটি বাবা-মায়ের সন্তান বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের Zero Degrees-র সংগীত-আয়োজনটা বোধ করি নিতিনের করা ছিল। এছাড়া বাদবাকিদের ব্যাপারে ধারণা পেতে কাদেরের লেখাটি কাজে দিয়েছে।
মোবাশর হাসানের উল্লেখ তামিম আলম সিতাব-র লেখা থেকে পাওয়া। বাংলা র্যাপগায়কদের ওপর ওল্ড স্কুল র্যাপের অন্যতম কুলপুরোহিত টুপাক শাকুরের প্রভাব নিয়ে হাসান কয়েক ছত্র লিখেছেন। এর বাইরে চোখে পড়ার মতো লেখা বা গবেষণার খোঁজ এখনো পাইনি। নিজের র্যাপবীক্ষণে তামিম আলম সিতাব সাংবাদিক ও গবেষক রবিন রাইটের সময়-প্রসঙ্গিক একখানা বহির নাম নিয়েছিলেন। গানপার-এ ইসলামবীক্ষণ বিষয়ক রচনাটি যখন পর্বে-পর্বে যাচ্ছে তখন বইটি সম্পর্কে জানা ছিল না। আরব জনমানসের সাম্প্রতিক পালাবদলের কার্যকারণ রবিন তাঁর কিতাবে পাঠককে ধরিয়ে দিতে আগ্রহী এমন ভাবার যুক্তি রয়েছে। বইটির আগাপাশতলায় প্রথম দফার ঝটিকা সফরে সে-রকম মনে হলো। সাংবাদিকসুলভ ঝরঝরে গদ্যে লেখা কিতাবে লাদেনঝড় ও আরববসন্ত অতিক্রম করে আসা মরুঅঞ্চলে হিপহপ সংস্কৃতির অভিঘাতকে রবিন পাঠকের নজরে আনতে চেয়েছেন। Hiphop Islam নামের বিশেষ অধ্যায়টি বইয়ের পাঁচ নাম্বারে জায়গা করে নিয়েছে। Rock the Casbah — Rage and Rebellion Across the Islamic World শিরোনামের কিতাবখানা পাঠ শেষ হলে আশা করি নতুন ভাবনার রসদ মিলবে।
সেইসঙ্গে বলে রাখি, মার্কিনপ্রবাসী ফিলিস্তিনি তথ্যচিত্রনির্মাতা জ্যাকি সল্লুমের Slingshot Hiphop বা হিপহপের গুলতি নিয়ে একাধিক রিভিউ চোখে পড়েছিল। অশান্ত গাজা উপত্যকা আর গায়ের জোরে ইসরায়েলের নিজের বলে দাগানো ওয়েস্ট ব্যাংকে প্রচুর ফিলিস্তিনি বসবাস করেন। হিপহপের গুলতিকে ফিলিস্তিনি যুবারা কীভাবে প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তুলেছে সেই কাহানি সল্লুম নাকি তথ্যচিত্রে তুলে ধরেছেন। ছবিটি দেখার কৌতূহল থাকলেও আপাতত বিফল হতে হয়েছে। সে যাকগে, দুনিয়া জুড়ে কতরকমের বিষয় নিয়ে আজকাল ছবি হচ্ছে সে-কথা ভাবলে অবাক লাগে। আরবের সিনেভাষায় এর অভিঘাত তরঙ্গের আকারে আছড়ে পড়ছে বৈকি।
হিপহপের মতো বৈশ্বিক তরঙ্গের প্রভাব আমাদের ওপর আছড়ে পড়বে না সেটা তো হয় না। বাঙালি নগরজীবী সংস্কৃতির লোকায়ত উৎস যারপরনাই তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি, কেবল লড়াইয়ের ধাতটা সেখানে ভিন্ন। তামিম আলম সিতাব তাঁর র্যাপবীক্ষণে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর সরাসরি হাভাতের কাতারভুক্ত ছেলেপিলেদের নগরজীবী সংস্কৃতির পেটের ভিতরে বসে হিপহপ চর্চায় ব্রতী হওয়ার খবর করেছেন। বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো এইসব পোলাপান একটা কাউন্টার কালচার দেশে জন্ম দিতে কতটা কী করছে ও তার ভালোমন্দকে নজরে আনতে ত্রুটি করেননি। বাংলা র্যাপের সাহিত্যিক মূল্য নিজের বীক্ষণে তিনি অবশ্য এড়িয়ে গিয়েছেন, যেহেতু তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল এর মার্কেট ভ্যালুর সুরতটা বোঝা। বিশ্ব বাজারে অধুনা ত্রিশ ভাগের অধিক জায়গা দখল করে রাখা হিপহপের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশী গানের বাজারে কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে এই বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা তামিমের বীক্ষণ থেকে পাওয়া যায়।
ফকির লাল মিয়া বা স্টোইক ব্লিস-র অভিবাসী যুবাদের হাত ধরে নিউইয়র্ককেন্দ্রিক বাংলা র্যাপ গানের শুরুয়াতের কাহিনি সেখানে উঠে এসেছে। তার সঙ্গে ব্ল্যাক জ্যাং, দেশি এমসিজ, জালালি সেট আর সোলো গায়ক রূপে এমসি ম্যাগ, শাফায়েত, স্কিবখান, তাউড়া সাফাদের লড়াইকে প্রাসঙ্গিক করেছেন তামিম। মিরপুরে শাহ আলীর মাজারকেন্দ্রিক হাভাতে যুবাদের র্যাপ গান চর্চার খবরও নিয়েছেন। নিজেকে একপ্রকার গুপ্ত রাখা এইসব যুবার জীবনভাবনা ও র্যাপগান যাপনের গল্পটা তাদের পেটের ভিতর থেকে টেনে বের করা কঠিন এবং এই অসুবিধা তাঁকে ভুগিয়েছে। বীক্ষণটি বছর পাঁচেক আগের হওয়ার কারণে ঢাকা ও অনেক জেলা শহর বিশেষ করে কুমিল্লার রাস্তাঘাট আর খোলা চত্বরে চ্যাংড়া পোলাপানদের ফ্রিস্টাইল র্যাপের সঙ্গে বিটবক্সিং চর্চার অন্ধিসন্ধির খবরটা বাদ পড়েছে।
যেমন আসেনি ভারত, নেপাল সহ এশিয়া মহাদেশের পথেঘাটে মজমা জমানো চ্যাংড়া পোলাপানদের সমাজবীক্ষণকে র্যাপে উগড়ে দেওয়ার গল্পগুলো। ভারতে হিপহপ অনেকদূর এগিয়েছে আর সেটা এমিওয়ে বানতাই, নেয়জি, ডিভাইন, কৃষ্ণা, রাফতার, ডিনো জ্যামস, সিধু মুচওয়ালার মতো র্যাপারদের গান শুনতে বসলে পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। আন্ডারগ্রাউন্ড হিপহপ-র বাড়বাড়ন্ত সেখানকার র্যাপগান চর্চাকে ক্রমশ শক্ত বনেদের ওপর দাঁড়াতে নীরব ভূমিকা রাখছে। হিপহপের সকল অঙ্গ র্যাপে জুড়ে নিতে এইসব র্যাপারের কামিয়াবি চোখে পড়ার মতো গভীর। গাল্লি বয় ছবিটি নির্মাণের দিনকালে মুম্বাইয়ের আনাচ-কানাচে ছড়ানো-ছিটানো আন্ডারগ্রাউন্ড র্যাপারদের একটি অংশকে পরিচালক কাজে লাগিয়েছিলেন। র্যাপার ডিভাইনের সুবাদে ছবির ওয়ার্কশপে জড়ো হওয়া গায়কদের বুলি আওড়ানো আর বিটবক্সিংয়ের ক্ষমতাটি গভীর মনে হয়েছে।
ভারতের র্যাপগায়কদের অনেকেই চরম আর্থিক দুর্দশা, সামাজিক বৈষ্যম্য ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার চড়াই ঠেলে সংগীতের বাজারে নিজের আসন পোক্ত করে নিচ্ছে। ছদ্মনামের আড়ালে র্যাপারদের প্রধান অংশটি সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায় থেকে উঠে আসছে এখনো। কারণটা আমেরিকায় কালো আদমির আত্মপরিচয়কে দমিয়ে রাখার ঘটনার সঙ্গে খানিক মিলে যায়। পশ্চিম গোলার্ধে বিশেষ করে মার্কিন মুল্লুকে রাষ্ট্র ও সমাজ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে সচেতন কৌশলে বারবার পৃথক বলে দাগানোর চেষ্টা করেছে। মার্টিন লুথার কিং, ম্যালকম এক্স বা মোহাম্মদ আলীকে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে জোর লড়াই করতে হয়েছিল একসময়। লুথার, ম্যালকম, আলীর স্ফুলিঙ্গ কৃষাঙ্গরা টুপাক শাকুরে দেখতে পেয়েছিল। বিজেপি জামানায় ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায় মোটের ওপর অনুরূপ অবস্থায় পতিত হওয়ার কারণে রাষ্ট্রের তির্যক সমালোচনায় এমিওয়ে বানতাই, নেয়জিকে মুখর দেখে শ্রোতারা। মার্কিন ন্যাস ও জন্মসূত্রে ভারতীয় র্যাপার রাজা কুমারীর সঙ্গে ডিভাইন বা নেয়জির কোলাবরেশন চোখে পড়ে। একটা পেশাদারি আবহ গড়ে ওঠায় গানের কথা ও পরিবেশনায় নিরীক্ষার ছাপ প্রবল মনে হয়েছে।
রনভীর সিং অভিনীত গাল্লি বয় কার্যত নেয়জি ওরফে নাভিদ শেখের উঠে আসার কাহিনি দিয়ে মোড়ানো। Bombay 70 স্বল্পদৈর্ঘ্য তথচিত্রে বস্তির জীবনে বেড়ে ওঠা নেয়জির র্যাপগানে যাত্রার পটভূমি সম্পর্কে যৎসামান্য ধারণা পাওয়া যায়। তার নিজের গানেও গল্পটা সে বলার চেষ্টা করে। আপন চেষ্টায় ইংরেজি ভাষায় র্যাপ গাইতে শেখা নেয়জি প্রথম শ্রোতাপ্রিয় গান আফাত থেকে হিন্দিতে র্যাপবুলি ছুঁড়তে শুরু করে, যদিও র্যাপগানে ভাষা আদৌ কোনো ব্যাপার কেন নয় সেটা গানের শেষ স্তবকে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে কসুর করেনি :—
This is not to prove that I can also rap in English
But this is to the people who fall so whack in English!
Who think that real hip hop is only slapping English!
Though we bad in English, still we rap in English!
[Aaafat (The introductory song; Lyrics & Song: Naezy]
উদ্ধৃত র্যাপবুলিতে গায়ক পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে ইংরেজিতে ভুলভাল গাইবার ঠেকা তার নয় বরং শ্রোতার, যারা র্যাপে ইংরেজি শব্দের ঝাঁকুনিটা শুনতে আরাম বোধ করে। তারা ভাবে ইংরেজিতেই র্যাপটা ভালো জমে। এখন যারা এটা নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে তাদের পোছার ঠেকা র্যাপ গায়কের নেই, কারণ র্যাপে ভাষা নয় বরং ভিতরের অনুভবকে গুলি করতে পারাটা হচ্ছে আসল ব্যাপার। এখন সেটা হিন্দিতে যেমন হতে পারে, ইংরেজিতে হলে গেল-গেল রব তোলার কিছু নেই। র্যাপার তার মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে যে-ভাষা শিখেছে সেটা এবং বিদেশি ভাষাকে প্রয়োজনে আপনার করে নেবে। যে-শব্দগুলো তার আবেগকে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে পারবে বলে সে মনে করবে সেগুলো ভাষার ভাণ্ডার থেকে সে তুলে নেবে আর এটাই হলো সাচ্চা হিপহপ :—
In rap we express ourselves!!
We rap what we actually feel
And the language doesn’t really matter!
Does it matter? No! It doesn’t!
[Aaafat (The introductory song; Lyrics & Song: Naezy]
কৃষ্ণা, ডিভাইন, নেয়জি, এমিওয়ে বানতাই এবং আরো অনেকের র্যাপগানের মূল শক্তি নিহিত তাদের জীবনবীক্ষণ থেকে উঠে আসা অকপট উচ্চারণের মধ্যে। মেকি অনুভূতির প্রয়োগ সেখানে সচরাচর চোখে পড়ে না। বাংলা অনেক র্যাপারের গানে এই মেকিত্বটা বোধ করি রয়েছে এবং মাঝেমধ্যে সেটা রীতিমতো শ্রুতিকটু ঠেকে কানে। র্যাপ মানে নিছক নিজেকে জাহির করার খেলা নয়। জাহির করার ভিতর দিয়েই সত্তাকে চিনে নিতে হবে। শ্রোতার জন্য একটা স্পেস সেখানে রাখতে হয় যেন মানুষটির জীবনজার্নিকে তারা অনুভব করতে পারে। বাংলা ভাষার র্যাপ গানে মার্কিন র্যাপারদের অন্ধ অনুকরণ চোখে লাগে, যেখানে আবার ওইসব র্যাপারের জীবন তামা করে উঠে আসা র্যাপবুলিকে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আত্মস্থ করার ক্ষমতাটি এখনো প্রবল নয়। অনুকরণ আর আত্মস্থ করার ফারাক (বিনয়ের সঙ্গে বলা প্রযোজন) বাংলা র্যাপে এখন অবধি শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই।
হিপহপের পয়লা মন্ত্রই হচ্ছে একজন শিল্পীকে এই অনুভবে দীক্ষিত করা যে সে এক স্বাধীন সত্তা। র্যাপগায়ক তার গানে নিজেকে উদযাপন করার কাহিনি শ্রোতাকে শোনায়। কাহিনি সুখের অথবা মর্মান্তিক বিষাদে মোড়ানো হতে পারে। গান গাইবার সময় ওটা তাকে রাগিয়ে দিতে পারে। প্রবল আক্রোশে সবকিছু ধ্বংসের বিষাণ বাজানোর জন্যও তাতিয়ে তুলতে পারে। সকল অবস্থায় ভিতরের সাচ্চা মানুষকে টেনে বের করা র্যাপবুলির মূল লক্ষ্য, এছাড়া বাকি সব গৌণ সেখানে। এমিওয়ে বানতাই ওরফে বিলাল শেখ ঠিক এই কাজটা করে দেখিয়েছে ঢুনকে কে দেখা এপ বা নিজেকে ও চারপাশের ব্যস্ত জীবনেস্রোতকে আবিষ্কারের উল্লাসে সাজানো র্যাপবচনে :—
বিধাতা তাকে ধরায় নামিয়ে দেওয়ার দিন থেকে বানতাই বুঝে গেছে আমির, ফকির, গরিব, উজির, প্রেমিক অর্থাৎ যে-বেশ ধরে জীবনের সঙ্গে কুস্তি লড়ুক সে, দিনের শেষে সবটাই তকদির কা খেল। এমন এক জীবন যেখানে ভুলশুদ্ধের সবটাই ঘোরের মধ্যে ঘটে যায়! লোকে জীবনে মাস্ত হয়ে আছে আর সেটা দেখতে বানতাই মজা পাচ্ছে। বুরা ব্যাপার হলো জীবনে মাস্ত হতে সবাই এতটাই ব্যস্ত, দেখে মনে হয় তকদিরের জালে তারা ফেঁসে গেছে। বানতাই বাকি থাকবে কী করতে? সেও চব্বিশ ঘণ্টা গান বানানোর কুদরতি কারবারে লাট বা বেহুঁশ হয়ে আছে। কিসমতটা সঙ্গে করে ধরায় তার জন্ম হয়েছিল আর কুদরতি খেল দিয়ে হিপহপকে সিধে লাইনে আনবে সে। খেলায় নামার পরে যদিও বোঝা মুশকিল কোনটা সাচ্চা পেয়ার আর কোনটা ধোঁকা। জীবন যেমনতরো হোক না কেন, তসবির খিঁচনা অর্থাৎ ফটো খিঁচাটা চলতেই থাকবে। বানতাইও এক ধামাকায় র্যাপটাকে গুলি করবে এই সুযোগে। তারপর যা পড়ে থাকবে সেটা তার নিজের ভাষায়, ‘বাকি টাইম মে পুরি পাবলিককো আপুন আচ্ছি থট দেতে হ্যায়।’
নিজেকে উদযাপনের এই খেলায় র্যাপঈশ্বর এমিনেমও বলেছিল বটে, I don’t know, it’s just the way I am. নিজের নামের শুরুতে র্যাপঈশ্বরকে জুড়ে নেওয়া এমিওয়ে বানতাইয়ের জীবনবীক্ষণ সেই প্রতিধ্বনিটা করে স্বকীয়তায় পা রেখে। তামিম বিন সিতাবের বীক্ষণটা বেশ পুরোনো হওয়ার কারণে বাংলা ও ভারতীয় র্যাপগানের সমান্তরাল নিরিখ অনুপস্থিত ছিল। যেমন নেপালি র্যাপার ইয়ামি বুদ্ধা ও বাংলাদেশের তাবিব মাহমুদকে এক ফ্রেমে জুড়ে আলোচনার সময় হয়েছে। দুজনের গানের কথা যেমন শক্তিশালী, সমাজবীক্ষণ ও প্রতিবাদী র্যাপকলি গাওয়ার ধাঁচেও তারা অভিন্ন বটে।
…
যা-ই হোক, হিপহপ নিয়ে লম্বা ভণিতাটা শুরুয়াত মাত্র। সময়ের সঙ্গে আরো প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা জুড়ে লেখার প্রয়োজন হতে পারে। অন্যরা লিখলে নতুন করে ভাবা, নিজের ভাবনার গলতি শোধরানো ও আলোচনার পরিসর বাড়বে বৈ কমবে না। একটা কংক্রিট আলোচনা ও অনুসন্ধান বোধহয় হওয়া উচিত। অন্যথায় ফকির লাল মিয়ার আক্ষেপটা সার হবে শেষতক :— ‘অ্যাওয়ার্ড শো তে সবই আছে দেইখা কঠিন মজা পাই / পপ গানেরই মেডেল আছে বাংলা র্যাপের নামই নাই / দাম তোরা কেউ না দিলে বাংলা র্যাপ আর গাইবো কে? / ঢোল পিটাইয়া পরে কি লাভ, শিল্পী যদি না থাকে? / সবার হাতে হিন্দি ক্যাসেট হাত তালিটা দিব কে? / গলা ভাইঙ্গা লালের কি লাভ, / মানুষ যদি না শোনে?’ [দ্রষ্টব্য : বাংলা র্যাপের দাম নাই; কথা ও গান : ফকির লাল মিয়া]
কথাগুলোকে লালের অহংকার বা স্বীকৃতির বাসনা মনে হতে পারে, তবে সত্যটা হলো র্যাপ কিন্তু স্বীকৃতির মধ্যে বাঁচে। র্যাপগায়ক কুস্তির মঞ্চে অবতীর্ণ এক কুস্তিগর। সে চায় দিনের শেষে তার পালোয়ানি দেখে লোকে তাকে বাহবা দিক। লোক ও বাউল, রবীন্দ্র-নজরুল, উচ্চাঙ্গ বা আধুনিক অনেক গানের মতো এই গানও যুগ-যুগ টিকবে, লোকে নিরালা বসে ফিরে-ফিরে শুনবে, গভীর অনুভবে অভিভূত হবে ইত্যাদি র্যাপের বেলায় অমোঘ নয়। এই গান সমূলে তাৎক্ষণিক এবং সেখানে তার তীব্রতা যত বেশি হবে সমাজকে সে ততো নাড়া দিয়ে যাবে।
শ্রোতাকে গুরুতর দার্শনিক ভাবনায় নিপতিত করা হিপহপের মূল লক্ষ্য নয়। দার্শনিকতা এখানেও থাকে তবে সেটা সময়ের দাবির কাছে নিজেকে আগে সঁপে দিয়ে তবে! তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ যেন গানের কথার মধ্য দিয়ে একটা জোরদার ও আনন্দদায়ক লড়াই উপভোগ করতে পারে। র্যাপের শোম্যানশিপটা এতেই চরিতার্থ হয়। সুতরাং মানুষ না শুনলে এই গানের জনরায় নতুনত্বের সৃজনশীল বিস্ফার অথবা কাউন্টার কালচার-এ মোড় ফেরা জন্মেও সম্ভব নয়।
সকল স্তরের শ্রোতার সংযুক্তি, গ্রহণ অথবা খারিজ করার পক্ষে-বিপক্ষে আওয়াজ উঠানো ছাড়া র্যাপগায়কের ইমপ্রোভাইজেশন ঘটে না। বাংলা র্যাপে আগাছার মতো অজস্র বুলি উড়লেও তার মধ্য থেকে খাঁটি র্যাপের স্বাদ পেতে হলে ইমপ্রোভাইজেশনটা প্রয়োজন। গানের কথা থেকে শুরু করে পরিবেশনার সকল ক্ষেত্রে এটা জরুরি। যারপরনাই এর ভালোমন্দ নিয়ে বিস্তারিত আলাপে গমনের পরিবেশ যদি তৈরি না হয় তবে আপাতত পোলাপানদের বৃত্তে জনপ্রিয় মাধ্যমটি অচিরে দম হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে। তাকে টেনে তোলার মানুষ তখন দেশে মিলবে না।
— সমাপ্ত —
র্যাপকাহন ২ : বাংলায় হিপহপ
র্যাপকাহন ১ : বাংলায় হিপহপ
বাংলায় হিপহপ ও র্যাপ নিয়া গানপারে অন্যান্য রচনা
বাংলায় রিদম অ্যান্ড পোয়েট্রি নিয়া প্রাথমিকা
বাকরুদ্ধ ভুবনের পলিটিক্যাল অ্যান্থেম : স্কিব খানের ‘সব চুপ’
র্যাপ, রাজা কুমারী, প্রাচ্য ও পশ্চিম
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS