আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি কোম্প্যানি হুমায়ূনপ্রয়াণের অব্যবহিত পরবর্তী বছরভর একটা ভালো ঘটনা ঘটিয়ে গেছে, এইটা আরও অনেকেরই নিশ্চয় ইয়াদ আছে। এইটা আমরা ফার্স্টে ভেবেছিলাম হুজুগ হবে, দেড়-দুইদিন তদুর্ধ্বে চল্লিশার পর বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু না, আমাদের আশঙ্কা ও অ্যান্টিসিপ্যাইশন ভুল প্রমাণ করতেই হয়তো ঘটনাটা টানা অনেক রজনী অব্দি ঘটে গেছে। একবছর পূর্তিও হয়েছে এই ঘটনার। পরিবর্তিত যুগ ও লোকলস্করের বিটিভির কাছ থেকে এইটা আশাতীত বললে বেশি বলা হয় না।
তা, ব্যাপারখানা আলাপের জন্য চয়ন করা হলো কেন, ঘটনাটা বলি। বিটিভি নিয়মিত প্রতিহপ্তায় হুমায়ূন আহমেদের নাটক পুনঃপ্রচার করে চলেছে দেখা গেল। টুয়াইস ইন অ্যা উইক, সোম ও বৃহস্পতি। তুঙ্গ সংস্কৃতি। বিটিভি তার এই সদিচ্ছা আর শুভকর্ম অব্যাহত রাখলে এক্সিস্টিং ভিশ্যুয়াল চ্যানেলগুলো না-হোক অন্তত ওয়েইটিং টু গেট ডিক্লারেশন গরিবদেশের শত শত বিনোদনব্যবসাস্বাপ্নিকগণ ব্যাকফুটে খেলবেন বলে রে-অফ-হোপ ঝিলকি মারে। কেননা বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভাঁড়ারে এমন সমস্ত মালমাত্তা আছে যেগুলো পুনঃসম্প্রচারিত হলে এই বিগশট ব্যাংকলুটুয়াদের দেশে এন্তার মিডিয়ামাস্তানি তথা চ্যানেলমালিকানা বাগায়ে অ্যাডযন্ত্রণায় নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দেদার প্রোফিট খাওয়া খানিকটা চাপের মুখে পড়ত। অজস্র অহেতুকতা আর রাজার ঢোলবাজানি সত্ত্বেও এই বিটিভিনির্মিত স্বর্ণযুগের অনুষ্ঠানগুলো উদ্দেশ্য ও উদ্ভাবনায় এখনও অতুলনীয়। বর্তমান জমানার চ্যানেলবেনেরা আর্কাইভের বিটিভি দেখতে পেলে একটু হলেও মৌলিক আইডিয়ানির্ভর অনুষ্ঠান নির্মাণের পরম্পরাটা ধরে এগোতে পারতেন। গত দুই দশকের বিটিভিবিকৃতি নিয়া আলাপ করছি না, আর্কাইভড বিটিভি মিন্ করছি। কিন্তু মোহাফেজখানা বা আর্কাইভ জিনিশটা রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে কেমন হালে এক্সিস্ট করছে এই খবর আমরা জানি না। অ্যানিওয়ে।
যেইটা বলছিলাম, হুমায়ূন আহমেদের একক তথা সাপ্তাহিক খণ্ডনাটকগুলো এবং পাক্ষিক ধারাবাহিকগুলো, স্বর্ণসময়ের সেই বিটিভিপ্লেগুলো, তখনও হুমায়ূন উদ্ভট চলচ্চিৎপটাং পরিচালক হননি কিংবা হননি বিনোদনসওদাগর, বিটিভি রিপ্লে করছিল দুইযুগের ওপার হতে সেইসব দিনরাত্রির হুমায়ূনস্ক্রিপ্টের টিভিফিকশনগুলো এবং আমাদের অস্বস্তিপীড়নকর সপ্তাহগুলো ওই হুমায়ূনপ্রয়াণোত্তর সময়টায় স্মৃতিহীরকখচিত খাসা কাটানো গিয়েছে। যে-ব্যাপারটা খেয়াল করলাম, মজার ব্যাপার এবং ভাবনারও, প্রতিবার নাটক শুরুর অগ্রে টিভিঘোষক এসে ফর্ম্যাল ঘোষণা দেন নাটক শুরু হবার এবং বলেন যে, এবার আমাদের অনুষ্ঠানমালায় আপনাদের জন্য রয়েছে প্রথিতযশা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ কিংবা ‘কোথাও কেউ নেই’ ইত্যাদি। ইন্ট্রেস্টিং। প্রতিবারই এই পরিচয় দিয়ে চলেছে টেলিভিশনখোকা টানা একবছর ধরে। কেমন খটকা লাগছিল কানে, রিয়্যালাইজ করতে বেশ-একটু সময় লেগেছে। ব্যাপারটা হলো, ‘প্রয়াত প্রথিতযশা’। তাদের কাছে হুমায়ূন হপ্তায় দুইবার মারা যাচ্ছেন। অথচ হুমায়ূন তো আমাদের কাছে বেঁচে উঠেছেন অতীতের যে-কোনো সময়ের তুলনায় বেশিভাবে।
এই প্যারায় এসে একটা ফাজিল-ফিচেল হাসির রেখা দেখা যায় দর্শকদের কারো কারো ওষ্ঠে — আরে, বিটিভি মরহুম না-বলে প্রয়াত বলছে যে! এখন, রবীন্দ্রপূর্ণিমা বা নজরুলতিথিতে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করে তারা, বিটিভিওয়ালারা, তাতে তো বলে না তারা, ঠাকুর-কাজীবৃন্দ, প্রয়াত প্রথিতযশা! ভাগ্যিস বলে না। তাহলে তো পচে যেত এদ্দিনে কান আমাদের। রোজ সকাল-সন্ধ্যা এই দুজনের নাম তো বিটিভি নিয়ে থাকে বছরজুড়ে। প্রয়াত প্রথিতযশা রবীন্দ্রনাথ … প্রয়াত প্রথিতযশা কাজী নজরুল ইসলাম … জীবনানন্দ দাশ … মরহুম মশহুর শামসুর রাহমান … ভাবা যায়!
এখন, দেখা যাচ্ছে, বিটিভির কাছে রবিন-জীবন-নজরুল জীবিত, হুমায়ূন মৃত। অথবা কি উল্টোটা! ভাবছিলাম, কয়দিন পার হলে একটা প্রতিষ্ঠানের নিকট কোনো-একজন লেখক জীবিত বলে গণ্যগ্রাহ্য হন! মরে যাবার পর কয়বছর গেলে পরে একজন লেখককে প্রয়াত বলা থেকে বিরত হবে বিটিভি! কিংবা স্বাভাবিক ও জীবিত ভাবতে অভ্যস্ত হবে কবে থেকে, যেমন হুমায়ূন আহমেদকে, এই বিটিভির বিকটসংস্কৃতি ব্যক্তিকর্তৃপক্ষ! তবে একবছর পর্যন্ত শোকযাপন ও মৃতসৎকার যে বিটিভির দস্তুর, তা তো প্রমাণিত হইল। দুইবছর বা তারচেয়েও বহু বহু ধূসর বছরের পরও যদি, দেখা যাক, বিটিভিবাকশো হুমায়ূন আহমেদকে লেখক হিশেবে জীবিত মনে করে একটু সম্মান দেখায়। দেখাবে নিশ্চয়, বাচিক এই মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রেহাই দেবে লেখকেরে এবং আমাদেরে, একবছরে না হলেও দুই, কিংবা তিন, অথবা একযুগ পরে, লেট’স সি, আমরা অপেক্ষায় থাকি বরং
কবে যে এইসব — শুধু হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে নয়, অন্যত্র, সর্বত্র — অহৈতুকী বিশেষণ ব্যবহারের বাহুল্য খসবে আমাদের খাসলত থেকে! লেখায় এবং শিল্পসংস্কৃতির অন্য সর্বত্র এই জিনিশের প্রকট প্রেজেন্সে এক্কেরে পর্যুদস্ত অবস্থা দেখি। বিটিভি নিশ্চয় আমাদের জাতীয় আমল-খাসলতের একটা আয়না, তা খানিকটা ম্যানিপ্যুলেটেড হলেও। শুধু বিটিভি কেন, গণপ্রচারমাধ্যম হিশেবে ব্যবসা করতে নেমেছে এমন সকলেরই এই বাবতে দায় থাকিয়া যায়। ভাষায় জিন্দেগি, মৃত্যুও ভাষায়, ইহবাদী হব নাকি মৃত্যুপারলৌকিকবাদী জিনিশটা ভাষানুশীলনেই ঠিকঠাক করে নিতে হয়। কাউকে অনার করতে যেয়ে বা কারো অস্তিত্বের স্ট্যাটাস আপডেট জানাইতে যেয়ে তার নামের আগে একেকটা ফায়শা টাইটেল মরহুম বা প্রয়াত বা বিদেহী বা লোকান্তরিত বা স্বর্গত প্রভৃতি না লাগাইলেই কি নয়? বিটিভিঘোষণাতেই শুধু নয়, এই জিনিশ আমরা হামেশা করি ডেইলি লাইফে ফর্মফিলাপ ইত্যাদি কীর্তিকলাপে। বেহুদা নয়?
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS