হুমায়ূন, মধ্যবিত্তের ফ্যান্টাসি ও ডেড ফিলোসোফি || হাসান শাহরিয়ার

হুমায়ূন, মধ্যবিত্তের ফ্যান্টাসি ও ডেড ফিলোসোফি || হাসান শাহরিয়ার

শেয়ার করুন:

মধ্যবিত্ত জর্জরিত না। মধ্যবিত্ত ভালোভাবে হিসাব বোঝা এক ধূর্ত শিয়াল। যদিও হিসাবনিকাশের এই যে বুঝদারি তার, এইটা ব্যক্তিগত থেইকা কেবলই ব্যক্তিগততর। বাংলাদেশের সাহিত্য মধ্যবিত্তের। অতএব এইখানে মধ্যবিত্তরাই হয় মহিমান্বিত। হুমায়ূন আহমেদ এই সাহিত্যের এক সফল ও জনপ্রিয় ব্যক্তি।

বলা হয়, হুমায়ূন মধ্যবিত্তরে খুবই সফলভাবে ধরতে পারছেন। তাঁর সাহিত্যে মধ্যবিত্ত কোথাও করুণ, কোথাও হাস্যরসে ভরা। মধ্যবিত্ত হুমায়ুন পইড়া কারবালার বিলাপ ধরে। এই বিলাপ হুমায়ূন-সাহিত্যে এমন এক টান তৈরি করে, যা তারে মধ্যবিত্ত পাঠকের কাছে আবশ্যক কইরা তোলে। যেইসব মধ্যবিত্ত বই পড়ে না, তারাও হুমায়ূন পড়ে। ফলে বই-পড়া শিইখা যায়। মূলত এইসব আলাপ খুবই অ্যাক্রোব্যাটিক ধূর্ত শিয়ালদের খড়ের গাদা। কেন?

তাঁর গল্পে শিক্ষক বড়ভাই আছে। আলাভোলা, সহজ সরল। মধ্যবিত্তের প্রিয় ভাব। তার কোনো পাপ নাই। অপরাধচিন্তা নাই। মধ্যবিত্তের চোখে যা অন্যায়, তার কিছুই তার নাই। যেইটা বরং মধ্যবিত্তরে মনে করাইয়া দেয়, তার কোনো মেরুদন্ডই নাই। মধ্যবিত্ত এইটাতে খুশি হয়। যেহেতু তার আর কোনো দায় নিতে হইতেছে না। সে শুধু সংসারের দায় নিবো। হাল ধরবো। যেন এই এক মহান স্যাক্রিফাইস। খুশিতে চোখ টলমল করে মধ্যবিত্তের। যেহেতু আসলেই তার আর কোনো দায় নাই…

শিক্ষক হইলো বাংলাদেশের স্যোশাল লাইফে সামন্তীয় প্রভুদের অবশেষ। সামন্তীয় পীড়নের অবিলুপ্ত ভার। ফলে মধ্যবিত্তের এর প্রতি ভয় থাকে, শ্রদ্ধা থাকে, মাথা নুইয়া রাখার প্রবণতা থাকে। মধ্যবিত্ত এর মধ্যে অলিআল্লাহ দেখে। মধ্যবিত্ত বিনয়ের ভান করে।

যখন সে দেখে শিক্ষক খুনি পোলারে নিজেই পুলিশের কাছে ধরাইয়া দেয়, তখন তার বুক হুহু করে। এই মুখোশটাই তার দরকার। এই ছল, এই ছদ্মবেশই পারে তারে নিরাপদ রাখতে। হুমায়ূন এই নিরাপত্তা আরো বাড়াইয়া দেন। রাত হইছে তবু অন্ধকার নাই। জোছনার আলোয় মধ্যবিত্ত নিজের কাছে দেবতা হইয়া ওঠে। ম্যাজিক হুমায়ূনে।

হুমায়ূন টেগর থেইকাও বড় জমিদার। একজন উদার জমিদার। তার জমিদার বজরায় ঘোরে। গরিব শিশুরে খুশি হইয়া কোলবালিশটা উপহার দেয়। ছাদে মদ খাইয়া লেংটা নাচে। গরিবের লগে মিশে না। তবে বড় হাতে দানখয়রাত করে। যেমন পরজীবী হিমুর অর্থের যোগান দেয় তার ধনী খালা মাজেদা। মায়াবী এক মুখোশের মতো মধ্যবিত্তের আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, লালসা, ফ্যান্টাসি আর পাগলামি হুমায়ূনে সচল থাকে। জোছনাদেখা রাতের অন্ধকারে।

আত্মকেদ্রিকতা, স্বার্থপরতা, লালসা, হীনম্মন্যতা ছাড়া মধ্যবিত্তের কী আছে? হিসাবনিকাশের বাইরে, ধনী খরগোশদের মিমিক্রি করার বাইরে মধ্যবিত্তের কোনো জীবন নাই। আপনে মিশনারি। আপনে এইটারে মরণ ভাবাইতে পারেন। ফলে আপনে তারে এইসব ইন্দ্রজালের খবর দিতে পারেন। আপনে আসলে ধূর্ত শিয়ালের রাস্তা আরো পরিষ্কার কইরা দিতেছেন।

মনে পড়তেছে একটা গল্পের কথা। পুতুল। এইখানেও তাঁরে ফ্যান্টাসি বানাইতে দেখি। জমিদারের আহ্লাদ মিটাইতে দেখি। ধনীর পোলা পুতুলরে প্রাসাদ থেইকা বাইর কইরা নিয়া আসেন হুমায়ূন। তারে মিশান রাস্তার পোলাগো লগে। তারা রাস্তার পাশে মুতে, তারা থুথু-ফেলা নিয়া খেলে, শুধু একটা জামা পইরা সারাদিন রাস্তায় ঘুইরা বেড়ায়, শীতে কাঁপে, রোদে পোড়ে। কীসব খায়। ধনীর পোলা পুতুল এইসব দেইখা অবাক হয়। ‘কী আশ্চর্য’ হয়। ধনীর ছেলের কঠিন একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়।

হুমায়ূন অপরাধের শাস্তি দেন কোথাও। ভ্যাগাবন্ড প্রচন্ড রিচ্যুয়াল আর সুপারন্যাচারাল হিমুরে দিয়া। হুমায়ূনের এই আধ্যাত্মিক জাস্টিস প্রসেস, গরিবের প্রতি প্রচন্ড মানবিক পক্ষপাত—মধ্যবিত্তরে হাতেমতাইয়ের কথা মনে করাইয়া দেয়। মধ্যবিত্ত সন্তুষ্ট হয়। বাজারে এইবার সে আরো একটা মুখোশ পাইলো।

হুমায়ূনের চরিত্ররা শুধু অবাক হয়। নয়ত অবাক করে। তারা সবাই একরকম। তারা কেউ আপনের মতো না। হুমায়ূন এইভাবে আপনেরে বা আপনের চিন্তার কাঠামোরে  ট্র‍্যাপড করতে পারেন। যেন এই অবাক হইতে-পারার পরে অবাক করতে-পারাটা একটা যোগ্যতা…মধ্যবিত্ত সারাজীবন যে-মহত্ত্বের বিলাপ শুইনা নিজের মুখোমুখি মহিমান্বিত হয়, হুমায়ুনের এই ট্র‍্যাপ মধ্যবিত্তের কাছে আরো এক্সপেক্টেড, আরো মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া ওঠে।

হুমায়ূনের মেয়েরা পরীর মতো সুন্দর হয় সাধারণত। আপনে একজন পরীই চান, তাই না? তারা আপনের পরিচিত মেয়েদের মতো কথা বলে না। বরং আপনারে সিডিউস করে আপনার প্রেমিকার মইধ্যে এইরকম কিছু পাইতে। তারা খিলখিল হাসে। তারা হুহু কইরা কাঁদে। তাদের জীবনের আর কোনো গন্তব্য নাই। লক্ষ্য নাই। এর বাইরে মধ্যবিত্ত পারলে চিন্তা করতে চায় না। হুমায়ূনের মেয়েরা জোছনারাতে প্রেমিকের পাশে এক রহস্য হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে কেবল। অল্পবয়সী মেয়েটা বিবাহিত পুরুষের টেন্টের বাইরে ছটফট করে।

মধ্যবিত্ত নামের ধূর্ত শিয়ালদের কাছে এইভাবে হুমায়ূন মহীরুহ হইয়া ওঠেন। চেখভ না। আরো বড় কিছু। হুমায়ূন।

বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের দুইটা বড় কাজ কী? এক, তার সাহিত্যের ভাষা। তিনি সবচেয়ে সফলভাবে বাংলা লেখার জনপ্রিয় সাহিত্যিক। প্রমিত-আধিপত্যরে কোনো থিওরি ছাড়া, শুধু হিউমার দিয়া বাংলাদেশের জলাশয়ে চুবাইয়া দিছেন। দুই, তাঁর লেখা অল্প কিন্তু বিউটিফুল কিছু সায়েন্স ফিকশন। তিনি সায়েন্স ফিকশনের নামে টোনাটুনির কিচ্ছা করেন নাই।

ফিলোসোফি কী? Knowledge আর Wisdom দিয়া অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎরে দেখতে পারা। আমাদের সোসাইটি এইভাবে দেখতে পারতেছে না বহুদিন ধইরা। সোসাইটিতে তাই চিন্তাও নাই। বরং চিন্তার নামে চলতেছে বাইনারি-ক্যাওসের মতো প্রতিক্রিয়া। বলা যাক, একটা দর্শনশূন্য সোসাইটি আমাদের। যেহেতু এইটা নাই ফলে এই সমাজ গিমিক, ভেল্কিবাজি, ভাইরাল, স্তূতিমার্কা ফ্যান্টাসিতে সহজে মগ্ন হইয়া যায়। ফ্যান্টাসিতে মগ্ন থাকা অপরাধ না। তবে এর বন্ধ্যা ফায়দা নেওয়া ক্ষতির।

দর্শন কি কোথাও আছে? এই পৃথিবীতে? নাকি ‘ফিলোসফি ইজ ডেড’? গোলটেবিলে পরমাণু চুক্তি কইরা ফেলে মহাজনেরা। আর ছানিপড়া চোখগুলা দেখে এই এক অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক ডেভেলপমেন্ট! ফলে আমরা দেখতেছি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, আধিপত্যবাদী ফ্যাসিস্ট, ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট, সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ট। অথচ এই দর্শনই একদিন…খুব বেশিদিন আগে না, পৃথিবীটারে ফ্যাসিস্টমুক্ত করছিলো।

দর্শন নাই, ফলে আপনার সাহিত্যও কোনো লক্ষ্য দাঁড় করাইতে পারতেছে না। সাহিত্যরে যদি পলিটিকালাইজডও করেন, আপনে যেন আরো বড় ভুল কইরা বসেন। যেহেতু সাহিত্য নিজে নিজে সবসময়ই রাজনৈতিক।

জুলাই ২০১৫


হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
গানপারে হুমায়ূন আহমেদ

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you