হুমায়ূনের স্মৃতিতাড়িত ‘দেয়াল’ আর ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইদুইটার দুইটা দুর্বল দিক হইলো—
১. গল্পের মধ্যখানে ঘটনার দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে গিয়া বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স দেওয়া, যা গল্পের গতিরে ভয়াবহরকম নষ্ট করছে। এইরকম চেষ্টা একজন রাইটারের আত্মবিশ্বাসহীনতারে লুকাইয়া রাখতে পারে না।
ইতিহাস অনেকটা খোলা বাজারের মতো। এই বাজারের ভিতরে আপনে অনেক পথে যাইতে পারেন। মনে হইছে, হুমায়ূন ইতিহাসরে লিনিয়ার আর বদ্ধ সময় ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন নাই বা বহুমাত্রায় ভাবার সাহস করতে পারেন নাই। অবশ্য এইরকম বাংলাদেশে—অনেকে অনেক কিছু করার বা ভাবার সাহস না-ও দেখাইতে পারে। এবং আমার কোনো ইচ্ছা নাই, কেউরে কাঠগড়ায় খাড়া করায়ে বিচার বসাই। কীসের বিচার? বরং এই বাংলাদেশে ‘সওদা’ হইতে পারে একটা ভালো শব্দ এবং এরে ডিফেন্ড করতে ‘কোলেটারাল ড্যামেজ’ হইতে পারে ভালো একটা এক্সকিউজ।
২. কোনো কোনো জায়গায় মনে হইছে, যুদ্ধ লইয়া হুমায়ূনের স্মৃতি খুব দুর্বল। তাঁরে স্মৃতির ভানে নির্ভর করতে হইছে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি লইয়া লেখা ‘ইতিহাসের দালিলিক সূত্রসর্বস্ব’ (!) বিভিন্ন বইয়ের উপর। মনে হইছে, ওইসব তথ্যের সত্যতা বা যৌক্তিকতা লইয়া হুমায়ূন খুব বেশি চিন্তা করতে পারেন নাই বা করেন নাই (কিছু কিছু ক্ষেত্র ছাড়া)।
হুমায়ূন নিজে মনে করতেন, রাজনীতিটা তিনি সেইভাবে বুঝতে পারেন না। কিন্তু উনার এই বুঝতে না পারা বা এই বিষয়ে উদাসীনতা আলোচ্য বইদুইটার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটরে যেন একটা অপরিণত চিন্তার এক্সপ্রেশন বানাইয়া দেয়।
এইবার ছফার ‘নিহত নক্ষত্র’ প্রসঙ্গে—
১৯৬৯ সালে আহমদ ছফা ‘নিহত নক্ষত্র’ নামে একটা গল্পের বই প্রকাশ করেন। বইয়ের নামে রাখা ‘নিহত নক্ষত্র’ গল্পে ‘মুনতাসীর’ এমন এক যুবক যারে দেখা যায় আচমকা নিজের নিভৃত খোলস থেইকা বাইর হইয়া আসতে। সোসাইটির হীনম্মন্য শরীর লইয়া তিরস্কার করতে। সমাজ বদলাইতে চাওয়া মেধাবী মুনতাসীরের চারপাশ ভরা সব ইম্বেসাইলে, ইম্পুটেন্টে। কিন্তু ছফার হাতে মুনতাসীরের পরিণতি কোনোভাবেই ছফার তৈরি করা মুনতাসীরের প্রাথমিক পরিচয় বা পজিশনের সাথে যায় না। বরং প্রোটাগনিস্টের উপর ছফা-চিন্তার আরোপ বা জবরদস্তি খুবই অস্বস্তিকর লাগে। গল্পটাতে এইটা হইলো একটা দুর্বল দিক।
অন্যসব গল্পে ব্যর্থ আর সামাজিকভাবে লাঞ্চিত এক কবিরে দেখা যায়, রুস্তম নামের এক ডাকাতরে দেখা যায়, কাজলী নামের এক পানবেচা মেয়েরে দেখা যায়—যার টানটান শরীর। কাজলীর ভরা বুক এক মোল্লারে তার অবদমনের মুখোমুখি করে এবং পরিণতিতে দেখা যায়, মোল্লা ‘মানবিক বিয়ে’ নামে হালের প্রতারণাপূর্ণ কূটভাষণের ধার না ধাইরা কাজলীর ভরা বুকে ঝাঁপাইয়া পড়তেছে। সখিনা নামের এক কাজের বুয়ারে দেখা যায়—যার শরীরের ডাকে বারবার ধরাশায়ী হইতেছে ঘরের মালিক, মালিকের ছেলে, মালিকের চাচা, মসজিদের মোল্লা।
কিন্তু ‘নিহত নক্ষত্র’ গল্পটাতে ‘অরাজক যুগ’—এই এক জোড়শব্দ বাদ দিলে, কোথাও কোনোভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে গল্পের সময়কালটা আইডেন্টিফাই করা যায় না।
ছফার লেখা পড়লে আমার বরাবর একটা জিনিস মনে হয়, উনি খুব হিসাব কইরা লিখতেন। স্বতঃস্ফূর্ত না, বরং খুব সতর্ক।
জুলাই ২০২১
হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
গানপারে হুমায়ূন আহমেদ
- ছফা, হুমায়ূন ও সাহিত্যের ভাষা || হাসান শাহরিয়ার - October 14, 2025
- হুমায়ূন, মধ্যবিত্তের ফ্যান্টাসি ও ডেড ফিলোসোফি || হাসান শাহরিয়ার - October 9, 2025
- বৃষ্টিতে ব্রহ্মনাদের খোঁজে প্রাগভবিষ্যের পদাবলিতে… || হাসান শাহরিয়ার - September 17, 2025
COMMENTS