হুমায়ুন আজাদ প্রণীত ‘বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠী?’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ পুনর্পাঠ

হুমায়ুন আজাদ প্রণীত ‘বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠী?’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ পুনর্পাঠ


বাঙালি, পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোট, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে; … ছোট ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোট, সংকীর্ণ হওয়া; কূপমণ্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধ’রে। বাঙালির এক অংশ প’ড়ে আছে এক বড় দেশের একপ্রান্তে, ভুগছে প্রান্তিক মানসিকতায়; এবং আরেক অংশ ঠাসাঠাসি ক’রে বেঁচে আছে আরেক ভূভাগে, যা এক টুকরো। বাঙালির দারিদ্র্য বিশশতকের বড় কিংবদন্তি ও সত্য। আর্থিক দারিদ্র্য মানুষকে মানসিকভাবে গরিব করে, বাঙালির মনের পরিচয় নিলে তা বোঝা যায়। প্রতিটি বাঙালি ভোগে অহমিকারোগে, নিজেকে বড় ভাবার অচিকিৎস্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বাঙালি। ইতিহাসে বাঙালির যে-পরিচয় পাওয়া যায়, তা গৌরবজনক নয়; এবং এখন যে-পরিচয় পাই বাঙালির, তা আরো অগৌরবের।

।।।
জাতি হিশেবে বাঙালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে। বাঙালির স্বভাব উঁচু গলায় কথা বলা; সাধারণত শুরুই করে উচ্চকণ্ঠে, বা ক্রমশ তার গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। যদি আলাপের বিষয়টি বিতর্কিত হয়, পক্ষবিপক্ষ থাকে, তাহলে অল্প সময়েই তারা প্রচণ্ড আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকে; এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি দুয়ের বেশি হয়, তিন-চার-পাঁচজন হয়, তাহলে আলোচনা পুরোপুরি পণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে-কোনো আলাপে বাঙালি নিজেই নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না; এমনকি, অনেক সময়, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই বাঙালি তীব্র আলোচনায় অংশ নেয়। বাঙালির যুক্তি কণ্ঠের উচ্চতা; যার কণ্ঠ যত উঁচু, সে নিজেকে ততটা যুক্তিপরায়ণ ব’লে গণ্য করে; এবং নিজের জয় অবধারিত ব’লে জানে। যুক্তিতে কোনো বাঙালি কখনো পরাজিত হয় নি, হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। … বাঙালির কথার পরিমাণ ও বক্তব্য সমানুপাতিক নয়; প্রচুর কথায় বাঙালি সামান্য বক্তব্য প্রকাশ করে। বাঙালির কথার প্রাচুর্য হয়তো বোঝায় যে জীবন তাকে ক্লান্ত করে নি; এবং সাথে সাথে এও বোঝায় যে জীবনে তার অপ্রাপ্তি অশেষ। বাঙালির অধিকাংশ কথাই তার না পাওয়ার কথা, তার সমস্যার কথা, তার জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যর্থতার কথা। বাঙালি তার কথা দিয়ে জীবনের না-পাওয়ার শূন্যতাগুলো পূরণ করে। এ-দিক দিয়ে বেশ ট্র্যাজিক জাতি বাঙালি; কিন্তু সে তার ট্র্যাজেডিকে লুকিয়ে রাখতে চায় অন্যের কাছে। বাঙালির কথায় ধরা পড়ে তার অন্তঃসারশূন্যতাও।

।।।
বাঙালির স্বভাবে রয়েছে অতিশয়োক্তি, সে কোনো আবেগ ও সত্য প্রকাশ করতে পারে না অতিশয়োক্তি ছাড়া। অতিশয়োক্তি ভাষাকে জীর্ণ করে, নিরর্থক করে, যার পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালির ভাষিক আচরণে ও লিপিবদ্ধ ভাষায়। ‘দারুণ পছন্দ করি’, ‘ভীষণ ভালোবাসি’, ‘শ্রেষ্ঠতম কবি’-র মতো অতিশয়োক্তিতে বাঙালির ভাষা পূর্ণ। অতিশয়োক্তি লঘুতার লক্ষণ; এতে প্রকাশ পায় পরিমাপবোধের অভাব। বাঙালি লঘু, পরিমাপবোধহীন। বাঙালি সাধারণত কারো আন্তর গুরুত্ব নিজে উপলব্ধি করতে পারে না; অন্য কারো কাছ থেকে তার জানতে হয় এটা; এবং একবার অন্যের কাছ থেকে জেনে গেলে, বিচার না ক’রে, সে তাতে বিশ্বাস করে। বাঙালি ভাষাকে এক ধরনের অস্ত্ররূপেও ব্যবহার করে। কলহে বাঙালির প্রধান অস্ত্র ভাষা — আগ্নেয়াস্ত্রের মতো বাঙালি ভাষা প্রয়োগ ক’রে থাকে।

।।।
বাঙালি সামাজিকভাবে ভদ্র বা সৌজন্যপরায়ণ নয়; তার সৌজন্য ভীতি বা স্বার্থচেতনাপ্রসূত। বাঙালি যখন পথেঘাটে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখনও ঠিক সৌজন্যবিনিময় ঘটে না। ধর্মীয় সম্বোধন অনেকে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক’রে থাকে, তবে তা যতটা যান্ত্রিক, ততটা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নয়। পশ্চিমে রাস্তায় বেরিয়েই পরিচিতজনের, সামান্য পরিচিতের, হাসিমুখ দেখা স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু এখানে হাসিমুখ দুর্লভ; রেশারেশি বাঙলায় আলোবাতাসের মতো সত্য। প্রতিটি এলাকা পারস্পরিক রেশারেশিতে গোপন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ভয়ঙ্কর এখানে। তাই সামাজিক ভদ্রতা দুষ্প্রাপ্য। বাঙালি সমাজ প্রতি মুহূর্তে ক্ষমতানিয়ন্ত্রিত; প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি ক্ষমতারূপে বিরাজ করে, চলাফেরা করে। ক্ষমতা কোনো ভদ্রতা জানে না। ক্ষমতার দুটি দিক রয়েছে; — একটি দম্ভ, তা শক্তিমানকে দাম্ভিক করে; আরেকটি অসহায়ত্ব, তা অধীন ব্যক্তিকে স্তাবকে পরিণত করে। তাই বাঙালি দাম্ভিক বা স্তাবক, ভদ্র নয়।

।।।
‘চরিত্র’ সম্পর্কে বাঙালির ধারণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ‘চরিত্রহীন’ বলতে বাঙালি বোঝে পরনারীতে আসক্ত পুরুষ; তার চোখে আর কেউ চরিত্রহীন নয়, শুধু পরনারীআসক্তই চরিত্রহীন বা দুশ্চরিত্র। ঘুষ খাওয়া চরিত্রহীনতা নয়, গৌরব; কপটতা চরিত্রহীনতা নয়, মিথ্যাচার চরিত্রহীনতা নয়, এমনকি খুন করাও চরিত্রহীনের লক্ষণ নয়, শুধু নারীআসক্তিই চরিত্রহীনতা। তবে বাঙালিমাত্রই পরনারীআসক্ত; প্রকাশ্যে নয়, গোপনে। বাঙালি ধর্মের কথা শোরগোল ক’রে ব’লে ধর্মবিরোধী কাজ করে অবলীলায়, প্রগতির কথা ব’লে প্রগতিবিরোধী কাজ করে প্রতিদিন; … শক্তি বাঙালির জীবনের বড় নিয়ন্ত্রক; — বাঙালি শক্তিমানের পদানত হয় নির্দ্বিধায়, আর দুর্বলকে পীড়ন করে অবলীলায়। বাঙালি শক্তিমানের কোনো ত্রুটি দেখে না, শক্তিমানের সমস্ত অন্যায়কে মেনে নেয়, বাঙালির চোখে শক্তিমান কখনো চরিত্রহীন নয়, শক্তিমানের কোনো চরিত্র থাকার দরকার আছে ব’লেও মনে করে না বাঙালি; কিন্তু চরিত্রবান হওয়া দুর্বলের জন্য বিধিবদ্ধ। … বাঙালি, অশেষ ভণ্ডামোর সমষ্টি, শক্তিকেই মনে করে বিধাতা।

।।।
বাঙালি কখনো প্রভুভক্ত নয়। বাঙালি জানে প্রভু শাশ্বত, কিন্তু কোনো বিশেষ প্রভু নশ্বর। এক প্রভু নিঃশেষ হয়ে গেলে বাঙালি আরেক প্রভু ধরে, আরেক প্রভুর নিন্দায় মুখর হয়, জয়গানে মুখর হয় নতুন প্রভুর। … অন্যদের সমস্ত কিছুতে নাক গলাতে বাঙালি শুধু পছন্দই করে না, এটাকে কর্তব্য ব’লে গণ্য করে। বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্থ রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি তার একটা খারাপ খবর তৈরি করে। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করে না। বাঙালি অন্যের একান্ত বা ব্যক্তিগত কিছু সহ্য করে না। তাই বাঙালির কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। … বাঙালির চোখে ব্যক্তিগত জীবন পাপ; বাঙালি মনে করে দরোজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়; তাই তার দায়িত্ব অন্যের দরোজা ভেঙে ঢুকে তাকে পাপ থেকে উদ্ধার করা। তবে বাঙালি উদ্ধার করে না, অন্যকে বিপদে ফেলাই তার সমস্ত উদ্বেগের উদ্দেশ্য। … বাঙালি কুৎসা রটিয়ে সুখ পায়; আর এ কুৎসা যদি যৌন হয়, তাহলে তা সর্বশ্রেষ্ঠ। বাঙালি একটি নিন্দাকেই বড় নিন্দা মনে করে, তা হচ্ছে লাম্পট্য নিন্দা। কোনো পুরুষকে লম্পট আর নারীকে ভ্রষ্টা হিশেবে চিহ্নিত ক’রে দিতে পারলে বাঙালি জীবন সার্থক হয়েছে ব’লে মনে করে। … বাঙালি নারীপুরুষ পরিতৃপ্তির সাথে পরস্পরকে উপভোগ করে না। উপভোগের ধারণাও তাদের নেই। যে-প্রশান্তি, স্বাস্থ্য ও নিরুদ্বেগ পরিবেশ প্রয়োজন পরিতৃপ্তির জন্যে, তা নেই অধিকাংশ বাঙালির। তাই বাঙালি অনুপ্রাণিত হওয়ার সাথে সাথেই উপসংহারে পৌঁছে; এটা তার জীবনের সংক্ষিপ্ততম কাজ; … এখানে যে-অপরিতৃপ্তি, তা ঘিরে থাকে বাঙালির সমগ্র জীবন; তাকে রুগ্ন ক’রে রাখে। এ-রুগ্নতার ফল বাঙালির হঠাৎ-জাগা কামনা। বাঙালি নারী দেখলেই তাকে কাম্য বস্তু মনে করে, মনে মনে রমণ করে। এমন যৌনঅসুস্থ জাতি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুস্থ হ’তে পারে না।

।।।
বাঙালি দায়িত্বহীন, কোনো দায়িত্বই বাঙালি ঠিক মতো পালন করে না। তবে বাঙালি দায়িত্ব পালন সম্পর্কে অন্যকে হিতোপদেশ দিতে ব্যগ্র থাকে। … বাঙালির প্রতিটি কর্মস্থল অকর্মস্থল, দায়িত্ব-পালন-না করার কেন্দ্র। … বাঙালি জীবনের অর্ধেকের বেশিই ব্যয় হয় অকর্মে। বাঙালি সততার ভান করে, কিন্তু খুবই অসৎ। প্রতিটি কর্মক্ষেত্র অসৎ মানুষের লীলাভূমি। … বাঙালি নীতির কথা বলে সব সময়, কিন্তু নীতি রক্ষা করে না। বাঙালি মনে করে নীতি রক্ষা করবে অন্যে, তার নিজের কাজ হচ্ছে নীতির কথা বলা।

।।।
এমন একটি জনগোষ্ঠীকে কি রুগ্ন ব’লে শনাক্ত করা ছাড়া আর কোনো পথ আছে? এ-রুগ্নতা সাময়িক নয়, কয়েক দশকের নয়, বহু শতকের; সম্ভবত শুরু থেকেই বাঙালি ভুগছে এ-সমস্ত রোগে; এবং দশকে দশকে দেখা দিচ্ছে নানা অভিনব ব্যাধি। … তার সমাজ রুগ্ন, সামাজিক রীতি রুগ্ন; তার রাজনীতি রুগ্ন, রুগ্ন তার রাষ্ট্র। কোথাও তার স্বাস্থ্য নেই, সুস্থতা নেই। … বাঙালি চিকিৎসায় বিশ্বাসী নয়। … জাতির চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু রাষ্ট্র চিকিৎসার বদলে রোগ বাড়াতেই বেশি আগ্রহী। … রাষ্ট্র এখন রুগ্ন ক’রে চলছে বাঙালির শরীর ও মন, তার কাঠামো ও মনোজগৎ; রুগ্ন ক’রে চলছে তার সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র। রুগ্ন রাজনীতি বিনাশ ঘটায় সব কিছুর; এখন বিনাশ ঘটছে বাঙালির সব কিছু। বাঙালি হয়ে উঠেছে আরো প্রতারক, ভণ্ড; হয়ে উঠেছে আরো অসৎ, নীতিশূন্য, আদর্শহীন; বাঙালি হয়ে উঠেছে আরো খল, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী। নিয়ন্ত্রণের ফলে বিকৃত হচ্ছে বাঙালির শরীর, ও কামনাবাসনা। যতই ধর্মের কথা বলা হচ্ছে অজস্র মাইক্রোফোনে, ততই বাড়ছে অনৈতিকতা; যতই শোনানো হচ্ছে সংযমের কথা, ততই বাড়ছে অসংযম ও বিকৃত কাম; … বাঙালি হয়ে উঠছে একটি বিকৃত জনগোষ্ঠী। মনোবিজ্ঞানীর চোখ দেয়া দরকার এদিকে, যেমন চোখ দেয়া দরকার সমাজবিজ্ঞানীর। … বাঙালির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; — একটি জনগোষ্ঠী কি রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হ’তে হ’তে লুপ্ত হয়ে যাবে?

[হুমায়ুন আজাদ প্রণীত ‘বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠী?’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ উৎকলিত; নির্বাচিত প্রবন্ধ ২৫৪-২৬৫, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৯]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you