দিগম্বর ও অন্যান্য

দিগম্বর ও অন্যান্য

সড়কের ওপর এঁকেবেঁকে হেঁটে বেড়াচ্ছে সে, সর্পিল গতিতে, ফের হাঁসের ভঙ্গিতে বেশ বড় বৃত্ত ধরে ঘূর্ণন তুলছে। সকাল-বিদেয়-নেয়া বারোটার রোদ। বৃষ্টি হয়েছিল সকালের দিকটায়, যে-কারণে রোদ কড়া হলেও রোদের এফেক্ট যথেষ্ট স্যুইট এখনো। তবে চোখে একটা ধাঁধানো অন্তরায় তৈয়ার করে বেশিক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে এই রোদের পানে। সড়কের মাঝবরাবর ডিভাইডার, দুইপাশ দিয়াই যাচ্ছে-আসছে ঘোড়াছাড়া গাড়ি। এবং যাচ্ছে-আসছে সে। এঁকেবেঁকে। সর্পগতিতে। হংসভঙ্গিমায়। একমনে হেঁটে ও দৌড়ে চলেছে সে ব্যালেরিনাস্টাইলে। দেহে একটা সুতাও নাই প্যাঁচানো। অগোছালো শ্মশ্রু। যথেষ্ট ম্যাস্কুলিন ফিগার। হাইট পাঁচ ফিট সাত অনুমান। ছিপছিপে, মেদহীন, এখনও অত ময়লা না-হলেও গতরে শ্যাওলার ন্যায় আস্তর যদিও। নগ্নগাত্র হলেই কি উন্মাদ বলা যাবে? সে তো উন্মাদনা কিছুই করছিল না, অস্থির পায়চারি করছিল শুধু সড়কের এ-ধার ও-ধার। যার ফলে তার পাশ দিয়া যাওয়া গাড়িগুলো সন্দিগ্ধ নয়নে একটু গতি শিথিল করছিল। সমীহ আদায় করে নিচ্ছিল সে ভিয়্যাকলগুলোর কাছ থেকে। ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল না কারোরই। কি কারণে কেউ বুঝতে পারছে না তার অস্থিরতা। কখন কি করে বসে, সেই ভয় নেই দেখলাম ইতস্তত-ছড়িয়ে-থাকা রাস্তাপার্শ্বের তামিশকির মানুষদের মধ্যে। এর মানে হচ্ছে যে, এই ব্যাপারটা, এই পাগল, অত্র তল্লাটে বেশ চেনাজানা সবার। না-হলে পথবাজারের লোকেরা ত্রাসকাণ্ড করত কিছু-একটা, তাড়াতে থাকত কন্টিনিয়্যু লোকটাকে, সেসব কিছুই করছিল না কেউ।


গতিরোধ করতে হলো আমারও ঘোড়ার। আমার গাড়িহীন ঘোড়ার। যদিও স্যাডল থেকে নামতে হয় নাই। মিনিট-খানেক দেখে ফের ঘোড়ার জিন চেপে ছুট লাগাতে হলো। পড়ে রইল পেছনে সে। মিস্টেরি অফ দি ইউনিভার্স। ব্যোদলেয়্যরের অচেনা মানুষ। সেই-যে, রহস্যময় সেই মানুষের সঙ্গে কবির কথোপকথা : বলো, রহস্যময় মানুষ, কাকে ভালোবাসো তুমি? না, উত্তর থেকে জানতে পারি আমরা, মা-ভাইবোন নয়, প্রিয়তমা নয়, প্রেম নয়, কেউ নেই তার সেভাবে, ছিল না কোনোদিন। তাহলে? সে জানায় : আমি ভালোবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ, উঁচুতে … ওই উঁচুতে … আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল। … পড়ে রইল। পড়ে রইল অর্ডার অফ দি থিংস। পড়ে রইল লর্ড অফ দি রিংস। পড়ে রইলেন মহান তিনি, দি ম্যাড, সার্বভৌম ও অবিসংবাদিত। সঙ্গে এল এই ডিসোর্ডার অফ দি সিভিলাইজেশন। এই লেখা। এই খেলা। এই ধান্দাবাজি। গোটা প্রকৃতির স্পটলাইট তার উপরে যেয়ে ফোক্যাস করছিল, জনা-পঞ্চাশ চোখের দ্রষ্টব্য সে সবসময়, সেলিব্রিটি অফ দি ন্যাচার। লোনস্যম লাইক গড। ডিভাইন কেওস্।


অবিশ্বাস্য মনে হবে শুনলে যে, সে একটা কাপড়খণ্ড ধরে রেখে তার একাগ্র ভূমিকার কাজ করে যাচ্ছিল সড়ক জুড়ে। ত্যানা-মতন বস্ত্রখণ্ড। বুকের কাছে ধরা কাপড়ের সেই টুকরোটা। হাবভাবেও ফুটে উঠছিল অমন একটা ব্যাপার যে সে কিছু-একটা যেন লুকোতে চাইছে দুনিয়ার কাছ থেকে। না, সভ্যতার শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার নিম্নাঙ্গ নয়, পেছনাঙ্গ বা সামনাঙ্গ ওইসব কিছুই নয়, সে লুকোচ্ছিল বুকের কাছটা। আমি ঠিক এই কিসিমের দিগম্বর আগে দেখেছি ইয়াদ হয় না। হার্ডকোর দিগম্বর অনেক দেখেছি জীবনে, দেখেছি ঢের হার্ডকোর কীর্তিকলাপও তাদিগের, কিন্তু বুকের কাছে এইভাবে ইতস্তত বস্ত্রখণ্ড ধরে রাখা দিগম্বর দেখি নাই আগে। এমন যদি হতো যে সে ত্যানাটা প্যাঁচায়ে রেখেছে শরীরে, বা ঝুলায়ে রেখেছে গলার সঙ্গে ফাঁসিগিট্টু সেঁটে, মেয়র আনিসুল হকের ন্যায়, সেক্ষেত্রে ছিল আলাদা আলাপ। কিন্তু না। সে এমনভাবে রেখেছে কাপড়টুকরোটা, এমন ভঙ্গিতে, যেন বুকটা সে রক্ষা করছে।


দেখে মনে হয় বেশিদিন হয়নি তার এই রূপান্তরের বয়স। নতুন প্রায়। আনকোরা। তারে যেয়ে একবার যদি জিগানো যেত, তুমি পূর্বরূপে ছিলে যবে, কি করতে ভাই? বিজনেস না সার্ভিসহোল্ডার ছিলে? ব্যাঙ্কে না বিনোদনসাংবাদিকতায়? নাকি সর্বরোগহর গবর্মেন্টে? এনজিওতে? ফেসবুকে বসতে? কে তোমারে এইখানে প্রমোশন দিলো? কোনো বন্ধু? কারো ফলন্ত গাছ উপাড়ি নিয়াছিলে তুমি? দিয়াছিলে বুঝি কারো পুত্রশোকে গালি? বাড়া ভাতে ছাই, কিংবা ধানক্ষেতে মই? কিচ্ছুটি না? হাইপাররিয়্যাল? অপর বাস্তব? অব্যাখ্যেয়? তোমারই চেনাজানা লোকগুলো তোমারে এই জায়গায় এনেছে? ফেসবুকিশ বকাবাদ্যি দিতে দিতে? আস্তিক-নাস্তিক ফেনোমেনা? নাকি হিন্দু-মুসলমান? তুমি কার পক্ষ নিয়েছিলে বলো তো? বুঝেশুনে পক্ষ নিতে পারো নাই তো? পক্ষ নিয়েই কি বুঝেশুনে এহেন হয়েছ? হতে পারে, এইসব, এসবের যে-কোনো একটা কারণে তুমি এ-রূপে অবতীর্ণ হয়েছ।


কবি ছিলে নাকি? তোমারই সতীর্থ তোমাকে ঠেলতে ঠেলতে, তোমাকে নিয়ে ফিচলেমি করতে করতে, এইখানে এনেছে হয়তো। করার নাই কিছুই। কেবল লিখতে চাইলেই তো হলো না, তোমাকে লেখার চেয়ে বেশি কন্সেন্ট্রেইট করতে হবে লেখাসংঘ-লেখকসঙ্গ বোঝাশোনার দিকে, ঘোঁট পাকাতে না-জানলে কিচ্ছুটি হবার নয় হে! আর জানতে হবে, শিখে নিতে হবে, পজিশন শিফ্টিং। মিনিটে মিনিটে পরিবর্তন, মিনিটে মিনিটে ধসানো, মিনিটে মিনিটে নিজেকে অস্বীকার। এরই নাম সৃজন। কোনোকিছুতে স্টিক করে থাকার রাবীন্দ্রিক সাহিত্যামল আর নাই রে ভাই। নিগেশনের অনুশীলন করতে হয় নিজের জীবনে, সাহিত্যে সেইটা করার ক্ষ্যামতা না-থাকলেও, তবেই তুমি পারবে অপরূপ থেকে যেতে। মরণোত্তরও। অপরূপ থেকে যেতে পারলে তুমিই হবে সভাপতি, শিশুদের আবহমান বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগের আসরে।


জয়দেব বসু একটা কবিতায় এমন পঙক্তি লিখেছিলেন মনে পড়ল যে, কবিরাই আমার বুকের মাংস খুবলে খেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এবং দেখিয়েছিলেন সতীর্থ কবিদের দাঁতে অপর কবিদের দেহের মাংসকুচি, জিবে সকসকানো লোভ। সতীর্থের পাওনা যেনতেন প্রকারেণ ছিনিয়ে নেয়ার লালসা। ঈর্ষার কা কা। খামাক্কা গালাগালি, ধ্বস্তাধ্বস্তি, চিৎকার-চিল্লাচিল্লি। ঠিক একইভাবে জয় গোস্বামীকেও বলতে দেখা যাবে, একই অভিজ্ঞতা, পিঠে ছুরি মারা বন্ধুটির জন্য আহত কবির পাগলামিও উন্মাদের পাঠক্রমপ্রণেতা আমাদিগেরে শুনিয়েছেন বহুবার। শঙ্খ ঘোষ অনেক আগেই ভিক্টিম হয়েছিলেন, পাগল হতে হতে এইটুকু বলে নিয়ে বেঁচেছিলেন, অলমাইটিকে লক্ষ্য করে, এত দিলে তির ও তিরন্দাজ চারপাশে, কেবল বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে। হে হরি! প্রভু হে! হায় খোদা!


কবীর সুমন এক পাগলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পাগল সাপলুডুখেলোয়াড়। সারাক্ষণ সাপলুডু খেলত আনমনে। কার সঙ্গে? বিধাতার সঙ্গে। রণজিৎ দাশ দেখিয়েছিলেন দুই পাগলের মুখ। একজন পুরুষ, একজন নারী। পুরুষ পাগলের ভূমিকায় ‘ক্ষ্যাপা হরেন’, যে শহরের সমস্ত ছেঁড়া পাতাগুলোর মধ্যে কি লেখা আছে তা বলে দিতে পারে আপনি জিজ্ঞাসা করা মাত্রই। কি লেখা, ভাই হরেন? কনফিডেন্ট উত্তর : মালতী বসু! এইবার নারী পাগলের কথাটা জানা যাক। এইটা কবি নিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী ইয়্যুং তথা কার্ল গুস্তাভ ইয়্যুং-এর থিসিস-অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে। ইয়্যুং যে-হাসপাতালে কাজ করতেন, সেখানে তারই তত্ত্বাবধানে এক রোগিনী ছিল, কেউ তার হিস্ট্রি জানত না। কোনো কথাও বলত না সেই রোগী। শুধু সারাক্ষণ দুই হাতে মেশিন চালানোর ভঙ্গি করে যেত, স্যুইং মেশিন, জুতো সেলাইয়ের স্যুইং। পঞ্চাশ বছর সেই হাসপাতালে থেকে সেই নারীটি এক-সময় মারা যায়। তার ভাই আসে তাকে নিয়ে যেতে দাফনের জন্য। ইয়্যুং কথা বলে জানতে পারেন, তার বোনটি ছোটবেলা থেকেই ছিল অন্যরকম, সবার মতো না, খুব ভালো ও মায়াবতী ছিল। সবাই তাকে ভাবত যে তার মাথায় ছিট আছে। অ্যানিওয়ে। এক-সময় সোমত্থ হয়ে তার এই বোনটি তাদেরই গ্রামের এক চর্মকারের প্রেমে পড়ে। কিন্তু চর্মকারের পরিবার থেকে আপত্তি জানানো হয় মেয়েটি পাগল বলে। চর্মকারও পিছু হটে যায়। এরপর থেকে এই পঞ্চাশ বছর ইয়্যুঙের চোখের সামনে সেই মেয়েটি তার প্রেমাস্পদকে কাছে রেখেছে, এক-মুহূর্তের জন্যও আড়াল করেনি, চর্মকারের ভঙ্গি নকল করে সে নৃত্যবিভোর জীবন কাটিয়েছে প্রেমে। উন্মাদ। উপবাসী। কবিতাটা আরও সুন্দর। কবিতার নাম ‘উন্মাদিনীর কথা’ বা এই-রকম কিছু।


মানুষ দিগম্বর হওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার নাকি ছোট, তা জানে তার্কিকরা। তবে এইটা ঠিক যে একজন দিগম্বর মানুষ মানেই নিশ্চিত সে আপনার-আমার মাপজোখের বাইরের কেউ। সে সাধারণ না। মনে হয় এইসব। পাগলামির ইতিহাস, কয়েদখানার ইতিহাস ইত্যাদি না-পড়েও, ক্ষ্যামতাকাঠামোর জজবা ও জোর-জবরদস্তি কিচ্ছুটি না-জেনেও আপনি পাগলের এইটুকু অভিজ্ঞান নিশ্চয়ই জানেন এবং সমীহ করেন। মানুষ কেন পাগল হয়, এইটা আপনি বই ঘেঁটে জানতে পারবেন হয়তো। তবে একজন দিগম্বর পাগল কেন বুকের কাছে ন্যাকড়া প্যাঁচায়ে হৃদয় সুরক্ষা করতে চায়, এইটা ভাই শুধু শুধু ফ্যুকো খুঁজে হেঁদিয়ে মরবেন না। আজাইরা।


I saw the best minds of my generation destroyed by madness, starving hysterical naked — অ্যালেন গিন্সবার্গের এই পঙক্তিটাই আমাদেরও বলতে হবে, একটু ঘুরিয়ে, হিস্টিরিয়ার পূর্বাপর সম্পর্কে একটু কথা খর্চে, অন্য কোনোদিন।

১০
মাগরেবের আজান হয় দিকে দিকে। আমাদের পাগলটির গা ধুইয়ে দ্যায় এখন সন্ধ্যার শুশ্রূষাশীলা বাতাস।


ব্যবহৃত ছবির শিল্পী : অ্যালেন গিন্সবার্গ ।। লেখা : জাহেদ আহমদ ২০১৫

… …

গানপার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you