চারপাশের পৃথিবীটা পাল্টে গেল। লাইনের দুই ধার ধরেই কলাক্ষেতের ভেতর দিয়ে একই রকম অন্তহীন পথ চলে গেছে। সে-পথ দিয়ে সবুজ কলা বোঝাই গরুর গাড়ির সারি চলেছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ ফাঁকা জায়গায় চোখে পড়ে লাল ইটের ক্যাম্প, অফিসের জানালায় ক্যানভাসের পর্দা আর ছাদে ফ্যান ঝুলছে, কখনো পপিক্ষেতের মাঝখানে একটা নিঃসঙ্গ হাসপাতাল। প্রত্যেকটা নদীর ধারে গ্রাম আর ওপারে লোহার পুল। ট্রেনটা প্রচণ্ড শব্দে হুইসল বাজিয়ে সেগুলো পার হচ্ছিল। বরফশীতল জলে গোসল করতে আসা মেয়েরা বিশাল শ্যাড মাছের মতো পানিতে লাফ দিচ্ছিল স্তনের চকিত দৃশ্যে ছুটন্ত ট্রেনের যাত্রীদের বেসামাল করে দিয়ে।
উপরোক্ত অংশটুকু তপন শাহেদ অনূদিত মার্কেসের আত্মজীবনী ‘বেঁচে আছি গল্পটা বলব বলে’ বই থেকে নেয়া। শুধু এই দৃশ্যটুকুর কথা বলব বলেই লিখতে বসা। ছুটন্ত ট্রেন থেকে কত কত দৃশ্য তো আমারও দেখা আছে। ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ — বিবাহ-পরবর্তী চলাচলে এই ট্রেনই তো বাধ্যতামূলক বাহন হয়ে উঠেছিল! ট্রেনে যেতে যেতে কত কত দৃশ্য চোখে পড়ত! কেন জানি না, ট্রেনকে আমার মনে হয় সাময়িক একটা ছুটন্ত পাড়া। কিংবা, একেকটি নতুন উপন্যাস। নানারকম মানুষের হাজাররকম গল্প নিয়ে সে ছুটে চলেছে। সিরাজগঞ্জ যেতে যেতেই একবার অ্যান্ড্রয়েডের নোটবুকে লিখেছিলাম :
আবার ট্রেনে। এই ট্রেন বুঝি জীবনের নতুন একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। এই যে হকার, পাশেই দাঁড়িয়ে পিঁয়াজুভাজা বিক্রি করছে আর থেকে থেকে হাঁক ছাড়ছে — এই ভাজা পিঁয়াজু! একটা ছেলে, কিশোর বলা ভালো, ‘এই পপকর্ন… এই পপকর্ন…’ বলে পুরো ট্রেনটাকেই উত্তেজিত করে তুলছে, এসব দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে। এখন ভূয়াপুর স্টেশন। এখানে মিনিট-পনেরো দাঁড়াবে ট্রেনটা। সেতু পার হতে আরো বিশ মিনিট। মনসুর আলী স্টেশন পেতে দিব্যি আরো দেড় ঘন্টা লাগবে নিশ্চিত।
এই শসা খান, শসা খান, আমড়া আমড়া আমড়া … এই বাদাম, ভাজা বুট, বাদাম … চায়না ব্রাশ, মানিব্যাগ, চায়না ব্রাশ … শসা খান এই শসা খান …
একেকজনের গলার আওয়াজ একেকরকম। এই মুহূর্তে ভূয়াপুর স্টেশনের সমস্ত হকাররা যেন একযোগে অভিযান চালাতে উঠে এসেছে সিল্কসিটির এই ট্রেনটাতে। যাত্রীদের অনেকেই নেমে কেউ কলা, কেউ সিগারেট, কেউ বিস্কুট কিনছে। একটু পরেই বিকট হর্ন বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেবে — যাত্রীদের সেদিকে সতর্ক মনোযোগ। হর্ন বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই, আমি জানি, ট্রেনে ওঠার হুড়োহুড়ি লেগে যাবে। একটা শ্রেণি এই ভিড় সম্বল করে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। সুতরাং যাত্রীদের ভেতর থেকেই কেউ-একজন চিৎকার করে স্বগোতক্তির মতো বলল, ‘এই মোবাইল সাবধান’। সামনের সিটে এক ভদ্রলোক মোবাইলে নির্বিকার কার্ড খেলছে। কে নেমে আবার উঠল, কার মোবাইল কিংবা মানিব্যাগ হারাল সেদিকে তার থোড়াই কেয়ার। এই যে, এখন যমুনা সেতুর উপর। ট্রেন তার স্বাভাবিক গতি কমিয়ে ঘন্টায় দশ কিলোমিটার গতিতে এগোচ্ছে। জানালা দিয়ে নিচে তাকালে সেতুপূর্ব যুবতী যমুনাকে মনে পড়ছে। এই নদী দিয়েই-না আমরা মামাবাড়ি যেতাম! সেই সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যায়, রিকশায়, বাসে, লঞ্চে — কখনও কখনও লঞ্চ থেকে নেমে ফের নৌকায় চেপে, যেন পুরো মহাদেশ ভ্রমণ শেষে আমরা মামাবাড়ি পৌঁছাতাম। লঞ্চে যেতে যেতে পালতোলা নৌকা, বিপরীত দিক থেকে আসা লঞ্চ কিংবা গাড়ি ভর্তি ফেরির চলাচল দেখে, ওইইই যে … ওইইই যে … রব তুলে আমরা দু-ভাই বাবা-মার শৃঙ্খলের ভেতর থেকেই উল্লাস করতাম। সেই যমুনা, মাঝে মাঝে কালো এক প্রকার প্রাণী আংশিক শরীর দেখিয়ে ফের ডুবে যেত। সেই প্রথম জেনেছিলাম শিশু বলতে শুধু ছোট ছোট ছেলেমেয়েকেই বোঝায় না। নদীকূলের মানুষেরা অন্য এক প্রাণীকেও শিশু বোঝে। সেই যমুনা, আমাদের সেই তেজী দেমাগী যমুনা এখন কেমন মাথা নুইয়ে সব সয়ে যাচ্ছে। আহা!
ওই তো, ওই যে ভেসে যাচ্ছে মুহুর্মুহু ঢেউ। ও ঢেউ, বালুচরে কেন এত দাগ রেখে যাস!
পরেরদিন সকালে সিরাজগঞ্জ শহরের নিরুপদ্রব রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘুরে এসে, নদী ও নৌকার তোলা ছবি দেখতে দেখতে ডায়রিতে লিখেছিলাম :
ট্রেন ভ্রমণের আনন্দ জীবনে যে না পেয়েছে তার জীবন বৃথা। গতকাল ট্রেনের ভেতর থেকে পৃথিবীর আশ্চর্যতম সুন্দর আকাশ দেখা হলো। দেখলাম, মুহুমুর্হু একমাত্র আকাশই নিজের রঙ বদলাতে পারে। সন্ধ্যার আগে আগে গেরুয়া রঙের কত রেখা, কত বিদগ্ধ তুলির স্ট্রোক যেন ছড়িয়ে দিয়েছেন কেউ আকাশ জুড়ে। যেন মুহূর্তে মুহূর্তে নানা রকম চিত্রে ক্যানভাস ভরিয়ে তুলছেন। গ্রামের পেছন থেকে সান্ধ্য গ্রাম — যেন দিগন্তরেখা বরাবর স্থির হয়ে আছে কোনো বিকল ট্রেন। সেই আলো-আঁধারিকে ভেদ করে আকাশে অর্ধেক চাঁদ একটু একটু করে বোল্ড হতে চাইছে। গ্রামের পেছনে আমি-বরাবর জলাভূমি। কচি কচি সবুজ আগাছা মাথা উঁচিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কেউ হেঁটে যায় হয়তো রোজ, পায়ে পায়ে সাদা সাপের মতো পথ তৈরি হয়ে আছে জলাভূমির একটা অংশে। মাঝে মাঝে জানালা ভেদ করে মোলায়েম একটা হাওয়া সপাটে এসে গালে লাগছে। তখন বোঝা যায় ট্রেন ছুটছে, জোরেশোরেই ছুটছে।
কুউউ…ঝিক ঝিক…ঝিক ঝিক…ঝিক ঝিক…ঝিক ঝিক…
কিন্তু গোসল করতে আসা মেয়েদের ঝাঁপাঝাঁপির সময় স্তনের চকিত দৃশ্যে যে ট্রেনের যাত্রীরা বেসামাল হয়ে পড়ে; এই আপাত সরল দৃশ্যটিকে যে এমন চৌকসভাবে বর্ণনা করা যায় এটুকু অভাবিতই ছিল। দেখার নতুন একটা চোখ তৈরি হলো এতে। আবার, ওই যে, কলাক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া অন্তহীন পথ — যেন দিনের পর দিন, ক্লান্তিহীন, সে ছুটেই চলছে। কোথায় চলেছে পথ? তার গন্তব্য কোথায়? কোথায় শেষ?
পথের শেষ না থাকার মতোই মহাসাগরেরও দ্বিতীয় কোনো পাড় থাকে না।
এমন একটা উত্তর দিয়েছিলেন মার্কেসের নানা। ফেনায়িত সবুজ জলরাশির এক বিপুল বিস্তারের সামনে দাঁড়িয়ে তার নানা যখন তাকে বলেছিলেন : এ-ই হলো মহাসাগর।
তখন মার্কেস তার নানাকে জিজ্ঞেস করে — অন্য পাড়ে কী আছে?
তার নানা জবাব দিয়েছিলেন, ‘এটার অন্য কোনো পাড় নেই।’
উৎপলকুমার বসু চলে গেছেন। একদিন সম্মতির আশা যার করেছিলাম; তিনিও। প্রতিধ্বনি রেখে মানুষ ক্রমাগত নৈশ ট্রেনের মতো দূরে চলে যায়। দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে একদিন সুদূর হয়ে যায় —
অবারিত এই শূন্য চরাচরে, ওই যে, আবারও কে ডেকে উঠছে, কে বলছে চিৎকার করে — দূর থেকে হাত তোলো, দূর থেকে হাত তোলো, দূর থেকে হাত তোলো … যদি পারো জানাও সম্মতি …
‘দূর থেকে হাত তোলো। যদি পারো, জানাও সম্মতি।
নইলে সংকেত আজো বৃথা যায়। চলে যায় নৈশ ট্রেন দূরে—
অর্ধেক জাগ্রত রেখে আমাদের। অবিরত যাত্রা কি কাঠের?
লোহার কোরক আজো দীর্ঘ, প্রতিধ্বনিময়
স্টেশনে স্ফুলিঙ্গ পড়ে। দরজায়, উজ্জীবিত নীড়ে—
ভাঙা হাত, নষ্ট চোখ, মনে রেখো সেই দুর্ঘটনা।
চলেছি নির্বাণহীন, ক্রাচে বাহু, অন্ধের বিত্ত নিয়ে খেলা—
আমাদের প্রস্তাবে কোনোদিন দিলে না সম্মতি।’
প্রচ্ছদচিত্র / অসীম দাস
… …
- ইচ্ছেশ্রাবণ ৬ || বিধান সাহা - August 26, 2020
- ইচ্ছেশ্রাবণ ৪ || বিধান সাহা - July 25, 2020
- ইচ্ছেশ্রাবণ ৩ || বিধান সাহা - July 15, 2020
COMMENTS