১.
রাস্তার ঠিক মাঝপথে আকাশ অন্ধকার করে সন্ধ্যা নামল। অথচ এখন সকাল। এখন উজানী সময়। আমরা বসে আছি একটা গুদামের বাইরের রাস্তা-লাগোয়া বারান্দায়। দুজন চটের বস্তার ছেঁড়া অংশ সেলাই করে চলেছে আত্মমগ্ন হয়ে। ব্যবসায় এ-রকম ছেঁড়া চটের বস্তা মাত্র চার টাকা পিসে কিনে রেখে কোন ব্যবসায়ী সতেরো টাকা দরে বিক্রি করে আরো লাল হয়েছে, সেসব আলাপে মশগুল বৃষ্টিতে সাময়িক আশ্রয় নেয়া বাকিরা। একটা বাঁশের মাচাঙের উপর বসে মাটিতে পা ঠেকিয়ে বসে আছি আমরা তিনজন। সামনে ক্ষয়ে-যাওয়া, পিচ-ওঠা রাস্তা। বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে এখানকার প্রকৃতি। বৃষ্টি যেন বহুদিন পর এমন অলস সময় বের করে দিলো। একটা কেঁচো, দেখতে পাচ্ছি, বৃষ্টিভেজা কাদামাটির ভেতর থেকে ঢেউ খেলে খেলে বারান্দায় উঠে আসছে। অদূরে একটা শালিক গা ঝাঁকি দিয়ে জল ঝাড়ছে। রাস্তার ওপারে একটা ছোট খেজুর গাছ। তিন চারটি ডাল খানিক উঠে মাথা নেতিয়ে দিয়েছে যেন। বৃষ্টি নামলে ওরাও কি ধ্যানী হয়ে ওঠে?
ওপাশে একটা চাতাল। তার উদোম বুক ভিজে যাচ্ছে নববিবাহিতের মতো। বাঁদিকে একটা ঘর। টিনের চালের উপর একটা বক না কী এক পাখি; ভিজে জুবুথবু। আর ডানদিকে আইলেভেল পর্যন্ত ভুট্টাখেত। সকলেই ভিজে যাচ্ছে। প্রকৃতি যেন আরও বেশি করে স্থির হয়ে আছে। যেন সকলেই ধ্যানরত।
আমার মনে পড়ছে তেরোই জুন। বৃষ্টিময় সকাল। সিএনজিতে ছুটে চলা। হাতের উপর একটি কোমল হাত। আর চোখে গোপন জল।
একটু সহজ দৃশ্য, গভীরতা তারও বেশি দূর।
২.
প্রচণ্ড শীত আর গরম একইসাথে টের পাচ্ছি। ফেরার পথে আলতো বৃষ্টি ধরেছিল; ভিজেছি সামান্যই। বৃষ্টির জল শুকিয়ে যাবার আগেই আবার ঘামে ভিজে গেছি। জীবনটাকে তোমার মতো ছক কষে কষে কাটানো আমার সাধ্যের বাইরে। অন্যদের মতো গতানুগতিক জীবন আমাকে কখনোই টানেনি। এখনও টানে না। ফলে রোদ-বৃষ্টির সামান্য এই ভিন্নতা আমার ভালো লাগছিল। ভেবেছিলাম কিছুই হবে না। কিন্তু এখন জ্বর আসছে। যে-জীবনে আমাদের আনন্দের ঘটনাগুলো হাতে গুনে বলে দেয়া যায়, সেখানে তুমি বলো, জ্বরের চাইতেও সেই মুহূর্তের আনন্দটা কি মূল্যবান নয়? যদিও মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। নাক বন্ধ হয়ে আছে। চোখও জ্বালাপোড়া করছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় ব্যথা তো তোমার অনুপস্থিতি!
কে বলো পোড়ায় কারে, কে জ্বালায় আপন শরীর!
৩.
কত অকারণ নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা! কত নিমেষ-ফুরানো জঞ্জাল নিয়ে এই নিরুদ্দেশ যাত্রা! কতই তো বৃষ্টি হলো, জল ঝরলো — কত আহ্বান, কত প্রণয়স্তুতি — কই, আকাশ যে এখনও তেমন! ঘর যার পোড়ে, সে-ই জানে, ভরা বন্যায় তার আর হারানোর কিছু নাই। সামান্য মুক্তিও নাই! মুক্তোদানার মতো ভেসে উঠছে অজস্র বেদনা। তুমি মুঠো খুলে দাও…
৪.
শহরে বৃষ্টি হচ্ছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। ইফতারের সময় হয়ে গেছে। জানালার ধারে চেয়ার টেনে বসে বাইরের বৃষ্টি দেখছে শ্রী। দূরে সোনালু ফুলের গাছগুলো ভিজে জুবুথবু। দুয়েকটা সাদা কার আর সিএনজি একটা রিকশাকে অতিক্রম করে সাই সাই করে চলে গেল। দুটো মেয়ে ছাতা নিয়ে আনন্দ করতে করতে এল সোনালু ফুলগাছটার নিচে। যেখানে গোল করে আল্পনা আঁকা তার মাঝখানে দাঁড়াল। নানান ভঙ্গিতে পর পর কয়েকটা সেল্ফি তুলল হাসিমুখে। তারপর বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি নামার আগেই চলে গেল। আকাশ হলুদ হয়ে উঠেছে। এই হলুদ আলোয় সরাসরি আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করল। শ্রী-ই এসে বলল, চলো ছাদে যাই। আমরা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশ কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। রাস্তার ওপারে, পশ্চিমে, সোনালু ফুলের সারিবদ্ধ গাছ। উত্তরদিকে মসজিদের দীর্ঘ মিনার। পূর্বদিকে যতদূর চোখ যায় অজস্র বিল্ডিং। পূর্বদিকে কোনো নদী নেই এই সত্য আমরা জানি। তবু একটা নদীর জন্য আমাদের ব্যাকুলতা তৈরি হলো। যেন, পূর্বদিকে, ওই ওই বিল্ডিংগুলোর ওপারে একটা স্রোতস্বিনী নদী থাকলে ভালো হতো।
গতকাল থেকেই শ্রীর জ্বর। আজ বৃষ্টি হচ্ছে। নদীর জন্য মনে বড় মায়া। মায়া মুছে গেলে মানুষগুলো এক-একটা পাহাড় হয়ে যায়। পাশের ফ্ল্যাট থেকে একটা গান ভেসে আসছে — পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো…
৫.
সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। আমাদেরও ছিল ঢাকায় ফেরার তাড়া। তবু বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সংবরণ করা ছিল কঠিন। অতএব দলবল গুছিয়ে নেমে পড়া। ঝুম বৃষ্টিতে সেদিন আরো ভিজেছিল শিয়ালকোলের সবুজ ধানখেত। নিঃসঙ্গ তালগাছ। মেহগনির বাগান। অরাজনৈতিক কড়িতলা। কোলাহলপ্রিয় টেম্পুস্ট্যান্ড আর চেতনাদের বাড়ির প্রহরী কুকুরগুলো। সেদিন বৃষ্টির জলের সাথে ভেসে এসেছিল সঙ্গহারা একপাটি জুতো। মনখুশিদির বাড়ির ভেতর ভরে গিয়েছিল থৈ থৈ জলে। সেই জলে টুকু একটা করে কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দিয়ে এসে করুণ মুখে সিমিকে বলছিল, “ইট্টু পরেই দেহিসনি ব্যাকটি ডুইবা য্যাবানি। গায়ে সাবান মাক। চল, পিচলা খেলি।”
বৃষ্টি থেমেছিল। আমরাও অনেক সংশয় নিয়ে দেখেছিলাম মনখুশিদির বাড়ির ভেতর থেকে জলগুলো একটু একটু বের হয়ে আসছে। রোদ উঠছে। সিমি হাসছে। টুকু হাসছে। আর বউয়ের সাথে ঝগড়া শেষ করে আরেকপাটি জুতোর খোঁজে বের হয়েছে ধলুর বাপ। তার ধারণা হারিয়ে-যাওয়া জুতোটি তার বউই ষড়যন্ত্র করে বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
এইসব গল্পের ফাঁকে টুকু লাল মগে ছাঁচের জল ভরে চট করে মাথায় ঢেলে নিলো।
সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। সেদিন ঢাকায় ফেরার খুব তাড়া ছিল।
৬.
এ-রকম মেঘলা ছুটির দিনে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রিমায় যাই। তখন বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে ভিজে যায় চন্দ্রিমার সবুজ সার্কেল। সেই সার্কেলে ভোরে হাঁটতে বের হওয়া মানব-মানবী থাকে, পথশিশুরা থাকে, থাকে প্রেমিক-প্রেমিকারা। সবুজ আপনাকে আর কিছু না হোক, সাময়িক প্রশান্তি দেবে। এই মেগাসিটি নামক জঞ্জালে ভরা নগরে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত হওয়া আপনাকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাবে।
এই যে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে — মেয়েটা ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বৃষ্টিস্নাত চন্দ্রিমার ইট-বিছানো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা তাকিয়ে আছে ভিজে-যাওয়া সবুজ গাছগুলোর দিকে। অনেক গাছের মাঝে একটা কাঁঠাল গাছ। সেখানে একটা বয়সী কাঁঠালপাতা রঙ হারিয়ে লাল হয়ে উঠেছে। হয়তো কয়েকটাদিন পরেই ঝরে পড়বে। ওরা সামান্য দাঁড়াল, পাতাটাকে আলতো ছুঁয়ে দিলো। তারপর কী ভেবে নিজেদের দিকে তাকাল। চোখে চোখেই কিছু কথা হলো। সামান্যই। তারপর আবার হাঁটা শুরু করল। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। ওরা কোনো আড়াল খুঁজছে না। বৃষ্টিতে নিজেদের মেলে দিয়েছে যেন।
সেই বৃষ্টিতে আমরাও ভিজে যাই। ভিজতে থাকি। বৃষ্টি মানেই অনন্ত বিক্ষুব্ধতার বিপরীতে এক অন্যতর রবীন্দ্রগীত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতার কথা মনে এল। ‘যখন বৃষ্টি নামলো’ —
বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো
কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল
নেই নিকটে — হয়তো ছিলো বৃষ্টি আসার আগে
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, তাই কি মনে জাগে
পোড়োবাড়ির স্মৃতি? আমার স্বপ্নে-মেশা দিনও?
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, চলচ্ছক্তিহীন।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম পাবো তোমার দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে — অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
প্রচ্ছদচিত্র / অসীম দাস
… …
- ইচ্ছেশ্রাবণ ৬ || বিধান সাহা - August 26, 2020
- ইচ্ছেশ্রাবণ ৪ || বিধান সাহা - July 25, 2020
- ইচ্ছেশ্রাবণ ৩ || বিধান সাহা - July 15, 2020
COMMENTS