শ্রীকান্ত দাশ :: গণসংগীতের অনন্য শিল্পী || অপূর্ব শর্মা

শ্রীকান্ত দাশ :: গণসংগীতের অনন্য শিল্পী || অপূর্ব শর্মা

সংগীত, সংস্কৃতি আর রাজনীতি- এই তিনের সমন্বয়ে ভাটি-বাংলায় যে ক’জন ব্যক্তি নিজেদের অনন্য উচ্চতায় আসীন করতে সক্ষম হয়েছেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু সিলেট অঞ্চলেই নয়, জাতীয়ভাবেও তিনি ছড়িয়েছেন স্বীয় কর্মপ্রভার দ্যুতি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে, মুক্তিসংগ্রামে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সাস্কৃতিক জাগরণে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা এক কথায় অতূলনীয়।

রাধারমন, হাছন রাজার গান শুনেই তাঁর বেড়ে ওঠা। লোকগানের উর্বর ভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি শুরু করেন গনসংগীত চর্চা। কালপরিক্রমায় হয়ে উঠেন গনসংগীতের এক অনন্য শিল্পী। গানকে তিনি শোষণমুক্তির হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। শখের বসে কিংবা অর্থ রোজগারের অভিলাষ তাঁকে কখনও নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুৎ করতে পারেনি। তাই সংগ্রামে তাঁর কন্ঠ প্রেরণার উৎস হয়ে অগননকে দেখিয়েছে সঠিক পথের দিশা। মেহনতি মানুষ নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে তাঁর সুরের দ্যুতিতে। কন্ঠযাদুতে পেয়েছে নির্ভরতা। তাঁর দড়াজ কন্ঠ উদ্দীপ্ত করেছে মানুষকে। বেদনায় দিয়েছে প্রশান্তির শীতল ছোয়া!

১৯২৪ সালের ৫ জুলাই, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের যে এলাকায় জন্মেছেন শ্রীকান্ত দাস তাঁর অবস্থান একেবারে সীমান্ত লাগোয়া। প্রান্থিক এই অঞ্চলে তাঁর জন্মের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো একেবারেই অনুন্নত। বর্ষায় নৌকায় যাতায়াত করা সম্ভব হলেও হেমন্তে পায়ে হাটা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। বিস্তীর্ন মাঠ-ঘাট পাড়ি দিয়েই চলাচল করতে হতো ভাটি এলাকার মানুষকে। শাল্লা তখন সবেমাত্র নৌ-পুলিশ থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রশাসনিক থানা হিসেবে যাত্রা করেনি তখনও। শ্রীকান্তের জন্মের আটদিনের মাথায় প্রয়ান ঘটে জ্ঞানদায়িনী দাশের। ছোট্ট শিশুকে দেখভাল করার জন্য বাধ্য হয়েই নবীগঞ্জের বাল্লা জগন্নাথপুরের মাতুলালয় বেছে নিতে হয় যোগেন্দ্র কুমার দাশকে। মাতৃহারা সন্তানকে দাদা-দাদির কাছে সমর্পন করেন তিনি। তাদের অসীম ভালোবাসায় বেড়ে উঠেন শ্রীকান্ত। তার দাদা সুরেশ চন্দ্র রায় কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কমিউনিষ্ট পার্টির সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং দলীয় কর্মকা-কান্ডে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সে কারনে রায় বাড়িতে প্রায়ই বসতো গানের আসর। চলতো সংগীত শিক্ষার পাঠ। সেই পরিবেশই গানের প্রতি আগ্রহী করে তুলে শ্রীকান্তের শিশুমনকে। দলীয় পরিবেশনায় সঙ্গত দিতেন তিনি, আর কোরাসে দিতেন দোহার। পড়া-লেখার পাশাপাশি গণসংগীতের হাতেখড়ি হয়ে যায় সেখানেই। সেই শিক্ষাই পরবর্তীতে গনসংগীতের নিবেদিতপ্রান শিল্পীতে রূপান্তরিত করে তাঁকে। বাম ধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন নবীগঞ্জ থেকেই। তবে, তাঁর বাক বদলের পেছনে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রয়েছে পরোক্ষ ভূমিকা। নেতাজীর হবিগঞ্জ আগমন তাঁর কিশর মনে প্রভাব ফেলে। সুরেশ চন্দ্র রায়ের সাথে হবিগঞ্জে বিপ্লবী বসুর বক্তৃতা শুনে উজ্জীবিত হয়ে সম্পৃক্ত হন দলীয় নানা কর্ম-কান্ডের সঙ্গে। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় কৈশরেই প্রশাসনের রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে। নবীগঞ্জ হাইস্কুল থেকে রাজটিকেট করা হয় শ্রীকান্ত দাশকে। যার ফলে বাধ্য হয়েই নবীগঞ্জ পর্বের পাঠ চুকিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হয় জন্মস্থানে। ভর্তি হন লউলারচর মধ্যবঙ্গ স্কুলে। লেখাপড়া আর রাজনীতি চলতে থাকে সমান তালে। এসময় বাম আন্দোলনের পুরোধা করুণাসিন্ধু রায়ের সংস্পর্শে আসেন শ্রীকান্ত দাশ। সেই যোগসূত্রতাই কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে তাঁকে। তারমতো একজন দড়াজ গলার শিল্পীর খুব প্রয়োজন ছিলো তখন। সেটাই যেনো পরিপূর্ণতা লাভ করে শ্রীকান্ত দাশের মাধ্যমে। করুণাসিন্দু রায়ের মাধ্যমেই বৃহৎমঞ্চে আসীন হন শ্রীকান্ত। ১৯৪৪ সালে নেত্রকোনা ‘অল ইন্ডিয়া কৃষক সম্মেলনে’ তাঁর সামনে উন্মোচিত হয় এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার। সেই সম্মেলনে তাঁর গান শুনে ভূয়সী প্রশংসা করেন কমরেড মনি সিং। সত্যেন সেনও স্নেহের পরশে সিক্ত করেন তাঁকে। সেই থেকেই কমিউনিষ্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দলের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর দড়াজ কন্ঠে ‘কাউয়ায় ধান খাইলরে, ডাকাইবার মানুষ নাই। কাজের বেলায় আছইন মানুষ, খাইবার বেলায় নাই’-গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই গানটি গাইতে হতো তাঁকে। সুরমা উপত্যকার কৃষক সম্মেলনেও গণসংগীত পরিবেশন করেন তিনি।

শ্রীকান্তের বয়স যখন তেইশ বছর, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি হয়ে গেলো দেশ। জন্ম নেওয়া ভূ-খন্ডের বিভক্তি তাঁকে ব্যাথাতুর করে তুলল। অনেকে পারি জমালেন ওপারে। কিন্তু তিনি যুক্ত হলেন না সেই দলে। মাতৃভূমি ছেড়ে কোথাও না যাবার যে সংকল্পে তিনি থাকলেন অনঢ়। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। তারপরও ছাড়েননি সংগ্রামের মোহনা। আর এ কারনে কিছুকাল আত্মগোপনে থাকতে হয় তাঁকে। জীবনের প্রয়োজনে নানা পেশার সাথে সম্পৃক্ত হলেও রাজনীতি আর সংগীতের সাথে সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হয়নি তাঁর। সময়ের প্রয়োজন তিনি মিটিয়েছেন হাসিমুখে। পাকিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শ্রীকান্ত দাশের কন্ঠে ছিলো সোচ্চার। সত্তরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে যখন অকালে ঝড়ে গেলো দশ লক্ষাধিক তাজা প্রাণ তখন অন্যান্যদে ন্যায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়ালেন তিনি। তাৎক্ষণিক লিখলেন ‘ভিক্ষা দাওগো নগরবাসী, দাও গো ভিক্ষা দাও’ শীর্ষক গান। নিজেই করলেন সুরারোপ। গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে সাহায্য আদায়ে ঘুরলেন দ্বারে দ্বারে। সেই ভয়াবহতা যেতে না যেতেই এলো মুক্তিযুদ্ধের কাল। সময়ের প্রয়োজনে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন মুক্তিযুদ্ধের সাথে। শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। সংগঠকের ভূমিকা পালন করলেন অভিবাবকসুলভ প্রত্যয়ে। মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করলেন অনেককে। তাঁর হাত ধরে অনেকে মিলিত হলো সংগ্রামের মোহনায়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই পরিবারসমেত তাঁকে পারি জমাতে হলো ভারতে। গ্রহন করলেন প্রশিক্ষণ। এর পূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্তে গাইলেন জাগরণের গান। অর্জিত অর্থ তুলে দিলেন বীর সেনানীদের হাতে। একাধিক ক্যাম্পে নিজেই রান্না করে খাওয়ালেন শরনার্থীদেরকে। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করলেন। শাল্লাসহ সুনামগঞ্জের একাধিক অপারেশনে অংশ নিয়ে ফিরলেন বিজয়ীর বেশে। দেশ স্বাধীনের পর মনোনিবেশ করলেন সংগীত চর্চায়। সেইসাথে কাঁদামাটি জলে একাকার হয়ে যোগ দিতে থাকলেন মিছিলে। শাষকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই আদর্শের পথে প্রবহমান রাখলেন জীবনের গতিপথ। রাজনীতি এবং সঙ্গীত সাধনাকে একই সরলরেখায় নিয়ে এসে নিজের কর্মসাধনাকে করলেন মসৃন। তাঁর সমাজ বদলের প্রত্যয় তাই বাধাগ্রস্থ হয়নি কখনও। বরং দুয়ের সমন্বয়ে শানিত হয়েছে অভিযাত্রা।

গণসংগীতকেই জীবনের অন্যতম আরাধ্য করেছিলেন তিনি। তাই শুধু গায়কির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। লিখেছেন গান, দিয়েছেন সুর। নিজের লেখা অর্ধশতাধিক গানের সুর করেছেন নিজেই। সর্বদা তাঁর কন্ঠে যেমন থাকতো সমাজ বদলের গান, তেমনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্মর সমাজ বিনির্মানের স্বপ্নে তিনি ছিলেন বিভোর। জীবনের পরন্ত বেলায় এসে তাই লিখলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক। নাম দিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যন্ত অঞ্চল।’ একাত্তরের ভাটি-বাংলার বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেন তিনি। যে চরিত্রগুলো চিত্রন করেন সেখানেও কোনওধরনের কাল্পনিকতার আশ্রয় নেন নি। বাস্তবমঞ্চে যার যে নাম সে নামই রাখলেন, হুবহু। স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করলেন একই পন্থায়। কেউ কেউ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, অন্তত চরিত্রের নামগুলো যেনও পাল্টে দেন তিনি। না হলে বিপত্তি পড়তে হতে পারে তাঁকে। আঘাত আসতে পারে পেছন থেকে। তিনি তাদেরকে নিবৃত করে বলেছেন, ‘ও নিয়ে আপনাদের চিন্তা করতে হবে না। রাজাকারদের ভয় পাইনা আমি। বুঝতে পারার কাল থেকেইতো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছি।’

শ্রীকান্ত দাশপ্রথমে ব্রিটিশ বিতারণে এরপর হানাদরদের বিরুদ্ধে এবং সব সময় শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিলেন শ্রীকান্ত দাশ। এবং যতদিন সক্ষম ছিলো তাঁর দেহ ততদিন সংগ্রামের মঞ্চ ছেড়ে যাননি কোথাও। কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন ছিলো তাঁর। প্রগতিশীলতার পথ পরিভ্রমন করা কঠিন হলেও সে পথেই গতিশীল ছিলো তাঁর জীবন তরী। লেখক মাধব রায়ের ভাষ্যে আমরা একজন শ্রীকান্ত দাশের আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার যে প্রমান পাই তা এক কথায় অনন্য। তিনি লিখেছেন, ‘সমাজতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ কিনা নাকি সমাজতন্ত্রের দিন শেষ, মানুষ এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলছে, নেতানেত্রীরা একদল থেকে অন্যদলে যাচ্ছেন, নতুন ফ্রন্ট করেছেন, ফোরাম করেছেন,  কেউবা হালুয়া রুটির আশায় বড় দুই দলে ভিড়ছেন, ঠিক তখনও শ্রীকান্তদা ছিলেন অনড়, অটল। হঠাৎ আসা বন্যার পানি নদীর তীরে ছাপিয়ে উঠে এলে যেভাবে তীরে পুতে রাখা কোন শক্ত খুঁটি পানির স্রোতে নড়ে চড়ে কিন্তু ভেসে যায় না বা উগড়ে স্রোতের টানে ভেসে যেতে পারে না, শ্রীকান্ত দা তেমনি। কিভাবে কোন মন্ত্র বলে সমাজতন্ত্রটাকে মনের মাঝে গেঁথে নিয়েছিলেন যে এই মতবাদই শোষিত মানুষের মুক্তির সনদ, সেই গাঁথা থেকে একচুল বিচ্যুতি হননি।’ হ্যা, তাই। আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার কারনেই লাল ঝান্ডা তাঁর হাতে ছিলো সবসময়। বরুন রায়ের রাজনৈতি দুঃসময়ে অনেকেল্পার পাশ থেকে সরে গেলেও তিনি দূরে যাননি। বিশ্বস্থ সহযোদ্ধার মতো পাশে ছিলেন সব সময়। যে স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেই স্বপ্নকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে জীবনভর তৎপর ছিলেন তিনি। পায়ে হেটে পরিভ্রমন করেছেন মাইলের পর মাইল। পার্টির যে কোন কাজই বা কর্মসূচিকে সবসময়ই অধিক গুরুত্বের সাথে গ্রহন করতেন তিনি। দলের মুখপত্র ‘একতা’ শহরে কিংবা গ্রামে হেটে হেটেই বিক্রি করতেন। এজন্য তার কোনও ক্লান্তি বা অবসাদ ছিলো না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শাল্লা উদীচীকে সামলেছেন অনেকটা একক প্রচেষ্টায়। প্রান্থিক মানুষ যে সময়টায় কমিউনিষ্ট পার্টি কিংবা উদীচীর সাথে সম্পৃক্তিকে গুলিয়ে ফেলতো নাস্তিকতার সাথে, সেই সময়টায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা মোটেই সহজ ছিলো না তাঁর জন্য। সেই কাজটি সাবলীলভাবেই সম্পন্ন করেন তিনি। শুদ্ধ সংগীত বিদ্যালয়ের ব্যানারে চালিয়ে যেতে থাকেন কার্যক্রম। নির্দিষ্ট কোনও স্থান না থাকায় কখনও স্কুলে, কখনও কলেজে আবার কখনও সমাজসেবা কার্যালয়ে বসাতেন গানের আসর। এজন্য একহাত বাই একহাত সাইনবোর্ড সঙ্গে রাখতেন সব সময়। কাঁধেতে ঝুলানো ব্যাগে থাকতো সেটি। তার এই নিবেদিত থাকার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। উদীচী কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য নির্বাচন করে তাঁর কর্মনিষ্ঠাকেই স্বীকৃতি দেয় সংগঠনটি।

শহরে বসবাসের সুযোগ থাকলেও সেই সুযোগ কখনও গ্রহন করেন নি। গ্রামের মানুষের সাথেই ছিলো তাঁর আত্মীক সম্পর্ক। গ্রামকে ভালোবাসতেন মায়ের মতোই। কোনও কাজে শহরে এলে তার স্থায়িত্ব হতো স্বল্পকালের। কৃষকের সুখ, দুঃখে সব সময় পাশে থাকতেন। যথারীতি আন্দোলনে থাকতেন অগ্রভাগে। তাই জোতদাররা তাঁকে কখনও ভালো চোখে দেখেনি। তিনি এসবকে পাত্তাই দিতেন না। বলতেন, ‘আমার কর্ম আমি করছি। কোনও অন্যায়তো করছিনা।’ আসলেই তাই; জীবনে কখনও কোনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি তিনি। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলেছেন নির্দিধায়।

ভালো কাজের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিলো। সুযোগ পেলেই মানুষের উপকার হয়, এমন কাজে নিজেকে সমর্পন করতে এতটুকু কুন্ঠা বোধ করতেন না। জীবন সায়হ্নে এসেও এমন কর্ম সম্পাদন থেকে বিরত ছিলেন না। মৃত্যুর পূর্বে মরনোত্তর দেহ দান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। কারন তাঁর আগে কেউ সিলেটে এমনিভাবে নিজ শরীর দান করে যায়নি। কতটা দৃঢ়চেতা এবং আধুনিক চিন্তা লালন করলে এমন একটি কর্ম সম্পাদন করা যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

শিক্ষাব্রতী অধ্যাপক তাপসী চক্রবর্তী লিপি ‘জ্যোতির্ময় প্রভা’ শিরোনামে লেখায় তাঁর এই দৃষ্টান্ত স্থাপনের ভূয়সী প্রশংসা করে একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘কীর্তিমান মানুষের মৃত্যু নেই। কমরেড শ্রীকান্ত দাশের মৃত্যু হয়েছে সত্য কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি রেখে গেছেন অমর কীর্তি। মরণোত্তর দেহ দান করে সিলেটের ইতিহাসে যেমন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তেমনি লাভ করেছেন মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন।’ তিনি নিজেও নিজেকে মৃত্যুঞ্জয়ী, বলতেন। কারন তিন তিন বার মৃত্যু হানা দিয়েছিলো তাঁর জীবনে। জন্মের আটদিনের মাথায় মায়ের মৃত্যুতে, দশবছর বয়সে হাওরপারে কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাঁর। প্রথমবার স্বজনদের ভালোবাসায়, দ্বিতীয়বার পরিজন এগিয়ে আসায় এবং মুক্তিযুদ্ধে কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান তিনি। সে কারনেই বন্ধু-বান্ধবদের বলতেন, ‘আমি মৃত্যুঞ্জয়ী!’ ২০০৯  সালের ১৯ নভেম্বর তাঁর প্রয়াণ ঘটলেও মৃত্যুকে জয় করেই তিনি পারি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। সত্যিই তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।

চিরায়ত নিয়মেই জীবন থেমে যায়। কবির ভাষায়-‘ফুরায় জীবনের সব লেনদেন।’ সত্যিই কি ফুরায়? ফুরায় না! কারো কারো লেনদেন থেকে যায় চিরকাল। কেউ কেউ চিরঋনী করে যান আমাদেরকে। শ্রীকান্ত দাশও আমাদের চিরঋনী করে গেছেন। তাঁর সেই ঋণ পরিশোধের সাধ্য নেই আমাদের।

… …

অপূর্ব শর্মা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you