১.
বহুদিন পরে আজ চমৎকার হাওয়া বইছে। জানালা খুলে দিলে সারা ঘর বাতাসে উত্তাল হয়ে উঠছে। অজস্র বই নিয়ে বসে আছি। সেগুলোকে দেখছি। বই যে দেখারও বস্তু তা ভেবে ভালো লাগছে।
বই দেখার বস্তু এ কারণে যে, প্রতিটি বইয়ের দিকে তাকালে আমাদের ভেতরে এক কল্পনার জগৎ তৈরি হয়। এই বইয়ের এই আছে, ওই বইয়ে ওই। সবটাই কল্পনা। আদৌ হয়তো বইগুলোর ভেতর সেই সেই বিষয়ের অবতারণা নেই। কিন্তু কল্পনার যে লাগামহীন জগৎ আমাদের ভেতরে ক্ষণে ক্ষণে জন্ম নেয় তা তো মিথ্যে নয়।
মানুষের মনোজগতে দৃশ্যবস্তুর প্রভাব বিস্তর। মানুষ যা দেখে তা-ই তার ভেতরে জারিত হয়ে অন্য কোনো রূপে প্রকাশিত হয়। সুতরাং ইমেজ হিসেবে বইয়ের টেক্সট দেখার (বা, পড়ার) পাশাপাশি ইমেজ হিসেবে বই দেখাটাও দুর্দান্ত ফলপ্রসূ।
দেখার ক্ষেত্রে সব থেকে ভালো কিছু দেখাই বাঞ্ছনীয়। অনুভবের ক্ষেত্রেও।
এই যে, আজ এদিকে হাওয়া বইছে বাঁধনহারা। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া ফুটে আছে গাছের চূড়ান্তে। সমস্ত সড়ক ধরে লাল আর হলুদের মিছিল। অবারিত সবুজের ভেতর থেকে ভেসে আসছে কলজে-কাঁপানো কোকিলের ডাক। কুউ… কুউ… কুউ…
জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যায়, দেখি। এই সময়টায় গত বছর অনেকগুলো ছবি তুলেছিলাম। কৃষ্ণচূড়ার। রাধাচূড়ার। সংসদ ভবনের সামনে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া ফুটেছিল। ভারমিলিয়ন রেড সব। কী যে ভালো লাগে! একবার কাকে যেন বলেছিলাম, ‘প্রিয় ফুল কৃষ্ণচূড়া। ওর রংটা একেবারে ভেতর পর্যন্ত পৌঁছায়।’ সে বলেছিল, ‘যার ঘ্রাণ নেই তা আমাকে টানে না। ফুল বলতে আমি ঘ্রাণসর্বস্ব রঙের বিস্তারকেই বুঝি।’ নীরবে মাথা দুলিয়েছিলাম। কয়েকছত্র দীর্ঘশ্বাস গোপন করে একা একাই, তবু, হেঁটে গিয়েছিলাম কিছুদূর। বুঝিনি, সে মূলত গন্তব্যেই বসে ছিল।
ফলে, আমাদের আর নদীর দিকে যাওয়া হয়নি। পাতার দিকে যাওয়া হয়নি। ভ্রম এবং ভবিষ্যতের দিকে যাওয়া হয়নি। শূন্য ক্যানভাসের সামনে বসে বসে শুকিয়ে-যাওয়া রঙের প্যালেটের দিকে নির্বাক তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।
উরুসেভস্কি গার্বেস্তার সেই কথাটা খুব মনে পড়তো, ‘তুমুল বর্ষা শেষে যে গাছ জানে বৃষ্টি তার কেউ না — সেই গাছ কীভাবে বাঁচে!’
উরুসেভস্কি গার্বেস্তা বলে পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন ছিল না।
২.
ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছিলেন — ‘মানুষ, মানুষের ভালবাসার জন্য চিরকাল, পথের ওপর বসে বসে কাঁদবে।’
মানুষ মূলত তার নিজস্ব মানুষের জন্যই কাঁদে। যার সঙ্গে আমাদের হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ, অধিকার-আবদারের মতো অন্যান্য আবেগিক অনুভূতিগুলো জড়িত। কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যখন আমাদের এই আবেগিক সম্পর্কগুলো ছিন্ন হয়, তখন সেই ব্যক্তিটি আর নিজের মানুষ থাকে না। সেই মানুষটি তখন পর হয়ে যায়। পর মানুষের জন্য স্মৃতি হয়তো থাকে, মন পোড়ায় না।
‘বত্রিশ বছর’ পর এই ভাস্কর চক্রবর্তীই বলেছিলেন —
তোমাকে অজ্ঞাত দেশে দেখি প্রায়
একটি নির্জন ছাতে দাঁড়িয়ে রয়েছ।
সব কথা
শেষ হয়ে গেছে।
আর কোনো কথা নেই — স্বপ্ন নেই —
শুধু কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে।
সত্যিই, স্রেফ কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে থাকে তখন।
এইখানে, এখন যেমন।
৩.
এই সকালবেলা, এইসব কথা যখন লিখছি, মনে পড়ছে একটা ফুটফুটে প্রজাপতির কথা। আমার মায়া ও মমতা দিয়ে যাকে আমি একটা আকাশ বানিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, `ওড়ো।’ আর সে উড়তে উড়তে অন্তহীন আকাশের শূন্যতায় মিলিয়ে গিয়েছিল। তাকে বলা হয়নি, টগরফোটা ভোরে এখনও তার আগমনী পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। চিরল চিরল নারিকেল পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঠলে তাকে দেখি। আর, বলা হয়নি, ‘চাঁদের কলঙ্ক থাকে ঠিক, তবু মানুষ চাঁদকেই ভালোবেসে মুগ্ধ হয়। প্রজাপতি, তোমার পূর্বরূপ তুমি নও, পরবর্তী পরিণতিও নও। তুমি তোমারই বর্তমান। আমি তোমার বর্তমানকে ভালোবেসে নাম দিয়েছি মঞ্জরী।’
কোনো কোনো পঞ্চমীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে এখনও স্পষ্ট শুনতে পাই, কে যেন গভীর গলায় গাইছে — ‘মলয়ও বাতাসে ভেসে যাব শুধু…’
তখন হয়তো পশ্চিম আকাশে একটা আধফালি চাঁদ আসন্ন ভোরের দিকে তাকিয়ে গভীর বেদনা নিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর দুটো লাইন মনে পড়ছে —
‘সব কথা শেষ হলে করাঘাত জাগাবে তোমায়,
তুমি এসে খুলবে দুয়োর — দ্যাখা হবে না।’
প্রচ্ছদ : অসীম দাস
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS