এইসব বিচ্ছিন্নতা, জীবন-জীবিকার ঘোরচক্করে পড়ে যোগাযোগের সুতোগুলোয় চিড় ধরা, নিজের ভিতরে রকমফের নিঃসঙ্গতার চাপা চিৎকার ও শিহরণ ইত্যাদি সয়ে লেখক তার নিজের ও পাঠকের সঙ্গে সংলাপ কেমনে সারবেন সে এক প্রশ্ন বটে!
এক হতে পারে, লেখক পড়ে চলেছেন পড়ার খাতিরে, লিখছেন লেখার খাতিরে, জৈব নিয়মে দেহঘড়ি সংকেত দিচ্ছে বুঝে লোকে যেমন প্রাতরাশ সারে, লাঞ্চ ও ডিনারটা সেরে ফেলে ঠিকঠাক! দেহঘড়ির সংকেত বুঝে আহারকার্য ও প্রাতঃকৃত্য সেরে ফেলার স্বয়ংক্রিয় আবেশে লিখে যাওয়া অপকারী কিছু নয়। এই আবেশ ধরে রাখাও ক্ষমতার ব্যাপার এবং সকলে সে-কাজে সমান দড় হয় না। মানুষের পৃথিবীতে সে-লেখক আগন্তকের মতো! ঘড়ির ছন্দে দিবারাতি ঘুরছে এবং অক্লেশে নিজের কাজগুলো করে চলেছে। ‘ক্লান্তি’, ‘অবসাদ’, ‘বিরক্তি’, ‘একঘেয়েমি’ এবং এসবের অমোঘ চোরাটান ‘বিবমিষা’ তাকে কাবু করে না। তার কোনও প্রশ্ন নেই নিজের কাছে; কারণ প্রশ্ন থেকে উত্তর জানার খিদে মনে জাগে এবং সেখান থেকে দেহ-মনের নরকগমন ঘটে। পৃথিবীটা দান্তের ইনফার্নো; পার্গেটোরি কিংবা প্যারাডিসো নয়। নরকে বিচরণকারী লেখক কাজগুলো করে যেন কিছু ঘটেনি যা তাকে পীড়িত বা নাজেহাল করতে পারে। এই লেখক উদাসীন কচ্ছপ; উপনষিদের ব্রহ্ম; জগতে সে বিরাজিত ও সক্রিয় কিন্তু তার সেই সক্রিয়তার কোনও গন্তব্য কিংবা উদ্দেশ্য নেই।
স্বয়ংক্রিয় বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত লোক, সে পড়ে কোনোকিছু না পড়ার জন্য, লিখে কোনোকিছু না লেখার জন্য, দেখে কোনোকিছু না দেখার জন্য। সে কীভাবে বেঁচে আছে তার বিবরণ হয়তো রেখে যায় কাগজ ও বহির মলাটে :— ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ / এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ / পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা / আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা / করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি — তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে…’ [আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়]
প্রশ্ন যদিও ওঠে, এই বিবরণ থেকে জন্ম নেওয়া চিহ্নসূত্র অথবা বিবরণদাতা লোকটি কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্লিপ্ত নিজের পরিপার্শ্বের প্রতি? নাকি নিটশের মতো অস্থির ও উন্মূল সে তার নিজের প্রতি? হয়তো দুটোই অথবা কোনোটাই নয়। তার চিন্তা ও কল্পনাশক্তির তীব্রতা কি সেই ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মতো দমফাটা হাহাকারে নিজেকে বিদীর্ণ করার শক্তি রাখে? হয়তো এবং হয়তো-বা নয়! স্বয়ংক্রিয়তায় জারি থেকে লিখে চলার উপকার যদি থাকে, তবে বলতেই হবে, — আপদও কম নেই সেখানে। এটি মানুষ কিংবা লেখকের সিলছাপ্পরে বন্দি লোকটিকে সেইসব চিহ্নের অধীন করে যার কিছুই তার নিজের নয়। যাপনের কারণ সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে তাকে যাপন করতে হচ্ছে জীবন। কেননা তার জন্মের ওপর তার নিজের হাত নেই। অসীম বিস্তৃত অজানায় সে এক বোকাসোকা শিশু। তাকে দুম করে কে বা কারা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে সে শিখছে এইভাবে পড়তে হয়। এই হচ্ছে অন্য লোকের সঙ্গে বাতচিতের নিয়ম। লেখার ধারা এইভাবে হওয়া চাই। আহার ও রমণ থেকে আরম্ভ করে পোশাক-পরিচ্ছেদ আর রোগব্যাধির চক্করে সুস্থ-অসুস্থ হওয়ার নিয়মগুলো মোটের ওপর একরকম।
নিয়মের রাজপাটে মাছির মতো উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে বেড়ানো সেই লোক একদিন হঠাৎ নিকেশ হয় এবং সেটাও নিয়মের ছক মেনে! যেন প্লেটোর গুহা থেকে বেরিয়ে-আসা লোকটি প্রতিবেশীর ঘরে দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। তারপর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ টের পেল সে আর নেই! স্বয়ংক্রিয়তার মধ্যে জারি থাকা সত্ত্বেও ‘কেমন করে বেঁচে আছি’ প্রশ্নটি যে-সাইনোলজির জন্ম দিয়ে যায় সেটি ওই লোকটি কিংবা লেখকটিকে মর্মান্তিক হাসির খোরাক করে তোলে। যার মানে হলো বেঁচে থাকার ঘটনাকে পরিশেষে প্রশ্ন না করে বেঁচে থাকাও কঠিন মনে হয়।
প্রকৃতির সমুদয় প্রাণের সঙ্গে মানুষের তফাৎ এখানেই। সে পাখি নয় যে উড়বার আনন্দে উড়বে, কোনও প্রশ্ন না করে উড়বে ও দানা খুটে খাবে। সে হতভাগা। প্রাণান্ত চেষ্টার পরেও সে বোধিসত্ব নয়; তথাগত গৌতম নয়; স্থবিরজাতকও নয়! সে দৈবজ্ঞ ওরাকলের সহজ শিকার। তাকে অভিশপ্ত করেছে ঈশ্বর; এই অপরাধে, — বনিআদম হওয়ার কারণে তার জন্য নেই স্বাধীন উড়াল; তার জন্য নয় সহজ অভ্যাসে দানা খুটে খাওয়ার আরাম। কারণ সে বেরিয়ে এসেছে নিয়ম থেকে যে-নিয়ম তাকে নন্দনকাননে প্রশ্নহীন বিস্ময়ে ঘোরার সহজ স্বাধীনতা দিয়েছিল। এমনকি স্বর্গ-পতনের পর থেকে সে নেই নিয়মে যেটি তাকে আরণ্যিক শিকারি ও যাযাবার করে রেখেছিল বহুকাল। ঈশ্বরের উদ্যান থেকে সে পতিত এবং সমভাবে অরণ্য থেকে বিপতিত। তার জন্য তাই স্বয়ংক্রিয়তায় পশুর মতো পাখির মতো সরীসৃপের মতো চারা থেকে অতিকায় বৃক্ষের মতো সহজ নির্লিপ্তিও অবশিষ্ট নেই আর! অভিশপ্ত এই লোকটির জন্যই ‘অনুপল’ :— রাবার বাগানে পাতা ঝরছে ঝরুক : / আমরা বরং এটা দেখি — / শিকারির এয়ারগান তাক করে আছে সঠিক নিশানা, / দিকচক্রবালে আশ্চর্য মালা হয়ে উড়ছে / অযুত নির্বিশঙ্ক মরাল।
…
হয়তো জল্পনা, তবু এটি সর্বজন বিদিত, নিটশে মানুষের হাটবাজারে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়েছিলেন, ‘তোমরা কি জানো না ঈশ্বর দেহ রেখেছেন!’ তাঁর এই বক্রোক্তির মধ্যে ‘সংলাপহীনতা’-র প্রগাঢ় দুঃখ লেগে ছিল। নিটশের অস্থির হৃদয় টের পেয়েছিল ঈশ্বর সেই অচেনা-অদৃশ্য বাস্তব যার সঙ্গে আলাপ সারা যায় না। দু-দণ্ড নিকটে বসে গল্প করার আরাম জোটে না। যদি সেটা সম্ভব হতো কোনোদিন তাহলে জগৎ হয়তো অন্য কাঠামোয় কথা কইত। আমাদের দুখ-সুখের গল্পগুলো তখন কেমন রূপ নিত কে জানে!
আমাদের স্বয়ংক্রিয় নির্লিপ্ততায় পাঠ কিংবা লিখনের উমেদারি করে যে-লোক সে এখানে বিদ্যমান অজ্ঞাত নিয়মের ফেরে। তার দেহের মালিক সে নিজে নয়। অযুত অণু-পরমাণু আপনা-খেয়ালে সেটি গড়ে। কেন গড়ে এ-প্রশ্নের মীমাংসা অনিশ্চিত। যদিও কী-করে-যেন নিজের নিয়মে নিশ্চিত অনন্ত ওই মহাকাশে সে বেঁচে থাকে মিশে যায়। এই লোকের দেহের কাঠামোয় ইলেকট্রনরা ঘুরছে। বিলিয়ন নিউরনকণা মগজ ফুঁড়ে ঢুকে পরক্ষণে হয়তো বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে মহাকাশের মেঘমালায়। নতুন রূপান্তরের অভিলাষ মিটানোর খেয়ালে।
নিয়মের প্যাঁচপয়জারে বাঁধা জীবনে স্রেফ করে খাওয়া ও দেখে যাওয়ার জীবনছকে যে-লোক লেখক বলে সুনাম কিনছে সে এই করে খাওয়া ও দেখে যাওয়ার বিবরণে নিজের কাজ সারে। হাঙ্গেরি দেশে বসে বেলা টার যেমন সেই জীবনকে ‘তুরিনের ঘোড়া’ নামে সেলুলয়েডের ফিতায় বেঁধেছিলেন। যার মোদ্দা কথাটি ছিল :— জীবনকে বোঝার কিছু নেই। এটিকে পাঠ কিংবা বিবরণে সাজানোরও কিছু নেই। জীবন হচ্ছে বৈরী হাওয়ার মাঝে দমভরা খাটুনির নাম।
ফ্রেডরিখ নিটশের জীবনে ঘটে-যাওয়া (যদিও এটি সত্যি ঘটছিল কি না সে-নিয়ে সন্দেহ করেন গুণীজন) ঘটনার লেজ ধরে আড়াই ঘণ্টার কাহানি ‘তুরিনের ঘোড়া’। নিটশে সেখানে ফুটনোট মাত্র। কাহিনির মূল নিয়ন্ত্রক ঘোড়ার কোচোয়ানের সঙ্গে তাঁর সংযোগ নিছক আকস্মিক। গৌরচন্দ্রিকায় নিটশে কেন ও কী কারণে সে-বিৃবতি পর্দায় ঝুলিয়ে পরিচালক নিটশেপালা সাঙ্গ করে মূল কাহিনির ফ্রেমে ঢোকে :
ইতালির তুরিন শহরের কোনো-এক স্টেশনে ঘোড়ার কোচোয়ান তার অবাধ্য ঘোড়াকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছিল। জেদি ঘোড়া এক পা আগুয়ান না হওয়ার পণ করে বসেছে। ‘ঘোড়া না শুনে কথা’-র জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে থুম মেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল জেদি পশু। কোচোয়ানের চাবুক ও শাসানি সকলই বিফল ভেল। নিটশে তখন নিজের অসুস্থ ও অশান্ত হৃদয়ের নিরাময় ঘটাতে তুরিনে ছিলেন। ঘটনাটি ঘটার সময় এর আশপাশে নাকি ঘুরঘুর করছিলেন বলে জল্পনায় লেখে। সে যাকগে, কথা সেখানে নয়। ঘোড়া অবাধ্যতা করায় কোচোয়ানের মেজাজ খারাপ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। নিটশের সেখানে মেজাজ খারাপ করা ও নাক গলানোর কোনও কারণ বা প্রয়োজন ছিল না। তবু তিনি খেপে ভোম হলেন সেদিন। জেদি ঘোড়ার নাক বরাবর দুই বাহু পাকিয়ে শুরু হলো অন্তহীন মিনতি; তারপর গালিগালাজ ও বিদ্রূপ। জল্পনা লেখে বাড়ির মালিক সঙ্গে থাকায় খ্যাপা ভাবুককে সামলে-সুমলে ঘরে ফিরিয়েছিল সেদিন।
পরের ঘটনা সম্ভবত মিথ্যা নয়। টানা কয়েকদিন নিজের ডিভানে নির্বাক বসে ছিলেন নিটশে। কারও সাথে কথা বলার মেজাজ ছিল না। ডিভানে বসে নাকি অবিরত বিড়বিড় করে গেছেন, ‘ওহ মা! আমি কী বোকা!’ এই ঘটনার পর নিটশে আরও দশ বছর জীবিত ছিলেন। যদিও তাঁকে কেউ কথা বলতে দেখেনি। তিনি কেন চুপ মেরে গেলেন সে-প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে লোকে ঘোড়ার সঙ্গে তাঁকে যুতে দিয়েছিল হয়তো! এটা যদি মিথ্যা হয়, এ তো সত্য নিটশে ক্রমে নিরাময়-অযোগ্য নির্বাক ছবিতে পরিণত হয়েছিলেন; যাকে সামলে রাখার ক্ষমতা সহোদরা ছাড়া দ্বিতীয় কারও ছিল না। জগৎ জেদি ঘোড়া বটে, যার সঙ্গে মোলাকাত ও যাকে মোকাবিলা করার চক্করে পড়ে নিটশকে নীরব হতে হলো। যেন নজরুল :— যাকে প্রশ্নটি করা হচ্ছে, — ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?’। প্রশ্নের উত্তর নেই। উত্তরটি যে দিতে পারে সে তো নিজেই নির্বাক। এইটে হলো প্রত্যাখ্যান। বৌদ্ধ একভাবে করেছে। নিটশে অন্য পথে। নজরুল কোন পথে? ‘ওসমান সমাচার’ -এর কাহিনিছকে নজরুল ইতিহাসের ফেরে উঁকি দিয়েছিল। সেটি স্মরণ করি একপল :
নজরুল ইন্দ্রজালের আদেশের অধীন। তাকে তিনি অস্থির করে মর্ত্যে পাঠিয়েছেন। বিধান জারি করেছেন, সে অস্থির থাকবে চিরকাল। প্রাণের বন্য আবেগে চলবে। স্থির পায়ে কোথাও দাঁড়াবে না। লেটোর দলে গান করার দিন থেকে সে অস্থির। কমরেড মোজাফফরের সান্নিধ্যে অস্থির। তাকে তিনি সাম্যবাদী হওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন। স্থিতধী কমরেডের সাধ্য কী নাবাল কিশোরকে বশে রাখে! কমরেডের সান্নিধ্যে নজরুল খ্যাপা দুর্বাশা। প্রাণচঞ্চল কবি স্বপ্নের ঘোরে হুইটম্যানকে দেখে ফেলেছে। তার রক্তে বিদ্রোহী ছলকে উঠছে। নিজের আমিত্বকে সাড়ম্বরে ঘোষণা করে,— ‘আমি কভু প্রশান্ত,— কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী / আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!’
নাবাল কিশোরের আমিত্বের দর্পে কমরেড চমকে ওঠেন। নজরুল দামাল শিশু। সকল বিচারের বাইরে তার জগৎ। যুক্তির সুস্থিরতা পায়ে পিষে সৃষ্টিসুখের গান ধরেছে। এমন উল্লাসপ্রবণ নটরাজকে কৃমিকীট সমালোচকের পক্ষে নাগালে পাওয়া মুশকিল। ইন্দ্রজাল তাকে সমালোচকের বাইরে রেখেই গড়েছেন। কাব্য ও অনুপ্রাসের অঙ্ক দিয়ে নজরুলকে মাপামাপি নিরর্থক। কবিতার মূল্য ও পরিমিতি দিয়ে তাকে বিচার করা অর্থহীন। সমালোচক জানে না, নজরুল হচ্ছে ইন্দ্র্রজালের অবোধ সত্তা। মাটির পুত্তুলিকে জীবন দেওয়ার ক্ষণে ওর কানে তিনি মন্ত্র পড়েছেন : — তুই দামাল শিশু। নিয়মকানুন তোকে পাবে না। বিরাট এই জগতে তুই থাকবি দামাল শিশু হয়ে। এটা তোর নিয়তি।
নজরুল দামাল। খিল খিল হেসে ইন্দ্রজালের বুকে লাথি মারে,— ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, / আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালি বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!’ তাকে লাথি ছুঁড়তে দেখে ইন্দ্রজাল হাসেন। তার চেতনায় নিজেকে বিরাট ও বিস্তৃত করেন। শিশু এবার বিরাটকে দেখে বিমোহিত হয়। জগৎ নিয়ে তার ভাঙা-গড়ার খেলাটি তাকে আশ্চর্য করে। দামাল শিশুর কণ্ঠে স্তুতি ঘনায়, — ‘খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে / বিরাট শিশু আনমনে।’
এত স্পর্ধা ও বিস্ময় যার হৃদয়ে তাকে আটকানোর সাধ্যি মানুষের থাকে না। সে তাই চির অস্থির। ‘বিদ্রোহী’ লেখার ক্ষণে অস্থির। ধ্যানমগ্ন রবিঠাকুরের তপোবনে আচমকা হাজির হয়ে তাকে ‘গুরুদেব’ বলে চমকে দেওয়ার দিনে অস্থির। ইন্দ্রজালের আদেশে নির্বাক হওয়ার দিনগুলোয় সে অস্থির। তার হাত এখন কাঁপে। ঠোঁট দুটো অকারণে বিড়বিড় করে। নজরুলের এই ভাষা শহরে কেউ বোঝে না। ইন্দ্রজাল হয়তো বোঝেন। তাকে তিনি দামাল শিশু করে গড়েছেন। এখন, অবোধ শিশু করে তুলে নিচ্ছেন উপরে!
সে যাকগে, নজরুল ছেড়ে বেলা টার-এ ফিরি। নিটশে নিয়ে বিবৃতির পালা সাঙ্গ করে ফেরত গেলেন তুরিন শহরের সেই ঘোড়া ও কোচোয়ানের কাছে। প্রশ্ন তুললেন, নিটশে তো যা ঘটানোর ঘটিয়েছেন, কিন্তু ঘোড়া ও কোচোয়ানের কি হলো সে-খবর কি কেউ জানো? ‘তুরিনের ঘোড়া’-র সূত্রপাত সেখান থেকে। জেদি ঘোড়াকে সামলে-সুমলে ঘরে ফিরতে সক্ষম হলেও টার জানিয়ে দিলেন পরের দিন থেকে সে আর ঘোড়া নিয়ে বেরোতেই পারেনি। শহর থেকে দূর কোনও গ্রামের এমন এক প্রান্তে তার বসবাস যেখানে বায়ুর দাপুটে গর্জন একবার শুরু হলে থামতে জানে না। একঘেয়ে ছন্দে ওটা চলতেই থাকে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয় ধূলিঝড়।
বেলা টার আড়াই ঘণ্টা সেই ধূলিঝড়ে দর্শককে আটকে রাখেন! ঘোড়ার বৃদ্ধ কোচোয়ান সকালে ঘুম থেকে জাগে। জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাসের গতিবিধির সুলুক করে। বউ নেই। সঙ্গী বলতে মেয়ে আছে একটি। কন্যা ঘর ঝাঁট দেয়। বাপ ও তার নিজের জন্য আলু সেদ্ধ হাড়িতে চাপায়। আলুর খোসা ছাড়িয়ে লবণ মাখায়। সকাল থেকে রাত অস্তক খাবার বলতে আলুসেদ্ধ। বাপ-বেটি টেবিলে বসে সকাল, দুপুর ও রাত অবধি একাগ্রমনে সেই আলুসেদ্ধ চিবায়। আহারপর্বের এই চাপ সহ্য করা পরীক্ষা বটে!
পেটের দায়ে বাপ চাইছে বের হতে কিন্তু ধূলিঝড়ের কারণে সেটা সম্ভব হয় না। ওদিকে মেয়ের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। বায়ু ও ধূলির প্রকোপ সহ্য করে মশকে পানি ভরে আনে। রোবটের মতো ঘর ঝাঁট দেয়। ধোয়ামোছা সারে। আস্তাবলে ঘোড়ার খবর নিতে ছোটে। ঘোড়াকে দানাপানি দেয় নীরবে। প্রতিদিন এক-নিয়মে সে দরোজার হুড়কো আাঁটে। ওদিকে বাপ ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হওয়ার জন্য পুনরায় তৈরি হয়। আস্তাবলের হুড়কো খুলে ঘোড়াকে সেই নিয়মে তৈয়ার করে। দুজনে বের হয় এবং ধূলিঝড়ের কারণে ফেরত আসে। টানা সাতদিন ধরে বায়ু ও ধূলিঝড়ের সঙ্গে তাল দিয়ে বাপবেটি ঘোরে নিত্য কাজ আর দেহঘড়ির ছকে। দুজনের মধ্যে বাতচিত যেটুকু হয় তাকে বাতচিত বলা অপমানের শামিল। প্রতিবেশীরা দু-একজন আসে। ধূলিঝড়, মানবজীবনের নিয়তি আর লাভালাভের বখরা নিয়ে কয়েকছত্র কথা ও ঝগড়া হয় ক্ষণিক। জীবনকে উষ্ণ করার মতো যথেষ্ট নয় সেই কথামালা। ওদিকে প্রায় সংলাপহীন বেঁচে থাকার সেই জগতে বায়ুপ্রবাহ ও ধূলির শো শো শব্দ সারাক্ষণ নেপথ্যে বয়ে চলে; যেন ওটা একমাত্র যে সরব এবং যে কথা বলতে জানে। কাহিনির অন্তিমে বাপবেটি বুঝে ফেলে এই ঝড় কিয়ামত অবধি থামবে না। ঘোড়ায় মালসামানা তুলে দুজনে রওয়ানা করে নতুন বসতির খোঁজে।
‘তুরিনের ঘোড়া’-য় বেলা টার নিঃস্ব ও নির্বাক। কাহিনিবয়নের আশ্চর্য এই ধারাবর্ণনা কেবল সেলুলয়েডে সম্ভব। সাহিত্যের ছকে এ-রকম কাহিনির ক্লান্তিকর হওয়ার ঝুঁকি ষোলোআনা হলেও সেলুলয়েডে বেলা টার দারুণভাবে উতরে গেছেন। আড়াই ঘণ্টা কোথায় কীভাবে কোনদিক দিয়ে ফুরায় দর্শক সেটা টেরও পায় না। মহান সিনেমার জাদু হয়তো এখানেই; বেলা টার যার ব্যতিক্রম নির্মাতা বটে। যেটি এই সত্যটি বলতে পেরেছে :
দেখো জীবন এ-রকমই। একঘেয়ে। রুটি-রুজির তালে একছন্দে ওটা বইছে। পরিবেশ বৈরী। হাওয়া প্রতিকূল। ঈশ্বর নিখোঁজ। এইসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেটের দায় মেটায় লক্ষ-কোটি কোচোয়ান। নিটশে মুখর ছিলেন এক সময়। তাঁর ভিতরে বুনো কথার স্রোত আঁকুপাকু করত বেরিয়ে আসার জন্য। সেই কথাগুলো তিনি কিন্তু বলতে পেরেছিলেন। কথার মধ্য দিয়ে স্বাধীন এক আত্মায় পরিণত হওয়ার খিদে তিনি ঠিক আদায় করে নিয়েছিলেন। যদিও কিছু পাল্টাতে পারেননি। এই না-পাল্টানোর বেদনা তাকে হয়তো অস্থির করেছিল, যে-কারণে পাগল হলেন শেষমেশ। পাগল হওয়ার কারণে জগৎ থেকে নির্গমনের পথটি খুঁজে পেলেন। কোচোয়ানের আসলে বলার মতো কোনও ঘটনাই ছিল না জীবনে। একটা কথা অবশ্য সে কিছু না-বলেই বলে ফেলেছে : — দেহ নামের চাকা যেভাবে পারো সচল রাখো, আর যদি না পারো মরো। এরচেয়ে বেশি বলার মতো শব্দের প্রয়োজন নেই বিশ্বে।
অজ্ঞাত নিয়মের ছকে বেঁচে থাকার কথা যে লিখছে তার আসলে কিছু পড়া, লেখা কিংবা দেখার প্রয়োজন নেই। ওইসব আপনা থেকে তার চারপাশে বৃষ্টিস্রোতের মতো গড়িয়ে পড়বে এবং এই গড়িয়ে পড়াটা সে লিখবে নিজের অনুভব ধ্বংস করে। নিজেকে External ও Internal-এ ছকে নিয়ে পেসোয়া যেমন কথাগুলো অকাতরে লিখে গেছে এক সময়। তার দেহ এবং সেই দেহকে ঘিরে চলমান ঘটনার স্রোত হচ্ছে External। দেহটি যেন টিনের কার্নিশ। বৃষ্টির জল সেখানে চুঁইয়ে পড়ছে। শো শো হাওয়ার ঘূর্ণি ছুঁয়ে যাচ্ছে কার্নিশ। শব্দ হচ্ছে খুব! সেই বৃষ্টিজল ও শব্দ অকাতরে ভিজিয়ে দিয়েছে কার্নিশ। ভেজা কার্নিশ সেটা শুষে নিচ্ছে, নিজের মধ্যে জারিত করছে এবং ওটাই Internal; অনুভূতির সেই জগৎ যেখান থেকে জন্ম নেয় বাক্য। নেই বাক্যমালা এলোমেলো ও চকিত বিক্ষেপে তাকে দিয়ে যে-কথাগুলো বলিয়ে নিচ্ছে, দেহ ও দেহকে ঘিরে চলমান ঘটনাকে অতিক্রম করে নতুন কোনও স্বপ্নের জগতে ঢুকে যেতে বাধ্য করছে, সেটাই পেসোয়া নামে লোকটির মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার খতিয়ান।
সে এক স্বাপ্নিক। তার মনে হচ্ছে যে-স্বয়ংক্রিয়তায় সে রয়েছে এবং সেটাকে ততোধিক স্বয়ংক্রিয়তায় উপেক্ষা করে বেঁচে আছে সেটাই জীবন। সে হচ্ছে ভাসকুয়েস নামক সতর্ক, সামাজিক আর কেতাদুরস্ত এক লোকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নগণ্য হিসাবরক্ষক। একজন বুককিপার; যে কিনা সতর্ক অথচ উদাসীনভাবে লেজার বহিতে ব্যবসার হিসাবনিকাশগুলো টুকে নিচ্ছে। তার নিজের জীবন ও লেখাপত্তর এরচেয়ে বেশি নয়। সে Carelessly careful লোক, যাকে নিজের অনুভবকে লিখতে প্ররোচনা দিচ্ছে কেউ, এবং সেই প্ররোচনা তাকে নিক্ষেপ করেছে স্বপ্নের জগতে। নিজেকে সে স্বপ্নে-ঘটা ঘটনার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে, যা ঘটেনি কিন্তু ঘটলে মন্দ হতো না, এমন এক স্থানে দাঁড়িয়ে দেখছে লিসবনের সাগরঘেঁষা উপকূলে জাহাজগুলো পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে সাগরে ভাসছে ও বন্দরে ভিড়ছে। বোঝা মুশকিল তারা সত্যি সাগর থেকে বন্দরে ফিরছে নাকি সাগরে ভেসে পাড়ি দিচ্ছে কোনও স্বপ্রের জগতে।
সে এটা জেনে ফেলেছে তার এই স্বপ্নে ঢুকে পড়াটা বহুকারণে বিঘ্নিত হবে এই স্বয়ংক্রিয় দেহের কারণে যেটি ভাসকুয়েসের লেজার বহির হিসাব রাখে, যেটি চুম্বনে বিবশ রমণীর শিৎকারের মধ্যে নিজেকে স্খলিত হতে দেখে, যেটি নিজের অজান্তে ডিনার সারে, যে-দেহ বই পড়তে গিয়ে যেন কিছুই পড়ছে না এমনভাবে বইয়ের পাতা উল্টায়, এবং শেষতক যার মনে হয় চারপাশে যেসব কথার খই ফুটছে তার অনেকখানি ওরা আসলে তার হয়ে বলেই দিচ্ছে, যেন সে এবং ওই লোকগুলো তারা সকলে মিলে অভিন্ন। এই অভিন্নতা তাকে দম আটকে মারার ক্ষণে সেখান থেকে সে পালাচ্ছে স্বপ্নের জগতে; যেখানে সে ছাড়া অন্য কারও আওয়াজ নেই। পেসোয়া বুঝে গেছে ঈশ্বর তার এই স্বপ্নকে বহুভাবে তার কাছ থেকে কেড়ে নেবে, তাকে বাধ্য করবে দেহের জোয়াল টেনে ভাসকুয়েসের লেজার বহির হিসাব নিতে, কিন্তু একটি বিষয়ে সে নিশ্চিত :— স্বপ্নে নিজেকে যাপনের এই বাতিক সে তার কাছ থেকে কখনও কেড়ে নিতে পারবে না, যেটি তাকে স্বাধীন করছে চিরকালের জন্য।
পেসোয়া কার্যত সভ্যতার ফাঁদে আটকা ঝড়ো পাখি। তার জন্য কোনও নিষ্ক্রমণের জায়গা নেই স্বপ্ন বা বিমূর্ত বিশ্বে নিজেকে চুবিয়ে মারার খেলাটি ছাড়া। সিভিলা্ইজেশন নামে মানুষের-গড়া অতিকায় এই স্বয়ংক্রিয়তার মধ্যে পেসোয়া কিংবা সেই লেখক কিংবা সেই লোকটি তারা সকলেই আসলে কিছুই পড়ছে না, লিখছে বা দেখছে না; কোনও ক্রিয়াই এখন আর যথেষ্ট নয় এই অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য, এই নির্গমনের সুলুক পাওয়ার জন্য, অথবা কবির মতো থকথকে কাদায় পা ঢুকিয়ে এই জিজ্ঞাসাটি ফের ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য : — ‘কতদূর এগোলো মানুষ?’
লেখা কিংবা পাঠের সেই দিন সত্যি আর নেই! সেই দিন বহুদিন ধরে বিগত যেই দিন ওই লোকটি বেরিয়ে এসেছিল বনভূমি থেকে, প্লেটোর গুহা থেকে, ডারউইনের দাগানো গাছের মগডাল থেকে। সে নেমে এসেছিল চুক্তির বরখেলাপ ঘটানোর জন্য :— এখন থেকে আমি দলের অংশ; সামাজিক চুক্তির অধীনে নিজেকে মান্যতা দিচ্ছি :— আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি দল ও দলপতির বিধানে যাপিত হব।
প্রকৃতির সঙ্গে চুক্তি তামাদি করে সামাজিক চুক্তি-র নতুন জগতে পা রাখার ক্ষণে সেই লোক — সে রুশো কিংবা সলিমুদ্দি যে নামে তাকে ডাকা হোক, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। যেহেতু সে বুঝতে পেরেছিল : Everybody everywhere wants to be free, but everybody everywhere doesn’t know to be free goes in vain; because freedom exists nowhere for the man you called him humans.
লেখকের সঙ্গে গানপারসঞ্চালকের ইমেইলসূত্রে এই আলাপিকা তাৎক্ষণিকা বিভাগে আর্কাইভড রইল। — গানপার
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS