বাবা শাহজালালের মাজারের শান-বাঁধানো পুকুরঘাটে আমরা বসে পড়ি। গজার মাছকে খাবার ছুঁড়ে দেই। পুকুরের পানি তোলপাড় করে তাদের ছুটোছুটি দেখে বুঝতে পারি শহরে তাণ্ডব ঘটিয়ে কারো কোনো উপকার হয়নি। তাণ্ডবকে হাঁটুশক্তির উত্থান ভেবে সকলে ভুল করেছি। রমণী ও শিশুরা আমাদের কারণে বিপন্ন হলো। সুযোগসন্ধানী ও সংবাদকর্মী ছাড়া কেউ এখন সুখী নয়। পিয়ার মোহাম্মদ ছাড়া কারো ভাগে কিছু জোটেনি। বুঝতে পারি, তাণ্ডব ও বিপ্লব এক নয়। বিপ্লব হলে ওসমান পালায়। সে ফিরে আসে বিপ্লবের শেষভাগে। পুনরায় হানা দেয় ঘর ও কর্মস্থলে। পুকুরঘাটে গজার মাছের রঙ্গক্রীড়া আমাদের বোধোদয় ঘটায়। আমরা বুঝে যাই নিমেষে, জীবন তামাশা ছাড়া কিছু নয়। দরবেশকে ভিতরে টের পাই। তিনি নীরব হাসছেন। মৃদুকণ্ঠে আমাদের ডেকে নিলেন টিলার পাদদেশে। তাকে অনুসরণ করে ছোট একটি ঘরে পৌঁছাই। খোল-করতাল ও গায়কের হল্লা কানে আসছে। দরবেশ ঘরে ঢুকতে ইশারা করেন। তার মুখে হাসির ছটা। সাদা আলখাল্লা নিরাকারে মিলিয়ে যায়। দরবেশকে আর দেখতে পাই না!
অপরিসর কক্ষে সকলে ঢুকে পড়ি। সেখানে ফকিরদের তাণ্ডবনৃত্য চলছিল। গেরুয়া পরা ফকিররা ঘোরমত্ত আওয়াজে কক্ষ গুলজার রেখেছে। তারা মাটি ছেড়ে শূন্যে ওঠে। পরমুহূর্তে মাটিতে নেমে আসে। তাদের ঘূর্ণি চোখে ঘোর তৈরি করায়। আকার ও নিরাকার একতালে রক্তে নাচে। আমরা ‘হাক্ মাওলা’ বলে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠতে চেষ্টা করি। সম্ভব নয় বুঝে ‘হায় মাওলা’ বলে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ি। আমাদের কাণ্ড দেখে ফকিররা হাসে। তাদের ঘোরলাগা হাসির দাপটে কক্ষ গমগম করে। নেশামত্ত ফকিরদের হাসির তরঙ্গ ভঙ্গুর হাঁটুতে গিয়ে আঘাত হানছে। হাসির ধাক্কা সইতে না পেরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি।
আমাদের বক্ষে লক্ষ কবুতর ডানা ঝাপটায়। ওরা কবুতর নয় ‘কৈতর’। লোকে বলে জালালী কৈতর। কবুতর ও কৈতরে শব্দগত প্রভেদ থাকলেও অর্থ অভিন্ন। লক্ষ জালালী কৈতরের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে আমরা বধির হয়ে পড়ি। নৈঃশব্দ্য আমাদের চেতনা দখলে রাখে। বধিরতা ও নৈঃশব্দ্যে ডুব দিয়ে বুঝতে পারি তাণ্ডব ও বিপ্লবে প্রভেদ ঘটলেও পরিশেষে কোনো প্রভেদ থাকে না। সকল তাণ্ডব সমর্পণে নিঃস্ব হয়। বিপ্লব শেষ হয় আলোচনার বিখ্যাত টেবিলে। সুস্থিরতালোভী বুদ্ধিসেবীর প্রলাপ বচনে। আমরা সোজাসাপ্টা বুঝে ফেলি তাণ্ডব ও বিপ্লবে শহর তছনছ করা যায় কিন্তু শিকল ছেঁড়া যায় না। তছনছ শেষ হলে বিপ্লবী ঘরে ফেরে। ছাতা-পড়া ঘিনঘিনে দিনে নিজেকে সুস্থির রাখতে ক্লান্ত হয়। তাণ্ডব শেষে আমরাও শহরে ফেরত যাই। মায়ের প্রসন্ন আদরে মাথা রাখি। বোনের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠি। টেংরিভাঙা সার্জেন্টের ইশারায় আমাদের বাইক আবার চৌরাস্তায় থেমে পড়ে। সার্জেন্টের পকেট মুদ্রায় ভরিয়ে তুলি। সবাই মিলে যোগ দেই ব্রিগেডিয়ার পিয়ারের বিবাহ-উৎসবে।
পিয়ারের বিয়েতে সকলে খুব খাটি। ডেকোরেটার ঠিকঠাক করি। ভূরিভোজের এন্তেজাম চলে। শহরের মানি লোকজনের কাছে পিয়ারের বিয়ের দাওয়াত পৌঁছাই। আমাদের রমণীরা বিবাহে শরিক হয়। তারা গোল হয়ে পানদান সাজায়। কোমর ঝুঁকিয়ে ধামাইল ধরে। পিয়ারকে আমরা বরের বেশ পরাই। রমণীরা কনেকে বিয়ের সাজে রূপবতী করে। আমরা কাজি ডাকি। বর ও কনেকে কবুল পড়াই। দাঙ্গায় কুড়িয়ে পাওয়া রাজকন্যা দেখে মন হু হু করে ওঠে। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলি। পিয়ারের সৌভাগ্য বুকে খচ করে বিঁধে। বিধাতার রসিকতা ও অপচয়ে হতাশ হই। বিয়ের হুল্লোড় শেষে শান্তি নামে শহরে। গরিলা হাতের থাবায় রূপবতী কনে বগলদাবা করে পিয়ার গাড়িতে গিয়ে ওঠে। তার আজ ফুলশয্যা। রাজকন্যাকে নিয়ে রাক্ষস হওয়ার দিন। কন্যার রক্তকমল পদযুগল চুম্বনে সিক্ত করার দিন!
পিয়ারকে ফুলশয্যায় পাঠিয়ে আমরা বিপ্লবের দিনগুলোয় ফিরে যাই। তেতলা বাড়ির ছাদে এক রাজকন্যাকে আবিষ্কার করি। কুঁচবরন কেশ আর তেঁতুলবরন ঠোঁটের কন্যাকে দেখে বিমোহিত হই। মেঘবরন কন্যা রে তার কুঁচবরন কেশ, চিরল দাঁতের হাসি দিয়া পাগল করল দেশ। কন্যার চিরলবরন সৌন্দর্য আমাদের বধির করে। অবাক হয়ে দেখি, বিপ্লবীরা কন্যাকে ঘিরে আছে। কন্যার আপনজন উঠানে লাশ হয়ে পড়ে আছে। বিপ্লব কুঁচবরন কন্যাকে ছাদে নিয়ে তুলেছে। রাজকন্যার বসন খসে পড়ার উপক্রম হয়। তার নগ্ন ত্বকে রাক্ষসের অট্টহাসি ঠিকরে পড়ছে। আঙুরফল চোখে দানবে পিষ্ট হওয়ার ভয়। কন্যার সুঠাম উরুদেশ রাক্ষসের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত। রাক্ষসরা তাকে ঘিরে আছে। কন্যা তার গোড়ালি তুলে রক্ষণব্যুহ ভেদ করার সুযোগ খোঁজে। তার স্তন ও শ্রোণিদেশ রাক্ষস-আতংকে তিরতির কাঁপছে। মেঘবরন কন্যায় সৌন্দর্য ও আতংকের এই যুগলবন্দি আমাদের বিকল রাখে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি। অবোধ চোখ তুলে রাক্ষসব্যুহে কন্যার গোড়ালি সঞ্চালন চলছে। ছুটোছুটি অর্থহীন জেনেই কন্যা এটি কেন করছে ভেবে মনে-মনে ক্ষুব্ধ হই। আবিষ্কার করি, আমাদের কারণে রাজকন্যা ও রাক্ষসব্যুহে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। আমাদের কাছে রাজকন্যার চাওয়া-পাওয়া নেই। রাক্ষসদের কাছে আমরা অবান্তর। টের পাই, ভয়ে আমাদের হাঁটু কাঁপছে।
নিজের কম্পিত পদ নিয়ে আমরা এখন বিব্রত। ছাদের সিঁড়িতে জুতোর খটখট আওয়াজ উঠছে। শব্দটি পরিচিত। রাক্ষসব্যুহে আলোড়ন শুরু হয়েছে। সবাই বুঝে ফেলে পিয়ার তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে ছাদে আসছে। তার আগমন টের পেয়ে রাক্ষসরা চোখের পলকে ছাদ বেয়ে নিচে নেমে যায়। অলিগলি দিয়ে পালায়। রাজকন্যা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। কলঙ্কিনী সীতা। তার স্তন থেকে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত ঝরছে। যোনিদেশ বেয়ে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। রাজকন্যার নগ্নতায় আমরা লজ্জিত হই। তাকে ছুঁতে সাহস করি না। পোশাকে আবৃত করতে ভয় লাগে। আমাদের হাঁটুর কম্পন চলতেই থাকে। হাঁটু গেড়ে ছাদে বসে পড়ি। পিয়ার মোহাম্মদ ততক্ষণে ছাদে উঠে এসেছে। তার জলপাইচোখ দুঃখ ও বিষাদে চকচক করছে। পিয়ার তার উর্দি দিয়ে রাজকন্যার লজ্জা ঢাকে। কন্যা এই মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিল। সব শেষ জেনেও বীর এক রাজপুত্রের অপেক্ষায় ছিল। পিয়ারের আগমনে তার অপেক্ষা ফুরায়। কুলহারা কলঙ্কিনী রাজপুত্রের বুকে ঢলে পড়ে। পিয়ারের চোখ অশ্রুসজল হয়। পাথুরে মুখ নরোম বিষাদে রাজকন্যার মুখের নিকটে ঝুঁকে থাকে। প্রমত্ত জলপাইয়ের শক্ত হাতের আবেষ্টনে কন্যা এখন নির্ভয়া। পিয়ার তাকে কোলে করে গরিলাবিক্রমে নিচে নামছে। তাকে অনুসরণ করে আমরাও নিচে নামি, — মাথা হেঁট করে!
পিয়ার আবারো আমাদের হারিয়ে দেয়। তার শক্ত হাঁটুর নিকট আমরা পরাস্ত। অদম্য এক ব্রিগেডিয়ারের পায়ে মাথা নত করি। বুঝতে বাকি থাকে না, ব্রিগেডিয়ার কেন পাখির ছানার মতো রাজকন্যাকে আগলে রাখে। রাজকন্যাই-বা কেন এত অনুগত সমর মানবে! আমরা স্বীকার করি কুঁচবরন কন্যা পিয়ারকে ভালোবাসে। তার পাগলামো সহ্য করে। মসৃণ গোড়ালি ও পদযুগল দিয়ে জলপাইকে প্রীত রাখে। পিয়ারের প্রতি রমণীর ভালোবাসা আমাদের কেন জানি সহ্য হয় না। আমরা হিংসায় ফেটে পড়ি। স্মৃতি থেকে পিয়ারকে মুছে ফেলতে তৎপর হই। নিজের ওপর ক্ষোভ জাগে। কারণ এটা আমাদের অক্ষমতা যে রাজকন্যাকে আমরা অভয় দিতে পারিনি। আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াই। রক্তের ত্রুটি অনুভব করে বিমর্ষ হয়ে পড়ি। অবাক হই এটা দেখে যে রাজকন্যাকে নিয়ে জল্পনায় ডুবে থাকার শখ আমাদের এখনো যায়নি। পিয়ারকে ফুটফেটিশ বলে গাল পাড়ার সময় আমরা ভুলে গেছি আমরা নিজেও কম ফেটিশ নই।
বীর হওয়ার সুযোগ ছিল। আমরা সেটা নিতে পারিনি। বীর না হতে পারার আফসোস আমাদের ক্ষুব্ধ রাখে। নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হতে গিয়ে পিয়ারের ওপর ক্ষুব্ধ হই। তার সাফল্যে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরি। সহজ মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার কারণে হয়তো, নিজেকে দায়ী ভাবতে বসে পিয়ারকে দায়ী ভাবি। তাকে প্রতিপক্ষ সাজাই। তার স্ত্রীকে জোর করে নিজের বলে ভাবি। জল্পনায় বিহার করে মন। আমাদের ভিতরে রাক্ষস মাথা তোলে। অন্যের বউকে নিজের বউ ভাবার বিভ্রম থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। বিভ্রমে বিচরণ করি। বায়বীয় সুখ উদযাপন চলে ক্ষণিক। বায়বীয়কে বাস্তব আর বাস্তবকে বায়বীয় ভেবে যাপন করি যৌথঅস্তিত্ব।
বাস্তবতার রূপান্তর আমাদের সুস্থির করে তোলে। আমরা ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজি। পিয়ারের বউকে নিজের বউ ভেবেই ভিজি। দুর্গম রাজ্য থেকে রাজকন্যাকে মুক্ত করার খুশিতে সিক্ত করি নিজেদের। মেঘবরন কন্যার কুঁচবরন কেশ বৃষ্টির তোড়ে খুলে-খুলে পড়ছে। আমরা দুহাত দিয়ে কেশ ধরি। কেশবতী কন্যাকে বুকের খাঁচায় ধরি। পিয়ারের রূপবতী বউকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিফোঁটায় সিক্ত করি। বৃষ্টিস্নান শেষ হলে সকলে ঘরে ফেরত যাই। শুকনো জামাকাপড় বের করে পরি। গরম চায়ের কাপ হাতে জানালার সামনে দাঁড়াই। টিনের চালে বৃষ্টিফোঁটার গর্জন শুনতে পাই। গলিরাস্তা ও দোকানপাটে বৃষ্টি তোড়ে নামছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের বাড়ির ছাদে সে ঝরে। আমরা দেখি ব্রিগেডিয়ার তার স্ত্রীকে নিয়ে ছাদে উঠেছে। রূপবতী স্ত্রীর হাত ধরে বৃষ্টিধারায় সিক্ত হচ্ছে দুজন!
ব্রিগেডিয়ার পিয়ার মোহাম্মদ এভাবে আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। আমরা এখন নাছোড়বান্দা সাংবাদিক। জাদরেল জলপাইকে নীরবে অনুসরণ করছি। সামনে পড়ে গেলে সমীহে মাথা ঝোঁকাই। আড়ালে পেছনে লাগি। তাকে নিয়ে কানাকানি চলে। মুখরোচক চাটনির মতো সারাদিন তাকে চাটি। এতকিছু ঘটে গেলেও পিয়ারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে প্রতিরোধ জেগে থাকে। টের পাই, পিয়ার ও আমাদের মাঝখানে বিষধর সাপ শুয়ে আছে। আমরা তার নাম রেখেছি ওসমান!
কথাসাহিত্যিক আহমদ মিনহাজের উপন্যাসপাণ্ডুলিপি ‘ওসমান সমাচার’ থেকে একাংশের উৎকলন উপরের রচনা, যা রাশপ্রিন্ট পত্রিকায় ষোলো পর্বে বিন্যাস্ত ও অংশত প্রকাশিত। ‘ওসমান সমাচার’-এর এ-যাবৎ প্রকাশিত পর্বগুলার লিঙ্ক রইল নিচে —
ওসমান সমাচার
তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪
১৫, ১৬, ১৭, ১৮…
লাল, চিরকাল
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS