জ্ঞানতাপস ইকবাল কাগজী — অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন কবি, লেখক, গবেষক ও পাঠক। জীবনে কখনও টাকাপয়সার পিছনে ছুটেননি। নিদারুণ অভাব-অনটনের মধ্যেই যাপিত জীবন। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যেটুকু প্রয়োজন, ততটুকু পেলেই যেন তিনি খুশি। জীবনের মানেই হয়তো তাঁর কাছে অন্যরকম!
তবে কাগজীর ঘরে যে-ধন আছে, অনেক উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্তের ঘরেও তা নেই। তাঁর ঘরভর্তি কেবল বই আর বই। বিভিন্ন শাস্ত্রের আকরগ্রন্থ সব। সারাজীবনের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে উঠেছে বইয়ের এই সুবিশাল সংগ্রহ। দারিদ্র্যের করাল থাবাকে উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে-থাকা তাঁর ঘরটি যেন এক জ্ঞানমন্দির।
বিস্ময়কর ও বিচিত্র তাঁর সংগ্রহ। কোনো রেফারেন্স বইয়ের দরকার হলে লাইব্রেরিতে না গিয়ে প্রথমেই কাগজীভাইয়ের দ্বারস্থ হই। আমাদের শহরের কোনো ব্যক্তি কেন, কোনো লাইব্রেরিতেও এত দুর্লভ সংগ্রহ নেই। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিতে চাই : ১৪/১৫ বছর আগে হাওরের ভেষজ উদ্ভিদের লোক-ঐতিহ্যগত ব্যবহার নিয়ে যখন কাজ করছিলাম, তখন একদিন কথাপ্রসঙ্গে কাগজীভাইকে বলি, সুনামগঞ্জে তো গাছপালার উপরে নির্ভরযোগ্য কোনো বইপত্র পাচ্ছি না। একথা শুনে তিনি আমাকে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। মনে মনে ভাবি, কাগজীভাই তো বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না, তাঁর সংগ্রহে বিজ্ঞানের বইও আছে! তেমন একটা আশা করিনি, তবু একদিন গেলাম। তিনি প্রথমে বের করে দিলেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’-র ১১ খণ্ড বই। বললেন — “কিছুটা কাজে লাগে কি না দেখেন, খুঁজলে আরও কিছু পেতেও পারি।”
এরপর ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে হয়ে যায় আমার গভীর বন্ধুত্ব। বয়সের বাধা যেন তুচ্ছ হয়ে গেল! তাঁর সান্নিধ্যে প্রতিনিয়ত বিস্মিত হই, মুগ্ধ হই, ঋদ্ধ হই! কাগজীভাইয়ের কাছে আমি আপাদমস্তক ঋণী। তিনি আমাকে স্নেহ করে ‘দাদা’ বলে ডাকেন। একদিন হঠাৎ ঘোষণা করলেন — “দাদা, আজ থেকে আমার লাইব্রেরি আপনার, আর আপনারটা আমার। যখন যা লাগে এসে নির্দ্বিধায় নিয়ে যাবেন।”
বহু লেখক, গবেষক তাঁর কাছ থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়েছেন। অনেকেই আবার বইপত্র নিয়ে আর ফেরতও দেননি। এভাবে খোয়া গেছে বহু বই। কিন্তু তাতে তিনি মোটেও বিচলিত নন। ছড়িয়েছিটিয়ে-থাকা বইগুলো ফেরত আনার জন্য তাঁকে মাঝেমধ্যে আমি তাগাদা দেই। কিন্তু তখন তিনি বলেন, “থাক্ না, যারা নিয়েছেন বইগুলো যদি তাদের কাজে লাগে তাহলেই আমি খুশি। প্রয়োজন শেষে অবশ্যই একদিন ফেরত দিয়ে যাবেন।”
কিন্তু এবারের সর্বগ্রাসী বন্যা (২০২২) কাগজীভাইয়ের সারাজীবনের সঞ্চয় গ্রাস করে নিলো, ভাসিয়ে দিলো — যা আর কোনোদিন ফেরত পাওয়া যাবে না!
ঘরের ভিতরে ছিল সাঁতারপানি। কোনোকিছুই রক্ষা করা যায়নি। অন্য সব জিনিস যায় যাক, কিন্তু দুর্লভ বই-পত্রপত্রিকা-সাময়িকী প্রভৃতির ক্ষতি অপূরণীয়। সেইসঙ্গে তাঁর লেখালেখির ডেস্কটপটিও ডুবে গেল।
ঘরেবাইরে সর্বত্রই কেবল প্রলয়ঙ্করী বন্যার ক্ষতচিহ্ন। ভিজে-যাওয়া, পচে-যাওয়া জিনিসপত্র রোদে শুকানোর জন্য লোকজনের সে কী প্রাণান্ত প্রচেষ্টা! কাগজীভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি অন্য কোথাও নয়, বন্যার আঘাতের গভীর ক্ষত ঠিক তাঁর বুকে! বইপত্রের ধ্বংসস্তুপে তিনি বসে আছেন; ভগ্নমনোরথে!
তাঁর এমন বিষণ্ণ, দুঃখভারাক্রান্ত, হতোদ্যম চেহারা এর আগে কোনোদিন দেখিনি। বন্যায় আমিও ক্ষতিগ্রস্ত, তবু মুহূর্তে নিজের দুর্ভোগের কথা বিস্মৃত হলাম। তবে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খোঁজে পেলাম না। ইচ্ছে হলো তাঁকে বলি — “কাগজীভাই, চিন্তা করবেন না। আবার আমরা আপনার সংগ্রহশালাকে গড়ে তুলবো।”
কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারি না। অক্ষম আমি তাঁর চোখের দিকে কিছুতেই তাকাতে পারি না!
- বন্যায় কী যে ক্ষতি হলো কবি ইকবাল কাগজীর! || কল্লোল তালুকদার - June 29, 2024
- সুধাংশু কুমার শর্মা : স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদ || কল্লোল তালুকদার - October 1, 2021
- বানপ্রস্থ থেকে ফিরে || কল্লোল তালুকদার - August 12, 2021
COMMENTS