জীবনানন্দের কোনো সাক্ষাৎকার নাই — ভাগ্যিস! — জীবনানন্দের, জীবনানন্দ দাশের, কোনো সাক্ষাৎকার কেউ নিতে যায় নাই। এখানেও ওই লোক আর-সকলের থেকে আলাদা হয়া রইলেন। এই বিষয়টা আমাকে কেমন মজা দেয় যে, একটা আদ্যিকালের জং-ধরা ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে বারায়া আসছে দাশগুপ্তের আখাম্বা সাক্ষাৎকারপাঠকৃতি! কিন্তু, আশার গুড়ে বালি, অমনটা আজও ঘটে নাই।
জীবনানন্দ দাশের কোনো সাক্ষাৎকার কেউ নিতে যায় নাই। যদি নিত, মনে-মনে ভাবি, আজকের সাক্ষাৎকার-দিতে-উদগ্রীব এবং ইন্টার্ভিয়্যু-প্রকাশে-ব্যগ্র সমকাল বেজায় আহ্লাদিত হতো, উপকৃত হতো। কথায় কথায়, জীবনের কবিতা-গদ্য-প্রবন্ধের মতো, রেফারেন্স টানত সবাই জীবনানন্দপ্রদত্ত সাক্ষাৎকারের। বলা যায় না, সাক্ষাৎকারের ভিতরে থাকা চাই পরিচ্ছন্ন ইতিহাসচৈতন্য ও মর্মে চাই কল্পনার সারবত্তা আর কালজ্ঞান এবং সর্বোপরি পৃথিবী-নস্যাৎ-করা পুংটা পোয়েটামি ইত্যাদি কিসিমের স্মরণীয় বাণীও হয়তো-বা পাওয়া যাইত হোথা।
হালের পুঁচকে পোয়েটেরও যেখানে গণ্ডা-তিন সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়া যায় তার সাতটা মাত্র পদ্যি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, সেখানে জীবনদাশও যদি দিয়ে যেতেন সো-কল্ড সাক্ষাৎকার খান-সাতেক, ভারি আমোদ হতো বোধহয়। যে-কোনো ছুতানাতায়, যেন-তেন অছিলায়, সাক্ষাৎকারসুযোগ-খুঁজতে-থাকা আজকালকার বাপদাদাদত্ত-নাম-লুকানো বাহাদুরবৃন্দের কায়কারবার দেখি আর জীবনদাশের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করি : ভাগ্যিস, জীবনবাবু সাক্ষাৎকার দিতে যায় নাই! কোথাও কোনো সাক্ষাৎকৃতি খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই আজ তক্, গুপ্তলুপ্ত বাবুমশয়ের, বরিশালী জীবনানন্দের।
ঠিক এই সূত্র ধরে — জীবনানন্দ দাশের কোনো সাক্ষাৎকার নাই — চিৎকৃত চারপাশ নিয়ে একটা লেখা তৈরির সম্ভাবনা আমি অনেকদিন ধরেই ভেবে চলেছি। দু-চার বছর লিখেই, এক-দুইটা পদ্যিপুস্তিকা ছাপা হবা মাত্রই, বন্ধুপরিজন ব্যতিরেকে ভিন্নগোত্রে পাঠকচাহিদা তৈরি হওয়ার কোনো নামনিশানা না-থাকা সত্ত্বেও, কেন জনৈক তরুণ সাক্ষাৎকারলোলুপ হয়া ওঠে — এর একটা আর্থরাজনৈতিক/সমাজমনস্তাত্ত্বিক সন্ধান চালানো দরকার বলেও বোধ করি। অবশ্য, তখন, তৎকালের ওই বিশশতকী তিরিশ দশকের লেখার-ছাপার জগতে, সাক্ষাৎকার ব্যাপারটার চল ছিল না। যদিও রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর বিদেশে যেয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, এবং সেটি ছাপাও হয়েছে ওই দেশের সাহিত্যজর্নালে, এমন নজির রয়েছে। কিন্তু অবাক হই তখনই, যখন দেখি, আলাপ-আড্ডার সূত্রেও কেউ জীবনানন্দের কোনো অসাহিত্যিক-সাহিত্যিক অভিমত আজ তক্ উল্লেখ করবার পারেন নাই! জীবন, সমানবৃত্তির লোক হলেও মহাভারতোক্ত ঈর্ষা সরায়ে রেখে স্বীকার যাইতে বাধ্য হই যে, এক নিঃসঙ্গ সার্বভৌম দ্বীপ।
লেখা / জাহেদ আহমদ
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS