গল্পগুলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নয় || জয়দেব কর

গল্পগুলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নয় || জয়দেব কর

 

চন্দ্রনাথ পাহাড়। অনেক গল্প তাকে ঘিরে। শৈশবেই শুনেছিলাম তাকে ঘিরে নানা চমকপ্রদ বিবরণ। একবার বন্ধুদের কোনও একজনের মুখ থেকে যখন প্রথম এই পাহাড়ের গল্প শুনি তখন বিষয়টা তাৎক্ষণিক মেনে নিতে পারিনি। বিষয়টা আমার কাছে এরকম ছিল, এমন কোনও পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার নাম আমি জানি না, আমার বন্ধুরা জানে! ঘরে ফিরে যখন ছোড়দিকে জিজ্ঞেস করি, দেখি সেও চন্দ্রনাথের খবর জানে। যেনতেন খবর নয় একদম তীর্থযাত্রীদের মতো করে জানে। ছোড়দি জানে অথচ আমি এর বিন্দুবিসর্গই জানি না, বিষয়টা মোটেও মেনে নিতে পারছিলাম না৷ আর সেদিনের গল্পের আড্ডায় এটাও চোখে পড়েছিল যে অন্য বন্ধুরাও এই পাহাড়ি তীর্থের নাম বা গল্পের সাথে পরিচিত । মনে মনে একটু আহত হলেও আবার এটা ভেবেও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, ব্যাটারা আমার আগে জানলে কী হবে, আমার দিদি কিন্তু আগ থেকেই জানে। যেহেতু দিদি আমাদের বড়ো, সেহেতু সে আগ থেকে জানার কৃতিত্বটা আমারও জন্মসূত্রে প্রাপ্য! সে রাতে ঘুমোবার সময় ছোড়দি গল্প শুরু করল। কী রোমাঞ্চকর বর্ণনা! ওই বর্ণনা যে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয় তা ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারবে না। মনে হচ্ছিল তীর্থযাত্রী যেন ছোড়দি নিজেই! উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে! হাঁটু কেপে ওঠে! কত উঁচু! বাপরে বাপ। আমি তখন দেখতে পাচ্ছিলাম লাঠি ব্যবহার করে সাঁ সাঁ করে ছোড়দি উঠে যাচ্ছে, সাথে আমিও! এমন দৃশ্য কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি কত রাত! একই গল্প শুনেছি বারবার! ছোড়দিও কতদিন ঘুমিয়ে পড়েছে গল্প বলতে বলতে। আমি হয়ত জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি তারপর…? ছোড়দি আর আমি কাছাকাছি বয়েসের। আমি যখন ফোরে তখন সে এইটে। এখন তার কন্যাই হাইস্কুলগামী! আর আমার পুত্র প্রাথমিকে!  চন্দ্রনাথের গল্পবলা বন্ধুদের মধ্যে কারা যে এখন কোথায় আছে তা জানি না। সংসারী হয়েছে সবাই। কেউ কি কখনও সত্যি-সত্যিই চন্দ্রনাথে গিয়েছে কিনা জানি না। আমার ছোড়দি যে আজও যায়নি তা নিশ্চিত। সে এক পাক্কা গৃহিণী। তারপরও আমাদের বিশাল শৈশবপ্রান্তর থেকে ভেসে আসা স্মৃতিসুখ উঁকি মারে। আহা! কতশত কল্পনাভ্রমণ!  হিমালয়-উচ্চতার উপরে উঠে মেঘে চড়ে ভেসে বেড়ানো দিন!

সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের মানুষ আমি। সমতলের মানুষ। আমার বাড়ি থেকে জেলা সদরের তুলনায় সিলেট শহর অনেক কাছে। শৈশবে তো আমাদের উপজেলার মানুষদের সুনামগঞ্জে সড়কপথে যেতে হলে সিলেট শহর হয়ে ঘুরে যেতে হতো, এখন অবশ্য জগন্নাথপুর থেকে সুনামগঞ্জে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। তো সুনামগঞ্জ জেলাশহর হলেও কোর্ট-কাচারি ব্যতীত আমাদের সিংহভাগ মানুষের সিলেটমুখিতা বেশি ছিল, এখনও একই। বুদ্ধিবয়সের শুরুতে সিলেট শহর আমার কাছে স্বপ্নপুরীর মতো এক জায়গা মনে হতো বিশেষত এর বাগবাড়ি, পাঠানটুলা, গোপালটিলা, ভাঙাটিকর, কাষ্টঘর ও টিলাগড়ের জন্য। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের বিভিন্ন নিকটাত্মীয়ের বাস ওসব জায়গায়। তাদের বাড়িতে নানা পরবে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ও বেড়াতে যাওয়া আনন্দদায়ক ছিল। বাগবাড়ি, পাঠানটুলা, গোপালটিলা, টিলাগড় আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ববাহী এলাকা। কারণ ওই এলাকাগুলো ‘পাহাড়’-সমৃদ্ধ। যদিও সবাই ‘পাহাড়’-গুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘টিল্লা’ বলে, যা টিলা শব্দটির স্থানীয় উচ্চারণ। কিন্তু আমার শিশুমনে টিলাগুলোই পাহাড়ের মর্যাদা পেয়েছিল। ওই টিলাগুলোর মাথায় বাড়িগুলোতে হেঁটে উঠতে পারা বিশ্বজয়ের মতোই মনে হতো। উপরে আকাশ আর নিচে জনপদ — কিশোরমনে দিতো এক অনন্য প্রশান্তির দোলা। শহর থেকে গ্রামে ফিরলে আমার ‘পাহাড়’-এর গল্প বন্ধুদের সাথে ভাগ করার কৃতিত্ব ও আনন্দ বড়োই নিখাঁদ ছিল।

সিলেটের বাইরে যে সমস্ত জায়গায় আমার যাতায়াত তার মধ্যে অন্যতম আমার মামা ও মাসীদের বাড়ি। আমার দুই মামা। দুইজনই চাকুরিজীবী ছিলেন। ছোটো মামা ডানকানের চা-বাগানে চাকুরি করতেন। ফলে টিলা-ছড়া-ঝিরি অধ্যুষিত বাগান এলাকায় তার স্টাফ কোয়ার্টারে বাৎসরিক ছুটিযাপন করার জন্য মুখিয়ে থাকতাম।  তাঁর চান্দপুর বাগানের কোয়ার্টারে আমি এসএসসি পরীক্ষার পর মাসদুয়েক ছিলাম। সমরেশের কালবেলা-কালপুরুষ-উত্তরাধিকার-গর্ভধারিণীর আরণ্যিক বিবরণ যেন আমি নিজমনে চেখে দেখেছি ওখানে। আর বড়ো মামা ভোকেশনাল কলেজের শিক্ষকতা করতেন। মৌলভীবাজার ভোকেশনালে দীর্ঘদিন ছিলেন। ওখানেই সুপারিন্টেন্ড হিসেবে অবসর নেন। তাঁর কোয়ার্টারও ছিলো টিলা-অধ্যুষিত এলাকায়। আমাদের ভাইবোনদের চড়ুইভাতি, পুতুলের বিয়ে, লুকোচুরী, বন্দী, কানামাছি খেলার বন্দোবস্ত যেন প্রকৃতি নিজহাতে সাজিয়েছিল। ছোটো মাসীর বাসা শ্রীমঙ্গলে। ফলে বাৎসরিক ছুটিতে দুই মামা ও ছোটো মাসীর বাড়ি পরিভ্রমণেও অধিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল টিলা। বড়োবেলায় এসেও দেখি পাহাড়-টিলা খুবই টানে। কিন্তু এই টানকে চরিতার্থ করার মতো বাস্তবতা দিনদিন কমে আসছে। কত সকাল যে বিকেল হয়েছে, রাত যে দিন হয়েছে টিলা আর অরণ্যের ইশারায় তার হিসেব আর মনে নেই। এ টানটা কেমন? — বলাটা কঠিন!

গত নভেম্বরে (২০২৪ খি.) যখন জীবনের প্রথম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠছিলাম, ছোড়দির কথা মনে পড়ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল যে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। ছোড়দির দেয়া তীর্থযাত্রীদের কষ্টের বিবরণ যেন গল্পের বর্ণনা থেকে উঠে এসে আমাকে একদম বাস্তবে ঝেঁকে ধরেছিল। পরিশ্রমহীন শরীরের অপরাগতাকে তুড়ি মেরে এগিয়ে যাওয়ার এই যাত্রাটা যদিও কোনওভাবেই একজন তীর্থযাত্রীর ছিল না, কিন্তু মনের দুর্নিবার এক শক্তি আমাকে টেনে তুলছিল। আমার ভ্রমণসঙ্গী শিল্পী পংকজ চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় হেসেখেলে উঠছিল, আর যেহেতু ওখানে তাদের নিত্য যাতায়াত ফলে তাদের উপর ভরসা রেখে ও পরামর্শ মেনেই এগুচ্ছিলাম। উচ্চতার বিচারে কোনও পর্বতারোহীর কাছে এ পাহাড় হয়ত গোনায় পড়বে না, কিন্তু আমার মতো মানুষের জন্য এ পাহাড়ভ্রমণ যেমন কষ্টসাধ্য, তেমন আরোগ্যদায়ীও। হলোও তাই। বিরুপাক্ষ মন্দিরে যখন পৌঁছতে পারলাম খুব দ্রুতই ক্লান্তি শুষে নিলো তার নৈঃসর্গিক রূপ। পাহাড়ের গায়ে লেগে যাওয়া ভাসমান মেঘেদের মতোই সুখী হয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পড়েই এক পশলা বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির বিরতিতে হাজার বছরের পুরনো মন্দিরের গায়ে ঝলকে উঠল সোনালি রোদ। সোনালি রোদের আভায় আচমকা চোখ পড়লো মাটির দিকে। চারদিকে ছড়ানো খাদ্যদ্রব্য, আগরবাতি আর কোমল পানীয়ের প্লাস্টিকজাত প্যাকেট ও বোতল। ট্যুরিস্ট নামক প্রাণিদের যথেচ্ছাচারের সাক্ষ্য। কেউই দায়িত্বশীল নয়? সাধু? তীর্থক্ষেত্র-কমিটি? অথবা রাষ্ট্র? উলটো দেখলাম দুই মন্দিরের মাঝখানে খাদ্য-পানীয়ের দোকান। যেটি প্লাস্টিকবর্জ্যের অন্যতম উৎস। বিষয়টি মনে করিয়ে দিলো পিটাছড়া আর্টক্যাম্পের কথা, আমার রাসেলভাইয়ের কথা।

সেবার মাটিরাঙায় প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার স্লোগানকে সামনে রেখে তিনদিনের আর্টক্যাম্পে সারাদেশ থেকে শিল্পী ও লেখকরা যুক্ত হয়েছিলেন। আমিও যুক্ত হয়েছিলাম প্রথমবারের মতো। বন্ধু চিত্রশিল্পী ও কবি জন মহম্মদের জন্যই মূলত পিটাছড়ায় প্রথম যেতে পেরেছিলাম। প্রায় এক বছর ধরে যাব যাব বলে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। ক্যাম্পে সবাই আলাপ-আলোচনা-গান-আড্ডায়-আঁকায় বুঁদ। হঠাৎ লক্ষ করলাম রাসেলভাই হাতে করে দু’মুষ্টি পরিমাণ সিগারেটের উচ্ছ্বিষ্টাংশ নিয়ে উপস্থিত। আর্টক্যাম্পের অংশীজনদের কাজ। একটা উচ্ছ্বিষ্টাংশের জন্য কতগুলো ক্ষুদ্র প্রাণীর জীবন ব্যাহত হতে পারে তা ভাবনায় নিয়ে আসেন রাসেলভাই। সচেতনভাবে তো আমরা একটা সিঙ্গেল প্রাণীর ক্ষতি করতে চাই না। কিন্তু অসচেতনভাবে করেই ফেলি। ২২ একর জায়গায় প্লাস্টিকের নামগন্ধ নেই। এটা রাসেলভাই দ্বারাই সম্ভব। লোকটি বড়োই সন্ত-স্বভাবের। বিলেতের উচ্চ-বেতনের চাকুরি, নাগরিকত্ব, বাড়িগাড়ি, বিত্তবৈভব বাদ দিয়ে মাটিরাঙার জঙ্গলে কুটিরে জীবন স্থির করেছেন। অ্যামাজন বনে আদিবাসীদের সাথে অর্থকড়ি ও আধুনিক সুযোগসুবিধা ছাড়া মাসকয়েকের জীবনযাপন তার চিন্তাজগতে বিশাল মোড় তৈরি করে। তারপরই শুরু হয় তার অনন্য এ সবুজযাত্রা।  রাসেল ভাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রায় ২২ একর জমি লিজ নিয়ে প্রাকৃতিক বনসংরক্ষণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছেন, যার নাম পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগ । বিলুপ্তপ্রায় পিটাপাখির উপস্থিতি এখানে দেখা যায়, তাই এর নাম পিটাছড়া করেন।  মাটিরাঙার পূর্ব খেদাছড়ার অর্জুনটিলায় এর অবস্থান। পাকা সড়ক থেকে রাসেল ভাইয়ের টিলায় পৌঁছতে বেশ দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হয়। কোথাও কোনও ছায়া নেই । দীর্ঘ জায়গাই বৃক্ষহীন নগ্ন টিলাপথ।। অসভ্য মানুষ জঙ্গল উজাড় করে দিয়েছে। বনজ বৃক্ষের কাটা গোড়াগুলো আত্মঘাতি মানুষগুলোর প্রতি ঘৃণাভরা ভেঙচি কাটছিল। প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন, পাম-কাসাভা চাষের মতো মনোকালচারের নগ্ন প্রয়াস প্রকাশ্য দৃশ্যমান। দেখার কেউ নেই। দীর্ঘ কাটফাটা রোদে যখন পিটাছড়া জঙ্গলে ঢুকি, তখন মনে হয়েছিল নরকের ময়দান পাড়ি দিয়ে স্বর্গে ঢুকে পড়েছি। আট-নয় বছরের নবীন প্রাকৃতিক জঙ্গলটি বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। বাস্তুহীন প্রাণিকুলের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে পড়েছে পিটাছড়া জঙ্গল। রাসেলভাই প্রাকৃতিকভাবেন জন্ম নেওয়া গাছগুলোর বাইরে কোনো গাছ লাগান না। ফলে নানা রকমের বনজ বৃক্ষের সমাহার। নানান গাছ নানান প্রজাতির প্রাণীদের আশ্রয় ও খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। সেবার একটা মজার দৃশ্য কারওরই চোখ এড়ায়নি। সেটা ঝন্টু আর রাসেল ভাইর রসায়ন। ঝন্টুকে, ঘুম পারানো, খাওয়ানো, স্নান করানো থেকে শুরু করে সব কিছুই রাসেলভাইয়ের রুটিনওয়ার্ক। তিনি যেদিকেই যাচ্ছেন তার কোলে-কাঁধে করে ফিরছে ঝন্টু। ঝন্টু কোনও মানুষের সন্তান নয়, বানরের বাচ্চা। শিকারীদের হাতে মা-বাবা খুন হয়েছে। অল্প কয়দিনের নবজাতক এই বানরছানাকে ফিডারে করে দুধ খাইয়ে, ফলের জুস খাইয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। এরকম অনেক প্রাণীরই জীবনদাতা তিনি। গড়ে তুলেছেন ভলান্টিয়ার শ্রেণি, যারা দুর্যোগে আক্রান্ত প্রাণীদের জন্য কাজ করে। মানুষের জন্য পাঠাগার ও ক্লিনিকের স্থাপন করেছেন। বৃক্ষনিধন ও শিকার নিরুৎসাহিতকরণ এবং প্রাকৃতিক বনায়নে উৎসাহ প্রদান করতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন সারাবছর। তাঁকে নিবিড়ভাবে দেখলে বোঝা যায়, স্রেফ মানুষ হিসেবে নয়, প্রাণী হিসেবে, পৃথিবীর সন্তান হিসেবে সকলের প্রতি আমাদের কতখানি সচেতন ও দায়িত্বশীল জীবনবোধের প্রয়োজন।

বোধ করি সিংহভাগ মানুষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার বাইরে গিয়ে পাহাড়ের প্রতি হৃদয়বৃত্তিক আকর্ষণবোধ করে মূলত এর সৌন্দর্য ও বৃহত্ত্বকে কেন্দ্র করে। পাহাড়, টিলা, ঝরনা, নদী, ঝিরি, সাগর, মেঘ, অরণ্য আর প্রাণিকুলের সামষ্টিক ও পারস্পরিক প্রাকৃতিক সম্পর্কের রসায়ন আমাদের টানে, মনের পুষ্টি জুগাতে উস্কানী দেয়, দেয় ভাবনা-নির্মাণে সৃজনশীল দার্শনিক ইশারা। পাহাড়ের মৌন ও ঊর্ধ্বমুখি অভিপ্রায় অভিযাত্রীর কানে যেমন অপ্রতিরোধ্য অভিযাত্রার মন্ত্র দেয়, তেমনই শুধায় নৈঃশব্দের অন্তর্নিহিত সংগীত। এই মন্ত্র ও সংগীত তো সবাই সমান মাত্রায় গ্রহণ করতে পারে না। প্রকৃতির এমন মন্ত্রণা পারে না অনেকেই ঠিকঠাক গ্রহণ করতে, হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাবধির । বৈষয়িক উন্নতির স্বার্থপর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বধির হয়ে ওঠা এই মানুষগুলোর কাছে পাহাড় কেন সমতলের প্রাকৃতিক আবেদনও শূন্যের কোঠায়। এরা দীর্ঘদিন ধরে বাসকরা ইতিবাচক প্রকৃতিবান্ধব জনগোষ্ঠীর জন্যও হুমকীস্বরূপ। বাংলাদেশের আদিবাসী পাহাড়ি মানুষদের কথাই ধরুন। তথাকথিত সমতলীয় সভ্য সামাজিক ও রাষ্ট্রিক শক্তির কাছে তাদের জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্যের মূল্য কি আজ পর্যন্ত যথাযথ মর্যাদা পেয়েছে? আমরা কি শিখতে পেরেছি বৈচিত্র্যের মধ্যে কী করে ঐক্য গড়তে হয়? দীর্ঘদিনের শাসকশ্রেণীয় কর্তৃত্ববাদ পাহাড়িদের জব্দ করতে পাহাড়কে কলোনিতে পর্যবসিত করেছে। যা সংখ্যাগরিষ্ঠের সামাজিক ও কর্পোরেট কর্তৃত্ববাদিতাকে প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য ও অরণ্যের পাশাপাশি পাহাড়-টিলা হারাচ্ছে নিজ অস্তিত্ব। সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন ও ব্যবসার নাম করে বৃক্ষনিধন, পাহাড় নিধন, সর্বোপরী প্রকৃতি-নিধনের উৎসব এদেশে সারা বছর বিরাজ করে।  মাটি-পানি-বাতাস সকল কিছুই দূষিত হয়ে উঠেছে, আর তাই তারা আত্মঘাতি অকৃতজ্ঞ মানুষ জাতিকেও দিচ্ছে অভিশাপ। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ভয়ঙ্কর অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে একমাত্র মুক্তির শক্তি পাই আমেরিকার সাদা সর্দারের কাছে লেখা লাল সর্দারের সেই চিঠিটি থেকে।  লাল সর্দারের সে চিঠিটা শুধু আমেরিকার প্রেসেডিন্টের জন্য নয়, সকল দেশের সকল কালের মানুষ ও সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য লেখা অমর কবিতা, প্রকৃতি-বান্ধব দেশ ও বিশ্বের ইস্তেহার। একটি আধুনিক সভ্য শহর গড়ে তোলার ধুয়া তোলে দিয়ে ১৮৫৪ সালে, আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সিয়াটলের আদিবাসীদের নির্দেশ দেন তাদের বসতি এলাকা ছেড়ে চলে যেতে।  প্রত্যুত্তরে সিয়াটল আদিবাসীদের প্রধান (লাল সর্দার) তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে (সাদা সর্দার) একটি চিঠি দেন। চলুন বিখ্যাত নিসর্গপ্রেমী লেখক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার অনুবাদে চিঠিটির উল্লেখযোগ্য অংশ পড়া যাক —

 ‘কী করে তোমরা বেচাকেনা করবে আকাশ, ধরিত্রীর উষ্ণতা? আমরা তোমাদের চিন্তা বুঝতে পারি না।

‘বাতাসের সতেজতা, জলের ঝিকিমিকি — আমরা তো এগুলোর মালিক নই, তবে তোমরা (আমাদের থেকে) এগুলো কিনবে কেমন করে?

‘এই ধরিত্রীর প্রতিটি অংশই আমাদের লোকদের কাছে পবিত্র। পাইনগাছের প্রত্যেকটি চকচকে ডগা, বালুকাময় প্রতিটি সমুদ্রতট, অন্ধকার বনভূমিতে জমে থাকা কুয়াশা, প্রতিটি প্রান্তর, প্রত্যেকটি পতঙ্গের গুনগুন আমার লোকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিতে পবিত্র। প্রতিটি বৃক্ষের ভেতর দিয়ে যে বৃক্ষরস প্রবাহিত হচ্ছে, তারা লাল মানুষদের (উপজাতি/আদিবাসীদের) স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে।

‘সাদা মানুষের (আধুনিক মানুষদের) — মৃতেরা তাদের নিজেদের দেশকে ভুলে দূর আকাশের তারার কাছে (স্বর্গে) চলে যায়, আমাদের মৃতেরা এই সুন্দর পৃথিবীকে কখনও ভোলে না, কেননা এই পৃথিবী লাল মানুষদের মা।

‘আমরা এই পৃথিবীর অংশ, এও আমাদের অংশ। সুগন্ধ ফুলগুলো আমাদের বোন; হরিণ, ঘোড়া, বিশাল ঈগল পাখি — এরা আমাদের ভাই।

‘পাহাড়ের পাথুরে সব গহ্বর, সরস মাঠ, ঘোড়ার বাচ্চার গায়ের যে উষ্ণতা আর মানুষ — সব কিছু মিলে আমাদের একই পরিবার।

‘তার জন্য ওয়াশিংটনের বড় সাদা সর্দার (তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট) যখন বলে পাঠায় যে, সে আমাদের দেশ নিতে চায় — তখন সে বলে আমাদের বাস করার জন্য একটা সংরক্ষিত অঞ্চল দেবে, যেখানে আমরা আরামে থাকব। সে আমাদের পিতার মতো হবে, আমরা তার সন্তানের মতো হবো। সুতরাং আমরা তার কথা বিবেচনা করে দেখব।

‘কিন্তু এটা এত সহজ নয়। এই ভূমি আমাদের কাছে পবিত্র।

‘যদি আমরা এ ভূমি তোমাদের দিয়ে দিই, তাহলে তোমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই ভূমি পবিত্র। তোমরা তোমাদের ছেলেমেয়েদের নিশ্চয়ই শেখাবে এর পবিত্রতার কথা। তাদের শিখিও যে, এখানকার হ্রদগুলোর পরিস্কার জলের মধ্যে দেখতে পাওয়া যেকোনো রহস্যময় ছায়াই আমাদের মানুষদের জীবনের কোনো না কোনো ঘটনার স্মৃতি।

‘ঝরনাগুলোর জলের মর্মরে আমার বাবার ও তার পিতৃপুরুষদের স্বর শোনা যায়।

‘নদীরা আমাদের ভাই, তারা আমাদের তৃষ্ণা মেটায়। নদীরা আমাদের ক্যানো (এক রকম নৌকো) বয়ে নিয়ে যায়, আমাদের ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার জোগায়। যদি আমাদের দেশ তোমাদের দিয়ে দিই তাহলে তোমরা মনে রেখো, তোমাদের ছেলেমেয়েদের শিখিও যে, নদীরা মানুষের ভাই, সুতরাং তোমরা নদীদের সে রকমই যত্ন করো যেমন তোমরা তোমাদের ভাইদের করো।

‘আমরা জানি সাদা মানুষ আমাদের ধরন-ধারণ বোঝে না। তার কাছে পৃথিবীর এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের কোনো তফাত নেই। কেননা সে ভিনদেশি — রাত্রির অন্ধকারে আসে, নিজের যা দরকার মাটির কাছ থেকে কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যায়। এই ধরিত্রী তার আত্মীয় নয়, তার শত্রু। সে একে জয় করে, তারপর ফেলে দিয়ে যায়।

‘সে পেছনে ফেলে দিয়ে যায় নিজের পিতার কবর, কিছুই মনে করে না। নিজের সন্তানের কাছ থেকে পৃথিবীকে সে চুরি করে, কিছুই তার মনে হয় না।

‘তার পিতৃপুরুষের কবর, তার সন্তানের অধিকার সে ভুলে যায়। তার মা এই ধরিত্রী, তার ভাই আকাশ — এসবকে সে মনে করে ভেড়া কিংবা রঙিন পুঁতির মতো কেনাবেচা করার, লুট করার জিনিস।

‘তার লোভ এই পৃথিবীকে খেয়ে ফেলবে, পড়ে থাকবে কেবল এক মরুভূমি।

‘আমরা এসব বুঝতে পারি না। আমাদের ভাবনা অন্যরকম।

‘তোমাদের শহর লাল মানুষদের ব্যথা দেয়। অবশ্য আমরা লাল মানুষেরা জংলি, তার জন্যই হয়তো এমন হয়।

‘সাদা মানুষদের শহরে কোথাও শান্ত নিরিবিলি জায়গা নেই — যেখানে বসে বসন্তকালে পাতায় কুঁড়িগুলোর খুলে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়।

‘অবশ্য আমরা জংলি বলেই আমাদের এ রকম মনে হয়। এত গোলমাল মনে হয় যেন তারা মানুষের কানকে অপমান করছে। জীবনের কী মূল্য আছে একজন লোক যদি জলের ঘূর্ণির মধ্যে আপন মনে একাকী গুনগুন করার শব্দ শুনতে না পায়? কিংবা রাতে ব্যাঙদের বকবকানি? আমি একটা লাল মানুষ, আমি এসবের কিছু বুঝতে পারি না (অর্থাৎ শহরের)।

‘আমরা লাল লোকেরা ছোট পুকুরের জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের হালকা শব্দ শুনতে ভালোবাসি, ভালোবাসি দুপুরের বৃষ্টিতে ধুয়ে পরিস্কার হয়ে যাওয়া বাতাসের নিজস্ব গন্ধ, পাইন বনের গন্ধ।

‘লাল মানুষদের কাছে বাতাস পবিত্র আর মূল্যবান, কেননা জন্তু, গাছ, মানুষ — সবার নিঃশ্বাস একই বাতাসের মধ্যে ধরা আছে।

‘সাদা মানুষেরা যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় তার দিকে মন দেয় না। অনেক দিনের বাসি মৃতদের মতো হয়ে গেছে তারা, তাদের চারপাশের বাতাসের দুর্গন্ধ তারা আর বোধ করে না।

‘কিন্তু আমরা তোমাদের দিয়ে দেব আমাদের জমি, মনে রেখো এই বাতাস আমাদের কাছে মূল্যবান। বাতাস যে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে তার সঙ্গে মিশে থাকে। যে বাতাস আমাদের পূর্বপুরুষের বুকে তার প্রথম বাতাসটি দিয়েছিল, সেই তার শেষ নিঃশ্বাসটি ধরে রেখেছে।…

‘জীবজন্তু ছাড়া মানুষ কী! যদি পৃথিবীতে কোনো জানোয়ার না থাকে, তার আত্মার একাকিত্বে মানুষ নিজেও মরে যাবে।

‘জন্তু-জানোয়ারের যা হবে, কিছুদিন পর মানুষেরও তাই হবে। সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা।

‘এই পৃথিবীর যা হবে পৃথিবীর সন্তানদেরও তা-ই হবে। জীবনের এই ছড়ানো জাল, মানুষ একে বোনেনি — সে কেবল এর একটি সুতো মাত্র। এই জালটিকে সে যা করবে, তার নিজেরও হবে ঠিক তাই।

‘আজ তোমরা ভাবো ঈশ্বর তোমাদেরই। যেমন তোমরা আমাদের এই দেশকে দখল করে নিতে চাও তোমাদের নিজেদের বলে, কিন্তু তা তোমরা পারবে না। সব মানুষের ঈশ্বর সে, তার দয়ার কাছে সাদা এবং লাল মানুষ একই রকম।’

লাল সর্দারের চিঠির ভাষার মতো হৃদয়ের মানুষের পৃথিবী চাই। যে হৃদয়ের মানুষ শুধু মানুষের জন্য নয়, সমস্ত প্রকৃতির জন্যও।  লেখাটার সমাপ্তি টানছি মধুশাহ্‌’র মাজারের চিল-পূর্ণিমার স্মৃতিকথা দিয়ে। চট্টগ্রামের ওয়ার্লেস এলাকায় পাহাড়ের উপর মধুশাহ্‌’র আস্তানা। বহু আগেই প্রয়াত হয়েছেন। মাজার যে টিলায় তার পাশের চূড়ায় পাগল-ফকিরদের জন্য ধুনি আছে। সে দিন অর্ধরাতভর গান হয়েছিল পূর্ণিমায়।  যে ঘরে গানের আসর বসেছিল হঠাৎ লক্ষ করে দেখি একটি চিল ঘরের একদিকে উপরে কোনায় আড়াআড়ি টানানো বাসের উপর বসে আছে। দেখে মনে হলো সে মোটেও অনাহূত নয়। আর গান ও বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিতে সে মোটেও বিরক্ত হয় না। বরং আসরের মনোযোগী নিরব শ্রোতা যেন। পরে জানলাম এটা আহত হয়ে পড়েছিল আশেপাশে কোথাও। একজন ফকিরের শুশ্রূষায় সুস্থ হয়। শুশ্রূষার মধ্য দিয়ে তাদের হার্দিক নৈকট্য বাড়ে। এরপর চিলটি ধুনীতেই স্থায়ী বাস শুরু করে। আকাশে কালপুরুষ উঠেছিল কিনা মনে নেই। পূর্ণিমার তীব্র আলোয় পথ চলছিলাম আমি আর সোমনাথ। টিলা কাটার কুৎসিত দৃশ্য কোনও মতেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। নিচের দিকে নামছিলাম আর  চিলটিকে সুস্থ করা সেই নাম-না-জানা ফকিরের মুখ ভাসছিল চোখে, ভাসছিল লাল সর্দারের চিঠির প্রতিটি অক্ষর, আর মানুষের অসীম মূর্খতাজাত আত্মঘাতী পদচিহ্ন।


জয়দেব কর রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you