ভিক্টোরিয়া ইউরিভনা অ্যামেলিনা ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ইউক্রেনের লভিভে জন্মগ্রহণ করেন । পরে ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা নামে পরিচিত-হয়ে-ওঠা এই মানুষটি একজন কথাশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক অ্যামেলিনা প্রথমে আইটিতে তার কর্মজীবন শুরু করলেও ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে পূর্ণকালীন লেখালেখির জগতে ঢুকে যান।
দুটি উপন্যাস এবং একটি শিশুতোষ বইয়ের লেখক অ্যামেলিনা Joseph Conrad Literary Award লাভ করেন এবং European Union Prize for Literature-এর ফাইনালিস্ট ছিলেন।
২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত ইউক্রেনের মেইডেন রেভুলেশনকে উপজীব্য করে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস Синдром листопаду, або Homo Compatiens (The Fall Syndrome: about, or Homo Compatiens) প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫-তে । উপন্যাসটি বেশকিছু সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছে, এবং ইউক্রেন সহ বৃহত্তর ইউরোপের সমালোচক ও পণ্ডিতমহলে সাদরে গৃহীত হয়েছে।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যামেলিনার শিশুতোষ বই Хтось, або водяне серце (Somebody, or Water Heart) প্রকাশ পায়। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস Дім для Дома (Dom’s Dream Kingdom)।
২০২২-এ রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণশক্তি নিয়ে আগ্রাসন শুরু করলে অ্যামেলিনা ইউক্রেনের একটি সংস্থা ট্রুথ হাউন্ডস-এর যুদ্ধাপরাধগবেষক হিসেবে কাজ করেন। এই সময় থেকেই মূলত তার কবিতার যাত্রা শুরু হয়। কবিতা সৃষ্টির এই প্রেরণা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “যুদ্ধ আপনাকে এমন এক অবস্থায় উপনীত করে, যেখানে বাক্যগুলো যতটুকু সম্ভব সংক্ষিপ্ত, বিরামচিহ্ন যেন মিথ্যা-আড়ম্বরপুর্ণ এবং ভাববস্তু ঘোলাটে লাগলেও প্রতিটি শব্দ অনেক গভীর অর্থবাহী। এই বিষয় সমভাবে যুদ্ধ ও কবিতায় প্রযোজ্য।” অ্যামেলিনা বুঝতে পেরেছিলেন যে, একজন নাগরিক হিসাবে যুদ্ধের সময় দেশে থাকতে বেছে নেওয়া এবং একজন লেখক হিসাবে ইউক্রেনের জাতিসত্তার ধ্বংসকারী এক হানাদার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়া কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
তিনি তার ছেলেকে পোল্যান্ডে নিরাপদে স্থানান্তরিত করেছিলেন কিন্তু নিজে ফিরে এসেছিলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে। গ্রীষ্মের শুরুতে কিয়েভ যখন বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছিল তখন তিনি তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বিস্ফোরণগুলি দেখেছিলেন এবং লিখেছিলেন : “যুদ্ধ হচ্ছে এমন এক অবস্থা যখন আপনি আর কোনও সংবাদ জানতে পারছেন না এবং সেইসব প্রতিবেশীদের জন্য কাঁদতে পারছেন না যারা কয়েক মাইল দূরে মারা গেছে, হয়তো সেখানে আপনিও মারা যেতে পারতেন। তারপরও, আমি নামগুলির খবর জানার কথা ভুলতে চাই না।”
তিনি দমে যাননি। বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয়দের মানবিক সহায়তা প্রদান ও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার মতো কাজে নিবেদিত ছিলেন। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে যুদ্ধাক্রান্ত মানুষদের, বিশেষত নারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে ইজিয়াম অঞ্চলে গবেষণা করার সময় তিনি সমকালীন ইউক্রেনীয় লেখক ভলোদিমির ভাকুলেঙ্কোর যুদ্ধের ডায়েরি উদ্ধার করেছিলেন, যিনি ২০২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে দখলদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।
২০২৩-এর জুনে অ্যামেলিনা প্যারিসে রেসিডেন্সি পান, এবং তার ছেলেকে নিয়ে ওখানে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু, ২৭ জুন ২০২৩ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর ক্রামতোর্স্কের একটি পিজা রেস্তোরাঁয় রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ১ জুলাই ২০২৩ মাত্র ৩৭ বছর বয়সে হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে লভিভে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে তার তৈরি পাণ্ডুলিপিটি অসমাপ্ত রয়ে যায়।
মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে তিনি চিত্রশিল্পী পলিনা রায়কো, যার কাজ রাশিয়ান আগ্রাসনে কাখোভ্কা বাঁধের পতনের ফলে সৃষ্ট বন্যায় অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সম্পর্কে লিখেছিলেন, “শিল্প ততক্ষণ বেঁচে থাকে যতক্ষণ জগৎ তা দেখে।”
ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা / আলোকপাত ও অনুবাদ : জয়দেব কর
সাক্ষ্য
এই অদ্ভুত শহরে শুধু নারীরাই সাক্ষ্য দেয়
একজন জানায় হারিয়ে-যাওয়া বাচ্চাটির কথা
বেসমেন্টের মধ্যে নির্যাতিত মানুষের কথা জানা যায় দুইজনের কাছে
তিনজন জানায় তারা ধর্ষণ সম্পর্কে শোনেনি এবং তারা তাদের চোখ ফিরিয়ে নেয়
সেনাসদর থেকে ভেসে-আসা আর্তচিৎকারের কথা জানায় চারজন
পাঁচজন থেকে জানা যায় তাদের আঙিনায় গুলিবিদ্ধ মানুষগুলোর কথা
ছয়জন যা বলে তা বোধগম্য হয়ে ওঠে না
সাতজন এখনও খাদ্যের মজুদ হিসেব করছে উচ্চৈঃস্বরে
আটজন আমাকে মিথ্যাবাদী বলে, কারণ এখানে কোনও ন্যায়বিচার নেই
গোরস্থানমুখী হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে নয়জন
আমিও যাচ্ছি আমার পথে, কারণ এই শহরের প্রত্যেককেই জানি
এর সকলের মৃত্যু আমার মৃত্যু
এবং এর সকল জীবিতরা আমার বোন
দশজন জানায় বেঁচে-যাওয়া সে-মানুষটি সম্পর্কে
যে ওদের হাতে বন্দি ছিল
সে-ই নির্যাতনকারীদের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে
আমি তার দরোজায় কড়া নাড়ি
তার প্রতিবেশিনী বেরিয়ে আসে
তার হয়ে সে উত্তর দেয় :
মনে হচ্ছে সে বেঁচে আছে
যাও, নারীদের সাথে কথা বলো
*ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন ভ্যালজিনা মর্ট
.
একটি কাক সম্পর্কিত কবিতা
অনুর্বর বসন্তের মাঠে
কালো পোশাকে আছে দাঁড়িয়ে এক নারী
বোনদের জন্য কাঁদছে
শূন্য আকাশে একলা পাখির মতো
তাদের সকলের জন্য তার কান্না
যে উড়ে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি
যে করেছিল মৃত্যুভিক্ষা
যে পারেনি থামাতে মৃত্যুকে
যে করেনি প্রতীক্ষার অবসান
যে করেনি বিশ্বাসের অবসান
যে এখনও নীরবে করে শোক
মাটির ভেতর সে কাঁদবে তাদের সকলের জন্য
মনে হবে মাঠে বেদনা করছে রোপন
এবং বেদনা ও নারীদের নামগুলো হতে
তার নতুন বোনেরা জন্ম নেবে ধরিত্রী থেকে
আর আবার গাইবে গান জীবনানন্দে
কিন্তু, তার কি হবে, কাক?
সে এই মাঠে থাকবে চিরকাল
কারণ শুধু এই কান্না তার
ধরে রাখে আকাশের ওইসব আবাবিল
তুমি কি শুনতে পাও কীভাবে সে ডাকে
প্রত্যেকের নাম ধরে?
*ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন উলিয়াম ব্ল্যাকার
.
শিরোনামহীন ১
ওই নারীকে দেখো, পেছনে বাড়ানো বাহু?
সে সম্ভবত স্যুটকেস বা কাউকে টেনে নিয়ে আসছে তার সাথে
অদৃশ্য স্যুটকেস অবশ্যই খুব ভারী, তাই সে ধীর
এমন নারী সাধারণত খুবই অদ্ভুত মনে হয়
তার ভস্মীভূত বাড়ি থেকে নিয়ে আসার মতো কিছুই ছিল না
আর ওখানে তার সাথে কে বাস করত? এখন কেউ জানে না
তবুও তারা তাকে অনুসরণ করে দেখে শ্লথহাঁটা একটি শিশু পেছনে
আর তাই নারীটি থামে : তার জন্য সব সময় থাকে অপেক্ষায়
*ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন লরিসা বাবিজ
.
শিরোনামহীন ২
এক অদ্ভুত সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে এক নারী, সর্বস্বান্ত,
আলুথালু চুল, ছেঁড়া কাপড়ের জুতো পায়ে,
রক্তাক্ত ঠোঁটে ফিসফিসিয়ে বলছে একটি নাম
স্থানীয়রা ভাবছে এই নারী তার স্বামীকে হারিয়েছে
কিন্তু তার উচ্চারিত নাম আমি শুনেছি
এটা কোনও পুরুষের নাম নয়, নয় কোনও শিশুর নাম
সে দাঁড়িয়ে আছে সাগরের পারে এবং ডাকছে সাগরকে
সাগরও ভাবে সে তার স্বামীকে হারিয়েছে
এই অদ্ভুত অখ্যাত নামের জবাব দেয় না সে
শুধু ঝিনুকের খোলস ও তীক্ষ্ণধার পাথর ধুয়ে যায়
শুধু সামুদ্রিক ভাষায় ফিসফিসিয়ে বলে :
হে নারী, সে তোমার কাছে ফিরবে,
তোমার আজভ
*ইউক্রেনীয় থেকে ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন লরিসা বাবিজ
ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা
আলোকপাত ও অনুবাদ : জয়দেব কর
গানপারপ্রকাশ ২০২৫ ফেব্রুয়ারি
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
- মাসুম পারভেজ : কবি, কাব্যগ্রন্থহীন || সরোজ মোস্তফা - February 7, 2025
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
COMMENTS