‘বিদায় পরিচিতা, এই বিদায়ের সুর / চুপি চুপি ডাকে দূর বহুদূর … জনহীন সৈকতে ওড়ে সিগারেটের ছাই / বিদায় পরিচিতা, আকাশ বিষণ্ন, তার কাছে যাই’ … Farewell Angelina, the sky is erupting, I must go where it’s quiet … এইটা না? তা, পরিচিতা হইল তো, অনুবাদে, নাকি অপরিচিতা ছিল, উচ্চারণ ভুল গেয়েছি আমি এদ্দিন? সুমনগায়নে এইটা পরিচিতা নামেই শুনেছি বলে মনে পড়ছিল। যতদূর স্মৃতি আছে, দেখছি হাতড়ে যে ক্যাসেটের খাপে ‘বিদায় পরিচিতা’ ছিল গানটার নাম। অ্যানিওয়ে। তেমন হেরফের কিছু তো না আননৌন বা নৌন, পরিচিত হোক অথবা অপরিচিত, কি-বা হায় আসে যায় তায়? স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়া যাইল এই পরিচিতা/অ্যাঞ্জেলিনা/অপরিচিতা সুবাদে, এক পরিচিতা আত্মীয়ের বিদায়দিনে, এইটুকু মম নগদ ফায়দা।
ভালো কথা, ‘ফেয়ারোয়েল অ্যান্ড্রোমিডা’ নামে একটা গানও তখন পাশাপাশি শুনতাম, ডেনভারের। Welcome to my evening, the closing of the day / You know I could try a million times and never find a better way / To tell you that I love you and all the songs I played / Are to thank you for allowing me in that lovely day you made … ইত্যাদি লাইনঘাটের গান, যার শুরু হয় Welcome to my morning, welcome to my day / Yes, I’m the one responsible, I made it just this way / To make myself some pictures, see what they might bring / I think I made it perfectly, I wouldn’t change a thing … ইত্যাদি লাইন সম্বলিত স্তবকটি দিয়ে। ফেয়ারোয়েল অ্যাঞ্জেলিনা, ফেয়ারোয়েল অ্যান্ড্রোমিডা। এইভাবেই ডিলান আর ডেনভার পাশাপাশি শুনেছি, চিরদিন, পিঠোপিঠি যেমন সুমন ও অঞ্জন।
শুধু এই একটা গানেই নয়, সুমনের অসংখ্য গান থেকে ব্যক্তিগতভাবে একটি জিনিশ আমি অপার বিস্ময়ে খেয়াল করেছি যে, কেমন করে একটি ভিনসংস্কৃতি/ভিনভাষা থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে হয়। নিজের ভূখণ্ডের সুরনিসর্গ সম্পর্কে, ল্যান্ডস্ক্যাপ ও সাউন্ডস্ক্যাপ সম্পর্কে, আপন ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গানবাজনাজাগতিক ইডিয়্যম সম্পর্কে একটা আয়ত বুঝসমুজ থাকলে পরেই সুমনের ন্যায় এহেন আত্তীকরণ/ইন্টার্নালাইজেশন সম্ভব। আজকাল সুমনের গানের সঙ্গে মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট উৎসগান তথা ইংরেজি গানটা/গানগুলো শোনার সুযোগ অনেক অবারিত হওয়ায় কিছু ব্যাপার খোলাখুলি নিজের সঙ্গে নিজে বোঝাপড়া করে নিতে পারি সহজেই। এর মধ্যে একটা বোঝাপড়া এ-রকম যে, এন্টায়ার ক্যারিয়ারে সুমন ইংরেজি গান থেকে দুইহাতে নিয়েছেন। গ্রহণের ধরন ও মাত্রা, সুমনকৃত সংগীতের সংগ্রহকৌশল, বাংলা কালচারের সৃষ্টিশীলেরা আমলে নিলে উপকার হয় সবদিক থেকেই। মনে হয়েছে যে, সুমন সর্বভূকের ন্যায় গ্রহিষ্ণু হয়েও সমন্বিত ও সুনির্বাচিত। সর্বভূকের সুসমন্বয় ও সুনির্বাচন সম্ভব হয় তখনই যখন তার আপন কপর্দকগুলো সম্পর্কে, আনা-আধুলি কয়েনগুলো সম্পর্কে, একদম পাক্কা ধারণা থাকে।
দেখি যে, সুমন ইংরেজি গান থেকে স্রেফ আইডিয়াটা নিয়েছেন কোনো-একটা গানের, কখনো আঙ্গিকের আইডিয়া কখনো লিরিক্সের খানিকটা আবছায়া, তারপর পুরোটা বাংলারই নিজের করে তুলেছেন। এই ‘ফেয়ারোয়েল অ্যাঞ্জেলিনা’ গান থেকে ‘বিদায় পরিচিতা’ বানানোর প্রক্রিয়াটাও লক্ষ করব সুমনস্বভাবের চিহ্নপরিবাহক। ববির গানে যে-রিফ্রেইন অংশ পৌনপুনিক, যথা Farewell, Angelina / The sky is on fire / And I must go … Farewell, Angelina / The sky is trembling / And I must leave … Farewell, Angelina / The sky is falling / I’ll see you in a while … Farewell, Angelina / The sky’s changing color / And I must leave fast … But Farewell, Angelina / The sky’s embarrassed / And I must be gone … ইত্যাদি, বাংলায় লিরিক্স মুসাবিদা করতে যেয়ে কবীর সুমন শুধু ধুয়াপদের আদলে এই আইডিয়াটাই নেন, গোটা গানের আক্ষরিক বা এমনকি ভাবানুবাদেও যান না। সুমন যা করেন, পৌনপুনিক, তা এই-রকম : বিদায় পরিচিতা / আকাশ ধূসর / তার কাছে যাই … বিদায় পরিচিতা / আকাশ বিপন্ন / তার কাছে যাই … বিদায় পরিচিতা / আকাশ একা / আমিও একাই … ইত্যাদি। কিন্তু এই রিফ্রেইনের আইডিয়া আত্মসাৎ করতে যেয়েও সুমন নিজের কবিক্যারেক্টারের জেন্যুয়িনিটি চিনিয়ে দেন এই লাইনে : ‘বিদায় পরিচিতা / আমার চোখে তুমি / তোমার চোখে জল।’
গোটা গানটা বাংলা করতে গেলে কী বিকট কারবার হতো, দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তবে এই-রকম দুর্ধর্ষ পঙক্তি নিশ্চয় পেতাম না : সঙের আর্শিতে সময়ের মুখ / রাঙতায় মোড়া যুগের অসুখ / তুমি শোনো বা না-শোনো / তবু তোমাকে শোনাই / বিদায় পরিচিতা … রাস্তায় পড়ে আছে স্বপ্নের লাশ / বাতাসে লুকনো তার দীর্ঘশ্বাস / খুন-হওয়া স্বপ্নের লাশ ঢেকে দেয়া চাই / বিদায়্ পরিচিতা … ইত্যাদি ইত্যাদি। শিক্ষকের ভূমিকা পালনে তখনও সুমন ব্যগ্র হয়ে ওঠেন নাই, কিন্তু নিজের মতো করে তার গান হয়ে-ওঠা তরিকাটা অভিনিবেশে খেয়াল করে গেছি আমরা, লাভবান হয়েছি স্বীকার্য।
সম্প্রতি সুমন যত-না সৃষ্টিশীল তারচেয়ে বেশি শিক্ষণশীল, কথায় কথায় শেখাতে চান এবং সমকালীন বাংলা নাচাগানায় নিজেকে ছাড়া আর-কাউকেই তিনি দেখতে পান না। নানান ইন্টার্ভিয়্যু, ইউটিউবে এবং অন্যান্য লেখাপত্রে, সুমনের এই গোঁড়া বাঙালির শিক্ষকভূমিকায় দেখতে পেয়ে একটু অন্যভাবে রেট্রোস্পেক্ট করতে হয় পেছন ফিরে। এইটা আদতে আফটার-ফিফটি সিন্ড্রোম ছাড়া কী আর, গত তিন-দশকের বাংলা গানে আমি ছাড়া নাহি কেহ যোগ্য গণনার, এ-মতো মনে-হবার পর্যায়টা প্রায় হিস্টিরিয়ার। সুমনের খেদ ও আক্ষেপের গ্রাউন্ড বুঝিয়াও অত অদ্বিতীয় ভূমিকার ক্লেইম নিয়া আমরা সন্দিহান হতেই পারি। না-হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আত্মরক্ষার প্রতিবেদন প্রণয়নের তাগিদটা আমি মনে করি জরুরি।
Yes, I’m the one responsible, I made it just this way / To make myself some pictures, see what they might bring / I think I made it perfectly, I wouldn’t change a thing … সেইটাই। উই মেইড ইট জাস্ট দিস্ ওয়ে। নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘরই খাসা। সাতটা শঙ্খ একসাথে বাজাব, পুরোটা সপ্তক একসাথে বাজাব, একটাও কম না — দাজ স্পেইক কফিল আহমেদ, ওয়ান অ্যামাং দ্য মায়েস্ত্রোস্ অফ আওয়ার সাউন্ডস্ক্যাপ।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, ‘বিদায় পরিচিতা’ গানটা কোন অ্যালবামের মনে করতে পারছি না। ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’? সার্চ দিলাম। না। ‘জাতিস্মর’? কনফিউশন কাটল। হ্যাঁ, ‘জাতিস্মর’ অ্যালবামের। পাদটীকা ক্যাসেটকাভারের উল্টা পিঠে দেয়া, যাতে লেখা, ‘কৃতজ্ঞতা : গানটি বব ডিলানের একটি গান অবলম্বনে’। এইটা সার্চ দিয়া বার করতে করতে ভেবে দেখলাম, জমানা পাল্টে গেছে। এককালে অ্যালবাম ধরে একেকটা গান লোকেইট করতে পারতাম। এখন তো অ্যালবামের কন্সেপ্টটাই নাই। উবে গেছে। এখন গান শুনি সিঙ্গেলে। এবং মোস্টলি স্ক্রিনে। ‘দেখতে দেখতে সবই পাল্টে যায়’। এই লাইনটাও, বলা বাহুল্য, সুমনের গানের।
পোস্টস্ক্রিপ্ট : ‘সহসা সুমন’ শীর্ষকের আওতায় এই নিবন্ধটি ইয়াদ-নাই-নাম জনৈক কবির পোস্ট করা স্ট্যাটাসের একটি ইনফর্মেশন ক্রসচেক করতে যেয়ে লেখা। ডাইরেক্ট কমেন্টে। একলাইনেই ছিল মূল স্ট্যাটাসটা, তাতে মোদ্দা কথাটি ছিল, ‘ফেয়ারোয়েল অ্যাঞ্জেলিনা’ গানের অ্যাঞ্জেলিনা সুমনের অনুবাদে অপরিচিতা হিশেবে আমাদের কাছে পরিচিত। সঙ্গে শেয়ার করা লিঙ্কে বব ডিলানের গানটি ছিল। তখন অপরিচিতা নয়, অ্যাঞ্জেলিনাকে সুমন করে তুলেছিলেন পরিচিতা, বাংলা গানটি ‘বিদায় পরিচিতা’ নামে, এই কথাটিই যুক্ত করবার ছিল। পরে সেই রিপ্লাইরিমার্কটুকু নোটস সেকশনে একটু গুছিয়ে রেখেছিলামও। কথা সেইটা নয়। এত বড় কলেবরে স্ট্যাটাসের কমেন্ট সেকশনে এনগেইজড হওয়া, তা যা-ই বিষয়-বিধেয় হোক, মাত্র দশককাল আগেও, কমন ঘটনাই ছিল। ২০১৫ জুলাই নিবন্ধটা ড্রাফটের এক্স্যাক্ট টাইমলাইন। দশককাল বাদে, ২০২৫ জুলাইয়ে এসে, এমন একটা ফায়দাছাড়া আলাপ কেউ জুড়বেও না, আর জুড়লেও হালে পানি পাবে না। ডাম্ব একটা ডামাডোল সবজায়গায় শাখায়শেকড়ে বেড়ে বেড়ে এখন অতিকায়। এর তলায় চাপা খায় বাকি আলাপগুলা। বাকি আলাপের সওয়ালই পয়দা হয় না আর। সকলেই হতে চায় রাজার আখ্যানকার। সকালে গ্র্যান্ড, দুপুরে মেটা, আরও শতেক ঠ্যাঁটা ঠ্যাঁটা ন্যারেটিভের পর ন্যারেটিভ। নদীভরা ন্যারেটিভের জোয়ার। অন্য আলাপ জুড়বার ফুরসত হয় না। আর, আরেকটা কথা, এই নিবন্ধ কবীর সুমন ও তার গান কিংবা ডেনভার ডিলান প্রসঙ্গ ধরে এগোলেও কোনো মূল্যায়ন মূল্যাঙ্কনের প্রয়াস এইটা না। কাজেই, রিয়্যাকশন ও রেস্পন্স যদি চিন্তাচর্চায় গ্রাহ্য হয় তাইলে এই নিবন্ধটিও গ্রহণে পাঠকের আপত্তি থাকবার কথা নয়। আপাতত অলমিতি।
গানপারে কবীর সুমন
- সহসা সুমন - July 22, 2025
- জন্মদিন, মৃত্যুদিন ও অন্যান্য অবসিন - July 11, 2025
- বিল নট অর্ধশতাধিক - July 4, 2025
COMMENTS