নোটস্ অন কবীর সুমন || জাহেদ আহমদ

নোটস্ অন কবীর সুমন || জাহেদ আহমদ

ততটা গান নিয়া না, মানে যে-অর্থে একটা সাংগীতিক জার্নি ভিশ্যুয়ালাইজ করতে দেখি নিবন্ধে-প্রবন্ধে দেশবিদেশের ভাষায় তেমন তো নয়ই, কবীর সুমনের কয়েকটা গানের লিরিক ধরে বেশ কয়েক বছর আগে একসময় কিছু নোট রাখা গিয়েছিল ফেসবুকের নোটস্টোরেজে। সেসব যতটা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়া ভাষ্য মুসাবিদার তাগিদ থেকে, মিউজিক বা লিরিকের স্ট্রেন্থ-উয়িক্নেস কি ইনোভেশন নিয়া আদৌ নয়। এবং সময়টা ছিল ২০১৩। নোটগুলো প্রয়োজনীয় পরিমার্জন-পুনর্যোজন করে এই নিবন্ধ। ফলে এইখানে কেউ কবীর সুমনের সংগীতসম্ভার বা তার ব্যক্তিজীবনের আদ্যোপান্ত খোঁজার মনোবাঞ্ছা নিয়া পাঠোদ্যত যেন না হন তাই গোড়াতে এই ডিসক্লেইমার।

কথাটা হচ্ছে এ-ই যে কবীর সুমনের গান নিয়া আজকের এই ২০১৯ প্রেক্ষাপটে এসে প্রশস্তিবাচক বা নিন্দামন্দের টোনে কথাবার্তা চালানোয় একটু নয় বেশ বৃহদাংশেই ডিফিকাল্ট মনে হয়। কিন্তু বছর-দশেক আগে স্রেফ সপ্রশংস প্রবন্ধ/নিবন্ধ রচনা আদৌ কঠিন ছিল না অন্তত কবীর সুমন বিষয়ে। এমন কি ঘটল এরই মধ্যে যে এই ডিফিকাল্টি? — ঠিক কিছু ঘটে নাই সেভাবে, আবার ঘটে গেছে অনেককিছুই। সিপিএম থেকে তৃণমূল ইত্যাদি হ্যাপেনিং বাদই দিতে পারেন, কিন্তু সুমন তার হাজারমতন (সংখ্যাটা জানা নাই) লিরিকের সিংহভাগে যেই বিপ্লবের আর যৌথখামারের জয়গাথা গাইলেন সেই বিপ্লব আর জয়গাথা বাদ দিয়া তার গানগুলা আদৌ কোথাও দাঁড়ায় কি না তা দেখতে চাইলে যেটুকু অধ্যবসায়ী যেটুকু অনুধ্যানী হওয়া লাগবে সেটুকু ফুরসত জুটাইতে হবে আগে। এছাড়া লাস্ট দশ-পনেরো বছরে কবীর সুমন এত বকবক করেছেন লাগামছাড়া, আর সেইসব বকবকানি এতই সেল্ফসেন্টার্ড আর এক্সেন্ট্রিক আর বেহুদা অ্যারোগ্যান্ট, আর সেইসব কথাবার্তা এতটাই খিস্তিমূলক ও শত্রুমিত্র যুগ্মবৈপরীত্যের ঝাণ্ডাবাহী, বিশেষ কিছু বলবার থাকে না আর উনার গান নিয়া। যা-কিছু বলার উনি নিজেই তো বলে যেতেছেন উদয়াস্ত।

মনে পড়বে সেফুদার মুখ, সিফাতুল্লাহ ওর্ফে সেফুদা নামে পরিচিত একজন ফেসবুক-ইউটিউবে দেদার গালিগালাজ করে যায় নিত্যি, খুবই দরকারি ডিসকোর্স সেগুলো হতে পারে, কেবল আপনার-আমার পার্টিসিপেশনের জায়গাটা থাকে না সেফুদাদের বল্গাহারা স্টাইলের ন্যারেটিভগুলায়। শিল্পী কবীর সুমন গত দশ-পনেরো বছর ধরে সেফুদার সঙ্গেই যেন কম্পিটিশনে নেমেছেন, মহাত্মা সিফাতুল্লা সেফুদারই কন্টেন্ডার যেন উনি। নিশ্চয় সিফাতুল্লার সেনাবাহিনীই পারবেন সুমনের গানবাজনা নিয়া সারগর্ভ প্রবন্ধটি লিখতে। অ্যাট-লিস্ট এই মুহূর্তে।

একটু টোন-ডাউন করে এভাবেও বলা যায় যে ব্যাপারটা শামসুর রাহমানের কবিতার মতো হয়ে গেছে। কেমন করে? রাহমানের জীবদ্দশার শেষ দুই দশকে এত কথাবার্তা হয়েছে উনাকে নিয়ে স্তুতিবাচক, এত কথা উনি নিজেই বলেছেন নিজের কাজ ও সময় সম্পর্কে, এত অজস্র ইন্টার্ভিয়্যু দিয়েছেন যে এরপরে উনারে নিয়া আলাপের আর কিছুই বাকি নাই। উনার কবিতার আর কোনো রহস্যাঞ্চল তো নাই যা আপনি নতুন করে দেখাইতে উদ্যত হবেন। কবীর সুমনও তথৈবচ। উনি ইন্টার্ভিয়্যু শুধু নয়, ভিডিয়োফর্ম্যাটে এত কথা আর বাগাড়ম্বর রাগগোস্বা করেছেন এদ্দিনে যে উনার গানের ভিতর যা-কিছু খননের অপেক্ষায় ছিল সবই তিনি স্বীয় হস্তে ঢেলে দিয়েছেন গলগল করে। কাজেই, নতুন আর কিছু বলবার তো নাই আপনার-আমার। উনি একলাই একশ।

তবু কথা তো বলা যায়ই। নিশ্চয় একদিন অন্য অ্যাঙ্গেলে কবীর সুমনের গানকর্মগুলো অবলোকনের ইনিশিয়েটিভ শুরুও হবে। সেই ইনিশিয়েটিভের দরকারও আছে। কেবল স্তুতির আর কেবল নিন্দার রাস্তাগুলা আমরা যেন পরিহার করে চলি, ইয়াদ রাখব। বর্তমান এই নিবন্ধে তেরো সনের গুটিকয় নাতিদীর্ঘ নোট পরপর জুড়ে দেয়া যাচ্ছে শুধু।

মগজে কার্ফিয়্যু ও বলিহারি বিরোধীনিকেশের ধুন্দুমার ঋতু
‘মগজে কার্ফিয়্যু’ কবীর সুমনের গান। অনেক পুরনো। গোড়ার দিককার। প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’ কিংবা দ্বিতীয়/তৃতীয় ‘বসে আঁকো’/‘ইচ্ছে হলো’ হতে পারে। গোড়ার স্তবকের লাইনগুলো অনেকটাই এ-রকম : “মগজে কার্ফিয়্যু / নিষেধ বেরোনো / ভাবনা নিয়ে একা / রাস্তা পেরোনো” … ইত্যাদি। কিছুই করার নাই যেন, মনে হয় মাঝে মাঝে। নাই কাজ, তো করবিটা কি? যা, খৈ ভাজ গিয়া। “তুই গান গা ইচ্ছেমতন / বাতাসকে খুশি করে বাঁচ / সবুজের বুকপাতা শিশিরে / পা ডুবিয়ে হাঁট” — এইটা অবশ্য অর্ণবের গান — সহিংস খুনাখুনির গৃহবন্দি দিনগুলিতে পুরনো জমানার গান শোনো, রেকর্ডপ্লেয়ারে, অথবা চালাও তোমার মেমোরিগ্র্যামোফোন। নতুন বছর, নবনির্বাচনী প্রহসন, পুরনো মুসোলিনি-হিটলারের ফ্যাসিজম-নাজিজম, বদু-খাঁ আমলের রাজনীতি।

কিন্তু ‘মগজে কার্ফিয়্যু’ গানটা বাদ দিয়ে এইবার আরেকটা গানে কর্ণনিবেশ করি, ‘বিরোধী’ সেই গানের শিরোনাম। অনেক অনেক বছর আগের — প্রায় দুই দশক তো হবেই — গান এইটা। আজকের বাংলাদেশে এই গান পয়লাবারের মতো শুনে যে-কেউ মনে করবে কবীর সুমন বোধহয় বিরোধীশিবিরের সঙ্গে আঁতাত করে সেরেছেন। বর্তমান বাংলাদেশে যে-জিনিশটা নাই একেবারে তা হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। প্রাচীন মাল এইটাও, অপরের মতামত খণ্ডনের সময়েও অভিপ্রেত সৌজন্য ও শিষ্টাচার, এইগুলা আজ আর আশাই করা যায় না। বাংলাদেশে এখন সর্বপ্রকার বিরোধীনিকেশের ধুন্দুমার ঋতু। বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাদারিতার জায়গায় ঢেঁকি হিশেবে পরিচিত যারা তাদেরে দেখেই বলছি কথাটা। আধো-আধো মনে পড়ছে একটা গান, সেখানকার বিক্ষিপ্ত কয়েকটা লাইন, শুনে দেখি :

বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক …

বিতর্ক চলতে দাও, বিতর্ক চলতে দাও, বিতর্ক চলতে দাও
নাই-বা করলে সন্ধি
বিতর্ক চলতে দাও, বিতর্ক চলতে দাও, বিতর্ক থামলে আমরা
মানসিক প্রতিবন্ধী

বিরোধীর যুক্তিটাও
বন্ধুরা আমল দাও

আহা! এই গানটার আরও দুর্ধর্ষ লাইনঘাট আছে, এখন মনে আসছে না, খুঁজেও পাচ্ছি না ইতিউতি হাতড়ে। একটা লাইন এমন : “বিরুদ্ধ ঢেউ উঠুক, উত্তাল হোক নদী / …” এর সঙ্গে অন্ত্যমিলে ‘নড়ুক কায়েমি গদি’ ইত্যাদি। বালাই ষাট! গদি নাড়ানোর আওয়াজ কে তুলতে যায়, আব্দার করে নিজের ভাগের হালুয়াহিস্যা আদায়-উশুল করা ছাড়া?

আমাদের মূল্যবান/অমূল্য অপিনিয়ন এ-ই যে, বিরোধীরা বাচ্চামানুষ, গদিনশিন ‘পক্ষীয়’-রা মা-বাপ; কাজেই বাচ্চাদেরে খেলতে দেয়া স্বাস্থ্যসঙ্গত যুক্তি, তাদের খেলার মাঠ বরাদ্দকরণ ও সারাদিন-না-হোক একটা টাইমে — ধরুন বিকেলের দিকটায় — খেলতে দেয়া কর্তব্য, অন্যথায় একসময় এরা বাপ-মা তো ডোবাবেই, গ্রামবাসীরেও লটকাবে বেহুদা বাঁশের আগায়। আর লোকেই-বা কী বলবে তখন? নিন্দুকেরা বলে যে প্যারেন্টস্-ছেলেমেয়ে সব্বাই মিলে আমরা নাকি অটিজম প্রোজেক্টের ক্লায়েন্টেল সার্ভিস বাড়াতে চাইছি। অ্যানিওয়ে। ওই গানেই আছে : “রাজনীতি নাম কেন? / রাজাদের দিন তো কবেই বিদায় নিয়েছে দেশ থেকে / লোকনীতি জন্ম নিক / লোকেদের মন্দ-ভালোর দিকেই তীক্ষ্ণ চোখ রেখে …”

গ্য টু হেল্ …

বাচ্চারা কেউ ঝামেলা কোরো না / উল্টোপাল্টা প্রশ্ন কোরো না / খেলা-ছোটাছুটি বেয়াদবি সব / চুপচাপ বসে থাকো …

পুরো লিরিক্স শেষমেশ বন্ধুদৌত্যে পেয়ে যাওয়ায় এইখানে ক্লিপ এঁটে রাখছি। গানের শিরোনাম ‘বিরোধীকে বলতে দাও’, অ্যালবাম ‘আদাব’, প্রকাশ পায় খ্রিস্টাব্দ ২০০২ নাগাদ। পঙক্তিগুলো দেখি :

বিরোধীকে বলতে দাও…
বিরোধীকে বলতে দাও…
বিরোধীকে বলতে দাও…
তোমার ভুলের ফর্দ দিক।

বিরোধীকে বাঁচতে দাও…
বিরোধীকে বাঁচতে দাও…
বিরোধীর দৃষ্টি দিয়েও সবাই নিজের হিসেব নিক।

যুক্তিকে বাঁচতে দাও…
যুক্তিকে বাঁচতে দাও…
যুক্তির স্বচ্ছ আলোয় শানিয়ে নিচ্ছি আমার চোখ।

বিরোধীর যুক্তিটাও
বন্ধুরা আমল দাও
বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক।

বিতর্ক চলতে দাও…
বিতর্ক চলতে দাও…
নাই-বা করলে সন্ধি।

বিতর্ক চলতে দাও…
বিতর্ক চলতে দাও…
বিতর্ক থামলে আমরা মানসিক প্রতিবন্ধী।

বিরুদ্ধ ঢেউ আসুক…
বিরুদ্ধ ঢেউ আসুক…
বিরুদ্ধ ঢেউ আসুক, উত্তাল হোক নদী।

তর্কের ঝড় উঠুক
তর্কের ঝড় উঠুক
তর্কের দামাল হাওয়ায় নড়ুক কায়েমি গদি।

রাজনীতি নাম কেন?
রাজনীতি নাম কেন?
রাজাদের দিন তো কবেই বিদায় নিয়েছে দেশ থেকে।

লোকনীতি জন্ম নিক…
লোকনীতি জন্ম নিক…
লোকেদের মন্দ-ভালোর দিকেই কিন্তু চোখ রেখে।

নামগুলো পাল্টে দাও…
নামগুলো পাল্টে দাও…
নামগুলো চিন্তাভাবনা করেই রাখাটা দরকারি।

দিনগুলো পাল্টে দাও…
দিনগুলো পাল্টে দাও…
সকলের থালায় আসুক ডাল ভাত আর তরকারি।

বিরোধীর মৌলিক মানবাধিকার আর তার যেই বিরোধিতাগুলো দৈনন্দিন আমারই বিকাশের স্বার্থে দরকার — এই কথাটা বাংলাদেশে, এই ২০১৯ ইসায়ির নজিরবিহীন নবনির্বাচিত মনোপোলি ডেমোক্র্যাসির বাংলাদেশে, কেউ গলা উঁচিয়ে এমনকি মিনমিনিয়েও বলতে পারবে? সেইজন্যে রাবণ হওয়া লাগবে, যে কিনা খ্যাতকীর্ত দশানন নামে।

নির্বিচারি নিধনের দিনগুলিতে গান
বিদ্রোহ করো ছেলেরা আমার
মেয়েরা আমার বিদ্রোহিনী
নিশানের রঙ যা-ইচ্ছে হোক
ভাবনায় হও স্রোতস্বিনী

স্রোতের মতোই বয়ে চলে গান
থামে না কোথাও এই জীবনে
তুমিও থেমো না প্রেমিকা আমার
গায়ে বিদ্রোহ মহুয়াবনে

কয়েক বছর আগে যখন জঙ্গলে জঙ্গলে মাওবাদীদেরে বেধড়ক খুন করা হচ্ছিল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে, একটি বিশেষ টেরিটোরি দিয়া ব্যাপক হারে নিধন চলে একটানা অনেকদিন, সুমন তখন এই গানটা এবং এর সঙ্গে অনেক গান বাঁধেন ও সুর করেন ও গেয়ে বেড়ান গনগনে আগুন এবং নির্যাতিত-নিহতদের প্রতি তীব্র মমতা আর মর্যাদা জানিয়ে। এই গানটা আমি শুনেছিলাম কোনো-একটা আন্তর্জালভিত্তিক গানসোর্স মারফতে। সেইটা হবে ২০১০। সাইটটা গানলাইভ  বা লাইভগানডটকম  বা এই-রকম কোনো নাম। এখন এইটা আর পাই না হাতড়ায়ে। সেইখানেই শোনা। ‘ছত্রধরের গান’ হতে পারে অ্যালবামটার নাম। বা ‘হুল’ হবে কি? কিন্তু সংকলন অনুসারে এখন আর গান শুনে কি কেউ?

সুমন তখন ভয়ঙ্কর ক্রোধান্ধ সময় পার করছেন। একেবারেই শিবক্ষ্যাপা। কালিক্ষ্যাপা। আকৈশোরের রাজনৈতিক বামবিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলেছেন। তৃণমূল ও মমতার ভোটের জন্য প্রত্যক্ষ লড়েছেন, জিতিয়েছেন, জিতেছেন। সুমন তখন সদ্য সংসদ-সদস্য হয়েছেন ইন্ডিয়ায়। ভাবা যায়! না, ভাবা যায় না। আর ভাবা যায় না বলেই শিগগির সুমনের প্রতিবাদক্ষুব্ধ প্রতিকৃতিতে পুনঃপ্রত্যাবর্তন। অব্যবহিত পরে ওয়েবসাইট লঞ্চ হয়েছে সুমনের। মাগনা প্রায় প্রত্যেকদিন নতুন গান শুনছি। কিংবা তার নিজের সাইট হবার আগে ইউটিউবে বেশ কতকগুলা গান-আবৃত্তি উইথ ভিশ্যুয়াল শুনে গেছি।  ভিডিওগুলো হ্যান্ডিক্যামেরায়। কিন্তু ওগুলো ক্রোধান্ধ বকাবাদ্যিভরা প্রতিবাদ-আয়ূধ, শুধুই খিস্তি আর খিস্তি, ঠিক সুমনোচিত কম্পোজিশন/রচনা না। কারণও ছিল ওইসব নগ্নকথনের। সুমনের পরিস্থিতি তখন কেমন যাচ্ছিল, অবোধগম্য নয় কারোর কাছেই। দীর্ঘদিনের লালিত ও পালিত ও আচরিত পোলিটিক্যাল প্রতীতি ফিক্কা মারছেন ছুঁড়ে, এইটা তো উন্মাদ দশার প্রত্যক্ষগোচর একটা কারণ।

মনে রাখতে হবে এইটা সেই সিচ্যুয়েশন, যখন একজন সৃজনশীল মানুষ তার সমগ্র সৃজনকাজের বিরুদ্ধে যেয়ে স্ট্যান্ড নেবার মতন পর্বতদেয়ালে ঠেকে গেছে। এমন যন্ত্রণাজান্তব সময় সবার পার করতে হয় না বলেই বাঁচোয়া। সুমনকে হয়েছে, ব্যক্তিজীবনে এবং সৃষ্টিজীবনে এমন দুঃসময় সুমনকে পার করতে হয়েছে আমরা দেখেছি, এবং বরাতজোরে সেল্ফডেস্ট্রাক্টিভ কোনো পন্থা না-নিয়েই তিনি সামলে উঠেছেন, ভালোভাবেই ফিরতে পেরেছেন ফের নিজের চরকায়। এখন তো উনি বাংলায় খেয়ালগানের কম্পোজিশন নিয়া মেতে আছেন মনে হয়। অ্যানিওয়ে। এইটা চাট্টেখানি কথা না। সারাজীবন যেই নিশানের জয়গান গাওয়া, সারাজীবন যেই লাল রঙের গানকীর্তন, তার বিরুদ্ধোচ্চারণ তো কম মকদুরের কথা না। রাজনৈতিক তীব্রতার দিক থেকে বাংলা গানসৃজনে সবচেয়ে সফল ভাষ্যকারদের মধ্যে একজন কবীর সুমন খোদ ভিত্তিমূলেই শিফ্টিং ঘটিয়ে নিতে চলেছেন, এর ফলে তার কাজের ব্যাপক বহর ভেস্তে যায় কি না, ব্যাহত হয় কি না সুমনাবয়ব তার অডিয়েন্সের কাছে, ধসে যায় কি না তার কন্ট্রিবিউশন তথা তার দুর্ধর্ষ মৌলিক গানক্যারিয়ার, এই নিয়া আমরা যারা শঙ্কিত ছিলাম তাদের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ হলো অচিরাৎ।

প্রমাণ হলো আরেকটা ব্যাপার, সেইটে এ-ই যে, সুমনের এ-যাবৎ কবিতাগানাবাজানা সাম্প্রতিকতা লতিয়ে এগোলেও মর্মমূলে এরা অনেক বেশি বিস্তৃত সুদূর। কন্টেম্পোরারি ইভেন্টগুলো সুমনের গানে বক্তব্যভাব বহনের একেকটা বাহন মাত্র, মর্মশাঁস নয়, পোলিটিক্যাল নোশন কখনোই সুমনগানের অনিবার্য-অবধারিত উপাদান নয় যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেসব গানকর্ম প্রসঙ্গসূত্র হারাবে। এইটা তো প্রমাণ হয়েই গেল, মনে হয়, একজন শিল্পী নিজের জীবনে এইটা পরখিয়া যাইতে পারাটা তো সর্ব-উচ্চ সৌভাগ্যশক্তির ব্যাপার। সুমন এইটা পারলেন। না, পোলিটিক্যাল কারেক্টনেসের কথা বলা হচ্ছে না এখানে। সেইটা, কারেক্টনেস, আলাদা বাতচিতের টপিক। বোরিং, সাপোজড টু বি, রাইট নাউ। সুমনের লাইফটাইমেই তো লাল পাল্টাল, তবু তার গানের মূল অংশটা দাঁড়িয়ে আছে যে-লালের বর্ণাবলেপে সেইটা প্রাসঙ্গিকতা হারাল না। তার মানে এইটাই কি নয় যে সুমনের লাল আর সিপিএমের লাল অভিন্ন প্রতিভাসিত হইলেও উহা অভিন্ন নহে? সেইটাই তো। “দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বচ্ছ জল” এই গানগুলো, উজ্জ্বল সেই বিনয়মৎস্য শ্রোতারা এর, যদিও মনে হচ্ছিল এতদিন ধরে যে এইগুলো তো অধিকাংশত সিপিএমরেড। ভুল হলেও মনে তো হচ্ছিল।

ওয়েল, আচ্ছা, লালের দৃশ্যত অর্থদ্যোতনা দিয়া সুমনগান বিচারের পথ রুদ্ধ না-হইলেও দুষ্কর ও কঠিন হইয়া উঠিল বৈকি। কিন্তু রক্তের যে-ডাক, ‘প্রথম মায়ের চুম্বন হয়ে’ যে বাঁচার আকুতি গিনিপিগসাইজের বিস্ময়কর মানুষগুলোর, নানান বরন গাভির ওলানে যে একই বরন দুধের বান, সমুদ্রোত্থিত এককোষী অ্যামিবা হইতে ক্রমে যে-রক্তঢাকদ্রিমিদ্রিমি, কবীর সুমনের লিরিকে লেপ্টে আছে এই লাল, ছোপছোপ এই রক্তপ্রস্রবণ, শাশ্বত এই চালিকাশক্তি। সিপিএমঝাণ্ডা বা টুপিটাপাডাণ্ডা প্রভৃতির বাইরে বেরিয়ে এই গান আপনাকে-আমাকে বিচারিতে হবে। আজ হোক, অথবা আগামীকল্য, পরশু হয়তো-বা। লাল কোনো জিপ কিংবা গাড়ি না-জুটলে স্রেফ পদব্রজে হেঁটে বেড়াবার কালে এই গান নিয়া না-ভেবে নিস্তার নাই আপনার। গান গাইতে পারলে তো উত্তম, না-পারলে এইধারা এই নিবন্ধকারের ন্যায় ভেবে ভেবে সারা। তা সে-যা-হোক, গাইতে পারুন বা না-পারুন, গান ছাড়া জিন্দেগি সিরিয়্যাল এক গঞ্জনা ব্যতীত তো অন্য কিছুই না।

তারপর একসময় এই গানটা, এবং এর সঙ্গে আরো কয়েকটা ভালো ও পূর্ণাঙ্গ সুমনোচিত সুরকাজ-কথাকাজ শুনে উঠি। তার মধ্যে একটি ছিল ‘পিঁপড়ের ডিম’, মনে আছে, আরেকটি এই ‘গায়ে বিদ্রোহ’। শুরুতে এর কয়েকটা শব্দ এমনতর : “এ-বাদী বারণ ও-বাদী কারণ / সরকারি খুন আইনসিদ্ধ / যৌথবাহিনী রাষ্ট্রকাহিনি / রাষ্ট্র মানেই অপাপবিদ্ধ” … পরের লাইনটি ছিল বোধহয় ‘মাও যদি নাও হবে গ্রেপ্তার’ ইত্যাদি। কিন্তু স্তবকের বাকিটুকু আর মনে নেই। কিন্তু ওই মাওবাদী নিধনের সময়টায়, গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির হাতে মুসলমানকিলিঙের সময়টায়, ইন্ডিয়ায় এক এই কবীর সুমন আর দুই ওই অরুন্ধতী রয় ছাড়া আমদের কানে এসে পশেছিল কি আর-কোনো গণতন্ত্রবাদী নিরপেক্ষধর্মধ্বজাধারীদের কণ্ঠ?

পুরো লিরিক কিছুতেই মনে পড়ছে না এখন। মাঝখানের একাংশ মনে পড়ল। উপরে সেটুকু ঝুলিয়ে রেখেছি। কিন্তু পরের কয়েক লাইন উঠছে-পড়ছে মনে। যেমন একটা চাকমা ছেলের রেফ্রেন্স আছে এই গানে, যে-ছেলেটা ঢাকায় থাকে, এই তথ্য সুমন সুরে-সুরে গেয়েই দিচ্ছেন জানিয়ে, যে-ছেলেটা সুমনকে সেইসময়কার মাওবাদী সন্দেহে সরকারি ধরপাকড় ও এনকাউন্টারে গণহত্যাখুন বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল (অত্র তল্লাটে যেই জিনিশটা ক্রসফায়ার বলিয়া সুচিহ্নিত, ক্রসফায়ারযুগের পরে আমরা আধুনিকতর গুমযুগও উপহার পেয়ে গেছি অবশ্য), মতামত জানিয়েছিল নিজের, সুমন সেই স্মৃতি গানে রেফ্রেন্স হিশেবে টেনে আনছেন : “চাকমা ছেলেটা বলেছিল মাও / পড়েছেন মার্ক্স্ বহুব্যাখ্যার / তার কাছে মার্ক্স্ মানে একটাই / বিদ্রোহে আছে ধ্রুব অধিকার” — এরপরের লাইনটা বহু কসরতেও মনে পড়ছে না কেন-যে — এর ঠিক পরের স্তবকে বলা হচ্ছে, “চাকমা ছেলেটা ঢাকায় থাকে / কি করে জানবে ছেলেটা আমার / সুমনের গান গাইছে তাকে” — এই গানের লিরিকটা আজ-পর্যন্ত অনেক খুঁজেও সুরাহা আর করা যাইল না। ‘নাগরিক কবিয়াল’ আর্কাইভে নেই, কিংবা তার ফেসবুকপিঠে, ‘কবীরসুমনঅনলাইন’ তো মুখস্থ সম্পূর্ণ, ওখানে কোথায় কি আছে না-আছে সবই তো আপনার-আমার নখদর্পণে, তাই না? সো, হোথা নাই। কিন্তু কয়েকবার হেঁড়ে গলায় গাইতে পারলে একটা আশা ছিল মনে পড়িয়া যাইবার। রুটিরুজিব্যস্ততা আর রাত্রিনৈতিক কতিপয় অন্তরায় থাকার কারণে এতদবর্তমানে তাহা না-মুমকিন। অচিরে স্কন্ধ হইতে বোঝাটা নামাইতে পারলে বেশ মনে-পড়ানোর কোশেশ করা যাবে।

অ্যানিওয়ে। হ্যাপা তো কম নয় এই জীবনযাপনের। ম্যালা শাকের বোঝা, শাকের বোঝা সাঙ্গ হইলে কান্ধে চাপে আঁটির বোঝা, আমরা তো জীবন বলতেই বুঝি ভাদ্রমাসের রইদে সেই গরুখোঁজা। কাজেই ড্রিম দেখি যে একদিন সুপ্রভাতে একটা বোঝাহীন স্যুয়িট য়্যুটোপিয়্যান লাইফ লিড্ করা স্টার্ট হবে। সেই লাইফের শেষ বলে কিছু থাকবে না। বাহ্! ভালো তো, না? ভালো, ভালো। দর্পণে দ্যাখো ওই য়্যুটোপিয়্যান জিন্দেগানির ঝলমলে আলো।

সুর শুনি নাই কিন্তু বাণীটুকু শোনা
এমনিতে যারা দিব্যি বলেন বাঙালি আর মুসলমান
অমনি তারা গম্ভীর মুখে কুরুক্ষেত্রে হাঁটতে যান

বাপ রে বাপ! এইটা একটা গানের লিরিক, মায়েস্ত্রো কবীর সুমনের, গানটা গাওয়া কেমন করে তা আমি শুনি নাই। কিন্তু কবীর সুমনের আর-দশটা গানের ন্যায় এইটাও ডুগডুগি বাজায়ে নেত্ত করার বাঁদরবাদ্যি-যে নয় এ-কথা বারবার না-বললেও হয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গানের টেক্সট থেকে সুরের পালক ছেঁটে পড়তে গেলে দেখবেন যে নেতিয়ে পড়ছে কথাগুলো, মুর্গির ন্যায় ঝিমুচ্ছে নয়তো, সুমনের গানবাণীমঞ্জরি স্রেফ পাঠকৃতি হিশেবে বাংলা গানের পূর্বতন কারিগর যে-কারো তুলনায় ঢের বেশি সফল ও সমর্থ। নিচে সেঁটে দেয়া গানটা, সুরযোজিত কি না তা জানা নাই, টেক্সট আকারে উপস্থাপিত এর শিরোনাম ‘সংস্কৃতি’। এতদবিষয়ে পাঁচ-সাতটা মোটাগাট্টা প্রবন্ধ লিখেও এই ছিপছিপে লিরিকে ব্যক্ত কথাগুলো পূর্ণত বলা সম্ভব কি না সন্দেহ। এইরকম একটা লিরিক পয়্দাইতে পারলে লেখক-সংস্কৃতিচিন্তক-কবি ইত্যাদি ডিগ্রি হাসিলের হ্যাংলামি নিষ্প্রয়োজন।

সত্যিই তাই, এরপরে এতদপ্রসঙ্গে তেমন বলবার কিছুই নাই। এরপরে, মানে, এ-গানখানা আস্ত পড়া বা শোনার পরে। কাজেই যা বলার তা আগেই বলি। বিচিত্রানুষ্ঠান হতো ওয়ান্স-আপঅন-অ্যা-টাইম আমাদের পাড়ায়-মহল্লায়, ইশকুলের বার্ষিক ক্রীড়া সমাপনী দিনের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, জাতীয় দিবস উদযাপনী ইভেন্টে। সেইসব অনুষ্ঠানে একটা কমন ফিচার ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। তার আগে দিয়া বাধ্য করা হতো ঘণ্টাতিনেক ব্যাপিয়া স্যারদিগের জ্বালাময়ী চিৎকৃত বক্তৃতার পূর্ণভাগ শ্রবণ না-হলেও উপস্থিত রহিতে। এমনিতেই কিন্তু স্কুলকম্পাউন্ড ছাড়িয়া যাইতাম না আমরা, আশেপাশে একটু ওইকালীন গার্লফ্রেন্ডদিগের সম্মুখসারি দিয়া কামনাকরুণ উদাস-উদ্বাস্তু মুখচ্ছবি ধারণপূর্বক সম্প্রসারণ-সম্ভাবনাব্যাকুল ব্যঞ্জনাবাদ্যভরপুর প্রতিকৃতি নিয়া হাঁটিয়া-চরিয়া ফিরিতাম নিজের মতো, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ওয়েইট করিতাম। একসময় এসে কর্ণে পশিত শতপ্রতীক্ষার সেই হ্যালো-মাইক্রোফোন-টেস্টিং-ওয়ান-টু-থ্রি এবং অবধারিত তবলা-হার্মোনিয়্যম। মহল্লামঞ্চে এবং ইশকুলঅ্যানুয়ালে গিটার-কিবোর্ড উঠেছে একদম শেষবছরে, মেট্রিক পরীক্ষার আগে আগে, ড্রাম লাইভ বাজাইতে দেখেছি একটা গায়ে-হলুদে খেপ-মারা ব্যান্ডের প্রোগ্র্যাম যখন আমরা আমাদের পাড়ার সিনিয়র ভাইদের ব্যাকিং নিয়া আয়োজন ঘটাতে সমর্থ হই। ডিফ্রেন্ট টাচ   তখন তুঙ্গে। এছাড়া মাইলসঅবস্কিউর  ও নোভা   মারাত্মকভাবে তখন আমাদের মা-বাবা-কাকাদের অপসংস্কৃতি সম্পর্কে দুশ্চিন্তিত করে তুলেছিল। ফিডব্যাক   ছিল, চাইম   তো পাড়ার প্র্যাক্টিস্-ব্যান্ডগুলোর পছন্দশীর্ষ হয়েই ছিল তাদের ‘জয় জগানন্দ’ ও ‘কালো মাইয়া’ নাম্বার দুইটার জন্য। যত-যা-ই-হোক, অনুষ্ঠান শুরু হতো ব্যতিক্রমহীনভাবে ডিফ্রেন্ট টাচ  দিয়া, কাঁপুকাঁপু কুয়াশাঝাপসা শীতরাতে ম্যারাপ-ছাড়া খালি-ও-খোলা আসমানতলে জামগাছ হইতে থেকে-থেকে তার শরীর-শিহরা শিশিরপাত, আর ওইদিকে মেস্মেরাইজিং শ্রাবণের মেঘগুলি ক্ষিপ্রগতিতে গিটারের রিফ জুড়ে এসে জড়ো হওয়া শুরু করে দিয়েছে। এই গানটা আমাদের জীবনে এত অঙ্গাঙ্গী মিশিয়া আছে যে এ নিয়া আলাদা সালিশি-বিচার বসানো দরকার পড়বে একদিন। যখন হবার তখন হবেনে, এখন থাক।

তো, কথা হলো যে, এমন তো দুম করে একদিনে হয়নিকো। কবীর সুমন সহসার ঘটনাব্যাপার নয় তো! সহসা হেন সংস্কৃতিবিচার সম্ভব কোনো সংস্কৃতিবিলাসী সেবায়েতের পক্ষে? নেভার। সেই প্রথম থেকেই সুমনজি কাজটা আপন কাঁধে তুলে করে আসছিলেন, আমাদের চোখের সামনেই তো ঘটল সবকিছু, সুমনের বিকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তার প্রত্যেকটা স্টেপিং আমরা নজর করে দেখেছি। এমনটা আর কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি আমাদের লাইফে। তিনি তার লিরিক্স দিয়ে এভরি স্টেপে আমাদিগেরে তীক্ষ্ণ মনোনিবেশে বাধ্য করে নিয়েছেন। মনে করে দেখুন সেই প্রথমাবধি সুমন বাংলা আর বাঙালির সাংস্কৃতিক ভণ্ডামি নিয়া নিরবচ্ছিন্ন সোচ্চার তার গানে। সেই কলকাতার তিনশ বছর পূর্তিতে গাওয়া গান : “তিন শতকের শহর তিন শতকের ধাঁধা / সুতানুটির পারে নেমে এল সাহেবজাদা”, যেখানে একজায়গায় যেয়ে এমন লাইন যাবে পাওয়া : “নাভির নিচে শাড়ি ইটের নিচে ঘাস / সংস্কৃতির নিচে পড়ে নববধুর লাশ” ইত্যাদি। কিংবা নিজেকেই-যে তার উপর্যুপরি হ্যামারিং গানের-পর-গানে, সমস্ত অনাসৃষ্টির মূলে নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করা, নিজেকে নিয়ে ভেংচি কাটা, নিজেকেই নিজে জিভ-ভেংচানো, ভণ্ড বলা বারবার নিজেকেই নিজে, এই জিনিশ বাংলা গানে একবর্ণও ছিলনাকো, ঘুণাক্ষরেও ছিল না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সাহস ও সাধ্যিসীমার বাইরে, একলাফে এসে হেমাঙ্গ-সলিল-ভুপেন-মান্না খাড়া করানো হলে তখন বলতেই হবে হেঁড়ে গলা উঁচায়ে আপনেরে যে এমনটা উনাদের কল্পনাতীত ছিল। উনাদের কাজ উনারা করেছেন, সুমনের কাজ সুমন। আলগা শ্লাঘার কিছু এইখানে নেই। সে-যাকগে। এইসব বলবার যোগ্যতর লোক দুনিয়ায় ঢের না-হলেও কয়েক ডজন তো অবশ্যই মিলবে। আমরা সামান্য লোক, গানভুক, আমাদের শুকনো কথায় নিগূঢ় সুরের ব্যবস্থা হোক। ব্ব্যাস, আর কি চাই! আমরা সংস্কৃতি  হই কিংবা মুসলমান,  আমাদেরে নিয়া আপনারা দাগাইয়া যান হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কিতাবের পাতার-পর-পাতা, আমরা এই ফাঁকে একটু চুরটে দেই দুইটা দম আর গাই গান আরও একটা।

কবিতাটা, বা গানটা, বা আর্টিক্যলটা নিম্নরূপা :

মাতৃদেবী ‘সংস্কৃতি’, আম্মা তুমি মুসলমান,
সংস্কৃতির ধারকরা সব গম্ভীর মুখে হাঁটতে যান।

স্বামীজিরা ‘সংস্কৃতি’, মৌলানারা মুসলমান,
সংস্কৃতির ধারকরা সব গম্ভীর মুখে হাঁটতে যান।

উপনিষদ ‘সংস্কৃতি’, কোরান হলো মুসলমান,
সংস্কৃতির ধারকরা সব শান্তিমিছিলে হাঁটতে যান।

জল বলাটা ‘সংস্কৃতি’, পানি বললেই মুসলমান,
সংস্কৃতির ধারকরা সব গম্ভীর মুখে হাঁটতে যান।

চাটুজ্জেটা ‘সংস্কৃতি’, কবীর সুমন মুসলমান,
সংস্কৃতির ধারকরা সব গম্ভীর মুখে হাঁটতে যান।

ঘোমটা তুমি ‘সংস্কৃতি’, বোরখা তুমি মুসলমান,
সংস্কৃতির ধারকরা সব কুরুক্ষেত্রে হাঁটতে যান।

এমনিতে যারা দিব্যি বলেন বাঙালি আর মুসলমান,
অমনি তারা গম্ভীর মুখে কুরুক্ষেত্রে হাঁটতে যান।

নিত্যযাপন ও সুমনগান
লাশকাটা ঘরে তানপুরা নিয়ে অতএব গলা সাধি …

কবীর সুমন এই কাজটা করে গেছেন অনবচ্ছিন্নভাবে, এই নিত্যযাপনটাকে লেখায়-সুরে ধরা, এখনও রোজ করে চলেছেন অনলস অবিরাম। এই সত্তর-অতিক্রান্ত বয়সেও তরুণ প্রজ্ঞায় তীক্ষ্ণ ও প্রতিভাস্পর্ধী টানটান! রোজকার রাজনীতি আর মনুষ্য সংসারের চালচিত্র সুমনের গানে এতটাই ভিতর্মহল সহ ধরা থাকল যে এর সঙ্গে তুলনীয় উপন্যাস-গল্প-কবিতাও বাংলায় ঝটপট বের করে দেখানো মুশকিল হবে। জেমস্ জয়েসের একটা ছোটগল্পসংকলন আছে ‘ডাব্লিনার্স’ নামে, সেখানে বিশ-শতকের আইরিশ মিডল ক্লাসটাকে এমন অনুপুঙ্খসমেত দলিলায়িত করা হয়েছে এবং এমন কায়দায় যে বলা হয়ে থাকে ডাব্লিন নগরী ডেস্ট্রয়েড হয়ে গেলেও জয়েসের ‘ডাব্লিনার্স’ অনুসরণ করে ফের ডাব্লিন নগর রিনোভেইট করে নেয়া যাবে। ভণ্ডামিডুবন্ত বাঙালিকে কেউ যদি পুনরুজ্জীবিত নতুন পৃথিবীতে শত্রুতাবশত পূর্বদশায় ফেরায়ে নেয়ার ব্লুপ্রিন্ট করতে প্ল্যান কষে, সুমনের গান ফলো করে সে সুচারু সেই দুষ্কর্মটা সাধিত করতে সফলকাম হবে। এতটাই তীক্ষ্ণ তুলিতে এঁকেছেন সুমন ভণ্ড বাঙালির মানসচিত্র ও পঙ্কিল ইন্টেলেক্ট।

নিত্যযাপনটাকে ফেসবুকযুগে লাখে-লাখে লোকেও তো ধরছে, স্ট্যাটাস দিচ্ছে আদাজল খেয়ে এর বিরুদ্ধে ও, ওর বিরুদ্ধে সে, এবং হিংসার ছুরি বানানো ও ছুরিকা শানানোর পেশায় বিস্তর ইনভেস্ট করে চলেছে সময় ও সংঘশক্তিমত্তা তারা। কামিয়াবও হচ্ছে কেউ কেউ, যশ-প্রতিপত্তিও জুটিয়া যাচ্ছে মারহাব্বা, অনুজের ভালো কাজটাকেও সমীহ করার উদারতা নাই বিচ্ছু ও অল্পসমর্থ অগ্রজের আচরণে। এ-ই ইন্টেলেকচ্যুয়্যল চর্চা সাম্প্রতিক, এ-ই আমাদিগের অধুনা আর্স পোয়েটিকা। আর আমার পাছায় ম্যাস্যাজ করে যাও তোমরা সবে, খালি আমারেই করো, ওর পাছায় বেবিঅয়েল-লোশন লইয়া লাইন লাগাইয়া অনাসৃষ্টি ঘটাইতেছ ক্যান! এ-ই সিচ্যুয়েশন, সংক্ষেপে, ডক্যুমেন্টেশন অফ আওয়ার নিত্যযাপন। এইটেকে ধরার নতুন রাডারওয়ালা পাব্লিক আবশ্যক এখন। সংগীতে, সাহিত্যে, এবং সর্বত্র।

সুমনের স্পেশাল ফিচার হলো, সুমন ডোবানালার নোংরা পানিটাকে ইথিয়োপিয়া-নিকারাগুয়ার জলাশয়ের সঙ্গে মেলায়ে দেখতে পেরেছেন, অন্ত্রবহুল পাকস্থলির মতন সর্পিল কলকাতাসরণির সঙ্গে ওয়ালস্ট্রিট ও মধ্যপ্রাচ্যপথের পেট্রোডলারভাসা রাস্তাঘাটের সঙ্গে এক-সমান্তরালে রেখে রিডিং নিতে পেরেছেন। রেয়াত দেন নাই কাউকে। তার গানে। তার লিরিকে। তার সুরে। তার কথোপকথার ন্যারেটিভে। এমনটা আগে হেরি নাই আমরা এত তীব্র ও সর্বাগ্রাসী নির্বিরতি করে যেতে কাউকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথও যখন লিখতে বসেছেন, মোটামুটি ইমেইজটা খানিক দাঁড়িয়ে যাবার পরে প্রাতঃস্মরণীয় রবিনের, সন্তসমাহিত একটা ভাব সতর্ক বজায় রেখেছেন। স্বদেশচৈতন্য ও জনজাগৃতিমূলক গান লিখতে যেয়েও রবিবাবু সন্তের জামাপাজামা ছাড়েন নাই। কিন্তু সুমন সাঁতরাতে নেমে নিজের কেশ যথেষ্টই ভিজিয়েছেন। স্যলিডারিটি-সংহতি-একাত্মতা প্রভৃতি প্রাগৈতিহাসিক ফার্স প্রকাশের বাইরে গেছেন অনেকানেক। নয়তো সুমনের গানবাজনা এতটা লাইভ হতো বলে মনে হয় না। আসলে সেইটাই তো। রক্তে দ্রবীভূত করে নিতে হয়। চিন্তাটা খানিক শরীরের শোণিতে ও শিরায় জারিত করে নেয়া চাই। সেহেতু সশরীর সক্রিয়তার দরকার অনস্বীকার্য। বোটে বসে, ফেসবুকে বা কাচঘেরা চাকুরিখানায়, এমনটা লাইভনেস্ প্যসিবল নয়কো।

সুমনের একটা গান নিয়া ভাবছিলাম। পার্টিক্যুলার একটা গানের পার্টিক্যুলার একটা ব্যাপার। ‘ভগবান’ সেই গান। পোলিটিক্সটাকে কেমন কৌশলে একটা য়্যুনিভার্স্যাল শেইপ-আপ দেন সুমন সেইটে এখানে শিক্ষণীয়। এক-ঝটকায় একটা ব্রড স্পেক্ট্রামে নিয়ে যাওয়া বীক্ষণটাকে। এইটা হামেশা দৃষ্ট সুমনগানে। যেই ব্যাপারটা ভাবছিলাম, সেইটা আসলে এই গানের স্যাটায়ার নিয়ে। এর টার্গেট অডিয়েন্স কে, কারা এর উদ্দীষ্ট অ্যাটাক-অব্জেক্ট, ভগবান নিশ্চয় নন? সুমন কেন ভগবানের ন্যায় নির্বিরোধ নিরীহ সন্তদরবেশেরে স্যাটায়ার করতে যাবেন সমস্তকিছু বুঝেজেনেও? ভগবান তো কোথাও কোনো সাতেপাঁচে নাই। ইহলোকজ্ঞানীরা এইটা জানবেন জরুর। কলকাঠি তো নাই তার হাতে, আল্লার হাতে, ছিলও না কোনোকালে। মেটাফর খুলে দেখতে শেখা তো চাই। ফলে ভগবান বা অন্য কোনো ধর্মবাদীর অলমাইটি সুপ্রিম বিচারপতি নিয়া গান লিখলে বা বই লিখলে, সেইটা কটাক্ষ হোক বা নিরীহ গোবাক্ষ/গবাক্ষ, ঈশ্বরকে/আল্লাকে/ভগবানকে/সদাপ্রভুকে নিয়া মানবসম্প্রদায়ের পক্ষে কটাক্ষমূলক/মর্তবামূলক কোনোকিছু বলা/লেখা ব্যাকরণত অসম্ভব। মানুষের সাধ্যির বাইরে এইটা। মানুষ আসলে মানুষেরে নিয়াই বলে/লেখে। স্যাটায়ার করে। গালিগালাজ করে। অ্যালিগোরি/মেটাফর হিশেবে একেকটা রিলিজিয়নের চিফ জাস্টিস আসেন বা যান। যারা রূপক-প্রতীকের খোসা ছাড়ায়ে দেখতে জানে না, তারাই তড়পায়। ব্যাপার হলো, দুনিয়ায় এখনো গরিষ্ঠাংশ পেটের অন্ন জুটাইতে যেয়ে রোজ রোজ নাকাল, মেটাফর নিয়া ভাবনাভাবনির তারা টাইম পাবে কখন? অতএব ডাইরেক্ট অ্যাকশন। অনক্ষর জনগোষ্ঠী এখনও সংখ্যাসাইজে বেশি। সবাই যদি সমান অনক্ষর হতো তখন দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। কিয়দংশ অনক্ষরেরও বাড়া। সাক্ষর তারা। মানে মহামুরুক্ষুর দল। মেটাফর তারা বাপের জন্মেও শোনে নাই। বোঝার আশা দাও জলাঞ্জলি। তদুপরি এরা ধান্দাবাজ, চুরিচামারি-রাহাজানি-চুগলখুরির সর্দার একেক দল, চালিয়াতির ইতিহাসচ্যাম্পিয়্যন টিম।

তো, ভগবানের জায়গায় আল্লা বসায়ে যদি এমনধারা অলমাইটি-গিল্টি-করা গান কেউ গায়? হ্যাঁ, এইটা একটু ভাবনাচিন্তার ব্যাপার। কপিরাইটের মামলা। ব্লাসফেমি বাদই দিলাম। তবে একটা কথা আমি নিজে এখানে উদাহরণ না-দিয়া আপাতত তথ্যাকারে রেখে যাই যে এমন গান ওই চিফ জাস্টিস নিয়াও দুর্লভ নয়। বাউলদের পদে, বা ফকিরি ধারার গানে, এমন নজির অনেক রয়েছে। ব্যাপারটা হলো, শ্রোতা/পাঠক শুধু প্রতীক-রূপক খসাতে জানে না বললেই তো হবে না, কাব্যিকারেরা/গানমহাজনেরা/প্রাবন্ধিকেরা কেমন করে মেটাফরাইছেন, কতটা কাব্যসত্তা আর বুদ্ধিমত্তা আর ইতিহাসজ্ঞান খর্চে, সেইটাও বুইঝা নিও উস্তাদ! যত দোষ নন্দঘোষ জনরুচি আর জনগণ আর বেচারা ধর্মান্ধের, না? ব্যাপার অত সোজাসাপ্টা না। ব্যাপার স্পাইরাল। অন্ধ বলে তারে তুমি আলো দিবা না? আলোর জন্যই তো কবিতা, গান, মেটাফর। চুদুরবুদুর বিনোদন ও ঘুরায়েপ্যাঁচায়ে অনুজেরে গাইলাইবার লাইগাই কি কবিতা-গান-গল্প ও এই দুনিয়া পয়দাইসি আমি? স্নিগ্ধ সুরৈশ্বর্যমণ্ডিত ঝলমলে মুখ ম্লান করাই কি কবিতার একমেবাদ্বিতীয়ম কম্ম? কব্বরে যেয়েও ষণ্ডামো করো? ওই জন্যই তো সুমনের গান। শোনো সুধীজন, শোনো প্রিয়জন! — ওইটা আবার আরেক কাজির। মহীনের ঘোড়াগুলির। মিডিয়াহাইপ-তোলা সম্পাদনা না। গৌতম চ্যাটার্জিকে চেনেন না এমন কোনো অভাগা বাঙালি কি সুলভ যে গত বিশ-বছরকালের ভেতর বুড়ো হয়েছে, ডেইট-এক্সপায়ার করেছে আমার ন্যায়? ট্রেস-আউট করা সহজসাধ্যি না। কানে কানে বলি, কবীর সুমন কিন্তু মহীনের ঘোড়াগুলি হারাম সইতেই পারেন না। তা, শুধু মহীনের কথাই বলি কেন, কবীর সুমন দুইচক্ষে দেখতে পারেন না বাংলার মৃত কিছু গানবাজনা ছাড়া জ্যান্ত কিছুই, নিজেকে ছাড়া আর-কিছুরেই তিনি ধর্তব্য মনে করেন না। আর, কানের লতি চিমটে এক-দুইজন বুজুর্গের নাম নেয়া ছাড়া আর-সবকিছুই উপহাসযোগ্য তার কাছে, তিনি ছাড়া ধরাধামে নাই আর কেউ। বটে!

সেই গান, সুমনের, ঘুমোও বাউণ্ডুলে   অ্যালবাম ১৯৯৫ থেকে, ভগবান,  ইজ গিভেন বিলো :

ভগবান কত ভালো
অপরের চোখ অন্ধ করেও আমাকে দিলেন আলো।।

ভগবান কত মিষ্টি
পণ্যখামারে আগুন জ্বেলেও আমাকে দিলেন বৃষ্টি।।

ভগবান কত ফর্শা
কালো মানুষকে মারবেন বলে শাদাকে দিলেন বর্শা।।

ভগবান কত কালো
কালো মানুষের ছুরিটা কালোরই তলপেটে চমকাল।।

ভগবান কত লক্ষ্মী
মরছে মানুষ এ-খবর টের পেল না তো কাকপক্ষী।।

ভগবান কত সুন্দর
জঙ্গিবিমান ধ্বংস করল শান্ত বিমানবন্দর।।

ভগবান আশাবাদী
লাশকাটা ঘরে তানপুরা নিয়ে অতএব গলা সাধি …

সুমন ও সারথীরা
ভারতীয় বাংলা গানে অঞ্জন ও নচিকেতা বা আরও যারা যারা গানটা গাইতে এসেছেন মুখ্যত কবীর সুমনের পথ ধরে, সুমনের সফলতায় প্রাণীত হয়ে, এবং সুমনগানের আধুনিক গীতরচনা আর সুরবাঁধা ব্যাপারটা একটা ধারাই তো হয়ে ওঠে অচিরাৎ। সেই ধারা নিয়া ডামাডোল তো কম হয় নাই, বিচিত্র উপায়ে হেয় করার ধারাবাহিক কাণ্ড সচল থাকতে দেখেছি আমরা টানা প্রায় দেড় থেকে দুই দশক, কিছুতেই নিশান অর্ধনমিত হয় নাই অবশ্য স্বাধীন সার্বভৌম নতুন বাংলা গানের। শরিক হয়েছেন এই নিশানের গোড়ায় বাংলা গানের তরুণ মেধাবী সমস্ত কারিগরেরা, শামিল হয়েছেন শ্রোতারা, বাজার ও বিপণনব্যবস্থাও ক্রমে এই ধারাটাকে সমঝে চলতে শুরু করে। এইচএমভি   ও আশা   নাম্নী দুই ইন্ডিয়ান গানকোম্প্যানি, এবং আরপিজি   ইত্যাদি, একের-বাদে-এক অনেকানেক নবীন গান-করিয়ে শিল্পীকলাকুশলী সামনে নিয়ে আসার রীতিমতো প্রকল্প গ্রহণ করে এই সময়টাতেই। সুমনের ‘তোমাকে চাই’ ইনকন্সিভ্যাব্লি হিট করার পর নচিকেতার ‘চল যাব তোকে নিয়ে’, অঞ্জনের ‘পুরনো গিটার’, মৌসুমী ভৌমিকের ‘এখনো গল্প লেখো’ বা তার আগের ‘তুমি চিল হও’ প্রভৃতি প্রকাশিত হতে থাকে একঝাঁক পায়রার ন্যায় পাখসাট তুলে এবং প্রত্যেকটাই একেকটা পতপতে পতাকা বাংলাগানের পাল্টানো সময়পর্বের।

এরপর অসংখ্য নতুন গান, নতুন সুর, নতুন ভঙ্গি, নতুন ভাষা গানে গানে পেয়েছি আমরা হাতের চেটোয়। সেইসব দিন আজ কেমন সুদূরের, অন্য কোনো জন্মের, অন্য সময়ের বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। একসঙ্গে এত নতুন গাইয়ে, এদের প্রত্যেকেই যার যার মতো করে নিজের সেরা কাজটা দিয়েছেন উজাড় করে, এমন হয়েছিল অনুমান করি এর আগে একবার মাত্র এবং সম্ভবত সেই সময়টাকে আমরা বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলে থাকি। ইন্ডিয়ান বাংলা গানের স্বর্ণযুগ ছিল ওইটা। ছায়াছবিবাহিত হয়েই এসেছিল ওই সোনাদানা। বাংলাদেশের ব্যাপারটা ব্যান্ডসংগীতে যেমন স্বর্ণখচিত হয়েছে, তেমন নজির অন্তত পঞ্চাশছোঁয়া স্বাধীন বাংলাদেশখণ্ডে এর আগে বের করা সাধ্যাতীত হবে এইটা সহজেই অনুমেয়।

স্বর্ণযুগ বলতে যে-সময়টা ভারতীয় বাংলা গানে চিহ্নিত, সলিল চৌধুরী থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য বাগগেয়কার ওই সময়েই আবির্ভূত। সুমন ও সুমনানুসৃত সুরের-কথার-ভাবের-ধারার বাংলা গান তুলনামূলকভাবে সেই চিহ্নিত স্বর্ণযুগের চেয়ে কতটুকু কোয়ালিটেইটিভলি আলাদা, কোথায় এবং কেমন করে আলাদা, এ নিয়ে এখন আস্তে আস্তে ভাবনাভাবনি নিশ্চয় শুরু হবে। এইটে শুরু করা জরুরিও মনে হয়। কেননা আবার এসে গেছে একটা স্ট্যাগ্ন্যান্ট কালসন্ধ্যা বাংলা গানে। কেমন চর্বিতচর্বন আর বৃত্তঘূর্ণিপাক পুনরায়। এমনিতে সুমন অবশ্য তার স্বীয় কক্ষপথে এখনও সচল ও ফলিয়ে চলেছেন স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশন, অঞ্জন যদিও ম্যুভিডিরেকশন ও অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত ও সফল, নচিকেতা অ্যালবাম করছেন না অনেকদিন, কোথাও হয়তো-বা ভারতীয়া বাংলা গানবাজনা আরেকটা ডিপার্চারের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

অঞ্জন কখনো গোপন রাখেন নাই ঋণ তার। গুরুদক্ষিণাকার্পণ্য অঞ্জনের মধ্যে দেখি নাই আমরা। অ্যালবামে ১০টা গান থাকলে একটা গান অবশ্যই রাখতেন অঞ্জন তার তরুণদিনের পথ-দেখানো সংগীতকম্পাস সুমনকে ট্রিবিউট জানিয়ে। এ-পর্যন্ত প্রকাশিত অঞ্জনের অ্যালবামগুলোতে এই ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়নি। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে, সুমনের ডেব্যু অ্যালবামের অব্যবহিত বছর-দুয়েকের মধ্যেই অঞ্জন শুরু করেছেন, বয়সেও খুব-যে আকাশ-পাতাল ফারাকের এমনও তো নয়, একজন সদ্য সিক্সটিওয়ানে স্টেপডাউন করেছেন ও অন্যজন পাড়ি দিয়েছেন সিক্সটিসেভেন, বছর ছয়ের ব্যবধান সাকুল্যে, এইটুকু তো অলমোস্ট সমানবয়সী, কাজেই অঞ্জন অবলীলায় চেপে যেতে পারতেন অনুপ্রেরণাঋণ। অঞ্জন করেননি তা, অ্যালবামের পর অ্যালবামে স্মরণ করেছেন নিজের জীবনে এবং একইসঙ্গে নতুনদিনের বাংলা গানের জীবনে সুমনের অবদান। তখন তো অঞ্জন যেমন, সুমনও নবীন গানশিল্পী। মিডিয়ামাদারির খেলায় বাংলা গানের লেবেল কখনো সমাজবদলের গান কখনো জীবনমুখী ইত্যাদি অংভং নানাকিছু সাঁটা হচ্ছিল, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এইগুলোকে আধুনিক বাংলা গান বলে পরিচয়দানে রাজি হচ্ছিলেন না বাংলাগানবোদ্ধা বিকট পণ্ডিতেরা। কারণ অজানা হলেও অননুমেয় অবশ্য নয় এই স্বীকৃতিকৃপণতা। তার মধ্যে একটা হলো, অনুমান করি, সুমন ও তৎস্রোতের নতুন গানবাজনা আধুনিক বলিয়া আখ্যায়িত হইলে এতকালের স্বর্ণযৌগিক হিমাংশু-ভুপেন-সন্ধ্যা-মান্না-হেমন্ত-হৈমন্তী প্রমুখের তরফদারি-করে-বেড়ানো বোদ্ধা গানালোচক-গানবেনেদিগেরে গোল্ডেন এইজের নিউ অরিয়েন্টেশন এক্সটেন্ড করা জরুরি হয়ে পড়বে। কেঁচে-গণ্ডুষের ভয়েই হয়তো উনারা প্রাণপণ রেজিস্ট করতে চেয়েছেন নতুন ও জেন্যুয়িন শিল্পস্রষ্টার অনুপ্রবেশন। যদিও জয় শেষতক, দুনিয়া ও আখেরাতে, বর-পাওয়া বীণাপাণির ক্যান্ডিডেটের। সুমন তো, অঞ্জন ও তার সতীর্থ সহযাত্রীরা তো, মঞ্জিল-এ-মকসুদে পৌঁছাবেনই।

“নানা কথা নানা সুরে / গান নিয়ে ঘুরে ঘুরে / সুমনের কাছে এনে দিয়েছে / এই বুড়ো পুরনো গিটার” — ডেব্যু অ্যালবামের নামভূমিকার গানে এই ছিল অঞ্জনের কনফেশন। অন্য কয়েক গানেও, ‘পুরনো গিটার’ অ্যালবামে, ছিল সুমনের উল্লেখ। সুমনের গানের রেফ্রেন্স অঞ্জনের প্রায় সমস্ত সংকলনেই আছে। যেমন ‘ক্যালসিয়াম’ গানটায় : “সুমন বলছে পারো যদি / অন্য ছবি আঁকো / অঞ্জন বলছে টিভি দেখো না” … ইত্যাদি ইত্যাদি। তদ্দিনে সুমনের সেকন্ড ভেঞ্চার ‘বসে আঁকো’ মুখ দেখে ফেলেছে আলোর, লভেছে বিপুল সমাদর আমাদের ন্যায় শ্রোতাদের, মিডিয়ার যথাপূর্ব মুখভেংচানো। অঞ্জনের প্রথম সংকলনে একটা আস্ত গান ছিল সুমনকে নিয়ে। সেই গানটা ব্যালাডধর্মী, দীর্ঘ, বর্ণনাত্মক। স্মৃতি খুঁচিয়ে বের করে এনে এইখানে বসাই কয়েকটা লাইন সেই গানটার : “তোমার কথা শুনতে ভালো লাগে / অনেকেই বলে / শোনায় তোমার কথা আমায় প্রায় / তাই শুনলাম তোমার কথা / গান শোনার ছলে / শুনলাম তোমাকে চাই / অনেক কথা কত কথা কথকতার সুরে / ভরে গেল ভেতরটা আমার / ইচ্ছে হলো বলতে কথা সুরের তালে তালে / আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গিটার / মন আমার  …” — এই বিশেষ গানটা, প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, সে-সময়ের নতুন গানে এত সংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ কেন ও কোন গোপন রহস্যের কারণে ঘটেছিল, খানিকটা ব্যাখ্যা করে। এখানে অঞ্জন সুরে সুরে নিজের গানপ্রবেশ ও নতুন গানের প্রবর্তনা সম্পর্কে বলতে বলতে যেন পুরো ওই টাইমটার গানক্ষিদে নিয়ে বলে ফেলেছেন। অঞ্জন বলছেন, যেমন, “গানটা আমার গাইবার এই ইচ্ছেটাই-যে ছিলনাকো / কানটা ছিল শুধুই শোনার / অভ্যেসটা ছিল কথার তালে কথার জবাব দেবার / কথা কেড়ে নেবার স্বভাব / তোমার কথার সূত্র ধরে পথ হারিয়ে নতুন করে / ইচ্ছে হলো কথাটা বলার / কথায় কথা বাড়ে / তাই বলছি ছোট্ট করে / আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গিটার” — এইটুকু হলো সমাপনী স্তবক গানটার। তার আগের অংশে অঞ্জন পুরো পরিস্থিতি বিবরণ করে এসেছেন অবশ্য যে কেন ও কোন পটপ্রেক্ষায় তিনি এলেন দুম করে গাইতে গিটার কাঁধে, সেই অংশটুকু অঞ্জনেরই সেল্ফ-স্টেইটমেন্ট হয়ে থাকে নাই শুধু, হয়ে উঠেছে সেই সময়ের একঝাঁক নবপ্রবেশিত ও প্রায়-আগন্তুক গানগেরিলার দর্শানো কারণপত্র। ফলে এর পুরোটা এইখানে উদ্ধার করি স্মৃতি নিংড়ে : “গানের কোনো প্রস্তুতি নেই নেই-যে শেকড়বাকড় / মালকোষ কি পিলু ভৈরবী / গলায় আমার নেই-যে কোনোই রেওয়াজ করার স্বভাব / এই অভাব আমার থাকবে চিরদিন / আমার শুধুই ছিল ও আছে কাঠখোট্টা বাস্তবটা / দিবারাত্রি আপোস আর আপোস / রবীন্দ্র কি গণসংগীত কোনোটাই ঠিক দিচ্ছিল না / বুকের ভেতর রেগে ওঠার রোষ” … ঘটনা — গানের বিবরণাংশে — এইটুকুই। কিন্তু কোনো কথা বাকি রইল বুঝি বলতে? এইটাই, ইন-শর্ট ও ইন-ফ্যাক্ট, রিজন ও  রেশন্যাল বিহাইন্ড নতুন কথা আর নতুন সুরের নতুন ফর্ম্যাটের বাংলা গানের প্রবর্তনার। এই নিয়ে একসময়, ইন স্যম-আদার প্যারাগ্র্যাফ, আরেকটু হয়তো বলতে উদ্যত হওয়া যাবে।

এখানে একটুকু শুধু বলা যাক যে, কবীর সুমন আবির্ভাবের আগে (আবির্ভাবসময়ে সুমন চট্টোপাধ্যায় হিশেবে পরিচিত, অনেক পরে যেয়ে কনভার্টেড কবীর সুমন) গণসংগীতের ধারায় আরও অসংখ্য সংগীতকারের দেখা আমরা পাই যারা বাংলা গানে প্রতিবাদের স্বরটাকে সমুত্থিত রেখে গান বাঁধছিলেন। কয়েকজনের নামই শুধু মনে করতে পারব, যাদের গান আগে-পরে শুনেছি ইত্যবসরে, যেমন — প্রতুল মুখোপাধ্যায়, পরেশ ধর, বিপুল চক্রবর্তী, অজিত পাণ্ডে প্রমুখ। সুমনের আবির্ভাবকালে একঝাঁক তরুণ সংগীতকারের মধ্যে নচিকেতা-অঞ্জন-মৌসুমী ছাড়াও অসংখ্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা যাবে যাদের গান আমরা শুনেছি। যেমন — কাজী কামাল নাসের, শিলাজিৎ, লোপামুদ্রা, রূপম, রূপঙ্কর প্রমুখ। কলকাতার ব্যান্ডগুলোও ময়দানে এসে হাজির হচ্ছিল উপর্যুপরি ওই একই সময়ে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, চন্দ্রবিন্দু-ফসিলস-ক্যাকটাস-উজান-ভূমি ইত্যাদি বিচিত্র সমস্ত নাম ও ধরনধারণের ব্যান্ড। নোট নিয়া রাখতে পারি যে এই সবকিছুই হয়েছে ঘেঁষাঘেঁষি-গা গত শতকের বিরানব্বই-তিরানব্বই-চুরানব্বই-পঁচানব্বই ইসায়ির অন্তর্গত।

সময় এবং অন্যান্য সন্দর্ভসংক্ষেপ
বলা হচ্ছে যে-সময়টার কথা, সেইটা আসলে কোন শতাব্দী? কোন রাজার আমল অথবা কোন নায়ক-নায়িকা বা বাংলা কোন সিনেমা তখন চলছিল মহাসমারোহে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করিয়া ঢাকা ও ভারতীয় বঙ্গে? এই খোঁজপাত্তাগুলো দরকার হবে একটু পরে। যেমন আমরা খানিক মনে করতে চেষ্টা করব, কোন ধরনের গান আমরা শুনছিলাম তখন, অথবা মান্না-ভুপেন ও মহীনের ঘোড়াগুলি (এই জায়গায়, এই ঘোড়াদেরে নিয়া, আলাদা রেসকোর্স রিক্যোয়ার্ড হতে পারে মনে হয়) কিংবা আইপিটিএ প্রভৃতির গান আমরা কিভাবে নিচ্ছিলাম তখন, এইসব নিয়া খানিক আলাপও দরকার হতে পারে।

এবং, বলা বাহুল্য, সময়টা লাস্ট সেঞ্চুরির নব্বইয়ের দশক। একেবারে গোড়াটা। বাংলাদেশের সিনেমাহ্যল্ ভরে কেবল সাপুড়ে কাহিনির বীণ-বাজানো বই। হিন্দি ফিল্মিগানার বাংলান্তর কুমার শানুর কণ্ঠ ভর করে ঘরে ঘরে, বাসে ট্রেনে, চাদোকানে, এমনকি বন্ধুবান্ধবীর কলেজফাংশানে। কেয়ামত স্যে কেয়ামত তক, সাজন, দিল্, ম্যায়নে পেয়ার কিয়া, ছায়া পেয়ার কা, ফুল আউর কাঁটা, সড়ক … ইত্যাদি সিনেমাগানের বাংলা ভার্শানে দেশকাল-সন্তানসন্ততি সয়লাব। উনিশশ বিরানব্বইয়ে অ্যালবাম নিয়া সুমনের আবির্ভাব। ‘তোমাকে চাই’ ছিল ওই অভিষেকসংকলনের নাম। ছিল তখন ফিতার ক্যাসেটে স্টেরিয়োপ্লেয়ার বাজাইবার সময়।

বাংলাদেশের ব্যান্ডগান অবশ্য তখন উল্লেখযোগ্য তুঙ্গস্পর্শী। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যান্ড নিয়া আলাদা প্যারাগ্র্যাফ লাগবে তো অবশ্যই। কবীর সুমন উনিশশ বিরানব্বই ইসায়িতে যে-জিনিশগুলা বাংলা গানে এনে একের পরে একেকটা কাব্যস্পর্শী লিরিক উপহার দিচ্ছেন, বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলা সেই জিনিশটাই করে যেতেছিল উনিশশ বাহাত্তর থেকে একটু অন্যভাবে, বেশ দুর্বলভাবে, এবং মধ্য-আশি থেকে সেই ব্যান্ডচেষ্টাগুলা আস্তেধীরে মোকামের নাগাল পেতে শুরু করেছিল, নব্বইয়ের শুরু থেকে ব্যান্ডসংগীত বাংলাদেশের পরানভোমরা। তার আগে যে-জিনিশটা কবুল করে নিতে হবে তা এ-ই যে ব্যান্ডগানগুলা বাংলাদেশে যে-এক্সপেরিয়েন্স উপহার দিয়েছে মিউজিকের — সেইটা আগে থেকে এইভাবে একদমই ছিল না। তা হয়তো সচেতন প্রয়াস ছিল না ব্যান্ডগুলার, সচেতন অনেকদিন পর্যন্ত ইংরেজি ফর্ম্যাটে বাংলা গান গেয়েছে ব্যান্ডগুলা, অচিরে অবচেতনার অভিঘাতে হোক বা অন্য কোনো দুর্জ্ঞেয় কারণে ব্রেক-থ্রু হয়ে দেখা দেয় বাংলাদেশের মিউজিককালচারে ব্যান্ডের অবদান। কথাগুলোর বিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে না হয়তো বর্তমান নিবন্ধে।

এছাড়া আরও কিছু জিনিশ বলে নিতে হবে। যেমন তখন টুপাক শাকুর আর বাবা সায়গল — এদের গান আমরা খুব শুনতাম। লং ড্রাইভে তো লা-জওয়াব এইসব গানই, যেমন, “লংড্রাইভ যায়েঙ্গে ফুলস্পিড লায়েঙ্গে / কোই রোকেঙ্গে না হাম / গানাবাজানা খানাপিনা / গাড়ি-ম্যে হো-গা স্যনম / আ যা মেরে গাড়ি-ম্যে ব্যেট যা” … ইত্যাদি। সেই মহাক্ষণে এলেন সহসা ডালপালা উথলিয়া, আদতে যেন উদয়িলা, বাংলা গান ও গঞ্জনার অশেষ-অপরূপ ভুবনডাঙায় সুমন ও তার সারথীরা। ভারতীয় বাংলা গান বলতেই ছিল আমাদের কাছে ওই বাবাচাচাদের আমলের বা তারও আগের পুরাতনী বাংলা গান, মহীনের ঘোড়াগুলি যদিও কবীর সুমনের আবির্ভাবের দেড়-দুই দশক আগের মামলা, ঘোড়ার গানগুলা বাজারে অ্যাভেইলেবল হবার শুরু সুমনের বাণিজ্যিক সাফল্যের সুবাদেই।

মিউজিকে ব্যান্ড ও সোলো : বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়া পার্সপেক্টিভ
বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক তখন সত্যি একটা ভালো সময় এনেছিল তরুণতর শ্রোতাদের মধ্যে। এন্তার নকলি হয়েছে, এন্তার হরবোলাগিরি, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে একটা ফাটাফাটি সৃজনোল্লাসভরা টাইম ছিল সেইটা। আনকোরা গানদলগুলোও পূর্ণ উদ্যম নিয়ে একটা-দুইটা গান টিউন করছিল নিয়মিত। গড়ে ওঠে এই সময়েই মিউজিক্যাল দলগুলোর সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্ম বামবা,  কার্যক্রম ও দায়বোধের দিক থেকে বামবা   তখন পূর্ণ সক্রিয়, বাংলাদেশের ব্যান্ডগান ধারাটাকে নিবারণ পণ্ডিতদিগের নানাবিধ বারণ ও ভূতুড়ে সাংস্কৃতিক জপস্তোত্রীয় তৎপরতা হইতে সুরক্ষা-প্রতিরক্ষা প্রোভাইডপূর্বক একটি নির্দিষ্ট দূর অবধি এনে সড়কে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে এই পাটাতনের ভূমিকা স্মর্তব্য, যদিও শুরুর দিককার জোটবদ্ধ গুটিকয় ইমিডিয়েইট সমস্যা সাময়িকভাবে সেটল-ডাউন করা ছাড়া বামবা   ব্যান্ডমিউজিকটাকে ফিলোসোফিক্যাল বা ইভেন প্র্যাক্টিক্যাল কোনো শেইপ-আপ দিতে পারে নাই, ফিন্যানশিয়ালি কিছু প্রতিষ্ঠানগত সমর্থন আদায় করা ছাড়া সার্বিকভাবে বাজার ও বিপণন ব্যবস্থাটায় তেমন অভিঘাত ফেলতে পারে নাই। কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডগ্রুপ স্পন্সর পাবার ক্ষেত্রে একটা সুবিধা পায় নিশ্চয়। এইটাই, এর সঙ্গে রিলেটেড আরও সমস্ত কারণাদি, বামবাকে একটা অক্রিয় জোট করে তোলে অচিরে, সেইসঙ্গে বামবার আদি অর্গ্যানইজারদের বানিয়ে তোলে বাবুরাম সাপুড়ে একেকজন। অর্জনের মধ্যে এইটাই যে, বামবা   গঠনের পর সম্মিলিত ম্যুভের ফলে একের-পর-এক বেশকিছু কন্সার্ট উপর্যুপরি আয়োজিত হওয়া। যার ফলে ব্যান্ডশ্রোতাগোষ্ঠী পয়্লাবারের মতন ভিজিবল হয়। এদ্দিন লোকে ক্যাসেট খরিদ করিয়া বাড়িঘরের ভেতর বিবিক্ত-বিচ্ছিন্নভাবে শুনত, ফলে বোদ্ধারা ঠাহর করতে পারতেন না আদতে ব্যান্ডগানের তালে তারুণ্যের পাল্স স্পন্দিত হয় কি না, বা হইলেও কতটুকু হয়, এইসব ওজন করিয়া দেখার চাক্ষুষ নজির তৈয়ার হয় বামবাকন্সার্টগুলোর সুবাদে। সেইসব কন্সার্ট, ওপেন এয়ার বা মিলনায়তনাভ্যন্তর যেখানে যে-ফর্মেই হোক, যেখানেই হোক যথা রাজধানী কিংবা জেলাশহরে, প্রতিষ্ঠানবেপারিদের সজাগ করে তোলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীটাকে ব্যবসায়ের প্ল্যানের ভেতর সংস্থান-সঙ্কুলান করে নিতে। এবং হয়ও তাই।

নিরখিলে দেখা যাবে যে, এই সময়েই ধীরে ধীরে বামবাকনসার্ট অনুষ্ঠানগুলোর নিউজ-কাভারেজ ন্যাশন্যাল দৈনিকগুলোর ফ্রন্টপেজে সচিত্র মর্যাদা পাচ্ছে। ক্যাসেট মার্কেটিং ও ম্যানুফেকচারিং কোম্প্যানিগুলোর নিউজ ও ফিচার ছাপা হতে শুরু করে বেশ ফলাও করে। উইক্লি টপচার্ট, অ্যালবাম বিক্রিবাট্টার খবর, ঢালিউড-বলিউড-হলিউড প্রমিলাদের প্রতিকৃতি প্রকাশে এন্টার্টেইনমেন্ট সাপ্লিমেন্টগুলোর অত্যাগ্রহে একটা ভাটা লাগে এই সময়ে এসে, ব্যান্ডভোক্যালদেরে গুরুত্ব দিয়া কাভার করার নিমিত্তে ফোটোশ্যুট একটা রেগ্যুলার আইটেম হয়ে ওঠে, জেমস্-মাকসুদ-বাচ্চু প্রমুখের মুখচ্ছবি এবং তাদের জীবনযাপন-শখাহ্লাদ প্রতি হপ্তায় কোনো-না-কোনো পত্রিকার পাতার খোরাক পূর্ণায়তন। ‘অপসংস্কৃতি’ অপবাদে খ্যাত গানবাজনা এইভাবে মূলধারা জনপদে মান্যতা লাভ করতে থাকে।

এবং চুল্লির মোটামুটি অনির্বাণ আগুনটা, এতাবধি-দিয়া-আসা ব্যান্ডগানের ফাইটটা, আনফর্চুনেইটলি হলেও আস্তে আস্তে স্তিমিত হইতে থাকে এই সময়েই। নিতান্তই মাটির মনে হয় — যেমন সৈয়দ হকের কবিতায় এ-পঙক্তিটি — একবার পাইবার পর, সোনার মোহর কিংবা ডায়মন্ডের ব্রেস্লেইট, ঘটনা কতকটা তা-ই ঘটে বলিয়া মনে হয়। এতদিন প্রতিষ্ঠা-স্বীকৃতি ইত্যাদি অর্জনের যে-স্ট্রাগল, যে-লড়াই, পাইবামাত্র উহা কাজে লাগানোর পরিবর্তে ব্যান্ডলিডারদিগের বগল ব্যস্ত হয়ে ওঠে বাজিবার তরে। সে এক ইতিহাস। বাংলাদেশের মিউজিকসিন নিয়া যারা আপকামিং দিনগুলায় আলাপালোচনা ফাঁদবেন তাদেরে এই ইতিহাস খননে নামতে হবে। এই নিবন্ধে তা বাহুল্য বিবেচনায় আপাতত পরিত্যাজ্য।

কথা হলো, গানের বাণী বা লিরিক্যাল স্ট্রেন্থ ইত্যাদি বিবেচনায় ব্যান্ডমিউজিকের অর্জন খুব সমৃদ্ধ, এমনটা বাতচিত বেশি বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু সদিচ্ছাটা অনুপস্থিত ছিল এমন বলা যাবে না। কয়েকটা মাইলফলক এফোর্ট লক্ষণীয় সর্বৈব বিচারসালিশির পর। সবই স্তিমিত হয়ে যায়, ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে, ভেস্তে যায় ধীরে ধীরে। এরপরবর্তী মিউজিক যতটা-না ব্যান্ডবাহিত, অনেকাধিক সোলো তথা ব্যক্তিক উদযোগজাত। বাংলাদেশের বাংলা আধুনিক গানের — অবশ্য ব্যান্ডমিউজিক ব্যাপারটা বাংলাদেশের গানের স্বল্পপরিসর উঠানে এখনো মডার্ন তথা আধুনিক আখ্যা পাইবার পরিবর্তে পপগান ডাকনাম নিয়াই চলিছে, কেউ কেউ রক্ ইত্যাদি নামেও সম্বোধিছে দেখতে পাওয়া যায় — রিসেন্ট ট্রেন্ড ব্যান্ড এফোর্টের বাইরে বেরিয়ে এককেরই সৃজন-নির্মাণ-পরিবেশন। মন্দ হচ্ছে না তা-ও।

লক্ষ করব পশ্চিমবঙ্গে এখন ব্যান্ডের রোয়াব, আমাদের এখানে যেইটা ছিল নব্বইয়ের জাব্দাখাতার উজ্জ্বলতর প্রাপ্তি। আমাদের এখানে এখন এককের উত্থান, সুমন ও তার সারথীরা যা নব্বইয়ের গোড়ায় দেখিয়ে সেরেছেন। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। যদিও এই নিবন্ধানুচ্ছেদে ব্যাপারটা ভালোভাবে দেখানো হয় নাই, পরের কোনো প্যারাগ্র্যাফে বা আলাদা কোনো নিবন্ধে এইটা ঘিরিয়া খানিকটা ভাবার ও ভাবানোর প্রয়াস নিতে দেখা যাইতে পারে। তখন বুঝসমুজ করা যাবে যে এই গোটা ব্যাপারটা আমাদের দিক থেকে পজিটিভ পালাবদল বলিয়া আখ্যায়িত করা যায় কি না।

না, আমাদের থেকে ব্যান্ডমিউজিক ঘরানাটা পশ্চিমবঙ্গ অনেক পরে রপ্ত করলেও ভ্রুণাবস্থা তারা দ্রুত কাটায়ে সেরেছে। ‘চন্দ্রবিন্দু’ বা রুপম ইসলামের ব্যান্ড ‘ফসিলস’ বা ‘ক্যাকটাস’ বা ‘ভূমি’ প্রভৃতি ছাড়াও কয়েকটা ব্যান্ড আমাদের শ্রবণতালিকায় নিশ্চয় নিয়মিত তা-ও-তো অনেকদিন হয়ে গেল। আমাদের অবস্থাটা কেমন, উত্তরণ কোথায় কিংবা আদৌ কোথাও উত্তরিত হয়েছি কি হই নাই, প্যারাডিম শিফ্টিং বলিয়া আমরা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিবরণ অভিহিত করব নাকি অন্য কোনোভাবে একে অরিয়েন্ট করে নেব, ভাবা যাবে নিজের মতো করে। সুমন ও তার সতীর্থ-সারথীদের নিয়া বলবার ফাঁকে-ফোকরে একটু রতি-উস্কানিমূলক আত্মজৈবনিকী নিশ্চয় বিরক্তিকর ঠেকছে? সেক্ষেত্রে এই নিবন্ধের ইস্তফা আশু কাম্য।

সংহার, আপাতত
কবীর সুমনের গানভুবনের একটা বড় অংশ বিপ্লব আর দিন-বদলের বাণীসম্বলিত। গত একদশক তো উনি ডিরেক্ট প্রচারণাগানও রচেছেন মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে। যেমন আগে গান বানাইতেন লালফৌজির দরকারে। এই এক সমস্যা লাস্ট কয়েক বছরে দেখা গেল যে উনি খবরের কাগজের বিবরণ বা টিভিনিউজের ভিশ্যুয়্যালফ্যুটেইজ দেখেই লিখতে বসে গেলেন লিরিক এবং সুরে ফেলে সেইটা আপ্লোডও করে দিলেন ঝটপট ঘটনা তাজা থাকতেই। কিন্তু ঘটনার নেপথ্য পোলিটিক্স সবসময় যে এভাবে আইডেন্টিফাই করা যায় তা তো নয়। এইটা আদতে সৃজনের নামে প্রতিক্রিয়াশীলতাই। কিন্তু কবীর সুমন তো সর্বজ্ঞ, সবজান্তা, বল্গাহারা আলোচনাঠাকুর। আগে এইটা অ্যালবামে এত বোঝা যাইত না টাইমফ্রিকোয়েন্সির একটা বাধা থাকবার কারণে। এখন তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় রিয়্যালিটি চেইঞ্জ হচ্ছে, কেননা রিয়্যালিটি তো মোস্টলি মিডিয়াক্রিয়েটেডই। কিন্তু কবীর সুমন রিয়্যালিটিটাকে মিডিয়াবাহিত গ্রহণ করছেন এবং গান বাঁধছেন মুহুর্মুহু। গত কয়েক বছরে একটু কমেছে এই প্রবণতা, ব্যাপারটার অসারতা বুঝতে পেরেই নাকি বাংলায় খেয়াল রচনার নবোদ্যম থেকে তা বোঝা যাচ্ছে না যদিও। ঘটনাটা গানের জন্য কবিতার জন্য তো বিপজ্জনকই। দিনশেষে সেই গানগুলো খুঁজে বের করতে হবে যেগুলোতে বাইন্যারি অপোজিশনের নায়্যিভ প্রেজেন্সটা নাই, কিংবা থাকলেও তা উদ্দেশ্যপ্রণোদনায় ব্যবহৃত হবার পক্ষে অনুপযুক্ত। কবীর সুমনের প্রেমের গানগুলোতেই, মিলনের বিরহের লিরিকগুলোতেই, ইন-ফোকাস কবীর সুমন সংগীতব্যক্তিত্বটাকে খুঁজতে হবে। প্রেমের গানে যেটুকু ক্রোধ, বিবমিষা, অসহায়তা আর ব্যক্তির বা মুহূর্তের উদ্ভাসন পাওয়া যাবে সেটুকুই দরকারি বিবেচিত হবে আখেরে। সেইটাই হবে বাংলা গানের জন্য দরকারি জিনিশ। করতেই হবে তা, গানের ভিতর দিয়ে এই খোঁজাখুঁজিটা, আজ হোক বা কাল।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you