সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথম কথা হলো, অসাধারণ মঞ্চায়ন। শহীদুল জহিরের যে ভাষা দীর্ঘ, কমা-সেমিকোলনময়, দাঁড়িকম — তা মঞ্চে অনুবাদ করা প্রায় অসাধ্য। সেই অসাধ্য সাধনও হলো।
সাহিত্যের ভাষা বলতে যা যা চলে তা থেকে দূরবর্তী শহীদুল জহিরের ভাষা। কোনোভাবেই আঞ্চলিক ভাষার বহু উপাদানের বিপুল জারণ থাকলেও তা প্রচলিত বাংলা না একেবারেই। এমন একটা ভাষাকে মঞ্চে নির্দেশিত করাটাই নাটকের মূল চ্যালেঞ্জ। আর বাদবাকি যা যা কিছু তা সৈয়দ জামিল আহমেদের জন্য ডালভাত; কেননা, ঢাকার মঞ্চপাড়ায় যারা হাঁটাহাঁটি করে মাঝে মাঝে, তারা তার সক্ষমতা সম্পর্কে অবগত। সেই ভাষা উপস্থাপনের ব্যারিয়ার তিনি উৎরে গিয়েছেন। অসাধারণ উপস্থাপন।
যারা অ্যাডাপ্টেশনের নানা কাজ দেখেছেন, তারা জানেন এর মতো দুরূহতম কাজ কম। অধিকাংশ অ্যাডাপ্টেশন ভিন্ন কিছু হয়ে ওঠে মূল থেকে দূরে। তবে এখানে ভিন্নতা ও পার্থক্য আছে মিডিয়াম পরিবর্তন করার কারণে। তবে, তা অনেক বেশি সফল। জহিরের লেখার যে বহুস্তর তা অনেকাংশে পাওয়া যায় এখানে।
এমন ইভেন্ট ঢাকার মঞ্চে বহুদিন বাদে বাদে হয়। কিন্তু নাটকওয়ালা লোকের ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার সাত-আটশ সিটের শিল্পকলার মূল মঞ্চের অর্ধেক ভরাট মাত্র, তাও আবার শুক্রবারে। এটা যেমন বিস্ময়কর তেমনি হতাশাজাগানিয়া। এমন অদ্ভুত একটা সৃষ্টি নাগরিক জনগণ না দেখে শুক্রবারের উইকএন্ড কী করে কোথায় কাটাচ্ছে? এই নগরে আর্টকনজ্যুমার কম না, অনেক। তারা যাননি কেন? এই নাটককে নীরবতার উপেক্ষা দেওয়াটা পরিকল্পিত বলে মনে হয়। শিল্পমঞ্চের দলাদলির বাজে ফলাফল। তা না হলে আর কোনো কারণ দেখি না।
ঢাকায় যারা মঞ্চফঞ্চ করেকেটে খায়, এরা খুব রাজনীতিসচেতন, ক্ষমতার গদিনদাররদের দ্বিতীয় শ্রেণির কালচারাল ফ্রন্ট, ক্রিয়েটিভ কাজে অপারদর্শী। এই সমস্ত উদাহরণ চোখ বন্ধ করার মতো সহজ কাজটি করেই উপলব্ধি করতে পারবেন। ফলে, ঢাকার নাট্যকর্মীরা বেশ নীরব এই নাটক নিয়ে।
যারা নাটকটি দেখে বলেছেন, এটা ইতিহাসের বিকল্প কলঙ্কিত বয়ার, তারা নিশ্চিত নাটক দেখতে গিয়ে এসির ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুমিয়ে যাওয়া মানুষ। হঠাৎ তারা ঘুম ও মঞ্চের সাথে নিদ্রার সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে সহসা শুনতে পায়, “আমাদের নেতাই যখন মাপ করে দিয়েছে, তখন তোমার উপর আমার রাগ নাইক্কা।” বা, “রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা চিরস্থায়ী শত্রু বলে কিছু নাই।” এটা শোনার পর তারা মঞ্চ ও নিদ্রার ভেতর সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। তার মধ্যবর্তী অনেককিছু আর শুনতে পায় না। তারা দেখতে পায় না “মানুষ কিছু ভোলে না।” মজিদের মেয়ের নাম তার ধর্ষিত, নিহত বোনের নামে রাখা হয়। মানুষ কিছু ভোলে না। না-ভোলার কারণেই ইতিহাস অগ্রবর্তী হয়। নানা ইন্টারপ্রিটেশনের ভেতর দিয়ে ইতিহাস আগায়। ইতিহাসকে লিনিয়ার গল্প হিসাবে দেখার সুযোগ কই? ফলে নাটকমহল্লার কিছু লোক নাটক শেষ হলে করতালির পট পট আজাইরা শব্দে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে, এবং নিদ্রা ও শহীদুল জহিরের গল্পের মধ্যে সঙ্গতি বিধান না করতে পেরে প্রথমত মূত্রাগারের দিকে ধাবিত হয়, তারপর অনুধাবনে সক্ষম হয় যে স্বাধীন বাংলার ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছে। তারা উত্তেজিত হয়ে যায়। মিডিয়ায় বাল ছাল কথা বলে। ফলে, নগরীর নটনটিরা সচেতন হয়ে পড়ে। তারা তিন পক্ষে ভাগ হয়ে যায়। সবপক্ষ নিজেরা নিজেরা কথা বলতে থাকে। বিভ্রান্ত জাতি ঠিক বুঝতে পারে না তাদের মঞ্চে গিয়ে নাটক দেখা উচিত কি না।
এমন কিছুই আমার চোখে ও কানে পড়ে নাই যার জন্য নাটকটা বন্ধ করে দেওয়ার কথা কোনো শিল্পসংশ্লিষ্ট মানুষ বলতে পারে। ন্যূনতম উপলব্ধি মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে পারে।
আপনারা নাটকটা দেখুন। আসাধারণ শহীদুল জহিরের মঞ্চায়ন।
সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নিয়ে অল্প কয়টা কথা বলি।
এক, নির্দেশক ধরেই নিয়েছেন যে শহীদুল জহির পড়েই দর্শক নাটক দেখতে গিয়েছে। সত্যি, সেটা পড়া না থাকলে কম্যুনিকেট করতে বেগ পেতে হবে দর্শকদের প্রথম দিকে। দুইঘণ্টা সময়ের নাটকে দর্শককে কম্যুনিকেট করতে বিশ-ত্রিশ মিনিট চলে গেলে একটা সংকট তৈরি হয় বৈকি!
দুই, দিনের দ্বিতীয় শোতে এসেই অভিনেতাদের ক্লান্ত লেগেছে। কারো কারো গলা ও উচ্চারণ অস্পষ্ট মনে হয়েছে গলার ওভার ব্যবহারের কারণে। বাকি দিনগুলোকে তারা কীভাবে সামলাবেন আল্লাই মালুম। তবে, এমন পরিশ্রমী উপস্থাপনার জন্য তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
তিন, ব্যবহৃত মিউজিক। বেশিরভাগই ওয়েস্টার্ন। পাশ্চাত্য সংগীত টেম্পোনির্ভর। প্রাচ্য চলে টিউনে, আপ-ডাউন কম, অন্তরাও ধুনকে লক্ষ্য করে শেষ হয়। ফলে, পাশ্চাত্য সুরের বিপরীতে যখন শহীদুল জহিরের জটিল-মিহি বাংলা উচ্চারিত হয়, তখন মনোসংযোগে একরকম বিচলতা তৈরি হয় বলে আমার মনে হয়। মিউজিককে ডায়লগের সাথে সংগতিপূর্ণ করা দরকার ছিলে। আবহসংগীত অনেক ক্ষেত্রে অসঙ্গত লেগেছে। আবহের মিউজিক ডায়লগকে ঢেকে দিয়েছে। ডায়লগ থেকে সংগীত বেশি প্রবল কোথাও কোথাও। এটাই এই নাটকের বড় পিটফ্যল।
এ বাদে সব অসাধারণ। এমন ইভেন্ট কালেভদ্রে হয় ঢাকায়। এর সাক্ষী হয়ে থাকুন। শহীদুল জহির এত হাল্কা কিছু না, সৈয়দ জামিল আহমেদও না। প্লাটিনামের অলঙ্কারে বসানো হীরক অঙ্গুরীর দাম বেশি হওয়া স্বাভাবিক তার বিরলতার কারণে। সেই গর্জিয়াস আভা আপনারা দেখে আসুন।
মূর্খের দেশে যখন জ্ঞানীরা অথর্ব, ঘুমন্ত — তখন তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হবেন না। সবই পেটের দায় তাদের জন্য।
… …
- কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব - February 15, 2020
- মুখোমুখি গুন্টার গ্রাস || মৃদুল মাহবুব - January 6, 2020
- হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব - December 15, 2019
COMMENTS