ওদের জন্য দোয়া করো দিলশাদ
কণ্ঠে ধরছি ওদের ঘৃণার বিষ
পুড়তে পুড়তে মিলিয়ে যাচ্ছে খাদ
থাকবে শুধুই ছোট্ট পাখির শিস।
খুব কনফিউজড লাগছিল, অত্যন্ত উদভ্রান্ত-উশখুস অবস্থায় দিন কাটছিল, দৈনিকপত্রিকা মারফতে এর পক্ষকাল আগে নিউজটা পাবার পর থেকেই। কিছুই ঠিক নির্ভরযোগ্য সংবাদ বলে মেনে নিতে মন সায় দিচ্ছিল না; আবার অবস্থাদৃষ্টে একেবারে অবান্তর বলে উড়িয়েও দেয়া যাচ্ছিল না। কারণ, খবরবস্তু হয়েছেন যিনি, তিনি ডাকাবুকো লোক তো বটেই, তিনি মিডিয়াবাজিকে বরাবর বুড়োআঙুল-কাঁচকলাসাইন দেখিয়ে-যাওয়া লোক, অন্তত কলকাতাঞ্চলিক নতুন বাংলা গানের দিশারী মানুষ তিনি এবং তার গানেরই মতন অপ্রতিরোধ্য-আনপ্রেডিক্টেবল ব্যক্তিত্বের চিহ্নভরা তার লাইফস্টেইটমেন্ট, এইসব ততদিনে নানা সূত্রে জেনেশুনে এবং বাকিটা গানবাহিত কল্পনা-আন্দাজ মিলিয়ে একপ্রকার বোঝাপড়া সারা। আবার এ-ও মনে হচ্ছিল যে, এই লোকটার বিরুদ্ধে খবরকাগজগুলো তো মুখিয়ে থাকে কুৎসা রটাতে, ব্যঙ্গ ছাপাতে একে কটাক্ষাঘাত করে, এমনতর কাণ্ড তো পত্রিকাবাড়িগুলোকে-তেল-দিয়া-না-চলা যে-কোনো করিৎকর্মা ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঘটা অপ্রত্যাশিতও ছিল না। কাজেই রটিত সংবাদটা মিছেও হতে পারে, স্রেফ রটনা বা মান-অবনমনমূলক উদ্দেশ্যচরিতার্থতাও হতে পারে, এমনও মনে হচ্ছিল।
কবীর সুমন বিষয়ক কনফিউশন। কবীর সুমনের ব্যক্তিজৈবনিক বিপর্যয় নিয়ে সেইসময়কার আমার উদভ্রান্তিকীর্ণ স্মৃতিচারণ এই নিবন্ধ। তখনও ফেসবুক-টুইটার আমাদের অভিজ্ঞতা তো বহুদূর এমনকি কল্পনারও বাইরে। নেই কোনো অনলাইন পত্রিকার টিঁকিটির দেখাও। তবে শুরু হয়ে গেছে ইন্টার্নেটযুগ, গুটিকয়েরই অ্যাক্সেস ছিল যদিও, জিমেইল অ্যাকাউন্ট হোল্ড করব কম-করে-হলেও বছর-দুই পরে। সেই-রকম একটা আন্তর্জাল-সোশ্যালস্পেইসশূন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বর আদিম কালের কাহানি এইটা। কাজেই ভুলভ্রান্তি-তথ্যত্রুটি নিরীক্ষণীয় হতে পারে ইতিউতি। শিল্পকরিয়ে কবিসাহিত্যিকদিগের ন্যায় নির্মম গর্তান্বেষী না-হয়ে একাধটু ক্ষমানান্দনিক হলে মেমোরিচারণের মোচ্ছব জমে ভালো।
ঘটনা হলো যে ফেরার হয়ে আছেন কবীর সুমন। দ্য ফিউজিটিভ। পয়লাবার পত্রিকায় খবর পড়ার পর থেকে খেয়াল করছি যে এরপরে তেমন কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না তারে নিয়া খোঁজপাত্তামূলক ফলোআপ নিউজ ছাপাইতে ডেইলিগুলো-উইক্লিগুলোর মধ্যে। সবেধন নীলমণি বিটিভি ছাড়া আর-কোনো চ্যানেলও নাই আমার যে একটু খবরাদি পাবো। সদ্য ধর্মান্তরিত হয়েছেন সুমন, সাবিনার সঙ্গে পাকাপাকি গাঁটছড়া বেঁধেছেন, খবরগুলো ততদিনে ভেসে এসেছিল বাতাসে। এরপর নতুন উদ্বেগ এই যেটা যুক্ত হলো যে সুমনের জার্মান স্ত্রী — বিবাহবিচ্ছিন্ন ততদিনে — আদালতে অভিযোগ দায়ের অথবা মামলা করেছেন। সুমনের বিরুদ্ধে মামলা। শোনা গেল। ওদিকে বজরংদল-শিবসেনা খাপ্পা, ভারতের বঙ্গাঞ্চলীয় সেক্যুলার সিভিল সমাজ গোস্বা, কালচারকরিয়েরা আগুনশর্মা। আর মিডিয়াগাণ্ডু তো তৈলাক্ত বেগুন, অগ্নি বিনে লেলিহান দাউদাউ টোকাটা পাইলেই, সিন্স হিজ বিগিনিং — সুমনের জন্মাবধি — মিডিয়ার আচরণ ইহা, আজিও তথৈবচ। সর্বকালে তথা আগের-কালের সেই চাটুজ্জে মশাই এবং পরের-কালের কবীর মিয়ার পশ্চাদ্ধাবিত মহিষাসুর মিডিয়া। বাংলাদেশে এর যে-চেহারা, ভারতেও তথৈবচ। পৈশাচিকভাবে পয়সার তথা ক্ষমতাশালীর পশ্চাদ্ধাবন্ত। সুমন অগত্যা উপায়ান্তরহীন অজ্ঞাতবাসে অন্তরীণ।
অনেক পরে মুক্ত ভারতীয় সুমন অবশ্য ওইসময়ের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন বই লিখে, অনলাইন জর্নালে নিবন্ধ লিখে, নানা প্রাসঙ্গিক আলাপে। এবং সুমন বোল্ড হরফে বলেছেন সেইসব লেখায় যে সেইসময় তার বামসহচরেরা যাদেরে তিনি মুক্তমনার বাপঠাকুর্দা ভাবতেন তারাই ন্যাস্টি বিহেইভিয়্যর করেছেন বেশি। এইগুলোতে আসলে-যে হেডেইক বেশি প্রগতিপিরফকিরদিগের, উগ্র-অন্ধরা এসবেরে থোড়াই পাত্তা দেয়, এইসব সুমন বলেছেন নানাভাবে নিজের ভঙ্গিতে। সেসব থাক। এখানে সেইসময়কার একটা ঘটনা, এবং ঘটনার কিছু লতাপাতা, বলছি কিংবা বলতে চাইছি। কিন্তু দুর্গাপুজো ও ঈদের যুগল আগমন, মার্কেট সরগরম, সময় বেশি নেব না অতএব।
বাসলে ভালো, গানের কসম,
পায়ের আঙুল ঠোঁটেই ছোঁব
ফাঁকের পরে পড়লেই সম
গানের জলে স্নান করাব।
অবাক করে দিয়ে দেশ পাক্ষিকে এইসময় একজোড়া কবিতা ছাপা হলো সুমনের। কবিতা হিশেবে এই প্রথম সুমনের রচনা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পত্রিকায় ছাপা হতে দেখলাম। গদ্য লিখেছেন আগে এখানে, দেশ পত্রিকায়, স্বনামে, বেনামে, মানব মিত্র নামে, বইয়ে সেসব পড়েছিও। যদিও সুমনের গান সমস্তই লিরিক্যালি ইন্টেন্স; অন্যান্য পোয়েটিক কন্ডিশন বিবেচনায় নিয়েও সুমনগানসমূহ কবিতাবাচ্য রচনা, তাতে সন্দেহ অল্পই। কিন্তু ব্যাপারটা আমরাই বলাবলি করতাম কেবল, সুমনের গান যারা শুনতাম, কথাদৈন্য কাটায়ে যেন আধুনিক বাংলা গান শক্তপোক্ত হয়ে উঠতে লেগেছে সুমনের হাত ধরে। এবং যেতে লেগেছে কবিতার কাছাকাছি। বা, কাছাকাছি কেন, মাঝেমধ্যে কবিতাকেও পথ-দেখানো কম্পাস হয়ে ওঠার রসদ সামনে এনেছে সুমনের গান ও গীতিকবিতাগুলো। কম্পাস আমরা খেয়াল করলাম কি করলাম না, কাজে লাগালাম কি লাগালাম না, তা আলাদা কথা। আর আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এইভাবে কথা চালালে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির-নাজির করা লাগে। এইটা আদৌ অসম্ভব নয়, একটু উদ্যমী হলে, এ-যাত্রা সেই দিগন্তের পানে মুখ ফিরিয়ে রেখে মেমোরিচারণে মনোনিবেশ করা বাঞ্ছনীয়।
সময়টা নতুন সহস্রাব্দ শুরুর বছর। বা তার আগের, তথা প্রাচীন সহস্রাব্দ শেষের বর্ষ। পুরো যুগ সমাপনের বছর-দুই বাদে এই ব্যাপারটা সামনে এনে এমন রোমন্থনের কারণ আর-কিছুই নয়, সেই পাক্ষিকটি বহুদিন সবিরত খোঁজাখুঁজির পর বসতবাটির জমানো পত্রিকাভিড়ে একদিন পেয়ে যাওয়া। আর ঘটনাটা সাম্প্রতিক, পত্রিকা পাবার ঘটনাটুকু, সহসা পাবার পর মনে এমনও হচ্ছিল যে এল-ডোরাডোর সন্ধান লভিয়াছি! কিন্তু সাক্ষ্য দিতে চাই যে এই যুগল-কবিতা-সম্বলিত পত্রিকাটার স্মৃতি নির্মল-ঝকঝকে মনে পড়ছিল থেকে-থেকে গত চোদ্দবছর ধরে, নানাভাবে ইন্টার্নেটযুগে এ-দুটোর খোঁজতালাশ করেছি সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায়, কবীরসুমনঅনলাইনডটকম বা নাগরিক কবিয়াল নামধেয় দুটো ওয়েবক্ষেত্রে, একটুও নজরে পড়ে নাই। এদ্দিন পর পুরো পত্রিকাটা খুঁজে পেয়ে, সেই পত্রিকাপাতান্তরে এটা-ওটা নাড়াচাড়া করে দেখতে যেয়ে সেই-সময়টা ঝাঁ করে এল উঠে। সেই-সময়টা, কাভারপেজে দেশ মাস্টহেডের তলায় এই তথ্য যথারীতি থাকে যেমন, ২০০০ খ্রিস্টাব্দ। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সেইটা ২৮ অক্টোবর ২০০০ দেশ রেগ্যুলার ইশ্যু। ওই-সময়টা, ঠিক ওই বছরটা, আমাদের বিদ্যায়তনিক কৃতকার্য-অকৃতকার্য পড়াশোনার অন্তিম বছরের আগের বছর।
ব্যাপারটা কাকতালীয় কি না জানি না, আজ এদ্দিন পরে দেখতে যেয়ে এইটা আমোদ যোগাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি, সেই সংখ্যা দেশ-এর প্রচ্ছদগল্প করা হয়েছিল মমতা নিয়ে। মমতা ব্যানার্জি। তৃণমূল নেত্রী। তখনও তো গো-হারা হারে ফি-বার নির্বাচনমরশুমে মমতাগর্জানো তৃণমূল, মমতা রেলমন্ত্রী ইত্যাদি হওয়া তখনও ভবিষ্যতের স্বপ্নপেটে ভ্রুণাবস্থাতেও আসেনি। পত্রিকার প্রচ্ছদচিত্রও মমতা, কাভার জুড়ে একমেবাদ্বিতীয়ম মমতামুখ, প্রতিকৃতিশিল্পী সুব্রত চৌধুরী, যিনি তখন দেশ নিয়মিত প্রচ্ছদে-অলঙ্করণে ভরিয়ে তুলতেন। ‘মমতা কতদূর যেতে পারবেন’ — এ-ই ছিল উল্লিখিত সংখ্যাটার প্রচ্ছদধৃত প্রতিপাদ্য। ছিল ভেতরভাগ জুড়ে মমতাপ্রশস্তি, বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্ণ পক্ষপাত দেশ-এর, সম্ভবত তখনকার কন্টেক্সট থেকে দেখলে এইটাই ছিল অভিপ্রেত। আমরা বিদেশি মানুষ, তবু নজরে এসব পড়ে গেলে তো মনে গেঁথে যায় এবং অনেকদিন পর ব্যাপারটা আবার অন্য-কোনো প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে রিলেট করেও ওঠা যায়, বিদেশি ভাষায় কথা বলার মতন সন্তর্পণে এইসব নিয়া এই নিবন্ধে দুই-চাইর লোকমা বলা হবে স্রেফ মেমোরিচারণের স্বার্থে।
এবং পত্রিকার রেগ্যুলার পৃষ্ঠাবিন্যাসের জায়গাতেও চমক/ভিন্নতা দেখা যাবে সেই ইশ্যুতে। দেশ শুরু হয় নর্ম্যালি ইন্ডেক্স, এডিটোরিয়্যাল, রিডার্স রেস্পোন্স তথা চিঠিপত্র বিভাগ, এরপর নিবন্ধ/প্রবন্ধ, ছোটগল্প, এরপর কবিতা এবং সবশেষে শিল্পসাহিত্য বিভাগ ও অন্যান্য দিয়া খতম। কিন্তু এই সংখ্যায় দেখা যায় যে চিঠিপত্র বিভাগের পরপর কবিতা দিয়া আরম্ভ হচ্ছে পত্রিকা। এবং শুরুতেই সুমনের যুগল কবিতা! কোয়ার্টার পেইজ ব্যানার এবং এর পরপর যুগল কবিতা বাই কবীর সুমন।
সেই পাখিটার খামখেয়ালের ডাকে
তোমার আমার গানের হদিশ রাখা
যেখানে বন্ধু বন্ধুর পাশে থাকে
সেখানে আমার তোমার সঙ্গে থাকা।
তখন আমাদের মধ্যে, সহপাঠী-অসহপাঠী বন্ধুবৃত্তের ভেতরে, একটা স্বল্পকালীন শিবিরভাগের ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল। বড় কোনো গোলমাল ঘটেছিল এমন নয়। এমন নয় আমার বন্ধুরা, এমন যেন না-হয় আমাদের বন্ধুরা, আমি বিশ্বাস করে যেতে চাই মৃত্যু তক সহিসালামতে। যে-ব্যাপারটা ঘটেছিল, স্বল্পকালীন বলেছিও, খুবই ইন্ট্রেস্টিং সেইটা। ব্যাপারটা কবীর সুমন ও তার ধর্মান্তরণ প্রভৃতি সংক্রান্ত। দুইদলের ভাগের ব্যাপারটা একটু বলি, সংক্ষেপে। একদল মুখ ঝামটা মেরে সুমনকে গালি দেয়, অন্য দলও তা-ই করে। দুইদলের আচরণ অভিন্ন, বক্তব্য অনেকখানি ভিন্ন বটে। একদল বলে, সুমন একটা ভিত্তিহীন আদর্শের ভোগবাদী লোক, নইলে একটা নারীর জন্য ধর্মত্যাগী হবে কেন! সুমনের ধর্ম তো ভুঁইফোঁড় ধর্ম নয়কো, সুমনের ধর্ম সংস্কৃতি-সমর্থিত ধর্ম, সুমনের রিলিজিয়ন ইজ অ্যা পার্ট অফ বাংলা কালচার! বলিহারি যাই, বিউটিফ্যুল বক্তব্য।
অন্য দলের বক্তব্য আরও ওয়ান্ডার্ফ্যুল। ওদের প্রতিক্রিয়া হলো, এইটা তাদের ধর্মেরও অবমাননা, আর এইটা একটা পার্ট অফ গভীর ষড়যন্ত্র, তাদের ধর্মের মেয়েদেরকে কূলুটা বানানো, ধর্মটাকে খেলো ও দশমেশালি করে তোলার ব্লুপ্রিন্ট। উদাহরণ হিশেবে দ্বিতীয় দল তৎকালীন এক টিভিনায়িকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ওয়েস্টবেঙ্গলি বিজ্ঞাপনবেচা বাবুর সঙ্গে প্রণয় ও বৈবাহিক সম্পর্কাবদ্ধ হওয়ার ঘটনাটা উল্লেখ করে, বাংলাদেশে সেই লোক অনেক মিডিয়াবাইট পায়, প্যাকেজ নাটকের খরুচে বাজেটে পকেট ভারি করে এবং নাচুনে সমস্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ভালো পত্রিকাগুলোর মুখে জুতো মেরে অভিনেত্রীটিকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চম্পটপূর্বক পূর্বতন দারাপুত্রপরিবারের কাছে চলে যায়; এই নিয়া পরে সেই ইন্টেলেকচ্যুয়্যাল ফ্যামিলির অভিনেত্রী স্বীকারোক্তি দেন যে তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না সেই ভিনদেশি বাংলাকালচারাল প্লেবয়টি বিবাহিত। ওই-সময় এই ব্যাপারটা আমাদের আক্কেল সত্যিই গুড়ুম করে দিয়েছিল। অজস্র নাচানাচি হয়েছে এই বিয়া নিয়া বাংলাদেশের মিডিয়ায়, এইটা কোনো গোপন বলিউডি কারবার ছিল না, এবং ওই বিজ্ঞাপনবেচুয়াকে প্রতিভাবানের প্রপিতামহ হিশেবে গোটা দেশের সামনে হররোজ পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ও শেষ পর্যন্ত সমস্ত ভালো পত্রিকাগুলো। পরে এরা তাদের উদলা থ্যাঁতা পাছা দেখায় নাই অবশ্য জাতিরে, এদের বাঁশ প্রবিষ্ট হবার জায়গাটা এরা নিজেরাও টের পেয়েছে বলেও মনে হয় না, এই তিলকে তাল বানানো মিথ্যুকের সিন্ডিকেইট। অ্যানিওয়ে।
প্রথম দলের বক্তব্যের মধ্যে একটা স্থূল ইঙ্গিত ছিল, সুমন-সাবিনা ইশ্যুতে, সাবিনাকে বেহেড-বাজে প্রতিপন্ন করা। দ্বিতীয় দলের মধ্যে ছিল ওই বিজ্ঞাপনবেচুয়া খেলুড়ে বালকের মতো গোটাকয়েক স্পেসিমেন মনে রেখে সুমনকে ডন জুয়ান সাব্যস্ত করা। আর এমন নয় যে এরা কেউ সংস্কৃতিগত দিক থেকে দুঃস্থ-দুর্গত সংস্কৃতিজীবনানুশীলনের লোক, পোলিটিক্যালি অর্থোডক্স-কনজার্ভেটিভ প্র্যাক্টিসের লোক, বরং উল্টো। প্রগতিবিশিষ্ট বন্ধুরা প্রায় সবাই। বামা। স্টুডেন্টলাইফে এইটা খুব চলতি হাওয়া ছিল বটে। এবং কালচারালি নিচের দাগের বন্ধুটাও যুদ্ধচেতনার সপক্ষশক্তি বিপণন-করা রাজনৈতিক দলের সাপোর্টার। কাজেই যেইসেই লেতিপেতি বন্ধু না এরা। মাইন্ড ইট। উপর্যুপরি ধুমিয়ে এইভাবে সুমন বয়কটের সোচ্চার আওয়াজ সক্কলের মুখে। এই আওয়াজগুলো চোদ্দবছর পরে নানা কারণে এই হিস্টোরি ন্যারেইট করার ক্ষেত্রে ভাইট্যাল রোল প্লে করবে। এর নির্বাচিত কয়েকটা আরেকবার স্মরণ করা যাক, এবং এরপর দেশ পূর্বোক্ত সংখ্যাটায় ফেরা যাবে।
ছ’তার ছুঁয়ে গাইছে আঙুল
জন্মখ্যাপা গানের ঘোরে
গাইতে গাইতে করছি কবুল
পদ্য লিখছি নতুন করে।
বন্ধুদের ব্যক্ত প্রতিক্রিয়ারাশি, কিয়দংশ গোত্রধর্মচৈতন্যসম্ভূত গর্হিত গোস্বার দিকটুকু ছেঁটে ফেলতে পারলে, ছিল অভিমানপ্রসূত। কবীর সুমন, যদ্দিন সুমন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অন্তত, সকলকেই সমানভাবে সঙ্গ দিয়া আসছিলেন। সহসা ডালপালা উথলিয়া এ কী ওয়াইল্ড উইন্ড! এ কী সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড! এ কী সংস্কৃতিবিনাশক পয়মালগিরি কারবার বাপু! সংস্কৃতির সুখের সংসারে এ কী অগ্ন্যুৎপাত! হবি তো হ, মুচলমান হবি তা-বলে! এইটা অবশ্য তখন বুঝতে পারছিলাম যে এই আমাদের বন্ধুরা বা আমি নিজে সুমনের গানের যেসব কথাবার্তায় একিন রেখে সুমনকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলাম, উদ্ভূত ও অভাবিত এহেন সুমনকাণ্ডের ফলে সেই নিকষিত কথাগুলোতে একিন অব্যাহত রাখা পুর্ববৎ সম্ভবপর হবে না আর। বন্ধুরা বলছিলও, ব্যাটা মাত্র কয়দিন আগে গাইলি ‘নিষিদ্ধ ইস্তেহার’, সেখানকার গানে গানে “মানুষ আমার সাধনগুরু / সেই মোকামেই যাত্রাশুরু / চলনে গান সঙ্গে থাকে / বলনে আস্ফালন” ইত্যাদি ইহবাদী ফিলোসোফি, কিংবা “আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু”, শেষকালে কি না আস্ফালন শুধু বলনেই নয় চলনেও! তথৈবচ!
সন্দেহ হচ্ছিল আমারও যে স্রেফ সাবিনাকে বিবাহকল্পে এতটা কাণ্ড! গলা ফাটিয়ে ফলাও করে এই প্রতিক্রিয়াবাক্য উঠছিল সকলের মুখে, বাবা বিয়া করবা তো পৈতৃক ধর্ম খোয়ানোর দরকারটা আবশ্যক ছিল কি? ইন্টার্ফেইথ বিবাহ তো সোনার পাথরবাটি নয় এদেশে। সেক্যুলারবর্জিত অথবা মাইল্ড ল্যাঙ্গুয়েজে বলা যায় যে স্বল্প-সেক্যুলারের এই দেশেও তো কবেকার সেই ষাট-সত্তরের দশকে যার-যার ধর্মে স্থিত থেকে বিবাহ হয়েছে, এর মধ্যে মশহুর দুই দম্পতির উদাহরণ উঠছিল যাদের মধ্যে একজন নারীকবির একমাত্র কন্যা ও উনি নিজেও ক্ষমতাবলয়ের খুব ঘনিষ্ঠ সহচরী এবং আরেকজন এদেশের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত অভিনেত্রী, বিয়া করেছেন তারা যাদেরে তাদের মধ্যে এক বর হলেন অখ্যাত আঞ্চলিক সংস্কৃতিপেরিফেরির চক্রবর্তীফ্যামিলি এবং অন্যজন মঞ্চনাটকের বিখ্যাত লোক ও মজুমদারপদবীধারক, এবং সাক্সেসফ্যুলি তারা তো সংসারধর্ম-সমাজ-দেশ-সংস্কৃতি-সভ্যতা করছেন ওভার থ্রি ডিকেইডস। করিয়া যাইছেন এখনও। সুমন এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারলেন না? আব্দার জানিয়ে তো আর ফায়দা নাই, যা ঘটার তা তো ঘটিয়াই গিয়াছে, এখন অতএব যা করা যায় তা হলো সুমন-বয়কট। ঘটনাটা আদতে ব্যক্তিরই সিদ্ধান্ত যে সে ইন্টার্ফেইথ বিবাহ করবে নাকি কনভার্ট করবে।
গোড়া থেকেই লক্ষ করা যাবে, সেই ‘তোমাকে চাই’ ১৯৯২ পর্যায় থেকেই, সুমন সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর গুণ্ডামির বিরুদ্ধে একটা স্ট্যান্ড স্পষ্টভাবে রেখেছেন তার গানে। সেই গোড়ার দিককার ‘ভরসা’ গানে যেমন, মনে করে দেখুন, “অর্চনাদের পাশেই যেন আয়েশারা থাকতে পারে” ইত্যাদি। কিংবা “আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধু” প্রভৃতি। এবং সেইসঙ্গে মনে করে দেখুন ওই সময়টায়, নব্বইয়ের শেষপাদ থেকে ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর সদম্ভ ঘোষণার গুজরাট কিলিং পর্যন্ত ভারতে ভয়াবহ সংখ্যালঘু খুনযজ্ঞ, জ্যোতি বসুর বামদলীয় স্বেচ্ছাচার সবকিছু মিলিয়ে কী বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। মহাভারতে তখন মুসলমান নিধনের মহাসমারোহ। সুমন ওইসময়ে ধর্মান্তর হওয়ার ব্যাপারটা কাজেই তার গানের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল বলা যাবে না। বা ইক্যুয়েশন অত সহজে মেলানো যাবে না। তারপরও ওইসময় এইভাবেই আমরা প্রতিক্রিয়ালিপ্ত হয়েছিলাম। যদিও আমরাই বলতাম যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ইত্যাদি একটা স্বার্থসংশ্লিষ্ট পোশাক মাত্র, স্রেফ একটা বাইরেকার লেবাস। এবং বলতাম যে প্রেমের জন্য বোখারা-সামার্কান্দ্ জলাঞ্জলি দাও, কিংবা আস্ত রোম্যান কিংডম ছেড়ে দাও প্রেমাস্পদেরে পেতে, বলতাম ধর্ম আফিমস্বরূপ। যদি ধর্ম পোশাক হয়, তাইলে একজন নিত্যনতুন পোশাক পরিবর্তন করতে চায় তো করুক না! আফিমের ব্র্যান্ড বদলাইলে কী-এমন সমস্যা! খাপ্পা হবার কী আছে তাতে আপনার-আমার? প্রেম ও শরীর হাসিলের জন্য তুচ্ছ ধর্ম ফুঁ করে উড়িয়ে দিলেই-বা কার কি আসে-যায়? এইটা তো আর রক্তসংবহনতন্ত্র বা হৃৎপিণ্ড নয়কো। লোকে তো ওইসবও প্রেমের জন্য কুর্বান করিয়া দেয়।
এই সমস্তই থিতু হবার পরের চিন্তাভাবনা। কিন্তু মজা তো হয়েছে আরও অনেককিছু। তখন অবশ্য পীড়নকর ছিল ঘটনাগুলো, মজা টের পেয়েছি অনেক পরে। কে বলে যে স্মৃতি তুমি বেদনার? স্মৃতি সততই সুখের। এমনকি সবচেয়ে বেদনাবহ অভিজ্ঞতাও একসময় গল্পযোগ্য রোমন্থনের স্মৃতি হয়ে ওঠে। এমনকি মাতৃ-পিতৃমৃত্যুর শোকাবহ ঘটনাও একসময় স্বাভাবিক স্মৃতিগল্প হয়ে ওঠে। সেসব কথায় একটু পরে আসছি।
সাতবাজারে ফাতনা ডোবাই
বাউল যেমন ডোবান খালি
পড়লে প্রেমে ডিগবাজি খাই
আর খেয়ে যাই ওদের গালি।
কোনো-এক ইন্টার্ভিয়্যুতে পড়েছিলাম, আহমদ ছফা বলছেন, এদেশের প্রতিক্রিয়াশীলরা খাঁটি নির্ভেজাল প্রতিক্রিয়াশীল, অন্যদিকে কথিত প্রগতিশীলরা ভেজালযুক্ত প্রগতিশীল। প্রতিক্রিয়াশীল সম্পূর্ণাঙ্গ, প্রগতিশীলরা আধাখেঁচড়া খণ্ডিত ও অপূর্ণাঙ্গ। ছফা আরও বলছেন, প্রসঙ্গক্রমে, একজন প্রতিক্রিয়াশীল ১০০ ভাগ প্রতিক্রিয়াশীল, অন্যদিকে একজন প্রগতিশীল ৬০ ভাগ প্রতিক্রিয়াশীল এবং ৪০ ভাগ কথিত প্রগতির উপাদান-অনুপান সম্বলিত এক দো-আঁশলা প্রজাতি। কৃষ্ণের জীব, সোজা বাংলায় গরু, বোধহয়, এদেরেই বলে। এবং প্রতিক্রিয়াশীলগুলোকে গোখরো ছাড়া আর-কিছু বলবার যৌক্তিকতা আছে? অ্যানিওয়ে। ২০০০ সালে সংঘটিত সুমনকাণ্ডের সময় এই ইন্টার্ভিয়্যুটা, আহমদ ছফার ওই পর্যবেক্ষণটা, মনে পড়ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, উভয়-সাম্প্রদায়িক বন্ধুদের সুমনাভিমান থেকে, ছফাবর্ণিত পর্যবেক্ষণের যাথার্থ্য। প্রগতিশীল ও প্রগতিশ্লীলতা কাকে বলে টের পেয়েছি তখন হাড়ে হাড়ে। এত অশ্লীল লেগেছিল গোটা ব্যাপারটাই যে এখনও মনে পড়লে বিবমিষা জাগে। পেয়েছি সেইসময় হাতেনাতে প্রগতিশীলতার উদাহরণসমেত প্রমাণ। অধুনা ফেসবুকদশকে এসে এক্সপেরিয়েন্স সম্প্রসারিত হয়েছে বেশ। মনে হয় দেখেটেখে যে এখন আমরা আহমদ ছফা ক্যাল্কুলেটেড ষাট ভাগটাকে একশ ভাগে এক্সপ্যান্ড তথা উন্নীত করতে পেরেছি।
তো, যা বলছিলাম, সুমনকে কেউ ওইসময় শেল্টার দেবে এমনটা ভাবার মতো স্পর্ধাও কোনো হতচ্ছাড়ার ছিলনাকো। সময়টা, আবারও বলি, নাইন্টিসের এন্ডিং। গোটা ওই দশক জুড়ে ইন্ডিয়ায় যেই তাণ্ডব ঘটেছে, যেই প্রলয়প্রেতনৃত্য সংঘটিত হয়েছে, এর তুলনীয় কিছু ভবে বিরল। শুধু বাবরি মসজিদ ভাঙাভাঙির হনুমানসেনাতাণ্ডব মনে করেই পগারপার হবেন না অনুরোধ রইল। অবশ্য ওই দশকেই বলি কেন, দশকে দশকে সেদেশে এমন সম্প্রদায়নিধন সচল, তবু তারা “সারা-জাহাঁ-স্যে আচ্ছা”। আস্ত দুনিয়ায় এক-শতকে যা সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, আনফর্চুনেইটলি, ইন্ডিয়ায় সেই ফিগার ক্রস করে যায় এক-দশকেই। বাবরি মস্ক প্রভৃতির জের তো অনেকদিন চলেছে, শেষমেশ ২০০২ সনে নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে একটা শান্তিপূর্ণ মুসলমান-সংখ্যালঘু কচুকাটা সম্পন্ন হয়েছে গুজরাটে, এবং মোদী রিওয়ার্ডেড হয়েছেন সেজন্যে ২০১৪ সনে এসে। এর আগের রায়টগুলোর স্মৃতিহিসাব না-উঠাই আলাপে। এইটা সম্ভব হয়েছে ইন্ডিয়া একটা বৃহৎ গণতন্ত্রের মহাদেশ বলেই, তিমিমাছের ন্যায় বৃহৎ ডেমোক্রেসির তামাশা আমি নিজে দেখেছি দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে সেবারকার ইন্ডিয়ার নির্বাচনপূর্ব পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্শন নজর করে যেয়ে, দেখেছি কী তুঙ্গ ও তুমুল মোদীসমর্থন, গণহত্যার দগদগে এই-সেদিনকার স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে যারা মোদীবিরোধিতা করেছেন, তারা আক্রান্ত হয়েছেন গণপাঠকের কমেন্ট-ব্যালাস্টিক মিসাইল দ্বারা। আনন্দবাজার অনলাইন ভার্শনের কলামগুলো আমি নিয়মিত নিবিড়ভাবে দেখে গেছি কেবল বড়-গণতন্ত্রের পাঠ গ্রহণকল্পে। সেখান থেকে একটা অভিজ্ঞতা কেবল টুকে রাখি এখানে।
যেমন, অমিতাভ গুপ্ত ‘অনর্থনীতি’ শিরোনামের ব্যানারে একটা কলাম লেখেন আনন্দবাজারে। সেইসময় লিখতেন নিয়মিতভাবে। এখনও কন্টিনিউ করেন কি না জানি না, আনন্দবাজারে ঢুঁ দেই না বহুকাল হয়, সেই নির্বাচনতোড়জোড়ের সময় লিখতেন মনে আছে। সেখানে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজের অভিজ্ঞতাপ্রাণিত ও বিবেকতাড়িত হয়ে প্রায় পিটিশন করে গেছেন বড়-গণতন্ত্রমনা ভারতীয়দের দরবারে এই ঘোষিত গণহত্যাকারীকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য। অমিতাভবাবু একসময় নাচার হয়ে এই রিক্যুয়েস্টও করেছেন যেন বিজেপি অন্তত মোদীকে এক্সক্লুড করে অন্য ক্যান্ডিডেট দ্যায়। কেউ নড়ে নাই এই কথায়। রিডার্স-রেস্পোন্সের জন্য বরাদ্দকৃত কমেন্টবক্সে একটা মানুষও নজরে ঠেকে নাই যে অমিতাভবাবুকে এহেন মোদীবিরোধিতার জন্য তুলকালাম গঞ্জনা-গালিগালাজ করছে না। একটু সুপ্ত ও জনদরদী-মানববাদী ভীতু প্রতিক্রিয়াশীল যারা, তারা বলেছেন : একযুগ আগে কে কী করেছে, তা দিয়া কারো বর্তমান বিচার করতে যাওয়া বাতুলতা। তারা বলেছেন, মোদী কেন, দুনিয়ার অনেক বড় বড় দরবেশ-মহামানুষেরা আর্লি লাইফে ভুল করেছেন, তাতে করে তাদের মহামানব হওয়া আটকায়নি। তারা টেনে এনেছেন রত্নাকর দস্যু তথা বাল্মিকী মিথ। বলেছেন তারা, বার্তামাধ্যমে-টেলিভিশনে সেইসময় মোদীবাবু উন্মত্ততা প্রকাশ করেছেন ঠিকই কিংবা তার গণহত্যাসম্পৃক্ততা তথা হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানের প্রমাণও দুনিয়ার সার্ভারে সঞ্চিত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু গত এক-দশকের তার কাজের গ্র্যাফ দেখে তাকে বিচার করা কর্তব্য, মোদীকে এখন ভারতমাতার দরকার, তা সে গণহত্যাকারী হইলেও।
খোদার কসম, এই কথাগুলো অসংখ্য মানুষের মুখে আমি শুনেছি ইন্ডিয়ান অনলাইন জর্নালগুলোতে। এই অসংখ্য মানুষের ভিড় থেকে দৈবচয়ন তরিকায় অনেকের ফেসবুকপ্রোফাইলে যেয়ে দেখেছি এরা আমাদেরই মতো ভালো ম্যুভি দেখে, ভালো বই পড়ে, ভালো কোটেশন গুঁজে রাখে ফেসবুকটাইমলাইনে, ভালো পোলিটিক্স-লিডারদের আদর্শ জ্ঞান করে। খোদার কসম, জান্, আমি ভালোবাসি তোমায়, যে-তুমি ক্যানাডায় থাকো, বুড়িয়ে গেছ ইত্যবসরে, যে-তুমি শিখ হত্যাযজ্ঞের কালে হারিয়েছ উচ্চশিক্ষিত সংস্কৃতিমনা বাপ-ভাই-মা-বোন সহ পরিবারের সাতজনকে কেবল শিখ হবার অপরাধে, যে-তুমি অমিতাভ বচ্চনের ছিলে একনিষ্ঠ ফ্যান, ওই নিধনযজ্ঞের বিভীষিকা চলাকালে রাষ্ট্রযন্ত্রের বড়ছেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমিতাভ সদম্ভ ধর্মজোশ ও জজবাতাড়িত গলায় টেলিভিশনে এসে হুহুঙ্কার বলেছিলেন “খুন-কা বদলা খুন!” — বুড়ো বয়সে এসে সেই একাকিনী নারী ইন্টার্ভিয়্যুতে বলছেন, তিনি এরপর থেকে তার এককালের জানেমন অমিতাভ বচ্চনের দুনিয়ামাতানো মধুস্বর দূর থেকে শুনলেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বলেছেন তিনি — রাষ্ট্রযন্ত্র বা সুদর্শিনী ইন্দিরা নয় — এরপর থেকে জীবনভর তার মনে হয়েছে, “কাভি কাভি ম্যেরে দিল্ ম্যে খায়াল আ-তা হ্যায়”, এই লোকটাই তার বাপ-ভাই-মা-বইন হত্যার হোতা। ছিঃ! এইভাবে বলতে নেই, প্রিয়তমা! এভাবে কাঁদে না! মাই ল্যভ! সুশীল সমাজের খেয়াল এসব, ধরতে নেই, মনে রাখা মানা। কাভি কাভি তাদের ইস্তারা-স্যে খ্যেয়াল আ-তা হ্যায়। এদেশে, ওদেশে, সেদেশে, এখানে, ওখানে, কমিবেশি সবখানে, একই চিত্র। খোদার কসম, জান্, আমি ভালোবাসি তোমায় — এইটাও, মর জ্বালা, সুমনেরই গান — যে-তুমি প্রিয়জন হারানোর শোক সামলে উঠলেও দুঃস্বপ্নস্মৃতি ভুলিয়া যাও না।
যা-হোক, এই নিবন্ধ ড্রাফ্টকালীন পথিমধ্যে পড়ে এলাম ফ্র্যান্সিস ফোর্ড কপোলার ইন্টার্ভিয়্যু — মারিও পুজো-র উপন্যাস অবলম্বনে সেই মাস্টার্পিস ম্যুভি ট্রিলজির মেইকার, আহা, সেই ওমার শারিফ আর আল পাচিনো — ওইখান থেকে নগদে একটা কোটেশন মারি : উই লিভ ইন অ্যা ওয়ার্ল্ড অফ ইনক্রেডিবল কন্ট্র্যাডিকশন্স দ্যাট এভরিওয়ান অ্যাক্সেপ্টস্। সেইটাই। এইটা খাপ-খাওয়ানো বুদ্ধিজীবীজিঘাংসার কাল। ওহো! কতদূর আর! এই নিবন্ধনোটক গোবেচারারে দেখি যমেও লয় না! শালা! যা-হোক। আল্লা, গানে ফেরাও মোরে এইবারে! অ্যানিওয়ে। ফ্র্যান্সিস কপোলার ইন্টার্ভিয়্যুটা ছাপানো রয়েছে ‘দ্য টক’ ওয়েবম্যাগে।
…
এই নিবন্ধ অসমাপ্ত, অর্ধরাস্তা পারায়া ব্যাহত, অকস্মাতের কোনো অপরূপ যোগসাজশের অপেক্ষায় বেশ বহুকাল কাটায়া ফাইন্যালি ইনকমপ্লিট অবস্থায় ছেড়ে দিতে হলো। উপরের পাঁচটা পার্টে এই নিবন্ধটা সামাজিক মিডিয়ায়, মানে ফেসবুকে, সেইসময়কার ট্রেন্ডি নোটস অপশনে পরপর পাঁচটি পৃথক কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিত নোটের আকারে লেখা হয়েছিল। অভিপ্রায় ছিল রচনাটাকে একটা আনুবোধনিক পরিণতির দিকে নিয়া যাওয়া। তা আর কল্পনার অনুসারে করা যায় নাই। ইতোমধ্যে কেটে গেছে একটা আরও দশক। দুইহাজারচোদ্দয় লিখেছিলাম দুইহাজারচার ও তৎপূর্বকালের স্মৃতি নিয়া। আধাপথে সেই যে থেমেছে লেখনী, লিখনপ্রবাহ, ফিরবার আর নাম নাই। তারপর দুইহাজারচব্বিশ যায়। দেশকাল ধর্মাধর্ম ধুলায় ফালায়া ফালাফালি করা হাসিনার পলায়নের হাওয়ায় খিলখিল হাসির কালও ফুরায়। এইবার দুইহাজারচোদ্দ ও চব্বিশের পরবর্তী লিখনপ্রবাহে সেই নিবন্ধশৈলী ফিরবে না আর ধরেই নিয়েছি। নিবন্ধনিহিত কণ্ঠটি ফিরাইবার কম কসরত করি নাই। বৃথাই। সিমিলার অভিজ্ঞতার অর্ধসমাপ্ত রচনা আরও যত রয়েছে, অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে ডিসিশন নিসি, অ্যাজ ইট ইজ রেখে একটি প্রি অথবা পোস্ট স্ক্রিপ্টাম জুড়ে দিয়ে ছেড়ে রাখব। কোনো রচনাই সমাপ্ত নয়। কিছু কিছু রচনা আছে যেগুলো শুধু সমাপ্ত বলে মনে হয়। কিন্তু অর্ধসমাপ্ত এই নিবন্ধে যেই জিনিশটা আমি এক্সপ্রেস করতে চেয়েছিলাম, যেই বিমূঢ় অসহায় বিস্ময়, সেইটা আমি রিডারদেরে পার্সিভ করাইতে পেরেছি বিশ্বাস করতে চাই। বিগ কোনো ডিল তো আর নয়। একই স্মৃতি দিয়া তাড়িত হতে হয় একেকজনেরে একেকভাবে একেকসময়। আমি স্পৃষ্ট হয়েছি দ্বিসহস্রাব্দগোড়ায় ইন্ডিয়ার চালানো গুজরাট গণহত্যায়। যেন চক্ষের সামনেই ক্লিনজিং কী করে এক্সিকিউট করতে হয় এর নজির দুঃস্বপ্নে দেখে উঠলাম। নব্বইয়ের দশকের বাবরি মসজিদ কেন্দ্র করে যেই মিহি কায়দায় ম্যাসকিলিং ও ম্যাসিভ রায়ট সংঘটিত হয় সেই দাগ আরও বড় হয় গুজরাট কিলিঙের সময়। নিবন্ধে সেসব খুব তথ্য-উপাত্ত দিয়া প্রামাণিক করবার কোশিশ গরহাজির হলেও অভিঘাতটা হাজির। সবচে বেশি হাজির নিবন্ধকারের প্রতিক্রিয়া। আবেগিক, বা মানসিক, প্রতিক্রিয়া। আর, গল্পচ্ছলে এই নিবন্ধ আগায়েছে একটা ব্যক্তিক গল্প বলার গরজেই। কিন্তু কনক্লুড করা যায় নাই। কী আর করা। আর রচনাটা একজন সংগীতকার ফোকাসড হলেও সংগীত নিয়া আলোচনার রচনা এইটা না। আলগ বিষয় এর আলোচ্য। তবে এই বিষয়ে এই নিবন্ধগুচ্ছ রচনাসালের পরের এক অধিক দশকে খোদ কবীর সুমন অনেক বলেছেন। রচনায়, হাজিরায়। সেখানে এত গল্প মিলেছে যে এইগুলো ফলো করে কেউ কোটআনকোট বাঙালি বস্তুটার অগ্রসরতা আর অনগ্রসরতার নজরানা বাইর করতে পারবে। কাজেই, অসমাপ্ত হলেও গল্পটা পাঠক ধরে ফেললেই হলো। গল্পটা আজও তথৈবচ। অধীত বিদ্যা, অর্জিত জ্ঞান আর আচরিত ধর্মই ফিরবে আমাদের যাবতীয় রচনায়। আমাদের রচিত সমস্ত শিল্পকল্পগল্পকলায়। আমরাই রয়া যাই। যা, যে, যেমন। রচনাগুলি চিহ্নবাহক। সময়ের। সওয়ারির। এই রচনায় ব্যবহৃত কবিতাউদ্ধৃতিগুলি দেশ পাক্ষিকে ছাপা-হওয়া কবীর সুমনের যুগল-কবিতা থেকে নেয়া। হাতের কাছে সেই পাক্ষিকটি ফিরে পেলে এই দুই কবিতার পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দেখা যাবে। এই নিবন্ধের, এই গল্পের, লুপ্ত প্রবাহ ও অস্পষ্ট কণ্ঠ পুনরায় একদিন যদি ফিরিয়া পাওয়া যায়।
জাহেদ আহমদ ৩১ জুলাই ২০২৫
*ব্যানারে ব্যবহৃত কবীর সুমনের পোর্ট্রেইট করেছেন শিল্পী আরিফ ইকবাল
- কবীর সুমন ও অন্যান্য কলহ - July 31, 2025
- সহসা সুমন - July 22, 2025
- জন্মদিন, মৃত্যুদিন ও অন্যান্য অবসিন - July 11, 2025
COMMENTS