ঋতুবৈচিত্র্য ও জৈবনিক চাকা  || ফাইয়াজ বিন নুর

ঋতুবৈচিত্র্য ও জৈবনিক চাকা  || ফাইয়াজ বিন নুর

গুরু এবং তার এক শিষ্যের জীবনকাহিনি প্রদর্শনের মাধ্যমে এর পরিচালক কিম-কি-দুক তার স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার অ্যান্ড স্প্রিং  চলচ্চিত্রে মানুষের বাস্তব জীবনের নানান দিক দর্শকের কাছে তুলে ধরেছেন। শুরু থেকেই দেখা যায় শিশুটির আস্তে আস্তে বড় হওয়া এবং তার সাথে ঘটে চলে অনেক ছোট ছোট ঘটনা যেইসবের বিশ্লেষণ খুঁজতে গেলে উঠে আসে মানুষের জীবনের বাস্তব গল্পগুলো।

একদম শৈশব বয়সে ম্যুভির একটা জায়গায় দেখানো হয় শিষ্য পানিতে থাকা একটি মাছ, একটি ব্যাঙ এবং একটি সাপ ধরে সেগুলোকে দড়ি দিয়ে ইট বেঁধে আবার ছেড়ে দেয়। ঘটনাটি তার গুরু নিজচোখে দেখে এবং বিষয়টি খুব দুঃখজনক মনে হয় তার কাছে। পরদিন ঘুমন্ত অবস্থায় গুরু তার শিষ্যের বুকের সাথে ইট বেঁধে দেয় যেমনটা সে বেঁধে দিয়েছিল সেই প্রাণিগুলোর সাথে। কিম-কি-দুকের ইট বেঁধে দেয়ার দৃশ্যপটটির বাস্তব চিন্তাভাবনা এখানে এভাবে প্রকাশ পায় যে, প্রাণ থেকেই প্রাণি, আর প্রাণি হয়ে অন্য প্রাণে ব্যথা দিলে সেই ব্যথা নিজের বুকেও বয়ে নিয়ে চলতে হয় সারাজীবন।

স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার অ্যান্ড স্প্রিং চলচ্চিত্রে ডিরেক্টর চারটি ধাপে মানুষের জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং পরে আবার স্প্রিং দিয়ে শুরু করেছেন সেই চক্রটি। এই চারটি ধাপ অথবা চক্রটির সম্বন্ধে চলচ্চিত্রালোচক মাসুদ পারভেজ তার ‘চলচ্চিত্রনামা’ বইটিতে বেশ সুন্দর করেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “জীবনে দুঃখ আছে / দুঃখের কারণ আছে / দুঃখের নিবৃত্তি আছে / দুঃখনিবৃত্তির পথ আছে।”

চলচ্চিত্রের শেষ পর্যায় অর্থ্যাৎ স্প্রিং,  যেখানে শিষ্যটি তার গুরুর জায়গাতে পদার্পণ করে, যার মাধ্যমে স্প্রিং সামার চক্রটিরও-যে কোনো শেষ নেই মানবজীবনে, বুঝিয়ে দিলেন ডিরেক্টর কিম। জন্মের পর থেকে মানুষ সুখের খোঁজে সারাক্ষণ দুঃখ বয়ে নিয়েই চলে যেটা প্রকাশ পায় প্রাণিগুলোকে আঘাত করার জন্যে শিষ্যের বুকের সাথে গুরুর ইটখানা বেঁধে দেয়ার দৃশ্য দিয়ে দর্শকের কাছে।

চলচ্চিত্রে প্রকৃতির কিছু লীলাখেলাও লক্ষ করা যায় গুরুর কাছে নিয়ে আসা অসুস্থ মেয়েটির ক্রমে সুস্থ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। শিষ্যের সাথে মেয়েটির ভালোলাগা শুরু হওয়া এবং শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার মাধ্যমে আরেকটি ভিন্নরকম চিত্র ফুটে ওঠে চলচ্চিত্রে, মেয়েটিকে হারিয়ে গুরুকে ত্যাগ করা, সমাজে বসবাস করতে গিয়ে নিজের বউকে পরকীয়ায় লিপ্ততার জন্যে হত্যা করে আবার গুরুর কাছে ফিরে আসা, কাহিনি অনেকটা ভিন্ন মনে হলেও সব একই সূত্রে গেঁথে রাখা। মোট কথা স্প্রিং সামার ফল-এর চক্রটি চলচ্চিত্রে ঘটে-যাওয়া সব ঘটনাবলির মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে যায় শেষ অব্দি।

চলচ্চিত্রটিতে বৌদ্ধ ধর্ম আর সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ চমৎকারভাবে এসেছে।  বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কটির তাৎপর্য অনেক গভীরে এবং এই কথাটা সিনেমাটা দেখতে দেখতে আরেকবার উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু সিনেমাটা আদৌ ধর্মীয় কোনো কূটকচাল নিয়ে নয়। বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রনির্মাতা কিম-কি-দুকের সেরা কাজগুলোর মধ্যে এই সিনেমা গ্রাহ্য হয়ে থাকে ক্রিটিকদের কাছে। এই সিনেমা তার দর্শকদের ভাবায়, জীবন সম্পর্কে, — জীবনের সুর, সার ও অসারতা সম্পর্কে।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you