কুন্দনলাল || রাখাল রাহা

কুন্দনলাল || রাখাল রাহা

সায়গলের প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড বিক্রি হয়েছিল পাঁচ লক্ষের অধিক। সায়গল কে? এ সময়ের শিল্পী-শ্রোতা হয়তো অনেকের কাছেই নামটা অচেনা! কুন্দনলাল সায়গল। তিনি হলেন সেই শিল্পী যাঁর সম্পর্কে কাননদেবী বলছেন, “সায়গলের গান টেক হচ্ছে শুনলে মেক-আপ রুমে থাকলেও ছুটে যেতাম। সব কাজ ফেলে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম ওঁর গান।” এই মুশকিল! কাননদেবী আবার কে? তিনি সবাক সিনেমার প্রথম যুগের সুপারস্টার নায়িকা-গায়িকা।

আমার ধারণা এতেও হবে না। আরো এগিয়ে যেতে হবে। বলতে হবে, সায়গল হলেন তিনি, যাঁর গান শুনে ছোটবেলায় লতা মঙ্গেশকর স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে তাঁকে বিয়ে করবেন। আর সে-যুগের সুপারস্টার নায়িকা-গায়িকা সুরাইয়া একটি সিনেমায় সায়গলের সাথে ডুয়েট গান থাকায় তার রেকর্ডিং নিয়ে এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে শেষমেশ সংগীতপরিচালক এগুলো বাদ দিয়ে দু’জনের জন্য আলাদা আলাদা ৪টি করে গান তৈরি করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে তাঁর কণ্ঠ নিয়ে অনেক কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে। তিনি নাকি আগ্রা ঘরানার সম্রাট ফৈয়াজ খাঁর কাছে গান শিখতে গিয়েছিলেন। তো খাঁ সাহেব তাঁর গান শুনে নাকি বলেছিলেন, “তুমি যেমন গান করো, তোমাকে তালিম দিয়ে এর চেয়ে ভালো গায়ক করে দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই।” আর সায়গলের ঠুংরি অঙ্গের গান শুনে কিরানা ঘরানার সম্রাট আবদুল করিম খাঁ নাকি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।

kundan lalবলা হয়, সায়গল-পরবর্তী গত শতাব্দীর সব প্লেব্যাক সিঙ্গারই সায়গল-প্রভাবিত। অথচ বাংলা-হিন্দি-উর্দু-তামিল মিলিয়ে দু’শো গানও তিনি গেয়ে যেতে পারেননি।

সায়গল জন্মেছিলেন জম্মুতে। পড়াশোনার ধার নেই, মন্দিরে গিয়ে কীর্তনে বুঁদ হয়ে থাকতেন। কিশোর বয়সে এ নিয়ে বাবার সাথে মনোমালিন্য। শেষে গৃহত্যাগ। এরপর রেলওয়ের টাইমকিপার, হোটেলের বেয়ারা, ইত্যাদি। এভাবেই রেমিংটন কোম্পানির টাইপরাইটারবিক্রেতা হিসাবে কোলকাতায় আগমন।

এখানে এসে ঘটনাচক্রে নিউ থিয়েটার্স সিনেমা কোম্পানির কর্তাদের সাথে পরিচয়। তাঁর অপূর্ব কণ্ঠ শুনে একবারে নিউ থিয়েটার্সের নায়ক! যেহেতু তখনও সিনেমার প্লেব্যাকযুগ শুরু হয়নি, তাই সে-সময় নায়ক-নায়িকার গান জানা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সে অভিনয়ের কিসসু জানত না। তাঁর গানই বাজিমাত করে দিয়েছিল। এটা কোম্পানির মালিক বি এন সরকারের মত।

কিন্তু সায়গল কখনো প্রথামতো গুরু ধরে গান শেখেননি। অথচ সাবলীলভাবে বিভিন্ন রাগে বিচরণ করতে পারতেন। তাঁর প্রসঙ্গে সুরকার ও সংগীতপরিচালক নৌশাদের স্মৃতি : একবার এক লাইটম্যান তার মেয়ের বিয়েতে সায়গলকে দাওয়াত করেছিল। সায়গল কথা দিয়েছিলেন যাবেন। কিন্তু সেদিন তাঁর এক মাহফিলে গাওয়ার কথা ছিল পঁচিশ হাজার টাকায় (গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের পঁচিশ হাজার!), তিনি এটা ভুলে গিয়েছিলেন। সায়গল কিন্তু সেই প্রোগ্রাম না করে দিয়ে লাইটম্যানের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন। গিয়ে সারারাত ধরে গান গেয়েছিলেন।

অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, তিনি গাড়ি থামিয়ে শীতে-কাঁপতে-থাকা রাস্তার মানুষকে নির্দ্বিধায় খুলে দিতে পারতেন গায়ের কোট। পকেটে-থাকা সব টাকা তুলে দিতে পারতেন অসহায় মানুষের হাতে। এমন সুখী মানুষেরও দাম্পত্যে অসুখ ভর করেছিল। শেষে ভালোবেসেছিলেন এক নামী অভিনেত্রী-নৃত্যশিল্পীকে। কিন্তু মোহভঙ্গ হয়েছিল শীঘ্রই। সেই যন্ত্রণায় অস্বাভাবিক জীবন বেছে নিয়েছিলেন।

মাত্র ৪২ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যান সায়গল। এর মধ্যে ১২ বছরের সিনেমা-সংগীত জগতে মাত্র ১৩০টি গান। কিন্তু উপমহাদেশের সিনেমা ও গানের আলোচনা করতে হলে তার একটি পর্ব সায়গলযুগ নামে টানতে হয়।

… …

রাখাল রাহা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you