সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হলেই সবার মনে নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের লেখা পড়ার আগ্রহ জন্মায়। কিন্তু কোনো কোনো সময় সাথে সাথে ঐ লেখকের বই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। মূল বই সংগ্রহ করে তার অনুবাদ প্রকাশ করতে করতে প্রকাশকদের মাসখানেক সময় লেগে যায়। এ বিবেচনায় এবারের নোবেলজয়ী লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের ২০১৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাসিকা চেজিং হোমারের প্রথম অধ্যায়টি প্রকাশ করলাম। অনুবাদ হয়তো ততটা ভালো হয়নি। তবে এটি পড়লে তাঁর লেখা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে। চাইলে পরের অধ্যায়গুলোও পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। — অনুবাদক

খুনিরা আমার পিছু নিয়েছে, রাজহাঁস নয়—অবশ্যই নয়, আমি জানিই না কেন রাজহাঁস বলেছিলাম; না, ভেড়া নয়, কবুতরও নয়, এমনকি ড্রাগনফ্লাইয়ের ঝাঁকও নয় এবং এসবকে আমি মোটেও পাত্তা দিই না; মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, এজন্যই এখন নিজেকে বারবার বলি—খুনি, রাজহাঁস নয়। এটা এমন এক বাক্য, যা আমার মনে বারবার হানা দেয়, কারণ মাঝেমধ্যে—যদিও সবসময়, কিন্তু তবুও—আমি মনোযোগ হারিয়ে ফেলি, এক মুহূর্তের জন্য, অথবা, দুই মুহূর্তের জন্য, তার বেশি নয়। কিন্তু ওই অল্প সময়েই মনটা অন্য দিকে চলে যায়, বিশেষ করে যখন কোনো বাসস্টপের বেঞ্চে বসে সামান্য বিশ্রাম নিই, কিংবা কোনো ফোয়ারার পাশে পর্যটকদের ভিড়ে মিশে যাই। তখন এ-কথা বলে নিজেকে জাগিয়ে তুলি—খুনি, রাজহাঁস নয়—তখন আবার মনোযোগ ফিরে আসে, চোখ ফের তীক্ষ্ণ হয়, কান ফের সজাগ হয়ে ওঠে। মানে, আমি নিঃসন্দেহে বুঝতে পারি তারা কাছে এসেছে কি না। এমন না যে তাদের আমি দেখতে পাই বা শুনতে পাই, আমি কখনো কাউকে দেখিনি, কারো কথাও শুনিনি—তবু আমার চোখ, কান, এমনকি, হয়তো নাকও এখনো পুরোপুরি কাজ করছে। সকল ইন্দ্রিয়ই এখনো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আমাকে জানতে হবে তারা কাছে আসছে কি না, কারণ আমাকে খোঁজা হচ্ছে, তারা আমাকে মেরে ফেলতে চায়। এটা আমাকে মনে রাখতে হবে, সবসময়, কোনো অবস্থাতেই নিজেকে আশ্বস্ত করা যাবে না এই ভেবে যে, হয়তো এখানে—কোনো এক জায়গায়, কোনো এক সময়ে—আমি বিশ্রাম নিতে পারব। তীক্ষ্ণ বিপদের আভাস ক্ষণিকের জন্য ম্লান হলেই ভাবা যাবে না যে, বিপদ কেটে গেছে। বিপদ সবসময়ই আছে, চারদিকে, সর্বত্র। নিজেকে বারবার মনে করাতে হয়, হয়তো তারা অপেক্ষা করছে ঠিক এমন অলস মুহূর্তগুলোর জন্য, মনোযোগ হারানো এই ক্ষণগুলোর জন্য। যদিও এটা সম্ভব—তাদের যুদ্ধকৌশল, তাড়া করার পদ্ধতি, আর বিশেষ শিকারের ধরন আমার কল্পনার একেবারেই বাইরে—তবু হতে পারে, তারা কেবল আমার দুর্বল মুহূর্তগুলোকেই নিশানা করছে। হ্যাঁ, সম্ভবত তারা এটাই চায়, অমন দুর্বল একটা মুহূর্তেই তারা আমাকে ধরে ফেলতে চায়, আর তখনই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তারা আমাকে ধরার জন্য বের হয়েছে বলে এটা নিয়ে মস্করা করা হাস্যকর হয়ে যাবে। না, শুধু হাস্যকর না, কাপুরুষোচিতও হয়ে যাবে বটে। এমন মস্করা অর্থহীন, যখন আমি জানি, নিঃসন্দেহে জানি, তারা আমাকে খুন করতে এসেছে। সংক্ষেপে বললে এটাই সত্য—তারা ধৈর্যের খেলা খেলছে, অনেক উঁচু অবস্থানে থেকে তারা এক প্রাণঘাতী খেলায় মেতেছে। যদিও এটাও সম্ভব যে তারা এটাকে পুরোপুরি এক ইঁদুর-বিড়াল খেলা বানিয়ে ফেলেছে। তাদের ধৈর্য আছে, প্রয়োজনের চেয়েও বেশি। এতদিন ধরে, আজও তারা থামেনি। না, এক মুহূর্তের জন্যও তাদের মধ্যে আমি ক্লান্তির ছাপ দেখিনি। ওরা ক্লান্ত হয়ে গেলে আমি বুঝতে পারতাম যে, হুম, তারা ব্যাপারটা নিয়ে কেবল মজা করছে, তবে নিছক মজা হলেও এতক্ষণে সেটা অনেক হয়ে গেছে, এবার তারা আমাকে ধরবে, ঝুলিয়ে দেবে, আমার পেট চিরে ফেলবে, মাথা কেটে ফেলবে, হৃদয় ছিঁড়ে ফেলবে—তারা এসব করবে শুধুমাত্র আমাকে শেষ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু না, আমি তাদের মধ্যে এমন কোনো অস্থিরতা দেখি না, বরং একদম উল্টোটা ঘটছে, যদিও আমি জানি তারা কখনোই থামবে না। মনে হচ্ছে তারা আদেশ পেয়েছে আমাকে দ্রুত শেষ না করার, তাড়াহুড়ো না করার, আদেশ পেয়েছে নিরন্তর তাড়া করার আর চোখের আড়াল না করার। শেষ মুহূর্তে আমাকে মেরে ফেলার চাইতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে চলমান এই অনুসরণে—আমাকে সর্বদা নজরে রাখা, ছায়ার মতো লেগে থাকা, আমার এই জীবনটাকে অবিরাম নিপীড়নের ভেতর রাখা, একদিন যখন—যদি তারা আমাকে ধরতে পারে—এই জীবন, আমার জীবন, আমার কাছ থেকে চিরতরে ছিনিয়ে নেবে।
লেখক কয়েস সামী ফিকশনরাইটার ও ট্র্যান্সল্যাইটার, থ্রিলার ঘরানায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য অরিজিন্যাল কাজ, পেশায় ব্যাঙ্কার
- রিপ্রিন্ট রিফ্রেশিং - November 7, 2025
- কোচবিহার ও আব্বাসউদ্দীন - November 7, 2025
- দেবেশ রায়ের ফ্যাসিবাদের বিত্তান্ত - November 6, 2025

COMMENTS