মেসি : মহাকালের মায়া, নৈশব্দের রেফিউজ || হাসান শাহরিয়ার

মেসি : মহাকালের মায়া, নৈশব্দের রেফিউজ || হাসান শাহরিয়ার

শেয়ার করুন:

৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫। বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে-পাঁচটা। আলোকসজ্জার ক্রন্দনে, বিরহের উৎসবে দুলতেছিলো এস্তাদিও লা’মনুমেন্তাল। আর্জেন্টিনার ঐতিহাসিক ফুটবল স্টেডিয়াম। উৎস লায়নেল মেসি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার। দেশের মাটিতে ন্যাশনাল টিমের হইয়া খেলবেন নিজের শেষ খেলা। আপাতত এইটাই ছিল সমস্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খবর। সম্ভবত মহাবিশ্বের সবচেয়ে করুণ রেজোন্যান্স। যেহেতু বিদায় নিতে হয় সবাইরে। বিদায় দিতে না চাওয়ার বেদনা মাইনা নিয়াই। যেহেতু রুহের মুহূর্তসম বস্তুগত উপস্থিতি শেষ পর্যন্ত একটা ধোঁকাবাজি। কার সাথে? এই বস্তুময় মুহূর্তসবের আর্তনাদের সাথে।

আর্জেন্টিনায় তখন আগেরদিন রাত আটটা। ত্রিশমিনিট পরে শুরু হবে লাতিন আমেরিকার সিন্ড্রেলা—রেড-ওয়াইন ‘লা ভিনোতিন্তো’ ভেনেজুয়েলার সাথে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের নিয়মরক্ষার ম্যাচ। যেহেতু ইতিমধ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করছে নাম্বার-ওয়ান পজিশন দখলে রাইখা। তবুও এই ম্যাচ সমস্ত আর্জেন্টিনার সাথে গোটা পৃথিবীর এক অপেক্ষার ম্যাচ। এই ম্যাচ এমন-এক মুহূর্ত—যেইখানে নশ্বরতার কাছে মানুষের পরাজয়—অবিনীত কারসাজি হিসাবে ফের হাজির হয়। নির্দয়ভাবে।

মেসিদের ওয়ার্ম-আপ শুরু হইলো। চারপাশে তীব্র আলোকসজ্জার মাঝে শুধু মেসি-মেসি ধ্বনি। আর্জেন্টাইন ফুটবলঈশ্বর ম্যারাডোনার পাশে মেসির দীর্ঘ ব্যানার। ফেস্টুনে ফেস্টুনে লেখা—গ্রাসিয়াস মেসি নাম্বার টেন। আনন্দাশ্রুতে মুখরিত মনুমেন্তালের সাতাশি হাজার জোড়া-চোখ। কান্না প্রচন্ডভাবে সংক্রামক। যেইভাবে হাসি। দেখলাম দর্শকদের তুমুল মেসি-মেসি মেঘনাদে স্বয়ং মেসি ধরাশায়ী। ওয়ার্ম-আপ করতেছেন। স্ট্রেচিং করতেছেন। ডি-পলের সাথে নয়ত পারেদেসের সাথে কথা বলতেছেন। কিন্তু চোখের পানি লুকাইতে পারতেছেন না। বিদায় বেদনার। আর এই বিদায়ের বিরুদ্ধে পরাজিত মানুষের আবহমান লড়াই হইলো মায়াবী উৎসব।

খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীতের সময় মেসি তার ত্রিশঙ্কু থিয়াগো, মাতেও আর সিরোরে নিয়া মাঠে হাজির। দেশের মাটিতে জাতীয় দলে পিতার এই ঐতিহাসিক বিদায়ের খুব ঘনিষ্ঠ সাক্ষি হইয়া থাকতে চায় তারা। খেলা শুরু হইলো। এবং এক কথায় প্রায় একপেশে একটা ম্যাচ চলতেছিল মাঠে। চার বছর আগের আর্জেন্টিনা থেইকা চার বছর পরের এই আর্জেন্টিনা আরো বেশি ধারালো। শাণিত। ইয়াং বারুদে ভরা একটা কার্টেল যেন। আলমাদা, মাস্তান্তুনো, সিমিওনি, নিকো পাজ, অ্যাশবেরি, কার্বোনি, লোপেজ, বালের্দি—এরা হইলো আর্জেন্টিনা স্কোয়াডের নতুন ব্যাটলম্যান। আলভারেজ, লাউতারো, নিকো গঞ্জালেস এখন আরো নিখুঁত। পারেদেস, ডি-পল, মলিনা, তালিয়াফিকো আরো পরিণত। ম্যাক এলিস্টার, রোমেরো, ওতামেন্দি, লিসান্দ্রো, এন্সো, পালাসিয়াস যেন একেকজন ক্ষীপ্র চিতা নিজের নিজের পজিশনে। বাজপাখি এমিলিয়ানো আর সেকেন্ড ন্যাশনাল গৌলি রুলি আছে নিজেদের সেরা ফর্মে বরাবরের মতো। আর এমন এক স্কোয়াডের শক্তির উৎস দ্য গ্রেটেস্ট অব অলটাইম লায়নেল মেসি।

বলতেছিলাম একপেশে খেলাটা নিয়া। পুরা খেলায় মনে হয় নাই, লাতিন ফুটবলের অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তি ভেনেজুয়েলা একটাও হান্ড্রেড পার্সেন্ট চান্স ক্রিয়েট করতে পারছে। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের এই খেলায় তবুও গোলের দেখা পাইতে প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হইছে আর্জেন্টাইনদের। পারেদেসের কার্লি লং পাসে আলভারেজের শৈল্পিক কন্ট্রোল আর পাসে মেসির মায়াবী চিপশট—করুণভাবে পরাস্ত হইতে দেখলাম ভেনেজুয়েলার ডিফেন্স আর গোলরক্ষক রোমারে।

মেসির দ্রুত নেওয়া এক স্পটকিকে নিকো গঞ্জালেসের দুর্দান্ত বাতাসে-ভাসানো বলে হেড দিয়া লাউতারো দলের সেকেন্ড গোল করে। সুযোগসন্ধানী এবং কঠোর পরিশ্রমী লাউতারো নিয়মিত গোল পাইতেছে, এইটা একটা অসাধারণ ঘটনা।

আশি মিনিটে মেসি করেন দলের থার্ড গোল। মিডফিল্ডে আর্জেন্টাইন জাদুকর ডি-পলের বাড়ানো লং পাসে পোস্টের ভিতর আলমাদার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাকওয়ার্ড পাস থেইকা মেসির নান্দনিক পায়ের ছোঁয়া—পৃথিবীর অমাময়ী উৎসব।

খেলা শেষ হইলো যথারীতি। অভিবাদন আর প্রেমোল্লাসে ভিজতেছিলেন মেসি সমস্ত মনুমেন্তালে। সাথে ডি-পলদের বিখ্যাত গান

Vamos, vamos Argentina,
sabemos que vos sos el mejor,
la banda está de fiesta,
hoy te venimos a ver,
con Lionel Messi y toda la hinchada,
vamos a correr…

মেসিরে নিয়া এত লিখতেছি কেন? রেফিউজের আনন্দে। পৃথিবী ভালো জায়গা না—স্বপ্ন আর সুন্দরের জন্য। মেসি এইখানে সব স্বপ্ন আর সুন্দরের এক মোহনীয় রেফিউজ। মেসির কাছে কি এইসব শব্দ কোনোদিন যাবে? না। মেসি কি জানে—তারে নিয়া প্রতিদিন কত শব্দের উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা চলে? না। মহাকালে বইসা আমরা কী করি? মহাকালের অসংখ্য প্রতিধ্বনির আরো এক প্রতিধ্বনি করি শুধু। আমি ছিলাম। আমি আছি। আমি থাকবো। এই রূপে না-হয় অন্য রূপে। টেসলার ফ্রিকোয়েন্সিতে। নিঃসঙ্গ এক সন্ধ্যায় শুধু ফিল করতে থাকবো এক অশরীরী হাহাকার। আমার অস্তিত্বের। অন্য কোথাও যারে রাইখা আসছি নিজের অনিচ্ছায়। হয়ত তার বিলাপে ক্ষণে ক্ষণে বিহ্বল হইয়া যাইতেছি আমি। এইসব শব্দ ও স্মৃতি ওই বিহ্বলতার স্মারক। আমি যার আদিতে, আমি যার বর্তমানে। আমি যার অবধারিত ভবিষ্যৎ।

অতএব দৃশ্যপট থেইকা মেসির চইলা যাওয়াটা কীভাবে ঘটবে খুব নিকট ভবিষ্যতে? আমি এইটা নিয়া ভাবি। যদিও ভালো লাগে না। আমার শৈশব অনেকটা মেসির শৈশবের সাথে শুরু। আমার সকল সুন্দর উপলব্ধি, মেসির পাসিং আর ড্রিবলিঙে উচ্ছ্বসিত যেন। আমি এমন এক সময়ের ভিতর দিয়া যাইতেছি যেইখানে মেসির মতো আমার সকল মহানায়কেরা সময়ের নৃশংসতায় পর্দার বাইরে চইলা যাইতেছেন। আমি তবুও—তাদের নতুন সৃষ্টি আর সুন্দরের অপেক্ষা করতে থাকি। অবলিভিয়ন। এক বিস্মৃতির ভিতরে যেন। আমি এমন এক সময়ের ভিতর যাইতেছি যার আকাশ নক্ষত্রপতনে রক্তাক্ত। বামনদের হল্লায় নাস্তানাবুদ। আমার নিঃসঙ্গতা ক্রমশ আশ্রয়হীন হইতেছে। অথবা দখল হইতেছে ওইসব ভাঁড়দের তান্ডবে। আমি খুবই বিরক্ত। আমি অসহায়। আমার নিঃসঙ্গতাও কি আমার থাকবে না তবে?

আমি এমন এক জেনারেশনের অংশ যে এনালগ পৃথিবীরে ক্রমশ ডিজিটাল হইতে দেখছে। দেখতেছে পৃথিবীর সব আকুতি আর আহ্বান কীভাবে এআই এলগরিদমে বন্দী হইয়া যাইতেছে। টম ক্রুজের শেষ মুভিতে দেখানো এন্টিটির মতো। ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ওয়েভে সেন্ট্রালাইজড হইতেছে সব ভাষা ও যোগাযোগ। যেন একদিন কবিতা থাকবে না। গান থাকবে না। গল্প থাকবে না। থাকবে শুধু ডেটা। থাকবে শুধু ইশারা। পৃথিবীর অনেক আকাশে আজ আর পাখি নাই।

আশঙ্কার ওই ধূসর-ছাইয়ের মতো পৃথিবী আমরা কেউ চাইতেছি না। মেসির মতো মোহনীয় সুন্দর আমাদের শক্তি। নিশ্চয়ই এই পৃথিবীটারে উগ্র-পশুদের দখলে নিতে দেওয়া যাবে না।

০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫


হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
গানপার স্পোর্টস

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you