শিল্পসাহিত্যের কাগজ ‘জাঙ্গাল’। সুনামগঞ্জ থেকে ২০১৬ ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়েছিল ম্যাগাজিনটির চতুর্থ খণ্ড। পরে এখন পর্যন্ত আর কোনো সংখ্যা বাইর হয় নাই সম্ভবত। পত্রিকাটা তারুণ্যস্পন্দিত রচনায় ঋদ্ধ হলেও পরিপক্বতা আর পারিপাট্যের ছাপ এর সর্বত্র।
সম্পাদকের ভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে বেশ লম্বা বিরতির পরে এই সংখ্যাটি নিষ্পন্ন হয়েছে। এই সংখ্যায় কেবল কবিতাই জায়গা পেয়েছে। এমনকি কবিতাবিষয়ক কোনো আবেগী কিংবা তাত্ত্বিক গদ্যও নয়, কেবল কবিতাই ‘জাঙ্গাল’ চতুর্থ সংখ্যায় নিরঙ্কুশ স্থান সঙ্কুলান করে নিয়েছে। একদিক থেকে এইটা কাগজের ভিন্নতাজ্ঞাপনী চিহ্ন, অন্যদিকে একঘেয়েও মনে হতে পারে বৈচিত্র্যসন্ধানী রিডারের কাছে। সেইটা পাঠকভেদে একেক ইম্প্রেশন্ তো হবেই, কিন্তু প্রথম নজরে এর নিরহঙ্কার অঙ্গসৌষ্ঠব, কাগজের সযত্ন পত্রবিন্যাস ও অনাড়ম্বর অলঙ্করণ, সবকিছু মিলিয়ে লিটলম্যাগের পুরানাকালিক স্মৃতিই মনে করিয়ে দেবে যে-কোনো দর্শনদারী পাঠক ও সম্ভাব্য ক্রেতাকে।
দেখা যাচ্ছে একুশজন কবির গুচ্ছাকারে কবিতা ছাপা হয়েছে ‘জাঙ্গাল’ আলোচ্য খণ্ডে। এবং প্রত্যেকেরই প্রায় একাধিক কবিতা, পাতাও বরাদ্দ হয়েছে প্রত্যেকের জন্যে একাধিক, ব্যতিক্রম হয়েছে এক/দুইজনের ক্ষেত্রে।
এছাড়াও দুইজন কবির প্রথম পাণ্ডুলিপি ছাপা হয়েছে এই সংখ্যায়, যা ম্যাগাজিনের মানোন্নয়নে একটা ভালো ভূমিকা রাখতে পেরেছে। একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে বলেই কি একুশজন কবির উপস্থিতি – হিসাবটা কি এই রকমের কি না, তা অবশ্য জরুরি জিজ্ঞাসা না, তারপরও অধিকসংখ্যক কবির অংশগ্রহণ যারা কাম্য মনে করেন তাদের মনে এহেন সপ্রশ্ন কৌতূহল হতেই পারে। একুশ যোগ দুই – একুশ কবির গুচ্ছকবিতার পাশাপাশি দুই কবির পাণ্ডুলিপি – মোটমাট তেইশজনের লেখা নিয়া ‘জাঙ্গাল’ ২০০৮ সালের পরে একটা দীর্ঘবিরতির দম নিয়ে নবযাত্রা করেছে দেখা যায়। এ-যাত্রা ‘জাঙ্গাল’ অসহনীয় কোনো মুদ্রণবিভ্রাট বা বানানবৈকল্য ব্যতিরেকে এডিটরের নিষ্ঠা ও সাহিত্যিক শ্রমের নজির পাঠকগোচরে রেখেছে।
তেইশ কবির প্রায় প্রত্যেকেরই কবিতা বাছাই/নির্বাচন – অবশ্য কবিতাবাছাইক্রিয়া কবি নিজেও করে থাকতে পারেন – প্রশংসা পাবে একনিষ্ঠ কবিতাপাঠকের কাছে। এর মধ্যে ডেব্যু-কবিতাপাণ্ডুলিপিদ্বয়, একটির প্রণেতা পাভেল পার্থ এবং অন্যটির প্রণেতা আলফ্রেড আমিন, নিঃসন্দেহে সম্পাদকের জহুরি নজরের প্রমাণবহ। সযত্ন ও সপ্রেম প্রকাশিত পাণ্ডুলিপিদুটো সুদৃশ্য অর্ধপ্রচ্ছদ দিয়ে বিভাজিত করে ছাপানো হয়েছে, একটুও দায়সারা অনবধানতার চিহ্ন কোথাও মেলে না। সংগৃহীত অঙ্কনকলার ব্যবহার ঘটিয়ে এই দুটো অভিষেক-কবিতাপুস্তিকার নকশা সাজিয়েগুছিয়ে তুলেছেন যিনি, বিমান তালুকদার, নিয়মিত কবিতাপাঠকের দৃষ্টি কাড়ার যোগ্যতা রাখেন তিনি।
কিন্তু খটকা থাকে অন্যত্র। পত্রিকার মূল প্রচ্ছদ এতটাই ম্যাড়মেড়ে ও বৈভবহীন বোবাকালা যে, এহেন প্রচ্ছদ ছোটকাগজের গতরের সঙ্গে বেমানান। বাংলাদেশের ছোটকাগজভুবনে এই এক প্রবণতা ক্রমবর্ধমান হচ্ছে দিনে দিনে, সবকিছুতেই কম্যার্শিয়্যাল্ ছাপ রেখে নিজেদের শিল্পচিন্তা ব্যাহত করা। ম্যাগাজিনের মুখে মেকাপ যদি দিতেই হয়, প্রসাধন যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে নিজেদের সাধ্যে যেটুকু কুলোয় সেটুকুই দৃশ্যনন্দনীয়; কম্যার্শিয়্যাল্ প্রচ্ছদশিল্পী দিয়ে ম্যাগাজিনের মুখ প্রসাধিত না-করলেও সম্পাদকের চলত।
গোটা দুইপৃষ্ঠাব্যাপী সম্পাদকীয় ভাষ্য পত্রিকাটাকে একটা দার্ঢ্য দিয়েছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হতচকিত পরিস্থিতিদৃশ্যধারা ভাষ্যটির লাইনে-লাইনে সাঙ্কেতিক ছাপ রেখে গেছে। শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়েছে মুক্তবাক যুক্তি ও বোধচৈতন্যের চর্চা ও প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ নতুন দিনের বাংলাদেশের ভাষাশহিদদের প্রতি, যারা নিহত হয়েছেন সাম্প্রতিক কূপমণ্ডূক অপরাজনৈতিক অসুরগোষ্ঠীর নৃশংস চাপাতিকোপে। এছাড়াও পত্রিকার অন্তিম প্রচ্ছদে সম্প্রতি-প্রয়াত কবি উৎপলকুমার বসু রচিত ‘পুরী সিরিজ’ কবিতার খণ্ডাংশ ছেপে লোকান্তরিত কবিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পাশাপাশি পত্রিকাসম্পাদকের অভিপ্রেত অবস্থানও সুস্পষ্ট করা সম্ভব হয়েছে, এর মধ্যে কয়েকটা লাইন এ-ই : “চাষীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাদ্যরত রাজনীতিজ্ঞের দলে / ভিড়ে যাই, চলো, সময় বড়োই অল্প, তা ছাড়া, যত দিন যায় / সময় ক্ষুদ্রতর, সে বামন, লাফিয়ে পিঠের / উপরে আরুঢ় হই, চলো … বামন ঘোড়ার পিঠে ন্যস্ত হয়ে কবিতার ব্যাখ্যা চেয়ো না / সস্তা ও কোমল তরিতরকারিময় দেশে ভালোমন্দ খাও-দাও / তোমার পিছনে কোনো গোয়েন্দার চোখ নেই। শুধু কবিতার / যে-কোনো ব্যবস্থা তুমি করে যাও। অন্তত এ-সব লেখা ব্যবহারযোগ্য কি না, না-জানালে / কৌতূহল থেকে যায় । না-হয় মফস্বলে সামুদ্রিক / মাছের সম্পাদনা তুমি কোরো” … ইত্যাদি। ইঙ্গিতপূর্ণ পঙক্তিমালা। তা, জিজ্ঞাসা করলে এডিটর বিব্রত হবেন হয়তো, গোয়েন্দাপাহারা কি একেবারেই নেই এই মহান ২০১৯ সনের বাংলায়? ‘‘মগজে কারফিউ / নিষেধ বেরোনো / ভাবনা নিয়ে একা / রাস্তা পেরোনো’’ – পরিস্থিতি কী এমনই নয়?
শামস শামীম পরিকল্পিত ও সম্পাদিত ‘জাঙ্গাল’ বেরিয়েছে সুনামগঞ্জ থেকে। ম্যাগাজিনের ফ্রন্টপ্রচ্ছদ করেছেন তৌহিন হাসান। সাড়ে-চারফর্মা কাগজটির মূল্য ধার্য রয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬০.০০ (ষাট টাকা) মাত্র। সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য পত্রিকাগাত্রে সাঁটা আছে স্পষ্টাক্ষরে।
প্রতিবেদন / মাহি রহমান
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS