যে-কোনো সৃষ্টি নিজস্ব ভূসংস্কৃতি, জনসংস্কৃতি, আচার ও যাপনের আবহে জন্ম নেয়। সেই সৃষ্টির অন্তর জুড়ে থাকে নিজস্ব জল-মাটি-হাওয়া। জনপদের আত্মকথন রপ্ত করেই শিল্পী অবগাহন করেন সৃষ্টির জমিনে। সেখানেই বিচরণ করেন, বিকশিত হন। সৃষ্টির স্বর এবং সুরও লেপ্টে থাকে সষ্ট্রার আবহমান সমাজ, সত্তা, পরিপার্শ্ব ও জীবনধারায়। তেমনই এক মহাজন উপমহাদেশের বিপ্লবী বাউলশিল্পী সাধক রশিদ উদ্দিন (১৮৮৯-১৯৬৪)। গানকে যিনি করেছিলেন জীবনের ধ্যান, গান নিয়ে ছুটেছেন মানুষের দ্বারে, গানের আহ্বানেই দূরের মানুষকে টেনে এনেছেন আপন আঙিনায়।
চেনা-অচেনা অনেকে আজকাল তর্ক ও তত্ত্বধর্মী মালজোড়া গান গেয়ে আসর জমিয়ে তোলেন। গায়ক হিসেবে শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তাও পান। অথচ প্রায় শত বছর আগে বাউলগানে এই মালজোড়া ভাবধারার সৃষ্টি করেছিলেন সাধক রশিদ উদ্দিন। সেসব গান শত বছর ধরে ভাটি বাংলার মানুষের মুখে মুখে। সেসব গানের গহীনে বইছে হাওরাঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ ও আত্মোপলব্ধির স্রোতধারা।
হাওর-বাওর ঘেরা নেত্রকোনার মৃত্তিকা সংলগ্ন বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের লেখা ‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ গানটির রচয়িতা নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক ও দ্বিধা সামনে এসেছে সেটি নিয়েই কথা। যেটুকু বুঝলাম — মূল গানের কথার দু-একটি শব্দ-বর্ণ এদিক-ওদিক করে গানটি অন্য একজনের নামে চালিয়ে দেওয়ার চাতুর্য দেখানো হয়েছে। বলা ভালো, এই দুষ্টু কৌশলটি একটি অবিকশিত গোষ্ঠীর নিছকই অপরিপক্বতা। যারা কি না হঠাৎ করেই দাবি করছেন গানটির লেখক খালেক দেওয়ান। অথচ আমার বাপ-দাদারা এই গান রশিদ উদ্দিনের বলেই শুনেছেন, জেনেছেন। আমি নিজেও গত দুই যুগে হাটে-মাঠে-ঘাটে অন্তত শতাধিকবার এই গান হৃদয় দিয়ে শুনেছি। বহুবার মনের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে উঠেছি।
রশিদ উদ্দিন শুধু নন, জালাল খাঁ, উকিল মুনশি ও শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ সাধকদের বহু গান যুগ যুগ ধরে ভাটিবাংলার মানুষের জীবন ও যাপনের অংশ হয়ে আছে। বৃক্ষের একটিও পাতা ঝরে গেলে, ভবনের একটিও ইট খসে গেলে, বৃক্ষও মরে না, ভবনও ধসে না। তবে সেখান থেকেই শুরু হয় সেই বৃক্ষ ও ভবনের পতনযাত্রা। রশিদ উদ্দিনের গানের উঠোনে যে-আঘাত আছড়ে পড়েছে, তার নিকষ কালো ঢেউয়ের সামনে আমরা সোমেশ্বরী, গোমাই, মগড়া ও সুরমাপাড়ের সন্তানেরা প্রবল প্রতিরোধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। গৌড়ের কালাপাহাড়ের মতো।
কবি সরোজ মোস্তফা (Soroj Mostofa) স্যারের অকাট্য বয়ানে গানটির ইতিহাস বিশ্লেষণ ও যুক্তিখণ্ডন হয়েছে (কার গান — রশিদ উদ্দিন না খালেক দেওয়ান)। আপনি-আমিও অনুসন্ধিৎসু হতে পারি। স্যারের ফেসবুকপেইজ থেকে রশিদ উদ্দিনের আলোচ্য গানটি নিচে তুলে ধরলাম —
মাগো মা ঝিগো ঝি করলে কি রঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে দিলে গাঙ্গে॥
গোমাই নদী নষ্ট করল ঐ না কোলাবেঙ্গে॥
ভাঙ্গা নৌকায় উঠে জল নদী করে কলকল
কলকলাকল পারি না তার সঙ্গে
নদীর নাম কামনাসাগর
বাঁকে বাঁকে উঠে লহর
কত সাধুর ভরাডিঙ্গা পার তার তরঙ্গে॥
ছিলাম শিশু ছিলাম ভালা
না ছিল সংসারের জ্বালা
হাসিতাম খেলিতাম মায়ের সঙ্গে॥
এই দেহে আইল জোয়ানী
ঘারে আইল নয়া পানি
কাম-কামিনী বসিল বাম অঙ্গে॥
ছিলাম জোয়ান অইলাম বুড়া
লইড়া গেছে বাঁকা জোড়া
গলই গোড়া সব গিয়াছে ভেঙ্গে॥
রশিদ উদ্দিন বলে গানে
ভেবে দেখ আপন মনে
একদিন মিশতে হবে মাটির সঙ্গে॥
(বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন ও তাঁর গান, আবু দায়েন, পৃষ্ঠা ৮৯)
কার গান — রশিদ উদ্দিন না খালেক দেওয়ান : সরোজ মোস্তফা
গানপারে কোকস্টুডিয়ো
কোকস্টুডিয়ো কম্পোজিশনে আলোচ্য গান
- ১০ কবিতা || হোসনে আরা কামালী - June 26, 2025
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
COMMENTS