মাধুরিজি

মাধুরিজি

শেয়ার করুন:

সোনি টিভিতে লাইভ মাধুরী। কোরিওগ্রাফির ফাঁকে একপলকের জন্য যখন একা হলেন, জানতে চাইলাম আপনার সেই বিজুরি-চমকানো শরীর কোথায় গেল? লাস্যের এমন নেতিয়ে-পড়া হাল কেন? ভঙ্গি শ্লথ, চোখের নিচে যেন অনেকদিনের হাই-ওঠা ঘুম জমে, আর কি আগেকার মতো আপনার শরীরময় ফিনফিনে রঙবাহারি ডানা-মেলা সেইসব প্রজাপতিরা উড়ে বেড়ায় না? এত তাড়াতাড়ি সব ফুরিয়ে জুড়িয়ে গেল? ক্লান্তি? হাই? উদাসীনতা? কে খেলো সমস্তকিছু? কারা প্রজাপতি কাড়ল আপনার? কোরিওগ্রাফির চটুল ভঙ্গিমায় চোলি কা পিছে কী আছে না আছে এই পুরনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন দীক্ষিত মাধুরী, মুক্তোর দানার মতন কপালে ঘামের ফোঁটা, উন্মাদনা বানাবার চেষ্টা করে আগেকার মতো চোলি ও ঘাঘরা যেন ভিজে ভিজে, তবু হাসলেন, এক ফাঁকে, ফিকে ফ্যাকাশে হাসিতে আরও কৃশ লাগল যেন। হাসিটা রইল ঠোঁটে, রঙ-করা চোখ তুলে মাধুরী হঠাৎ খুব একা হয়ে বললেন, কিছুটা বয়স খেলো, আর অনেকটাই, মাধুরী থামেন, সতীর্থরা। সতীর্থরা? আমি খুব চমকাই, তাই? মাধুরী না চমকান না হাসেন, শুধু মিহি, ভাঙা, ভেজা গলা হঠাৎ গর্জন হয় : ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতার নখে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সতীর্থরাও খায়, যতক্ষণ পায়!

 

এক দো তিন চার পাঁচ ছে সাত আট ন্য দ্যস্ য়্যাগারা বারা তেরা … আবির্ভাবের তিন/চার বছরের মধ্যেই তিনি লিড রোলে অ্যাক্ট করে কিস্তিমাৎ করেন ‘তেজাব’ সিনেমায়; এর আগের বছর-তিনেকে খান-দুই সিনেমায় মাইনর রোলে কাস্ট হয়েছিলেন, ‘দয়াবান’ বা ‘ওয়ার্দি’ ইত্যাদি, শুরুটা তাপস পালের সঙ্গে ‘অবোধ’ দিয়ে হলেও আমাদের সঙ্গে তার পয়লা শা-নজর ঘটে ‘তেজাব’ দিয়েই। কিন্তু ওই গল্পে পরে ঢোকা যাবে, আগে জেনে নেয়া যাক তাপস পাল মালটা কে; সেই গুরুদক্ষিণার ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা / গুরুকে জানাই প্রণাম / যার শুভকামনায় আমি / আজ এই গান গেলাম’ না? শতাব্দী রায় আর দেবশ্রীদের সঙ্গে সেই-যে আলাভোলা গাঁইয়া অভিনয় করত উত্তমম্যানারিজম কপি করে? — হ্যাঁ, এ সেই মাল যিনি কিছুকাল পূর্বে বেডরুমে ঢুকে সে-দেশের বেহেনজি-মাইজিদিগের ইজ্জত তামা করে দেবেন বলে হুঙ্কার ফুকারিয়াছিলেন; ভদ্রলোকের দাবিটি নিরীহই ছিল, — ভোট দে-না পাড়েগা বাসান্তি হামারি পাট্টি-মে, বার্না তেরা ইজ্জত-কা হাল তামা কার্দেগা; তারপর? আমজাদ খান মিট্টি-কি নিচে-স্যে উঠে এসে ‘ইয়ে তু কিয়া বাত নিক্লা রে হারামখোর! মু মে তেরা গু-কি-তারা বদবু আ রাহা হ্যায় বে বক্রিচোদ! আব তেরা ক্যায়া হো গা রে তুপ্সা!’ — অ্যায়সা ডায়লগ ঝাড়েন নাই? না, বিল্কুল নেহি, নারেন্দ্রামুদি-কি মুল্ক-মে গাব্বার সিং কে-লিয়্যে কোই জাগা নেহি হ্যায়। এরপর কি হলো? সোনাবন্ধু তুপ্সা পালের? বাঁড়ায় ঝামাপাত্থর বগল-মে ইট? ফুহ্! ফাড়িছিঁড়ি সিংহাসনের উপর দিয়া হনুমানাসনে। ডাইরেক্ট সম্মাননা, আজীবন অ্যাওয়ার্ড, ইয়ে হ্যায় ইন্ডিয়া মেরা গার্লফ্রেন্ড! দুঃখ কোরো না, বাঁচো, ‘হোক কলরব’ করো। বন্ধুটি রিয়্যাক্ট করে, ‘উত্তমকুমারের দেশে এইসব ধ্বজরোগদীর্ণ নরাধম জন্মায় কেমন করে!’ — জন্মায়, জন্মায়, ডোন্ট বি সার্প্রাইজড মেরি ইয়ার!, — বলি আমি; আরও বলি, — কেন, তোমার দেশে, দ্যাট মিন্স রবিরাজ্যে, ধর্ষণবীর খোকা ঠাকুর বা মানিক মেকুর জন্মায় নাই? তাইলে? চায়ে-দুকানদারো-কা হাল খরাব করে দিতে লেগেছ কেন? বন্ধুর দীর্ঘশ্বাসের সুবিধার্থে প্যারা ভাঙতে হয় এইখানে এসে। লেট’স্ গ্য, চলো, ভাঙি।

তিনি সেই-যে হরণ করলেন ঘুম, পৃথক পালঙ্কে থেকেও সঙ্গিনী হলেন চিরতরে সেই থেকেই যে, এরপর আর ছাড়কাট হয় নাই। কিন্তু গোপিনী ষোলোশ, মতান্তরে ষোলো সহস্র, প্রকৃতির ব্যত্যয় কিছু তো নয়। এসেছে, গেছে চলে এসে ফের প্লাবনের মতো, ম্যাড বিনয়ের কবিতা থেকে আমাদেরও জীবনে, সে মনিকা বেলুচি হোন বা তারও অনেক আগের ইনগ্রিড বার্গম্যান, উনারা উনাদের ন্যায় তারা, তাই বলে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা মাধুরিজির কদর তো কমবার নয় হে! গোপিয়া আ-নে যা-নে স্যে / রাধা তো মন-কি রানি হ্যায় … আলবৎ! ‘মোহিনী! মোহিনী! মোহিনী!’ — ওই জাভিদ আখতারের লিরিক্সেই, লক্ষ্মীকান্ত্-পিয়ারিলাল জুটির কম্পোজিশনে, অল্কা যাজ্ঞিক বা আমরা বলতাম অলকা ইয়াগ্নিক মাদামের তৎকালীন ইম্যার্জিং গলায়, সেই নৃত্যমৌতাতের অভিনবত্বে ম্যেইফেল-রৌশন-করা মাধুরিজির আবির্ভাব আমাদের জীবনে — ‘ডিং ডং ডিং / ডিং ডং ডিং ডং ডিং ডং … নামাস্কার নামাস্কার / কাহিয়্যে কেয়া স্যুনেগে আপ / আরে প্যেহলে ইয়ে কাহিয়্যে, কাহা থি আপ’ — এতদিন কোথায় ছিলেন, মধুবালা মরে যেয়ে ভূত হয়ে গেলেন, কোন পাখির নীড়ে বসে এই নৃত্যকত্থক রপ্ত করছিলেন — প্রশ্নের অভিঘাতে নেত্রবাণ হানিলেন মারাঠি ব্রাহ্মিন মাধুরিলতাসেন, বলিলেন বিলোল কটাক্ষে হেসে হাজার বছরের পথহাঁটা গাজগামিনি, ‘ম্যে কার রাহি থি কিসি-কা ইন্তিজার’, কার? — ‘উয়ো জিসে কার্তি হু পিয়ার … ঔর জিসে কার্তি হু মিন্নাত বারবার’, ক্যেয়সে? — অ্যায়সে, ‘ডিং ডং ডিং …’

না, আনিল কপুরজির জন্যি ইন্তিজার নয়, অ্যাট-লিস্ট শ্রিরাম নেনেজি তখনোব্দি মাতৃগর্ভে নো-ডাউট, তাহলে কে? বোমা ডাট? আহিস্তা, আহিস্তা, জারা ধিরে-স্যে, গার্লফ্রেন্ড! টাডা প্রিজনহাউজ চিনব আমরা আরও কম-স্যে-কম বছর-দশ বাদে। এক-দশকের টাইম অ্যান্ড স্পেস্ উল্লম্ফন/উল্লঙ্ঘনের মতো কবিত্বফুটানি আমারে দিও না বান্দেমাত্রাম! তাই তো বলি, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ন্যায়, ‘পায়ের তলায় নরম যেন ঠেকল কি / আস্তে একটু চল্-না ঠাকুরজি!’, কিংবা বলি কমল চক্রবর্তীর গলা ধার করে, ‘আস্তে চলো, গার্লফ্রেন্ড!’ দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং নাও, দ্য লাইফ টু, রজনী আভি বাকি হ্যায়!

কিন্তু সত্যের খাতিরে এবং তথ্যেরও, কথাটা বলে রেখে এগোনো যাক যে, আনিলজির সঙ্গেই তিনি বোধহয় বেশি ফিল্মে অন-স্ক্রিন হয়েছেন এবং বক্সঅফিস্ ব্লকবাস্টার ক্যাল্কুলেশনে গেলে তো অবশ্যই তা-ই। সোনামের বাপের সঙ্গেই মাধুরিজির স্ক্রিনকেমিস্ট্রি ডিভ্যাস্ট্যাইটিংলি ডাকাবুকো জমেছিল কবুল করতেই হয় উইথ অ্যা লিটল ম্যালিস্। হোয়াই? ম্যালিস্ কেন? উত্তর, ব্যক্তিগত। মুচুয়া আনিলজির পাশে মর্ত্যপাতাল-মন্থন-করা মাধুর্যনির্মিত মাধুরিজির স্ক্রিনপ্রেজেন্স মেনে নেয়া ক্লাসফাইভে-পড়ুয়া নবকৃষ্ণদের পক্ষে টেক্নিক্যালি ডিফিকাল্ট তো হবেই। এইটিএইটে, বিগত সহস্রাব্দের লাস্ট ডিকেডের ঠিক আগে আগে, মাধুরিজির চিরপ্রেমিক অনেকেই নিশ্চয় পাঠশালায় মাইনা পাশ দিবার মুখে। অ্যানিওয়ে। এর মানে এও বলা যাবে না যে তিনি আনিলজি ছাড়া আর কারো সঙ্গে সেভাবে স্ক্রিনে যান নাই; নো, তা নয়, গিয়েছেন এমনকি অচিরেই বেঁটে আমির এবং হোৎকা সাঞ্জায়ের সঙ্গে তো বটেই, বিদূষক সল্লু আর মেলোড্রামাহিরো শারুখের সঙ্গে এন্তার স্টারিং করতে দেখেছি তারে আমরা, আর ওদিকে জ্যাকি স্রফ ইভেন দি মোস্ট আনয়্যুজুয়্যাল অনস্ক্রিন পেয়ারিং হয়েছে আনিলজির ইয়াঙ্গার ব্রাদার সাঞ্জায় কপুরের সঙ্গে ‘রাজা’ আর ‘মুহাব্বাত’ বইয়ের ফিতায়। কিন্তু মাধুরিগুণে সেগুলো সমালোচকরা সয়ে গেলেও ক্রমশ সুপক্ব যবের ন্যায় প্রেমিকের নয়নে কেমন বেখাপ্পা ঠেকেছিল তা নিয়া আলাপ আর ঝালায় নেবার হুজ্জতে না-যাই আমরা।

মাধুরিজি ছিলেন সাবলীল সবার সঙ্গেই। প্রোফেশন্যালি প্রোফাউন্ড ক্রাফট সর্বত্রই গোচরীভূত হয়। তিনি প্রোফেশনের সঙ্গে ইন-পার্সন ইমোশন্যাল অ্যাটাচমেন্টের আঁতাত গুলায়ে ফেলেন নাই। জিনিশটা সাঞ্জায়ের সঙ্গে লটরপটর চলাকালীন ঘটনারাজি থেকেই ক্লিয়ার হয়। কিন্তু ওইসব তো আরেকটু পরের ব্যাপার। ‘থানেদার’ থেকেই কি? ‘তাম্মা তাম্মা লোগে / তাম্মা তাম্মা লোগে তাম্মা’ — থানেদার সিনেমায় মাধুরিম্যাজিক বলিউডি ফিল্মি নৃত্যকলার আরেক সোপান — প্রাণে ঝিলমিল লেগেছিল সেই-যে, চন্দ্রবিন্দুর ন্যায়, গেল কই! কিংবা প্রভু দেবার সঙ্গে সেই ‘ক্যে স্যেরা স্যেরা’ গানের ড্যান্স! চোলিনৃত্যকথা নাই-বা বলিনু সর্বসমক্ষে, কিন্তু ঘটনা তো! এইসবের পাশে অ্যাশের তালফাল, ফুহ্, মিজাজ বিগড় যায়েগা ব্রো, ডোন্ট প্যুশ্ মি টু বি হার্শ অ্যানিমোর। কিন্তু এইসবও তো বছর-কয়েক গ্যাপের ঘটনা। বাংলা কবিতার নকশালি ফাল দিও না এখুনি। ডিটেইলে হও আগুয়ান। দেবেশ রায় কিসিমের ডিটেইলিং। কেমন সেইটা? আমাদের এক বন্ধু গল্প লিখত, গল্পের ভিতর তার লেকচারের তুজুর্বায় জেরবার হয়ে থাকতে না-পেরে একদিন জিজ্ঞেস করে ফেলি, ব্যাটা কি বাল শুরু করলি তুই এইসব? আমাদের গলা যত শুকায়, পাল্লা দিয়া তর দেখি গলায় রসের জোয়ার আসে, কি শুরু করলি! — ডিটেইলিং; এইগুলো হইল ব্যাটা ডিটেইলিঙের কাজ। কি লিঙ্গের? কটমট অগ্নিনয়ন বন্ধুর অম্লানবদন উত্তর, ডিটেইলিঙের। তা তো বুঝলাম, কিন্তু মুসিবতের থেকে উত্তরণের উপায় কি সেইটা ক। বন্ধু মুখ ঝামটায়ে কয়, দেবেশ রায় ত পড়ে দেখলি না জীবনে, দেখলে বুঝতি ডিটেইলিং কী জিনিশ। তা, কথা সত্য। তবে বন্ধুটির গল্প তো শুনতে হয়েছে আমাদিগেরে, ফলে ব্যাপারটা উইথ উদাহরণ হাড়েমজ্জায় জানি কী বজ্জাতি চিজ্। হুদাই ডিটেইলিং। আপনাদের উদাহরণ দেখানো দরকার হবে না মনে হয়, এগোন, টের পাবেন আপ্সেই।

২.
ছিল তখন সময়টা এমনই যে একটা ছায়াছবি নিয়া আমাদের বছর কাবার হয়ে যেত, ছবিদেখার অভিজ্ঞতা তা-ও পুরানা হতো না, মলিন হতো না দেখনাভিজ্ঞতা-দেখাস্মৃতি, হাউশ মিটত না মনের বা নয়নের একটাই ফিরে-ফিরে দেখে যেয়ে। এমন নয় যে আহামরি কিছু হতো তখন ছবিটবি; বরং যে-কোনো বাটখারায় এখন ম্যুভি ভালো হয় আগের তুলনায়। টেক্নিক্যালি সাউন্ড হয়, সেল্যুলয়েডিক ইডিয়ম বা আইডিয়া ইত্যাদি সব বিচারেই বিচিত্র ম্যুভি এখন পরিমাণে এবং গুণমানেও বেশি, এমনকি ম্যাসালা ম্যুভির হরেক রকমফের্কা আজ উন্নত অনেক, বেড়েছে দেখন-ও-কদরদারিরও বৈচিত্র্যমাত্রা। যারা মনে করেন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম / মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম’ — না, আমি ঠিক ওই দলে এনরোল্ড নই, ছিলাম না কোনোদিনই পুরাতনী বাংলা গানের বেদরদ বোদ্ধা। খালি সিনেমার কথাই-বা কেন বলি, ন্যাংটামার্কেট ইকোনোমির প্রাকযুগের কথা বলছি, তখন যেমন কোনো-একটা ব্যান্ডের অ্যালবাম বেরোল তো পরের তিনবছর এই একটা অ্যালবামই আমরা শুনে গেছি নিরবধি অন্যান্য অনেককিছুর সঙ্গে। তেমনি সিনেমা আমরা দেখেছি একটাই, যেইটা ভালো লেগেছে যখন, তিনবছর ওইটা বাপ-ভাই মা-কাকিমা মিলেই কোঅপারেটিভ ওয়াচিং চালায়ে গেছি। কিন্তু বছর-বছর ম্যুভি ঠিকই বেরোত শতেক, যেমন আজ দিনে বেরোয় দেড়লক্ষাধিক, অথচ পছন্দের ম্যুভিটা পাঁচদিনেই দেখাতালিকা থেকে বিদেয় নিত না আজিকার ন্যায়। সেকালে র‍্যাঙ্কিং ছিল না, আইএমডিবি ছিল না, আমরা রটেন টোম্যাটোও ছিলাম না। ঝাল আমরা শাদন্তে স্বমুখেই চাখতাম এবং সেইটা বারবার।

ছিল তখন ভিসিআর টেক্নোলোজি দিয়া ছায়াচিত্রোপভোগের যুগ, অচিরে আসে এর পরবর্তী যুগের ভার্শন ভিসিপি; দুয়ের ফারাক এইখানেই সংক্ষেপে যে, পয়লাটাতে রেকর্ডিং সুবিধাদি ছিল, পরেরটায় এই সুবিধা কর্তনপূর্বক কেবল প্লেয়ার নিয়া আসে মেশিনটা। আর ভিসিপি আমলে এসেই ভিডিয়োক্যাসেটে ম্যুভিদেখা সাধারণের সাধ্যে রেগ্যুলার হয়ে উঠতে থাকে। এইটা অবশ্য বলতে গেলে এই দিনকয়েকের ব্যাপার। মানে সেদিনের ব্যাপার বলতে গেলে যে, এত অবারিত হয়ে উঠল দেখার মওকা আর মাত্রা। তারপর এল কম্প্যাক্ট ডিস্ক, গাদাগাদি ভিড়ের দুনিয়াদারি, সহজপ্রাপ্যতা এবং ফলত অগোচরে রেখে যাওয়া যা-কিছু গোচরযোগ্য। এবং, ফাইন্যালি, এল সেই সুমহান সাম্যের সময় যার জন্য অপেক্ষিত ছিলাম আমরা হাজার বছর ধরে হেঁটে যেতে যেতে এই পৃথিবীর পথে; সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর সর্বত্রই ছিটিয়ে-ছড়িয়ে এত দর্শনেন্দ্রিয়মুখরতা, খালি দেখা আর দেখা, নিষ্কাম-সম্পর্করহিত দেখিয়া যাওয়া হাবা যুবকের হাসাহাসিঋতু, অগাধ অঢেল দেখনোপকরণের তোড়ে কোণঠাসা দশা বাকি ইন্দ্রিয়সমূহের ন্যূনতম অধিকার ফলানো, ফলে দেখাদেখিসর্বস্ব বড়াইবিফাইয়ের যুগে বেফজুল বইতে লাগল অস্বস্তিবোধবুদ্ধিহীন বিজ্ঞাপনী জীবন আমাদের। আমরা আস্তেধীরে পদার্পণ করলাম যৌবনে এক-সময়, সে তো বড় সুখের সময়, সে তো অত্যন্ত আনন্দের অবগাহনঋতু আমাদিগের। না হে না, সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়; কেবল মাধুরিজিকেই ব্লেইম করা ন্যায্য হবে না তজ্জন্যে, পেছনে যার/যাদের ব্লুপ্রিন্ট ক্রিয়াশীল ছিল তাদেরে এজলাসে এনে দাঁড় করানো সম্ভব কোনোদিনই হবে না আমাদের পক্ষে; তেমন গ্যেটে যেন না-হই যে বিয়াত্রিচে বেচারিকে ব্লেইম করব স্বীয় বর্তমানতার ঘটনপটীয়সী হিশেবে।

ছিল তখন উথালিপাথালি বিয়াশাদির ঋতু। ঘটনাটা সংক্ষেপে এ-ই হয় যে, মাধুরিজির ওই-সময়কার নবকুমার প্রেমিকেরা কেউ পঞ্চম কেউ সপ্তম বড়জোর কেউ নবম শ্রেণিতে ধুঁকছিল অকারণ হরষে এবং তাদের আন্টি-কাজিন বা প্যাটার্নাল-ম্যাটার্নাল জ্ঞাতিগোষ্ঠীদিগের পরিণয় সাধিত হচ্ছিল একাদিক্রমে; এবং ওই-সময়, আশি-মধ্যভাগ থেকে নব্বই-অন্তিম অব্দি, বিয়াশাদি মানেই ছিল গায়েহলুদরজনিতে লেতিপেতি পিচ্চিকাচ্চিদের জন্যে রেন্ট-অ্যা-ভিসিআর ফর ওয়ান নাইট সুবন্দোবস্তব্যবস্থা। রাতভর মাধুরিজির সনে অভিসার সম্ভব হতো যে এমন নয়, তখনও তো আমাদের ইচ্ছেয় পৃথিবীটা চালিত হতো না, আজও যে হয় না তা আলাদা কারণে, ইত্যবসরে হাইওয়েতে উঠে গেছেন মোটরবাইক হাঁকিয়ে ‘দিল্ জিগার নাজার ক্যায়া হ্যায় / ম্যে ত তেরে লিয়ে জান ভি দ্যে দু’ অজয় দেবগান আর তার ‘ফুল ঔর কাঁটা’ ইত্যাদি; শিরোপরে উঠতি-বয়সী পিতা/পিতৃব্যদের আজ্ঞায় দেখতে হতো ম্যুভি অফ দ্য উইক হোক বা সানডে আফটারন্যুনের বিটিভি পরিবেশিত ‘জিলেট ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস স্পেশ্যাল’ কিংবা ডাব্লিউডাব্লিউএফ তথা রেস্লিং। ফলে নিরবচ্ছিন্ন মাধুরিজি দর্শনের মধুমওসুম আমাদের জিন্দেগিতে সেভাবে আসে নাই। বিস্তর কায়ক্লেশে প্রেমের জন্যে স্পেস্ ক্রিয়েট করে নিতে হতো তখন, সহজলভ্য ও অলমোস্ট নিঃশর্ত ছিল না আজকে যেমনটা আছে একটিপে প্রেম ও পরন্তু নির্বিকার নিরাবেগ নির্দেবদাস বিচ্ছেদ ও অবশ্যম্ভাবী বিস্মৃতি।

ছিল তখন রঙিন রূপবান নিশিদিন; অন্য-অর্থে বেরহম মনোবেদনার। একের পরে এক মাধুর্যের আত্মীয়াদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল ষণ্ডামুখো হোঁদলকুঁতকুঁত লোকেদের লগে; সেই আমাদের মধুহৃদিরা, আমাদের স্যুইটহার্টবৃন্দা, যারা আমাদের খালাতো-ফুপুতো-মামাতো, কোলে ও আঙুলে খেলেছি আমরা যাদের স্নেহকুলুকুলু শান্তিকল্যাণসুরভিত ওড়না-দোপাট্টাছায়ায়, হাওয়াবাতাস ও অন্যান্য পৌরাণিক অধিবিদ্যা জানাবোঝার অন্তর্বর্তীকালে সেই আমাদের প্রথমা রাধিকারা একে একে ছেড়ে যাচ্ছিলেন আমাদের আঙুল ও মর্মপরিপার্শ্ব; বয়ঃসন্ধির ওই অশ্লেষার কৈশোরবেলায় সমুদ্যত দৈবদুর্বিপাকে; সেইসময়ের ষষ্ঠ-সপ্তমশ্রেণিতে অধ্যবসায়বাধ্য উড়োউড়ো ছোকরাদের মনোযাতনার ইতিহাস কোথাও নথিবদ্ধ নাই, কিন্তু হওয়া উচিত লিপিবদ্ধ অবশ্যই; নিশ্চয় সেইটা হবেও, অচিরে, কারো-না-কারো হস্তে। এখনও প্রৌঢ় হইনি, প্রিয়তমা, আহত ও অনাদরে আর্ত যদিও যৌবনের শিরা-উপশিরা, আমাদের মাধুরিদিনের মনোবেদনাগাথা মাইকে সংকীর্তনঢঙে গেয়ে যাবার ন্যায় হেঁড়ে ও পাষাণ হইনি আমরা; আবার দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রেখে যাবার মতো বিত্তপরাক্রমী পিরালি ব্রাহ্মণ না-হলেও নিজেদের শ্রেষ্ঠ-সময়ের ব্যর্থপ্রাণ-আবর্জনাটাও পুড়িয়ে ফেলতে বুকে দেবে না। মায়া, বুঝলি বিন্দিয়া, মায়ায় ফেলেছে আমাদেরে এমনধারা আঁতান্তরে যে না-পারি গিলতে না-উগ্লাতে। অ্যানিওয়ে। ‘কান্দিস না রে বিন্দিয়া / কি আর হইব কান্দিয়া’ … গানটা দ্য গ্রেইট মুজিব পরদেশীর না? হ্যাঁ, তা-ই তো মনে হয়।

ছিল তখন বাসনকোসনের অ্যাল্যুমিনিয়ামঢাকনি দিয়া ডিশ্যান্টেনা বানায়ে দেশের টেলিভিশনে ভারতীয় ডিডিমেট্রো ও দুরদর্শন-কি রাষ্ট্রীয় কারিক্রম দেখার ঝিরিঝিরি দিনরাত্রিগুলো। মুফতে ম্যুভি দেখার ওই এল ভৈরবহর্ষের প্রথমপ্রেমের মরশুম। ঝিরিঝিরি হলেও ঝুম-কাওয়ালি; দুরুদুরু হলেও দুর্ধর্ষ। বিটিভি তখনও বছরে ১২টার বেশি সিনেমা দেখানো গর্হিত মনে করত। ওই মাসান্তে দেখানোও ছিল ঘনঘন ‘বড় ভালো লোক ছিল’ বা ওই বুলবুল আহমেদেরই ‘মহানায়ক’ বা বেশি-থেকে-বেশি ববিতাজির ‘ল্যভ ইন সিঙ্গাপুর’ বা ‘মিস্ লঙ্কা’ বারেবারে দেখায়ে ফেরা রাউন্ড দ্য ইয়ার। ফলে ভারতমাতার কল্পতরুচ্ছায়ে বেশ খোশহাল চলছিল দিন গুজরানো। অচিরাৎ মাগনা বছর-তিনের জন্যে বিবিসি-সিএনএন দেখবার প্রোমো-মওকা পাওয়া যাবে বিটিভিরই ঝিমানো পর্দায় এবং উপসাগরীয় যুদ্ধে অ্যামেরিকা আয়োজিত দ্যূতক্রীড়ায় মানুষনিধন দেখতে দেখতে তালাকলব্ধা রাজকুমারী ডায়ানার কারক্র্যাশে ডেথ ও অব্যবহিত পরবর্তী ফিউনার‍্যাল ইভেন্টে এল্টন জনের ‘গ্যুডবাই ইংল্যান্ডের গোলাপ’ তথা ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড’ শুনে শোকে মূহ্যমান সাঙ্গ হবে সিএনেন-বিবিসি ফ্রি ট্র্যান্সমিশন ইন বাংলাদেশ। মাধুরিজি সে-বছর ‘ওয়াজুদ’ ম্যুভিটায় শ্রেষ্ঠাংশে থাকবেন, নানা পাটেকরের সঙ্গে, এবং বক্সঅফিস্ শুমারিতে সেইটা মান্দা ব্যবসা হলেও আমাদের তা ভালো লাগবে মুখ্যত নানাজির বাচিক অভিনয় তথা আবৃত্তির জন্যে এবং স্রোতেলা মাধুরিজির গ্রেইস্ প্রেজেন্সের জন্যে। এর আগে ও পরে, ভ্যেরি রিসেন্ট ‘দেড়-ইশকিয়া’ আর ‘গোলাব গ্যাং’ পর্যন্ত, যে-স্নিগ্ধশ্রী জীবনানন্দ উনি বিলিয়েছেন অকাতরে, সেই কাহানি ধীরে প্রকাশ্য। ক্রমে মাধুরিজি আসিবেন। কমলকুমারের কাহিনিতে যেমন ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’ ব্যঞ্জনাভা, তেমনি মাধুরিজিরও দ্যোতনাভিঘাত। ‘প্রেমিক-মনে বুঝে নিতে কি বলিব আর।’ মাধুরিকুঠির বাকি ইতিহাস প্রণম্য ও প্রবহমান রইবে এভার্লাস্ট। মাধুরিজি চিরশ্রী, চিরস্বাগতা, চিরপৌনপুনিক।

৩.
আমিই শেষ স্যুপারস্টার। আমার পরে আর কোনো স্যুপারস্টার নাই, আসবেও না আমার পরে আর কোনো স্যুপারস্টার। আমার আগে অমিতজি ছিলেন অবশ্য মহানায়ক, স্যুপারস্টার, তবে সেসব বিগতকালের তথা আমার আগের রাজপাটের তিনি ছিলেন অধিপতি। তারও আগে ছিলেন যেমন দিলিপকুমার সাহাব মুঘল-ই-আজম অফ দি এন্টায়ার টেরিটোরি। কিন্তু আমিই শেষ নবাব, বাদশা, আমার পরে আর কোনো রাজাবাদশা নাই, দাঁড়াতেই পারবে না এসে বা আসবেও না।

শারুখ খান বলেছিলেন কথাগুলো, কোনো-এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, অবিকল লিখতে পারি নাই বলে কোটেশনমার্ক বসাই নাই। ওই যে-বছর কেবিসিপি তথা ‘কৌন বনেগা করোরপতি’ থেকে রেহাই দিয়া চ্যানেলকর্তৃপক্ষ বাদশা খানসাহিবকে রেক্রুট করে একটা সিজনের জন্য তপ্তাসনে তথা হটসিটে বসায়, সে-বছর নয়া বাদশা আর পুরান বাদশায় বেঁধে যায় ক্যাওয়াস্, সেগুলো পত্রিকাওলারা ছাপালে আমরা পড়ি। মিজাজ যায় বিগড়ে, এসব কি কয় ব্যাটা মুখপোড়া! চার-পাঁচ বছর পূর্বেকার স্মৃতি, জীবনানন্দীয় ধূসর কালার হলেও ঘটনারাজি ইয়াদ আছে অনেকেরই। বিগড়ে যায় মিজাজ যে-কারণে সেইটে এ-ই যে সেই তো তুমি তিতপুরানা প্রাইডের খপ্পরে পড়লা বাছাধন। মুরুব্বির লগে এত শিং-গুঁতাগুঁতির দরকারটাই-বা কেন পড়ল তোমার, যদি শিল্পীই হয়ে থাকো তবে এসব দিকে চোখ তুলিয়া তাকাইবার ফুরসতও তো হবার কথা না। তার মানে, বেলা ভাটির দিকে টার্ন নিতেছে তোমারও নতুবা খামাখা আত্মম্ভরিতা কেন প্রকাশিবে! বেয়াদবি করো অসুবিধা নাই, কিন্তু নস্ত্রাদামাস্ কিসিমের ভবিষ্যদ্বাণীর দরকার ছিল আদৌ? ভবিষ্যতে কেউ বলিউড-অধিপতি হবে না এইটা কে বলল? রবীন্দ্ররচনাবলি ছাব্বিশ খণ্ড লাথি মেরে পাপোশে ফেলে কেউ কবি হয়েছে দেখাতে পারবা? মাস্তান হয়েছে, শেরিফ হয়েছে মেট্রো নগরীর, স্টেইটমেন্ট হয়েছে শুধু খালাসিটোলার কুতুবদের করতালির আসরে। যে বা যারা রবীন্দ্রনাথের ছাব্বিশখণ্ড মুশকিলে ফেলেছে বলিয়া আজ মনে হয়, তাদের জাত আলাদা, তাদিগেরে স্টেইটম্যান্ট ম্যানিফেস্টেশনের জরুরৎ কোনোকালেই হয় নাই, আজও হয় না, ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে, এখানে নস্ত্রাদামাসির অপকাণ্ড হুদা এস্তেমাল করে কোই ফায়দা নেহি হ্যায়। অ্যানিওয়ে। এইটুকু প্রতিক্রিয়া আংশিক পড়ার কুফল হিশেবে অচিরে বুঝতে পেরেছি। কেননা শারুখের পরের প্যারার কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য। পরের অনুচ্ছেদে এখন অবিকল না-হলেও কথাগুলো মনে করে দেখি একটু।

“তবে এইটা আদৌ সত্যি না যে আমিই এই-সময়ের সবচেয়ে মেধাবী অভিনয়শিল্পী। আমার সতীর্থ ও সমসময়ে আবির্ভূত অনেকেই আছেন যারা আমার চেয়ে ঢের বেশি মেধাবী এবং আমার পরে যারা এই নতুন প্রজন্মের অভিনয়শিল্পী তারা তো অসম্ভব শক্তিশালী একেকজন। তবে কেউই স্যুপারস্টার নন। স্যুপারস্টারের জন্ম হবে না আমার পরে। আমিই অন্তিম মহানায়ক। এর কারণ খুবই সহজ, বোধগম্য, স্যুপারস্টার কেউ হতে পারে না, স্যুপারস্টার হয়ে কেউ জন্মায়ও না, স্যুপারস্টার বানিয়ে তোলে একটা বিশেষ সময়। সেই বিশেষ সময় এখন আর নাই। এখন বরং মিনিটে মিনিটে স্যুপারস্টার তৈয়ার হবে এবং পরমিনিটেই ইরেজ হয়ে যাবে ব্ল্যাকবোর্ড থেকে তার চকখড়িদাগ। কারণ মেধা নয়, প্রতিভা নয়, যোগ্যতাফোগ্যতা কিছু নয়, এখন লোকে চ্যানেলসার্ফ করা ছেড়ে ইউটিউবে মিনিটে মিনিটে মহানায়ক বানায় এবং পরক্ষণে তা পাশরিয়া যায়।”

এই কথাগুলো বলার পাশাপাশি শারুখজি নাম ধরে কয়েকজন অভিনয়শিল্পীর উল্লেখ করেন যারা রূপে এবং গুণে তারচেয়ে অনেক এগিয়ে। এরা ভালো রোলে অ্যাক্ট করেছেনও এবং প্রেইজ জুটেছে সে-বাবদে। কিন্তু তবু তারা স্যুপারস্টার হতে পারবেন না। কারণ, ওই তো বলা হলো, সময়। এই কথাগুলো মনে রেখে আমরা মাধুরিজিকে দেখতে চেষ্টা করব। কথাগুলো শুধু বলিউডম্যুভি ক্যাটিগোরির জন্যই নয়, এই অ্যাপ্সযুগে, হেন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে এই তত্ত্ব প্রযোজ্য হবে না। খালি বাংলাদেশের বিরাট কবিসাহিত্যিকের হাট সম্পর্কে প্রেডিক্ট করা শারুখের সাধ্যাতীত হবে। এরা বলিউডথ্রব ফেসবুকউডে সেকান্দার একেকজন। প্রত্যেকের দাবি অনুযায়ী তিনি কবি হিশেবে নতুন কবিতার নিশানবর্দার, বাকি সবাই গ্রোস্যারি-শ্যপের গুমড়োমুখো প্রোপ্রাইটার, তিনিই ‘বেত্তমিজ দিল্’ আইটেমে মাধুরিজির সনে আশ্নাই-করতে-পারা রানবির কপুর অফ বেঙ্গলি কবিতা আর বাকি সক্কলে গরলে ভেল তথা বাংলা কবিতার জনি লিভার, তিনিই রকেটলঞ্চার আর বাকি সকলে অ্যানশিয়্যান্ট ম্যারিনার। এইসব কারণ ও হুজ্জোতির বিপদাপদ সম্পর্কে আগেই আঁচ পেয়ে শারুখ খান কখনোই বাংলাদেশের ফেসবুকিশ কবিতাযাত্রাপালা সম্পর্কে এখনও ‘বলিউড হাঙ্গামা’ বা আরও সমস্ত জর্নালে মুখ খোলেন নাই। কিন্তু সমস্তই আন্দাজ আমাদের, অন্য কারণেও হতে পারে।

এইখানেই, এইভাবেই, মাধুরিজির স্টারডম বোঝা যাবে। এবং তিনি স্যুপারস্টার, শারুখের উইটি বীক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে এবং অন্য যে-কোনো অবলোকন থেকেও মাধুরিজি দি লাস্ট ডাচেস্, তিনি হো ভিন্না। না, শারুখের চেয়েও অভিনয়লীলালাস্যে মাধুরিজি বেহতর এহেন উদ্ভট তুলনা বাংলাকবির কম্ম হলেও হতে পারে; এই বিসদৃশ তুলনা টানিয়া যাদবপুর য়্যুনিভার্সিটির কম্প্যার‍্যাটিভ লিট্যার‍্যারি স্টাডিজ বিভাগের বা ঢাকার কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসাবিদ্যালয়ের মিডিয়াস্টাডিজ বিভাগের মাখন-মেয়োনিজ রুটিতে মাখাতে পারেন, আমরা হাবা যুবকের হাসি দেখার অপেক্ষায় থেকে যাই টিল্ দি আপকামিং স্প্রিং। তবে এইটা আলবৎ লক্ষ করে দেখব যে ইন্ডাস্ট্রির কো-স্টারদের সঙ্গে মাধুরিজির রেষারেষি ঠিক কর্ণপটহে এসে পৌঁছায় নাই আমাদিগের। মহানায়িকার নখরামির দরকার হয় না বাস্তবে; পর্দায় বিস্তর নখরা মাধুরিজিকে করতে হয়েছে যদিও, অগত্যা নিশ্চয়। এ-ও লক্ষ করব আমরা যে ক্যারিয়ারে মাধুরিজি খুব-যে দাগ কাটার মতো রোলে অভিনয় করেছেন এমন নয়, সেই সুযোগও তো বলিউডি ঝালমুড়ি ফিল্মে নেই বেশি-একটা। ফরম্যুলা ছায়াছবির সুখদুঃখের কাহিনি আমরা জানি তো সকলেই। এর মধ্যেই চিরুনিটা চালাতে হবে। হ্যাঁ, জানব বৈকি ধীরে-স্যে, মাধুরিজির পাপ ও পরমায়ু সম্পর্কে একটা আইডিয়া আমরা বানায়ে নেব অচিরে।

৪.
‘তেজাব’-এর পর ‘রামলক্ষণ’ ও ‘পারিন্দা’ মাহতারিমা মাধুরিজির দুইটা ছায়াছবি, যে-দুইটায় তিনি লিড হিরোয়িন হয়ে একই বছরে আবির্ভূত হন, দ্বিতীয়োক্ত ম্যুভিটি শুনেছি তখন অস্কারে গেছিল এবং লভেছিল সপ্রশংস ম্যুভিক্রিটিকদৃষ্টি। ঠিক পরের বছর থেকে পরপর বেরোতে থাকে ‘দিল্’, ‘সাজন্’, ‘বেটা’, ‘খলনায়ক’, ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’ প্রভৃতি বিগ হিট্ ম্যুভিগুলো। লক্ষণীয়, ঠিক নারীক্যারেক্টারকেন্দ্রী না-হয়েও উল্লিখিত ম্যুভিগুলো সফল হয়েছিল মাধুরিজির অভিনয় এবং নৃত্যকলায়; মেইকিং খুব যে আহামরি তা তো নয়। কিংবা কাহিনির জঙ্গম খুব-যে বেজবাব বুলন্দ্ দরোয়াজার আদপে তেমন কিছুই না। তাহলে কেমন করে এল সফলতা? তা তো বলা দুরূহ না-হলেও জেনার‍্যালাইজেশনের ঝুঁকিবহ।

বলিউডের পৌরুষদর্পদর্শানো ম্যুভিবাজারে মেইলশোভিনিস্টিক অ্যাপ্রোচের ছড়াছড়ি শিশুটিও বোঝে, বধূটি তো বোঝে তা বলাই বাহুল্য, এরপরও ‘ফেবিক্যল-স্যে’ আইটেমে ম্যাজিক-হিপ্নোটাইজড হয়ে থাকে স্পেক্টেটর নির্বিশেষে। এই ম্যাজিশিয়্যান বলিউডম্যাসালা হেলাফেলার বিষয় নয়। এইটাই ফার্স্ট-অফ-অল গভীর অনুধ্যানের। খালি ইন্সটিঙ্কট্ আর গড়পরতা জনরুচির অবনমন এইসব কথাবার্তা বাজখাঁই জবানে চেঁচিয়ে এখন আর পার পাবার দিন ম্যুভিবোদ্ধাদের নাই মনে হয়। এইগুলো বরং আলোচ্য হিশেবে এখন সিরিয়াস্।

পুংচরিত্রের চিত্রায়ণভিত্তিক ম্যুভিতেই মাধুরিজি নিজের জায়গাজমিন করে নিয়েছেন। এবং করেছেন এমনভাবে যে, এখন এমনকি অতিবৃহৎ মাধুরিনিন্দুকেও বলবে না যে ‘বেটা’ আনিলজির ছবি, বা ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’ সল্লুজির, বা ‘দিল্’ আমিরজির, ‘খলনায়ক’ সাঞ্জুবাবার বললেও বলতে পারে, যদিও ছবিতে মাধুরিজির এন্ট্রান্স ঘটে একেবারে পর্দা কাঁপিয়ে — একটি প্রিজনহাউসে ইনমেইটের সঙ্গে ডায়লগ ডেলিভারি আজও শৌর্যের স্মৃতি হিশেবেই দর্শক স্মরণ করে, যেখানে ‘ক্যায়সি আউরাৎ হ্যায় তু?’ প্রশ্নের জবাবে মাধুরিজি সপাট তানে একটা থাপ্পড় কষায়ে পর্দায় পিনপতন স্তব্ধতা নামিয়ে বলেন ‘অ্যায়সি আউরাৎ হুঁ ম্যায়’ এবং সোল্লাসে সকরতালি রিজোয়েস্ করে দর্শক। আমরা তো প্রেক্ষাগৃহে দেখি নাই, কিন্তু অনুমান করি রিয়্যাকশন, ভিসিআরে দেখার সময় এইসব প্রত্যক্ষ করেছি। শুধু এই-কয়টাই নয়, মাধুরিজির অংশগৃহীত সমস্ত ম্যুভির ক্ষেত্রেই এই কথাটা খাটানো যাবে যে এখন সেগুলো নায়কের কারণে নয়, নায়িকার কারণেই স্মৃতিলগ্ন হয়ে আছে। এছাড়া ‘খলনায়ক’ ম্যুভির ‘চোলি-কা পিছে ক্যায়া হ্যায়’ গানে মাধুরিনৃত্য পরবর্তী অসংখ্য ছবিতে বলিউডি ডিরেক্টরদের পয়সা উসুলের ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে ওঠে। ট্রেন্ডসেটার হয়েছেন তিনি এই একবার নয়, এর আগে-পরে অনেক অনেকবার। কিন্তু মাধুরিনৃত্যালাপ এখনই উঠছে কেন? পরের কোনো সিজনে এইটা আরও ভক্তিবিন্যাস্ত গলায় বলার জন্য তোলা থাক।

মাধুরিজি অভিনীত ছবিগুলো ওয়ান-আফটার-অ্যানাদার মাধুরিময়, মাধুর্যমণ্ডিত, মাধুরিমুখর; যদিও পুংকেন্দ্রিক কাহিনিবিন্যাস, তৎসত্ত্বেও; এইটা কীভাবে হয়, এবং কেন? বলা হবে, গ্ল্যামার; বলা হবে, নাচ; বলা হবে, সুড়সুড়ি; — না, জনাব! ওগুলো থাকলেও ম্যুভির মধুগুণের জন্য ওগুলো থোড়াই ক্রিয়াশীল। উদাহরণ বানানো যাক এ-প্রাসঙ্গিক একটা। কারিনা কপুরের নাচ, অভিনয় এবং অন্যান্য কসরত মনে এনে একবার বিবেচনা করুন, দেখবেন আলো আসিতেছে। এই বেচারিকে, নবাব পরিবারের এই বধূটিকে, এত পরিশ্রম করে নেচেকুঁদে খাটিয়া ভেঙে ফেলতে দেখা যাইলেও মনে হয়, আহা, বেচারি, দুইটা রুপাইয়ার জন্য কী খাটুনিটাই-না করছেন! মনে হয় টার্মিনেটর-টু ম্যুভির আর্নল্ড শোয়ার্জিনেগ্যর নাচিতেছে। পাশাপাশি মাধুরির নাচ ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ নখরামোগুলোও স্মুথ ও স্যুদিং একটা অ্যাটমোস্ফিয়ার ক্রিয়েট করে আপনার দৃশ্যজগতে। আর সুড়সুড়ি ও অন্যান্য নিগ্যাটিভ কনোটেশনের শব্দগুলো যদি পাড়েন, তো মনে করায়ে দেই জিনাত আমানের স্মৃতি, কিংবা সিল্ক স্মিতা প্রমুখ; কারিনাজির ঘটনাটা ওই জিনাত আমান। মন্দ বলছি না, দরকার আছে জিনাত আমানের, খালি জিনাত আমান আপনার ড্রিমক্যুইন হয় কি নয় এইটাই জিজ্ঞাস্য।

মোদ্দা কথাটা, মাধুরিজির ন্যায় লার্জার-দ্যান-স্ক্রিন শিল্পীর ক্ষেত্রে, পার্সোন্যালিটি হয়ে ওঠা। নাচ দিয়ে, অভিনয় দিয়ে, এমনকি নখরামো ও সুড়সুড়ি দিয়েও পর্দাব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা যায় এবং ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার ব্যাপারটা ফাইন্যালি ডিফাইন করাও মুশকিল। ওইটা থাকে এসবের বাইরে কোথাও, ওইটা সাম-প্লেস্-এল্স বিরাজ করে সম্ভবত। কবি ও কবিতার ক্ষেত্রে যেমন। অনেক ছন্দ পুরলেন ঠেঁসে, অনেক ছন্দোমুক্তি, অনেক শহর, অনেক স্মার্টনেস্, অনেক ঢাকাই রক, অনেক নতুন টাইম ও স্পেস্, বকরবকর অনেক করলেন দেশবিদেশ কাটপিস্ মেরে। আল্টিমেইটলি কবি আর কবিতার ব্যাপারে কী হলো, মীমাংসা আদৌ সম্ভব? বাগিন্দ্রীয়ে না-সম্ভবে, হে আকেলমান্দ, ইশারায় সম্ভব। মাধুরিজির অমীমাংসিত রহস্য ক্রমশ উদ্ঘাটিত হবে না, অ্যাট-লিস্ট কতিপয় ক্লু যোগানো যাবে না, এমন মনে করাটা বাড়াবাড়ি।

৫.
‘মুঝে নিন্দ না আয়ে, মুঝে চেন না আয়ে / কোয়ি যায়ে জারা ঢুন্ড-কে লায়ে / না জানি কাহা দিল্ খো গায়া’ — আমরা তখন সপ্তম, মানে কিনা আমরা তখন সেভেনে, সপ্তমশ্রেণির বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ কেউ কেউ, কেউ-বা বিশিষ্ট বান্দর, পেকে পুরোপুরি উঠি নাই তখনও, তবে উঠি উঠি পা পা করছি সক্কলে, এবং উপোস বুভুক্ষু ম্যুভি দেখার ছুঁতোনাতা খুঁজতে খুঁজতে খাজুল দিনগুজরান করছি। বছরের এ-মাথা ও-মাথা পাঁচ-সাতখানা সাকুল্যে দেখে ওঠার অপোর্চুনিটি পাচ্ছি এবং স্ক্যানড কপির ন্যায় বিলকুল মনে রেখে দিচ্ছি সব দৃশ্য সমস্ত সংলাপ সব সুর। ম্যুভি দেখছি অল্প, সুর ও সংলাপ শোনার সুযোগ পাচ্ছি তুলনামূলক বেশি, স্টিরিয়ো প্লেয়ারে ক্যাসেট থেকে সেসব গরুর চেয়েও অধিক আগ্রাসী নিরীহ নয়নে গিলছি নাকে-মুখে, এইভাবে একবার দেখা ছায়াছবির গানমালা হাজারবার শুনছি ভাইবোন-কাজিন মিলে একদঙ্গলে। এই প্রক্রিয়ায়, এই পথ ধরে, দৃশ্যপটে মাধুরিজির প্রবেশ; দিল্ খো গায়া মাধুরিজির সঙ্গে আমাদেরও। উনি যদিও জানতেন না, মাধুরিজির কথা বলছি, বা ড্যাম শিওর ছিলেন না তার হৃদয় খোয়া যাওয়ার ব্যাপারে; আমরা জানতাম আমাদের হৃদি ভেসে যায় কোথায়, হৃদি ভেসে যায় মাধুরিজি-কা সাথ সাথ; হ্যাঁ, ফ্রয়েডের কসম-কিরা কাটবার জরুরৎ নেহি পাড়েগা, আমরা জানতাম ওই সময়েই। কিন্তু সে-কী শুধুই নৃত্যপটুত্বের কারণে? সে-কী শুধুই রূপমোহ? শুধুই সিনেমা-সিনেমা? না, মাধুরিজি, না! এ কেবলি বিলাসব্যসন নয়, এ কেবলি নৃত্যচাতুরির ট্র্যাপ নয়, সখা হে! সেই সময়ে ব্যক্তিত্ববিকাশ বা বড়বয়স্ক হয়ে ওঠার শর্তাবলি জানতাম না যদিও, পরে জেনেছি যে ইনডিড ওই সময়টাতেই বড়বয়সপ্রাপ্ত হয়ে উঠছিলাম, অসহায়ভাবে বড় হচ্ছিলাম ক্রমশ। সময়, পাঁজি মিলিয়ে দেখছি এখন, স্মৃতিঝাঁপি আগুপিছু করে — সেইটা ছিল ১৯৯০।

ঘুমের ব্যঘাত হচ্ছিল বললে ডাহা মিথ্যা বলা হবে। বরঞ্চ পড়তে বসে ঢুলছিলাম, দশটা বাজতে-না-বাজতেই নিদ্রাদ্বীপে বিহার করছিলাম বেঘোরে। কিন্তু গান শুনছিলাম তখন, ওই তো শোনালাম গেয়ে শুরুতেই, ‘মুঝে নিন্দ না আয়ে’ এবং মাধুরিজির গুণকীর্তন করছিলাম গুরুজনের কান বাঁচিয়ে। ‘হালাত ক্যায়া হ্যায় ক্যায়সে তুঝে বাতাউ ম্যায় / কার্বাৎ বদল বদলকে রাত বিতাউ ম্যায়’ — এইটা বাড়াবাড়ি বিবৃতি বলাও যায়, আবার সমুজদারের জন্য বলা বাহুল্য হয় যে তেমন বাড়াবাড়ি কিছু ছিলও না তাতে। সিচ্যুয়েশন ঊনিশ-বিশ হলেও মোটামুটি কিন্তু অভিন্নই এবং আমাদেরই। ‘পুছো জারা পুছো ক্যায়া হাল হ্যায় / হাল মেরা বেহাল হ্যায় / কোয়ি সমজ না পায়ে ক্যায়া রোগ সাতায়ে’ — ইট ওয়্যজ ট্রু, সহি, বিলকুল। ‘জান স্যে ভি প্যায়ারা মুঝকো মেরা দিল্ হ্যায় / উসকো বিনা এক পল-ভি জিনা মুশকিল হ্যায়’ — সেভেনেই অতটা হাল না-হলেও মনে মনে তেমনটাই ভাবতাম যে স্যমওয়ান ডিভ্যাস্ট্যাটিং অ্যান্ড ক্রুয়েল বিউটি ইজ কিলিং মি সফটলি; কিন্তু পরের লাইনগুলো বুঝে বা না-বুঝে ভালো তো লাগত এমন যা বলার নয়, — ‘তওবা মেরে তওবা ক্যায়া দর্দ হ্যায়, দর্দ বাড়া বেদর্দ হ্যায় / কভি মুঝকো হাসায়ে কভি মুঝকো রুলায়ে / কোয়ি যায়ে জারা ঢুন্ড-কে লায়ে …’ অ্যানিওয়ে, অনেক সময় গেলে পরে একদিন বুঝেছি এই-যে ‘হাল মেরা বেহাল হ্যায়’ বা ‘দর্দ বাড়া বেদর্দ হ্যায়’ ইত্যাদি লাইনের নিহিত কূটাভাসগুলো; উত্তরোত্তর এই ও অন্যান্য গানের ভেতরকার মজাগুলো অর্থসমেত তুলতে পারব অনধিক বছর-পাঁচের মধ্যে। তদ্দিনে গায়ে গত্তি লাগতে শুরু করবে আমাদের, ছাঁটি-ছাঁটি দাড়িগোঁফ আমরা, ডাঙ্গর হয়ে উঠছি জিসম্ ও দিল্ উভয় দিক থেকেই। ফি আমানিল্লা মেট্রিক এক্সামে বসছি সবাই মিলে সপরিবার। কিন্তু অন্যান্য ক্যাসেটের পাশাপাশি ‘দিল্’ ম্যুভির ক্যাসেটখানাও যত্নে রেখে দিচ্ছি এবং রোদে শুকোচ্ছি ফিতা আর বাজাচ্ছি ফাঁকফোকরে।

এই সিনেমার গান সব-কয়টিই হিট করেছিল তখন, ড্রয়িংর‍্যুম থেকে চাদোকান সর্বত্র সমমাত্রায়, আজও সমান অ্যাপিল এর। বিচ্ছেদী গীতিগুলো সচরাচর চ্যাংড়াপ্যাংড়াদের ডাইরেক্ট হিট করতে সক্ষম হতো না তখন, কিন্তু ‘দিল্’ ম্যুভির ক্ষেত্রে এর অন্যথা ঘটতে দেখা যায়। ‘দিল্’ প্রথম নয়, এর আগে ‘ক্যায়ামত স্যে ক্যায়ামত তক’ থেকে এই ধারা শুরু হয়েছিল, পরে অন্যান্য ম্যুভিতেও অব্যাহত থাকে স্যাড-রোম্যান্টিক মেলোডির এহেন জয়জয়কার। এক্সাম্পল চাইলে দেয়া যায় বিস্তর; যেমন, ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’, ‘সাজন’, ‘আশিকি’ ইত্যাদি। কিউএসকিউটি থেকে যে-কোনো গান চয়ন করে দেখা যায় এর সত্যতা, বা আশিকি থেকে, এর পরের জেনরেশন অজয় দেবগনদিগের ‘ফুল ঔর কাঁটা’ বা ‘ছায়া প্যায়ার কা’ বা ‘বেখুদি’ থেকেও। ‘ধীরে ধীরে স্যে মেরে জিন্দেগি ম্যে আনা / ধীরে ধীরে স্যে ইয়ে প্যায়ার কো বাড়ানা’ — আশিকির গান কথায়-মিউজিকে-দীর্ঘচাপাশ্বাসে আজও অমলিন। কয়েকটা গান বোধহয় চিরায়ত সৌন্দর্য লভেছে এর মধ্যে, একটি দিল্ ম্যুভির এই আলোচ্য, অন্যটি কিউএসকিউটি ম্যুভির ‘হ্যায় ম্যেরে হামসফর / ইক জারা ইন্তিজার’ প্রভৃতি।

সেকালে ক্যাসেট শুনে গীতিকার-সুরকারদের নাম মুখস্থ হয়ে যেত। খুব নতুন হাওয়া বইয়েছিলেন লিরিক্সে পুরাতনী গুলজার সাহাব আর জাভিদ আখতারের পাশাপাশি ইম্যার্জিং সামির নামে একজন; সুরে যেমন দুই জুটির নামডাকের পারা তরতরিয়ে চড়ছিল — আনান্দ-মিলান্দ আর নাদিম-শ্রাবান; প্রথমোক্ত জুটি তথা আনান্দ চিত্রগুপ্ত আর মিলান্দ চিত্রগুপ্ত ‘দিল্’ ছাড়াও জয়যাত্রা জারি রেখেছিলেন অন্যান্য অনেক ম্যুভিতে একাধারে বেশ অনেকদিন, এদের ঘোড়ার জিনে এসে গুত্তা মারেন ‘আশিকি’ দিয়ে নাদিম-শ্রাবান। মাধুরির সঙ্গে যিনি অনেকদিন দোনোমোনোর ভেতরে রেখেছিলেন তিনি জুহি চওলা। মাধুরিজি নাকি জুহিজি — হু ইজ দি ক্যুয়িন অফ হার্টস্, এই বিদগ্ধ দ্বৈধ অনেকদিন গ্রস্ত করে রেখেছিল আমাদিগেরে। যা-হোক।

কিউএসকিউটি, দিল্, আশিকি ইত্যাদি ম্যুভি দিয়ে একটা প্যারাডাইম্ শিফট ঘটেছিল শুধু হিন্দি নয়, হিন্দির দেখাদেখি গোটা পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডের সিনেমারাজির। মোটা দাগে সেইটা হচ্ছে মধ্যবয়স্ক চরিত্র চিত্রায়ণের বাইরে বেরোনো। যদিও এমন বাইরে বেরিয়েছে যে এখন চোদ্দবছর ছাড়া নায়িকা আর সতের বছর ছাড়া নায়ক রোলে এন্ট্রি পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে বলিউডে। আলিয়া ভাট নয় কেবল, অনেক বালিকা নায়িকা পাওয়া যাবে এর প্রমাণ হিশেবে যারা আজ হয়তো বিবাহপ্রণয়যোগ্যা হয়ে উঠেছেন ক্যারিয়ারে তেরোখানা ছায়াছবি জুতে। এইসব হিসাবকিতাব থেকে এতদঞ্চলের পুংমনস্তত্ত্ব অল্প হলেও বোঝা যায় কি না, আল্লা জানেন। বিফোর কিউএসকিউটি/দিল্, বিফোর আশিকি এটেসেট্রা, ম্যুভি ইত্যাদিতে গোটা পরিবারটা পাওয়া যাইত, এই নতুন সিনেমাকালে এসে পরিবার উধাও হতে শুরু করে কাহিনিচিত্র থেকে; ফোকাস্ হতে থাকে প্রেমপাত্র-প্রেমপাত্রী। ইন্ট্রেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যে, ইন রিয়্যালিটি, বাস্তবেও পরিবার ভাঙতে ভাঙতে একেবারে এককেন্দ্রিক হতে শুরু করে এই পর্যায়ে, এই ফ্রিমার্কেট গ্লোব্যালাইজেশন গোড়ার দিকটাতে, এই ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দটাকে একটা বেঞ্চমার্ক ধরে এগোনো যায় এই খোঁজাখুঁজিকাজে। কিন্তু আমরা খুঁজি অন্যকিছু, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ক্ষ্যাপা যেমন খোঁজে পরশপাথর, হন্যে হয়ে আমরা খুঁজতেসি সিনোরিতা মাধুরিজিকে।

৬.
ডেব্যু ম্যুভির পরে একাধারে আরও গোটাছয়ের মতো ম্যুভিতে মাধুরিজি ঠিক ক্লিক করতে পারেন নাই, ম্যুভিগুলোও ফ্লপ করে, কিন্তু ম্যুভি হিট করা বা না-করার ব্যাপারটা মাধুরিজির একলার হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না নিশ্চয়। মাধুরিজি ঠিকই কিন্তু নজর কাড়েন প্রথমাবধি। কার নজর কাড়েন? জহুরিদিগের, আলবৎ। এইটিএইট থেকে একটানা নাইন্টিনাইন বা তারও পরে যেমন টুথাউজ্যান্ডসিক্সে সাঞ্জায় লীলা বান্সালি নির্মিত ‘দেব্দাস্’ অব্দি মাধুরিজিকে রাজ করতে দেখা যাবে, সেইটা তো বলিউড দিভ্যা হিশেবে অনস্ক্রিন থাকার খতিয়ান। তবে নাইন্টিনাইনেই যুক্তরাষ্ট্রে বেইসড কার্ডিয়োভ্যাস্কুলার ডক্টর শ্রীরাম মাধাভ নেনে বাবুকে বে-থা করে তিনি গদি থেকে স্বেচ্ছায় ক্যুইট করেন। রিটায়ার করার পক্ষে ম্যাচিয়্যুর সময় সেইটা না-হলেও ডিসিশনটা মাধুরিজি নিয়েছিলেন সংসার আর সন্তান ভরনপোষণের স্বার্থ ভেবেই।

দীর্ঘ দশকাধিক এই সময়ের মধ্যে কি আর কেউই আসেন নাই মাধুরিমেধার আশেপাশে? তা হবে কেন, অনেকেই না-হলেও কয়েকজনের নামোল্লেখ মানহানিকর তো হবেই না, উপরন্তু উনাদের নামোল্লেখ দরকারও। তব্বুজির নাম নিতে হয়, কিংবা অ্যাশেরও; যদিও দ্বিতীয়জনের ব্যাপারে নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত রিজার্ভেশন রয়েছে; কিন্তু সবাইকে টেক্কা দিয়ে এই-সময়ে প্যার‍্যালালি উঠে এসে সর্বগুণে গুণান্বিতা নায়িকা হন দুইজন, উনারা বাংলাঘরের ব্যুৎপত্তি হলেও বলিউডেই দুই-বা-ততোধিক প্রজন্ম ধরে ব্যবসাপাতি করে আসছিলেন, দুইজনেই মুখুজ্জে সিলসিলা-সালতানাত, যথাক্রমে রানিজি এবং কাজালজি। দ্বিতীয়োক্ত ঔজ্জ্বল্যে বেড়ে দেখিয়েছেন। এছাড়াও স্যুশ্মিতা, স্যুশ্ সেন, অন্তত শরীরকাঠাম আর বিশেষত ‘চিঙ্গারি’ সিনেমাটার জন্য অনেকের কাছেই স্মৃতিনিত্য। তবে ম্যাসালাম্যুভিতে এই-সময়টায় আধাশত অন্তত এসেছেন যারা বক্সঅফিস্ একবার হলেও উন্মাতাল করেছেন। অনেকেই আছেন যারা ঢাকঢোলশোহরত বাজিয়ে এসে বেশ অনেকদিন থেকে ফের চলেও গেছেন দাগটা না-কেটে, এমন একজনের নাম হতে পারে করিশ্মা, দ্য গ্রেইট কপুর খান্দানের ওয়ারিশ। ‘সেক্সি সেক্সি সেক্সি মুঝে লোগ বোলে’ গানে এর উত্থান হয়েছিল স্মরণ হয়, ফিজিক্যালি না-হলেও আর্টিস্টিক্যালি ইনি গরহাজির দেড়-দশক ধরে। উনার ফ্যামিলি মেম্বার্স অনেকে এই লাইনে করেকম্মে খাইলেও উল্লেখ বাহুল্য। ঊর্মিলা মাতান্ডকরের কথা বলতে হয়, ইনি বেলেমাছের ন্যায় একটা নাচকৌশল জানতেন এবং ভূতপ্রেতের সিনেমায় বেশ অভিনয়ও করতেন মনে পড়ে আবছা। বা আমাদের মনে পড়তে পারে এমনি বিস্তর নায়িকাদিগের নাম; মমতা কুল্কার্নি থেকে স্যুনালি বেন্দ্রে কি শিল্পা শেঠি ইত্যাদি। কিন্তু একটা নাম নিতেই হয় পৃথক বাক্যে, যেমন পৃথক বাক্যে তব্বুজির নাম আমরা নিয়েছি, নেপালি রাজবংশের সেই প্রিন্সেসের নাম মানিশা কৈরালা।

মাধুরিজি নিশ্চয় সেকালে যে-জিনিশটাকে ডাকা হতো আর্টফিল্ম নামে, সেইসবের নায়িকা হইতে আসেন নাই। কিন্তু ভালো ম্যুভিতেই অভিনয় করতে চেয়েছেন, করেছেনও কালেভদ্রে সুযোগ পেলে, বলিউড মেইনস্ট্রিমে সেই সুযোগ কম, তখন তো অধিকতর কমই ছিল। স্মিতা পাতিল হইবারে নিশ্চয় তিনি ইচ্ছুক ছিলেন না, তারপরও তো দেখেছি তিনি স্মিতাজিরই ন্যায় ক্ষীণ পরিসরের রোলেও স্বেচ্ছায় কাস্ট হয়েছেন এবং প্রশংসা পেয়েছেন আমাদিগের। ‘সতী’ ম্যুভিটা ক্যারিয়ারের গোড়ার দিককার হলেও উদাহরণ হিশেবে এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে, যদিও ফ্লপ ম্যুভি কিন্তু মাধুরিজি ওয়্যজ্ ওস্যম্ ওভার দ্যায়ার। স্যুপারহিট ম্যুভি না-হলেও গ্যুড সাক্সেস্ ছিল মিঠুন চক্কোত্তির সনে ‘প্রেমপ্রতিজ্ঞা’ ছায়াছবিতে মাধুরিচিত্রিত রোলটা। বা ছোট কিন্তু উল্লেখযোগ্য অভিনয়ের জন্য স্মর্তব্য ‘ত্রিদেব’ ম্যুভির মাধুরিকৃত চরিত্র। তেমনি ‘পারিন্দা’ মাধুরিজির ভালো রোলে অ্যাক্ট করার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। শেষের তিনটে ম্যুভিই তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে কল্কে পেয়ে যাবার পরের ঘটনা। উদাহরণ চয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাগসই দুইটা এভিডেন্স এখন হাজির করা যাক, সেই দুইটা মাধুরিজি যখন মসনদে আসীন তখনকার ঘটনা, সেগুলো হলো ‘লজ্জা’ আর ‘দেব্দাস্’ ম্যুভিতে উনার দুই চরিত্র পরিস্ফুটন ও সেহেতু প্রভাব।

তবে যত-যা বলা হোক, শুধু অভিনয়ের জন্য মাধুরিজি অ্যাপ্রিশিয়েটেড হবেন, এমনটা আমার অন্তত মনে হয় না। ম্যাজিক, সবকিছু মিলেজুলে একটা জাদু উপস্থিতি, দ্যাটস্ ইট। শুধু অভিনয়ের জন্যে যে-অর্থে শ্যাবানা আজমিজি কিংবা নান্দিতা দাশ অভিনন্দিত হবেন বহুকাল, মাধুরিজি ঠিক সেই কাতারের তো নন। ওরা ছিলেন ভালো রোল পাবার ক্ষেত্রে ফর্চুনেইট দ্যান মাধুরি ওয়্যজ্। ভালো ম্যুভিডিরেক্টরের নাগাল পাওয়া মাধুরিরই শীর্ষবাসের কারণে সেভাবে হয়ে ওঠে নাই। কিন্তু যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন এরই ভিতরে, সেটুকু নিজের মতো করে বেস্ট ইয়্যুজ করেছেন মনে হয়। এরপরের কোনো অনুচ্ছেদে মাধুরিজির ডিরেক্টরভাগ্য ও ভালো স্ক্রিপ্টে কাজ করার ক্ষুধা নিয়া আমাদের জানা একটা গল্প আমরা শেয়ার করব নিশ্চয়, যেখানে দেখা যাবে যে মাধুরিজি একটা বাংলা কাহিনিতে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন তখনকার এক তরুণ পরিচালক ও পরবর্তীকালে যিনি অল-ইন্ডিয়াব্যাপ্ত মশহুর হয়েছিলেন ফর্মুলা ফিল্মের বাইরে যেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ম্যুভি বানিয়ে। অ্যানিওয়ে। কাজটা মাধুরিজির আর করা হয়ে ওঠে নাই শেষমেশ। নসিবের লিখন না-যায় খণ্ডন।

সব মিলিয়ে, যেটা ওই-যে বলা হচ্ছিল, তিনি ছিলেন সেই জাদুভূখণ্ডের লঘুডানা পাখি যার কাছে বাকি সবকুচ ম্লান হয়ে যায়। ফেয়ারি টেইল্স পছন্দ করে না এমন নরাধম দুনিয়ায় আছে নিশ্চয়, কিন্তু সংখ্যায় এরা অল্পই হওয়ার কথা। খোদ য়্যুরোপ-অ্যামেরিক্যাতেও পরিলক্ষ করা যাবে এর সত্যতা। ডায়ানা তিরোধানে, মেরিলিন ম্যুনরো প্রয়াণে, কেইট মিডল্টনের সঙ্গে প্রিন্স উইলিয়্যমের পরিণয়বন্ধনে মানুষ যে-হাঁউকাউ দেখায়, এতে করে মানুষের সেই ফেয়ারি টেইল্স ফন্ডনেস্ বোঝা যায়। মাধুরিজির জন্ম ও অমরত্ব জনসাধারণের এই ইচ্ছের, এই পরী-অভিলাষের, এই বিয়োন্ড-লাইফ থার্স্টের মধ্যেই বিরাজে। সম্ভবত, মনে হয় এই-রকম, ভুলও হতে পারে। কমলকুমার মজুমদার একবার যেমন বলেছিলেন কোথাও যে মাছরাঙা পাখির রঙ থাকে অর্ধেক বনে, অর্ধেক মনে। এই কথাটা আরও পরে যেয়ে আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠবে বলে এখনোব্দি মনে করা যেতে পারে।

৭.
সেই-যে একটা প্যারায়, এক-দুইটা আগের একটা প্যারার কিয়দংশ জুড়ে, ইন্ডিয়্যান ম্যুভিতে ফ্যামিলি ডিমোলিশনের কথা বলা হচ্ছিল, কথাটা খামাখা বলার জন্য বলা না। আদতে ফ্যামিলি তখনও ছিল বহাল ভূখণ্ডে, বেহাল হলেও বহাল ছিল, সেইটা নাইন্টিননাইন্টি ডিকেড। অমিতাভজি কিংবা রাজানিকান্ত্ বা সাত্রুঘ্না সিনা প্রমুখের ম্যুভিচিত্তিরে দেখা যেত গোটা ফ্যামিলিটাকে কেন্দ্র করে হিরো রোটেট করছে; নাইন্টি ডিকেডেই শুরু হলো ম্যুভি থেকে ফ্যামিলি উচ্ছেদন। তখন বাস্তবেও, ম্যুভিফিতার বাইরেকার জগতে, পরিবারভাঙন দৃশ্যত না-হলেও তলে তলে শুরু হয়ে গেছে। চাষবাসের আশ ছেড়ে লোকে আধাখেঁচড়া কারখানাকাজে দুইটা ক্যাশ পয়সা ইনকামের জন্য শহরাভিমুখী হচ্ছে এবং ক্রমে সেখানেই গেঁড়ে বসছে। এইটা খালি ইন্ডিয়ার সিন্যারিয়ো নয়, কিপিং ইট ইন মাইন্ড বাংলাদেশের ছবিটাও চোখে ভেসে উঠবে আমাদের। নাইন্টিজে এসে এই সিচ্যুয়েশন তথা ফ্যামিলি ভাঙনের পাল্সটা বাণিজ্যিক ছায়াছবি ঠিকই রিড-আউট করতে পারছে দেখতে পাব। তবে প্রতিবেদিত ছবিটা নানান মশল্লা সহযোগে পরিবেশিত হবার ফলে তখন-তখনই ধরা পড়ে নাই হয়তো দর্শকচোখে। মাধুরিজির শুরুর দিককার ছবিগুলোতে এন্টায়ার একটা ফ্যামিলি চিত্রিত হতে দেখি, পরের দিককার ম্যুভি থেকে সেইটা নিউক্লিয়াস রূপ পরিগ্রহ করতে করতে ভ্যানিশ হয়ে যেতেছে দেখব, কিন্তু ওই সময়েরই অন্য তরুণতরদের ম্যুভিতে স্রেফ কলেজকিড ফর্মুলা পালিত হতে শুরু হবে অজয় দেবগন বা সাইফ আলি খান প্রমুখের ম্যুভিনিচয়ে। এরপর, কালক্রমে, বাস্তবেরই ন্যায় স্রেফ ‘হাম-তুম এককাম্রে ম্যে বান্ধ হো’ পরিস্থিতির ব্যত্যয় দেখা যাবে অক্যাশন্যালি।

কিন্তু তর্কটা আছে দেখতে পাই নানাভাবে যে রূপালি পর্দার ফ্যান্টাসি ইন-রিয়্যালিটি জীবনযাপন ও দুনিয়াদারিটারে ইনফ্লুয়েন্স করে কি না। মানে, সেই বিতর্কে পক্ষের লোকজন বলে থাকেন যা-যা তার সারাংশ এ-ই যে কর্পোরেট ক্যাপিট্যালের লগ্নি উঠিয়ে আনতে একটা আখাম্বা কাল্পনিক বাস্তবতা চাপিয়ে দেয়া হয়, প্যুশ্ করা হয় ক্যাপিট্যালের বিজ্যায়্যার বাস্তবতা। গাড়িডিম্যান্ড আগেই ক্রিয়েট হয়ে থাকে, নাকি ডিম্যান্ড ক্রিয়েশনের গরজেই গাড়ি ইন্ট্রোডিউস্ করা হয়, এ সেই তর্ক। সময় ও সম্পদের সংগতি থাকলে দুই তরফেরই বক্তৃতা শোনা যেত। তবে সেমিনারের প্রতিপাদ্য অন্য বিধায় আমরা লাইনেই দাঁড়াই বরং; সোজা হয়ে? না, আরামে। অ্যাটেনশন!

তবে এই বিষয়ে মতানৈক্যের অবকাশ কমই নিশ্চয় যে ফ্যামিলি ডিমোলিশড হলে পরেই, নিউক্লিয়াস ফ্যামিলি ইহলোকে এসে গেলেই, ফ্যামিলি ভ্যাল্যুজ ইত্যাদির বাজার তৈয়ার হয় এবং ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’ বা ‘কাভি খুশি কাভি গাম্’ স্যুপারডুপার বাণিজ্য অর্জন করে। যা নাই, যা অনুপস্থিত, তা নিয়া ম্যাস্-পিপলের মনখারাপ ভাবের ঘরে সিঁধ কেটে ঢোকার কায়দা আধুনিক বিদ্যাবুদ্ধিশাস্তরের বাৎলানো জিনিশ। জলবায়ু চোদ্দটা বাজাইলাম আমিই সিএফসি ছড়িয়ে এবং আরও হ্যানত্যান রাহাজানি করে, ফের আমিই ক্লাইমেট-রেসিলিয়্যান্ট প্রোডাক্ট ল্যঞ্চ করে মালমাত্তা কামাই।

কিন্তু মাধুরিজি জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন পরিবারাবহেই, পিতামাতা-ভাইবোন মিলিতমিশ্রিত পরিমণ্ডলে, শিক্ষাদীক্ষাকালীন বড় হয়ে ওঠার গোটা মাধুরিজীবনাংশ পরিবারের সঙ্গেই কেটেছে। মুম্বাই শহরেই তিনি বর্ন অ্যান্ড ব্রট-আপ হলেও প্রোথিত ঐতিহ্যে তাদের পরিবার মারাঠি সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ। শৈশব থেকেই মারাঠিস্পিকিং, হিন্দিটা আয়ত্ত করতেই হয়েছে এবং হয়েই গিয়েছে অনায়াসে মুম্বাইনিবাসী হবার সুবাদে, ইংরিজিতেও প্রোফিশিয়্যান্সি এসে যায় ব্রিলিয়্যান্ট স্টুডেন্ট হওয়ায় বিনা আয়াসেই। জন্ম ১৯৬৭ সালে। মে মাসে। মে-ফ্লাওয়ার মাধুরিজি চার সহোদরের ভিতর সর্বকনিষ্ঠ। উপরে বড় দুই বোন এবং এক ভাই। মুম্বাই য়্যুনিভার্সিটি থেকে মাইক্রোবায়োলোজি ডিসিপ্লিনে মাস্টার্স মাধুরিজির কথা ছিল হবেন সায়েন্টিস্ট, অন্তত বিজ্ঞানশিক্ষক, টানা আটবছর প্রোফেশন্যাল স্কিল গেইন করেছেন কত্থক ড্যান্স বিষয়ে এবং সেহেতু হতে পারতেন নৃত্যয়িত্রী বা ভারতীয় কত্থককলার প্রথিতযশা বিদুষী। শেষের বিদ্যাটা সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই জানি এবং এ-ও অনুমান করি যে কেবলই হিন্দি সিনেমায় স্ট্যামিন্যা না-খর্চে মাধুরিজি নিজের নাচপ্রতিভা আরও উৎকৃষ্ট উপায়ে ব্যবহার করতে নিশ্চয় পারতেন। কিন্তু যা হয়েছে তা হয়েছে, যা হয়নি তা হয়নি, এ নিয়া বিলাপ বৃথা। ভাগ্যিস! জড় অথবা জীবের কোনোপ্রকার বিজ্ঞানী হন নাই তিনি, হন নাই পিয়েচডি তকমাধারী শিক্ষক, দেশদুনিয়ায় বিস্তর-বেশুমার পণ্ডিত পক্বকেশ অধ্যাপক; জয়শ্রী জীবনের স্নিগ্ধমূর্তি মাধুরিজি তো অদ্বিতীয় ও অনন্যা।

পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি মাধুরিজির আনুগত্য আমরা ঠাহর করতে পারি জীবনের দু-দুটো বড় ঘটনায় গৃহীত পথরেখা থেকে। এক, তিনি যখন প্রায় স্ক্যান্ডালবিহীন ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়টার সময় নিজের প্রেম অথবা মিডিয়াম্যানিফেস্টেড প্রণয় থেকে উইদাউট অ্যানি স্ট্যাইটমেন্ট নিজেরে উইথড্র করে নিচ্ছেন; এবং দুই, শ্রীরাম নেনের সঙ্গে নিরানব্বই ইসায়ীতে যখন পোক্তপাকা গাঁটছড়া বেঁধেছেদে ডেনভারবাসী হচ্ছেন। প্রথম ঘটনাটা আমরা আবার কোথাও সবিস্তার দেখতে চেষ্টা চালাব আরেকবার, তৎকালীন প্রিন্টপত্রিকার বরাতে ফ্ল্যাশব্যাকের হেল্প রিক্যোয়্যার্ড হবে সেক্ষেত্রে প্রচুর, রয়েসয়েও বলা লাগবে। দ্বিতীয় ঘটনাটা র‍্যাদার চোখের সামনেই এবং অল্পে সেরে নেয়া কাজেই অসম্ভব নয়। নেনেজির সঙ্গে মাধুরিজির শাদিসুদা পারিবারিক সিদ্ধান্তেই হয়েছে; এবং, লক্ষণীয়, নেনেজি নিজে একটা মারাঠি কুলীন পরিবারজাত এনআরআই। ননরেসিডেনশিয়্যাল ইন্ডিয়ান। অ্যানিওয়ে। নেক্সট টাইম অন ইট, হোপফ্যুলি।

৮.
তিনি ইন্ডাস্ট্রি অক্যুপাই করবার আগে কেউ কেউ মনে করছিল জুহি বুঝিবা আসন পোক্ত করে ফেলেছেন। হ্যাঁ, তা খানিকটা মনে হয়েছিল বৈকি। কিছুদিন জুহিজিই ছিলেন এগিয়ে এবং সে-সময়টায় মাধুরিজির কপালে একের-বাদে-এক ফ্লপ জুটছিল। জুহিজির অবয়বে এবং এক্সপ্রেশনে একটা ইনেইট ইনোসেন্স আমাদের ভালো লাগত, আজও লাগে তাই, কিন্তু পূর্ণ নারীর পরিস্ফুটন জুহিজির মধ্যে মিলছিল না। আজও অনুরূপ, জুহিজিতে নেই ফিমেল সিডাক্টিভিটি, ‘ওয়েইক আপ, সিড’ বা মাধুরিজিরই সঙ্গে উনার কামব্যাক ম্যুভি ‘গোলাবি গ্যাং’ কোথাও জুহির কিশোরীকীর্তনিয়া ভাবভঙ্গির বাইরেকার অভিব্যক্তি বিরল; এমনকি শেষোক্ত ম্যুভিটিতে, ‘গোলাবি গ্যাং’-এ অ্যান্টি-হিরোয়িন রোলে জুহিজিকে কমিক ক্যারিক্যাচারই লাগে। কিন্তু মন্দ লাগে না বটে। ‘কেয়ামাত স্যে কেয়ামাত তক’ জুহিজির যে-চেহারা গড়ে দিয়েছিল, সেইখান থেকে বেরোতে তিনি পারেন নাই ইভেন শারুখের সঙ্গে একের-পর-এক হিট ম্যুভি দিয়েও। যাকে বলে ভার্সেটিলিটি, মাধুরিজিতে যা পাওয়া যাচ্ছিল ফ্লপের ভেতরেও, জুহিজিতে তা ছিল না। বলিউডবোদ্ধারা তা মার্ক করছিলেন নিশ্চয়।

কিন্তু জুহি নন, মাধুরিজি যখন অবতরণ করেন মর্ত্যে, শ্রীদেবীই ছিলেন তখন তখতাসীন। ইন-ফ্যাক্ট শ্রীদেবীজির হাত থেকেই মুকুট উঠেছে মাধুরিজির শিরে। মাঝখানে জুহিজি ছিলেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বড়জোর। যদিও কথালাপে মাধুরিজি জানিয়েছেন জুহি কিংবা আর-কেউ নয়, শ্রীদেবীজিকেই তিনি নিজের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। তা, এইটা র‍্যুটিন কথার মতোই, ডেকোরাম যেন, বলতে হয় সবাইকেই সেইফ সাইডে থাকার জন্য। তবে এ ইতিহাস-সমর্থিত তথ্য অবশ্যই যে শ্রীদেবীজির পরেই মাধুরিজি নাম্বার ওয়ান স্কোর অ্যাটেইন্ করেছেন। মনে পড়বে একটা ব্যাপার যে এর আগে একনাম্বার আসনখানা ধার্য ছিল ধারাবাহিকভাবে দক্ষিণীদের বসার জন্য, দক্ষিণী নায়িকারাই সিরিয়্যালি বলিউডে একচ্ছত্র রাজ করেছেন বৈজয়ন্তীমালা থেকে শ্রীদেবী পর্যন্ত। সাতের দশকে, এবং আটের দশক জুড়ে, এই আসনে হেমা মালিনি আর রেখাজিরা রাজ করে গেছেন; অব্যবহিত পরে, এই দুইজনের, এলেন শ্রীদেবীজি। নব্বইয়ের মধ্যপাদে এসে শ্রীদেবীর হাতছাড়া হলো সাধের আসন। কবি বিহারীলাল বাংলা পাঠ্যপুস্তকে প্রায় নির্বাসিত, রবি অস্তমিত, বৌঠান বহুদিন হয় আত্মহননে বিদায়ভূত। বলতে গেলে একটা রেকর্ড ভাঙলেন মারাঠাকন্যা মাধুরিজি এই আসনগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এরপর জয়যাত্রা তার, স্বেচ্ছায় নবজাতকের জন্য বাসস্থান ছাড়ার সুকান্তীয় অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণের আগপর্যন্ত, কেউ পারে নাই রুখতে।

একদিনে হয়নি বিজয়, ছিনিয়ে নেন বললেও ভুল বলা হয়, একেকটা ধাপ সপরিশ্রম পেরিয়ে এসেছেন তিনি শীর্ষাসনে। কেবল জুহিজিই ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী, না, এমন নয়। কুসুমাস্তীর্ণই ছিল পথ, প্রচুর কুসুমের কলকাকলিতে মুখর তখন মুম্বাই, কুসুমে কুসুমে মাধুরিজির চরণচিহ্ন টলোমলো হলেও সধৈর্য সামলে নিয়েছেন অচিরে। এ এমন পথ, সাফল্যের পথ, এ-পথে কুসুমেরাই কাঁটার নামান্তর। কুসুমদিগের উল্লেখযোগ্য নামতালিকা, —  মানিশা, রাবিনা, করিশ্মা, শিল্পা, মমতা, কাজল, তব্বু, পূজা প্রমুখ। ফিনিশিং লাইনের ঠিক আগে তখনও-অমলিন তখনও-থ্রবিং শ্রীদেবীজি এবং সদ্য-রজঃস্বলা আলো-ঝলমল জুহিজি। কিন্তু ছোটবেলা ‘ফাউন্টেন অফ লাফ’ বলে যাকে ডাকা হতো, তরুণবেলায় সে-হাসিনির্ঝর অভিধার অর্থটা আরেকদিকে ব্যঞ্জনা বাড়ায় নৃত্যঝর্ণা হিশেবে, ভুবনমোহন হাসির কিরণ আর নাচের নন্দনের আধিকারিক মাধুরিজির সামনে বাকিসব খাজাঞ্চিবাবুর খাতার পাতা বাতাসে বেসামাল উলটপালট হয়ে যায়। যা ঘটবার কথা, অ্যাট লাস্ট, তা-ই ঘটে।

এহেন সাক্সেসের গোপন টনিকটা কি, ইত্যাকার প্রশ্ন তো সকল সফলের কাছেই একবার-না-একবার করা হয়, মাধুরিজিকেও করা হয়েছিল। ইন রিপ্লাই তিনি যা বলেন, তার একাংশ —  অভিনয়নিষ্ঠা, কাজের প্রতি একাগ্রতা আর অধ্যবসায় এই তিনের কিমিয়ায় সাক্সেস অফ মাধুরি নিহিত। সঙ্গে এ-ও বলতে তিনি ভোলেন না যে, সুস্থ প্রতিযোগই ঈপ্সিত/অভিপ্রেত তার কাছে। সেইফ সাইডে থেকে একনাম্বারের সুখভোগ করতে তিনি চান না। আরও বলেন, ইন ট্রু সেন্স নাম্বার ওয়ানের ব্যাপারটা খানিক প্রেসমিডিয়ার এবং বাকি পুরাটাই ইন্ডাস্ট্রিট্রেডের তৈরি-করা মাল বা মামলা। হায়ারার্কির এহেন ভেদবুদ্ধি ইঞ্জেক্ট করে দেয়া হয় অনেকটা চাপানো জোয়ালের মতো প্রোফেশন্যাল ক্যারিয়ার ক্রিয়েটের জন্য। অথচ মাধুরিজি চেয়েছেন চিরকাল অভিনয় করে যেতে, প্রাণভরে অভিনয় করে যেতে একের-পর-এক চ্যালেঞ্জিং রোলগুলোতে, নিজের মুখেই বলেন তিনি। কিন্তু এর ভিতর ন্যাস্টি পজিশন্যাল অঙ্ক কষাকষি শিল্পীর অজান্তে শিল্পীরই চিন্তাচৈতন্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। একপ্রকার কল্পনাবিলাসী ক্যারিয়ারের শীর্ষ গজদন্তসৌধে শিল্পীকে আটকে রেখে দেবার পরিকাঠামোরই নাম ফিল্মইন্ডাস্ট্রি, হোক সেইটা ঢালিউড, বা হলি-বলি-টলি ইত্যাদি নানান বাহারী বনজঙ্গল, সবখানেই চিত্র অলমোস্ট দ্য সেইম।

অভিনয়জীবনে ফ্লপ ছবির সংখ্যা কম নয়, ফিরিস্তি দিলে বেশ লম্বাই ঠেকবে সেই লিস্টি, কিন্তু ফ্লপের চেয়ে হিট তথা সাক্সেসের সংখ্যাই বেশি। নমুনা হিশেবে কয়েকটা ফ্লপ মনে করতে পারলে বোঝা যাবে সেগুলো মাধুরিদোষে ফ্লপ, না মাধুরিস্পর্শে এখনও উহাদের নাম উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন মজমায়; যেমন, ফ্লপসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, —  ‘অবোধ’, ‘উত্তর-দক্ষিণ’, ‘হিফাজত’, ‘দয়াবান’, ‘আওয়ারা বাপ’, ‘মোহরি’, ‘ইলাকা’, ‘মুজরিম’, ‘কানুন আপ্না আপ্না’, ‘জীবন এক সংঘর্ষ’, ‘সয়লাব’, ‘জামাই রাজা’, ‘প্যায়ার কা দেবতা’, ‘খিলাপ’, ‘প্রহার’, ‘জিন্দেগি এক জুয়া’, ‘খেল্’, ‘সাহিবাঁ’, ‘দিল্ তেরা আশিকি’, ‘আঁসু বনে অঙ্গারে’, ‘আঞ্জাম’ ইত্যাদি আরও অনেক ম্যুভি আছে যেগুলো মাধুরিজির ভালো অ্যাপিয়ার সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়েছে ব্যবসা করতে যেয়ে। এদিকে ফের হিট/স্যুপারহিটের সংখ্যাও অঙ্গুলিমেয় নয়। মধ্য-নব্বই পর্যন্ত কয়েকটা নামের উল্লেখ থুয়ে রাখা যাক আপাতত। যথা —  ‘দিল্’, ‘সাজন্’, ‘বেটা’, ‘খলনায়ক’, ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’, ‘রাজা’ প্রভৃতি। এরপরেও অনেকানেক, যেমন ‘দিল্ তো পাগাল হ্যায়’, ‘ইয়ারানা’, ‘মৃত্যুদান্ড’, ‘দেব্দাস্’ প্রভৃতি।

৯.
ঠিক যেইটেকে আমরা বলি নেক-টু-নেক ফাইট, জুহিজির সঙ্গে মাধুরিজিকে অন্তত শুরুর বছরগুলোতে তা-ই করতে দেখেছি সিনেমার পর সিনেমা পাশাপাশি রিলিজিং সিন্যারিয়ো অনুযায়ী। কিন্তু মাধুরিজি এগিয়ে ছিলেন অভিনয়বৈচিত্র্যে, নৃত্যে এবং গ্ল্যামার তথা লাস্যে তো বটেই। বিউটি-অ্যাস্থেটিক্স অনুসারে জুহিজি সীমাবদ্ধ, অভিনয়প্রকরণ অনুসারে তিনি টাইপ্ড, উচ্ছলতা আর প্রাণখোলা তারুণ্যের বাইরে বিষাদমন্দ্র জৈবনিক অভিব্যক্তির প্রকাশনৈপুণ্য জুহিজিতে নেই। ফিমেল বিউটির প্রধান যে-তিনটা ডাইমেনশন, যথা — আবেদন, সম্মোহন এবং মাধুর্য, তিনটা মাত্রার প্রত্যেকটা মাধুরিজিতে বিরাজমান পূর্ণত। বলা বাহুল্য, মাত্রাগুলো প্রয়োগেও সমানুপাতিকতা রাখতে পেরেছেন তিনি, ক্ষেত্রবিশেষে ঊনিশ-বিশ ইগ্নোর করে এই বিবৃতিটা আপাতত প্রকাশ রেখে এগোনো যাক।

ওই সময়টায়, মাধুরি-জুহি দ্বৈরথঋদ্ধ নব্বইয়ের শুরু থেকে প্রাক-মধ্যপাদ পর্যন্ত, আমরা অনেকেই ভাবতাম যে জুহিজি রিগেইন করবেন তার মোন্যার্ক স্যমডে স্যুন্। জুহিজির দিকে এই সিম্প্যাথি ছিল অটুট আমাদের অনেকদিন; ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল এই কারণে যে, এই সিম্প্যাথির ভিতর দিয়া আমরা আসলে আমাদের টিন্যাইজটাকেই ট্রিবিউট জানাতাম, আস্থা রাখতে চাইতাম আমাদের বয়ঃসন্ধিনীল সময়টার ওপর, আমাদের চিরতারুণ্যঝলমল বয়সের পর্বটাকে যেতে নাহি দিতে চাওয়ার অভিলাষ কাজ করত হয়তো-বা আড়ালে এই সিম্প্যাথির; কিউএসকিউটি, কেয়ামাত স্যে কেয়ামাত তক, আমাদের লাইফে একটা ব্যাপার ছিল তো বটেই, ছিল গোটা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতিগণ্য মধ্যবয়সের আধিপত্য খর্ব করার ফার্স্ট স্টোন-ল্যায়িং। ক্রমে সেই নিশান, উঠতি বয়সের সিনেমাকাহিনির জয়ধ্বজা, এতই বিস্তারী হয়ে উঠল যে এর তলায় চাপা পড়ে এখন অন্য সবকিছুই বিলয়ের দুয়ারে যেয়ে ঠেকেছে। এর কুফলে সবচেয়ে বেশি লস্ হয়েছে চাইল্ডহুডের। এখন চোদ্দ-পেরোনো পুৎলাবাচ্চা মেয়েটা নায়িকার রোল করে, এবং দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহ ভরে দেখে সেই শিশুনায়িকার পুংভোলানো পূর্ণদেহা নারীচিহ্ন ও অন্যান্য নখরামো, ‘সত্যমেব জয়তে’ টেলিভিশনানুষ্ঠানে মাদার ইন্ডিয়ার শিশুকন্যাপীড়ন দেখি আমরা আর মানবোন্নয়ন নীতি নিয়া কপ্চাই। কিন্তু ওসব কথা আলাদা, থাক এখন, বাদে এ-বাবতে দেখা যাবে একটা আলাপালোচনার ব্যবস্থা করা যায় কি না। মাধুরিজিতে প্রত্যাবর্তন করি।

কিন্তু জুহিজিকে ছেড়ে মাধুরিজির কথা পাড়া না-মুনকিন। ওই সময়টায় আমরা ভাবতাম যে ম্যাচিয়োরিটি এসে যাবে জুহিজির মধ্যে অচিরে এবং তখন মাধুরিজিকে টেক্কা দেখায়ে দান নিয়া যাবেন জুহিজিই এন্ড-অফ-দি-ডে। সেই সীমাসময় পেরিয়েছে যেহেতু, খোলাখুলি কথাগুলো বলেই ফেলা যায় এখন। জুহিজির সবচেয়ে বড় বাধাটাই ছিল উনার ইনোস্যান্ট ফেইশিয়্যাল আউটল্যুক, উনার পুতুলমুখ, উনার ডিজনি ক্যারিক্যাচার, উনার কৈশোরক চাপল্য ও সারল্য, সর্বোপরি উনার মধ্যে শরীরী জেশ্চারের অ্যাবসেন্স। কাজেই বাধা ছিল তো অনেক, জুহিজির, মনে করা গিয়েছিল ক্রমে সেসব অন্তরায় কেটে যাবে। কিন্তু অবাক ব্যপার, সর্বশেষ ‘গোলাবি গ্যাং’ ম্যুভিতে জুহিজি-মাধুরিজি যুগলবন্দি দেখার মকসুদ পুরা হলো আমাদের এবং সেখানেও জুহিজি এই এতগুলো দশক বাদেও অপরিবর্তিত অমলিন, আশ্চর্য অমল-ধবল শারদীয়া রাইকিশোরী! উনার মধ্যে মায়া আছে, চিরকাল যা ছিল ও আছে সেই স্নিগ্ধশ্রী শরৎপ্রভা, যা নাই তার নাম স্বেদে-ও-মেদে নারীমাদকতা। মাধুরিজির মধ্যে এই জিনিশটা আছে ব্যাপক। এই মাদকতা। নারীর মেদুর মত্ততা। আর, এমনকি, শরীরী সুড়সুড়ি ব্যাপারটাও ধর্তব্য এক্ষেত্রে; লক্ষ করা যাবে যে মাধুরিকীর্তিত সুড়সুড়ি ঠিক জিনাত আমানের সুড়সুড়ি না, বা আজকের মল্লিকা শ্যারাওয়াৎ প্রমুখের সুড়সুড়ির সঙ্গে মাধুরিবিতরিত সুড়সুড়ির সুস্পষ্ট ফারাক অগোচরে থাকে না আমাদের। মাধুরিজি ইজ্ অ্যান অ্যাক্ট অফ দ্য স্যুপ্রিম এ-কারণেও যে তিনি ফিজিক্যাল ইনক্লাইনেশনটাকেও একটা এলিগ্যান্স দিয়েছেন দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে।

এত অপরূপায়িত ভুবনমোহন হাসি সত্ত্বেও মাধুরিজির সামগ্রিক সৌন্দর্য উপত্যকার সঙ্গেই তুলনীয়; গভীর, এবং স্তব্ধ। ‘নীরবতা-গভীরতা দুইবোন বলে কথা’ — আবদুল মান্নান সৈয়দের একটা কবিতাবইয়ের নাম; বইয়ের নামকবিতাটা আঙ্গিকের দিক থেকে স্যনেট, সেখানকার ষটকের পঙক্তিগুলো পুনরুচ্চারণ করা যাক মাধুরিজির অনারে এইখানে — “নীরবতা গভীরতা দুইবোন বলে কথা / সমস্ত দীনতা নিয়ে মাটির পৃথিবী ডুবে যায় / হাড়-হিম মাঘ থেকে গরমের ঋতুর পর্যায় / কখন নিঃশব্দে ঘোরে; খসে পড়ে বাক্যের তুচ্ছতা / কোলাহল খুঁড়ে চলে নীরবের গভীর ইঁদারা / সাঁঝের আকাশে ফোটে একে একে লক্ষ কোটি তারা।” মাধুরিজির নারী পোর্ট্রেইটের কাছে এইখানেই জুহিজির হার। জুহিজি নিরন্তর ঝর্ণাসাবলীল, টিন্যাইজ অ্যাডোর‍্যাবল স্যেনোরিতা, অ্যাডমায়ারও কম করি না আমরা তারে সেই কারণে। ‘ম্যে কোই অ্যায়সা গিত গাউঁ / ক্যে আরজু জাগাউঁ / আগার তুম কাহো’ — এই গানের সঙ্গে জুহিজির মিষ্টি নৃত্যনাট্য স্মরণ করে দেখুন, এই নৃত্যনাট্যিক কমিক ভিশ্যুয়্যালাইজেশনই জুহিজির হ্যলমার্ক হয়ে আগাগোড়া থেকে যায়। এবং মাধুরিজি নীরবতা-গভীরতা আর অতলান্তিক রহস্যময়তা মিলিয়ে ক্রমে হয়ে ওঠেন মাদম্যোয়্যাজ্যেল। ফ্লপেও যেমন, হিটেও তেমন, অনস্বীকার্য মোহস্বপ্নচারিণী।

ইয়াদ হবে অনেকেরই যে, যেই বছরটায় ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন্’ দিয়া মাধুরিজি পিক্ ক্লাইম্ব করেন, নাম্বার ওয়ান অ্যাক্যোয়ার করেন, সেই বছরেই সম্ভবত জুহিজি ‘ডর’ দিয়ে নেক্সট টু মাধুরি সিটটা দখলে রাখতে সক্ষম থাকেন। লড়াই তখন এই দুইজনের মধ্যেই ছিল, তা না, শীর্ষারোহণের অভিযাত্রাটায় সে-সময়ে এসে গেছেন একদঙ্গল মারদাঙ্গা মডেল-ল্যুক গ্রুমড নায়িকার পাশাপাশি কাজল আর রানির ন্যায় অ্যাক্ট্রেস্, এসে গেছেন দ্য ব্রেথটেইকিং বডিলি অ্যারোম্যার সুস্মিতা সেনের পাশাপাশি পরবর্তীকালে আমি না-চাইলেও যিনি বলিউডক্যুইন হবেন সেই রাইবচ্চন তথা ঐশ্বর্যা বা ঐশ্বরিয়া। আরেক গল্প সেইটা, বাংলা আর বেঙ্গালুরুর দ্বৈরথ, আপাতত অপ্রাসঙ্গিক।

১০.
অন্যান্য অঞ্চলের খবর জানি না, কিন্তু বাংলা আচার-ব্যবহারের অঞ্চলে আমাদের বাপ-চাচাদের আমল থেকে বেদনামাধুরীকীর্ণ স্বপ্নচারিণীর আইকন একদিকে মধুবালাজি আর অন্যদিকে সুচিত্রাজি। কিন্তু কথাটা জেনের‍্যালাইজড হয়ে গেল, অবভিয়াস্লি, তবে জেনের‍্যালাইজেশন ব্যতিরেকে এগোনোও তো মুশকিল। অতএব কথাটা মানিয়া আগানো যাউক। সহজ তুলনায় সেহেতু মধুবালা-সুচিত্রা পার্ফেক্ট ব্লেন্ডেড শ্যাম্পেইনের টেইস্ট হয়তো-বা মাধুরিজিতে পেয়েছে বংশানুক্রমিক বাঙালি। সেইসঙ্গে আরও অনুষঙ্গ সম্বলিত ককটেইল্। কত্থক সেক্ষেত্রে একটামাত্র অনুপান, স্ট্রং নিঃসন্দেহে, প্রধান বা একমাত্র তো নয় নিশ্চয়।

তবে এইটা ঠিক, মাধুরিজির ব্র্যান্ডিং হয়েছে অ্যাক্টিং যতটা-না তারচেয়ে বেশি গানের জন্যে। দ্যাট ডাজন্’ট্ মিন্ মাধুরিজি অভিনয়ক্ষীণ ম্যুভির কারবার করে গেছেন; না, নিশ্চয় সেইটা ভাববেন না পাগলেও। কথা হচ্ছে যে হিন্দি বিজন্যাস্-অরিয়েন্টেড ম্যুভিতে অভিনয়ের সুযোগ কই, এক্সেপ্ট অনলি মেলোড্রামা? নায়কনির্ভর হিম্যানশিপ্ আর মাচো ইমেজের দুই/আড়াইঘণ্টার ফরম্যুলা ছায়াচিত্রাবলিতে নারীর জায়গা নাচাগানা ছাড়া প্রায়শ অতীব অপরিসর ও কোণঠাসা। মাধুরিজিকে এরই মধ্যে মেধাবুদ্ধি খাটিয়ে বের করে নিতে হয়েছে একটা রাস্তা আপনকার মহাকালগ্যালাক্সির।

মাধুরিজি নিজেও গোটা ব্যাপারটা জানতেন বিলক্ষণ। সম্ভবত ১৯৯৬/৯৭ দিককার ঘটনা; সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টাই কিছুটা বলে নিয়েছিলেন মাধুরিজি একটা চান্সে। এমনিতে এদেশে-ওদেশে সর্বত্র শোবিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকেদের ইন্টার্ভিয়্যু লইতে যেয়ে লেনেওয়ালারা তাচ্ছিল্যের একটা ভাবে থাকেন, অপগণ্ড সংবাদকর্মীদেরেই মোস্টলি ইন্টার্ভিয়্যু লইতে পাঠানো হয় দেখতে পাই আজও, বিনোদন বিটে র‍্যায়ার্লি ইন্টেলিজেন্ট জার্নালিস্ট রিক্র্যুটেড হইতে দেখা যায়। মিউজিশিয়্যান আর অভিনয়শিল্পীদের প্রশ্ন করার ধরন থেকে এতদঞ্চলের বিদ্বানদের সম্পর্কে একটা আন্দাজ করে নেয়া যায় নিশ্চয়। এর ফলে এদেশের মিউজিক আর ম্যুভিশিল্পের আঁতের খবর আঁতুড় থেকে বেরোনোর মওকা আজও পেলো না। খালি এদেশেই বলি কেন, খোদ হলিউডের চিত্রও তথৈবচ, তবে এক্ষেত্রে অ্যামেরিক্যান-ব্রিটিশরা ক্রমে উন্নয়নশীল বলা যেতে পারে। মেরেলিন ম্যুনরোর সঙ্গে সেদেশের সংবাদপত্রগুলোর সাক্ষাৎকার পরিগ্রহণের ধরন ও ভাবভঙ্গি থেকে যে-কেউ শিউরে উঠবেন যে কী বিদারক পীড়ন করেছে এরা একজন ম্যুভিকর্মী শিল্পীকে এবং কী বীভৎসভাবে মেরেলিনকে এই নিউজপেপারকর্মীরা আন্ডার‍্যাস্টিমেইট করে গেছে! মেরেলিনও সরেস কম না, কাউয়াদের সঙ্গে কাউয়াচার করেই গিয়েছেন, দেড়আংলাদের অঙ্গুলিকীর্তনে একেকটা বাঁশ যুগিয়েছেন মন্তব্যের পর মন্তব্যে। অ্যানিওয়ে। মেরেলিন নয়, এখানে মাধুরিজির ওপর আমাদের স্পটলাইট।

বলছিলাম মাধুরিজির নাইন্টিসিক্স/সেভেনের একটা সাক্ষাৎকার বিষয়ে। সেখানে তিনি ক্লিয়ার বলছেন, নার্গিস-মধুবালা-মীনাকুমারীদের অভিনয়জীবৎকালীন ইন্ডাস্ট্রি ছিল আজকেরই ন্যায় নায়কনির্ভর; তবে এখনকার মতো উদ্ভট কায়দার পুংপেশীর ঢিসুম-ঢিসুম তখন ছিল না। গানম্যানের স্টান্টবাজি ছিল না। ছায়াছবি ছিল তখন অনেক বেশি নিটোল গল্পযৌক্তিক, সেখানে পরিবার ছিল, লোকালয় এবং লোকজন ছিল। ফলে সেইসব কাহিনির কুশীলবদিগের করার মতো অনেককিছুই তখন থাকত। নায়কের যেমন অনেককিছুই হিউম্যাইন করাকরি ছিল, নায়িকারও প্রোপোর্শোনেইটলি। কিন্তু অধুনা নায়িকারা কাহিনিচিত্রে এমনভাবেই ডেপিক্টেড যে বেচারিরা নেচে-গেয়ে আর পুকুরে-স্যুইমিংপুলে-বাথরুমে নেয়ে ঘেমে সেক্স দেখিয়ে কুল পায় না। কাজেই এহেন যৌনস্রোতের আবিলতায় ভেসে-থাকা বাণিজ্যম্যুভির বাজারে এর থেকে নিজেরে মুক্ত সন্ত রাখা আদৌ সম্ভব নয়। তিন-চারটে এক্সপেরিমেন্ট পর্যন্ত সম্ভব, এর বেশি নয়, ক্যারিয়ার হিশেবে এইটেকে নিতে চাইলে এর আঁচ পেতেই হবে। … এই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। ওইসময়কার শারদীয় আনন্দলোক বা এই-রকম কোনো পত্রিকায় দেখেছিলাম। ওইখানেই খেদের সঙ্গে মাধুরিজিকে বলতে শুনেছি নিজের অভিনয়ক্ষিধে নিয়ে। বলেছিলেন, সত্যিকারের অভিনয় না-করে স্রেফ সময়টা নাম্বার ওয়ানের দৌড়ঝাঁপানিতেই কেটে গেল। যথার্থ অভিনেত্রী হবার বাসনা ছেড়ে নিজের গোর নিজেই খুদেছেন, এই-রকম আক্ষেপও করেছেন এবং বলেছেন তিনি সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। হয়তো সুযোগ মিলবে, দেড়-ইশকিয়া ইত্যাদি ম্যুভির পর এই বিশ্বাস বলীয়ান হয় বৈকি, অমিতাভজি যেমন পরিণত বয়সে এসে সত্যিকারের অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন তেমনি মাধুরিজিও পাবেন আশা রাখা যায়, এখন অনেক বেশি মাল্টিলিনিয়্যার ম্যুভি নির্মাণের স্কোপ, ক্লায়েন্টেলও এখন আগের চেয়ে প্রিপেয়ার্ড এবং ম্যাচিয়োর্ড।

হ্যাঁ, মাধুরিজির ব্র্যান্ডিং হয়েছে গান দিয়েই মুখ্যত। চলচ্চিত্রে, এতদঞ্চলের চলচ্চিত্রে, গানের বহুল ব্যবহার নতুন নয়। ইন-ফ্যাক্ট ম্যাসালাম্যুভির গানেই চিরদিন প্রাণের একাংশ। তবে সেই গানেরও দশকে দশকে ধরন-ধারন ঠাটঠমকগত বিবর্তন হয়েছে, বিপ্লব-উপপ্লবও হয়েছে ঢের। আর মাধুরিজির ক্ষেত্রে এইটা আলাদাভাবেই উল্লেখ্য। গোটা সিনেমা ছাপিয়ে-ওঠা মাধুরিজির একেকটা গানের সিক্যুয়েন্স। কোরিয়োগ্র্যাফি। এবং অবধারিতভাবে ড্যান্স। গোটা ক্যারিয়ারে একগাদা মেগাহিটের পাশাপাশি মাধুরিজির ফ্লপও গুচ্ছগাদার। ইন্ট্রেস্টিং হচ্ছে যে এইসব ফ্লপের প্রত্যেকটাতেই একটা-না-একটা গান রয়েছে যেখানে মাধুরিম্যাজিকে সেই ফ্লপগুলোও স্মরণার্হ। সত্যিই তাই, বিস্মৃত হই নাই আমরা, স্মরণ করাও হয়ে থাকে সর্বত্র। উদাহরণ চাই?

১১.
লিপ্সিং এবং ফেশিয়্যাল এক্সপ্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অত্র অঞ্চলের চলচ্চিত্রিক জগতে একটা আসন যদি পেতে চান আপনি নায়ক বা নায়িকা হিশেবে; — প্লেব্যাকের সঙ্গে লিপ্সিং, বিশেষভাবেই; সিক্যুয়েনশিয়্যাল অন্যান্য স্লটে বাচনিক অভিনয়ের ব্যাপারটা ডাবিংকালীন দুইয়ে-দুইয়ে চার বা পাঁচ করে নেয়া যায় বা সেই সুযোগটুকুন অন্তত পাওয়া যায়; কিন্তু গানচিত্রায়নের সময় টেক শেষে এডিটিং প্যানেলে এসে ডাবিং দিয়া অন-দ্য-স্পট যদি কিছু লোকসান হয়ে যেয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মেকআপের বিন্দুমাত্র সুযোগ বেচারা পার্ফোর্মার পাচ্ছেন না; কাজেই মিউজিক্যাল অ্যাক্টগুলোতে চ্যালেঞ্জ অনেক ব্যাপক। বলিউডি সিনেমায় প্লেব্যাক থাকে এক্কেরে কমের পক্ষে সাতটা; আর সিনেমাভাগ্য অনেকটা গানের চিত্রায়নের উপরেই নির্ভর করে। নায়িকাদের উপরেই বিষয়টা যায় শেষমেশ। মাধুরিজি গোড়া থেকেই জিনিশটা আয়ত্ত করেছেন দর্শনীয় নৈপুণ্যের সঙ্গে; এক্ষেত্রে তিনি বিস্তর প্রসাধিত প্রমীলা নায়িকাদের মধ্যে ন্যাচার‍্যাল। এই ন্যাচার‍্যালিটির মধ্যেই তিনি আর-দশের চেয়ে আলাদা।

গ্ল্যামার ক্যুইন তিনি, কিন্তু রূপের জেল্লায় আর নায়িকাসুলভ আদেখলাপনা-আহ্লাদি দিয়া আমাদের চোখ কুঁচকায়ে দেন না। মাধুরিজির আলাদাত্ব ওইটুকু স্বভাবানুকুল্যতা দিয়া জাজ করা যায়। ড্যান্স ও অন্যান্য অভিনয়মুদ্রা বাঙময় করার ক্ষেত্রে তিনিও ভাল্গার জেশ্চার করেন, ইরোটিক ইশারাইঙ্গিতে তিনিও লক্ষ্যভেদী অঙ্গরাগের আশ্রয় নেন বৈকি, শুধু ওইটুকুতেই নিঃশেষ হলে স্রেফ খেলার প্রতিভা হিশেবেই উনারে নেয়া যেত। অথচ ঘটনা তা না। মাধুরিজি খেলতে জানেন, খেলেনও, তবে খেলুড়ে ট্যাগিং উনার জন্য বরাদ্দ রাখা যায় না হাজার ইরোটিকার পরেও। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অঙ্গাতিরিক্ত অন্যান্য রহস্যানুষঙ্গের কারণে গ্ল্যামার ক্যুইন হয়েও উনি সেক্সসিগ্নিফায়ার নন।

শব্দটা মাদকতা, মাধুরিজিতে যা আসলেই বিরাজে, শারীরিক ও হার্দ্যিক উভয়ত। অঙ্গসঞ্চালনে, সেন্স্যুয়্যালিটি চিত্রিতকরণে, ড্যান্সে এবং অন্যান্য অ্যাক্টিং রিলেইটেড পার্টগুলোতে উনার অ্যাপিল লাজোয়াব। অলমোস্ট ডিভাইন। অলমোস্ট ইনফার্নাল। উদাহরণ? ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’-এর ঘরোয়া মাদক রাখুন একদিকে, ফের ‘খলনায়ক’-এর চোলিপিছের আগ্নেয় ড্রাগ আরেকদিকে; দেব্দাসের সুরা আর শরবৎ কোনদিকে রাখবেন তাহলে? কিংবা গজগামিনীর গজবনেশা? আর বাকি বিস্তৃতাংশ?

কমপ্লিট অ্যাক্ট্রেস্, প্রিসায়েস্লি, নিখুঁত প্রায় এবং মাপা। ঘাটতিবিহীন বললেই চলে। এমন না যে বেচারি বিরাট রূপবল্লরীর আধিকারিক; বরঞ্চ উনার রাজপাটে দেহে ও দংশনে ঢের ঢের শক্তিশালিনী ছিলেন অন্তত ডোজেনখানেক, নাম নিচ্ছি না আপাতত, মাধুরি কিন্তু দুইজন নাই। দ্বিতীয় অমিতাভ নাই যেমন। অমিতাভানুকারী ছিলেন এবং আছেন আজও অনেক অনেক এই অ্যাংরি-ইয়াংম্যান ফর্ম্যুলা ম্যাসালার ম্যুভিপ্রিমাইসে। তেমনি, বললে বেশি হয় না বরং কমই হয়, মাধুরিবিম্বিত অসংখ্য নায়িকা আমরা নামে-বেনামে দেখেছি ইন্ডাস্ট্রিতে; এখনও যত হিরোয়িন গদিনসিন, ব্যতিক্রম বাদে মশল্লাটা মাধুরিরই।

ইন শর্ট, সব হিসাবকিতাব শেষে একটা আঙ্গিক সারল্যভরা রাহসিকতা। মাধুরিজি, ইন অ্যাব্রিজড ভার্শন, ইট্যারন্যাল্ বিউটি। স্নিগ্ধ শরীরী সৌন্দর্য ও সমুদ্র-সফেন অবলীলাধারা। মাধুরিজির এক্সপ্রেশনগত স্মুথ ডেলিভ্যারি এবং অন-ক্যামেরা তার ন্যাচার‍্যাল পজিশন এক-কথায় আনপ্যারাল্যাল। অ্যা ট্রিম্যেন্ডাস্ ড্যান্সার। ফোটোজিনিক ফেস্। প্রসাধনসজ্জাসাজছাড়া ম্যাগ্নেটিক অ্যাট্রাকশনের আকরিক। সবকিছু মিলিয়েই স্ক্রিন পার্সোনালিটি। কেয়ার্লেস্ বিউটি হিশেবে সাজুগুজু বলিউডে, ফিজিক্যাল আর্টিফিশিয়্যাল ইমপ্ল্যান্টের এই বিন্দাস্ সময়ে, মাধুরিজি আবহমান অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

১২.
তিনি ভিন্না, ন্যাচার‍্যাল এবং অরগ্যানিক বিউটির অধিকারী, মাধুরিজির মধ্যে এক্সট্রা এবং এক্সেস্ কিছুরই বাড়াবাড়ি নাই। তিনি স্বতন্তরা। পার্ল-গ্লিটারিং স্মাইল। দ্যুতি ঠিকরাতে যেয়ে একগাদা রাসায়নিক দ্রব্যগুণের আশ্রয় নিতে দেখি নাই তারে আমরা। মাধুরিজি বিনে-প্রসাধনে টেরিফিক, অথবা আলতো প্রসাধিতা আগুন-পানির মায়াবী উপাখ্যান তিনি। বিশেষ কারণ ব্যতিরেকে উগ্র সাজে দেখা যায় নাই কখনো, উদ্ভট সজ্জা তো একেবারেই না, উদ্ধত ভঙ্গিমা ও উগ্রতা মাধুরিজিকে স্যুট করে না সেভাবে। এবং এই ব্যাপারে স্যেনোরিতা আগাগোড়াই ছিলেন সচেতন। ফলে রাভিনা ট্যান্ডন ধাঁচের চুরট-রুক্ষ অ্যাপিলে অ্যাল্যুর করার নেসেসিটি ছিল না তার তরফ থেকে।

মেট্যালিক ল্যুকের একঝাঁক র‍্যাম্পমডেলমার্কা নায়িকার উদ্বোধন ও অভিষেক হয়ে গিয়েছে সাড়ম্বরে জাঁকের সঙ্গে সেই-সময়টায়; মাধুরিজি তখন সদ্য তখতে উপবেশন করেছেন। অস্বাভাবিক হতো না মাথা বিগড়ানো; হয় নাই। সিম্পটমটা গ্রেইটদের ক্ষেত্রেই দেখা পাবার সম্ভাবনা থাকে যে তারা আপন সিগ্নেচার সম্পর্কে কনফিডেন্ট থাকেন। সমান মনোযোগে তারা নিজেদেরে ফ্যাশনদুরস্ত করার চেয়ে র‍্যাদার স্বকীয় স্টাইল গড়ার দিকেই নিবিষ্ট থাকেন। বলিউডে র‍্যাম্পমডেলিং হাওয়ার তোড় মাধুরিপিরিয়ড থেকে শুরু হয়ে এখনও চলছে বলা যেতে পারে। সেক্সহন্টেড ক্রেইজি ইম্প্রোভাইজেশনের প্রেজেন্স, হাস্কি অ্যান্ড স্পোর্টি ইমেইজ, ওয়েস্টার্ন ওয়াইল্ড উইন্ড শুরু হয়েছিল নব্বই-মাঝামাঝি এবং অব্যাহত চলছে। চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে ফ্যাশন বদলাচ্ছেন ক্যুইনেরা বারবার, স্টাইল গড়তে ব্যর্থ হচ্ছেন, যারা খানিকটা পেরেও ক্ষান্তি দিয়েছেন তাদের মধ্যে কাজল-রানি বিশেষভাবে উল্লেখের হকদার।

জেন-ওয়াই হিরোয়িনেরা তো বক্স-অফিসের পলিসি ও গাইডম্যাপ সামনে রেখে ক্যারিয়ার গড়ছেন। কিয়দ্দুর যেয়েই ফলে ট্যালেন্টেড ফিমেল আর্টিস্টরা প্যাভিলিয়্যনে ফেরত আসছেন। তদ্দিনে একতোড়া বাণিজ্যসাফল্য পেয়ে বেশ মোটা অঙ্ক মুঠো ভরে নিয়ে ব্যবসা পাল্টে ফেলছেন; প্রযোজনা নামাতে লগ্নি বিনিয়োগ করছেন, রেস্টোর‍্যান্ট খুলছেন বা ডিস্কোথেক, জমি লিজ্ নিয়া সাগরতীরে রিসোর্ট আর ক্রিকেটগ্যাম্বলিঙে ইনভেস্ট করে ভেঞ্চার খুলছেন মানিমেইকিং। ফলে হেমা মালিনির রেকর্ডদীর্ঘ নাম্বার ওয়ান আসন মাধুরিজির হাতে এসে এত লম্বা টাইম থেকে যায়। এরপর যারাই এসেছেন, সুস্থায়ী বিশেষ কেউই হতে পেরেছেন বলা যাবে না, স্টে বেশিদিন করেন নাই, ইনক্লুডিং কাজল এবং অ্যাশ্। মাধুরিজি ডিভোটেড থেকেছেন, টিল্ টুডে, অভিনয়ে। ফলে স্টাইল দ্য উওম্যান মাধুরিজি স্টিল্ ইনফ্লুয়েন্সিং। নিজের একটা দাগ রেখেছেন ফর‍্যাভার, নিজের ঘরানা, নিজের ম্যানারিজম। এখনকার লম্বা লম্বা হাতপায়ের মডেলল্যুক স্মোকি ট্রেন্ডসেটে মাধুরিজির ন্যায় স্টাইল-প্রোডিউসিং ম্যানার্স অনুসরণ করার শ্রমসাধ্য পথে না-যেয়ে চটজলদি বোল্ডসিন্ করার দিকে এম্ফ্যাসিস্ অভিনয়শিল্পী বিশেষভাবেই নায়িকাদিগের।

ন্যাচার‍্যাল ল্যুকের স্টেপকাটেই মাধুরিজি চিরসময় মাতোয়ারা রেখেছেন। ন্যাচার‍্যাল মেকআপ। স্টেপকাট হেয়ারস্টাইলে ফ্যাশনদিভ্যা মাধুরিজি ডিভ্যাস্ট্যাইটিংলি বিউটিপ্রিন্সেস্। পর্দাব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এইগুলো একেবারেই বাইরেকার গুণমাপক বিশেষণ হলেও অগুরুত্ববহ নয়। যেমন অগুরুত্ববহ নয় মাধুরিজির কস্ট্যুমস্টাইল। ‘বেটা’ ছায়াছবির ‘ধক্ ধক্ করনে লাগা’ গানে ব্যবহৃত কমলা কালারের শাড়িটার কথাই ধরা যাক। অত্যন্ত লাউড হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও লাউড হয় নাই; উপরন্তু পরবর্তী সিনেমারাজ্যে বিশেষ তেজসঞ্চারের গরজে নায়িকাদের কমন পরিধেয় অরেঞ্জ ড্রেসের পত্তনি দেখতে পাই আমরা; বাংলাদেশের মৌসুমী-পপি-শাবনুরের ম্যুভিতেও পরিচালকেরা কমলানৃত্যের ঠমক চালু করেন মাধুরিবিকিরণ ছড়াইবার মানসে। ফের মনে করা যাক মাধুরিজির ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’-এর গ্রিন অ্যান্ড হোয়াইট স্যাটিন সিল্কের লেহেঙ্গা আর চোলি, পিঠমুক্তা ব্লাউজ; ব্যাকলেস্ অ্যান্ড র‍্যাকলেস্ বিউটির রোশনাই ফিদা মকবুল হুসেনের চোখেই ঝিলমিল লাগিয়েছিল তা তো নয়, তামাম জাহানেই ঝিরিঝিরি স্প্রিং বইয়েছিল ওই পিঠতীর্থের প্রসাদ। পরে ফের গজগামিনীতে এই পিঠতীর্থদর্শন অধিকতর পুণ্যিসঞ্চারক ও প্রান্তরবিস্তৃত হয়েছিল খোদ হুসেনসাহাবের পেইন্টিংক্যামেরায়। এর কাছে অ্যাশের পরবর্তীকালিক ‘চোখের বালি’ বিতরিত ঋতুপর্ণব্যবস্থাপিত দধিপিঠের পরিবেশনাও নস্যি। কিন্তু চোখস্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ উন্নত হয়েছিল অনস্বীকার্য অ্যাশের স্ক্রিনজোড়া মাখনের মোলায়েম আভা। আর শুধু শাড়ি-লেহেঙ্গা না, ওয়েস্টার্ন আউটফিটেও মাধুরিজির সেন্স অফ কস্ট্যুম ওয়্যারিং লক্ষণীয় বুদ্ধিনন্দনদীপ্ত। ‘রাজা’ ছায়াছবির ‘আঁখিয়া মিলাও’ গানে জ্যাকেট এবং টাইট ট্রাউজার্স স্মরণ করুন একটাবার। প্রভুদেবার সঙ্গে ‘ক্যেই স্যেরা স্যেরা’ গানের সেই বিস্ময়কর ড্যান্সে মাধুরিজির কস্ট্যুম অ্যাক্সেস্যরিস্ সিম্পল, স্যুপার্ব, এবং অননুকরণীয় অনন্যসাধারণ। ওয়েস্টার্ন, ইস্টার্ন, রাজপুতানা, বাঙালি, দ্বীপদূরবাসিনী ইত্যাদি বিচিত্র বহু ল্যুকেই মাধুরিজিকে দেখেছে দুনিয়ার লোকে, বেমানান বলবে না কেউই।

বিশেষভাবে এখানে ড্যান্স তথা গানকালীন পরিচ্ছেদাবলির উল্লেখ করা হচ্ছে মাধুরিনন্দনশৈলীর স্মারক হিশেবে দেখাটা ছায়াছবিনিরপেক্ষ সহজ হবে ভেবে। ‘তেজাব’-এর ‘এক দো তিন’ ছাড়াও প্রসঙ্গত মনে পড়বে ‘থানেদার’-এর ‘তাম্মা তাম্মা লোগে’, ‘ত্রিদেব’-এর ‘ওয়ে ওয়ে’, ‘সাজন’-এর ‘তু শায়ের হ্যায়’, ‘খলনায়ক’-এর ‘চোলি কা পিছে ক্যায়া হ্যায়’, ‘ইয়ারানা’-য় ‘মেরা পিয়া ঘর আয়া ও রামজি’ ইত্যাদি গানে মাধুরিজির মনোরঞ্জনী নৃত্য ও পোশাক পরিধান শৃঙ্গারগমক ও শোভাঠমকের স্বাভাবিকতায় নিশিদিন উড্ডীন। বাৎস্যায়ন জিন্দা থাকলে চৌষট্টি কৃৎকৌশল রিভিয়্যু করতেন বলেও মনে করা যায়, মাধুরিজি শাস্ত্রানুবর্তী থেকেও শাস্ত্রোর্ধ্ব, রিরাইট করার কথা ভাববেন নিশ্চয় আধুনিক কলাবিদ্যা ছায়াছবিশিল্পীরা।

১৩.
আজকের যে আইটেম স্যং, আইটেম ড্যান্স, ব্যাপারটার আদি উৎস কি মাধুরিজির যোগসাজশে হয়েছিল? ‘খলনায়ক’ ম্যুভির ‘চোলি কা পিছে ক্যায়া হ্যায়’ দিয়েই কি ইঙ্গিতে এসে গেছিল মহান আইটেম আমল? প্রশ্নের হ্যাঁবাচক উত্তরের সুযোগ সরাসরি মিলছে না, সংগত কারণে, একটু ঘুরিয়ে উত্তর খোঁজা লাগবে। হ্যাঁ, এইটা ঠিক যে, মাধুরিজির ম্যুভিগুলোতে, যেগুলোতে শ্রেষ্ঠাংশে মাধুরিজি বিরাজেন সেইসব সিনেমায়, লক্ষ করে দেখবেন, পাঁচ বা সাতটা গানের আয়োজন থাকলে এর মধ্যে একটা খানিক ভিন্নায়োজনের হয়ে থাকে, একটু গরম ও গতিপ্রমত্তা, জারা হটকে, এর পক্ষে উদাহরণ পাতে তোলা লাগবে না মনে হয়। সেকেলে হেলেন খান বা পারভিন ববিদের ক্যাবারে ড্যান্স যা করত, মাধুরিজির আমলে খোদ নায়িকা নিজেই সেই পার্পাস সার্ভ করতে শুরু করেন। শুধু ক্যাবারে ড্যান্সের বেলা আগে যে ভ্যাম্প ব্যাপারটা থাকত, নতুন সময়ে সেই নিগ্যাটিভিটি তিরোহিত হয়। নায়িকাকে একআধটু সুড়সুড়ি ডিস্ট্রিবিউট করার কাজে লাগানো গেলেও রক্তেমজ্জায় ভ্যাম্প দেখাবার সাহস বা ঝুঁকি মুম্বাই ফিল্মমেকাররা আজও দেখান নাই বটে।

অ্যারাইজ করেছিল যে-প্রশ্নটি, যে, আইটেম গানের আদি উৎসভূমি/উৎসম্যুভি কোনটি, সেইটার উত্তর এখনও মেলেনি। রিসার্চ করা যাক আরেকটু। কয়েকবছর আগের বিবেচনা মাথায় রেখে আইটেম গানের জনক সত্যজিৎ রায় বলিয়া মামলা নিষ্পত্তি করা যেত। না, গোস্তাকি নিয়েন না রায়বাবুর নাম উচ্চারিত হওয়ায়। আপনারা যারা রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ দেখেছেন, তারা সেই দীর্ঘ ভূতগান স্মরণ করুন। ‘ভূতের রাজা দিলো বর / এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর … গুপি বাঘা গুপি বাঘা তোরা বড় ভালো ছেলে’ … এইটেকে আইটেম বলা হচ্ছে সিনেমার মূল ন্যারেটিভের সঙ্গে এই নৃত্যগীতের সরাসরি সম্পর্ক খুব-একটা নাই কিংবা না-থাকলেও চলত বিধায়। অ্যানিওয়ে। এইটা মনে করার কোনো কারণ নাই যে সেই নার্সারি রাইম ধাঁচের ফিউশনধর্মী গানটা, আদ্দিকালের স্পেশ্যাল এফেক্ট সমেত সেই মেশিন-মেইড কোরিয়োগ্র্যাফি, আনন্দনান্দনিকতার বিচারে কিছুমাত্র মন্দ হয়েছিল। তদ্রুপ এখনকার আইটেম নাচাগানা হাজার ধুন্দুমার জগঝম্প সত্ত্বেও মন্দ বলার বা গালমন্দ করার কিছু নাই। এইগুলো ট্রেন্ড, চিরস্থায়ী কিছু নয়, আসবে এবং চলেও যাবে। আবার অভাবিত অন্য ট্রেন্ড আসবে। অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন।

‘ক্যোম্প্যানি’ সিনেমা দিয়েই কি আজকের আইটেমের স্বনামযাত্রার সূত্রপাত? যদ্দুর স্মৃতি ও ইতিহাস যায়, তাতে তা-ই মনে হয় ট্রু। ম্যুভিটা রামগোপাল ভার্মার। ভালো স্ক্রিপ্ট এবং ডিরেকশনও মুম্বাই অ্যাভারেজের পাল্লায় রামজির বরাবরই আলাদা এবং চোখেও পড়ত তখন আলাদা করে। সেইখানে এই ইতিহাসকম্পী দৃশ্যের জন্ম হয়, যাকে অচিরে আইটেম নামে ডেকে ওঠা হবে, এবং যার জন্য গোটা ম্যুভির প্রায় ইক্যুয়্যাল অ্যামাউন্টের বাজেট বরাদ্দ করতেও অগ্রবর্তী ডিরেক্টরের সংখ্যা বাড়বে হু হু করে। শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন অজয় দেবগন, মানিশা কৈরালা, বিবেক ওবেরয় এবং অন্তরা মালি। কিন্তু বোম্বিং হয় ঈশা কোপিকরের গর্জমান গনগনে লেলিহান গোলা থেকে। কে এই ঈশা, যার নাম নাই শ্রেষ্ঠাংশে কিন্তু বোম্বিংটা তারই অবদান? উনি আইটেমগার্ল। পরবর্তীকালে উনাকে আপনি চিনেছেন এবং উনার বংশপরম্পরা। মালাইকা অরোরা খান, মল্লিকা শ্যারাওয়াৎ, শমিতা শেঠি, সেলিনা জেটলি, কোয়েনা মিত্র, লারা দত্ত, নেহা ধুপিয়া, রাখি সাওয়ান্ত, ইয়ানা গুপ্তা, অমৃতা অরোরা, নিশা কোঠারি, নিগার খান, সমিরা রেড্ডি, মেঘ্না নাইড়ু, তনুশ্রী দত্ত, উদিতা গোস্বামী, ঈশা শর্বানী, পেরিজাদ, পায়েল প্রমুখ হুড়মুড় করে একঝাঁক অগ্নিপ্রজ্জ্বলক অবতরণ করেন লোকালয়ে। মায়াবী আগুনে লকলকিয়ে ওঠে মুম্বাই ও অন্যান্য দুনিয়া। ‘শারারা শারারা … ম্যে হু ইক শারারা’ …

‘খাল্লাশ’ গানটার, নাচটার, অভাবিত সাফল্যে রামের শুধু নয় মাথা ঘুরে যায় রামায়ণের সমস্ত কুশীলব এবং গোটা অযোধ্যার। দারুণ সমস্ত সিনেমাকাহিনিতে ব্যবসাঝুঁকি এড়াতে কাহিনির সঙ্গে একেবারেই সংশ্রবহীন আইটেম যোজিত হতে থাকে। এবং ছবি যতই ইতলবিতল অযৌক্তিক হউক, আইটেমের জোরে ব্যবসা ব্যাহত হয় না হারাম কানাকড়িও। উদাহরণে একটা ব্যাপার বোঝা যাবে যে সেই-সময় কি সিনেমার সঙ্গে কিসব আইটেম গিয়েছে; যেমন, ‘দিল্ স্যে’-র ন্যায় একটা ভালো গল্পের সিনেমায় নায়ক শারুখের এন্ট্রি হয় মালাইকার বরাভয় নিয়ে ট্রেনের রুফটপ ‘চল্ ছাইয়া ছাইয়া’ আইটেমমন্ত্রে মোহিত কম্প্রজ্বরে দেশগাও উজালা করে দিয়ে; মালাইকাজির মালপোয়া আর মক্ষীমাতাল অঙ্গ ও অঙ্গারে ভেসে যেতে থাকে পদ্মা-ভাগিরথী-বুড়িগঙ্গা-সুরমা। সে বড় শরীরী দিন ছিল হে! সে বড় অশরীরী দেহহীনা চামেলীর দিন! চিক্নি চামেলী! কিংবা আপনাদের মনে কি পড়ে না ‘জাঙ্গল’ সিনেমায় সেই ‘পাত্লি কোমর’ আইটেমের নিসর্গতোলপাড় প্রাকৃতিক কালো আগুনের বরিষন? এতটাই পাষাণ আপনারা! খাপখোলা বাঁকানো চিকন বিদ্যুৎবহ তরবারিদৃশ্যা  আইটেমশিল্পীটির নাম কাশ্মিরা শাহ, ওরা প্রায়শ ক্ষণবিরাজিতা, অধিকক্ষণ স্টে করেন না। বা, ডায়ানা হেইডেন মনে পড়ে না? তামাম জাহান জটপাকানো ‘ধুম মাচালে’ ভুলিয়া যাইলেন বাহে! কিংবা ‘দাইয়া দাইয়া দাইয়া রে’, এইটা যদিও মহারানী অ্যাশের জওয়ানি-কি-জজবা, একই স্যিনোরিত্যার পিওর মুজরোধর্মী আইটেম ‘বাব্লি ঔর বান্টি’ সিনেমায় সেই ড্রিমরিয়্যাল কোমরবাস্তবতার অতীন্দ্রিয় সঞ্চালন, তদুপরি রিয়্যাললাইফ স্বামী-শশুরজির সঙ্গে! এরপর ওই ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এ আইটেমআর্টিস্ট মুমাইয়েৎ খানের ‘দেখ লে’ ফরগেটেব্যল? অথবা ওই ইয়ানা গুপ্তার ‘বাবুজি জারা ধীরে চলো’ আইটেম নাম্বারখানা? আর ‘শিলা-কি জওয়ানি’ ভুলিলেন ইত্যবসরে? ক্যাট্রিনা কাইফের জেল্লা! হায়! ক্যাম্নে কি তাইলে?

সেকেলে সিনেমায়, যেমন ‘শোলে’ মনে রাখা যাক, ক্যাবারে ধাঁচের গানে একটা কাহিনিগত নৈতিকতা রাখা থাকত পরিচালকের তরফ থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নায়কের বিরহদহনকালে, কিংবা নায়কের জীবনসংহারী দৃশ্যে, নায়িকা লখিন্দর বাঁচানো বেহুলানৈতিকতা দ্বারা স্পৃষ্ট হয়ে ইন্দ্রের সভার পরিবর্তে ভিলেনডেরায় দর্শকহ্লাদিনী খুল্লামখুল্লা নাচত বা বাধ্য হতো নাচতে; হেমা মালিনি যেমন হয়েছিলেন গব্বররূপী আমজাদ খানের আস্তানায়; ‘যব তক তেরি প্যায়েল চলেগি, তব তক উসকা স্বাস্ চলেগা’ … মালিনিজির খসম ধর্মেন্দ্রকে মরণপণ জিম্মি রেখে গব্বরের এই শর্তে কাচচূর্ণের নৃত্যাঙ্গনে বাসান্তির রক্তকামোদ্দীপ্তা নাচ স্মরণ করে বুড়োরা আজও গভীর শ্বাস টানেন সন্তর্পণে। এরপর থেকে, ইভোল্ভিং ওভার টাইম, আইটেমের প্যারাডাইম শিফট হয়েছে ব্যাপক। হালে এসে দেখা যাচ্ছে আইটেমগার্লদের ভাত মেরে দিয়েছেন খোদ লিড হিরোয়িনরাই। ‘দিলবর’ নাচাগানা দিয়া সুশ্মিতা সেন নবজীবন লভেছিলেন একদা; বা ‘মুঝে মাস্ত বহরম জিনে দো’ দিয়া। তারপর অ্যাশ্ সম্ভবত সর্বাধিক আইটেম ঝুলিতে ঠেসেছেন। অথবা কারিনা কাপুর তো ক্রমে চেহারাসুরতেও আইটেম হয়ে উঠলেন। ক্যাট্রিনা কাইফ, বলা বাহুল্য, বিপাশা বসু এবং দি গ্রেইটেস্ট অ্যান্ড দি গ্রেইশ্যাস্ দিপিকা পাড়ুকান। শরৎচন্দ্রকাহিনিভিত্তিক ‘পরিণীতা’-য় রেখাজি আইটেম হয়ে দুলিয়ে দিয়েছিলেন একেবারে। এমনকি বাকি থাকেন নাই খোদ মাধুরিজিও। কাপুর খান্দানের রনবিরের সঙ্গে উনার রাজকীয় বিভঙ্গিবহুল হংসবলাকা সাবলীলতা তো নয়নসমুখে তিনি না-থাকলেও নয়নের মাঝখানে নিয়াছে যে ঠাঁই। ডিফ্রেন্স বিটুয়িন গোড়ার দিককার সঙ্গে এখনকার আইটেমের, অল্প কথায়, অনেক। এখন অনেক বেশি গোছানো, অর্থব্যয়বহুল এবং যথেষ্ট নান্দনিক, কারিগরি দিক থেকেও যৌক্তিক চোখধাঁধানো লম্ফলাস্য। আগে আইটেমগার্লদের উপস্থাপনায় ভাল্গার জেশ্চারের উপর জোর দেয়া হতো বেশি, এখন সম্রাজ্ঞীপ্রতিম স্বপ্নকামাতুরতার উপরেই জোরারোপ অধিক। ইন্দ্রিয়ভারাতুর উপস্থাপনায় এখন অনেক বেশি ইফেক্টিভ টেক্নোলোজি এবং বাজেট খর্চা যায়। গেস্ট অ্যাপিয়্যার‍্যান্স হিশেবে এখন নায়িকারা ফাঁকফুরসতে আইটেম করেন। ফলে অনেক চিন্তাভাবনা তারা নিজেরাও হয়তো করেন নিজেকে প্রেজেন্টেশনে। অ্যানিওয়ে। এখন বাংলাদেশে তথা ঢাকাই সিনেমাতেও শুরু হয়েছে আইটেম কালচার, শুনতে পাই, তবে বিশেষ প্রতিবেদন পেশ করা যাচ্ছে না আপাতত তথ্যাভাবে। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়; আইটেমের সবচেয়ে বড় সুফল সম্ভবত কাটপিসের বিদায়। এফডিসিনির্মিত মুনমুন-ময়ুরীদের ম্যুভিতে কাটপিসের সেই রমরমা আমলের দৃশ্যরচনাগুলোর চেয়ে এখনকার বাংলাদেশী সিনেমার আইটেমগুলো কতটা আলাদা আদলে প্রেজেন্ট করা যাচ্ছে, এইটা জানা দরকার আমাদের। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী, সেইদিকটায় সকলের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। টেলিভিশনপ্রিমিয়ারে আর কাঁহাতক!

১৪.
ছবির নাচাগানার কোরিয়োগ্র্যাফি ঝিকিমিকি হোক-না হাজার, গান যদি না-হয় জিন্দা ছন্দের, প্লেব্যাক যদি না-হয় শিরাধমনীশিহরা সিম্ফোনি ও অর্কেস্ট্রার, কম্পোজিশন না-হয় যদি কূলপ্লাবী, সমস্ত প্রয়াস তবে গেল ময়দানে মারা। কাজেই আইটেম বলি বা অন্যান্য গানসিক্যোয়্যান্স, গোটা সিনেমাটাই, ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডট্র্যাক সমেত, মিউজিক-কম্পোজার বা মিউজিক-ডিরেক্টরের ওপর ডিপেন্ড করে। সেই সূত্রে এইটাও বলা বাড়ানো হবে না যে এতদঞ্চলে এ-যাবৎ ব্লকবাস্টার বা মেগাহিট বা স্যুপারডুপার প্রভৃতি পরিভাষা-অভিধার সিনেমারাজি ইনডিড বহুলাংশেই মিউজিক-কম্পোজারের কৃতিত্বও। যদিও সংগীতায়োজক-সুরসৃজক-গীতরচক ওইভাবে অ্যাক্নোলেজড হতে দেখা যায় না, টাইটেলকার্ডে নামটা ছাপানো হয় অবশ্য, গাইয়ে শিল্পীর একটা স্টারডম জুটে যায় বেশ। তবু ‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম’ উদযাপনের এই রমরমায় মিউজিশিয়্যানদিগেরে নেপথ্যে থেকে যেতে হয় এখনও।

খুব দূরে না-যেয়ে লেইট সিক্সটিজের ডোমেইন মনে রেখে দেখা যাক কারা আইটেমের প্রিডিসেসর্স। বর্মণতনয় তথা রাহুল দেব ওর্ফে পঞ্চমের নাম বললেই হুড়মুড়িয়ে নেক্সট ঘটনাগুলো ঘটতে থাকবে, মনে পড়ে যাবে মেলোডি কিং পঞ্চমের কাজকামগুলো। ‘শোলে’-র ‘মেহবুবা মেহবুবা’ কিংবা আরেকটা ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি ছোড়েঙ্গে’ তো প্রজন্ম উজিয়ে এসেছে এ-পর্যন্ত, অন্যান্য ম্যুভির নাম মনে না-থাকলেও গানের কলি তো গুনগুন করতেই পারে, যেমন ‘চুরা লিয়া’ বা ‘মেরে সাম্নেওয়ালি খিড়কি ম্যে’, ‘ইয়ে শাম মস্তানি’ বা ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’ … এইগুলো তো প্রজন্মজয়ী ইতোমধ্যে। এই রিমিক্সযুগের ভরভরন্ত বেলায়, এই আইটেমধামাকায়, আরডি রিলোডেড দেখা গেল ‘কাঁটা লাগা’ ছাড়াও অন্যান্য অনেক আরডিবিটের সরাসরি বা ছায়ামূর্ছনায় বেসামাল উইন্ডি নিশান পুনরুড্ডয়নে। ‘এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা / জ্যায়সে খিল্কা গোলাব’ তো তার অন্তিম বছরের কাজ, অনবদ্য, তবে চটুল বিটের ওয়েস্ট-ইস্ট ব্লেন্ডেড কম্পোজিশনের জন্য পঞ্চমের জুড়ি আজও পাওয়া ভার। পঞ্চমের সময় বাপ্পি লাহিড়ী চটুল বিটের পল্কাহাল্কা গানের আয়োজনে বেশ সাফল্য পেয়েছেন আমাদের তখনকার শ্রবণে, বিশেষভাবেই ইন্ডিয়ান বাংলা ছায়াছবিতে; কিশোরকুমার তো মোটামুটি সব ধরনের গানেই লা-জওয়াব, তা গাইয়ে হিশেবে এবং কম্পোজিশনেও।

ওই সময় এবং এর কিছু পরে/আগে থেকে শঙ্কর জয়কিশান, লক্ষ্মীকান্ত-প্যেয়ারিলাল জুটি, নাদিম-শ্রাবন, আনান্দ-মিলিন্দ প্রমুখেরা মাঠে এসেছেন। এদের নাম আমরা ক্যাসেটের খাপে পেয়েছি, বিনোদন পত্রিকায় এরা কাভারস্টোরিও হয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ে; শেষের দুই জুটি অবশ্য নব্বইয়ের প্রাইম টাইমে কাজ করেছেন আমাদের হাতের তালুতে। এদের প্রত্যেকেরই ডিরেকশনে মাধুরিজি লিপ্ দিয়েছেন, প্লেব্যাকে গেয়েছেন আশা বা আল্কা বা পুরুষদের ক্ষেত্রে কুমার শানু বা বাবুল সুপ্রিয় বা সনু নিগম প্রমুখ। তখনও অবশ্য আইটেম ড্যান্স বা আইটেম গান ধারণা আকারে আসে নাই। ক্যাবারে মিউজিক বা ক্লাব স্যং টাইপের একটা আঙ্গিকে, বা ডিস্কো ইত্যাদি, বলিউডে-এফডিসিতে এইগুলো হতো। বইপত্র থেকে নয়, কিংবা গান রিভিশন থেকেও নয়, স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত হচ্ছে বিধায় এখানে এই নিবন্ধে এহেন উপরটপকা আলাপে সেরে নেয়া যাচ্ছে দায়; এইভাবে কথা চালানো অন্যায় নিশ্চয়। কিন্তু গোটা গানের কন্টেক্সট থেকে এই নিবন্ধ ধোপে রেখে দেখবেন না আপনি, রিকোয়েস্ট, নিছক আইটেমের এবং চটুল চটপটে মিউজিকের আলাপসূত্রে এলোমেলো দুইয়েকটা শান্ত রোম্যান্টিক রসের গানও প্রবেশিছে দেখা যাবে।

এরপর একসময় আইটেমের জমানা আসে। এতদ্বিষয়ে এর আগে যেমন, পরেও তেমনি, কথা পাড়া হয়েছে এবং হবেও হয়তো প্রয়োজনে ফের। আইটেম-টাইমে এসে সনু নিগম বা অনু মালিক দিয়া খানিক চালানো হয়েছে, যেমন শুধু গাইয়েদের মধ্যে শান বা অভিজিৎ প্রমুখ, কিন্তু অচিরে এলেন নতুন ছন্দতালের লোকজন। হিমেশ রেশ্মিয়া এদের মধ্যে সবচেয়ে অ্যাভারেজ এবং মিডিয়োক্যর হলেও সফলতা, জনপ্রিয়তার নিরিখে ব্যবসাসাফল্য, জুটেছে হিমেশেরই বেশি। কিন্তু সত্যিকারের ভালো কম্পোজিশনের হিম্মৎ নিয়ে এলেন শঙ্কর-এহসান-লয় ট্রায়ো। এই ত্রয়ীর বিটে মেস্মেরাইজড সময় গিয়েছে আমাদের অনেকদিন। অনেক কাজ আছে এদের যেগুলো অনেকদিন পর্যন্ত শোনা যাবে আরও। দোস্তত্রয় মিলে ‘দশ বাহানে করকে লে গয়া দিল্’ আমাদের সেই-সময়ের সবার। আর্বান, অ্যাংলোসাইজড এবং ওয়েস্ট ফিউশনধর্মী মিউজিক। এর পরে, এবং এরই পাশাপাশি, বিশাল-শেখর জুটি মিলে এক আলগ সুরসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। বিশাল দাদলানি এবং শেখর রাজভিয়ানি। দুর্ধর্ষ। রকিং। সবার শেষে যার নাম নিচ্ছি, কিন্তু সর্বনিম্নোল্লেখ্য মনে করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ কেউ দেখাতে পারবেন না, আবির্ভাবকাল ধরে এই বাঙালি রকসংগীতকারটি আমাদের চেনাজানা, যিনি আমাদের জেমসকেও দলে ভিড়িয়েছেন এবং প্লেব্যাকে জেমস পেয়েছেন অল-ইন্ডিয়া খ্যাতি ক্ষণিকের এবং খানিক হলেও প্রতিপত্তি, তিনি প্রীতম চক্রবর্তী। ট্যালেন্টেড মিউজিক কম্পোজার প্রীতম। আগে জুটিতে কাজ করতেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে, নেইমট্যাগে দেখা যেত জিৎ-প্রীতম, এখন একক কাজ করেন নিজের পছন্দের ক্র্যুজ নিয়ে।

অ্যানিওয়ে। মাধুরিজি, আগেও বলা হয়েছে, ওই-অর্থে আইটেম পরাক্রমের কাল আসার আগেই সিনেমাকাজ থেকে স্বেচ্ছা-অবকাশে গেছেন; যদিও উল্লিখিত অলমোস্ট সবার কম্পোজিশনেই কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু মাধুরিজির সময়ে আইটেম শুরু না-হলেও উনি একাই আইটেম আটকে রেখে দিতে পেরেছিলেন অনেকদিন পর্যন্ত স্বীয় খাজুরাহশৈল্পিক যৌনঠমক ও শৃঙ্গারগমকের নৃত্যকলাবিদ্যার ভিয়েনে। এইটাই বলতে চেয়েছি হয়তো অতক্ষণ। সম্ভবত পোস্ট-আইটেম বলিউডি ফিল্মিগানা মাধুরিজির প্রদর্শিত পথেই মুক্তি ও মোক্ষ খুঁজতে চাইবে অচিরে।

১৫.
আনুমানিক ’৯৬/’৯৭ সালের দিকে একটা খবর চাউর হয়েছিল, পত্রিকান্তরে এসেছিল গোচরে আমাদের; এবং খবর পড়ে বেশ উদ্বেলিত হওয়া গিয়েছিল এই মর্মে যে, যাক, এইবার একটা ‘ভালো’ ম্যুভিতে মাধুরিজি অভিনয় করতে চলেছেন। খবর বেরিয়েছিল যে মাধুরিজি একখানা বাংলা ম্যুভিতে অভিনয় করবেন এবং তদনুযায়ী প্রাথমিক যোগাযোগ ও আলাপালোচনা শুরু হয়েছে। এখন, প্রশ্ন উঠবে, বং কানেকশন শোনা মাত্র চ্যাং মাছের মতো উদ্বেল-বিহ্বল হতে হবে কেন? সংক্ষেপে এর উত্তর এ-ই যে, ট্যাগোরের একটা নভেলোপম ‘বড়গল্প’ অবলম্বনে ম্যুভিটা বানানো হবে বলে খবর বেরিয়েছিল; এবং যে-বইটা বাবু সত্যজিৎ রায় বানিয়ে রেখে গেছেন চিরকালের প্রেক্ষাগারে; এবং বইটা আবার বানাতে চাইছেন আরেক গ্রেইট, তখনও তুরুপের সব তাস দেখায়ে ফেলেন নাই তিনি, ঋতুপর্ণ ঘোষ। খবরের সত্যতা যাচাই করব পরে যেয়ে, এর আগে নির্মিত-হয়নি-কিন্তু-হতে-পারত ঘোষ অ্যান্ড কোম্প্যানির প্রোজেক্টটার নাম অন্তত বলে নিই। স্ক্রিপ্ট করবার কথা ছিল ‘চারুলতা’ গল্পভিত্তিক; ঋতুর চারুলতা; হতে পারতেন অমল ও ভূপতির মাঝখানে টেনশনবহ্নি হৃদিপ্রিয়া মাধুরিজি, ভাবা যায়! কী ডাকাতিয়া বাঁশিকাণ্ড হতো যে! কিন্তু হয়নি শেষমেশ, সে-তো বলা বাহুল্য।

তখন ঋতুপর্ণ সম্ভবত ‘আনন্দলোক’ সম্পাদনকর্তা। বাংলায় ভিন্ন ঘরানার ম্যুভি বানাবার হিম্মৎ তদ্দিনে দেখিয়ে ফেলেছেন ঋতু। ‘চোখের বালি’ কি বানিয়ে সেরেছেন ওই-সময়? ‘রেইনকোট’? দুইটাই তো বলিউডস্টার কাস্ট-করা ছায়াচিত্র। পরেও ঋতুপর্ণ প্রোফেশন্যাল ম্যুভি মেইকিঙের সঙ্গে অ্যামেচার ও মেইনস্ট্রিম্ কম্যার্শিয়্যাল ম্যুভির ব্লেন্ডিং ঘটিয়ে সফল হবেন, নজর কাড়বেন স্বাভাবিক ম্যুভিস্ট্রিমের দর্শকামোদীদের। তো, ওই-সময়, আনন্দলোক পত্রিকার জন্য মাধুরিজির এক্সক্লুসিভ ইন্টার্ভিয়্যু করতে যেয়ে ঋতু প্রস্তাবটা আনেন; চিত্রনাট্য সম্পর্কে একটা আউটলাইনও তিনি মহামান্যা মাধুরিজিকে শেয়ার করেন, সম্রাজ্ঞী ইন্ট্রেস্ট শো-আপ করায় ঋতু অগ্রসর হবার ভরসা পান। পরে এই বিষয়ে একটা আগাম সংবাদ বেরিয়েছিল আশাব্যঞ্জক। অবশ্য গুজবও হতে পারে। তবে ঋতুপর্ণ আর রবিঠাকুর নিয়া রিউম্যর বেরোনো খুব-একটা ব্যবসামন্ত মনে হয় ছিল না তখন, অন্তত তখন পর্যন্ত, আর ঋতু ওইভাবে মিডিয়াহাইপ তৈয়ার করেন নাই আগে কিংবা পরে। অ্যানিওয়ে।

এর আগে এসআর ব্যানারে যে-একটা চারুলতা হয়েছিল, সেইখানা তো অনবদ্য সন্দেহ নাই। কিন্তু, ভুল বুঝবেন না, এসআরকে তথা শাহ রুখ খান সাহেবের কোনো চারু আছে বলিয়া জানা নাই আমার, উনার প্যানপ্যানে পারু অবশ্য ছিলেন, চন্দ্রমুখীমর্ম বুঝিয়াও-বুঝিলেন-না যিনি তিনি কি বুঝবেন বলেন চারুমর্ম! বলা হচ্ছে এসআর ব্যানার, মানে সত্যজিৎ রায় ডিরেক্টেড চারুলতা ছায়াছবিটার কথা। মাধুরিজি এইটা জানতেন নিশ্চয়। রায়চৌধুরী খান্দানের অস্কারউইনার বাবুটি কাশ্মির স্যে কন্যাকুমারি তক পরিচিতই ছিলেন আপন গুণে। অ্যানিওয়ে অ্যাগেইন। মাধবী মুখোপাধ্যায় ছিলেন, এবং অদ্যাবধি বিরাজিছেন মম হৃদয়ে, সত্যকল্পিত চারু; মাধুরিজি ইনফোটুকু ওয়াকিবহাল হলেও ম্যুভিটা দেখেন নাই; ঋতুকল্পনায় কেমন চারু অঙ্কিত ছিল তা আমরা আর জানতে পারব না কোনোদিনই, হায়! কিন্তু মাধুরিজি ভিডিয়োক্যাসেট চেয়েছিলেন দেখতে, ঋতুর কাছে, সেই চারুর; এইটাই খবরে বেরিয়েছিল তখন। গঙ্গা আজও বইছে, মাতামুহুরি দিয়াও জলপানি গড়ায়, ঋতু প্রয়াত অত্যন্ত অকালে; এবং মাধুরিজি সন্তানসন্ততি নিয়া পারিবারিক ও নাচের ওয়েবসাইট চালানোর কুটির শিল্পে মনোনিবিষ্ট। যাকগে।

একবার ভেবে দেখুন, যদি ঋতু চারুলতা বানায়ে যেতেন, এবং সেখানে মাধুরিজি বিরাজিতেন আমাদের বিষাদসুরভী মাধবীদেবীর স্থলে, কেমন হতো ব্যাপারস্যাপার! তা, সামনে যা নাই তা নিয়া কথা চালানো তো যায় না। আজ্ঞে হ্যাঁ, তা যা বলেছেন। ওই ‘দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা’ স্টাইলের হতো কী বিষয়টা? আরে না, ওইটা তো দিদির দেবর, আপন দেবর আর দিদির দেবর দুই ইম্প্রেশনের মামলা, মাধুরিজি ছাড়া এই জিনিশ সামলানো সবার কম্ম না। ‘দেড়-ইশকিয়া’ দেখে উনার ম্যাচিয়্যুর অভিনয় আর মুখবিম্বে বিষাদরেখা পরিস্ফুটনের স্কিল্ নিয়া আর কোনো সন্দেহ রইতে পারে না আপনার। তবে, এমন অনেক দৃশ্য আছে যেইগুলিতে মাধবীদেবী ইনস্যাপার‍্যাবল জেনেও পুনশ্চ জানতে সাধ হয় এইসব দৃশ্যে মাধুরিজি কেমন করতেন। যেমন অমল ঠাকুরপোর সঙ্গে বাগানদৃশ্যে চারুবৌঠান কেমন করতেন, কে জানে। লেকিন ঋতুপর্ণ না-হয়ে পরিচালক যদি সঞ্জয় লীলা বান্সালি হতেন, তবে তো বৌঠান বিশাল বহরের লেহেঙ্গা পরে দেব্দাস স্টাইলের একটা আইটেম করতেনই নির্ঘাৎ; অ্যাসিমেট্রিক ড্রেসের ছটায় শিল্পকর্ম বেয়ে ত্রাহি ত্রাহি রব বেরোত।

এতকিছু ভাবছি, কিন্তু তা না-ও হতে পারত। ওই-সময় ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছিল বলিউড থেকে ক্লান্তশ্রান্ত ঝরতিপড়তি নায়িকাদের ঢাকা শহরে এনে ধুমিয়ে আফসানা মিমির ডাবিং দিয়া ছায়াছবি বানানো। মমতা কুল্কার্নি, আয়েশা জুল্কা, এমনকি নিঃশেষিত হাটের জয়াপ্রদাকেও পদ্মাপারে এনে ঢোলশোহরত পিটিয়ে জিনিশ বানানো হয়েছে। এখন তো অধঃগতি সীমানা পেরিয়ে গ্যালাক্সি ছোঁবার রাস্তা ধরেছে। ফারুকীর লাস্ট প্রোজেক্ট, আর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার নামে যা তিলিসমাতি স্টার্ট হয়েছে, বলিহারি যাই। হালে ফের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে খেইল, কালচারাল এক্সচেঞ্জ, আসলে তো ইন্দ্রনীল আর পরমব্রতের ছুটিদিনের হাডুডু বৈ কিছু না। আর আমাদিগের জয়া প্রমুখের কলকাতাবাংলায় একাধটু অতিনাটুকেপনা। নারদ, নারদ!

১৬.
সুনীল দত্তপুত্র সঞ্জয় ছাড়া আর কারো নাম জড়িয়ে সেভাবে কোনো গসিপ বা গুজব রটিত হয়েছে বলা যাবে না মাধুরিজিকে নিয়ে। এমনিতেই ফিল্মি দুনিয়ার মানুষজন নতুন ম্যুভি রিলিজ-প্রাক্কালে প্রচারণাকৌশল হিশেবেও অনেক-সময় নিজেদের পার্সোন্যাল অ্যাফেয়ার্স নিয়া বানোয়াট-বাস্তব মুচমুচে কথাবার্তা নানাবাহারী মিডিয়ায় রটিয়ে থাকেন। মুক্তিপ্রতিক্ষীত ম্যুভির দিকে ভিয়্যুয়ারদের নজর টানানোর জন্য বহু ভুজুংভাজুং করা হতো এবং হয় এখনও। তবে মাধু-সঞ্জু জুটির সম্প্রচারিত খবরটা রটনা না-হয়ে বেশ ঘটনার ডিগ্নিটি পেয়েছিল তখন। বহুদিন দস্যুদেহ সঞ্জু ও লঘুডানা মাধুরিজি নিয়া নিউজটা প্রিন্টপত্রিকায় ছিল বহাল। তবে যেইটা তখনই ছিল লক্ষণীয় তা এ-ই যে এতদ্বিষয়ে ছাপিত খবরগুলো পত্রিকাওয়ালারা শালীন ও সসম্ভ্রম একটা ভাবের সঙ্গেই ট্রিটমেন্ট দিতেন মনে হয়। হোয়ার‍্যাজ্ অন্য অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হার্ডকোর হতো অনেক বেশি।

কিন্তু সঞ্জয় ছিলেন তখনই বিবাহিত, তৎকালীন ওয়াইফের নাম রিচা শর্মা, তবে সেইটাও হয়তো বড় বাধা হয়ে উঠত না আদৌ। অন্তরায় ছিল সঞ্জয়েরই লিভিং ও লাইফস্টাইল। উদ্দাম, স্বাভাবিক উদ্দামতার চেয়েও ঝড়ো ও বল্গাহারা, উচ্ছৃঙ্খলও বলা যায়। মাধুরিজির মারাঠি পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠার সঙ্গে এইটা মানিয়ে যাওয়া মুশকিলেরই ছিল। সঞ্জয়ের ক্যারিয়ারে তার যুবা বয়সের যাপনধারা ছাপ রেখেছে ন্যেগেটিভ ও পজিটিভ দুইভাবেই। মাধুরিজি ওই-সময়ের ব্যক্তিগত বিষাদাচ্ছন্ন পরিস্থিতি দ্রুত সামলে ওঠেন, ভিতরে বিষের বালি নিয়েই হয়তো মুক্তা ফলিয়ে চলেন পরবর্তীকালে, সঞ্জয় অচিরে মুম্বাই বোম্বিং সন্ত্রাসের অভিযোগে জেলে প্রেরিত হন এবং অবশেষে তিনি তার প্রাপ্য সাজা পান। বর্তমানে, এই ২০১৫ অব্দি, সঞ্জু তার দণ্ডকাল কাটাচ্ছেন কারাগারে প্রায়-সেইন্ট আচরণে। অ্যানিওয়ে।

‘দেশ’ পাক্ষিকটা, ভারতীয় বাংলা বিগ মিডিয়াহাউস আনন্দবাজার প্রাইভেট লিমিটেডের ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল সাহিত্যপত্রিকা, আমাদের দেশে তখনও অচল আধুলি হয়ে ওঠে নাই; ঠিক আদি চেহারায় একনিষ্ঠ সাহিত্যের কাগজ থেকে ‘দেশ’ তখন থেকেই শিফট করছিল ক্রমে একটু একটু করে; এক-সময় পুরা বারোয়ারি বিষয়াশয়ের কাগজ হয়ে ওঠে ‘দেশ’ এবং বাংলাদেশের ফুটপাতপত্রিকাছাউনিগুলোতে পোকার খোরাক হতে থাকে। সেই ভালো-মন্দ অন্তর্বর্তীকালে ‘দেশ’ একটা নিয়মিত বিভাগ চালু করেছিল ‘অধিকন্তু’ নামে, সেই বিভাগে স্বপনকুমার ঘোষ মাধুরিজিকে নিয়ে একপৃষ্ঠার একটা আত্মস্মৃতিচারণিক রিপোর্টাজ্ লিখেছিলেন। স্বপন তখনকার আনন্দলোক প্রভৃতি সিনেম্যাগের পুরনো অবদায়ক। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসের লাস্ট ফোর্টনাইটের ‘দেশ’ থেকে সেই রিপোর্টের প্রাসঙ্গিক অংশ নিচের প্যারায় দেখে নিতে পারি।

“অনেকদিন আগে ‘থানেদার’ নামে একটি ছবির শুটিং চলছিল। সেদিন শুটিং শুরু হয় সন্ধ্যায়। চলে মাঝরাত অবধি। সেটা ছিল মুম্বইয়ের শীতকাল। জানুয়ারির মাঝামাঝি। স্টুডিওতে ঢুকে বাঁ দিকে সারি সারি মেকআপ রুম। লম্বা সরু বারান্দা। তার ওপর ছাউনি। অদূরে ফ্লোর। লোকজন তেমন ছিল না। ফ্লোরে প্রবেশ নিষেধ ঝোলানো ছিল। মেকআপ রুমের বারান্দায় ছবির নায়ক সঞ্জয় দত্ত বসে আছেন। ফ্লোরে মাধুরী। ফ্লোর থেকে বের হলে তার সঙ্গে দেখা হবে, এই প্রত্যাশায় ফ্লোরের বাইরে ঘোরাঘুরি করছিলাম। ইউনিটের কেউ আমাকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে আজ ম্যাডামের মন ভালো নেই। সঞ্জয়ের সঙ্গে মান-অভিমানের পর্ব চলছে। অতএব মাধুরীর জন্য আমার আর অপেক্ষা না-করাই ভালো। গোটা ব্যাপারটায় গসিপের গন্ধ পেতে আমি এবার মেকআপরুমের চত্বরে এসে দাঁড়ালাম। এমন সময় দেখি ফ্লোর থেকে বেরিয়ে আসছেন মাধুরী। পরনে চোলি ঘাঘরা। নাচের পোশাক। সঞ্জয়ের পরনে পুলিশের পোশাক। দূর থেকে সব লক্ষ করে যাচ্ছি। মাধুরী গট গট করে ঢুকে গেলেন তাঁর মেকআপরুমে, একা। এর মিনিট খানেকের মধ্যে সঞ্জয় ঢুকলেন মাধুরীর মেকআপরুমে। দরজা বন্ধ রইল মিনিট পাঁচেক। তারপর দেখা গেল মেকআপরুমের সামনে লম্বা বারান্দার একদিকে একা সঞ্জয় বসে আছেন। একেবারে অন্যপ্রান্তে মাধুরী প্রায় অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে। এটা নিজের চোখে দেখা।

‘থানেদার’ মেগাহিট হয়েছিল অবশ্য; তখন অমিতজির সঙ্গে টারজানকন্যা কিমি ক্যাটকার ‘হাম্’ নামে একটা ম্যুভি দিয়ে বহুদিন মজিয়ে রেখেছিলেন পোলাপানবুড়ো সবাইকে, সেখানে অসমাপ্ত চুম্বন ও অচরিতার্থ সংরাগের একটা গান আজকের প্রায় আইটেমের মতোই শীর্ষ হয়েছিল জনপ্রিয়তায়, ‘ঝুম্মা চুম্মা দে দে / ঝুম্মা চুম্মা দে দে চুম্মা’ ইত্যাদি ছিল শুরুর দিককার কলি গানটার। মজার ব্যাপার হলো, অব্যবহিত প্রায় পরেই ‘থানেদার’ ম্যুভিতে একই ট্র্যাকের অনুসরণে একই বিটে একটা গান ‘তাম্মা তাম্মা লোগে / তাম্মা তাম্মা লোগে তাম্মা’ আমাদের মুখে মুখে লতিয়ে উঠেছিল। ওইখানে মাধুরিজির ব্রেইকড্যান্স আর সঞ্জুবাবার মাতলামি ম্লান করে দিয়েছিল অমিতজির বলিরেখা-ঢাকা-দেয়া মাফলার আর কিমির চুমকি-জরিঝালরের দেহবল্লরীর ছলাকলা। যা-হোক। মাধুরি-সঞ্জয় বিয়োগান্ত সম্পর্ককাণ্ডের সঙ্গে রেখা-অমিত মিথিক্যাল প্রণয়বিধুর বিরহকাহিনির একটা সাযুজ্য চোখে পড়ে।

১৭.
‘খলনায়ক’ কিংবা ‘থানেদার’-ই নয় কেবল, সঞ্জয়ের সঙ্গে মাধুরিজির স্ক্রিনপ্রেজেন্স গোচরে এসেছে অ্যাট-লিস্ট আরও কয়েকটাতে; এর মধ্যে ‘সাজন্’ তো স্যুপারডুপার সাফল্যপালক টুপিতে গুঁজেছে। এরপরও জুটি হিশেবে এইটা লাস্টলঙ্গার হয় নাই কেন তা আন্দাজ করা আদৌ কঠিন হবে না; ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনই সেক্ষেত্রে ক্যাটালিস্ট হিশেবে কাজ করেছে, এতে নিঃসন্দেহ হওয়া অমূলক হবে না। তা সত্ত্বেও, লক্ষ করবার ব্যাপার এখানে এইটাই যে, দুজনের কেউই নিজেদের টানাপোড়েনটাকে ডেলিবারেইটলি মিডিয়ায় এনে পানি ঘোলা করার সস্তা স্টারডমের রাস্তা ধরেন নাই। হ্যাঁ, সেই সময়ের বিবেচনায় কিছুটা আনলাইক্লি হলেও সত্যি যে এক্ষেত্রে সঞ্জয়ও সহবত মেনে গেছেন আগাগোড়া। ঢাকঢ্যাঁড়া ফাটিয়ে কেউ পরস্পরের নামে একগাদা গালমন্দ রটাতে প্রেসমিডিয়া ব্যবহার করেন নাই। কিন্তু জুটিটা তামাদি হয়ে যায় শিগগিরই।

বিষয়টা খানিক কল্পনা করে নেয়া যায় যে, এই মিস্টেরিয়াস্ ব্রেইকআপের পর মাধুরিজি নিজের কাজে সর্বোচ্চসাধ্য লগ্ন হবার দিকে ধাবিত হন এবং সঞ্জয় ফিল্মিহিরোর চিরাচরিত কায়দা বাস্তবে মঞ্চস্থ করার দিকে যান; বিচ্ছেদে-বিরহে বিধুর দেবুদা এইখানে পার্বতীপ্রাসাদের সামনের স্পট বাদ দিয়ে বেছে নেন আত্মহননমুখো শোম্যানশিপের সোজা রাস্তা; মঞ্চ এখানে মুম্বাই শ্যপিংমলের পার্কিংলট বেইসমেন্ট। অবশ্য অন্য কারণেও হতে পারে গোটা ব্যাপারটা সংঘটিত; সমস্ত অনুমানের পেছনে একটা চার-তিন সাত মেলানোর আঙ্কিক নিয়ম সবখানে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে নিশ্চয়। কিন্তু সঞ্জয়ের যুক্ততা আলামত হিশেবে একদম প্রথম থেকেই মুম্বাই প্যুলিস্ বলে এসেছে। এইটাও সত্য যে সেই-সময় মাফিয়া ফান্ডিং বড়সড় আকারে বলিউড ম্যুভিমার্কেটে এন্টার করতে দেখি আমরা। নায়ক-নায়িকা আর পরিচালক-প্রযোজক অনেকেই মাফিয়া ডনদের গ্রিপে হেসেখেলে স্বেচ্ছা-সানন্দে যেতে থাকেন। অচিরে একাধিক নায়িকার আত্মহত্যা আর নায়কদের টেরোরিস্ট বিহেইভিয়্যর দেখে নড়েচড়ে বসেন সবাই। ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যাপিট্যাল ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপারে স্টেইটের নজরদারি বাড়ানো হয় এবং রেগ্যুলেটোরি ম্যেজার ইন্ট্রোডিউস্ করা হয়। অ্যানিওয়ে। সঞ্জয় পয়লা দফা জেলখানায় যেয়ে বেইল-আউট হয়ে এসে ফের কাজে যোগ দেন। ফাইন্যালি তিনি আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং কয়েদ খাটতে পাকাপাকি লালঘরে ঠাঁই গাড়েন। অবশ্য ততদিনে দেড় থেকে দুই দশক সময় গেছে খোলা আলোবাতাসে অন-স্ক্রিন মুন্নাভাই এমবিবিএস আর গাঁধিগিরি করে। তা যাক। আমরা এবার অন্য সাজন্ সল্লু খানের সুষ্ঠুমিষ্টি বিচার দেখতে চাই।

কিন্তু যে-ব্যাপারটা আজও রহস্য, সঞ্জু-মাধু সম্পর্কের ক্ষেত্রে, দুজনের কেউই এই বিষয়টা নিয়ে মুখ খোলেননি। ইভেন গণমাধ্যমিক বিনোদন বিভাগের পাপারাৎসি জার্নালিস্টরাও ঘটনাটা নিয়া মাধুরিজি কিংবা সঞ্জু কাউকেই বিশেষ খোঁচাখুঁচি করেনি আগে কিংবা পরে এখনোব্দি। মিডিয়া বরং সমীহ করে গেছে গোটা ব্যাপারটা আগাগোড়া। আগেও অনুরূপ একটা কাহিনি লক্ষগোচর হয়েছে এককালে রেখা-অমিতাভ সম্পর্করহস্য ঘিরে। সেক্ষেত্রেও অমিতাভ কিংবা রেখা আড়ালে নিয়ে গেছেন নিজেদের ব্যক্তিক রোদন। অবশ্য অমিতজির দুর্ঘটনাটা ওই-সময় না-ঘটলে কে জানে গল্পের মোড় অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পথের বাঁকে প্যাঁচ খেয়ে যেত কি না। ভাদুড়িতনয়া বাংলার জয়াজিও অবশ্য সংসার সমরাঙ্গনে মেডেল পাবার দাবিদার।

পরে একটা পর্যায়ে সঞ্জয় যখন টাডার কারাগারে বন্দি, সেই-সময় খবর বেরোয় যে মাধুরিজি নাকি সঞ্জয়ের সঙ্গে একটাবার দেখা করতে চেয়েছিলেন। হয়তো-বা কার্টেসি ভিজিট, ফেলো ফিলিংস এক্সপ্রেস্ করতে চেয়েছিলেন হয়তো, অথবা লাস্ট পোয়েজি রিসাইট করতে। অ্যানিওয়ে। সেইটা আর হয় নাই শেষমেশ। হলে কি হতো, তা জানি না, অথবা না-হয়েও কোন ফায়দা কার হয়েছে কেউ বলতে পারবে না মনে হয়। কিন্তু হয়নি যে, এইটাই রিয়্যালিটি। মাধুরিজির সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন আর মারাঠি সামাজিক সংস্কারপ্রথার দেয়ালটা ভাঙা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। একেবারে ভেঙেচুরে একটাকিছু করা মাধুরিজির পক্ষে সম্ভব হয়নি, এমনকি অভিনয়েও, স্ক্রিপ্ট ভালো পান নাই কিংবা সামর্থ্যের মাত্র তিরিশ শতাংশ ব্যবহারের মওকা মাধুরিজি পেয়েছেন ইত্যাদি যত যা-ই বলুন ইন্টার্ভিয়্যুতে।

ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে ভ্যানতারা সাক্ষাৎকার অবশ্য খুব বেশি দিয়েছেন মাধুরিজি, তা বলা যাবে না। মানে, যেমনটা হামেশা দেখি আমরা নায়িকাসুলভ নখরা বা আহ্লাদিপনা করতে অ্যাভারেইজ অ্যাক্ট্রেসদিগেরে; মাধুরিজি বরং সোজাসাপ্টা অ্যাক্নোলেজ্ করার দিকেই মনোযোগী থাকেন, রিটেন ফর্মে যেসব ইন্টার্ভিয়্যু লভ্য সেগুলো বিবেচনায় রেখে বলছি। নৃত্যের প্রসঙ্গেই কমন ইন্ট্রেস্ট শো করতে দেখা যায় বেশি। কোনো-একটায় পেয়েছিলাম মাধুরিজি বলছেন যে তিনি তিরিশ শতাংশ সাকুল্যে ব্যবহার করতে পেরেছেন তার অভিনয়সামর্থ্যের; তবে এখন থেকে সেই লালিত সত্তর শতাংশের ব্যবহার করতে চান, ইচ্ছা প্রকাশ করে রেখেছেন সেখানে। নেনেজির সঙ্গে সেই-সময় তিনি বিদেশে পাকাপোক্ত বসবাস শুরু করে দিয়েছেন, মাঝখানে একফাঁকে এসে ‘আ যা নাচলে’ করে গেছেন, ‘দেড়-ইশকিয়া’ তখনও ভবিষ্যৎগর্ভে।

১৮.
অভিনয়স্কোপ আছে, এমন ম্যুভির দিকে মাধুরিজির চোখ সবসময় নিবদ্ধ ছিল লক্ষ করব। বলিউডে সেই সুযোগ সবসময় হয়ে ওঠে না, আজকাল যদিও বৈচিত্র্যবহ থিম ও নির্মাণশৈলীর নানান স্ট্রিমের ম্যুভি প্রোডিউস্ হচ্ছে দেখতে পাই। দীপা মেহতা বা মীরা নায়ার যে-ধরনের সিনেমা বানাচ্ছিলেন, বা শ্যাম বেনেগাল, কম্যার্শিয়্যালি সেগুলো খুব-একটা ভায়্যাব্যল ভেঞ্চার না-হওয়ায় মাধুরিজির পক্ষে এ-ধরনের অফবিট ম্যুভি দিয়া সার্ভাইভ করা আদৌ সুসাধ্য হতো না। তারপরও ‘পরিন্দা’, ‘লজ্জা’ বা ‘দেব্দাস’ প্রভৃতি সিনেমায় মাধুরিজি যেভাবে পার্টিসিপেইট করেছেন, তাতে এই বিবৃতি সত্যায়িত করা যায় যে তিনি ভালো স্টোরি এবং স্ট্রং ক্যারেক্টারের ম্যুভিতে অভিনয় করতে মুখিয়ে থাকতেন। প্রকাশ ঝা বানিয়েছিলেন ‘মৃত্যুদণ্ড’, মেইনস্ট্রিমট্র্যাকেই, নিয়েছিলেন মাধুরিজির সঙ্গে শাবানা আজমি এবং তখন ইম্যার্জিং অভিনয়মেধাবী শিল্পা শিরোদকর মুহতারিমাকে। শেষোক্ত অভিনেত্রী ইন্ডাস্ট্রিতে বেশিদিন টিকতে পারেননি বিউটিফ্যুল হাইট, স্ক্রিনফ্রেন্ডলি ফেস্, ফেভ্যর‍্যাবল ভাইট্যাল্ স্ট্যাটিস্টিক্স সত্ত্বেও। তো, ম্যুভিটা ভালো ব্যবসা করেছিল, পুরস্কারও ভরেছিল থলেতে, খুল্লামখুল্লা না-হয়েও। অতএব মাধুরিজি রিলেন্টলেসলি এফোর্ট জারি রেখেছেন অনুমান হয় মশলাপাতি বিনা শান্তসুস্থ রসের ম্যুভিতে অভিনয়ের জন্য। মশলার যুদ্ধে শামিল না-হয়েও তো উপায় নাই জিন্দেগি জিনিবার। তাছাড়া মাধুরিজির ন্যায় প্রিন্সেস্ ফ্রম হ্যাভেনের লাক্সারি লিভিং এবং লাইভলিহুড থোড়া-সা শানদার হো-না চাহিয়ে, এইটা তো ‘অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে’ যে-কেউই হৃদয়ঙ্গম করবেন উই হোপ্।

গজগামিনী ফেজের অভ্যুদয় ‘হাম্ আপকে হ্যায় কৌন্’ অলটাইম ওয়ার্ল্ডরেকর্ড গড়ার অব্যবহিত পরে থেকেই। ‘হাআহ্যাকৌ’ হয়েছিল ১৯৯৫/৯৬ দিকটায়। সেই মিছরি পিঠে দিদির দেবরের গুলতির ঢিল ম্লান করে দিয়েছিল আবাল্য-পড়ে-আসা আমাদের শরৎসাহিত্যের একটুকরো দেবদাসের সেই ছিপের আঘাত পারুর ভুরুশীর্ষ সুকোমল সুরোজ্জ্বল কপালে। তখনও সঞ্জয় লীলা বান্সালি হয়নি, অ্যাশের ‘ইশ’ ধ্বনির কাৎরানিশীৎকার মরমে তখনও পশেনি এসে, ‘দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা’ গানে পেছন থেকে ছুরিকাঘাতে ঘায়েল হয়েছিল দুনিয়ার কতশত দিদির দেবরেরা, সেই হিসাব কোথাও লেখাজোখা নাই। কিন্তু খতিয়ানখাতা আস্ত চোখ না-বুলিয়ে একটা এন্ট্রির খবর নিলেই হৃদয়ঙ্গম ও দেহঙ্গম করা যাবে যে সেই-সময় এর ক্রেইজ্ পোলাপান সোসাইটি থেকে শুরু করে সারস্বত সমাজে কেমন ও কোন পর্যায়ের ছিল। মকবুল ফিদা হুসেন কাণ্ড দুই-তিন প্যারায় নয়, মিনিমাম সাত প্যারায় বলা বাঞ্ছনীয়। সেই প্রয়াস ক্রমশ গ্রহণ করা যাক।

ম্যুভিটা, ‘হাআহ্যাকৌ’ ম্যুভিটা, এমএফ মোটমাট ৫৭ বার মতান্তরে ৬৩ বার দেখেছিলেন। তন্মধ্যে প্রেক্ষাগৃহ এককভাবে একলা ভাড়া নিয়ে একাধিকবার ইয়ারবখশি সমভিব্যহারে এবং গহন-মগন একাকী দেখার ব্যাপারটাও অন্তর্ভূত। গোটা ব্যাপারটা প্রতিভাবান পেইন্টারের পাগলামি বলেই উড়িয়ে দেয়া যেত, যদি-না পরবর্তী কয়েক বছরের ঘটনাবলি সংঘটিত হতো। হুসেন ওই-সময় মাদার টেরিসা নিয়া সিরিজ পেইন্টিং করছিলেন, সেই সিরিজের অনেক ছবি আমরা বাংলাদেশের নিউজপ্রিন্ট পত্রিকাগুলোতে দেখছিলাম অনিয়মিত হপ্তান্তে। অ্যাব্রাপ্টলি ফিদা মাদারের সিরিজ পোস্টপোন্ড রেখে মাধুরিজিতে মশগুল হয়ে পড়েন। দিওয়ানা মাস্তানা যাকে বলে। একেবারে ফানাফিল্লা ফিদা। সাক্ষাৎকার ভরে কেবল মাধুরিকীর্তন হুসেনের মুখে, চোখে, সর্বাঙ্গ উপচিয়ে কেবল মাধুরিজিকিরের রোশনাই। রীতিমতো জ্বরে বেসামাল উন্মাদনা মায়েস্ত্রো মকবুলজিকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছিল, মাধুরিজ্বরে বেফানা করে ফেলেছিল, মুক্তির পথ বিমোক্ষণের রাস্তা খুঁজে ফিরছিলেন তৎকালে সত্তরোর্ধ্ব বুজুর্গ সেই চিত্রকর।

অচিরে পথ পাওয়া গেল অবশ্য। হুসেন দাঁড়ালেন তুলি-প্যালেট হাতে ক্যানভাস-সমক্ষে। এবং একের-পর-এক ফুটিয়ে চললেন মাধুরিবিভঙ্গি। বিভোর রইলেন ফিদা মাধুরিজিতে একটানা বছরেরও অধিক ক্যানভাসের মুখোমুখি। মাধুরিসৃজনে ব্যাকুল বিহ্বল সেই দিনরাতযাপনের সুধা আমরা একসময় পেলাম, ‘হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে’ খেলাম বিসমিল্লার পাগলা সানাইয়ের ন্যায় ফিদার পাগলপারা মাধুরিসিরিজ, অশেষ কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশের নিউজপ্রিন্ট দৈনিকীগুলোর শিল্পসাহিত্য সেবাকার্যক্রমের নিকট। পত্রিকাগুলো মকবুল ফিদার মাধুরিসিরিজ প্রদর্শনীর সচিত্র প্রতিবেদন, প্রদর্শনীরিভিয়্যু, ছবিমালার একাংশ উল্লেখযোগ্য স্পষ্টগোচর মুদ্রণসৌকর্য লগ্নি করে ছেপে দেখতে দিয়েছিলেন আমাদিগেরে। এখন তো উইকি ইমেইজে সেসব অবারিত দরিশন করা যায় অ্যানিটাইম, তখন ছিল অন্যসময়, তখন ছিল অন্যযুগ, তখন ছিল নিউজপ্রিন্ট পোয়েট ও পোয়েমের অগাধ ব্রাহ্মণ্য ও অকহতব্য বারফট্টাই।

কিন্তু মহাকাব্যের সেখানেই শেষ হয় নাই। এপিক বিউটি মাধুরিজির অশেষ অক্ষয় ইনার-অ্যাস্থেটিক্স নিয়া এমএফ সম্ভবত তার লাস্ট ব্রেথ অব্দি বিভোর শিবশঙ্কর হয়েই ছিলেন, হুসেনের পোস্টমাধুরি প্রোজেক্টগুলোতে সেই চিহ্ন ধরা আছে দেখতে পাই। অ্যানিওয়ে। অ্যানাউন্স করা হয় এরই মধ্যে এমএফ তরফ থেকে যে মাধুরিজিকে ট্রিবিউট জানিয়ে একখানা বায়োস্কোপ বানাবেন স্বয়ং মকবুল ফিদা হুসেন। তাতে শ্রেষ্ঠাংশে থাকবেন স্বয়ং মাধুরী দীক্ষিৎ। পত্রিকান্তরে সেই নির্মিতব্য ম্যুভি নিয়া চিত্রকরের প্ল্যানপ্রোগ্রামের ফিরিস্তি নিয়মিত শুনি, ঝিলিক দেখি ফিদা-আঁখিকোণে সৃজনস্বপনের, ফিদার মাধুরিজ্বর নিয়া মাদারি মিডিয়ার ঠাট্টাতামাশাও নজর এড়ায় না আমাদের। তখনও ওয়ান-সাইডেড ল্যভ ছিল হুসেনের দিক থেকে, মাধুরিজি সিনে এসেছেন বেশ পরে এক ফুরসতে যখন ভারতশ্রেষ্ঠ অঙ্কনশিল্পীর উন্মাদনার আখরগুলো, যে-আঁকিবুকিগুলো আবার খোদ তাকে নিয়েই বলে ইতিউতি শুনেছেন মাধুরিজি, হুসেনের আমন্ত্রণে একদিন সম্রাজ্ঞী চললেন লটবহর নিয়া আঁকিয়ে বুড়োর স্টুডিয়োতে। এরপর প্রেম আর একচোখা রইল না বলেই মনে হলো আমাদের। এরপর মুম্বাই আর হায়দ্রাবাদের ক্যাফেতে, ক্যান্ডল্ লাইট ডিনারে, দোঁহে ঢের তাকিয়ে থাকা হলো, মুখোমুখি বসিবার অন্ধকারও হলো অনেক, তারপর শুভদিনে বিসমিল্লা বলিয়া হলো ম্যুভিমহরৎ। গজগামিনী শুরু করল চলা তার হাজার বছর ধরে অযুত-নিযুত বছরের তরে পৃথিবীর পথে। সেই চলার হিস্ট্রি, জিয়োগ্রাফি, জিয়োমেট্রি ফিতেধৃত রইল হুসেনের গজগামিনীতে। না, আসলে বলা উচিত মাধুরিজির গজগামিনীতে, হুসেনের মাধুরিকীর্তনে।

১৯.
সিনেমার ভাষা আর মাধুরিজির মহানৈসর্গিক শরীরের ভাষা একাত্ম করার প্রয়াস ‘গজগামিনী’, ফিদা হুসেনের এহেন কবুলতি নিউজপেপারে পেয়েছি আমরা। তা, প্রথমোক্ত ভাষা বুঝিতে-পড়িতে-লিখিতে ও প্রকাশ করিতে গেলে যে-ব্যাকরণ অধ্যয়ন করা লাগে, যেমন আজকাল গাদাগুচ্ছের গজানো প্রাইভেট পয়সাকড়ির য়্যুনিভার্সিটিগুলোতে আর-কিছু থাকুক না-থাকুক ফিল্মস্টাডিজ্ বিভাগ একটা থাকবেই, সেইটা আমার নাই, মানে সেই বিদ্যা আমার ব্যাগে ভরার সামর্থ্য হয় নাই ইহজন্মে। ডোন্ট গেট আপসেট, ডিয়ার, লাখটাকা খর্চে বিদ্বজ্জন হয়ে কবরে যাবার গৌরব তুমি অর্জন করতে পারো নাই; তা, চাষাচামুণ্ডার এই দেশের কোটি-কোটির নসিব অলমোস্ট দ্য সেইম, কবরে যেয়ে এরা ভারি শরমিন্দা থাকবে কনফার্ম। দীর্ঘশ্বাস।

দ্বিতীয়োক্ত ভাষার ব্যাপারে এইবার বলা যাক। মানবশরীরের ভাষা। সারাজীবন বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজি নাকি যে আমরা মানবশরীরী লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বুঝব না? ভাষাবিদ না-হয় নই দিগগজ বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মহাশয়ের ন্যায়, কিন্তু তার মানে তো বোঝায় না যে আমরা মানবশরীরের ভাষা ব্যাপারে একদম বকলম উম্মি। নিশ্চয় না। আলবৎ আমরা ভাষাকারবারী, ভাষা ব্যবহারকারী, মানবশরীরী ভাষার সমুজদার। লেকিন, দোস্ত, তুম্ মুঝকো ভাষাবোদ্ধা জরুর মাৎ বোলা, সামঝা? মানবশরীরের ভাষা বুঝি কিংবা না-বুঝি, মাধুরিজির মহানৈসর্গিকতা আমরা আলবৎ বুঝি, আমরা তার যোগ্য সমাদর ও অকুণ্ঠা তারিফ করি। কিন্তু ভুবনব্যাপ্ত ‘মধু ও মশলার বনে’ আমরা কি ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারি যা যা বুঝি বলে দাবি করি তার সবটা? না, পারি না, বা যা বুঝি তার অল্পই পারি ঠারেঠোরে প্রকাশিতে। এবং মাধুরিজির মহানৈসর্গিক শরীরভাষা হচ্ছে তা-ই যা আদৌ বোঝা-নাবোঝার পরোয়া না-করেই ক্রিয়াশীল রয় বিপুলা এই ধরণীমাঝারে।

মেরিলিন ম্যুনরোর চেয়েও অধিক বাঙময় মনে করতেন ফিদা মাধুরিজিকে। এইটা ব্যাপার না, ফানাফিল্লা ফিদা হলে লোকে এমন বহুকিছুই বলে প্রলাপ কিংবা বাড়িঘর-পোড়ানো বহুকিছুই কাণ্ডাকাণ্ড করে। অ্যানিওয়ে। ফেলনাও না একেবারে এমএফ অ্যাপ্রিসিয়েশনটা। মাধুরিজিকে কেন্দ্রে রেখে একটানা বছরকাল পেইন্টিঙের পর হুসেন মারাঠি বিউটি মাধুরিজিকে নায়িকা বানিয়ে একখানি শিল্পধর্মী সিনেমা নামাতে লাগলেন। সিনেমার থিম্যাটিক কন্সার্ন ‘ভারতীয় নারীশক্তি’, ইন্টার্ভিয়্যুতে এই রকমের শব্দবন্ধ বলেছেন মকবুল ফিদা। আরও বলেছেন যে, ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন্’ চলচ্চিত্রটা তিনি যতবার দেখেছেন ততবার ঘুরেফিরে এইটাই বুঝেছেন যে মাধুরিজির ভিতরে-বাইরে অন্তরে-প্রান্তরে রয়েছে এক অসাধারণ ‘ভারতীয় নারীত্ব’; গজগামিনীতে এমএফ মাধুরিজির চোখ দিয়ে তুলে ধরেছেন নারীবিবর্তনের রূপকল্প। অপার্থিব ঐরাবতের ন্যায় মাধুরিজির মন্দ্র হণ্টন, ভুবনমেদুর গুরুমেঘভার জেব্রাদাবনা ও উল্টনো নৌকোনিতম্ব, ‘নয়নের বিজুলি-উজল আলো / যেন ঈশানকোণে ঝটিকার মতো কালো’, সত্য সকলি সত্য, ক্ষণে মেঘাচ্ছন্ন ক্ষণে রৌদ্ররণসফলতার হিল্লোল বয়ে-যাওয়া মাধুরিজির উপস্থিতি, বিজুরিরেখাজ্যামিতিক চাহনির অতলান্তিক ধাঁধা, আগুনবিভা আর পানিহিলহিলে ঢেউয়ের ঊর্মিলতা, নাচের তরঙ্গ ও স্তব্ধতা, মানবজৈবনিক গমনাগমনের সফেন সমুদ্র ধরে রাখার উচ্চাভিলাষী প্রয়াস গজগামিনী।

ইন্ডিয়্যান উওম্যানহুড জিনিশটা, ভারতীয় নারীত্ব ব্যাপারটা, আমার ঝুনা নারকেলের করোটি দিয়া বুঝবার আশায় দিয়াছি জলাঞ্জলি। থিয়োরিটিক্যালি কিংবা অ্যাম্পিরিক্যালি নয়, একেবারে খালি চোখে কমনসেন্স দিয়ে ব্যাপারটা খানিক বোঝা যায় বলেই মনে হয়। যেমন ধরা যাক য়্যুরোপিয়্যন নারীর শরীরী বিভঙ্গ ও কাঠামো আর ননয়্যুরোপিয়্যন নারীর শরীরী বিভঙ্গ ও কাঠামো আমরা তো খোলা আর খালি চোখেই ডিটেক্ট করতে পারি; তেমনি পারি ইজিপ্শিয়্যান, মেডিটের‍্যানিয়্যান, চৈনিক এবং সর্বোপরি কামরূপকামাখ্যা নারীর শরীরসংস্থানের আলাদাত্ব। তবে এইভাবে যখন বলা হয় যে ভারতীয় নারীত্ব, বলা হয় যখন গ্রিক নারীত্ব, তখন বুঝতে কেমন বাধো-বাধো ঠেকে। একইভাবে নারীত্ব ব্যাপারটাও বুঝতে একটু হলেও বেগ পেতে হয় এখনকার গোলমেলে বিদ্যাবুদ্ধি দিয়া। তা, ভারতীয় পুরুষত্ব বুঝতে পারো সম্যক? ওরেব্বাপ, তা আর বলতে! অ্যানিওয়ে। ব্যক্তিত্ব শব্দটা মানানসই হতো কি না, ভাবছিলাম। গজগামিনী দিয়া মাধুরিজি মানবসভ্যতার বিশেষ একটা ভূখণ্ডের, এতদঞ্চলের, একাংশ ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন হুসেনের নজরনিশানায় পাখা মেলে দিয়ে। এবং ম্যুভিনির্মাণকলার বিচারে এটা-ওটা ব্যর্থতার কথা বাদ দিলে মাধুরিজির মধ্য দিয়ে যেটুকু উঠিয়ে এনেছেন হুসেন, তার দরোয়াজা ব্যাপক বুলন্দ্।

হুসেনের ভিতর তখন হয়তো সক্রিয় ছিল মহাভারতীয় নারীত্বের ছবি। নিজে তিনি দীর্ঘদিন ধারাবাহিক ক্যানভাসে এঁকে গেছেন মহাভারত ও রামায়ণের চরিত্রদেরে একনাগাড়ে। এইখানে লক্ষণীয়, ভারতীয় নারীত্ব বললে এক-রকম অর্থসঙ্কীর্ণ পরিস্থিতি তৈয়ার হয়, ফের মহাভারতীয় নারীত্ব বললে পরে পরিসর যথেষ্ট প্রশস্ত হয়ে আসে। এবং ঘটনাটার পক্ষে এভিডেন্স হচ্ছে এ-ই যে, মাধুরিসিরিজের পেইন্টিংস্ যে-কয়টা আমরা দেখতে পেয়েছি টুটাফাটা, তাতে দেখেছি যে এমএফ কখনো সেখানে মেনকা হিশেবে দেখছেন মাধুরিজিকে, কখনো দ্রৌপদী, কখনো-বা সীতার আদলে দেখতে চাইছেন। পরে এক-সময় ফিদা জানিয়েছেন যে পেইন্টিং করতে যেয়েই তিনি বিষয়টা আরও বড় পরিসরে, গতি ও দুর্গতি সমেত, একটা টোট্যালিটির জায়গা থেকে দেখতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন। গজগমন শব্দটা, ধারণাটা, আমাদের অপরিচিত মনে হবার কোনো কারণ দেখি না। মাধুরিজির ভিতর দিয়ে এমএফ গোটা নারীতান্ত্রিক সভ্যতার অতীত ইতিহাস বয়ন করতে চেয়েছেন হয়তো। করেছেনও, খটোমটো হয়ে গেছে যদিও অনেক জায়গায়, হয়েছে অতিসরলীকরণের শিকার স্থানে স্থানে। সেসব তর্কাতর্কিসাপেক্ষ হলেও মাধুরিজির মহাসৌরজাগতিক উপস্থিতি সিনেমা জুড়ে সমস্ত তর্কের উর্ধ্বে এক সার্বভৌম অরণ্য ও আবহমানতার ঝিরিঝিরি মৃদুমন্দ হাওয়াহিল্লোলে ধ্যানগম্ভীর।

২০.
গজগামিনীর দুই প্রেমিক। একজনের নাম চিরন্তন, অন্যজন পার্থিব। খুবই সিগ্নিফিক্যান্ট প্রেমিকদ্বয়ের নাম, সুচিন্তিতও হয়তো, লক্ষ করব নিশ্চয়। কী হবে লক্ষ করে, আমরা তো এ-ই জেনেছি, প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সনে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না … । তা, না-পাইলে না পাক, আমাদের কার তাতে কী! নিপাত যাক জয় গোস্বামী, — কী হবে দুঃখ করে / আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে; — এবং গোল্লায় যেতে দাও শহীদ কাদরী, — বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা / মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ / কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা / ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ; পুরনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরুক তোমার স্বরে, মেয়েলি গানের স্বাদু আওয়াজে গ্রামান্তরে দেশে-বিদেশে তোমরা দু-জনে প্রেমরিংটোনে একঘরে পাও ঠাঁই, এতেই আমরা আনন্দিত, আমরা তো অল্পে খুশি…

সিনেমার দৃশ্যবিবরণে প্রকাশ, পাঁচ হাজার বছর ধরে গজগামিনীরা আবিশ্বভূমণ্ডল পরিক্রমরত; চষে চলিয়াছে স্থান এবং কাল তারা, টাইম অ্যান্ড স্পেইস্, হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছে তারা পৃথিবীর পথে — সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে, বিদর্ভ নগরে — এইসব মকবুল ফিদা আর মাধুরিজিরা। আবহমান ধ্বংস ও নির্মাণে বেফানা ব্যাকুল এরা; এই প্রেমিকেরা, প্রেমিকারা, প্রেমাপ্লুত, প্রেমাচ্ছন্ন, প্রেমপ্রত্যাখ্যাত, প্রেমান্বেষীরা; আনঋতুতে বিদায়-নেয়া আবুল হাসানেরা, — যদি সে সুগন্ধী শিশি, তবে তাকে নিয়ে যাক অন্য প্রেমিক / আতরের উষ্ণ ঘ্রাণে একটি মানুষ তবু ফিরে পাবে পুষ্পবোধ পুনঃ / কিছুক্ষণ শুভ্র এক স্নিগ্ধ গন্ধ স্বাস্থ্য ও প্রণয় দেবে তাকে; — অ্যানিওয়ে, একটি প্রেমিক খুশি হলে আনন্দিতই হব আমরা; আমাদের বিনয়, আমাদের জয়দেব বসু আর আমাদের মিরাবাঈ; আমাদের জীবনানন্দ ও বনলতারা, আমাদের গজগামিনীরা…

আমাদের এক বন্ধু, তখন সহপাঠী ছিলাম আমরা, ‘গজগামিনী’ বিগস্ক্রিনে দেখার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিল। ওই সময়টায়, যে-বছর গজ মন্দ্রগমকে হেঁটে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন ঘন নিদাঘের এই তাপিত দুনিয়ায়, সেই বন্ধুটি ইন্ডিয়া গমন করেছিল কোনো পরিজনের পারিবারিক আতিথ্য সুবাদে। এবং পয়লা সুযোগেই সিনেমাবাড়িতে যেয়ে বড়পর্দায় মাধুরিজির কোম্প্যানিধন্য হয়। ফিরে এলে সে স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোরের ভিতর দিয়া দিনাতিপাত করে অনেকদিন। ওয়াইন পানোত্তর খোঁয়ারির মতোই ছিল অনেকটা তার ঘোরাবস্থা। আড্ডায় সে ঠিকমতো কথাও বলতে পারে নাই দীর্ঘদিন। অথচ যথেষ্ট সপ্রতিভ ও স্বতঃস্ফূর্তই ছিল সে, বারোইয়ারি মজলিশি আড্ডায়, জায়ান্ট স্ক্রিনে মাধুরিজিকে দেখে সে এতই বিহ্বল ও জবানবিভ্রমে বেহাল হয়ে পড়ে। অ্যানিওয়ে। কিন্তু আমাদের তো সচিত্র গল্পটা চাই বন্ধুর মুখ থেকে সরাসরি শোনা। ব্যাটা তো ভং ধরে বেজবান হয়ে আছে। একেবারেই স্পিকটি-নট বোবা হয়ে যেত যদি, তবু মনেরে প্রবোধ দেয়া যাইত, কিন্তু আমাদের চাপাচাপিতে সে কখনো মামু কখনো-বা ভাই সম্বোধনে অসংলগ্ন কথাবার্তা বাইর করে। অ্যাই, কি দেখলি ব্যাটা, ক! জবাবে এহেন, — বুঝলি মামু, বুঝলি ব্যাটা, বুঝলি ভাই, কি কমু, বড়পর্দায় মাধুরি দিক্ষিৎ … উফ! বিগস্ক্রিন বিউটি ব্যাটা, বিগস্ক্রিন বিউটি, বুঝলি, বিগস্ক্রিন … ধুর ব্যাটা! খালি বিগস্ক্রিন বিউটি বিগস্ক্রিন বিউটি…

দীর্ঘদিন অসংলগ্ন মাম্বলিং করতে করতে এইভাবে একপ্রকারে দিন ও সন্ধ্যাগুলো বয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় দেড়-সপ্তাহ বাদে বন্ধু প্রকৃতস্থ স্বভাবে ফেরে। এবং শুনতে পাই তার মুখবাহিত বড়পর্দায় মাধুরিসন্দর্শনের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। মামুর ব্যাটার মাজাভাঙা জবান ফুঁড়ে এক-সময় কাঁসা-পিতলের ঝিলিক বেরোয় ফিনকি দিয়া; মাধুরিজির সিনেমা জায়ান্ট স্ক্রিনে না-দেখলে লাইফের সাড়ে-বারোআনাই মিছা, এই মর্মে সে যখন বেরহম দর্প প্রকাশ করে, পিত্তি জ্বলে গেলেও আমরা মানিয়াই নেই এবং খাজুল হয়ে শুনতে থাকি তার মাধুরিভ্রমণগল্প। ‘গজগামিনী’ বিশেষ একটা প্রদর্শনী ছিল কলকাতার কোনো-এক কম্যুনিটি-প্রেক্ষাকক্ষে। সে, আমাদের বন্ধুটি, তার মাসতুতো ভগ্নিপতির স্পন্সর্শিপে সেই শো উপভোগের প্রবেশপত্র হাতে নিয়া আসনে গিয়া বসে। এক-সময় ফিল্ম চলতে শুরু করে। ফের এক-সময় ফিল্ম ফিনিশও হয়ে যায়। এরপরেও, বন্ধুটির অরঞ্জিত অথবা অতিরঞ্জিত দাবি অনুসারে, অনেকক্ষণ অসাড় ও বিবশাচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে মাধুরিপ্রেজেন্স। শুধু তাকেই নয়, ক্লেইম্ করে সে, সেই সিনেমাকামরাটিও তদ্রুপ স্তব্ধপ্রায় ড্রিমাচ্ছন্ন হয়ে থেকেছিল সন্ধ্যাপারানো কলকাতাহাওয়ায়। ভিসিআরে গজগামিনীবিহারী আমরা তার গল্প শুনি এবং দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে দমের সাধনা করি।

কিন্তু অনধিক বছর-দুই মাধুরিদেশফেরত সেই বন্ধুটির মুখে কেবল একটাই গান শুনি, — এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর, হে সুন্দর / ধন্য হলো অঙ্গ মম পুণ্য হলো অন্তর / সুন্দর, হে সুন্দর … ইত্যাদি। আমরা তাকে বহুদিন যথাযোগ্য ঈর্ষায় সম্মানিত করে গেছি। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সে অচিরে, আমাদের থেকে, চিরতরে। এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে অবশ্য গজগামিনী কিংবা মাধুরিজির কোনো যোগসূত্র ঘুণাক্ষরেও নাই, কিংবা কে জানে, পৃথিবীতে এই একটাই অমোঘ অ্যালিয়েনেশন। বধূটিও ছিল পাশে, শিশুটিও, তবু তারে ধরিল কোন ভূতে, ফাল্গুনের আঁধারে, কুয়াশার শীতে …; একটা কথা প্রায়ই মনে হয় যে, গজগামিনীরা তাদের পরিক্রমায় শেষতক উপেক্ষা করে যেতে পারে কি তাদের চিরন্তন প্রেমিকদেরে?

২১.
সঞ্জয় লীলা বান্সালির ‘দেব্দাস্’ পুরাটা আজও পর্যন্ত দেখা হয় নাই, দেখা আমার পক্ষে একদম অসম্ভব-সন্নিকট, এর শতেক কারণ রয়েছে। একটা আপাতত বলি। বিতিকিচ্ছিরি রকমের কড়া আলোকোজ্জ্বলতা আর জবরজং রয়্যাল কস্টিয়্যুম ব্যবহার একেবারে বেরহম পর্যায়ের বিদঘুটে লাগে সিনেমাটা আসনপিঁড়ি বা বালিশবক্ষে দেখতে গেলেই। তিন-চারটে দৃশ্যজ অভিব্যক্তির মধুসুধা পান করে টেনেটুনে বার-কয় পেছন-সামন করে পেয়ালা-পিরিচ ছুঁড়ে ফেলে ছেড়ে পালাতে হয় স্ক্রিনভাগ। অত জমকজাঁক শরৎচন্দ্রের ভাষাদেশের মানুষের পক্ষে দেখা কালান্তরে কেন, মহাকালান্তরেও সম্ভব নয়। সেই চেষ্টা বারংবার করেও দেখেছি, নিষ্ফল চেষ্টা, ব্যর্থ হয়েছি দেখতে। দেব্দাস লীলাভার্শন দেখতে বারবার ব্যর্থ হবার একটা কারণ বলতে যেয়ে একজোড়া বলে ফেলেছি, লাইট আর কস্টিয়্যুম, তো, অধিকন্তু ন-দোষায়, আরও দুইয়েকটা যাক না-হয় বলা। তা, সেজন্যে প্যারা পার হয়ে এগোতে হবে, রাজি থাকলে চলুন।

অ্যাশ আমার কাছ থেকে অ্যাক্ট্রেসের মর্যাদা আদায় করে নেবার যত প্রচেষ্টাই করে যান-না, ফায়দা নাই, উনি মিস্ ওয়ার্ল্ড বা বেশি-থেকে-বেশি মিস্ য়্যুনিভার্স আমার কাছে। দেব্দাসে অ্যাশ বড়জোর র‍্যাম্পে ক্যাট-হণ্টন-করা ঘাঘরাকন্যে-লেহেঙ্গাবালার বেশি কিছু না। সাজুগুজু করে স্রেফ পটের বিবিটি হয়ে বেঙ্গলের দেবুদিগেরে হরণ করা যায় না। পারু ধরিত্রীশ্রেষ্ঠা বা বিশ্বশীর্ষ কোনো পোশাকি মেনেক্যুয়িন না। পারু স্বতঃস্ফূর্ত তরঙ্গিনীর উৎসার আর বহমান মগ্নচৈতন্য বিষাদের মেলবন্ধন। অ্যাশের পক্ষে এই দিকটা কাভার করা জন্মান্তরে নিশ্চয় প্যসিবল্ হবে। বেচারির দোষ নাই, বেচারি বিউটি কন্টেস্টে ট্রেইন্ড, নট ইন রিয়্যাল লাইফ, ঘটনাটা গুরুতর। আজ পর্যন্ত কথিত ওয়ার্ল্ড/য়্যুনিভার্স প্রতিযোগের কেউ দুনিয়ায় রিয়্যাল আর্ট অ্যারিনায় বিশেষ দাগকাটা কাজকাম কিছু করে যেতে পেরেছে হেন নজির নাই। মাধুরিজি জিতে যান এইখানে, ট্রেন্ডি নয় মাধুরিজিরা র‍্যাদার ট্রেন্ডস্যেটার, যুগে যুগে।

এত প্রসাধন আর ওজনদার জেওর পরে পারু হওয়া অ্যাশেরেই মানায়, এসআরকে-র উর্বর অভিনয়েই কিনা মানায় দেবুর প্রায়-শ্যাম্পেন চকচকে স্মার্ট বিরহবিচ্ছেদন্যাকামি, কিংবা নাটের গুরু ডিরেক্টরজি লীলা বান্সালিই হোতা তাবতের। ভাবা যায়, এত সপ্রতিভ দেবু যে-কিনা জাতে মাতাল তালে ফিটফাট! শরৎবাবুর গুল্লি মারো, ঐশ্বর্যা-শারুখ মিলে যে এলিগ্যান্ট মেলোড্রামা চালাইলেন তার তুলনা এলিজ্যাবেথান বা ভিক্টোরিয়্যান ইংরিজি সিনেমাতেও নাই। লীলা বান্সালি যদি রিমেইক করেন ম্যুভিটা আসন্ন কোনো জন্মে, সেদিন আমরা তারে আমাদের কবরিজির পারু ক্যারেক্টার রূপায়িত যে-দেবদাস, দেবু বুলবুল আহমেদ যেইখানে, সেইটা আগ বাড়ায়ে দেবো। তবু যদি লীলাবাবু দেবদাসের হার্মেন্যুটিক্স হজম করতে সক্ষম হন তাতে আমাদেরই মঙ্গল। ছবি দেখতে বসে কড়া লাইট আর অত্যালোকিত পরিধেয়-পরিচ্ছদের স্মেল্ নাকে এসে ধাক্কা মারলে তো সম্ভব না সার্ভাইভ করা।

তা-ও গোটা-কতেক সিন্ যে-দেখেছি, পেরেছি দেখতে, সে-ও ওই মাধুরিজির কল্যাণে। চন্দ্রমুখীর কল্যাণে। ভাগ্যিস, চরিত্রটা চন্দ্রমুখীর! অল্প কলেবরের, যদিও শক্তিমত্তায় দেবু-পারু টপকে যাওয়া হাজারবার না-হলেও কয়েকবার তো বটেই, ফলে বেশিক্ষণ অ্যাশ-এসআরকেজনিত জুলুম সইতে হয় নাই। রিওয়াইন্ড-ফরোয়ার্ড করে মাধুরিজির অংশটুকু সুস্থভাবে সুস্থিরে দেখে পাশ ফিরায়ে ক্যারমঘুঁটি পকেটে ফেলায় ধীশক্তি বিনিয়োগ করা যায়। অ্যানিওয়ে। আমি চিন্তা করছিলাম, মিস্ ওয়ার্ল্ড/য়্যুনিভার্স অথোরিটি এইসব কথা শুনলে পরে নতুন সিন্থেটিক অ্যাশ তৈয়ারের বছরমেয়াদী গ্যাল্যা-ইভেন্ট আয়োজনে ঢিল দিয়ে দেবে কি না, মাধুরিজি তো ওই কৃত্রিম কলের কারখানাবিকশিত ব্যক্তি না। আফটার অল্, কথিত ‘সুন্দরী প্রতিযোগ’ তো মহাইন্ডাস্ট্রি পৃথিবীজোড়া, গ্লোব্যাল কর্পোর‍্যাট ক্যাপিট্যল্ মোবিলাইজ্ করার ফুক্টে ফড়িয়াগিরি, তাছাড়া নতুন অ্যাশ প্রোডিউস্ করার পাইপলাইনে এহেন অন্তরায় দুনিয়াবাসী সইবে কেন! হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো!

কথা মাধুরিজি নিয়েই। কথা চন্দ্রমুখী নিয়ে। এসআরকে নেভার, অ্যাশ নেভার এভার, র‍্যাদার চুনীলাল ব্যেটার। সঞ্জয় লীলা বান্সালি পরজনমে এসে রিয়্যাল রাধা আর বনমালী চিনিতে ব্যর্থ হইলে আমাদের কপালে রিমোট ঘনঘন টানাটুনির খরাবি অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক জেনারেশন তাদের প্রেমের মাপেই পেয়ে যায় রাধা, পায় শ্যাম, মাধুরিজি ইমোশ্যন্যালি রিজেনারেইট করে, হ্যাপিলি থেকে যায় হৃদয়ে এভার-আফটার।

২২.
‘গজগামিনী’ নয়, মাধুরিজির কথা ভাবলেই ‘দিল্’ মনে পড়ে। এর সঙ্গে ম্যুভিক্রিটিসিজমের হারাম কোনো যোগবিয়োগ নাই, নিছক ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ অধ্যায় সেলিব্রেইট করার ব্যাপার জড়িত। অন্যান্য সব ব্যাপারেই কথাটা খাটানো যাবে যে, আমরা আসলে নৈর্ব্যক্তিকতার নামে একটা আজদহা ভান করে চলি জিন্দেগিভর; অবশ্য, ব্যক্তিকতা আরেকটা ভান বৈ কিছু তো নয়। এই বিপদটা আছে যে, থেকেই যায় সবসময়, ব্যক্ত কথা মাত্রেই ইন-অ্যা-সেন্স ভান। কোথায় যাবেন তাহলে? যেতে হবে না, থাকতে হবে এখানেই, দিস্ ইজ্ ইট, দিস্ ইজ্ রিয়্যালিটি, দিস্ ইজ্ লাইফ উইথ অ্যান্ড/অর উয়িদাউট আর্টকালচার। আর ভান ইজ্ নট ন্যেসেসারিলি খারাপ কিছু। অপরূপ কথার জগতে, যে-জগৎ তৈরিই হয়েছে সহসা শব্দের সন্ত্রাসে, ওঙ্কার ধ্বনির পরম ব্রহ্মত্ব বলুন বা ‘কুন ফা-ইয়া কুন’, বিগ ব্যাং প্রভৃতি বিস্তরকিছু সশব্দ দুনিয়াভানের তত্ত্ব সমর্থন করছে। কাজেই ভান ইজ্ প্রাইমারি পত্তনিস্থল এবং অ্যাট দ্য সেইম্ টাইম আল্টিমেইট ডেস্টিনেশন। সো-ফার মনে হয় মিথ্যে নয় এই কথাগুলো। কথাটা হচ্ছে গিয়ে এ-ই যে প্রিটেনশ্যাস্ হতে যেয়ে একটা মানুষ তার কথায়/লেখায় টেনশন ও প্যাশন প্রভৃতি কীভাবে এবং কতটা অ্যাম্যালগেমেইট করছে, সেই মিশ্রণেই তার আপন ভুবন গড়ে ওঠে। লেখার ভিতরে বিশেষ করে ‘নিছক ভান’ আর ‘আভিপ্রায়িক ভান’ দুয়ের মধ্যকার দ্বৈরথটা থাকতে হয় চক্ষুগোচর বা অন্তর্লীন। না-থাকলেই কী এমন ক্ষতি, ইত্যাকার চেইন-রিয়্যাকশনে না যাই এখন।

সময়টা আমাদের অরুণ-বরুণ বেড়ে ওঠার, আমাদের রাঙা কৈশোর, আমাদের আতাগাছে তোতাপাখি আর ডালিমগাছে মৌ দেখার তারুণ্য। বৌ কন্সেপ্ট তখনও আবছা, আরও পরে যেয়ে এইটা অ্যাকাডেমিক অ্যারেনায় ইনক্লুড হবে। তেল-নুন-হলুদ-মরিচের নিত্যপ্রয়োজনীয়তায়, ঠাকুরকথাটা ইয়াদ করুন ‘শেষের কবিতা’-য়, জীর্ণধ্বস্ত ও জেরবার হব অনেক পরে যেয়ে। তখনও অকারণ ‘মুঝে নিন্দ না আয়ে’, তখনও ‘হ্যায় ম্যেরি হামসফর ইক জারা ইন্তেজার’, তখন মগন-গহন ‘দিল্’ এবং ‘কিয়ামত স্যে কিয়ামত তক’ দিনরাতদুপুরসন্ধ্যা আতপ্ত অথচ উড্ডীন। পরে একগোছা ছায়াছবি এসে বেবাক লুটপাট হয়ে যাবে, ভেসে যাবে ভেলা ও যৌবনমান্দাস, ভেসে যাবে আদরের নৌকা আর জাহাজগুলো নবদ্বীপে, বগুড়ায়, নাটোরে, ক্যানাডা আর ক্যালিফোর্নিয়ায়। ‘যা গেছে তা যাক’, সলিল চৌধুরীর গান, মাধুরিজি চিরবহমান।

অবশ্য অনতিবিলম্বে এসে-যাওয়া ‘সাজন্’ ম্যুভিতেও মাধুরিজি সিডাক্টিভিটি নিয়া হাজির। যদিও ওই ম্যুভিতে সঞ্জুর এক্সট্রা দেবদাসমার্কা হাজিরানা তখনও উদ্ভট বিরক্তিকর লেগেছিল যেমনটা আজও তথৈবচ। সল্লু বরং লাইফফ্যুল ছিল ওইখানে। তখনও সল্লুর শইলদেখানোর ব্যামো সমবেত হাসাহাসির খোরাক হয়ে ওঠে নাই। হি ওয়্যজ ডুয়িং গ্যুড, দ্যাট টাইম, পরের দিকে যেয়ে সল্লু কসাইদের কাছে মার্কেটভ্যালু তৈয়ার করতে নিজের খাসিগোস্ত আর পাঁঠাহাড্ডি এক্সিবিট করার দিকেই স্থির করেন মন। তো, ‘সাজন্’ ম্যুভির গান না-গেয়ে ওই সময়টায় কেউ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে নাই। ইন-ফ্যাক্ট পরীক্ষার পূর্বপক্ষে, শুক্ল হোক বা কৃষ্ণ, বাড়ি থেকে ভেগে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহে বসে-থাকা ক্যান্ডিডেট ধরে এনে পেটানো তখনকার বাবাদের বিশেষত্ব।

পরে এসে যাবে ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, অবশ্য অনেক পরে, এবং মাধুরিজি পৃথিবীর নদী ও সমুদ্রে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি শিপ্ রেক্, আর্থকোয়েইক্, পর্বতপাদদেশে দাবানল প্রভৃতি ঘটাবেন সেই সিনেমায়। মেরুপ্রদেশরাজ্যে স্লেজকার্টগুলো সংঘর্ষের অব্যবহিত প্রভাবে বেশকিছু অভিযাত্রী-ক্যারাভ্যান বাধ্য হয় বেসময়ে নকটার্নাল্ টেন্ট ফেলতে তাদের অভিযানপথিমধ্যে। এবং আমরা তখন দিনে সাঁইত্রিশবার ‘হায় রাম, কলি-কা জামানা’ গানটা গাইছিলাম, যদিও গানটা নারীকণ্ঠের এবং নারীবিষয়জীব্য লিরিক্সের, দিদিরাও গাইতেন আমাদের, এবং মাধুরিজি নিয়া প্রকাশ্য মঞ্চে প্রশংসা করবার সাহস ও সংস্কৃতি কিছুই ছিল না তখন।

‘গজগামিনী’ নিশ্চয় উল্লেখযোগ্য, অনেক কারণে এর উল্লেখ করিও, তবে ‘দেড়-ইশকিয়া’ মাধুরিজির নতুন কবিতা। মানে, কেউ কেউ বলেন যেমন ‘সশস্ত্র কবিতা’, তা, পদ্মলোচন নামটা আমার ভারি মিষ্টি লাগে, অ্যানিওয়ে। লেকিন ‘দেড়-ইশকিয়া’ মাধুরিজিকে তার নিজের ফিউচার-অ্যাক্টিং সম্পর্কে একটা নেভিগেইটিং ম্যাপ দিতে পেরেছে মনে হয়। এখন, কথা হচ্ছে, সেই-রকমের স্ক্রিপ্ট তো হতে হবে। এবং মাধুরিজিকে বলি, কবিতা হলেই হলো মাদাম, নতুন-পুরাতন নিয়া ক্যাওয়াস্ নাইবা করিনু। অভিনয়ে বসতি সমুজদার, চেহারা প্যে নেহি।

২৩.
বলিউডি ফিল্মগুলো সবসময় অ্যাভার‍্যাজ্ একটা ব্যবসা ঠিকই করে, কিন্তু বক্স-অফিসের মুনাফা মেইকিং গ্রাফটা আলাদা আলোচ্য। ওদের প্রোফিট মার্জিন এবং ওদের লাভক্ষতির ইন্ডিকেইটর আমাদের পক্ষে হার্ড-টু-রিচ হাই। ওইদিকটায় বিএফডিসিল্যান্ডের লোকলস্কর আমরা নাইবা গেলুম। তবে যেইটা ইন্ট্রেস্টিং এবং দেখে শেখার ব্যাপার, তা এ-ই যে, সেখানকার ম্যুভিজ্ ইনসাইড ইন্ডিয়া অ্যাভার‍্যাজ্/ফ্লপ্ হলেও ওভার্সিজ্ ব্যবসাটা দিয়া মাশুল সামাল দিয়া লাভের গুড় বোয়েমে তোলা যায়। আর আমাদের? ওভার্সিজ্? দূর দিল্লি … ইন-হাউজ্ মুর্গি ফড়ফড়ায়, ডিম তো দিবাস্বপ্ন, আবার বলে বিদেশব্যবসা তথা হাতির দুগ্ধ! ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়’, ঠাকুরকথা খাসা, হায়!

যেমনটা আগেও বলা গিয়েছিল বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে যে মাধুরিজির মেগাহিটের আশেপাশে মেগাফ্লপেরও স্তূপ, তবু ম্যুভিগুলো রাফলি বিজনেস্ করে ফেলতে পেরেছে যে এর পেছনে মাধুরিজিই একমাত্র তরণী না, ফ্যাক্টর রয়েছে বেশকিছু। ওরা অ্যামেচারিশ কিসিমে ম্যুভি বানিয়েই তো খালাস হয়ে যায় না, কারবার তথা ব্যবসাপাতিটা জানে এবং করে, বিপণন ওরা জানে এবং করে। আমরা নাগিন ছবি বানাই, কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করি, বাঁশি বাজাই, ইন দ্য লং রান সরকার-বাহাদুরের অনুদানের অপেক্ষা করি এবং ম্যুভিশিল্প প্রসারের প্রধান অন্তরায় রাষ্ট্রীয় অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকের অত্যল্পতা বলিয়া সাব্যস্ত করে ঝিমাই। টিভিসি বানায়ে যৌবন পানি করি। বিজনেস্ করে কে হায় শিল্পকলা বাঁচাইতে চায়! আমাদের দরকার সার ও সিডের ভর্তুকি জীবনভর। ঠিক হ্যায়। য়্যু ম্যে স্যে আ’য়াম অ্যা সিনিক্, বাট আ’য়াম নট দি ওনলি ওয়ান…

মধ্যপ্রাচ্যে এবং দুনিয়ার অন্য গোলার্ধসমূহে, এশিয়া আর বাংলাদেশগ্রামের কথা তো কল্পনা বাহুল্য, মাধুরিজি এবং গংদের ম্যুভি অ্যায়সা বাণিজ্য করে যা না-বললেও হয়। এইটা আমরা খালিচোখে, ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস্ ছাড়াই দিব্যি, দেখতে পাই। ‘হাম আপ্কে হ্যায় কৌন’ খোদ ইন্ডিয়ায় যে-ব্যবসা করেছে, সেই হিসাবখাতা জানলেও মনে নাই, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে এবং য়্যুরোপে অ্যায়সা ব্যবসা করেছিল যে সেইটা রীতিমতো সংবাদবস্তু হয়েছিল তখন বিবিসি-সিএনএন ইত্যাদিতে। এরপর থেকে হেন ম্যুভি নাই যেইটা আদার-পার্ট অফ দি ওয়ার্ল্ডে একটা আন্দাজমতো প্রোফিট করে নাই। ইদানীং এগুলো খবরেরও মর্যাদা পায় না, কারণ ব্যবসাটাই ন্যাচার‍্যাল তাদের কাছে, নট ভুয়া নামডাকের বেগড়বাই। তিফিল বাচ্চাও যদি সিনেমা বানায় সেখানে, সেইটা ছায়াছবিভাষায় ইনকারেক্ট হোক বা কারেক্ট, ব্যবসাটা আসবেই।

সেইসঙ্গে এখনকার দিনে ব্যবসার দিগন্ত অতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, অ্যাপ্সযুগের এই টাইম এবং স্পেইসে, যেখানেই যা রাখবেন সেখানেই ক্লিক এবং কাউন্টিং ডাউন। শুধু প্রোফেশ্ন্যালি নিতে হবে ব্যাপারটাকে, হতে হবে স্ট্র্যাটেজিক্যালি প্রোফাউন্ড, এবং সো-ফার ট্যাক্নিক্যালিটি নিয়া সাউন্ড হতে হবে। এবং মার্কেট-ওরিয়েন্টেড কমার্সটা আয়ত্তে রাখা চাই। এইসব জায়গায় একদার হংকং-চায়না, আশি ডিকেডের আগুপিছু সময়টায়, ফাইন্যালি হলিউড যদি ইন্ডিয়ার কাছে হেরে যেতে পারে, একদিন আমরাও তো পারব, এমনটা বলা আজকের দিনে দিবাস্বপ্ন বা নিশার স্বপন কোনোটাই না। নাদের আলিকে ছাড়া আর কারেই-বা সুনীলের পড়শিবাড়ির মানুষ বলবে যে, — দেখো হে, একদিন আমরাও…

‘গোলাব গ্যাং’ এবং এর আগের ‘দেড়-ইশকিয়া’ মাধুরিজির কামব্যাক দেখায়েছে, কতটা ব্যবসা হাতে এসেছে সেইটাও প্রকাশিত, এখানে আমরা মাধুরিজির প্রত্যাবর্তনেই হ্যাপি হয়েছি। ঠিক যেমন এসবের বছর-চার আগে ‘আ যা নাচলে’ প্রেজেন্টেড মাধুরিজি দেখেও অনেকটা সান্ত্বনা পেয়েছিলাম। তবে এগুলো সকলে-যে ইক্যুয়্যাল ব্যবসা করেছে, এমন না। ব্যবসাগ্রাফ সেইটা তো বলে না। আগামীদিনের মাধুরিজি নির্মিত হবেন পরিচালকযত্নে, যেমনটা আজকের অমিতাভ বচ্চন। আশারশ্মি নিশ্চয় দেখা যায়। ঈশাণে, অগ্নিতে, নৈঋতে…

২৪.
পরিতাপের কি না ব্যাপারটা তা বলতে না-পারলেও এইটা বাস্তবতা যে এত ভালো কত্থকদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও মাধুরিজি নিজের শিল্পচৈতন্য ও সুষমার বিনিয়োগ গলদ জায়গায় লগ্নি করে গেলেন আগাগোড়া। অ্যাক্টিং স্কিলের জন্য যতটা না, তারচে বেশি তিনি যা আজকে হয়েছেন তা নাচের জন্যই। ইনডিড, মাধুরিজি যাহা হইলেন তাহা নিয়াই তুষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়, যাহা হইতে পারতেন কিংবা যাহা যাহা হইবেন ভবিষ্যতে, সেই সম্ভাবনা তো অ্যালাইভ মনুষ্য মাত্রেরই থাকে, সেসব নিয়া আলাপ ওঠানো অজরুরি। কিন্তু মনে তবু হয় থেকে-থেকে যে তিনি কীই-না হইতে পারতেন যদি শুধু ও শুদ্ধ নৃত্যধর্মে নিয়োজিত ও নিবেদিতপ্রাণ রইতেন! কত্থকে ডেভ্যোটেড থাকলে পরে ড্যান্স ফর্মে ওয়ার্ল্ডোয়াইড ফেইম তো অবধারিত জুটত, হয়তো সর্বজনের সনে এই আজকের ন্যায় দিল্-কা-রিশ্তা গড়িয়া উঠিত না; বাট রেকোগ্নিশন তো জুটতই, এবং বলা যায় না, ব্যাপারটা আন্দাজ করা ইজি যে, নাচে সর্বভারতীয় এবং টুটাফাটা ভারতবহিরস্থিত গোটা দুনিয়া জুড়ে মাধুরিজির বদৌলতে নৃত্যের শাস্ত্র ও প্রথাগত বোলচাল মোহর-মুদ্রা যাইত বদলে। যেতেও তো পারত, ওই হিম্মৎ উনার ছিল, ওই মুরদও উনার রয়েছে এইটা আমরা ফাঁকফোকে চাক্ষুষও করেছি। কিন্তু উনি হয়েছেন মশলারাজ্যের রাজ্ঞী, সুষমারাজ্যের সম্রাজ্ঞী তিনি হন নাই কিংবা চান নাই হতে। অ্যানিওয়ে। তাতে যেটুক ক্ষতি হয়েছে সেটুক পুষিয়েও দিয়েছেন অন্যান্যভাবে।

এখন পরিতাপ যদি করতেই হয় তো এই কারণে যে, যাকে জগৎ কত্থককন্যা নামে একডাকে চেনার কথা ছিল, তাকে চেনে ধকধককন্যা নামে। এইখানে কেউ মনে করেন যদি যে এতে তেমন ক্ষয়ক্ষতি কিছু তো হয় নাই, সেইটা যেমন হ্যাঁ, তেমনি কেউ মনে করেন যদি যে হ্যাঁ ক্ষতি বিস্তর হয়েছে এবং অনপনোদনেয়, সেইটাও সমান হ্যাঁ। কিন্তু যত যা-কিছুই বলুন-না মশাই, ‘ধকধকগার্ল’ ইনস্টেড অফ ‘কত্থকগার্ল’ ইজ্ সামথিং সিক্সহান্ড্রেড মাইলস অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য মন্যুমেন্ট অফ ইটার্ন্যাল্ বিউটি অ্যান্ড অ্যাস্থেটিক্স। তবে এইটাও বলা বাঞ্ছনীয় যে এইসব কম্যার্শিয়্যাল কোরিয়োগ্র্যাফিগুলোতেও মুরদ-ও-হিম্মৎওয়ালা মাধুরিজির নমুনা নাগালের বাইরে থাকে না। আলবৎ বোঝা যায় তিনি, দি মাধুরিজি, কীই-না পারতেন হইবারে! স্রেফ ‘ধক ধক করনে লাগা’ টাইপ দিয়া মাধুরিজি বিচারিও না জানেমন, ওই নৃত্যদিভ্যার মুজরো তরিকার প্রদর্শনীগুলো গূঢ় নয়নে, শরিফ নয়নে, হেরিয়া যাও তো বুঝবে উনি কি এবং উনি কি-নন। ধরা যাক, দু-একটা ইঁদুর এক্ষুণি না ধরে বরং দুইয়েকটা নাচস্মৃতি, সর্বশেষ ‘দেড়-ইশকিয়া’ মাতানো ‘হামারি আতারিয়া প্যে আ যা রে সাবারিয়া’ গানটা তথা মাধুরিজির বৈঠকি নৃত্যটা, বা সেথাকার কত্থকী নৃত্যহর্ষভৈরব। গোটা সিনেমায় তিন-চারটে এমন চূর্ণদৃশ্য রয়েছে যেখানে এহেন মনে হয় যে কত্থকপক্ষী তিনি হইলেও হইতে পারতেন। যদিও ধকধকদ্বীপের দেশগাও বলিউডে তিনি যা হয়েছেন তার অন্যথা হওয়া ডিফিকাল্ট ছিল বৈকি। স্ক্রিপ্ট তো ধকধকের, তো ‘স্যোয়্যান লেইক্’ ব্যালে অপেরা আপনে ক্যাম্নে হইবেন!

বরং ‘গজগামিনী’-তে ব্যাপারটা ভালো ও খোলতাই গিয়াছিল বোঝা। মাধুরিজি ফিদার ক্যানভাসে ব্যাকড্রপ ও ফ্রন্টড্যোর ব্যেপে নেচে বেড়িয়েছেন না-বলে ভালো হয় যদি বলি যে উড়ে উড়ে বেড়িয়েছেন মকবুল ফিদা হুসেনের ক্যানভাসাকাশে। একজন শিল্পীর কদর আরেকজন শিল্পীই করেছে, অন্য মাধ্যমের হয়তো, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে। এবং শিল্পীর কদর মানে তো ব্যক্তিশিল্পীটিকে তেলানো বা তোয়াজ নয়, শিল্পেরই কদর, শিল্পীর সারবত্তা আবিষ্কার ও অবিনশ্বর শিল্পভুবনে সেই বিশেষ ক্ষণজন্মা ব্যক্তিশিল্পীটির থ্রু দিয়া আবহমান শিল্পের প্রকাশ ও নবতর প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত। ব্যাপারটা অ্যাজ্ সিম্পল্ অ্যাজ্ উই এক্সপ্রেসড। তবে এটুকু কর্তব্য যে-ইন্ডাস্ট্রি করতে ব্যর্থ হয় সেই ইন্ডাস্ট্রি সিক্ ডিক্লেয়ার করা আশু উচিৎ কি না ভাবতে হবে ভ্যেরি স্যুন্। মুশকিল হলো, পয়সা। হ্যাঁ, টাকাবাহাদুর বা রুপাইয়াকুমারী শিল্প বলুন সাহিত্য বলুন সংগীত ও অন্য সমস্ত ললিত কলা বা কাঁঠাল বাজারদরে বেচে। সেহেতু বিবেচ্য বণিকের বাৎলানো পথঘাট। রফা তাই করে নিতেই হয়।

কিন্তু মোটামুটি শ্লীল-অশ্লীল যুগ্মবৈপরীত্যের বাইরে থেকে দেখতে পারলে দেখবেন যে মাধুরিজির প্রত্যেকটা ছায়াছবিতেই কিছু-না-কিছু মুদ্রা আছে আপনি পাবেন যেখানে একবার থমকে যেতে হবে এবং ভাবতে হবে যে এই বিদূষী বিলকুল প্রথানুগত কত্থকব্যাকরণ গুবলেট করে ক্যাপাব্যল্ অফ ডুয়িং সামথিং ইনকন্সিভ্যাব্যল্ … ওয়্যজ্ ক্যাপাব্যল্ অফ, অ্যাট-লিস্ট, সন্দেহাতীতভাবেই, মনে হবে। এক্সামপ্ল্যারি ড্যান্সার বলতে তো মাধুরিজিই দ্য ওয়ান অ্যান্ড দ্য ওনলি টিল্ ডেইট। ধানাইপানাই বাদ দিয়া কথাটা আপনি বলেই দিলেন মনে করেন; বলেছেন ভালো করেছেন, কে ঠেকাতে আসবে আপনেরে! অ্যানিওয়ে। এইটা, বিলিভ মি, আদৌ অসত্য না।

যা-ই হোক। খালি যে-কয়টা নামোল্লেখ করা হলো ওইগুলোই একমাত্র মনে করলে জিভ কাটুন লজ্জায়। হ্যাঁ, ধামাকা নাচের তো সরহদ্দি-সীমাসংখ্যা নাই, মাধুরিজির ভালো ও রসোত্তীর্ণ নৃত্যের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য সর্বাপেক্ষা শীর্ষস্থানীয়। সংখ্যায় এবং গুণমান উভয়ত। শেষের দিক থেকে এগোলে মনে পড়াতে সুবিধে হবে। ‘দেব্দাস্’ মনে করে দেখুন। ‘মার ডালা’, দেব্দাসে, মার্ডারাস্ নাচ যাকে বাংরেজি ভাষায় নির্দ্বন্দ্ব বলা যায়। তারপরের ‘আ যা নাচ লে’ ম্যুভির নামগানখানায় ম্যাজিক মাধুরিজির, ভোলা যায়! রিসেন্ট সেই ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ম্যুভিতে ‘ঘাঘরা’, বাব্বা! ‘হামকো আজ কাল হ্যায়’ নাচের ‘সয়লাব’, ‘লজ্জা’-য় ‘বড়ি মুশকিল্’, ‘আঞ্জাম্’ ম্যুভিতে ‘চ্যেনে ক্যে খাত ম্যে’, ‘ম্যেরা পিয়া ঘ্যর আয়া’ নাচের সেই ‘ইয়ারানা’, ‘রামলখন’ ম্যুভির ‘ব্যড়া দুখ দিনা’ … তা, আর কত বলি, ভাই, বরং ক্ষ্যামা দেই। তা-ই সই। স্যি য়্যু স্যুন্, স্টে ড্যান্সিং…! ড্যান্স উইথ মাধুরি…

২৫.
২০১৩ সালে এসে ড্যান্স অ্যাকাডেমির পত্তন করেন মাধুরিজি, নিজের নামে, ‘ড্যান্স উইথ মাধুরি’ শিরোনামে সেই নৃত্যকলানুশীলনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা আস্তে আস্তে বেশ মশহুর হয়ে উঠেছে। এইটা কাজ করে প্রধানত ওয়েবক্ষেত্র ধরে; নৃত্যানুরাগীরা শারীরিকভাবে প্রেজেন্স না-রেখেও ওয়েবসাইটে রেগ্যুলার লগইনের মাধ্যমে লেস্যনগুলো সাবস্ক্রাইব্ করতে পারেন। ওয়েবক্ষেত্রিক এই নৃত্যশিক্ষাকার্যক্রম দুনিয়ার দুইশটা কান্ট্রিতে অ্যাভ্যেইলেব্যল্। রয়েছে এর প্রায় দ্বিলক্ষাধিক ফ্রিক্যুয়েন্ট লার্নার। মাধুরিজি নিজে এই নৃত্যচর্চালয়টার সার্বক্ষণিক অধ্যক্ষ। যুক্ত রয়েছেন অন্যান্য নৃত্যগুরুদের মধ্যে রেমো ডি-স্যুজা, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, সরোজ খান প্রমুখ। শেষোক্ত সরোজ খানের হাত ধরেই বলতে গেলে বলিউডে মাধুরিজির নৃত্যপাখার বিস্তার ও অধিষ্ঠান। পরবর্তী পর্যায়ে পণ্ডিতজির প্রায় শিষ্যত্বই নিতে দেখি মাধুরিজিকে। রেমোর পরিচালনাতেও অনেক হিট নাম্বারের কোরিয়োগ্র্যাফি আমরা দেখেছি মাধুরিনৃত্যের। মোদ্দা কথা, মাধুরিজিকে ঘুরেফিরে এই তিনজনের কোরিয়োগ্র্যাফিতেই উড়তে দেখেছি চিরকাল। ফলে এই তিনটা নামই বালবুড়োবনিতা আমাদের সকলের নিকট সুপরিচিত।

সুপরিচিতির কথা থাক। তথ্য ছড়ানো দরকার কিছু। এইবেলা তা করে সারা যাক। মাধুরিজির এই ড্যান্স অ্যাকাডেমির কারিক্যুলামে সব-ধরনের নাচেরই শিখন-শিক্ষণব্যবস্থা থাকলেও ঘুরেফিরে মাধুরিজির অলটাইম হিট সেগ্মেন্টগুলোই শিখতে চায় বেশিরভাগ শিষ্যভক্তছাত্তরেরা। স্বাভাবিকই ব্যাপারটা। যার ফলে মাধুরিজির ফ্যুলটাইম ইনভোল্ভমেন্ট রাখতে হচ্ছে এখানে। এমনিতে এর সঙ্গে, এই নৃত্যপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, মাধুরিজির বেটারহাফ মিস্টার শ্রিরাম নেনেও জড়িত। ব্যবসার গ্রাফটাও উপরের দিকেই উঠছে রোজ। নেনেবাবু প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটিগুলো সামাল দেন, মাধুরিজি দেখেন ওভারঅল ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যাকাডেমিক দিকটা।

“মাধুরিজি হলেন”, সরোজ খানের সরলসহজ দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তি, “কোরিয়োগ্র্যাফার্-স্ ডিলাইট”; কত্থক থেকে ধকধক, যে-ফর্মেই ইম্যাজিন্ করবেন আপনি সৃজনস্বপ্নে-বিভোর আপনার কম্পোজিশনটা, মাধুরিজিকে পেলেই কেবল প্রত্যাশামাত্রার অনেক-অনেক উপর দিয়ে যেয়ে সেইটা ডানা মেলে স্বয়ং কম্পোজারকেই স্পেলবাউন্ড করে ফেলতে পারে। এই কথাটা সরোজ খান না-বললেও কথান্তর্নিহিত কথাটা তা-ই ছিল। বহুদিন বাদে একসঙ্গে কাজ করতে যেয়ে, ‘গোলাব্ গ্যাং’ পর্যায়ে, সরোজবাবু মাধুরিকীর্তনে মেতেছিলেন মিডিয়ায়। একসময়, মাধুরিজির আর্লি হিটগুলো, মাধুরিজি এককভাবে সরোজ খানের কোরিয়োগ্র্যাফিতেই কাজ করতেন। পরে পণ্ডিত বিরজু মহারাজ হলেন মাধুরিনৃত্যের কোরিয়োগ্র্যাফার। মাধুরিজির বিরতিদিনের শেষে ‘দেব্দাস্’ পর্যায়ে এসে পণ্ডিতজি তার সৃষ্টিকল্পনার বাস্তব-রূপায়ক মাধুরিজির ব্যাপারে মন্তব্য করতে যেয়ে যা বলেন, ইন-শর্ট তা এই-রকম : “দ্য বেস্ট বলিউড ড্যান্সার ডিয়্যু টু হার ভার্স্যাটিলিটি”; মিনিম্যাল স্টেইটমেন্ট এইটা, বলা যায়, মাধুরিজির ব্যাপারে।

রেফ্রেন্স হিশেবে, মাধুরিজির প্রসঙ্গে, গ্রেইট তিন পূর্বসূরির নাম টানা হয়ে থাকে; এই তিন হলেন একে একে মধুবালা, মিনাকুমারি এবং নার্গিস। ওই তিনজন ছিলেন তাদের যুগে, ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট বলিউডে, বেস্ট এবং মোস্ট প্যপ্যুলার অ্যাক্ট্রেসেস্। নব্বইয়ের মধুবালা নামেও মাধুরিজিকে প্রেসওয়ালারা প্রায়শ সম্বোধন করত তাদের প্রচ্ছদে, প্রশংসায়, প্রতিবেদনে। যেমনটা, মনে পড়বে, মাধুরিপ্রভাবে দিশাহারা মকবুল ফিদা হুসেন প্রশংসা করতে যেয়ে বলেছিলেন মেরিলিন ম্যুনরোর চেয়েও মাধুরিজি ট্যালেন্টেড অ্যাজ্ অ্যান্ আর্টিস্ট। প্রশংসা বড় কথা নয়, বড় কথা প্রেম, বড় কথা প্যাশন্। আইজ্ঞা।

ক্ল্যাসিক বিউটি বলতে একটা জিনিশ আছে নিশ্চয় যা আমরা ঠিক বোঝাতে না-পারলেও বুঝি বলেই মনে হয়। মাধুরিজি ঠিক তা-ই। মিনাকুমারি, মধুবালা তো অবশ্যই, এবং নার্গিসজিও। ধ্রুপদী সৌন্দর্য বোঝানো একেবারেই যাবে না এমনও নয়, অধ্যাপকীয় প্রভাষণায় ঘ্যাঁৎঘোঁৎ না-করেও কথা মাইলটাক চালানো যায়, কিন্তু আমতা-আমতা বাগ্মিতার চেয়ে একটা বা আধখানা স্যলিড উদাহরণ শ্রেয় বলে মনে করেন যারা, তাদেরে বলি যে, আগুন সম্পর্কে লেকচার না-ফেঁদে একটা ম্যাচবাকশো থেকে দেশ্লাইশলাকা বার করুন, তারপর ফস্ করে জ্বালিয়ে দেখান যে এ-ই হয় আগুন, ইহা হয় দি প্রিমিটিভ অ্যান্ড দি হাইয়েস্ট ফর্ম অফ ক্ল্যাসিক বিউটি।

২৬.
শি’জ্ স্টিল ক্যাপ্যাব্যল অফ কিপিং অ্যান অডিয়েন্স গ্লুড টু দ্যেয়ার সিটস্ হোয়েন দ্য ক্রেডিটস্ স্টার্ট রোলিং, অল বিকজ্ শি’জ্ ড্যান্সিং অন স্ক্রিন। কথাগুলো মনে হবে আপনারও, যদি আপনি মাধুরিজির সাক্সেসফ্যুল কামব্যাক ‘দেড়-ইশকিয়া’ দেখতে বসেন। অবশ্য ম্যুভিটা কাহিনিচিত্রণ ও ম্যুভিনির্মাণশৈলী, মিউজিক ও মন্তাজ্, ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়েই ভালো। অল্প কয়েকটা অ্যাক্টর নিয়া গোটা ম্যুভি জুড়ে যে-জঙ্গম, মনে রাখার মতো। মুঘল মিনিয়েচারের ফর্ম যেন, মনে হয় দেখতে দেখতে, গোটা ম্যুভিটা। আর ম্যুভির শুরু থেকে শেষ জুড়ে এমন একটা পেইস্, এমন একটা রিদমিক্ স্পিড, মনে হয় যেন ম্যাক্সিক্যান ম্যুভির ওয়েইভ-ফ্রিকোয়েন্সি দিয়া মুঘল নবাবি বোলচালের গল্পছবি ফোটানো হতেছে।

এইটা তো মানবেন যে, অ্যানি রোল্ গিভেন্ টু মাধুরিজি, যে-ক্যারেক্টারেই কাস্ট করুন তাকে, ক্যাপ্যাব্যল্ কোয়ায়েট্ টু ক্যারি ইট উইথ সহজিয়ানা, সাবলীলতা অ্যান্ড গ্রেইস্। ইভেন্ ডেস্পাইট দি মিস্ম্যাচ্ অফ অ্যাইজ্, শি ডাজ্ জাস্টিস্ টু হার রোল্। পরিচালনা আর গল্পবয়নগত ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে ‘গোলাব গ্যাং’ উৎরাতে না-পারলেও এইটা আলবৎ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে প্রোফিট-ওরিয়েন্টেড ম্যুভির জন্য এসেনশিয়্যাল বায়ান্নটা তাসের প্রধান সব-কয়টা তাস এখনও মাধুরিজির হাতে। এবং তিনি তাসের আসরে ক্যাওয়াস্ না-হলে এখনও তুলতে পারেন গোটা দান নিজের করপুটে।

শি’জ্ ম্যাজিক্যাল্ ইন দি ড্যান্স সিকোয়েন্সেস্, অল-রাইট, বাট ইভেন্ মোর্ অ্যামেইজিং ইন্ দি ডায়ালগ সিকোয়েন্সেস্। বাচিক অভিনয়ে, ইন-ফ্যাক্ট, একজন অভিনয়শিল্পীর বাঁচামরার ভোমরাটা থাকে। এইখানে মাধুরিজি লা-জোয়াব্। ভুলে যান সংলাপ-প্রক্ষেপণে এন্তার মাধুরিবিকীর্ণ ম্যুভি, ভুলে যান ‘পুকার’ ম্যুভিতে সেই জটিল ক্যারেক্টারে স্বরপ্রক্ষেপ ও অভিব্যক্তি পরিস্ফুটনের পটু নৈপুণ্য, শুধু স্মরণ করুন এখনও-সাম্প্রতিক ‘দেড়-ইশকিয়া’ ডেলিনিয়েটেড মাধুরিবাচনিকতা। ভাবা যায়, কী নিরভিনয় এক্সপ্রেশন করায়ত্ত থাকলে পরে লেসবো-বাসনাভিব্যক্তির এহেন ম্যুভি এন্টায়ার ফ্যামিলিকে একাসনে বসিয়ে দেখানো যায়!

দেব্দাসের কথাও স্মরণ করতে পারেন, ইফ য়্যু আস্ক মি টু, ছোট্ট একটা ব্যাপ্তির ক্যারেক্টার গোটা কাহিনি জুড়ে ফ্রেগ্রেন্স ছড়িয়ে গেছে শেষ তক। দ্য মোস্ট আন্ডারস্ট্যাইটেড রোল্ অ্যান্ড পারহ্যাপ্স দ্য ওয়ান দ্যাট ইজ্ মোস্ট লিঙ্গারিং, ইন টার্মস্ অফ ভার্চ্যুয়্যোসিটি, প্লেইড বাই মাধুরিজি ইন দেব্দাস্। চন্দ্রমুখী ক্যারেক্টারটায় শি’জ্ সিম্পলি স্টানিং। কী ক্যারিশ্মায় সেখানে প্যাশন্, ফায়ার অ্যান্ড জেন্টলনেস্ পুরে ক্যারেক্টারটা ক্রিয়েইট করেছেন যে এমনকি এর আদি স্রষ্টা বাংলার অফুরান প্যাথোসের নবাব শরৎচন্দ্রও অবাক ও তাজ্জুব হয়ে যেতেন মাধুরিজিকে দেখতে পেলে। ওয়াচিং হার পার্ফোর্ম্যান্স ইন দেব্দাস্ ইজ্ শিয়্যার ডিলাইট।

পাওয়ারহাউস অফ ট্যালেন্ট মাধুরিজিকে একটাবারের জন্যও আপনি কোনোদিন দেখেন নাই বিউটি ও অ্যাল্যুর‍্যান্স বাড়াতে যেয়ে বডিপেইন্ট করছেন বা ব্লন্ড-হাইলাইট হচ্ছেন বা কন্ট্যাক্টল্যান্স লাগাচ্ছেন বা গাদাগুচ্ছের ঝালরওয়ালা কাপড়মোড়া ক্যুয়িন হচ্ছেন। না, তা হতে হয় নাই। ইভেন্ ওয়েস্টার্ন ক্যারেক্টারাইজেশনে যেয়ে তাকে ওয়েস্টার্ন ট্রেন্ড বডিতে চাপাতেও হয় নাই। রিম্যার্ক্যাবল এই ব্যাপারগুলো।

পোস্টস্ক্রিপ্ট

টু বি কন্টিন্যুড, সোজা বাংলায় ইনকমপ্লিট, আনফিনিশড অর ইয়েট টু বি ফিনিশড, স্বকীয় অসমাপ্ত রচনার তালিকায় এইটা আরেকটা। পাদদেশে এই টীকাটাই ইনকর্পোরেইট করে এমনটা হাফডান রেখে ছেড়ে দেবো সমাপ্ত করবার দুরাশা। আমি ঠিক জানি না আদৌ কোথায় এর শেষ। তবে একটা বিশেষ এপিসোডই লিখতে চেয়ে খেলাচ্ছলে আশকথা-পাশকথা বাড়াতে যেয়ে এলিয়ে যাচ্ছে লেখা, তা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম তখনই, কিন্তু ২০০২ সালের একটা ভারতীয় গণহত্যা/দাঙ্গার ব্যাপার নিয়া হাল্কা চালে আমি আমার রাগটা ঝাড়তে চাওয়ার স্কোপ অনেকদিন ধরেই খুঁজছিলাম। মোটমাট ছাব্বিশটা পার্ট, এ-পর্যন্ত। প্রত্যেকটা পার্টে পাঁচটা করে প্যারাগ্র্যাফ। প্রথম পর্বটা খেয়াল করে থাকলে দেখবেন যে সেই লাইনেই আগাচ্ছিল রচনাখানি। ইন্ডিয়ায় কী ভয়াবহ ধর্মোন্মাদনা আমরা দেখেছি বিজেপির পক্ষে গোটা বলিউডকে অ্যালাইন করে দিচ্ছে! একে একে আমাদের আবাল্য পছন্দের পেয়ারা নায়কনায়িকা গায়কগায়িকা ভিলেইনভ্যাম্পায়ার অ্যাক্টরডিরেক্টর সবাই বিজেপির পতাকায় সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করতে থাকে। এই দৃশ্যরাশির দুর্বহ ভার থেকে এই নিবন্ধেই নিস্তার পেতে চেয়েছি। কিন্তু পরীর ছোঁয়ায় কী থেকে কী যে হয়ে গেল বলেন! আশা ছাড়ি নাই। আর ধরেন পাঁচ/ছয় এপিসোডে না পারলে এইখানে সেই বিশেষ বহুদিনের দুঃখটা না-ঝেড়ে ভবিষ্যতের কোনো রচনায় সেই চেষ্টা আবার চালাব, পুনরায়, বারবার চালাব। খুব একটা ফায়দা নাই জেনেও। শুধু সান্ত্বনা এ-ই যে, গ্যুগল করলে দেখা যায় শীর্ষ গণহত্যাকারী বিশ্বসন্ত্রাসীর রিডারসার্চে এখনও মোদির নাম পয়লাক্লিকেই দেখায়ে দেয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে এও মনে পড়ে, সেই-সময় অ্যামেরিকা ভারতীয় বর্তমান জনদেবতা রাষ্ট্রপতি মোদিকে অ্যামেরিকায় ঢুকতে দেবে না মর্মে ডিক্লেয়ার করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই ঘোষণা অ্যামেরিকা পাশরিয়া গেলেও গ্যুগল কিন্তু ভুলে নাই।  ইয়াদ হয়, এই নিবন্ধমালা আমি লিখছি দুইহাজারচোদ্দতে ফেসবুকে নোটস আকারে, যেই সময় জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা নানান তামাশা শেষে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধুলায় পায়ে দলেছেন, একই বছরে মে মাসে মোদি ইন্ডিয়ার তখতে বসেন। কংগ্রেসবিরোধিতা ভারতের উচ্চমহলের সমাজে এত ব্যাপক হয় যা প্রায় বিদ্বেষে রূপ নেয়। এই বিদ্বেষের সংস্কৃতি বিজেপি ইন্ডিয়ায় ব্যাপক কৌশলে এবং প্রকাশ্য দিবালোকে এস্ট্যাব্লিশ ও এস্তেমাল করতে থাকে। একে কেউ রুখেছে বলা তো বহুদূর, মদত যুগিয়েছে অ্যাভারেইজ সর্বভারতীয়। ‘কবীর সুমন ও অন্যান্য কলহ’ গদ্যটাতে এর আগের একদশকের ইন্ডিয়া নিয়া আলাপ তুলেছিলাম। লম্বা এই বিজেপিটাইমে এক অন্য অসুর ইন্ডিয়া দেখে আমরা আল্লাআল্লা করছিলাম। আমাদেরও রক্ষা হয় নাই। হাসিনার হিংসা ও জিঘাংসায় বাংলাদেশ দীর্ঘ গুমখুন ও প্রশাসনিক-বিচারিক রাহাজানির শিকার হয়। এর আগে এরশাদ এই জিনিশ করেছিলেন, তবে তা হাসিনার তুলনায় পানতোয়া। নারেন্দ্রা মোদি কী হাসিনাকে পেছনে ফেলতে পারবেন এইবার? ছাব্বিশে, দুইহাজারছাব্বিশে, সেই মীমাংসা আসবে। সেইসময়, বিজেপির উত্থানের সময়, ইন্ডিয়ার বুদ্ধিজীবীশিল্পীসাহিত্যিকদের বড় অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত যুগিয়েছিল। বলিউডের বড় বড় ফিল্মস্টাররা রাস্তায় বেরিয়ে প্রকাশ্যে মোদিকে সমর্থন করেছিল। পরোক্ষ সমর্থন ছিল মাধুরিজিরও। হয়তো মাধুরিজির রচনায় এ-যাত্রা মাফ করব উনারে। কিন্তু অমিতাভজি নিয়া লিখলে লাইনে লাইনে সেই শিখ নিধনযজ্ঞকালে উনার শিখবিদ্বেষী প্রকাশ্য টিভিবিবৃতি সহ মনোভাব এবং উনার দোস্তো রাজিবজি অ্যাসাসিনের পর উনার ক্রোধান্ধ উস্কানি আমি নিজের চক্ষে হেরিয়াছি জনাব! শিখনিধনকালে এই বান্দা আম্মার আঁচলতলে ছিল, পরে নানান সূত্র মারফতে এইটা জানতে পেরেছি। সিনেমা দেখেছি ‘আম্মু’ ইত্যাদি। ডক্যু দেখেছি। খুশবন্তজির উপন্যাসে এবং কলামে বেদনাটা আঁচ করতে চেয়েছি। ইত্যাদি। কিন্তু ২০০২ সালের মোদিমদতের গুজরাট কিলিং নিজের চোখে দেখেছি হে! কেউ বলে না এইসব নিয়া, খালি সংস্কৃতিচৈতন্য! খুব-একটা আমি লিখতেটিখতে পারি না, যা-ই লিখি তা ছাইপাঁশই স্বীকার করি, কিন্তু প্রত্যেকটা লেখায় আমি এই জিনিশগুলো বলার জন্য মওকা খুঁজি। কুলিয়ে উঠতে পারি নাই এখনো। প্রতিদিন ভাবি। কিন্তু পারব একদিন। অরুন্ধতী সহায়। অরুন্ধতী রায়। এই একজনই লিখেছিল তখন সত্যিকারের লেখা। ২০০২ সালে। একজনই রিয়্যাল আওয়াজ হাঁকে, কে বলে রে এই দেশ হিন্দুর? কার বুকে এত শখ জেগেছে এই হাজার জাতের মানুষের দেশটারে হেঁদুর দেশ বানাবার? কে বলে এইটা হিন্দুর দেশ? যে বলে, তারে আমার সামনে নিয়া আসো, আমি তার সিনা ফেঁড়ে কইলজা বাইর করে দেখতে চাই তার কইলজাখান লাল না কালা। লালুপ্রসাদ যাদব, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, হুঙ্কারটি দিয়েছিলেন। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ থাকুক এই কথাগুলো, ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা শহরের বাইরে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনে আগুন লাগানো হয় , যার ফলে ৫৯ জন পুণ্যার্থী নিহত হন। এই ঘটনাকে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হিসেবে দেখা হয় এবং গুজরাট রাজ্য জুড়ে ব্যাপক মুসলিমবিরোধী সহিংসতার সূত্রপাত হয় যা কয়েক সপ্তাহ ধরে স্থায়ী ছিল। নিহতের সংখ্যা অনুমান করা হয় দ্বিসহস্রাধিক, ২০০০ ছাড়ানো, যখন দেড়লক্ষাধিক লোক বাস্তুচ্যুত হন। ধর্ষণ, অঙ্গহানি এবং নির্যাতনও ব্যাপক হারে এবং মাত্রায় হয়েছিল। তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু করার এবং প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল, যেমন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গাবাজদের নির্দেশ দিয়েছিল এবং তাদের মুসলিম মালিকানাধীন সম্পত্তির তালিকা দিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের এপ্রিলে, গুজরাট দাঙ্গার মামলাগুলি তদন্ত এবং ত্বরান্বিত করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট একটি বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) নিয়োগ করে। ২০১২ সালে এসআইটি কর্তৃক নরেন্দ্র মোদিকে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যার ফলে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। বিজেপিবিধায়ক মায়া কোডনানি , যিনি পরে মোদি সরকারে মন্ত্রীসভায় দায়িত্ব পালন করেছিলেন, দাঙ্গার একটি পরিকল্পনার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন এবং ২৮ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন; পরে গুজরাট হাইকোর্ট তাকে খালাস দেয়।  পল ব্রাস , মার্থা নুসবাউম এবং দীপঙ্কর গুপ্তের মতো পণ্ডিতরা বলেছেন যে এই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় যন্ত্রাংশের জড়িত থাকার উচ্চ স্তর ছিল। তো, যা হোক, গুজরাট গণহত্যা চালানোর হোতা ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জনতার উপহার হিশেবে চোদ্দয় ইন্ডিয়ার শাসনভার হাতে পান। ওইটুকু পটভূমি, নিবন্ধের। শেষমেশ এইটা নায়িকারই ক্যারিয়ারকীর্তন হয়েছে। বেশ। অখুশি নই তাতে। একটা ফাইন্ডিঙ এ-ই যে, সেই সময়, কী পরিমাণে যে হিন্দি সিনেমা দেখতাম আমরা! দেখতাম, কারণ উপায় ছিল না। আমরা জন্মেছি সিনেমাহীন এক দেশে। এই দেশে আমাদের নিজেদের নায়ক নাই, নায়িকা নাই, গায়ক নাই, গায়িকা নাই, বিনোদন সাপ্তাহিকীগুলায় কেবলই ইন্ডিয়ান নায়কনায়িকাদেরে আমরা নিজেদের নায়কনায়িকাই হিসাব করে এসেছি দীর্ঘকাল। জিহ্যাঁ, এটাই বাস্তব, আই লাবিউ। ও, আরেকটা কথা, রচনার সূচনায় উদ্ধৃত কবিতাটি ইন্ডিয়ান, লিখেছেন ব্রত চক্রবর্তী। বিশেষ আর কিছু বলার রইল না। হাস্তা লা ভিস্তা।

জাহেদ আহমদ (রচনাকাল ২০১৪ গানপারপ্রকাশ ২০২৫)

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you