একই সে-বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সেদিনের মালি নেই
কিংবা আছে, চেইঞ্জ হয়েছে কেবল আড্ডার পয়েন্ট অফ টাইম, চেইঞ্জ হয়েছে আড্ডার ডিউরেশন শুধু। পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম যেহেতু, বিনাশ নয়, পুরোপুরি বিনাশ নাই জীবনের কোনোকিচ্ছুটিরই। ভিন্ন সুরতে সেই আড্ডাটাই তো রয়ে গেছে আজও। মধু ও মদের সেই কিশোরকালোত্তীর্ণ যৌবনবাউলিয়ানা। আড্ডার মুখগুলো বদলে গেছে, এবং বদলেছে আড্ডার আঙ্গিক ও আদলও হয়তো। তবু আড্ডা তো অনিঃশেষিত। ফুরায়ে যেয়ে আবার ভরাতে আসে জীবন নব নব।
কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আমাদেরও অস্তমিত অনেককাল হলো, সকলেরই নিয়তি ইহা, আড্ডা ভেঙে যায় কিন্তু তার সুর তো অটুট। ফলে এই গান, এই একটিমাত্র গানেই, প্রতিটি বাংলাভাষাভাষী মানুষের প্রাণের চলচ্চিত্র। কফিহাউসেই বিশেষ একটা হার্টবিট — আমার, তোমার, আমাদের সবার; যে-বন্ধুটি কোনোদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকেনি বারো-ইয়ারি দুস্তিয়ানায়, এমনকি তারও। ফলে সেই আড্ডাগানের শিল্পী মান্না দে এক-অর্থে যেমন চলে গেলেন, আবার ঠিক চলে গেলেনও না, বিদায়ের ভিতর দিয়া মান্না দে অন্যপ্রকারে হলেন বরং চিরস্বাগত!
আমরা যারা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের জন্মপূর্ব সময়ে জন্মেছি এবং আড্ডায় বেড়ে উঠেছি, আড্ডায় আড্ডায় জুড়িয়ে দিয়েছি জীবন ও জাগতিক সফলতা-নিষ্ফলতা, তাদের ছলছল গুনগুনানির ভেতর অমর এই কফিখানার মালিক মান্না। আর মান্না দে আমাদের জীবনে সেই বিরলজন্মা মানুষ, যিনি আমার বাপের বন্ধু, আমার বন্ধু, আমার মেয়েরও বন্ধু। চুরটফোঁকা ভাবভালোবাসার বন্ধু, একই কাপ তিনজনে ভাগ করে খাওয়া চায়ের ইয়ার মান্না দে।
যদিও আক্ষরিক অর্থে আমার জীবনে তো কফিহাউস নয়, ছিল অন্য ডেরা, আড্ডার একাধিক চিপাচাপা ছাপড়া চাদোকান ছিল আমাদের। ছিল টিলাগড় কলেজগেটের মামার দোকান, ছিল প্যারিস ম্যানশনের রতনের দোকান, ছিল বইপত্রদোকানের বারান্দালাগোয়া চায়ের ছাউনি। ছিল চৌহাট্টার মোড়ের ছাপড়া। আর ছিল আমাদের ছোট্ট শহরের রাজকীয়তা — পাঞ্জেরী রেস্টোরেন্টের দুধডোবা চায়ের ঘণ্টার পর ঘণ্টার বিকাল-সন্ধ্যাগুলো। সমস্ত রাস্তাপাশের ঝাপতোলা-ঝাপফেলা চায়ের ছাপড়াগুলো মিলে একত্রে আমাদের কফিহাউস।
যখন থেকেই গানটা আমরা শুনেছি, কোনোদিনই ঘুণাক্ষরেও কলকাতার কোনো ব্র্যান্ড আঁতেল কফিখানার কথা মাথায় আসে নাই। আমাদের মাথায় চিরদিনই কফিহাউস বলতে সেই সম্মিলিত ছাপড়াগুলো। কফিহাউস আমাদের ক্যালাইডোস্কোপ, আমাদের স্যানাটোরিয়াম। যতগুলো চরিত্র কফিহাউস ছোটগল্পে এসেছে, সেগুলোর একটা আমি — কিন্তু কোনটা, তা তো নিজের মুখে বলব না, তা জানে আমার বিচ্ছু বন্ধুরা। বাকি চরিত্রগুলো ধরে ধরে আমি নিজে একটা ভার্শন তৈরি করতে পারি কফিহাউস গল্পের, সেই গল্পের শিরোনাম দিতে পারি : কফিহাউস রিভিজিটেড!
গল্পটা আমাদের কাছে হ্যান্ডোভার করে বেশ-অনেক বছর হলো অগস্ত্যভ্রমণে গেছেন মান্না। তার দিয়া-যাওয়া ফর্ম্যাটে প্রত্যেকেই নিজের বলয়ের গল্পটা আলবৎ বলে যেতে পারে। এতটাই ইম্প্যাক্ট আপনার আমাদের জীবনে, ডিয়ার মান্না দে, মিথ্যে বলছি না, মাইরি বলচি! কিন্তু ভুলে যেতে পারি আমরা আপনাকে, যেতেই পারি ভুলে হে গানবন্ধু, অতি অনায়াসে যেতে পারি ভুলে, এবং ভুলিয়া যাওয়াই তো মনুষ্যস্বভাব। ভুলিয়া থাকাই তো বেঁচে থাকা। আমরা তো সমস্ত দুনিয়া চাওয়াচাওয়ির পর এই একটা চাওয়ার কাছে প্রণিপাত করি অবশেষে। বেঁচে থাকবার এক অতিকায় ইচ্ছে। বেঁচে থাকার কাঙালপনা আমরা রাখি প্রকাশ্যে। এত মনে রাখলে তো চলে না তাই। কিন্তু কফিহাউস ভুলে যাওয়া! না, নেভার, নৈব চ।
সব ভুলে যাই, মৃত্যুশোক ও প্রেমিকার সদ্যদত্ত দাগা, মাতৃমৃত্যু ও পিতৃবিদায়, কিন্তু নিজের শৈশব ও তরুণদিনের মন্ত্রতুল্য সময়ট্র্যাক ভুলে যেতে পারি? নিতান্ত অসুখ করে তো, মস্তিষ্কবৈকল্য ঘটে তো, অন্য কথা। আর বন্ধুদের ভুলে যাওয়া মানে তো নিজেকেই ভুলে যাওয়া। আর নিজেকে ভুলে যাওয়া মানে মৃত্যু ছাড়া আর কী! ইনডিড, কফিহাউস আপনি গেয়েছেন গান হিসেবে, আর আমরা এটাকে নিয়েছি আমাদের মন্ত্র হিশেবে। এই মন্ত্র নিয়েই আমরা বিচ্ছেদ মেনে সেঁধিয়ে গেছি যার যার খোঁয়াড়ে। এবং এরপর থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি বিদঘুটে একাকিত্বের ফোকরে, জীবিকাশাসিত জন্তুর এই জীবনে, এই সকরুণ রোদনের রণরৌদ্রময় নিষ্ঠুর নির্বান্ধব উঠোনে, এই কফিহাউস আমাদের বাহুতে-গলায়-মণিবন্ধে রেখেছি বেঁধে কবচের ন্যায়।
এ-গান রক্ষা করে চলেছে এক-দুই-তিন নয়, একুশ-বাইশ-তেইশ বছর ধরে আমাকে এবং আমি জানি আমার দূরদীর্ণ বন্ধুগুলোকেও। কদাচ কখনো ফুঁপিয়ে উঠি, শুনতে শুনতে, পরক্ষণে ফের নতুন ধানের ন্যায় নির্মল ঝলমলে সোনালি হয়ে উঠি দৃশ্যগুলি দেখে, মুখগুলি দেখে দেখে। সেই মুখগুলো, দুর্দান্ত ধ্বনিচিত্র-ছায়াছবিগুলো সেদিনের, সম্বল বলতে এ-ই তো একান্ত আমার। আত্মপরিচয়, নিজস্ব সংবাদ, রেজিয়্যুম প্রকৃত এ-ই।
এ কোনো অবিচ্যুয়ারি নয়, এ নয় বিচ্ছেদগীতিকা, বা এ নয় ইংরেজিতে যেটা জানি ট্রিবিউট/হোমেজ বলে। একশো বছরে এইবার পা রাখলেন মান্না দে। এ নয় হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সেলেব্রেশন। এ নিজেকেই মনে করা আরেকবার, রোজকার মতো, নিজের নিঃশ্বাস করতলে টের পাবার ব্যাপার। এ হলো রক্তগ্রন্থির কাছে গোপনে কৃতজ্ঞতা স্বীকার। এটা কোনোভাবেই মৃত্যুপরবর্তী বিদায়চিঠি নয়, শেষ পুষ্পস্তবক নয় কফিনের পিঠে, এ নয় বার্থডে সেলেব্রেইটিং ধামাকা। আদতে এ এক স্বীকৃতি, তৃণপুষ্পের ন্যায় তিফিল, নিজেরই জীবনের। আমার বন্ধুদের জীবনের। স্বীকৃতি এই মর্মে যে, ব্যর্থ, হয়তো বৈষয়িক ও অন্য বহুবিধ বিবেচনায় ব্যর্থই আমরা, তবু ব্যর্থ নই পুরোপুরি, ব্যর্থ হয়নি জীবন আমাদের। কফিহাউসের মতো অনুপম গানাভিজ্ঞতা আছে আমাদের, কাজেই, ব্যর্থ নই তো!
অনেককিছু করে-দেখে-খেয়ে-শেখে-এঁকে-বেঁকে-নেচে-বেচে শেষে এসে এইখানে এই ইঁদারার ধারে দাঁড়াই, উবু হয়ে থাকি অনেকক্ষণ, ধ্বনি করে উঠি জোরে প্রতিধ্বনির আশায়। এ-ই তো, কফিহাউস, বন্ধুদের নাম ধরে ডাকছি আবার। ওই তো, ডোমচাড়ালের নাচের সঙ্গে একডজন ব্যান্ডগান, গুটিকয় ইংরেজি আর যখনতখন দমকাবাতাস পল্লিগীতি, সবশেষে কফিহাউস । কফিহাউস দিয়ে ব্রহ্মদত্যি টিলার ওপর মনোজ্ঞ অ্যামেচার অনুষ্ঠান সমাপ্তি। তিরিশদিনই, প্রায়। ভেন্যু বদলাত, অনুষ্ঠানের ফর্ম্যাটও, শুধু কফিহাউস বদলাত না। কফিহাউস কখনো সলো হয়নি, নিয়ম ছিল না কি-না জানি না তবে সম্ভব ছিল না, কফিহাউস সলো গাওয়া আজও সম্ভব নয়। বৃন্দগানেও যার গলা মাটির মতো মরমে মরিয়া যায় সে-ও কফিহাউসে হেঁড়ে বীর!
আমরা ছেড়ে গিয়েছি একে অন্যেরে, কফিহাউস ছেড়ে যায়নি আমাদেরে কোনোদিন। একই কফিহাউস প্রত্যেকের সঙ্গে! তাজ্জব! জীবনেরই মতো, অবাক ম্যাজিক, তাজ্জব। ফলে এইটা আমাদের নয়, এক অনিঃশেষ কফিহাউসের জীবনী। বায়োগ্র্যাফি অফ স্ট্রিটসাইড টিস্টলের মুহুর্মুহু মুখরিত আড্ডাবাজি। নিবন্ধটা আর কিছু নয়, ট্রিবিউট টু কফিহাউস, ইনফ্যাক্ট। ফলে, নেভার অ্যাডিয়্যু, এভার ওয়েল্কাম, মান্না দে! এভার্গ্রিন কফিহাউস ! এভার্গ্রিন বুড়ো-হতে-শুরু-করা বন্ধুরা আমার …
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS