সুবীর নন্দী : স্মৃতিতর্পণ || উজ্জ্বল দাশ

সুবীর নন্দী : স্মৃতিতর্পণ || উজ্জ্বল দাশ

গল্পটি প্রিয় মানুষ এবং প্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দীকে নিয়ে। কেবল আমারই তো নয়, বাংলাদেশের অনেকেরই তিনি প্রিয় মানুষ, প্রিয় শিল্পী, প্রিয় সুবীর নন্দী।

গল্পটা আজ থেকে বছর পনেরো আগের। জনতা ব্যাংকের কত তলায় দাদা বসতেন ভুলে গেছি। এক দুপুরে দেখা করতে গেলাম। নবীগঞ্জে একটা অনুষ্ঠানে নেবার ব্যাপারে; যদি ভাগ্যচক্রে রাজি করানো যায়, এই আশায়। আমন্ত্রণের বিস্তারিত জেনেই শিল্পী হ্যাঁ বলে দিলেন।

দিনটা ছিল ২০০৪ সালের ০৪ মার্চ। ‘আনন্দ নিকেতন’-এর অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী সাংস্কৃতিক উৎসবে গাইতে এসেছিলেন দাদা। সাতসকালের সেই ট্রেনযাত্রায় ভাবি সহ গীতিকার কবির বকুল ভাইও সেইবারে এসেছিলেন নবীগঞ্জ।

বলা দরকার যে ‘আনন্দ নিকেতন’ একটা সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা শিখন-শিক্ষণকেন্দ্র, সোজা বাংলায় ললিতকলা শিক্ষালয়। নবীগঞ্জে এই শিক্ষালয় ২০০৪ থেকে আজও কাজ করে চলেছে স্বেচ্ছাব্রতী কিছু উদ্যমী তরুণের স্বপ্ন আর বুকের পাটার উপর ভর করে।

দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী চলেছেন এমন একটা জায়গায় আমন্ত্রিত হয়ে, দেশের আর-দশটা জায়গার চেয়ে এই জায়গার খানিকটা গুরুত্ব অন্তত শিল্পীর কাছে তো আছেই। নিশ্চয় আছে এবং তা বোঝা যাচ্ছিল শিল্পীর কথাবার্তা আর তার হন্তদন্ত ব্যস্ততায়। নিজে আমন্ত্রিত প্রধান শিল্পী হয়ে যাচ্ছেন নবীগঞ্জে, সেদিকে শিল্পীর ভ্রূক্ষেপ নাই, ভাবেসাবে মনে হচ্ছিল সুবীর নন্দী নিজেই যেন হোস্ট, সফরসঙ্গী সবাইকে সেভাবেই নিয়ে চলেছেন!

হবিগঞ্জ সুবীর নন্দীর জন্মজেলা। আর এই হবিগঞ্জ জেলারই একটা উপজেলা নবীগঞ্জ। সুবীর নন্দীর বাল্য-কৈশোর আর ইশকুলবেলা কেটেছে এই পানিতে এই বাতাসে এরই আলোয় এরই মিঠায়। সেইদিন আরও দশ থেকে বারোজন তারকাশিল্পী সঙ্গে লয়ে সুবীর নন্দী নিজের দেশে চলেছেন, আর সবাইকে মুখে বলছেন বারবার যে, আরে, আজকে আমি তো অতিথি না! আমার বাড়িতে তোমাদেরকে অতিথি হিশেবে নিয়ে যাচ্ছি!

অনুষ্ঠানের দিন। মাঠভর্তি উত্তাল দর্শক। একসাথেই গাইছিলেন শিল্পী সুবীর নন্দী, পলাশ আর দিনাত জাহান মুন্নী।

হঠাৎ একটুকরা কাগজ হাতে স্টেজে উঠলেন কবির বকুল! কানে কানে সুবীর নন্দীকে কিছু-একটা বলছিলেন বুঝতে পারছিলাম অডিয়েন্স থেকে। কিন্তু কি বলছিলেন তা তো আর বোঝার উপায় ছিল না দর্শকসারিতে বসা আমাদের পক্ষে।

সেই কাগজের টুকরাটা হাতে নিয়ে সুবীর নন্দী ২/৪ মিনিট ভাবলেন! স্টেজ থেকে কবির বকুলকেও নামতে দিলেন না!! তারা চারজন মিলে গাইলেন :

আনন্দ নিকেতনে
আনন্দ প্রতিক্ষণে …
বয়ে যাক দখিনা হাওয়ার মতো
শিক্ষায়দীক্ষায়, ত্যাগতিতিক্ষায়
সবার মনন হোক আরো উন্নত …

হয়ে গেল আনন্দ নিকেতনের সূচনাসংগীত! পেয়ে গেলাম আমরা আমাদের সংগঠনের উজ্জীবনী মন্ত্র!

‘আনন্দ নিকেতন’ সূচনাগানের গীতিকার কবির বকুল এবং সুরকার সুবীর নন্দী।

সেই থেকে দাদা আনন্দ নিকেতনের কথা ভুলেননি। দেখা হলে জিগ্যেশ করতেন, সংগঠন কেমন চলছে? তার জেলার একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী উৎসবে মানুষের উপস্থিতি তাকে আপ্লুত করেছিল।

তার সান্নিধ্য সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে আমাকে, আমাদেরকে, দেশের সাংস্কৃতিক তৎপরতায় লিপ্ত অনেককেই। শিল্পী হিশেবে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি অফুরান। সুবীর নন্দী তার নিজের শক্তি, গুণ, ক্ষমতা ও সাধনায় শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। দুই হিট গানেই স্টার আর বারো লাইন লিখেই গীতিকার … এই শর্টকাট লাইনে ছিলেন না তারা।

তার সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো লাখো ভক্তের মতো তোলা থাকল আমারও অন্তরের গহীনে।

‘আনন্দ নিকেতন’, একটি শিশুকিশোর শিল্পপরিবার, আঁকড়ে রাখবে তার অমূল্য স্মৃতি, অপার্থিব সুর!!

বিনম্র শ্রদ্ধা আর প্রণাম জানাই শিল্পীর নতুন যাত্রায়!

… …

উজ্জ্বল দাশ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you