ম্যাক দ্য রকার || জাহেদ আহমদ

ম্যাক দ্য রকার || জাহেদ আহমদ

শেয়ার করুন:

আমাদের দেশে, এই নির্জল-নিরম্বু অগ্নিজ্যান্ত মানুষের দেশে, এই নিরস্ত্র ও অসহায় লেখক-কোপানোর দেশে, বেডরুমে সেইফ্টি দিতে অস্বীকারকরণের আশ্চর্য ঘোষকের এই সরকারবাহাদুরির দেশে, এই ঘিঞ্জি মিনিবাস-মহাট্রাক-ট্যাক্সিক্যাবের ভিড়ে গানপাউডারে পোড়াকয়লা বার্বিকিউ নগরীর দেশে, মেহমানদেরে খেতে বসিয়ে খুন করা ট্র্যাজেডির এই বীভৎস হোলি-আর্টিস্যান তৎপরতায়, এই মৃত্যুমুখরিত সন্দেহ-প্রতিসন্দেহ কলকোলাহলের গণতান্ত্রিকতায়, এই নিদয়া শাসকের তল্পীবাহী সিভিল সমাজের সুনাগরিকতায়, এই বিপ্লববাতিকগ্রস্ত বৈপ্লবিকতায়, এই জিহাদি জজবায় বিভ্রান্ত আসুরিকতায়, এই নিমখুন-গুমখুন আর জঙ্গি জিঘাংসার জান্তবতায়, এই বিপন্ন প্রজাতান্ত্রিক বদ্বীপে, এই সুন্দরবনবিনাশী মিনসে চালিয়াতদের সংস্কৃতিনৃশংসতায়, এই নিরপরাধ জনসাধারণারণ্যে একপাল পঙ্গের পরাক্রমী ফ্যাসিক্রিয় তৎপরতায়, জ্যাক দ্য রিপারের এই নৃশরীর শিকারের মর্মস্পর্শা বাংলায়, এই বিধুর বোবা কান্নার বধির ও ভৌতিক ভূতুড়ে ভূখণ্ডে, এই স্থিতাবস্থায়, স্ট্যাটাস-ক্যু পরিবেষ্টিত এই নিস্তারহারা বাস্তবতায়, এখন এ-মুহূর্তে, এই বর্তমানে — এই দ্বিসহস্রষোলো-সতেরো অতিক্রান্তিদিনে — সেই গান কই, চিৎকার কোথায় সেই কিংবা হাহাজারিদীর্ণ সক্রোধ সংগীতের প্রতিরোধ কোথায়, যেখানে ন্যাংটো প্রজাতন্ত্রের বস্ত্রসংবাদ শোনা যায়?

নেই। কিংবা আছে, হয়তো, ভূগর্ভস্থ। শোনা গেলেও গুটিকয় এবং কালেভদ্রে অত্যন্ত। পল্লিগীতি আর খাঁচার ভিতর অচিন পাখি প্রীতিগীতাখ্যের এই নিঠুরা বাউলসাংগীতিকতায়, ইনফার্নোপ্রতিম দৈনন্দিনে এই ফোকফেস্ট-সুফিফেস্টের মরমিয়া মোচ্ছবে, এই হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক ফ্যাশনপ্যারেডে, এই ইন্ডিয়া-পাকিস্তানি কোকস্টুডিয়ো আর নেস্ক্যাফে বেইসমেন্টে, কেমন আছো ওগো বাংলা গান? কেমন আছো ওগো তুমি মম সখা বাংলাদেশিয়া গান? সর্বাগ্রে ব্যান্ডগান, ব্যান্ডসংগীত, শহুরে শোর-মাচানো ‘অপসংস্কৃতি’ বদনামের সেই ‘অপরূপ’ লড়াকু সংগীতকলা আমাদের — কেমন আছে সে? ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, হ্যাঁ, ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ হতেছে দিকে-দিগন্তরে। এতই মিষ্টি বিকাশ, এতই মিষ্টি এবং মিস্টিক সেই বিকাশ, দমবন্ধ-দমবন্ধ লাগে সহসা, সাফোকেইটেড লাগে ব্যাপক মিষ্টদ্রব্য উৎপাদন ও গলাধঃকরণের চোটে। কেমন সেই মিষ্টিজাত ভোজ্যপণ্যগুলো? জলের গান, আহা, খাসা নাটুকেপনা! আছে চিরকুট, আছে চিরকুটের চ্যুয়িংগাম-বাবলগাম, মধ্যবয়স পারায়েও আছে টিনেইজ ফোঁপা কান্না, আছে নৃত্যসুরেলা হাবিব ওয়াহিদের মিঠে বটিকা, আছে প্রেমাংশু অর্ণবের অনেকানেক পরীক্ষানিরীক্ষান্তে একগুচ্ছ সুরচড়ুই। নিশ্চয় আছে ঢের আরও। সর্বত্রই মিষ্টির আধিক্য। বর্তমানে এদেশে কোক-নেস্ক্যাফের ইনফ্লুয়েন্সেই হয়তো কোক-নেস্ক্যাফের চেয়েও সুরেলা অ্যারেইঞ্জমেন্টের সুমিষ্ট স্যফিস্টিকেইটেড গানপণ্য।

তবু, তবুও, গুটিকয় হলেও প্রচেষ্টা জারি রয়েছে এই মিষ্টিজাত দ্রব্যাদি তৈয়ারিকারকের ভিড়ে ঈষৎ তেতো বলারিষ্ট উৎপাদনকারীদের। অতি বিরলপ্রজ আর্টসেল তাদের মধ্যে একটা। আছে শিরোনামহীন, আছে নেমেসিস, আছে মেঘদল, আছে মনোসরণী, আছে সহজিয়া, আছে চিৎকার, আছে দি সোনার বাংলা সার্কাস প্রভৃতি। কিংবা আছে আরও অনেকানেক নিশ্চয়ই। কিন্তু মোটের ওপর সবখানে প্যাঁচপয়জারছাড়া প্রেমের ভাসান। সর্বোপরি ভীষণ এক্সপোজারের শো-শা। চারপাশে নিত্য ঘটমান মনুষ্য-পরিবেশ-প্রতিবেশবিরুদ্ধ বহুবিধ অনাচার-অজাচারের অ্যাগেইন্সটে স্টেইটমেন্ট হয়ে ওঠার দায় যেন নাই আজকের গানের। নাই বেবোধা বাস্তবতার ভাষ্য-প্রতিভাষ্য রচনার দায়। কেবলই মিউজিক হচ্ছে। ব্যাপক মিউজিকই হচ্ছে, বেবাকেই মিউজিশিয়্যান হয়ে উঠছে উত্তরোত্তর, দক্ষ মণিবন্ধের গাইয়ে-বাজিয়ে মিউজিশিয়্যান, বটে! স্কিলড, কনফিডেন্ট, কম্যার্শিয়্যালি ভায়্যাবল মিউজিক পয়দা হচ্ছে মিনিটে-মিনিটে। অ্যাঙ্গার নাই, উষ্মা নাই, চিৎকার নাই, গর্জন নাই, ঘৃণা ও অনাস্থা নাই, ডিস্যাগ্রিমেন্ট নাই ডোমিন্যান্ট এস্ট্যাব্লিশমেন্টের সঙ্গে, এন্তার গালিগালাজে আর খুনখারাবিতে আবিল এই সমাজে যে-গানটা বাইর হচ্ছে সেখানে একচেটিয়া রাধাকৃষ্ণ বৈষ্ণবাইট প্রণয়ের প্রোটোটাইপ শুধু। কোথাও ক্রন্দন নাই, চিল্লানি নাই, গিটারে একটুও বমন উগরানো নাই, ড্রামসবিটে নাই প্লীহা-চাবকানো হ্যামারিং। সুবাতাস শুধু। সুন্দর শুধু। অচিন পাখি শুধু। শূন্য পিঞ্জিরা শুধু। লোকসংগীতের প্রতিরোধের লম্বা খান্দান ও সিলসিলা না-জেনে ‘ফোকফিউশন’ শুধু। গণসংগীতের গনগনে আগ্নেয় গগন-ছাওয়া ইতিহাস ভুলে কেবল এনজিওধ্বজা-ওড়ানো প্রচারণাগানগপ্পো।

অথচ ছিল, কোনো-একদিন, সত্যি কি ছিল? গোলাভরা ধান আর গলাজোড়া গান? অতটা না হয়তো, তবু ছিল, কিছু-একটা তো অবশ্যই ছিল। কতটুকু এবং কী ছিরিচেহারায় ছিল সেসবটুকু? খতিয়ান নিতে বসা চাই। কিছু হলেও বোঝা যাবে ব্যাপারটা। যাচ্ছে কোন সড়কে ব্যান্ডগান, কোন মঞ্চে কার মাইক্রোফোনে, কথা ছিল কোন পথে যাবে এবং ছিল কি না আদৌ বলবার মতো কথাবার্তা কোনো। অন্তত রঙঢঙা চ্যানেলের উড়ন্ত জোকারের মতো স্টুডিয়োজন্মের আগে ব্যান্ডসংগীতের পদাতিক দিনকাল কেমন ছিল, পদব্রজে সে যেতে যেতে পৌঁছুতে পেরেছিল কি না তার টার্গেটেড অডিয়েন্সের হৃদয়াঙিনায়, খোঁজপতা চালানো দরকার। হয়তো অত নয়, বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত সময়শুমারে এমন কোনো মহারাস্তা পারায়েছে বলা যাবে না, কেবল শুরুর দিককার ঝড়ের হল্কা পারানো হয়েছে তার, এরপরও উল্লেখযোগ্য কতিপয় বিসর্জন ও অল্পবিস্তর অর্জনও ঝোলায় পেয়েছে সে এরই মধ্যে, সেই তল্লাশিটুকু দরকার করা। ব্যান্ডসংগীত টার্মটাও অধুনা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতেছে দেখা যায়। এখন রক, বাংলা রক, হেভিমেটাল, ডেথমেটাল ইত্যাদি নিয়া কাজিয়াফ্যাসাদে বেলা ভাটি লয় রোজ। খোঁজপতা চালানো দরকার স্মৃতিসমস্ত অব্লিভিয়নে চলিয়া যাবার আগেই। বিশেষত এমন একটা সময়ে এই খোঁজতালাশ যখন আমরা সব্বাই পার্ফোর্মার এবং সব্বাই ক্রিটিক।

প্রশ্ন এক নয়, একাধিক, অ্যান্সারেরও ইশ্টিশন নাই। কিন্তু সর্বাগ্রে এ-ই জিজ্ঞাস্য হতে পারে যে হেন খোঁজপতা চালাইবে কে? এবং কেমন করে? ব্যান্ডসংগীতের উত্থানগাথা আর তার উভয়ত ইতি-নেতি জীবনেতিহাস কে রচিবে কেতাদুরস্ত কুতর্কের এই ঢিশুম-ঢিশুম সোশ্যালসাইটপ্রমত্তা ফাইটারের দেশে? সেই ছেলে কবে হবে — এই-না বাংলাদেশে — হবে সেই মেয়ে কবে — যে এই ইতিহাস রচিবে ডেভিড টাউন্সেন্ডের ন্যায়? এই দেশে ব্যান্ডসংগীতের সংশপ্তক সংগ্রাম ও শস্যোত্তোলনের ইতিহাস কবে লেখা হবে? হে সাম্প্রতিক যুবা, ফেবুকমেন্টে সোশ্যাল রেস্পোন্সিবিলিটি সেরে দিলখুশ দুনিয়াজয়ী রেভোল্যুশনারি হে চঞ্চলমতি বন্ধু, এই ইতিহাস তুমি মিলিয়ে না-দিলে কে মেলাবে? ডেভিড টাউন্সেন্ড সিক্সটিজের অ্যামেরিকায় রক্-ন্-রল্ রেনেসাঁসের ডক্যুমেন্টারি লিখেছেন ‘চেইঞ্জিং দ্য ওয়ার্ল্ড : রক্-ন্-রল্ কালচার অ্যান্ড আইডিয়োলোজি’ শিরোনামক বইটির পেটের ভেতরে অনবদ্য ব্যাখ্যাবিশ্লেষ আর স্মৃতিবিধৃত ভাষিক বুননে, যেখানে গ্রেইট সমস্ত সিঙ্গার-স্যংরাইটার-ব্যান্ড ছাড়াও বব ডিলান জন লেনন ল্যু রিড সহ ফোক-রক এবং অন্যান্য অজস্র পপ্যুলার ও আন্ডার্গ্রাউন্ড ঘরানার গোটা রকজাগৃতি নিয়া ভাষ্য ও বয়ান সহজবোধ্য স্বরে পেয়ে যায় পাঠক। চঞ্চল যুবা, সাম্প্রতিক হট্টগোলের ভট্ট-আচার্য, ভাবো। তুমিই লিখবে, হে আমার আত্মজা ও আকাশচূড়া গাছের ন্যায় ঢ্যাঙা-লম্বা ছেলে, আমাদের গরিমার গানদিনগুলি নিয়া গলা খুলে কথা বলার প্রিপারেশন গ্রহণ করো তুমি।

কিন্তু মনে কোরো না যেন যে তোমার সময়টাকে, তোমার আজকের ক্রিয়েটিভ ইউফোরিয়াটাকে, এই নিবন্ধে হেয় করা হচ্ছে। একজন ব্যক্তিশিল্পীকে ধরে, একজন ব্যক্তিশিল্পী ভর করে, এই নিবন্ধ অগ্রসর হলেও ভেবো না যেন যে বাকি সবাইকে আন্ডার্মাইন করা হচ্ছে। ব্যক্তিপূজা নয়, ব্যক্তিকে অবমূল্যায়নও নয়, ব্যক্তির ভিতর দিয়া পূর্বাপর সময়টাকে এক-নজর দেখার চেষ্টাটাই নিবন্ধের অভিপ্রেত। সত্যি বলতে ব্যাপারটা এ-ই যে, ইতিহাসের ভিতর দিয়া ব্যক্তি নির্মিত হয় এবং একইসঙ্গে ব্যক্তির ভিতর দিয়াই ইতিহাস গড়ে ওঠে তথা আদল পায়। আন্ডার্মাইন নয়, কাজেই, আন্ডার্লায়িং রয়ে গেল গোটা নিবন্ধের রিডিং-বিটুয়িন-দ্য-লাইন্স অসংখ্য ব্যক্তি ও নৈর্ব্যক্তিকতা।

 

বাটার্ফ্লাই ইয়ার্স

ফিডব্যাক  একটা গান বেঁধেছিল বছর-তিরিশ আগে, সেই আমাদের কৈশোরক কড়কড়ে নোটের ন্যায় নিকষিত রৌদ্রোজ্জ্বল দিনগুলোতে, সেই গানটা আমরা আজও ভুলি নাই। কিংবা আমরা হয়তো ভুলে গেছি, কিন্তু সেই গান আমাদেরে ভুলে নাই, ফিডব্যাকের গানটা আমাদের পিছা ছাড়ে নাই। রিয়্যালিটির ন্যায় আছাড়িপিছাড়ি যায় সেই-সময়ের শোনা ব্যান্ডের গানগুলো। সুরের ভিতর দিয়েই ফিরিয়া পাই মিস্টিক্ সেই দিনরাতগুলোর টুপুটুপু জোছনা আর ঝিরিঝিরি হাওয়া, তিরিতিরি পাখির অরণ্য আর ফিনফিনে ঘুড়ির আকাশ, গনগনে দুপুর আর হেলিকপ্টারসদৃশ গঙ্গাফড়িং। ফড়িং বললেই গঙ্গাফড়িং বোঝায়, এমন তো নয় নিশ্চয়; ঘাসফড়িং, ফুলফড়িং, ধানফড়িং, গাঙফড়িং, বাঘফড়িং, জলফড়িং, বনফড়িং ইত্যাদি বিচিত্র ফড়িঙে আর ফলপাকুড়ের পত্রপল্লবছায়ায় লেপ্টালেপ্টি ছিল গোটা সাংস্কৃতিক সংখ্যাশীর্ণ বয়ঃসন্ধিডিঙানো সময়টা আমাদের। ফিরে যাই সেই দিনগুলোর দীপাবলি উৎসবে, যেখানে একদঙ্গল বন্ধুহুল্লোড়, ব্যাপক চড়ুইভাতি আর অন্ত্যাক্ষরী ক্রীড়াময় দিনরাতগুলো ভরা গানে-গানে এবং গল্পনাটকের সংলাপে-সৌহার্দ্যে। সেই গান, ফিডব্যাকের সেই গান, মনে পড়ে : “একঝাঁক প্রজাপতি ছিলাম আমরা / একঝাঁক বুনোহাঁস ছিলাম আমরা / বাঁধনহারা পাগলপারা ছিলাম আমরা” — গানের মুখপাতে এই লাইনগুলো ছিল মনে পড়ে। এবং সুরের মৌতাত অধিকতর খোলতাই হয়েছিল বৃন্দকণ্ঠ কম্পোজিশনের কারণে। সেইসঙ্গে এ-ও মনে পড়ে যে ব্যান্ডসংগীতের মোড়কে যেমনটা আমাদের তরুণ তুর্কি দিনগুলো প্রবাহিত রয়েছে, তেমনি রয়েছে টেলিভিশনের নাট্যধারাবাহিকে এবং ম্যুভি-অফ-দ্য-উইকে। একেকটা গানের সুর/কথা বা একেকটা নাটকের দৃশ্য/সংলাপ মনে-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্তীর্ণ সময়ের সুরবর্ণগন্ধ উঠে আসে একটানে। সেই সময়ের প্রেম-অপ্রেম, সফলতা-নিষ্ফলতা, তরঙ্গ-নৈস্তরঙ্গ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, শরীর ও হৃদয়ের শোভা আমরা ব্যান্ড ও অন্যান্য মাধ্যমিক গানের ভিতর দিয়াই ইন্-রেট্রোস্পেক্ট সমঝিয়া পাই। ফিডব্যাক  নয় কেবল, গঙ্গাফড়িং ছাড়াও যেমন রয়েছে এন্তার লাইট-উইংড অরণ্যপরির ন্যায় ফিনফিনে ফড়িং, রয়েছে তেমনধারা ব্যান্ডের দীর্ঘ ক্যারাভ্যান। অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পর থেকে এই বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের পত্তনি ও প্রসার নবোদিত ভূখণ্ডের কালচারাল আইডেন্টিটি নির্মাণ ও বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে, যেমন রেখেছে স্টেজ-থিয়েটার এবং মুক্তির দশকান্তে এক-পর্যায়ে অল্প পরিমাণে হলেও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান গুটিকয় বিকল্পধারার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তবে ব্যান্ডসংগীতের ব্যাপারটা আলাদা অভিনিবেশের দাবি রাখে নানা কারণে, এর মধ্যে একটা কারণ বলা যায় প্রাগুক্ত অন্যান্য অবদায়ক ক্ষেত্রগুলো কমিবেশি রিকগ্নিশন/অ্যাক্নোলেজমেন্ট পেলেও ব্যান্ডমিউজিক মধ্যবিত্ত মননসৃজনকারবারীদের লেখায়-স্পিচে সেভাবে স্বীকৃত হয় নাই। বিস্তর কপিমিউজিক হলেও পরীক্ষণপর্যায়িক উন্নত সংগীতও কম হয়েছে মেইনস্ট্রিম ব্যান্ডগুলোর হাতে, এমন বলাটা আদৌ সুবিচার হবে না। আপনার কৈশোর/তারুণ্য যদি হয়ে থাকে গত সহস্রাব্দের লাস্ট ডিকেডে, এইটিজের মাঝমাঠ থেকে নাইন্টিজের কর্নারলাইন পর্যন্ত ধরে নেয়া যায়, সেক্ষেত্রে আপনার পক্ষে ব্যান্ডসংগীতের ইম্প্যাক্ট অস্বীকার করা ডিফিকাল্ট হবে বেড়ে-ওঠাকালীন জীবনাধ্যায়ে। এমন হয়তো নয় যে ব্যান্ডগুলো সকলেই সমান সংগীতবোধঋদ্ধ, তবে একেবারে অনুল্লেখ্য গ্রুপটাও অনেক খুশিয়া দানিয়াছে আপনেরে এইটা আপনি স্বীকার যাবেন যদি-না আপনি বঙ্গীয় বুদ্ধিভেল্কিজীবিত্বে-মেকিত্বপূর্ণ বনেদের ধ্বজাবর্দার হয়ে ওঠেন ইত্যবসরে। ব্যান্ডমিউজিকের একসহস্র ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও আপনি যদি স্বীকারোক্তিভিত্তিক স্মৃতিচারণের আদলে সেই সময়ের সুরযাপন স্কেচ করে যেতে পারেন, তাতে করে আপনার নিজেরই বিকল্প ও অথেন্টিক অটোবায়োগ্র্যাফির পাশাপাশি মিউজিকের বাংলাদেশি রিসোর্সফ্যুল হিস্ট্রিটাও রচিত হবে, সেই স্মৃতিগুচ্ছ হয়ে উঠবে একটা সাংস্কৃতিক জাগৃতির দলিলায়ন; উপরন্তু নতুন দিনের বাংলাদেশের মধ্যবিত্তবলয়ের জনগোষ্ঠীর উন্মেষপর্বের মনমেজাজ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, স্বপ্ন-অভিলাষ-অভিপ্রায় জেনে নেয়ার কাজটাও হবে; সেইসঙ্গে এইটাও বোঝা যাবে যে সেই-সময়ের তারুণ্যসংগীতে কি কি মিসিং ছিল এবং কতটা কি ছিল অনবদ্যভাবে হাজির; শুধু ফিডব্যাক  নয়, — ফিলিংস, সোলস, মাইলস, এলআরবি, সিম্ফনি, তীর্থক, নোভা, চাইম, আর্ক, রেনেসাঁ, ওয়ারফেজ  প্রভৃতি অসংখ্য ব্যান্ডের সাহচর্যে প্রবাহিত হয়েছি আমরা সাবলীল মাছের ন্যায় সেই-সময়কার ফেনিল স্রোতে। একঝাঁক প্রজাপতির মতো উড্ডীন ছিলাম তুখা ধারালো রোদ্দুরের সেই শীতগুলোতে, সেই গ্রীষ্মগুলোতে, সেই বিব্রতমধুর বসন্তগুলোতে। সেই সময়খণ্ডটি নিয়া, আমি বলি কি, খান-তিনেক উপন্যাস লেখো জগতের জন্য, শরৎবাবু! অত্যন্ত সাধারণ আবেগের উপন্যাস, কোনো পণ্ডিতি শিল্পরূপের ধার না-ধেরে, পড়ে যেন চোখে পানি আসে আমাদের সেই নিখোঁজ ঘুড়িটার শোকে এদ্দিন বাদে, যেন গর্বও হয় একাধটু ওই নির্ঘোষ-বজ্র ব্যান্ডসময়ের বাসিন্দা ছিলাম বলে।

 

ম্যাক অ্যান্ড ফিডব্যাক ইন রেট্রোস্পেক্ট

ম্যাক যখন ফিডব্যাক থেকে বেরিয়ে সেল্ফ-টাইট্যল্ড ব্যান্ড গড়ে তুলছেন, মাকসুদ ও ঢাকা, সেই সময়ের গল্প এইটা। ম্যাক তথা মাকসুদুল হক সমভিব্যহারে ফিডব্যাক  থেকে শেষ অ্যালবাম সম্ভবত ‘বাউলিয়ানা’, নাকি সিঙ্গল্স অ্যালবাম ‘দেহঘড়ি’, আজ আর ক্রোনোলোজিক্যালি ঠিক মনে নাই; কিন্তু দুইটার একটাই ফিডব্যাক  থেকে ম্যাকের প্রস্থানপূর্ব পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতির চিহ্নবহ; দুইটাতেই ম্যাকের সিগ্নেচারমার্ক সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য, বলা বাহুল্য। পরবর্তী ইতিহাস ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের; সেই ইতিহাস আরও ঝড়ো, উইন্ডি, ফিডব্যাকমুক্ত নতুন পর্যায়ের মাকসুদ লিরিক্স ও রেন্ডিশন সবদিক দিয়েই পোলিটিক্যালি অনেক বেশি ইনভোলভড, এনগেইজড, মনে হয় যেন নোঙর ও নিশানা সম্পর্কে আগের চেয়ে ঢের বেশি ডিফাইনড। বলা বাহুল্য, মিউজিক্যালিও নতুন পর্যায়িক মাকসুদ নিজের অভিপ্রেত ধরনে আগের চেয়ে অনেক বেশি এনরিচড।

বহুকালের গাঁটছড়া ফিডব্যাক  থেকে বেরোনোটাও কোনো দলকোন্দলগত কাজিয়াফ্যাসাদ থেকে নয়, যেমনটা ব্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রে হামেশা হয়ে থাকে দেখতে পাই, — বিটলসের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গেছে যে ব্যবসায় এবং ব্যক্তিগত অহংসাংঘর্ষিক দ্বন্দ্ব দানা বাঁধার ও পুঞ্জীভূত হবার অবধারিত ফল হিশেবে ব্যান্ড ব্যাহত হয়ে গিয়েছিল সম্পূর্ণত, — ফিডব্যাক-মাকসুদ পৃথগন্ন হবার ঘটনায় তেমনতর কোনো দ্বৈরথ গরহাজির। স্মারকবিহীন সমঝোতার মধ্য দিয়ে, মেমোরান্ডামবিহীন আন্ডার্স্ট্যান্ডিঙের মাধ্যমে, ম্যাক এবং ফিডব্যাক  আলগ রাস্তায় গিয়েছিল। ফলে এখনও অল্পপ্রাণ হলেও ফিডব্যাক  নিজের কায়দায় গান করে চলেছে কালেভদ্রে, এবং অত্যন্ত স্বল্পপ্রজ হলেও ম্যাক নিজের স্বভাবজ ক্রোধে ও বেদনায় নিভু নিভু আঁচে আগ্নেয় আভামণ্ডিত; সময় এবং প্রকৃতির নিয়মে উভয়েতে সেই সৃষ্টিনির্ঝরের উৎরোল উন্মাদনা নাই যদিও। তবে ম্যাকের নতুন অ্যালবাম প্রোডাকশনের খবর, বহুদিন গ্যাপে এই ২০১৫ সালে এসে, শোনা যাচ্ছে; এইটা আশার বার্তা আমাদের জন্য, ওল্ডি-গোল্ডি মিউজিক ও মিউজিশিয়্যানের সমুজদারদের জন্য বিশেষত, সন্দেহ নাই। ফিডব্যাক  ও মাকসুদ রিয়্যুনিয়ন হয়েছিল ১৪২২/২০১৫ বৈশাখে ‘মেলা’ গানের পঁচিশ পূর্তি উপলক্ষ্যে সেলেব্র্যাশন্যাল পার্ফোর্ম্যান্সের সময়। এর বাইরে ম্যাকের সাম্প্রতিক কাজের নমুনা হিশেবে আমরা অনলাইনে-রিলিজড ‘শব্দচিত্র’ শীর্ষক প্রোজেক্টের আন্ডারে গোটা-চারেক গান সামনে পাচ্ছি, যেখান থেকে ‘যুগের মন্ত্রণা’ নামের একটা গানচেষ্টা হাতে নিয়ে একবার খুঁজে দেখতে চেষ্টা করব পুরানা ধারায় গেয়ে ম্যাক কোথায় পিকিয়্যুলিয়্যর ঝামেলাটা পাকাচ্ছেন। অবশ্য যদি সুযোগ পাই এবং সময়ে-সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারি, মিজাজমর্জি লিখনানুকূল থাকে, তবেই কিছু কম্পোজিশন নিয়া ম্যাকের পূর্বাপর ঔৎকর্ষতুলনামূলক সমীক্ষাটা চালাব। সঙ্গে ফিডব্যাক-অনোয়ার্ডিং ম্যাকের রচনাচেষ্টা, ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ এবং ‘গরিমা গানের দল’ উভয় ভেঞ্চার নিয়া, খানিকটা আলাপালোচনা আসবে প্রসঙ্গপাকেচক্রে। এ-যাত্রা এরচেয়ে বেশি পারা যাবে না মনে হয়।

অ্যানিওয়ে। ফিডব্যাক  থেকে ম্যাক বেরিয়ে এসেছিলেন, পত্রিকান্তরে ম্যাকজবানিতে যেমনটা আমরা জানতে পেরেছি সেই-সময়, নিজের ধরনে সংগীত রচনা ও আপন মেজাজের অনুকূল সাংগীতিক যাপন জারি রাখবার গরজে। ম্যাক চাইছিলেন ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ পর্যায়ের নিরীক্ষাসাফল্য অভাবিত জনগ্রাহ্য হবার পরে পেছন ফিরে ফের মেইনস্ট্রিম বাংলা ব্যান্ডগুলোর রম্যরোম্যান্স চালায়ে না-যেয়ে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড স্ট্রং পোলিটিক্যাল লিরিক্স প্রণিধানে রেখে ব্যান্ডটা পার্মানেন্টলি রিওরিয়েন্ট করাতে। এইখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার হবে যে, ম্যাক সবসময় ফিডব্যাকে প্রেমরোম্যান্সমূলক মিউজিকের পাশাপাশি বিদ্রোহদ্যোতক জনচৈতন্যের গানও করে আসছিলেন। মুখ্যত ফিডব্যাক  যাত্রাশুরু থেকে এতাবধি ভিন্নতাবাহী মিউজিক্যাল গ্রুপ হতে পেরেছিল রোম্যান্সগানের জন্য নয়, দ্ব্যর্থহীন কথাটা আজ কবুল করে নেয়া বাঞ্ছনীয়, এত দ্রুত ও অতি দীর্ঘদিনব্যাপী ফিডব্যাক  শ্রোতার কাছে মান্যতা পাবার পেছনে তাদের সেমিপোলিটিক্যাল লিরিক্সের নাম্বারগুলোই ছিল অনুঘটক। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ পর্বে এসে এইটা আরও জমিজিরেত পেয়ে যায় যে, হ্যাঁ, ব্যান্ডের এই দিকটাকে ক্যাশ করে এগোনো সময়েরই ডিম্যান্ড। বঙ্গাব্দসফলতার অব্যবহিত পরে ‘দেহঘড়ি’ ও ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবামদ্বয় ফিডব্যাকের ফোক-ফিউশনভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ দুইটা কাজ, জনপ্রিয়তাও জুটিয়া যায় ব্যাপক, তখন পর্যন্ত সংকলন-দুটো পথিকৃতের দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালিক বাংলাদেশে ব্যান্ডগ্রুপগুলোর একচেটিয়া কাজকাম-ধ্যানজ্ঞানই হয়ে ওঠে এই ফিডব্যাকের ফোক-ফিউশনসাফল্য ফলো করে দেদারসে অ্যালবাম করা। আর ফোক-ফিউশনের নামে স্রেফ রিমেইক-রিমিক্সই রিলিজ পেতে থাকে ক্যাসেটকোম্প্যানিগুলোর কম্যার্শিয়্যাল উস্কানি ও আস্কারায়। ব্যান্ডসমূহ খোয়াতে থাকে তাদের নিজেদের ল্যান্ডমার্ক। মৌলিক গানবাজনা প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সম্বিৎ ফিরে এলে ব্যান্ডদের আর কিছুই করার থাকে না। তা, এগুলো অবশ্য অনেকটা বাদের ব্যাপার, তক্ষুণি ঘটেছে এমন নয়। এবং অত্যন্ত সরলীকৃত বর্ণনাভাষ্য হয়ে গেল যদিও, সংগতি ও সময়সাধ্য অত্র নিবন্ধে অল্প, অগত্যা।

তারপর ফিডব্যাক  যখন নতুন অ্যালবামের জন্য প্রস্তুতি নিতে গেল, দু-দুটো ফোক-ফিউশন অ্যালবামের সাফল্য উপভোগের উদ্গার শেষে, ম্যাক তখন চাইলেন ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ পর্বান্তরের কন্টিন্যুয়েশনটাকে আরও অধিকতর অভিপ্রায়ের কাছাকাছি নিয়ে যেতে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, ম্যাক রাজনৈতিক ধারার অর্থসংগতিশীল গানপ্রাধান্য রাখতে চাইলেন নতুন প্রস্তাবিত প্রকল্পের অ্যালবামে। এবং স্বাভাবিক কারণে ব্যান্ডের পক্ষে এতটা হার্ডকোর পজিশনে যাওয়া সাধ্যি থাকলেও সাধে বাধ সাধল। সহজেই অনুমেয় মতদ্বৈধের/মতানৈক্যের কারণগুলো, তবে এখানে সেসবের ঝাঁপি খোলা বাহুল্য। সংক্ষেপে ব্যাপারটা আসলে এ-ই হবে যে, ম্যাক যতটা আউটস্পোকেন, ব্যক্তিগত ও শিল্পাদর্শিক জীবনযাপনে, ম্যাকের লিরিক্স মেইকিং ও রেন্ডারিং যতটা রাজনৈতিক রকধারার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ, অন্যদের ততটা না, বা ব্যান্ডের অন্য ভোক্যাল যারা তাদের সঙ্গে ব্যাপারটা আদতেই যায় না। কাজেই বিরোধ ভঞ্জনের সোজাসাপ্টা রাস্তাঘাট ছিলও না সেক্ষেত্রে। ম্যাকই রিস্ক নিলেন, বেরোলেন, অন্তত দুইটা অ্যালবামে সেই নিজস্ব অভিপ্রেত সড়কে হেঁটে গেলেন লড়াকুর দর্পে। এবং এইসব কথাবার্তা আমরা খানিকটা আন্দাজ করে বলছি, কিছুটা ম্যাক-ফিডব্যাক  উভয়ের জবানিভাষ্য যট্টুকু মনে পড়ে সেই নিরিখে বলছি, বিশদাংশ অনুসিদ্ধান্ত করে নিচ্ছি ম্যাক ও ফিডব্যাক  উভয়ের আলগ আলগ রাস্তায় হাঁটার ট্র্যাক দেখে, ট্র্যাকরেকর্ড দেখে, ম্যাক-ফিডব্যাকের পৃথক জমিনে ফলানো শস্যের সফলতা ও নিষ্ফলতা গ্রাহ্যিগণনায় রেখে। এর মানে, হাইপোথিসিসেরও হাইপোথিসিস; হ্যাঁ, নিঃসঙ্কোচে যাহা সত্য তাহা স্বীকার্য। এম্পিরিক্যাল নজর দিয়ে দেখে এই নিবন্ধের সম্ভাব্য গোচরকারী বিরল ব্যান্ডসমুজদারেরা হাইপোথেটিক্যাল অত্র কথাকারের বারোটা বাজাবেন অথবা নিজদায়িত্বে থিসিসে হেল্প করবেন।

তো, গড়ে ওঠে ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ড; পুরনো দলসঙ্গীদের মধ্যে সেকান্দার খোকা থাকেন, সেকান্দার আহমেদ খোকা, বাকি সবাই নতুন। অনেকটাই রেপোর্ট্যারি থিয়েটারের অ্যাপ্রোচে যেন অনিয়মিত-ধারাবাহিক দলের মিউজিশিয়্যান লাইনআপ। প্রথম অ্যালবাম ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ অর্জন করে ব্যাপক শ্রোতানুকূল্য ও দৃশ্যত সমালোচকপ্রিয়তা। মাকসুদ বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতপরিমণ্ডলে এহেন বৌদ্ধিক চূড়ায় আরোহণ করেন যা কি-না আদ্যোপান্ত অভাবিতপূর্ব। পরের প্রোজেক্ট ডিক্লেয়ার করা হয় ‘রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০’, অধীর আগ্রহ ছিল মাকসুদ-অনুরাগীদের এই অ্যালবামটা নিয়া, যদিও সংকলনটা আলোর মুখ দেখে নাই ফাইন্যালি; কিন্তু পথিমধ্যে এসে গেছিল ‘ওগো ভালোবাসা…’ নামশীর্ষক একটা আশ্চর্য সংকলন, বাংলা ব্যান্ডগানের মণ্ডলে এই অ্যালবামটা নানা কারণেই সিগ্নিফিক্যান্ট; গদ্যস্পন্দী লিরিক্সের বঙ্গীয় ইতিহাসে এই অ্যালবাম উল্লেখযোগ্য হয়ে রইবে বহুকাল পর্যন্ত। যদিও ‘ওগো ভালোবাসা’ ব্যাপক আলোচিত ও অবজ্ঞাত হয় বিস্ময়কর কারণে, রবীন্দ্রনাথের একটা গানের সংগীত ও সুর বিকৃতির অভিযোগ তুলে ম্যাকের ঘুমনিদ্রা হারাম করে দেয়া হয় এদেশের কথিত শুদ্ধসংগীত ও মঞ্চনাটক ও পত্রিকা-টেলিভিশন ইত্যাদির বিজ্ঞাপনী পৃষ্ঠপোষণার দালাল মহলের প্রকাশ্য কলকাঠিকৃত্যে। ম্যাক অলিখিতভাবে ব্যান্ হয়ে যেতে থাকেন সর্বত্র, অলমোস্ট, এমনকি নিজের বিচরণক্ষেত্র তথা ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন বামবায়। ম্যাকের এহেন অবমাননার বরাতে সেই-সময় বাংলাদেশের ফাঁপা সাংস্কৃতিক জগতের একটা আমূল স্ন্যাপশ্যট দেখা, শোনা ও বোঝা সারা হয়েছিল আমাদের। সেসব অবশ্য অন্য গল্প।

অনেক ঘটনা পাশাপাশি এবং উপর্যুপরি ঘটতে থাকে দ্রুত। সংক্ষেপে, ম্যাক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিজ্ঞাপনত্রাতাগোষ্ঠীর ফড়িয়াদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়ার খোলা আহ্বান সত্ত্বেও ক্ষমা না-চেয়ে উল্টো সোচ্চার হয়ে উঠতে থাকেন উত্তরোত্তর, কয়েদখানায় যেতে হয়, দীর্ঘ চারদিন-চাররাত কয়েদ খেটে বেরিয়ে এসে একপ্রকার লাইফ অ্যান্ড ডেথ ট্র্যানজিশন্যাল ট্রমার ভিতর দিয়ে যেতে হয় ম্যাকেরে; এইসব আমরা জানতে পেরেছি অনেক বছর পরে; সেই সময়টায় ম্যাক ও তৎসম্পর্কিত সমস্তকিছু ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়। এ-সময়ের কাজের মধ্যে একটা একক অ্যালবাম করেন সম্ভবত অডিয়োকোম্প্যানির ব্যবসাস্বার্থ ও বিপণনশর্ত মেনে, সেই অ্যালবাম ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ ম্যাকের গলাটা ছাড়া আর কিছুই দিয়া যায় না আমাদেরে, ম্যাকের ফুরনো দশা ভেবে আমরা শঙ্কিত হই, অনেকদিন ম্যাকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না, আবার প্রত্যাবর্তন ‘মাআরেফাতের পতাকা’ শিরোনামে একটা আশাব্যঞ্জক নতুন সংকলন দিয়ে, যেখানে ম্যাকের সুফি টিউন করার প্রবণতা আরেকটু খোলতাই হবার মওকা পায়, যা আগের সেই ‘…নিষিদ্ধ’ পর্যায় থেকেই কিছু গানে টের পাওয়া যাচ্ছিল। সুফি টিউনের আলতো স্পর্শচিহ্ন ‘…নিষিদ্ধ’ এবং ‘মাআরেফাতের পতাকা’ থেকে গোটা-তিনেক গান চয়ন করে একবার দেখার চেষ্টাটা করা যাবে হয়তো।

সর্বোপরি, ইন-জেনারেল আমাদের স্যুইপিং অব্জার্ভেশন এ-ই যে, স্তিমিত হয়ে যেতে থাকে ম্যাক-ব্যানিং কন্সপিরেইসির তলে তলে এতদঞ্চলের গোটা ব্যান্ড-অ্যাক্টিভিটি। নিছক স্বচক্ষে দেখাজাত অনুমিতি ইত্যাকার পর্যবেক্ষণগুলো। কোনো প্রাইম্যারি কি সেকন্ডারি লিট্রেচার রিভিয়্যু নয় এর উৎস। ফলে এগুলো ওইভাবেই বিবেচ্য, পাঠকের স্ববিবেচনা খাটিয়ে, পর্যবেক্ষকের সতর্ক অভিনিবেশে। এই নিবন্ধভাষ্যকারের বীক্ষণপ্রেক্ষণী কিয়দংশও ভরসাযোগ্য হতে পারে কি না তা পাঠকের বিচার-অপেক্ষাধীন।

 

নতুন গানের বারুদ ও মাকসুদ

অঞ্জন দত্ত ও মাকসুদুল হক তখন পরস্পরের ভালো বন্ধু, সম্ভবত বন্ধুত্ব অটুট এখনও, সুমন অবশ্য উনার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ফিডব্যাক ও ম্যাকের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখলেও অচিরে ভেস্তে যেতে দেখি সম্পর্ক। সুমন ও অঞ্জন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে গান গেয়ে সেই-সময়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন এবং ছোট্ট সেই প্রাদেশিক গণ্ডি পেরিয়ে তাদের গানবাজনা বাংলাদেশের বৃহত্তর বাজারেও দোকানের তাকিয়া জুড়তে শুরু করেছে। সুমনের ‘তোমাকে চাই’ দিয়া ক্যারিয়ার শুরু ১৯৯২ সালে এবং অব্যবহিত পরে এইচএমভি  থেকেই রিলিজ পায় একে একে নচিকেতা, অঞ্জন, মৌসুমী প্রমুখ অনেকেরই অ্যালবাম। ‘তোমাকে চাই’ রিলিজের আগেই ফিডব্যাক  বাংলাদেশের বাজার ও ব্যান্ডশ্রোতাদের শ্রবণহৃদয় অক্যুপাই করে নিয়েছে তাদের ‘ভল্যুম্ ওয়ান্’ ছাড়াও ‘উল্লাস’, ‘মেলা’ প্রভৃতি অ্যালবাম দিয়ে এবং সুমনজন্মের আগে এইচএমভি কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ইন্ডিয়ার বাংলাবাজারে নতুন গানের নমুনা দেখিয়ে সেরেছে তাদের তখন-অব্দি-হিট-নাম্বারগুলোর অ্যান্থোলোজি ‘জোয়ার’ দিয়ে। এই ইতিহাস সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর সুমন হয়ে-ওঠার অন্তর্বর্তীকালে সুমনেরই আভিজাত্যভরা বাগাড়ম্বর আর আমাদের বিদেশপ্রীতিজনিত জন্মগত প্রতিবন্ধিত্বের কারণে আলাপের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। এহেন অনাকাঙ্ক্ষিত উল্টাপাল্টা ধারাবাহিকতার এক-পর্যায়ে অঞ্জন দত্ত পয়লাবারের ন্যায় বাংলাদেশে গাইতে এসে একটা গানসংকলন করেন ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ শিরোনামে এবং সেখানেই পাওয়া যায় “একটা পাগল হাওয়া আমায় হাতছানি দ্যায় / হয়তো ঢাকা থেকে আমার মনকে মাতায় / হয়তো হঠাৎ খুঁজে-পাওয়া নতুন গানের বারুদ / হয়তো মাকসুদ” ইত্যাদি লাইনসম্বলিত রচনা। মাকসুদ তখনও ফিডব্যাক  ছাড়েন নাই, রিলিজ পেয়ে গেছে ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ এবং ‘বাউলিয়ানা’ ইত্যাদি। কিন্তু শুধু অঞ্জনই নন, ফিডব্যাক  ও মাকসুদ এবং বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক নিয়া ভারতীয় নতুনগানের অনুশীলক অনেকেই কৃতজ্ঞচিত্ত মন্তব্য করেছেন গোড়ার দিকে, এদের মধ্যে নচিকেতার ফিডব্যাকমুগ্ধতা ও ঋণস্বীকারের প্রসঙ্গ পরে এক-সময় আমরা আলাপে আনব। সুমন ছাড়া বাকি সকলেই মোটামুটি বাংলাদেশের সেই-সময়ের ব্যান্ডসৃজনশীলতার ব্যাপারটাকে অ্যাক্নোলেজ করেছেন। শুধু ফিডব্যাক  নয়, অসংখ্য দলের গানবাজনায় বিলোড়িত সময় পেয়েছি আমরা ব্যান্ডগুলোর প্রায়-স্বীকৃতিবিহীন সৃজনোল্লাসের সুবাদে। একদিন সকলেই স্বীকার করবেন ভবিষ্যতে যে সেই-সময়ের ভারতীয় বাংলা আধুনিক গানে নতুন দিনের দিশারী হয়েছিল বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক। ফিডব্যাক  সেই-সময় সিগ্নিফিক্যান্ট রোল প্লে করেছিল বৈকি।

কিন্তু এইটাও কবুল করে নেয়া অবশ্যকর্তব্য হবে আমাদের তরফ থেকে যে, ম্যাক একা নন বা ফিডব্যাক একলাই নয়, সেই-সময়ে ম্যাকের সংগীতসতীর্থ সহযোদ্ধারাও বাংলাদেশের এই আশ্চর্য সংগীতোন্মাদনাকাল তথা সাংস্কৃতিক নবজাগৃতিটিকে পুষ্টি যুগিয়ে গেছেন যথাসাধ্য যার যার জায়গা থেকে। এবং বিচিত্র-সব তরিকায় তারা তাদের সেরা সময়টাকে ব্যয় করেছেন মিউজিকের কাজে, মিউজিকের ডেভেল্যপমেন্টে, কোনোপ্রকার কোনো অ্যাওয়ার্ড-রিওয়ার্ডের তোয়াক্কা না-করে, কোনো পরাক্রমীর থোড়াই পরোয়া করে। একটা বৈরী সময়েই ছিল তাদের উন্মেষ ও বিকাশ। সর্বোচ্চ সাধ্যি দিয়ে এবং শত তিরস্কার সয়েও সাংগীতিক সক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক দায়বোধ লগ্নি করে তারা তাদের কাজটা চালায়ে গেছেন। সাধ্যাতীত ভালোবেসেছেন অরুণ-বরুণ বাংলাদেশের বাংলা গানের বিস্ফোরণপর্বের পরিশ্রমপরায়ণ প্রতিকূল-অথচ-সম্ভাবনাদীপ্ত সময়টাকে।

কেউই ঠিক পুরস্কারমুখাপেক্ষী ছিলেন বলে মনে হয় না। বাস্তবিক পুরস্কার পানও নাই খুব-একটা। খানিকটা শ্রোতানুকূল্য পেয়েই তারা সন্তুষ্ট থেকেছেন, চতুর্গুণ উৎসাহে-উদ্দীপনায় জীবন্ত ও জারি রেখেছেন তাদের স্ট্রাগল। তখন, ওই সময়ে, প্রচারমাধ্যমের এতটাই স্ফীতি কল্পনাতেও ছিল না আজকের মতো। ফলে ব্যান্ডসংগীত সম্পূর্ণ আনুকূল্য ছাড়াই, প্রায় একলব্যের ন্যায়, নিজেই হয়েছে নিজের খড়কুটো ও মঞ্চ। শ্রোতানুকূল্য পেয়েছে নিঃশর্ত, অবশ্যই, হোক-না তা শাহরিক মধ্য/নিম্নমধ্য-বিত্তীয় বিশেষ-একটা শ্রেণি। কিন্তু ওই এক ক্যাসেটকোম্প্যানির বাণিজ্যিক কোলাবোরেশন ছাড়া আর-কোনো প্রতিষ্ঠানগত সহযোগ/কোঅপারেশন আমাদের এই নিরুপম সাংস্কৃতিক জাগৃতির পরিচ্ছদটা লাভ করেছিল বলা যাবে না। অ্যাক্নোলেজ্ করা হয়নি তখন, এমনকি আজও ওই-সময়ের অবদানটুকুর ফলভোগ করেও ওই বিশেষ বৃহৎ সময়টাকে অ্যাক্নোলেজ্ যথাযথ করা হচ্ছে না। ব্যান্ডসংগীত তথা মাকসুদের ভাষায় ‘বাংলা রক সংগীত’ আজও এক অব্যাখ্যাত কন্সপিরেইসি অফ সাইলেন্সের শিকার। এই-সমস্ত প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ধরে একদিন আমরা আলাপ উঠাইব অচিরে।

এইটা ঠিক যে ম্যাকের ন্যায় কেউই মিউজিকের বাইরে যেয়ে, উভয়ত ইন-বিটুয়িন অ্যান্ড বিয়ন্ড মিউজিক, ফ্রন্টলাইন কম্ব্যাট চালান নাই সেভাবে। ম্যাকই নিয়েছিলেন টু-প্রং ওয়ারস্ট্র্যাটেজি। যুগপৎ ভেতরে থেকে এবং বাইরে যেয়ে লড়াই। ম্যাকের ন্যায় লেখায়-লিরিক্সে-ডেমোন্সট্রেশনে একাট্টা লড়াই চালাতে সেই-সময়ে এবং এখনও পর্যন্ত ওইভাবে কাউকে দেখা যায় নাই। দ্বিতীয়রহিত ভূমিকা ম্যাকেরই একমাত্র এক্ষেত্রে। এরপরও সাংগীতিক সক্রিয়তা তথা গানে-বাদনে মেধা ও প্রতিভা ও সপ্রেম শ্রম বিনিয়োজনের ক্ষেত্রে ম্যাকের সময়ের সংগীতযোদ্ধারা, আমাদের ব্যান্ডসংগীত ম্যুভমেন্টের পুরোধা ও পথিকৃৎ প্রজন্মের শ্রদ্ধার্হ সদস্যরা, যার যার ভূমিকা পালন করে গেছেন সদলবলে এবং/অথবা একলা-একা। আজও চলেছেন তারা তাদের গানবাজনা দিয়ে ভূমিকা পালন করে ইত্যবসরে-স্ফীতকায় মিউজিক ও শোবিজ্ ইন্ডাস্ট্রির ক্রমবর্ধমান খাই মেটাতে। সেই উন্মাদনা অন্তর্হিত হয়তো-বা, প্রাকৃতিক নিয়মেই, তবু তারাই তো নব-কলেবর এই মিউজিক-শোবিজ্-এন্টার্টেইনমেন্ট ওয়ার্ল্ডের গোড়াপত্তনিকালটাকে পোক্ত করে চলেছেন তাদের অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। এই একদা-সম্মুখসারির-ব্যাটলশিপে নেতৃত্বদানকারী এবং অধুনা-নেপথ্য কর্মকদের অবদান স্বীকার করে নেয়া, যার যেটুকু প্রাপ্য তা তাকে দেয়া, কৃতকার্যের ভেতর থেকে গ্রাহ্যটুকু রেখে বর্জ্যটুকু অপসারণ করা, আমাদের কর্তব্য। দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের ইতিবৃত্ত রচনার কাজ শুরু হওয়া আশু দরকার।

যখন হবে কাজটা, বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের ইতিহাস ও আবহমান মূলধারা বাংলা গানে ব্যান্ডমিউজিকের কমপ্লিমেন্টারি ও কন্ট্রিবিউটরি পয়েন্টগুলো যখন সর্বসমক্ষে এক্সপোজ করা হবে, ম্যাকের গানপদাবলি ও অন্যান্য রচনাপত্তরগুলো, বং-ইং উভয় ভাষায় সমানতালে লেখা ম্যাকের আর্টিক্যলগুলো, অনুসন্ধিৎসু রকমিউজিশিয়্যান ও সংস্কৃতিচিন্তক সকলের কাছে একটা ভালো সোর্স বলে সমাদৃত হবে। এবং তখন উপকার হবে ব্যান্ড-ননব্যান্ড প্র্যাক্টিশন্যার সহ সব ধরনের সর্বপথের মিউজিশিয়্যানের, উপকৃত হবে সংগীতসন্ধিৎসু সমুজদারবর্গ, উপকৃত হবে গোটা বাংলা গান। কুয়োতলা থেকে বেরিয়ে একটু খোলা প্রান্তরে যেতে চাইলে এ-বাবতে একটা ইনিশিয়েটিভ তো নিতেই হবে আমাদিগেরে। এবং খুব বেশি দিরং হবার আগেই ইনিশিয়েটিভ নেয়া দরকার এই-কারণেই নয় যে ব্যান্ডের সেই স্বর্ণসময়ের রিসোর্স পার্সনবৃন্দ ন্যাচারালিই বিদায় নেবেন টুডে-অর-টুমরো, বরং এই কারণেই যে সেই সময়ের সংগীতোন্মাদনাটা আমাদের স্মৃতিধৃত; অচিরে আমাদের স্মৃতিও কন্ট্রোলে থাকবে না ধারক-বাহকের, সমস্তই ন্যাচারাল। ফলে স্মৃতিনির্ভর এই ইতিহাস মুসাবিদা করার কাজটা স্মৃতি বিকল হবার আগে, মেমোরি আমাদিগেরে বিট্রে করার আগেই, যার যার জায়গা থেকে শেয়ার করে নেয়া দরকার। এইটা যাকে বলে জরুরি ও জনগুরুত্বসম্পন্ন একটা দায়িত্ব বলেও অনুচিত হবে না ভাবা। আগামীদিনের মিউজিকম্যানিয়া জেনারেশন, নেক্সট-জেন রক্ রিসার্চার, যখন তাদিগের পূর্বসূরি প্রজন্মের সংগীতচারণ, সাংগীতিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ, বাংলাদেশের ফার্স্ট জেনারেশন রক্ মিউজিক তথা রক্ কালচার ও রক্ হেরিটেইজ বা আদি বাংলার রক্ লিগ্যাসি খুঁজতে যাবে, তখন যেন আমাদের আজকের এই স্মৃতিচারণগুলো ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং ভবিষ্যতের প্রোজেক্টগুলোতে কাঁচামাল হিশেবে কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারে। এমনিতেই আমরা কালের কাজ অকালে করেই ইউজড্-টু, সময়ের কাজ সময়ে না-সেরে পরে যেয়ে পস্তাতে প্রেফার করি আমরা, পস্তানো দিয়াই আমরা আমাদিগের শিল্পসাহিত্য ও প্রার্থনার সকল সময় পণ্ড করে চলি। সময় গেলে সাধনভজনপ্রিয় বলেই আমাদের জন্য লালন সাঁইজিকে একাধিক গানে ব্যাপারটা অ্যাড্রেস করতে হয়। এই জায়গাটা থেকে বেরোনোও দরকার।

 

ম্যাক, ফিডব্যাক, ব্যান্ডমিউজিক ও অন্যান্য পুনরীক্ষণ

মাকসুদুল হক, তথা ম্যাক, বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকে একমেবাদ্বিতীয়ম কিংবা যারপরনাই সিগ্নিফিক্যান্ট বলে অ্যাডজেক্টিভবাহী নিবন্ধ পয়দা আদৌ বক্ষ্যমাণ প্রতিবেদনপ্রণেতার লক্ষ্য না। বাংলা ব্যান্ডমিউজিকে গেয়ে-বাজিয়ে ক্রেজ তৈরি করেছেন, সফল হয়েছেন, উন্নত-স্বল্পোন্নত মিউজিক উপহার দিয়েছেন অনেকেই; শীর্ষসারির ব্যান্ডশিল্পীরা ছাড়াও দুইয়েকটা অ্যালবাম প্রকাশ করে পরে হারিয়ে-যাওয়া ব্যান্ডগুলোর অবদানও অনস্বীকার্য এক্ষেত্রে। ম্যাকের ইউনিক্ ফিচার এইখানেই যে এতদঞ্চলে ব্যান্ডগানের খোলনলচে এবং স্ট্রেন্থ-উইক্নেস-অপোর্চুনিটি-থ্রেট বুঝেভেবে এর সামগ্র্য প্রোস্পেক্ট নিয়া ভাবনাচিন্তা হাজির করেছেন আমাদের সামনে একলা হাতে। সেসব যতই কিঞ্চিৎ হোক, এখন অব্দি শহুরে বাংলা গান নিয়া মাকসুদ ছাড়া আর-কোনো মিউজিশিয়্যান নিজেদের বক্তব্য খোলাসা আনতে পারেন নাই আমাদের সামনে। ম্যাকের একটা মিশনারি জিল ছিল সবসময়, বাংলা রক মিউজিক নিয়ে, সেইটা গানের লিরিকে যেমন পরিস্ফুট তেমনি অন্যান্য গদ্যরচনায় এবং নানাবিধ কর্মকাণ্ডে ব্যক্ত হতে দেখি। নিয়ন্ত্রণমানসিকতা আমাদের বদরাজনীতিনিগৃহীত সংস্কৃতিবিকারের দেশে এখনও মূর্তিমান সঙ্কট হলেও তখনকার অবস্থা, আজি হতে মাত্র দশক আগে অব্দিও, — প্রায় নিবারণ-দুঃসাধ্য বলিয়াই পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হতো। আজকের আধিপত্য ও মনোপোলি মোড়লপনার চেহারা আলাদা। আর-যা-ই-হোক, এখন অন্তত গান গাইবার সুযোগের জন্য কোনো কোম্প্যানি কিংবা দাদামশাইয়ের দৌরাত্ম্য সহ্য করতে হয় না। চাইলেই এখন একজন তার আপন সৃষ্টির নজির হাজির করতে পারে মুক্ত হাওয়ামাধ্যমে। স্টারডম চাইলে অবশ্য অন্য রাস্তা, প্রায় আদিকালিক রাস্তাই, আলাদা ম্যাকানিজমের তালাশে তক্কেতক্কে থাকতে হয়। সেইটা আলাদা মামলা।

ব্যাপারটা এ-ই যে, ম্যাক আজ থেকে দেড়-দশক বা তারও বছর-কয়েক আগে এই বিষয়াশয় নিয়ে ভীষণ সোচ্চার হয়েছিলেন এবং নিজের ক্যারিয়ার সর্বার্থেই বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে একলা-একাই নিজের লড়াইটা চালায়ে গেছেন। লড়াই চালায়েছেন তিনি লিরিক্স দিয়ে, স্টেজ-পার্ফোর্ম্যান্স দিয়ে, এবং লেখালেখি সহ বামবাকেন্দ্রিক ও বামবার বাইরে ব্যক্তিক অবস্থানগত সক্রিয়তা দিয়ে। এই-সমস্ত সোচ্চার সব্যসাচী ক্রিয়াশীলতায় ম্যাক বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকটাকে একটা ম্যাচিউর প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যেতে সেই-সময় সিগ্নিফিক্যান্ট ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। আমরা তার একলষেঁড়ে লড়াইদিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি অনেকেই নিশ্চয়।

মাকসুদুল হক নিজের তৈরি লিরিকে এবং সুর ও সংগীতাবহ রচনায়, এবং তৎপ্রণীত অন্য সমস্ত রচনাদিতে, মিউজিক্যাল সেন্সিবিলিটির পরিচয় রেখেছেন পদে পদে। এমনিতে অবশ্য দলের কাণ্ডারি ফুয়াদ নাসের বাবু, যদ্দিন ম্যাক ফিডব্যাকে ছিলেন, সংগীতযোজনার কাজটা টিমওয়ার্কের মাধ্যমেই করা হতো এবং ফুয়াদ নাসের বাবু মিউজিক-অ্যারেঞ্জার হিশেবে একজন জিনিয়াস্ কথাটা আদৌ অসত্য নয়। ম্যাক বাংলা গানে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে বাবুকে মেন্টরের মর্যাদায় স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন আগাগোড়া। বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলোর ভিতর নিত্য ভাঙনঘটনার সময়ে এই ফিডব্যাকের বাইরে রেনেসাঁয় ডিসিপ্লিন্ ছিল শ্রদ্ধার্হ। অন্যান্য বড় দলগুলোতে ব্যান্ডলিডার বলতেই ছিলেন সাধারণত ভোক্যাল যিনি তিনিই এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যান্ডলিডার তথা লিডভোক্যালের প্রাধান্যজর্জরিত; ফলে ব্যান্ডের স্বাভাবিক বিকাশ মন্থর হবার ঘটনা আমাদেরও অগোচরে রইত না। ফিডব্যাক এক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটিক আচরণ বজায় রাখার দিকেই নিবিষ্ট ছিল লক্ষ করেছি। মিনিমাম্ কন্ট্রিবিউশন করেছেন যিনি তিনিও সমান মর্যাদায় টাইটেলকার্ডে অ্যাক্নোলেজড হয়েছেন সবসময়। ম্যাক নিজে কোনো যন্ত্রবাদন/যন্ত্রায়োজন না-করেও, গ্রুপলিডার না-হয়েও, মুখপাত্রই ছিলেন ব্যান্ডের শুধুমাত্র দলমধ্যস্থিত গণতান্ত্রিকতা আর সংগীতবোধের প্রতি ব্যান্ডমেম্বারদের নিরঙ্কুশ সমীহ ও শ্রদ্ধা থাকার কারণেই।

ফিডব্যাকে ম্যাক মুখ্য কণ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অন্যরা প্রায় সমসংখ্যক গানে কণ্ঠলগ্নির সুযোগ পেয়েছেন। লাবু রহমান অন্যরকম অসাধারণত্ববহ কণ্ঠবৈভবের অধিকারী শিল্পী, গিটারলিড দিতে লাবু রহমানের জুড়ি মেলানো ভার। ফিডব্যাকের হিট নাম্বারগুলোর মধ্যে এমন কয়েকটা গানে লাবু রহমান এতটাই মিশে-যাওয়া গায়ন উপহার দিয়েছেন যে সেই গানগুলো লাবু ছাড়া আর-কারো কণ্ঠে কল্পনাই করা যায় না। ‘আশা’, ‘বিদ্রোহী’, ‘ওগো ছোট্ট পাখি’ ইত্যাদি ছাড়াও লাবু রহমানের কণ্ঠে তোলা গানগুলো নিয়া আমরা আলাদাভাবে একসময় নিশ্চয় আলাপ জুড়তে পারব। শুধু লাবু রহমান নন, ম্যাকের বাইরে পিয়ারু খানও কণ্ঠ দিয়েছেন প্রত্যেকটা অ্যালবামে একাধিক পূর্ণাঙ্গ গানে; যদিও পিয়ারু খানের কণ্ঠ কোনোদিনই ঠিক সবল অথবা সুরেলা কোনোভাবেই কোনো বৈশিষ্ট্যবহ কণ্ঠ মনে হয় নাই, রিদম প্রোগ্র্যামিং করতেন দক্ষ হাতে, কিন্তু সমান অংশগ্রাহী হিশেবে দুর্বল-কণ্ঠে-মানানসই গানগুলো পিয়ারুকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছে প্রত্যেক অ্যালবামেই। কিবোর্ড বাজাতেন দলনেতা ফুয়াদ নাসের বাবু এবং বেসগিটার ধরতেন সেকান্দার আহমেদ খোকা। অ্যালবামগুলোতে তখনকার প্রচল রীতি মোতাবেক বারো থেকে চোদ্দটা গান থাকত; এর মধ্যে ম্যাক বড়জোর পাঁচটা বা বেশি হলে ছয়টা গান নিজে গাইতেন, বাকি গানগুলো লাবু-পিয়ারু ছাড়াও সবাই ভাগেযোগে গেয়ে উন্মাদনাটা উদযাপন করতেন শ্রোতাদের সঙ্গে।

লেখালেখিতে ম্যাক একটা লম্বা টাইম ধরে সক্রিয় দেখতে পাই। সেসব লেখায় মিউজিক নিয়া যতটা-না বলেছেন ম্যাক তারচেয়ে বেশি সোচ্চার থেকেছেন সংস্কৃতিপৃথিবীতে বিদ্যমান অধিপতি-মনোভাব নিয়া, আগ্রাসন নিয়া, এইসব উদ্ভটত্ব ও উদ্ভট উটেদের বিরুদ্ধে ব্যয় করতে হয়েছে ম্যাকের সেরা সময়টা। আরেকটা ব্যাপারে ম্যাকের বেদনাটা, তার বেদনাপূর্ণ স্ফুলিঙ্গসদৃশ অসহায়-নিরুপায় ক্রোধ আমাদের নজর এড়াবে না নিশ্চয়, সেইটা আর-কিছু না আমাদের অন্যাধীনতা ছাড়া; আমাদের নিজেদের ভালোটুকু ওভার্ল্যুক করে, ছিঁবড়ে বানায়ে নিয়ে নিজেদের রসালো ফলগুলোকেও, অন্যের ফেলনাগুলো উদযাপন করা, অন্যের ভূষিমালগুলোকেও সমারোহে ক্ল্যাপ উপহার দেয়া, নিজের অবনমনের বিনিময়ে অন্যতোষণ করা; আমাদের নিজেদের তাকত ও হিম্মত নেগ্লেক্ট করে, নিজেদের খাসা ঘরটাকে ইগ্নোর করে অন্যের কাঁচাঘরটাকে হেইল করার বিকট মানসিকতা; আমাদের যেন আদ্দত হয়ে গেছে এইটা। আর এইসবের বিরুদ্ধে ম্যাকের ঘর-খোয়ানো কুস্তি আমরা দেখেছি। বিদ্যমান উৎকটতা আর অজভূতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তখনকার পার্সপেক্টিভ থেকে দেখলে এই প্রোটেস্ট কতটা জরুরি ছিল বোঝা সহজ হবে। ম্যাকের গানে এবং অন্যান্য রচনায় স্থিত এই বেদনার জায়গাটা আজও বহাল কি না সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক আমাদের সাধের জনপরিমণ্ডলে, এই দিকটা বেখেয়ালে আনপড় যেন না-রাখি আমরা। কালচারাল হেজেমোনি নিয়া আজকের দিনের থিঙ্কার যারাই ভাবনাভাবনি করেন, তাদের জন্য ওই-সময়ের ব্যান্ডমিউজিক নিয়া কাগুজে-মুদ্রণমাধ্যম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগত পরিসরগুলোর বিহেইভিয়্যরাল অ্যাটিট্যুড সমীক্ষাযোগ্য উপাদান গণ্য হবার কথা। মাকসুদের যাবতীয় কথালাপে, সৃজিত সংগীতের বাণীমঞ্জরিতে, লেখায়-ইন্টার্ভিয়্যুতে এইসব আধিপত্য ও আগ্রাসন ও অবনমন নিয়া প্রভূত তথ্য-উপাত্ত-পরিস্থিতিচিত্র সুলভ। মাকসুদুল হকের এ-বাবতে প্রচুর লেখাপত্র ছাপা হয়েছে মূলত ইংরেজি ভাষায় দেশের ডেইলি ও উইকলি/ফোর্টনাইটলি সাপ্লিমেন্টারি ম্যাগাজিনগুলোতে। বাংলাতেও হয়েছে। ‘ডেইলি স্টার’, ‘দি নিউ এজ’, ‘অবজার্ভার’ প্রভৃতি দৈনিক কিংবা ‘ঢাকা ক্যুরিয়্যার’ প্রভৃতি ইংরেজি সাপ্তাহিক-পাক্ষিকের পুরনো আর্কাইভ ঘাঁটলে এ-ধরনের লেখাগুলো পুনরুদ্ধার করা যাবে, যেমন বাংলা সাময়িকপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চলতিপত্র’, ‘আনন্দভুবন’, ‘প্রতিচিত্র’ প্রভৃতি। প্রকাশকাল নব্বইয়ের মধ্যপাদ থেকে মোটামুটি শেষপাদ পর্যন্ত। একটা বই বেরিয়েছিল সেইসময় মাকসুদুল হকের, বাংলায়, ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ শিরোনামে, এখন বইটা আরও বড় কলেবর নিয়ে বেরিয়েছে বেশ-অনেকদিন আউট-অফ-প্রিন্ট থাকার পরে। রিসেন্ট অনলাইনযুগে এসে ম্যাকের প্রচুর লেখাপত্র পড়ার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে বেশকিছু অনলাইন-অফলাইন পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য কয়েক ব্লগস্পটে। ফেসবুকের ইন্ডিভিজুয়্যাল পেজে এবং ফ্যান পেজে এক-নজরে যে-কেউ ফলো করে যেতে পারেন ম্যাকের সাম্প্রতিকতা।

পাক্কা দুই দশকের ঘরগেরস্তালি পিছে ফেলে ম্যাক যখন ফিডব্যাক  ছেড়ে বেরোলেন, সতর্ক অভিনিবেশে সেই সময়টা আমরা লক্ষ করব। প্রচুর ঘটনার সমাগম হতে থাকে ম্যাকেরই ঠোঁটকাটা আচরণে, ম্যাকের কাজকর্মের অবধারিত জের হিশেবে, এবং ব্যতিব্যস্ত কত্তাসাহেবদের কারসাজিতে। এই কত্তারা আমাদের আবহমান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রদীপজ্বালানো পায়রাবিলাসী চেনাজানা সাহেববাবু সকলে। ম্যাক আদাজল খেয়ে নামেন আস্তিন ও পাৎলুনপ্রান্ত গুটায়ে। উইন্ডি লিরিক্যাল অ্যালবাম বের করেন নতুন ব্যান্ডের ব্যানারে। এবং লক্ষণীয়, নতুন ব্যান্ডের নামকরণকালে নিজনামের প্রথমাংশ যুক্ত করেন ব্যান্ডনামের সঙ্গে কোনো ভনিতা না-রেখে, লুকোছাপাহীন। যদি বিপদ আসে, তখন যেন দলভুক্ত অন্যদের হুজ্জৎ পোহাতে না-হয়, এইটা একটা কারণ হতে পারে ব্যান্ডের নাম ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ রাখার পেছনে; এবং তা-ই হয়েছে, বিপদ হুড়মুড়িয়ে এসেছে, একলা সামলেছেন ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে। এরপর আলাদা প্ল্যানের আরেকটা গানদল গড়েন ‘গরিমা গানের দল’ শিরোনামে, সেখানেও প্রবণতা দেখে এইটা আর অস্পষ্ট থাকে না যে, ম্যাক বাংলাদেশের ব্যান্ডদলগুলোতে একনায়কাধিপত্যে জেরবার হয়েছেন, ভুগেছেন অনেক, ভিতর থেকে ব্যামো বুঝতে পেরেছেন, এবং ফাইন্যালি রাখঢাকহীন নিজের বন্দুকটা নিজের স্কন্ধে নিয়া আউট-ল্য হবার পথ বেছেছেন।

 

ওয়াইল্ড উইন্ড

মঞ্চে গেয়ে ক্রেইজি জেনারেশনের ফেব্রিট রকস্টার হবার দিকে ম্যাকের তাগিদ আদৌ জোরালো ছিল লক্ষ করি নাই, তিনি বরঞ্চ গোটা ব্যান্ড কন্সেপ্টের ডেভেল্যপমেন্টে চেষ্টাশীল সবসময়; ব্যান্ডমিউজিকের ভেতরে দেশ ও দুনিয়াটা আরও পরিণত উপায়ে ক্যাপ্চার করা, গানের মিউজিক্যাল এবং লিরিক্যাল ইন্টেন্সিটি উত্তরোত্তর বাড়ানো, প্রাযুক্তিক পরিসর ও কন্সার্টের মঞ্চসুবিধাদি বৃদ্ধিকরণের জন্য তৎপরতা ছাড়াও স্বদেশস্থ বৈচিত্র্যপ্রয়াসী ইয়াং পপ্যুলেশনের পক্ষে একপ্রকার স্পোক্সপার্সোনের ভূমিকায় ম্যাকের এনগেইজমেন্ট ও অ্যাক্টিভিটিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ধর্তব্য। অডিয়োকোম্প্যানিগুলোর আর্টিস্ট-এক্সপ্লোয়েটিং মনোপোলি বিজনেসপোলিসি নিয়া ম্যাক যেমন সোচ্চার ছিলেন, তেমনি মিউজিকের পাইরেসি নিয়াও কথা বলেছেন, সরেজমিন কাজ করেছেন এই ইশ্যুগুলোতে, ফ্যাসিলিটেইট করেছেন গোটা ব্যান্ড ম্যুভটাকে।

ম্যাকের ক্রেইজ্ তখন ছিল সর্বশীর্ষে, স্টেজে এবং টেলিভিশন-শোগুলোতে সমান তালে, এবং ফিডব্যাক সবসময়ই ছিল সচেতন মিউজিকের অনুশীলক ও সময়চৈতন্যবহ সংগীতধারার প্রসারপ্রয়াসী ব্যান্ড। তখনও ‘ফিলিংস’ তথা জেমস সেভাবে জনপ্রিয় হন নাই, কিংবা এলআরবিও তখনও দৃশ্যপটে অত জোর দেখাতে শুরু করে নাই, ফিডব্যাক  তখন অনেকদিন পর্যন্ত পর্বতশিখর ছুঁয়ে রেখেছিল। ‘ওয়ারফেইজ’ তখনও ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড ধরনের ব্যান্ড, জনপ্রিয়তা ও শ্রোতাগ্রাহ্যি-পরিচিতি দিনে দিনে বাড়লেও অদ্যাবধি তারা তা-ই, ‘ওয়ারফেইজ’ হার্ডকোর রক/ব্যান্ডশ্রোতাদেরই নিরঙ্কুশ পছন্দ। ওই-সময় ক্রেইজ ছিল ফজল মাহমুদের ‘নোভা’ ব্যান্ডের, অনেক ভালো কম্পোজিশন উপহার দিয়েছে ব্যান্ডগানে এই দলটা, আর ‘সোলস’ তো বাংলাদেশে ব্যান্ডমিউজিকের গোড়াপত্তনি থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত, ‘মাইলস’ তাদের সাল্সা ধারার বাংলা গান দিয়েও শ্রোতাকে একটা ভালো ও উপভোগ্য সময় দিয়ে যেতে পেরেছিল অনেক বছর অব্দি। ফিডব্যাক  ছিল উত্থানপতন হিসাবনিকাশের বাইরে থেকে মিউজিক-করে-যাওয়া গানদল, ইংরেজি গানে যেমন ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’, যদিও ফ্লয়েডের সঙ্গে ফিডব্যাকের তুলনা টানার ব্যাপারটাকে কেউ যেন সংগীতসাদৃশ্যের উদাহরণ না-ভাবেন। ফিডব্যাক  সর্বদা বাজারের বিজ্ঞাপনী ইশারায় না-মচকানো সংগীতভাবুক ব্যান্ড, যে-অর্থে ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’, যদিও সংগীতবিপণনের খোলনলচে সম্পর্কে ম্যাকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ সবসময় হাজির পেয়েছি আমরা আমাদের চলার পথে।

এইসবের বাইরে ম্যাকের কাজকর্মের ফিরিস্তি না-দিয়ে একটু নজর দৌড়িয়ে নেয়া যাক স্মৃতির দেউড়ি দিয়া, যাতে ম্যাক নয় বরং ওই সময়টাকে দেখে ওঠা যায় খানিকটা। ম্যাক মূলত লিরিসিস্ট, স্যং-রাইটার, সুর করেছেন ব্যান্ড আম্ব্রেলার তলায় নিজের কথাগুলোতে। এর বাইরে ম্যাকের শাণিত পর্যবেক্ষণের গদ্যকাজগুলোও মূল্যবান। অধুনা-প্রকাশলুপ্ত চলতিপত্র সাপ্তাহিকে ম্যাক বাংলায় একটানা অনেকদিন লিখেছেন। পত্রিকাটা যদ্দুর মনে পড়ে গত শতকের ’৯৭ খ্রিস্টাব্দে বেরোনো শুরু করেছিল। পোলিটিক্যাল অকারেন্স ও হ্যাপেনিংগুলো নিয়াই ফি-হপ্তায় বেরোত পত্রিকাটা। ভালো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সম্পাদক ছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। যথেষ্ট পাঠক-কাটতির রাজনীতিবিচিত্রা জাতীয় পত্রিকা ছিল এইটা। ঢাকা থেকে বেরোত, নিউজপ্রিন্ট মলাটে ও পাতায়, কখনো মনো-কালারে ফের কখনো বাই-কালারে। এখানে মিউজিক ও সিনেমা নিয়েও ফিচার থাকত চমৎকার। নিয়মিত লিখতেন এইখানে ম্যাক, হপ্তাবিরতি দিয়ে বেরোত তার ‘নিষিদ্ধ এই সময়ে’ শিরোনামক কলামের লেখাগুলো; তদ্দিনে ফিডব্যাক থেকে ম্যাক বেরিয়ে গেছেন, ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ বাজারে এসে গেছে, এবং ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামের নিরীক্ষাও শ্রোতাদের সামনে এসেছে, ম্যাক কর্নার্ড হতে শুরু করেছেন মেইনস্ট্রিম কালচার-করিয়েদের কবলে পড়ে, রোষের মুখে পড়েছেন নটরাজদের, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ প্রভৃতি জায়ান্ট সংস্কৃতিসিপাহসালারদের দাপটে ও দৌরাত্ম্যে অচিরে ম্যাকের ঘটিমাটিচাটি বিনাশের মুখে পড়তে দেখব আমরা। কারাগারেও যেতে দেখব আমরা তাকে, ফ্যামিলি লাইফ ব্যাহত ও এক্সপোজড হতে দেখব পাব্লিকলি, দেখতে পাবো ম্যাকের পতনে একপ্রকার সাইলেন্ট উল্লাস একটি মহলের এবং ওই-সময়েই ব্যান্ডমিউজিক ও মিউজিশিয়্যানরা আশ্চর্য চুপচাপ হয়ে যাবেন এইটাও দেখতে হবে। সেসব অন্য গল্প। এই গল্পগুলো অপ্রাসঙ্গিক নয়। এই গল্পগুলো করতে হবে আমাদেরকে। কেউ-না-কেউ ওই সময়টাকে রিক্যাপ করবেন নিশ্চয়। ব্যামো ও ভরসার সেই অম্লমধুর এক্সপ্লোসিভ সময়টাকে ফিরে দেখতেই হবে আমাদেরকে, যদি বাংলাদেশের গান বলিয়া আলাদা একটা ভুবন আমরা দুনিয়াকে দেখাইতে চাই।

ঠিক সেই কারণে ম্যাকের ইংরেজি-বাংলা গদ্য তো বটে এমনকি ইন্টার্ভিয়্যুগুলোও গুরুত্ববহ বহু বিবেচনায়, বাংলায় ব্যান্ডমিউজিকের সুলুকসন্ধানীদের কাছে পুনঃপুনঃ পঠনপাঠনযোগ্য, ফুরিয়ে যায়নি নিশ্চয় সেসবের রিডিং-যৌক্তিকতা; বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের পথপরিক্রমা যারা দেখতে চান তাদের কাছে ম্যাক ও অন্য ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান সকলের কথাবার্তা আন্তর্তাগিদ থেকেই শুনতে হবে। সেই সুবাদে এবম্বিধ বিষয়ে যেখানেই যা-কিছু লভ্য সবই বিলক্ষণ ফেলনা নয়, যে-কোনো টুটাফাটা আলাপচারিতাও সংরক্ষণযোগ্য। চলতিপত্র  সাপ্তাহিকীটিতে ম্যাকের বাংলা কলামধর্মী গদ্যরচনা ছাড়াও কথাচারিতা আছে একাধিক, আছে তেমনি ‘আনন্দভুবন’ প্রভৃতি বিনোদন পাক্ষিকেও, গদ্য তো বটেই এমনকি এই ইন্টার্ভিয়্যুগুলোও পঠনবস্তু হিশেবে অনেক উপভোগ্য; যদিও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা আলাপে না-এনেও বলা যায় যে বাংলাদেশে শোবিজনেসের আর্টিস্টদের সমধর্মী ইন্টার্ভিয়্যুগুলো রম্য তামাশা আর রগড়ে পর্যবসিত হতে দেখি আমরা হামেশা। আমাদের দেশে তো, অপ্রাসঙ্গিক হলেও মনে পড়ে গেল, রগড় করার একটা জাতীয় হুজুগঢেউ উঠেছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশক হিশেবে খ্যাত সময়টা থেকেই, বিশেষত হুমায়ুন আজাদ আর আহমদ ছফা বা শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ প্রমুখের ঘন ঘন কথাবার্তাধারকেরা সাক্ষাৎকার নিতে যেয়ে সাক্ষাৎদাতাকে খেলো বানানোর যে-কেমিস্ট্রি ইনভেন্ট করেছিলেন, সেই কিমিয়া আজও সচল এবং উপরন্তু সর্বত্রবিস্তারী হয়েছে দিনে দিনে। সেইটা আরেক প্রসঙ্গ। লক্ষ করব যে ম্যাকের ইন্টার্ভিয়্যুগুলোও তথৈবচ; — ওই মিনি-ফানি জিজ্ঞাসা আর রগড়ের বাইরে সাক্ষাৎকারগ্রাহী যেতে চাইছেন না। আমাদের দেশে মেইনস্ট্রিম ম্যুভির নায়ক-নায়িকাদের সাক্ষাৎকার নিতে যেয়ে তাদেরে আন্ডারেস্টিমেইট করার ব্যাপারটা আজও চোখে লাগে। ম্যাকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা হয়েছে বেশ খানিকটা, তার কারণ ম্যাক নিজের কাছে ক্লিয়ার তিনি কি করতে চান বা কি তিনি বলবেন, ফলে স্রেফ অ্যালবাম রিলিজের পরবর্তী বিজ্ঞাপনী বাইট হয়েই থাকেনি তার কথাচারিতার পাঠকৃতিগুলো।

পত্রিকাচাহিদানুসারে ফানি-মিনি ইন্টার্ভিয়্যু গ্রহণে এবং প্রদানে অভ্যস্ত আমাদের পত্রিকাপক্ষ ও সংগীতসিনেমাশিল্পীপক্ষ, বহুদিনের ক্রনিক ব্যামো হিশেবেই দেখতে হবে একে; — এমনিতে ম্যাক সবসময় কথা বলতে চেয়েছেন বলেই বিভিন্ন পর্যায়ে ম্যাকের গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই খেয়াল করেছি। কিন্তু কথাধারকেরা এসেই জুড়েছে ভ্যান্তারা ফানি-মিনি রম্যপত্রিকাপ্রচ্ছদের তারকাচিহ্নিত প্রশ্নডিম্ব। লক্ষণীয় যে আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোতে কালচারাল্ বিটে এখনও প্রোফেশন্যালিজম্ আসে নাই বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে-অর্থে কূটনীতি বিটে বা অর্থনীতি বা শিক্ষা বিটে এসেছে; দেখতে পাই যে একজনও লোক পত্রিকাগুলোতে নাই যিনি ওয়েস্টার্ন-মিউজিক-শোনা ম্যাক বা বাচ্চু বা জেমসকে সেভাবে একটুও ক্রিটিক্যালি রিফ্লেক্ট ও রেস্পোন্ডে বাধ্য করতে পারেন। ফলে একটাবারের জন্যও আমরা আজ অব্দি শুনি নাই পিঙ্ক ফ্লয়েড বা স্যান্ট্যানা বা মার্ক নোফ্লার বা জিম মরিসন বা স্টিভি ওয়ান্ডার বা এরিক ক্ল্যাপ্টন কি জিমি হেন্ড্রিক্স শুনে একজন বাংলাদেশি ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান সেইটাকে কেমন করে নিজেদের কাজের বেলায় ডিল করেন, ফেলে দেন কতটা আর রাখেন কতটা, আজও সংগীতের অন্তর্গত নোট ধরে ধরে কেউ প্রশ্ন করল না কোনো ব্যান্ডসিঙ্গারকে যে এই জায়গাটা আপনার অপটুতার চিহ্নায়ক অথবা এইখানটায় আশ্চর্য শক্তিমত্তা। যাকগে। ম্যাক বরং এইসব ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলেন দেখেছি, বলতে চেয়েছেন মিউজিক নিয়েই, হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ ধরনের পরিস্থিতি এক এই ম্যাকের ক্ষেত্রেই লক্ষ করে গেছি আগাগোড়া। বাকি সবাই মোটামুটি হ্যাপি স্মাইলি ইন্টার্ভিয়্যু দিয়াই নিরালোকে দিব্যরথ ছুটিয়েছেন বলা যায়, এসবের বিরুদ্ধে এক ম্যাকের মধ্যেই বিরাগ টের পাওয়া যায়। ইয়াদ হয়, ‘ওগো ভালোবাসা’ রিলিজের পর মাকসুদ পত্রিকান্তরে চিল্লিয়ে বলছিলেন যে তিনি তার এই অ্যালবামটায় জ্যাজের ফিউশন করেছেন এত ব্যাপক হারে যে এর আগে এমনটা বাংলায় হয়নি; বিভিন্ন গানের নাম উল্লেখ করে বলছিলেন যে এই-এই গানে তিনি এত-এত সংখ্যক জ্যাজের নোট প্রয়োগ করেছেন, কই, কেউ তো ম্যাকের ওইসব ক্লেইম নিয়া তারে যেয়ে জিগাইল না কোনোকালে! হ্যাঁ, ম্যাক কেন রবীন্দ্রসংগীত একখানা-সাকুল্যে দন্তকিড়িমিড়ি না-গাইয়া দাঁত-উদাত্ত উদ্দাম গলায় গাইল ইত্যাদি জিজ্ঞাসা আমাদের জীবনমরণ সংস্কৃতিনৈতিক সমস্যা। তা, বেশ, বেশ!

কথা হচ্ছে, যত গুরুত্বহীনই হোক না কেন এদেশের ব্যান্ডসংগীতের উত্তাল সময়টা নিয়া আলাপ শুরু করা ছাড়া বাংলাদেশের বাংলা গানের ব্রেইক-থ্রু সুদূরপরাহত বলে মনে করেন যারা, তাদের জন্য প্রবেশসোপান হিশেবে ম্যাকের কথাবার্তা-গানকর্ম-তৎপরতা দালিলিক প্রিজার্ভেশন্ জরুরি। ভীষণ দরকারি একটা কাজ সম্ভব হলে খুঁটিনাটি মিউজিক্যাল মাইলফলকগুলোর লিখিত তথ্যচিত্র। ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে ব্যান্ডসংগীতের যা-কিছু তথ্যোপাত্ত সমস্তই প্রিজার্ভ করা দরকার, নাগালসীমায় রাখা আবশ্যক সম্ভাব্য ব্যবহারকারীর, কাজেই মুদ্রিত কাগুজে প্রকাশনা এক্ষেত্রে একটা আকর। অবশ্য ব্লগে বা ব্যক্তিগত প্রয়াসে এই কাজ হচ্ছেও যথেষ্ট। তবু পূর্ণায়ত কোনো উদ্যোগ গোচরীভূত হয় না। যা-কিছু সমস্ততেই এলোমেলোপনা। তা-ও যদি পাওয়া যাইত লোকালয়ে লেখাপত্তরগুলো অ্যাভেইলেবল, তো কথা ছিল না। আমরা কেবল ইনফো হিশেবে এইটুকু জানি যে ব্যান্ডসংগীতের গোল্ডেন টাইমের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী রীতিমতো পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা করেছেন একটা, ‘বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীত আন্দোলন’ সম্ভবত শিবলীপ্রণীত বইটার নাম, বেরিয়েছে মেলা-ও-বিবিধ-খেলাধুলা আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে মহাকালে মাল সাপ্লাই হয় বলিয়া মাঝেমধ্যে দৈববাণী শোনা যায়, কিন্তু সরবরাহকৃত মাল সমকাল জাম্প দিয়া যায়টা কোথায় তা কাউরেই জিজ্ঞাসিয়া জানার উপায় নাই। জিনিশটা তাহলে প্রেম, স্বর্গে উদয় এবং স্বর্গেই বিলয়, আমাদের ন্যায় হার্মাদের তাহা দেখিবার জো নাই, হাতাইবার প্রশ্ন তো উবিয়া যায় উঠিয়াই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটার পাত্রমিত্র পোলিটিক্যালি নিরীহ ও গোবেচারা, প্রান্তরে উদাসীন কৃষ্ণের জীব সমতুল্য, সুখ্যাত তারা সুললিত সত্যপুত্তুর ও সজ্জন বলিয়া। আর পিতৃঅন্তপ্রাণ, কন্যাবৎসল। তাদিগের প্রত্যেকের রয়েছে একেকটা বাগানবাড়ি এবং বাগানবাড়িতে রয়েছে একাশি খণ্ড অভিধান ও উন্নত জাতের ভূষি, খৈল ও ঘাস। তাহাদের তরে ক্যামেরাফোকাস ও উৎসব বারোমাস।

খ্রিস্টাব্দ ২০০০ পরবর্তী কিছু বছরের মধ্যে ব্যান্ডঅ্যাক্টিভিটি স্তিমিত ও নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখব আমরা আস্তেধীরে। ক্যাবলটিভির যুগ শুরু হবে। ময়দানে কন্সার্ট আয়োজন প্রায় নিষিদ্ধের পর্যায়েই চলে যেতে দেখব আমরা। ব্যান্ডঅ্যাক্টিভিস্টরা সবাই এইসব প্রকাশ্য অপতৎপরতা বুঝিয়াও টুঁ-শব্দ করবেন না বলেই আমাদের গোচরে আসবে। টেলিভিশনস্টুডিয়োর ফেইক অ্যাটমোস্ফিয়ারে অ্যাঙ্করিং-করা আর্টিফিশিয়্যাল সুহাসিনীর সনে নাইটলং ফ্লার্ট করে যেতে দেখব আমরা আমাদের এককালের ব্যান্ডবিদ্রোহীদেরে। দেখব কল্পিত শ্রোতাদর্শকের উদ্দেশে ভুতুড়ে জেশ্চার আর বায়বীয় দরদী মরমিপনা তাদের। ব্যান্ডসিঙ্গারদের বাড়িতে বাড়িতে গজাবে স্টুডিও। ফল হাতেনাতে পাবার পরিবর্তে অথর্ব ও অফলা হতে দেখা যায় এই-সময়টাতেই আমাদের ব্যান্ডের মায়েস্ত্রো মিউজিশিয়্যানদের। জিঙ্গেল বানানো ছিল আগে থেকেই, এবারে যুক্ত হলো টিভিসি-টিভিফিকশন ইত্যাদির আবহসৃজনের ব্যস্ততা, আর মহামারীর ন্যায় অভিনয়। অ্যাক্টিং হয়ে উঠল গোটা জাতির সর্বশীর্ষ গর্ব। কবি থেকে শুরু করে কামার-কুমার-জেলে-তাঁতি মিলে সক্কলে অ্যাক্টিং শুরু করল স্ব স্ব ধর্মকর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে। ব্যান্ডমিউজিকও এই অ্যাক্টিং-ডোমিনেইটেড ওয়েইভের তোড়ে তলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। এছাড়া প্রোডাকশন হাউস, ফ্যাশন ও ব্যুটিক হাউস প্রভৃতি খুলিয়া বসিয়া দুইটা নগদ পয়সা কামানো তো দরকারও ছিল। ফোক্যাসড থাকল না কেউই নিজের ধ্যানে। স্টিক করে থাকাটা গেল উঠে। গেল ডুবে ব্যান্ড। এখন যৌবন যার, মিউজিকভিডিও বানাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এইটুকু অল্পকথার গল্প, আপাতত।

দুঃখ কোরো না, বাপু হে, বাঁচো! সুদিন ওই তো আসছে, বেঙ্গলের পরিত্রাতারা রাতের পর রাত জেগে স্টেডিয়াম জুড়ে এত পরিশ্রম করছেন, মাগ্না গানবাজনা শোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন তোমারে, সংস্কৃতিবিপ্লব দেখে দুনিয়া ধন্য ধন্য করবে দেখে নিও দাদাঠাকুর! বড়লোকের বাজনা, রাজারাজড়ার আয়েশী মিউজিক, কানে এবং চোখে চেখে দেখবার মওকা পাচ্ছো তুমি লিটললোকের বাচ্চা, শোকরগোজার করো হে! ক্যাল্কুলেশনে যেও না লাভক্ষতি, জীবন্ত সংগীত উপেক্ষা করে মৃত ক্ল্যাসিক্যালের কলা বাঁচাইবার দিকেই নিবিষ্ট হও স্কয়ারের আর বেঙ্গলের কোলাবোরেটর হাঁদাভোঁদা কোথাকার! খবর নিতে যেও না ওইদিকে ব্যবসাটা লাটে উঠল কেন, ডোভারলেইন মিউজিক কনফারেন্সের দশাটা এখন কোন পর্যায়ে, আর কোকস্টুডিয়োতে বিনিয়োগ করে কেমন মুনাফা হয় এইসব খবরে তোমার ফায়দা নাই। তুমি ইশটুডেন মানুষ, চিরকালের শিক্ষানবিশ, লাইফল্যং অ্যাপ্রেন্টিস, তোমার গাইবার এখনও সময় আসে নাই। ইশটুডেন আছো ইশটুডেন থাকো। তোমার গরিমার কিছুই ছিল না কোনোকালে, এখন পণ্ডিত আর বিদূষীদের জ্যোতির্ময় চেহারাছবি দেখে একটু যদি নিজেরে আপলিফট করতে পারো, দ্যাখো। রোম ওয়্যজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে, আজ্ঞে, হ্যাঁ। এইটাও শুনেছি যে বান্দরের ন্যায় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে রুখিয়া না-উঠিলে হাওয়ার্ড ফাস্ট নাকি স্পার্টাকাস  ম্যুভিটা বানাইতে এত গুচ্ছের পয়সা ঢালতেন না।

 

১৯৯৪, ফিডব্যাক, বঙ্গাব্দ ১৪০০ ও উন্মাদনার বাংলা ব্যান্ডশাস্ত্রীয় সংগীত

অবশ্যই ফিডব্যাক  তাদের ‘উল্লাস’ এবং ‘মেলা’ অ্যালবাম প্রভৃতির অন্তর্গত ‘মৌসুমী-১’, ‘মৌসুমী-২’, ‘ডাকপিয়ন’, ‘জীবনজ্বালা’, ‘স্বদেশ’, ‘মাঝি ৮৮’, ‘মাঝি ৯১’, ‘মেলা’ ছাড়াও অন্যান্য গানগুলো দিয়ে আগে থেকেই লিস্নারদের কাছে ব্যাপকভাবে মান্যতা আদায় করে নিয়েছে। ম্যাকের অননুকরণীয় বডিম্যুভমেন্ট, স্টেজে এবং টেলিভিশনপর্দায়, লিরিক্সের কথানিহিত ভাববস্তুর সঙ্গে মানানসই ফিজিক্যাল ম্যানারিজম তথা শরীর-অভিব্যক্তিগত মুদ্রা দিয়ে ম্যাকের কায়দায় ব্যান্ডমিউজিকটাকে এত অন্তরাত্মাহাহাজারিদীর্ণ উদ্ভাসের জায়গায় যেয়ে প্রেজেন্ট করতে পেরেছেন গুটিকয় শিল্পীই। ফিডব্যাক  তখনই পিক স্পর্শ করে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছিল আমাদের; কিন্তু না, ব্যাপক জনপ্রিয়তা হাসিলের পরেও ফিডব্যাক  নিজেদেরে গৎবাঁধা প্যারাডাইমে বেঁধে না-রেখে একটা আলাদা মর্তবার উচ্চতায় নিয়ে যায় শিখরারোহণের পরেও। ঝুঁকি ছিল ভূমিধস পতনের, শ্রোতার পরিচিত সড়কে হেঁটে বেড়ালে অন্তত পা হড়কানোর ডর অল্প, তদুপরি ফিডব্যাক  শ্রোতাগ্রাহ্যিবিবেচনায় ক্যারিয়ারের অমন ভরভরন্ত সময়েই রিভোল্যুশন্যারি শিফট্ ঘটায় নিজেদের গানে-বাদনে। এর ফলে ব্যান্ডের, যুগপৎ ফিডব্যাকের এবং গোটা বাংলা ব্যান্ডসংগীতের, পরিসরগত ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায় ভীষণভাবে। সে বড় সুখের সময় ছিল বটে ব্যান্ডসংগীতের, সে বড় উন্মাদনার সময়, সে বড় উত্তুঙ্গ সময় ব্যান্ডমিউজিকে ডেডিকেইটেড উত্তম-মধ্যম প্রত্যেকটা ব্যান্ডের জন্য। সময়টা তাৎপর্যবহ, বছরটা বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক অধ্যায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য, ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ তথা বাংলা ১৪০০ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরই ঠিক ৯৮ বছর আগে, ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন দ্বিতীয় দিবসে, একটা পাঠকসম্বোধনী কবিতা রচেছিলেন ‘১৪০০ সাল’ শিরোনামে। এই বঙ্গশতাব্দ উদযাপনের ক্ষণে ফিডব্যাকপ্রণীত ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ উন্মত্ত অধীর চঞ্চল পুলকরাশির ন্যায় নিখিলের এবং বাংলা ব্যান্ডসংগীতশ্রোতাদের মর্মে এসে লাগে। ‘সেদিন উতলা প্রাণে হৃদয় মগন গানে কবি এক জাগে’, হ্যাঁ, জেগেছিল বৈকি, ফিডব্যাকের খরশান বসন্তগান আমাদের বসন্তদিনে, হৃদয়স্পন্দনে আমাদের, নবতারুণ্যতূর্ণ পল্লবমর্মরে।

এই নিবন্ধকার সহ বাংলাদেশের বহু সুরমূর্খ গানকাঙাল ওই বছরেই পুলসিরাতের সাঁকো তথা মাধ্যমিক পরীক্ষা পার হবার পাঁয়তারা করছে দুরুদুরু বক্ষে আল্লা-রামের নাম নিয়ে; এই নাইন্টিন-নাইন্টিফোর বছরটা বাংলা গানের ইতিহাসে একটা তাৎপর্যবহ বছর, ঘটনাকীর্ণ ও সৃজনোদ্দীপ্ত বছর; অনেক সাংগীতিক ঘটনা এই বছরেই সংঘটিত হয়, যে-ঘটনারাজি পরের কয়েক বছরের বাংলাদেশজ ও বহির্বাংলাদেশজ বাংলা গানচিত্রে ব্যাপক প্রভাব রাখবে। এই বছরেই ফিডব্যাক  নিয়া আসবে ব্যান্ড-মিউজিকসিনে এখনোব্দি অপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালবাম ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’, যে-অ্যালবাম গোটা বাংলা ব্যান্ডসংগীত তৎপরতাকে এমন-একটা দার্ঢ্য দেয় যা আজও মূল্যায়িত হয় নাই; নিছক পোলিটিক্যাল স্টেইটমেন্টের ডিরেক্টনেসের জন্য নয়, যদিও সংকলনভুক্ত গানগুলোর জনরাজনীতিঋদ্ধ বক্তব্যদ্যোতনা আজও অতুলনীয়, ফিডব্যাকের এই অ্যালবাম গোটা বাংলা গানে আলাদা সাউন্ডস্কেপ হাজির করেছে। একটু আগের প্যারায় এহেন তথ্যোল্লেখ থাকলেও পুনরোল্লেখ করা যায় যে এর আগে থেকেই ফিডব্যাক  বাংলাদেশের নতুন দিনের গানে তিন-তিনটে অ্যালবামে নিজেদের প্রতিভাস্বাক্ষর রেখে এসেছে, ব্যাপক সাফল্য লভেছে ক্যাসেটকোম্প্যানিগুলোর বিজনেস-খতিয়ানে এবং সর্বোপরি মিউজিকের ক্রিটিক্যাল অ্যাক্লেইমগুলো তরুণ ও যুবাশ্রেণির শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরেছে; — ‘উল্লাস’, ‘মেলা’ এবং ‘জোয়ার’ শীর্ষনামী ফিডব্যাকের তিনটা মাইলস্টোন ইতোমধ্যে আমাদের শ্রবণাভিজ্ঞতাভুক্ত — ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ দিয়েই ফিডব্যাক দুনিয়াজোড়া বাংলাগানে ব্রেক-থ্রু ঘটায় এই চুরানব্বই সালে এসে, যে-বছর বাংলা আরেকটা নতুন শতাব্দীতে পা রাখতে চলেছে, ফিডব্যাকের অ্যালবামনাম থেকে শুরু করে ক্যাসেটপ্রচ্ছদ ও বক্তব্যভাষ্য সহ সর্বত্র বঙ্গাব্দ-কোমেমোরেইটিং ব্যাপারটা হাজির এবং সর্বোপরি লিরিক্সের অভাবিতপূর্ব নতুন দিগন্তদর্শন।

শুধু ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ তথা ফিডব্যাক  নয়, এই বছরেই কিংবা খানিক পরে হয়তো ‘সোলস’ তাদের সর্বকালের সেরা অ্যালবাম হাজির করবে আমাদের সামনে ‘আজ দিন কাটুক গানে’ শিরোনামে, এই অ্যালবামটার ধ্বনিঋদ্ধ অবদানের ঘটনা ব্যান্ডমিউজিকে এবং গোটা বাংলা গানের হরকিসিমের আওয়াজের আঙিনায় পৃথক মর্যাদায় অধিষ্ঠান পাবার যোগ্য। উনিশশ’ চুরানব্বই খ্রিস্টাব্দেই রিলিজ পায় ক্যালক্যাটাবাসী বাংলা গানের আরেক অবিসংবাদিত সংগীতস্রষ্টার ডেব্যু-অ্যালবাম ‘শুনতে কি চাও’, অঞ্জন দত্ত, পরের দুই দশক জুড়ে যিনি বাংলা গানে একাধিক দিগন্তবিহার করবেন। এর বাইরেও বঙ্গের শতাব্দসন্ধির ওই বছরে অ্যালবাম বেরিয়েছে উল্লেখযোগ্যতার বিচারেও অসংখ্য। পরে এই বিষয়ে ফাঁকেফোকরে আরও বলা যাবে হয়তো। মোদ্দা কথায়, এই যিশুবর্ষ ১৯৯৪ তথা বঙ্গাব্দ ১৪০০ মুখ্যত ‘সোলস’ তথা পার্থ বড়ুয়া আর নাসিম আলী খান, ‘ফিডব্যাক’ তথা মাকসুদুল হক আর ফুয়াদ নাসের বাবু ও লাবু-পিয়ারু-খোকা এবং অঞ্জন দত্তের জন্যই মিউজিকামোদীদের কাছে এভার-রিমেম্ব্রিং।

 

আবহমান বাংলা গানে একটা মাতনদোলা

মেলা উপজীব্য করে, মেলাকে সেলেব্রেইট করে, যে-দুইটা গানের অস্তিত্ব উল্লেখ করা যায় বাংলায়, এদের একটা বাংলাদেশের ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’ ও অন্যটা ভারতের ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত বাংলা গানের সৃজন। ফিডব্যাকের গানটা পাওয়া যায় ‘মেলা’ শিরোনামেরই অ্যালবামে, গত শতকের নব্বইয়ের গোড়ার দিকে এই গানটার জন্ম। ওদিকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-সম্পাদনায় গানটা ‘ঝরা সময়ের গান’ শীর্ষক অ্যালবামে প্রথম প্রকাশ। ঘোড়াগুলোর ওই অ্যালবামে আশ্চর্য সুন্দর তিনটা গানের একটা সিক্যুয়েল্ পাওয়া যায় ‘গানমালা’ শিরোনামে। সেই মালার মাঝখানের গানটা হচ্ছে মেলাপ্রাসঙ্গিক, ‘পেরিয়ে মাঠের সীমানা ওই মেলা বসেছে’ গানটার পয়লা লাইন। ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামের টাইটেল্ স্যং শুরু হচ্ছে ‘লেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে এ কী মাতনদোলা’ লাইনটা দিয়ে। এখন পরপর দুইটা গানের লিরিক্স লক্ষ করব। পয়লা ফিডব্যাকের, তার বাদে মহীনের ঘোড়াগুলির।

“লেগেছে বাঙালির ঘরে ঘরে এ কী মাতনদোলা / লেগেছে সুরেরই তালে তালে হৃদয়ে মাতনদোলা / বছর ঘুরে এল আরেক প্রভাত নিয়ে / ফিরে এল সুরের মঞ্জরী / পলাশ-শিমুল গাছে লেগেছে আগুন / এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি / মেলায় যায় রে, মেলায় যায় রে / বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায় / মেলায় যায় রে, মেলায় যায় রে / বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই / … / লেগেছে রমণীর খোঁপাতে বেলিফুলের মালা / বিদেশী সুগন্ধী মেখে আজ প্রেমের কথা বলা / রমনা বটমূলে গান থেমে গেলে / প্রখর রোদে এ যেন মিছিল চলে / ঢাকার রাজপথে রঙের মেলা / এ বুঝি বৈশাখ এল বলেই …”

ঠিক তুলনা-প্রতিতুলনার জন্য নয়, একটার সাপেক্ষে আরেকটাকে শ্রেয় প্রমাণের বদ অভিপ্রায় থেকেও নয়, ‘মেলা’-প্রাসঙ্গিক বাংলা গানের লিরিক্সের পরিমণ্ডলে ম্যাকের লিরিকের ডিস্টিংক্ট ফিচার্স পয়েন্ট-আউট করার প্রয়াসে এখানে ম্যাক হক এবং গৌতম চ্যাটার্জির গানদ্বয় পাশাপাশি রেখে দেখা হচ্ছে। এর আগে স্বীকার্য, এবং সমস্ত বিবেচনার পরেও স্বীকার্য, দুইটা গানই টিকিয়া আছে একদম প্রথমদিনের ঔজ্জ্বল্য ও উচ্ছলতা নিয়ে। ম্যাকের গানটা আগের অনুচ্ছেদে রেখে এসেছি, বিস্তারে যাবার আগে ঘোড়াগুলির গৌতমের গানটা রাখি এইখানে।

পেরিয়ে মাঠের সীমানা ওই মেলা বসেছে / চর্কি ঘোরে, পাপড় ভাজায় / মাতালিয়া ঢোলকে মনকে মাতায় / তোরা কে কে যাবি রে, কে কে যাবি রে / কে কে যাবি রে তোরা আয় / … / পয়সা যদি নেই পকেটে ভাবনা কী আছে / ঘুরতে মানা, চড়তে মানায় / ভিড়ে মেশা আনন্দের কী আসে যায় / তোরা কে কে যাবি রে, কে কে যাবি রে তোরা আয় / … / একরঙা এই জীবন ছেড়ে একটু পালানোর / এর বেশি হায় কে-ইবা কি চায় / বেচাকেনা হিসেবের খুশির মেলায় / মোরা সবাই যাব রে, সবাই যাব রে / সবাই যাব-যে রে মেলায় … তোরা কে কে যাবি রে, কে কে যাবি রে তোরা আয় …

গান কথাশ্রিত যতটা না, তারচে বেশি সুরাশ্রিত। উপরোক্ত দুইটা গান সুরারোপিত হয়েছে এমনভাবে যে, একবার শুনলেই শ্রোতা টের পাবেন এদের অনন্যসাধারণত্ব। মহীনের ঘোড়াগুলির গানটাতে এমন প্রশান্তি লেপ্টানো রয়েছে, একবার শুনে এর রেশ ও আবেশ থেকে বেরোনো যায় না বাকি জিন্দেগিতে। এদিকে ফিডব্যাকের গানটা শুনে ছয়-বছরের শয্যাশায়িত মুমূর্ষুও গতর ঝাঁকানি দিয়া দাঁড়াবে সটান। সর্বমোট তিনসেকেন্ড-কম টানা সাড়ে-পাঁচমিনিটের গান ফিডব্যাকের ‘মেলা’। ওইটুকু কথাবস্তু দিয়া সাড়ে-পাঁচমিনিট টেনে যাওয়া আদৌ কথার নির্ভরতা না, বলা বাহুল্য, সুরের সৌকর্য, বাজনা ও বাদনের কারুকর্ম। গানটা মাকসুদুল হক লিখেছেন ও গেয়েছেন। মাকসুদের অননুকরণীয় ভয়েস ও রেন্ডিশন তখন পিকছোঁয়া। ফিডব্যাক  তাদের ব্যান্ডক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করছে সেই-সময়টায়। সাড়ে-পাঁচমিনিটের গানে ইন্টার্লিউড ও প্রেলিউড এতই দীর্ঘ অথচ অক্লান্ত ফুর্তির যে টেক্সট তথা গানের কথাবস্তু গৌণ হয়ে যায় এর সূচনা ও সমাপনকালীন বর্ষআবাহনী মিউজিকের মৌতাতে। গোটা দুইদশক-পরের প্রজন্মের কাছেও ফিডব্যাকের মেলা আজও অপ্রতিরোধ্য ও অমলিন আবেদন নিয়া হাজির হয় ফি-বছর। যারা গানটা তার জন্মলগ্ন থেকেই শুনে আসছেন তারাও এর সুরাবেশ কাটায়ে উঠতে পারেন নাই এতটা কাল অতিক্রম করেও। বরঞ্চ এর আবেশ ও প্রয়োগোপযোগ উত্তরোত্তর বর্ধিষ্ণু। শ্রোতা যারা আজও শোনেন নাই ফিডব্যাকমহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত দুই মেলা-উদযাপনী গান, তারা শুনে দেখুন, বুঝতে পারবেন বাংলা গানের পাঠ্যপুস্তকে স্বর্ণযুগের পরেও কত স্বর্ণ-গজমোতি-হীরা-পান্না জন্মিয়াছে। বিফলে কথা ফেরৎ। ঝুট বোলে কাউয়া কাটে।

ফিডব্যাকের গানে যে-মেলার ছবিটা পাওয়া যায়, সেইটা নাগরিক মেলা। ঢাকা শহরের উল্লেখও রয়েছে লিরিক্সে। কিন্তু লক্ষণীয়, গত শতকের এই গানজন্মকাল থেকেই নাগরিক পরিসরে, গোটা দেশের জেলাশহরগুলোতে, একটা আর্বেইন কালচারাল রেনেসাঁ সাড়ম্বরে না-হলেও শক্তিসারবত্তা নিয়া সামনে আসতে শুরু করে। রাজধানীর আদলেই ছায়ানটসদৃশ বর্ষআবাহনী প্রভাতী সংগীত অনুষ্ঠান আয়োজন দিয়া দিনের শুরুয়াৎ, মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা চালনা, দিনজোড়া নানা বর্ণিল উৎসবফোয়ারা ইত্যাদি সূচনাবৈশাখের পরিচয়চিহ্ন হয়ে উঠতে থাকে। এতই দীর্ঘ প্রভাব বিস্তারক হয়ে উঠতে থাকে এই নগরকেন্দ্রী উদযাপনাগুলো যে অচিরে এগুলো দমাতে বোমা ফালানো হয়; এমনকি বোমাও রুখতে পারে না এর বেগ, এই উৎসবস্রোত। উত্তরোত্তর এই মিলমিশের মেলা বাড়তে থাকে, এমনকি ফি-বছর ক্ষমতাস্বার্থান্বেষীদের অপতৎপরতাও থোড়াই পরোয়া করে এই মিলনাকাঙ্ক্ষী নগরজনতা। বাংলাদেশের ব্যান্ডগান এই জাগৃতিতে একটা ভালো অবদান রেখেছে দেখতে পাব। সময়ের কাজ করে যাওয়ার জন্যই তো গান ও অন্যান্য সমুদয় সাহিত্য ও শিল্পকলা।

নাগরিক গণ্ডির বাইরে যে-মেলা মহীনের ঘোড়াগুলির গানে রেপ্রিজেন্ট করছে, সেই মেলাও ক্ষয়িষ্ণু হলেও বহাল বাংলাদেশে আজও। তবে একটা জায়গায় এইভাবে একটা ভিন্নতা টানা যায় গানদ্বয়ের মধ্যে যে, ‘একরঙা এই জীবন ছেড়ে একটু পালানোর / এর বেশি হায় কে-ইবা কি চায় / বেচাকেনা হিসেবের খুশির মেলায় / মোরা সবাই যাব রে, সবাই যাব রে / সবাই যাব-যে রে মেলায়’ … এই-যে একটা নায়িভিটি মহীনের ঘোড়াগুলির গানে, স্রেফ একটু কৈশোর-উদ্বেলক ভূমিকায় মেলার উপস্থিতি এই গানে, এস্কেইপ করার একটা মওকা হিশেবে মেলার নেসেসিটি স্বীকার, ফিডব্যাকের গানটা ঠিক এইখানেই এগিয়ে। ফিডব্যাকের এই গান পোলিটিক্যালি একটা স্ট্রং পজিশনে দাঁড়ানো। উত্থানের জয়গাথা গাইছে গানটা, গাইছে চির-উজ্জীবনের মাভৈ। ফিডব্যাকের গানটা পোলিটিক্যাল একটা কনশ্যাস্নেস্ থেকে এগিয়ে থাকবে চিরকাল। মহীনের ঘোড়াগুলির মেলা যে-অর্থে চিরদিন নস্ট্যালজিয়্যায় মৃদু মর্মরিত রইবে, ফিডব্যাকের গান কোনোদিনই সেইটা হবে না। কারণ একটাই। ফিডব্যাকের গান কনফ্রন্ট করছে। এমনভাবে করছে সেইটা যে এই কনফ্রন্টেশন কখনো উবে যাবার নয়। ভিন্ন ফর্মে ভিন্ন ভিন্ন দেশকালপাত্রে কনফ্রন্টেশন্ তো চির-জাগরুক। তবে দুইটা গানই ইক্যুয়্যালি মেলা ইভেন্টটাকে সেলেব্রেইট করেছে অনবদ্য অনুপম উপায়ে। এই সেলেব্রেশনের জুড়ি মেলা ভার, অন্তত বাংলা গানের আবহমান পটভূমে এর তো জুড়ি নিমস্বরেও নাই।

ফিডব্যাকের মেলা চাইছে একটা ঐতিহ্য গড়ে তুলতে, একটা আবহমানতার সন্ধিক্ষণে নবায়ন করে নিতে নিজের জ্বালানিসামর্থ্য ও সংযোগধর্ম, চাইছে একটা জাতির প্রাণস্পন্দ ধরে ঝাঁকানি দিতে ফিরে ফিরে। সেদিক থেকে মহীনের ঘোড়াগুলির মেলা স্মৃতিজাগানিয়া হলেও মৌহূর্তিক এনার্জাইজ্ করার বাইরে যেন তার বিশেষ কিছু করবার নাই। কিন্তু গানটা এমনিতে ভালো। সুখশ্রাব্য। সুন্দর। দুই গানের লিরিক্সও সো-ফার বাহুল্যপ্রমাদমুক্ত। ওই অর্থে লিরিক্যাল বৈভব বা কাব্যধর্ম নাই যদিও, কথাপ্রধান গানে এইটা বাড়তি মাত্রা যোগ করে ঠিকই, তবে এর অভাব অনুভূত হয় না গানের সুর ও সংগীতযোজনাগত নৈপুণ্যের জন্য। দুই গানের বাণীভাগে একাধিক আপোস লক্ষ করা যাবে। এমনটা আপোস গোটা আধুনিক বাংলা গানে এন্তার দেখা যায়, এবং কখনো কখনো অত বিরক্তির কারণও হয় না বৈকি। ফিডব্যাকের গানে যেমন ‘ললনা’ ও ‘রমণী’ এই দুই শব্দের স্থাপন আধুনিক সচেতনতার জায়গা থেকে আপত্তিকর। এছাড়া বাকি সবকিছু পার্ফেক্ট বলা যায়। তেমনি মহীনের ঘোড়াগুলির লিরিক্সটেক্সটে ‘মোরা’-‘তোরা’ সর্বনাম পদের প্রয়োগ। অন্যদিকে এইটাও সত্যি, ফিডব্যাকের গানে একটা লাইনেই সময়চেতনা দারুণভাবে টের পাওয়া যায় : ‘বিদেশী সুগন্ধী মেখে আজ প্রেমের কথা বলা’ … মাকসুদের গানে দেশপ্রেমচৈতন্যে ও ঐতিহ্যপ্রণয়ে অন্ধ হয়ে ‘আতর-গোলাব-চুঁয়াচন্দন’ গতরে ছিটাইয়া ছিটাইয়া মাখবার কথা বলা হলেই এই নিবন্ধাংশটা আজ আর ফাঁদতে হতো না। আল্লা বাঁচিয়েছেন অল্পের উপর দিয়া। বাংলা গানের ফি-আমানিল্লা কামনা করি আমরা সক্কলে। এবং কামনা করি মেলার চিরপ্রাসঙ্গিকতা। দুই মেলারই। ফিডব্যাকের, মহীনের ঘোড়াগুলির। এবং অনাগত সকল মেলা বাণিজ্যনিরপেক্ষভাবে বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক, বিকশিত হোক, আমাদের সক্কলের আস্কারা পাক মানুষে-পাখিতে-গাছে-মাছে-ছাগলে-পাগলে মেশামেশির মেলা।

 

ম্যাক ও তৎকালীন বঙ্গসমাজের প্রিন্টমিডিয়া

ব্যান্ডসংগীত নিয়া হাসিতামাশা আর তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা আদি থেকে এ-পর্যন্ত কোয়ালিটেইটিভলি অপরিবর্তিতভাবেই বহাল দেখা যাবে। এইটা আমাদের হেমন্তমান্নামাহমুদুন্নবীপ্রিয় মুরব্বি পিতা-পিতৃব্যদের মধ্যেই ছিল শুধু এমন নয়, ছিল এবং আছে এমনকি ইয়াঙ্গার ওয়ার্কফোর্সের বড় অংশের ভিতরেও। ক্যজ্-অ্যান্যালিসিসের দিকে এই নিবন্ধে যেতে চাইব না আমরা, আল্লা চাহে তো পরে এক-সময় এই কিবোর্ডে কিংবা আরও যোগ্যতর কারো কিবোর্ড দিয়া আনুপূর্ব অনুসন্ধানী রিসার্চরিপোর্ট্যাজ্ একটা বাইর হবে। এইখানে কেবল প্রোক্ত প্রবণতার অস্তিত্ব বিষয়ে এই বিবৃতি রাখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে টেস্ট কেইস্ হিশেবে এক-দুই ইন্সিডেন্ট উল্লেখ করে ব্যাপারটা হাল্কা চালে দেখিয়ে নেয়া যাক শুধু। তবে এই কথাটা আলতো বলে নেয়া যায় যে, এককালের তরুণযুবা বায়োলোজিনিয়মেই পর্যায়ক্রমে দেহে যতটা-না তারচেয়ে বেশি হৃদয়মনে-ভাবনাচিন্তনে মুরব্বি হয় এবং মুরব্বিদের বিহেইভিয়্যরাল অ্যাটিট্যুড গ্রহণ করে বেখেয়ালে হলেও; ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভগুলোরই রিপিটেড অনুশীলক হয়ে ওঠে সে এবং রিয়্যাক্ট করে রেস্পোন্স করার পরিবর্তে। এর বাড়বৃদ্ধিতে, এই প্রবণতার বিকাশে, দেশের সংবাদপত্তর ছাড়াও গণমাধ্যম হিশেবে গণ্য সমুদয় ইন্সট্রুমেন্টস্ মদত যোগায় ব্যাখ্যাযোগ্য কারণেই। ইন-ফ্যাক্ট গণমাধ্যম এক্ষেত্রে ক্যাটালিস্টের রোল প্লে করে দেখতে পাবো।

অপসংস্কৃতি, অশ্লীলতা, রুচিবিকার আর বিজাতীয় কৃষ্টির ধুয়া তুলে ব্যান্ডসংগীত নস্যাতের চাল্লু প্রবণতা আমরা আপাতত ভুলে থাকতে চাইব। করুণাবশত প্রসঙ্গ করতে না-চাইলে সেইসব খোঁড়া আপত্তি-অজুহাতওয়ালাদের কথা আলাপে তোলার প্রাসঙ্গিকতা আজ আর নাই মনে হয়। ম্যাকের সূত্রে এক-দুইটা প্যারায় আমরা বরং তৎকালে ব্যান্ডমিউজিকের কাভারেজ দিতে যেয়ে মুদ্রিত পত্রপত্রিকার আচরণ লক্ষ করব। শুধু ম্যাকের সঙ্গে নয়, এহেন আচরণ গোটা ব্যান্ডসংগীতের বেলায় দেখা গেছে ম্যাসমিডিয়াগুলোতে, এতদাচরণ তখনকার আউটস্ট্যান্ডিং সমস্ত ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানের সঙ্গেই মিডিয়াকে নিতে দেখেছি আমরা। তারপরও উল্লেখ্য যে ব্যান্ডসংগীতের প্রসারেও অল্পস্বল্প আন্তরিক প্রচেষ্টা আমাদের গোচরে এসেছে তখনকার বিরলপ্রায় কিছু ব্যক্তিক-প্রাতিষ্ঠানিক ইনিশিয়েটিভের দৌত্যে। সেসব আলাদা আলোচ্য।

রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ম্যাক যখন সাংস্কৃতিক অনড়-স্থবিরপন্থীদের রোষানলঝরা গ্যাঁড়াকলে পড়েন, তখনকার পত্রিকাপ্রতিবেদনগুলো মনে থাকলে এইটা আপনি বুঝতে পারবেন যে ম্যাসমিডিয়া কীভাবে মুরব্বিদের ভাষানুশীলনে ব্যাপৃত হতে পারে। এরও আগে একটা আনেক্সপেক্টেড ঘটনার উল্লেখ করে দেখানো যায় মিডিয়ার ব্যান্ডসংগীতবৈরী বিরুদ্ধাচরণ। ঘটনাটা ঘটেছিল সম্ভবত ১৯৯৬/’৯৭ দিকটায় মিরপুর স্টেডিয়ামে একটা ওপেন-এয়ার কন্সার্ট চলাকালে। এন্ট্রি বিষয়ক বচসার একপর্যায়ে দুই তরুণের মধ্যে একজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এই ঘটনার পর মূলধারা মিডিয়ায় মুরব্বিরা আবারও সোচ্চার হয়ে ওঠেন অপসংস্কৃতি শীর্ষক তাদের ভোঁতা হাতিয়ার শানিয়ে এবং রীতিমতো কলাম-উপসম্পাদকীয় ফেঁদে দাবি তোলেন ভয়াবহ ব্যান্ডসংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজন নিষিদ্ধকরণের জন্য। অথবা ড্রাগ ইত্যাদি নিয়া নানান গালগপ্পো তো পত্রিকায় আগে থেকেই ছিল। পরে ম্যাকের ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ প্রকাশের পরেও সংবাদপত্রিকাগুলোর রগড় লক্ষণীয়। অথবা ম্যাক কয়েদখানায় থাকাকালীন পত্রিকায় তামাশামূলক সংবাদগুলো পরিবেশন করা হতো যে-কায়দায়, সেই কায়দাটা খেয়াল করে দেখুন।

অন্যদিকে ইন্ডিয়ার উল্টাপাল্টা ব্যান্ড নিয়া, পাকিস্তানের জুনুন  নিয়া, ষাটের দশকে গেয়ে ছিঁবড়ে-হয়ে-যাওয়া স্টাইলে নাসিক্যধ্বনির রিমেইক-আর্টিস্ট নিয়া, জীবন-ও-গণমুখী অন্ত্যমিলপর্যুদস্ত লিরিকের কলকাত্তাই শিল্পী নিয়া আমাদের শ্রদ্ধাভাবগাম্ভীর্যের সীমাপরিসীমা নাই। কিন্তু দেশজ ব্যান্ডসংগীতশিল্পী নিয়া তাচ্ছিল্য করা ফ্যাশনই ছিল তখন যেন। পত্রিকায় কাভারস্টোরিও হতে শুরু করে একসময় ব্যান্ডমিউজিক, সেইটা আরেক অধ্যায়ের গল্প অবশ্য। তবে ট্রিটমেন্ট যদি খেয়াল করেন তো দেখবেন যে সেইসময় সি-গ্রেডের বলিউডনর্তকী মমতা কুল্কার্নি নিয়া আমাদের পত্রিকাপ্রতিবেদনে যে স্পেইস্ এবং স্ট্যামিনা ব্যয় হতে দেখি, এর এককোণা ব্যান্ডমিউজিকের জন্য খর্চা করতে দেখি না তাদেরে। এখনও অনুরূপ, তথৈবচ পরিস্থিতি এখনও। তখন ছিল শুধুই প্রিন্টমিডিয়া, এখন যুক্ত হয়েছে ইলেক্ট্রোনিক্যালি ভিশ্যুয়্যাল্ মিডিয়া। আজও বলিউডের-টালিউডের-হলিউডের নিউজে-ভিউজে সয়লাব আমাদের মিডিয়া। ব্যান্ডসংগীত তো দূর, এফডিসিনির্মিত চলচ্চিত্রকর্ম/চলচ্চিত্রকলাকুশলী নিয়া আমাদের পাতাগুলোর বিশ শতাংশও খর্চা হতে দেখি না।

ম্যাক এইসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সবসময়। এই বিদেশতোষণ আর স্বদেশতাচ্ছিল্যকরণ প্রবণতার বিরুদ্ধে। ম্যাস-মিডিয়ার এই বদখাসলত নিয়ে ম্যাকের গানে এবং কথাবার্তায় আমরা নানাবিধ বয়ান পেয়েছি বিভিন্ন সময়। একটা সাক্ষাৎকার উদাহরণত চোখের সামনে রেখে সেকালের প্রিন্টমিডিয়ার প্রবণতা আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক। সাক্ষাৎকারটা ছাপানো হয়েছিল ‘চলতিপত্র’ সাপ্তাহিকে, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, সে-বছরের ঈদসংখ্যায়। ইশ্যুটার পূর্ণ সনতারিখতথ্য সংরক্ষণ করা যায় এইভাবে : ১১ জানুয়ারি ১৯৯৯, ২৮ পৌষ ১৪০৫, বর্ষ ৩ সংখ্যা ৬; মূল সাক্ষাৎকার প্রকাশের কালে এর শিরোনামায় ছিল কথালাপ থেকে উৎকলিত একটা লাইন, “পেচ্ছাবে ভাসছে কলকাতা অথবা কাউকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিলেই জীবনমুখী গান হয় না” — আমরা এইখানে দেখব যে ম্যাকের গোটা সাক্ষাৎকারের অভিমুখ অন্যদিকে চলে যায় কেবল এই এক শিরোনামাবাক্য চয়িত হবার কারণে। এমনিতে এই ইন্টার্ভিয়্যু পঠনবস্তু হিশেবে অপেক্ষাকৃত উপভোগ্য, প্রশ্ন সঞ্চালনের ধরন এবং উত্তরকারীকে স্পেইস্ দেয়া ইত্যাদির কারণে বেশ ধর্তব্যযোগ্য উন্নত, অন্যান্য সমধর্মী ইন্টার্ভিয়্যুগুলো রম্য তামাশা আর রগড়ে পর্যবসিত হতে দেখি আমরা হামেশা। আমিনুল হাসান শাফিঈ এবং আলী ফিদা একরাম তোজো, পত্রিকার পক্ষে ম্যাকের ইন্টার্ভিয়্যু করেছেন যে-দুইজন, প্রশংসা পাবার যোগ্য কাজ করেছেন অবশ্যই। কিন্তু রগড় করার ব্যাপারটা ম্যাক শুরুতেই বুঝে ফেলেন এবং কাতর অনুরোধ করেন তামাশা অ্যাভোয়েড করার জন্য। লক্ষ করব যে এই ইন্টার্ভিয়্যুটাতে যে-কয়েকবার এহেন রগড় উঁকি দিয়েছিল, তখন ম্যাক কীভাবে ইন্টার্ভেন্ করছেন, উদাহরণ কপিপেইস্ট করি : বৃদ্ধ ও ন্যুব্জ সাংস্কৃতিক মুরুব্বিদের স্থিতাবস্থা আর যুবাশ্রেণির লড়িয়ে মানসিকতা নিয়ে ম্যাক বলছিলেন, তদ্দিনে ‘নিষিদ্ধ’ প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং ম্যাক ঘোষণা দিয়েছেন তার পরবর্তী প্রোজেক্টের নাম ‘রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০’, যদিও ঘোষিত অ্যালবামটা পরে বের হয় নাই আর, সেইসময় ম্যাকের কথার পিঠে সাক্ষাৎকারগ্রাহীরা বারবার পৌক করছিলেন তারই কথার কয়েন নিয়ে, অবিলম্বে ম্যাক সেইটা হ্যান্ডল করেন এই বলে, “আপনাদের মতো তথাকথিত প্রগতিশীলদের কাছ থেকে এ-রকম কথা শুনতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।” এই কায়দায় আরও বার-কয়েক রগড়চেষ্টা খানিক উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়, ভাগ্যিস!

এইবার বলি, ঠিক কোথায় এবং কেন কথালাপটার শিরোনামে ম্যাসমিডিয়ার/প্রিন্টমিডিয়ার বাঁদরামি দেখতে ব্যগ্র হব আমরা। “পেচ্ছাবে ভাসছে কলকাতা অথবা কাউকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিলেই জীবনমুখী গান হয় না”, ম্যাকের সাক্ষাৎকারের এ-ই ছিল শীর্ষবাক্য। সংগত কারণে ম্যাক তখন সুমন-নচিবিরোধী কিছু বক্তব্য প্রকাশ্যে এনেছিলেন আমাদের দেশীয় সংগীতবাজারের ব্যাপারটা মাথায় রেখে এবং কলকাতার তথা ভারতের আধিপত্যশীল মনোবৃত্তির ব্যাপারটা সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবেলা করার আর্তি নিয়ে। একই পত্রিকায়, ‘চলতিপত্র’ সাপ্তাহিকে, ম্যাক স্বনামে লিখিত ধারাবাহিক কলামে এতদবিষয়ে তার বক্তব্য পেশ করছিলেন এবং পাঠকচিঠির গালিগালাজ খাচ্ছিলেন ভারতীয় সুমনগানের বিপক্ষাচরণ করবার অপরাধে। এবং আমরা জানব যে আমাদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলোতে দেশের গাইয়ে-বাজিয়েদের সম্মান না-জানিয়ে একচেটিয়া ভারতীয় সংগীতজীবীদের ডেকে এনে মানপত্র ও ফুলমাল্যদানের ঠাকুর-ফেলে-কুকুর-ধরা খাসলত তখন তুঙ্গে। ম্যাক ক্ষেপেছিলেন এইসব দেখে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন সুমন চাটুজ্জের স্বভাবজাত উক্তিনিচয়ে বাংলাদেশের গান নিয়া আভিজাত্যবশত কটুক্তির রেশ। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যখন স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উদযাপনকালের অনুষ্ঠানে সুমনকে ডেকে এনে রীতিমতো বাংলাগানের মুক্তিযোদ্ধা শিরোপা দিয়ে দ্যায়, ম্যাকের তখনকার বেদনাবাহিত ক্রোধ গোটা বাংলাদেশের গানজীবীদের পক্ষ হয়েই আমাদের কাছে এসেছিল। অসংখ্য পপসংগীতশিল্পীর নাম ভুলে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরওয়ালারা আজম খানের কথাটা একবারের জন্যও মুখে আনতে পারে না! সাংস্কৃতিক এই মুরব্বিদের চেহারা আমরা চিনি। সুমন চট্টোপাধ্যায় বেড়াতে এলে এরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিরাট অনুষ্ঠান করেন, রজনী দশটার আংরেজি নিউজের পরে সেই অনুষ্ঠান রামপুরা দালান থেকে ব্যাপক ভাবগাম্ভীর্যভরা তেলানো সহযোগে সাংস্কৃতিক অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের উপস্থাপনায় দেশব্যাপী লোকেরে দেখানো হয়, ওদিকে ম্যাক-বাচ্চু-জেমস-পার্থকে বিটিভির ম্যাগাজিনমঞ্চে ঝুলে ঝুলে একেকটা তাড়াহুড়োর গান গাইতে হয় তা-ও বছরের এমাথা-ওমাথা বারদুইয়েক বড়জোর। ম্যাকের ক্রোধ যত আবেগবশত হোক না কেন, অবোধগম্য ও অমূলক ছিল না নিশ্চয়।

এরপরও এইটা স্বীকার্য যে প্রোক্ত শিরোনামায় ম্যাকের কথাগুলো অনর্থের দিকেই যায়, ম্যাককে ম্যাড প্রমাণ করতে চায় কালান্তরে। আজকে এসে সাক্ষাৎকারের সেই খোঁচাখুঁচিগুলোর কন্টিন্যুয়িটি তিরোহিত পুরোপুরি। কিন্তু ম্যাকের বক্তব্যগর্ভস্থ ক্রোধের ভিত্তি অন্তর্হিত নয়। এখনও ওই অধিপতি-অধীনতার সম্পর্কসংস্কৃতি বিরাজিছে আমাদের মিডিয়ায়। ম্যাকের সুমন-নচিবিরোধী উক্তি/বিবাদ আজ আর প্রাসঙ্গিক নয়। কেননা ‘জীবনমুখী গান’ ধারণাটা খোদ কলকাতার গণমিডিয়ামাদারির সৃষ্ট বোতলছাপ্পা আদতে এবং এই জিনিশ নিয়া আজকের কবীর সুমন ও তার সতীর্থরা মাধ্যমিক গণপত্রপতিদের বাধ্য করেছেন সঙ্কীর্ণ অর্থদ্যোতনার এই সিলমোহর তাদের গায়ে না-দাগাতে। ব্যাপারটা আজ অনেককাল হয় একেবারেই মীমাংসিত। এখন আর কোথাও বলা হয় না কবীর সুমন বা অঞ্জন দত্ত বা মৌসুমী ভৌমিক প্রমুখ জীবনমুখী মিউজিকবাদ্য করেন। আরেকটা কথা। ম্যাক তখন অনেক লেখায়, নিবন্ধে এবং সাক্ষাৎকথনে, এতদব্যাপারে যা-কিছু বলেছেন সেসবের পেছনে অন্য ক্রোধ অন্য বেদনা জ্ঞাপন ও প্রকাশের ইচ্ছেটাই ছিল প্রধান, অন্তত আমাদের তা-ই মনে হয়েছে বরাবর, যথাস্থানে কখনো সেই বেদনারাগের প্রমাণ দাখিল করা যাবে, এইখানে এবং এখন তো নয়ই। কিন্তু যদি ম্যাকের এই কথাগুলোকে এইভাবে আক্ষরিক অর্থে না-নিয়ে এর গোড়ার কথাটা আমলে নেয়া যেত, নিতে যদি পারতাম আমরা, বাংলাদেশের গানব্যাবসা আজ ভুবনপ্রসার লাভ করত মনে হয়। আমরা ম্যাকের কথাগুলো উপরটপকা নিয়েছি, মিচকি হাসির মজাক করেছি, ক্যাচি লিড হিশেবে ম্যাকের স্যুইপিং কমেন্টটাকে এনেছি এম্বোল্ডেন হরফে নজরটান দেগে ভুলভাবে জনসমক্ষে। এই করে করে তেরোটা বাজিয়েছি ব্যান্ডমিউজিকের। জিন্দেগিটা তামা করে দিয়েছি ইভেন খোদ ম্যাকেরও।

অধিকন্তু আজ যদি ম্যাকের সাক্ষাতে যান অভিন্ন সাক্ষাৎকারীদ্বয়, এই লিড নিয়া ম্যাকের পুনর্বিবেচনার কথা পাড়েন যদি, মিউজিকে ম্যাকের যে-ব্যাপ্ত পড়াশোনাজানাবোঝার পরিধি সম্পর্কে আমাদের আন্দাজ হয়েছে এদ্দিনে, মনে হয় তিনি লিড চেইঞ্জ করতেই রিকোয়েস্ট করবেন, অবশ্য আগের লিডটা তারই ইচ্ছেয় হয়েছে এমন তো ঘুণাক্ষরেও মনে হয় না, বা এমনকি ইন্টার্ভিয়্যুয়ারদের ইচ্ছেতেও হয়েছে এই ব্যাপারেও হলফনামা নাই আমাদের কাছে। ম্যাগাজিন-পত্রিকার ডেস্কে সেই লোকটাকেই বসানো হয় বলে শুনেছি, যে নাকি জানে কোনটা পাঠক রয়েসয়ে খায় আর কোনটা টপাটপ গলায় ফেলে ফের ছুটে যায় নেক্সট প্লেইটের দিকে। ডেইলি নিউজপেপার আর উইক্লি সাপ্লিমেন্ট তো রয়েসয়ে চেখে দেখলে ব্যবসায় লালবাত্তি নিশ্চিত। কাজেই ব্যাপারগুলো ডেস্কে বসে অঙ্ক কষা লোকটার দুর্বুদ্ধিপ্রসূত হবার চান্স অধিক। আর আজকের কবীর সুমন বা অঞ্জন দত্ত প্রমুখ তাদের গানবাজনা মানেগুণে এবং সংখ্যায় এমন একটা জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছেন যে এইসব নিয়ে দেড়-দুইবাক্যে রিবিউক করা যায় না, করলে স্পেইস্ এবং টাইম জুড়ে থিতু বসে করা চাই। কিন্তু এইসব উল্টোপাল্টো কটুকাটব্য করতে যেয়ে একদশকেরও অধিক সময় গেছে ম্যাকের যাত্রানাস্তিই ঘটায়েছি আমরা, ওদিকে সুমন-অঞ্জন একদিনও সৃষ্টিনিস্পৃহ বসে ক্ষেপণ করে নাই কাল, ম্যাকের গানের জায়গাটা আমরা সুগম রাখতে পারি নাই। ফিচলেমি আর ফস্টিনষ্টি লিড দিয়া আমরা ম্যাকের বেদনা ও ক্রোধের রাজনৈতিকতার, কালচার‍্যাল্ হেজিমোনি রুখবার চেষ্টার, ইঙ্গিত-ইশারা ঠাহর করতেই ব্যর্থ হয়েছি। ইন্টারপ্রেট করেছি ভুলভাবে, স্প্রেড করে দিয়েছি ভুলভাবে, ম্যানিপ্যুলেইট করেছি ইন্টেনশ্যন্যালি কিংবা আনইন্টেন্ডেড নায়িভ ইন্টারপ্রিটেশন্ দিয়ে, এবং ম্যাকের ও শক্তসমর্থ বাংলা গানের গতি করে দিয়েছি মন্থর।

অথচ ইন্টার্ভিয়্যু প্রকাশ ও সম্প্রচারের সময় এর শিরোনামায় ম্যাকেরই মুখনিঃসৃত যে-উক্তিটা বাছাই করে সেঁটে দেয়া হয়েছে, এর পরিবর্তে একাধিক ক্যাচি লিডলাইনই ছিল ম্যাকেরই ন্যাচারপ্রসূত উক্তিগুলোতে, যেমন একটা : “নামডাক কতটা হলো, সেদিকে আমার নজর নেই। আমি চেয়েছি একটা ছাপ রেখে যেতে”, — এই অটোবায়োগ্র্যাফিকতার মূল্য অপরিসীম আমাদের কাছে। একটা ছাপ রেখে যেতে চাওয়া মাকসুদ, রম্যপত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে সদর্পে সরে থাকা মাকসুদ, এই তীব্রগতি শিল্পীটির চেহারা আমরা পাঠ করে এসেছি আপন কররেখার ন্যায় তিরিশ বছর ধরে একটানা। মাকসুদের ছাপ, তার চলার পথের ট্রেইল, কি কি ইম্প্রেশন তিনি রেখেছেন এতাবধি এবং রেখে চলেছেন নিত্য অথবা রাখছেন না, আজকের দিনের নতুন গাইয়েকে নতুন বাজিয়েকে নতুন মঞ্চকর্মীটিকে সেই টিপছাপের মাপজোখ নিতেই হবে। না, ব্যক্তি ম্যাকের তোয়াজ নয়, নিজেদেরই ভিতরের ঘাড়ত্যাড়া ষাঁড়ের সম্মানে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে এখানে। একজন নবীন গানকর্মী ঠিক করবেন তিনি টর্চবেয়ারার হবেন, আলোবর্তিকা বহন করবেন, নাকি হবেন তিনি ভীতত্রস্ত অন্ধকারের চোখবন্ধ সংহিতা।

বারান্তরে এই নিয়া আরও কথা পাড়া যাবে। এখানে ম্যাকের থ্রুতে প্রিন্টমিডিয়ার ম্যানিপ্যুলেটিভ আচরণের আরও নজির হাজির করা যেত। তবে এক্ষণে এতাবধি। নিশ্চয় নিরবধি বহমান বাংলা গানের জয়গাথা গাইতে চাই আমরা। আর করে যেতে চাই ফিরে ফিরে এই প্রার্থনাটা — বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের একদা-উত্তাল পালে ফের হাওয়া লাগুক ঝড়ের ও ঝঞ্ঝাতাণ্ডবের, উন্মাদনায় কাটুক রাত ও দিন তারুণ্যে ঝঙ্কৃত, অস্তিত্ব উথলায়ে বাজুক মহাকালের ড্রামস্ ও গিটার।

 

বাংলাদেশের ছাপাকাগজে ব্যান্ডমিউজিক প্রোমোটিং অ্যাক্টিভিটিস

শুধু ব্যান্ডমিউজিক কেন, পপ্যুলার কালচারের খুব কম জিনিশই প্রিন্টমিডিয়া সানন্দে দেখায় আমাদেরে। দেখায় অবশ্য, যথা বাউলগান, পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া খানিকটুকু। বর্ণিত জঁরগুলোর মোটামুটি লিগ্যাসিই গড়ে উঠেছে এদ্দিনে, হেরিটেইজ তৈয়ার হয়েছে এলিগ্যান্ট পিপ্যলদের কল্যাণে, অ্যারিস্টোক্রেইসি অফ ড্রয়িংরুমডুয়েলার্স বলতে যে-জিনিশটা আবছাভাবে উল্লেখ করা যায়। অ্যানিওয়ে। একেবারেই ছিল না, তা নয়; ব্যান্ডমিউজিকের প্রচার ও প্রসারে বেশকিছু ইনিশিয়েটিভের হাজিরা আমরা দেখেছি সেই নব্বইয়ের দশক জুড়ে। বেশকিছু দৈনিকে এবং পাক্ষিকে সেই সময় সাপ্লিমেন্টারি ফিচার ছাপতে দেখা গিয়েছে রেগ্যুলার্লি। নিয়মিত প্রচ্ছদমুখ হয়েছে ব্যান্ডগ্রুপ এবং ব্যান্ডসিঙ্গাররা। তারপর একসময় স্তিমিত হয়ে এসেছে, সেইটা আলাদা কাহিনি, ফের শুরু হয়েছে মার্গীয় সংগীতের মড়া জাগাইয়া তুলিবার মজমা। আরও কত উরাধুরা হাজার টাকার ছাগলামি। জিন্দা গানের খবর নাই, মৃতের সৎকার নিয়া রাতজাগা রাই আর শ্যাম কাপলের কাতর করতালি।

কিন্তু তত্রাঞ্চলে যেয়ে কাজ নাই। আমরা বরং সুখবসন্তের গল্প বলি, বিদায় নেব সুখের ভুবুজ্যেলা বাজায়ে, অ্যাফ্রিক্যান বাদ্যযন্ত্রে একটু কর্ণপীড়া আপনার হতে পারে জেনে আগেভাগেই ন্যোটিস দিয়া দিনু। ওয়েল, দ্যান্, লেট্’স্ প্রোসিড। বলছিলাম ব্যান্ডসংগীতের, বাংলাদেশের খাঁটি বাংলায়, পিক পরিচ্ছেদটি নিয়া। আজম খান আর জিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠীর পপ মিউজিক অব্যবহিত পরের দিকে ব্যান্ডসংগীতের পল্লবঝাকড়া গাছে পরিণতি পায়। হিউজ অডিয়েন্স গড়ে ওঠে। ডেফিনিটলি হিউজ বিজনেস। বাণিজ্যের বহর সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাওয়া যায় সেই সময়ের পত্রিকাগুলোতে, ডেইলি-ফোর্টনাইটলি মিলিয়ে এন্তার পত্রপত্রিকার অলমোস্ট সবখানে, অ্যালবাম-রিলিজিং লিস্টিটা বা অ্যাডভার্টাইজিং কম্যার্শিয়্যালগুলোর মোট অ্যামাউন্ট লক্ষ করে দেখলে। সেই সময় এমটিভি ইত্যাদির কল্যাণেও আমাদের দেশী মিডিয়া গানবেচাবিকির দিকে একটু হলেও ঝুঁকছিল মনে হয়। এবং নব্বইয়ের দশকটায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ফ্রেশ ব্লাড প্রবেশিতে দেখা যায়, একসঙ্গে এর আগে এত পরিমাণে দেখা যায় নাই। নিত্য নোটন-নোটন পায়রার ন্যায় নিউজপেপার জন্মাচ্ছিল। প্রচুর ফিচার আইটেম আর সাপ্লিপেইজেস্ লঞ্চ হচ্ছিল। কলাগাছমালিকেরা রাতারাতি মিডিয়ামুঘল রুপার্ট মার্ডক্ হবার ড্রিমও হয়তো দেখছিল। ফলে ব্যান্ডসংগীত এই সুযোগটা লাভ করেছিল মুফতে। এবং তখনকার তরুণ সাংবাদিকেরা হাজারও ওজর-আপত্তি আর মালিকি নিয়ন্ত্রণ উজিয়ে ব্যান্ডের গুণগান, নিজের পছন্দের ব্যান্ডসিঙ্গারের ওপর ফোটোফিচার, ছাপতে পারছিলেন। সোলস-মাইলস-ফিডব্যাক-ফিলিংস-এলআরবি আর জেমস্-মাকসুদ-বাচ্চু সহ অসংখ্য ব্যান্ডকলাকুশলীদেরে নিয়ে সেই সময় ফিচার ছাপা হয়েছে নিয়মিত। তখনও পত্রিকামালিকের জ্ঞাতিগোষ্ঠী-পুত্রকন্যা বাংলা ব্যান্ডমিউজিকে ইন্ট্রেস্টেড হয়ে ওঠেন নাই, ফলে গোটা ব্যান্ডমিউজিকটা বেশ ফেয়ার ট্রিট লভেছিল অনুমান করি, রিয়্যালি স্টলোয়ার্ট ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানরা কাভারেজে এসেছিলেন।

উদাহরণত সঞ্জীব চৌধুরীর কথা ভাবা যায়, যিনি ফিচারপাতাগুলোর মধ্যে একটা স্মার্ট আউটল্যুক্ এনেছিলেন, সঞ্জীবের সংগীতক্যারিয়ার শুরু হবে এরও কয়েক বছর বাদে, ‘মেলা’ নামে একটা সাপ্লি দিয়া ব্যান্ড ও অন্যান্য আর্বেইন কালচারের প্রোমোশন্যাল ইনিশিয়েটিভস্ গ্রহণ করে পেপারের সার্কুলেশন বাড়িয়েছিলেন। অন্য পত্রিকারাও অচিরে সেই পথ ধরে। ব্যান্ডসংগীত শুধুই নিয়মিত শ্রোতাদের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বসাধারণ জনতার গোচরে আসে এই প্রথমবারের মতো। অব্যবহিত অচিরেই বিনোদনপত্রিকাগুলো তাদের রঙিন প্রচ্ছদ আর সচিত্র প্রতিবেদনের উপযুক্ত হিশেবে ব্যান্ডগুলোকেও গণনায় নিতে শুরু করে। ব্যান্ডসংগীতের যাত্রাপুস্তক যেদিন রচিত হবে, সেদিন এই পত্রিকায়োজন আর প্রতিবেদকদের অবদান স্বীকারের জন্য কয়েকটা চ্যাপ্টার ধার্য রইবে নিশ্চয়। সেইসব ফিচার-আর্টিক্যলের উপজীব্য হরহামেশা ব্যান্ডগুলোর লাইনআপ্ আর মঞ্চপরিবেশনার নানাবিধ উন্মাদনা। আর এই সময়েই মিনিবুক ছাপা হবার চল শুরু হয় জেমস-বাচ্চু-হাসান প্রমুখের বায়োস্টোরি দিয়ে। সেইসঙ্গে পোস্টার, স্টিকার; অ্যালবামগুলোর সঙ্গে লম্বাচওড়া ব্লার্ব/ফ্ল্যাপ, — তথা আমরা যারে ইনলে-কার্ড বলিয়া জানব। সবচেয়ে বেশি মিনিবুক/বুকলেট হয়েছে জেমসকে নিয়ে, এত প্রচুর যে এর ঠিকঠাক সংখ্যা ফিগারআউট করা আদৌ সম্ভব হবে না মনে হয়।

অ্যানিওয়ে। এইসব রম্য উৎপাদনের বাইরে তেমন কিছু কি ছিল? অত্যন্ত অল্প হলেও, ছিল, শুরু হয়েছিল অন্তত। পরে, এখনকার রমরমা গানবাজনা আর আইডিয়াবাজির দিনে, সেই অল্পটুকুও অনুপস্থিত। তৎকালে ব্যান্ডসংগীত নিয়া আলাপের একটা গাম্ভীর্য বোঝা যেত গোটা-কয়েক কাগজে। এর মধ্যে ‘চলতিপত্র’ সাপ্তাহিকটার নাম মুখে নেয়া যায়, এবং সবচেয়ে ভালো করত ‘আনন্দভুবন’ নামে একটা বিনোদনপাক্ষিক। অধুনা-সার্কুলেশন-সীমিত শোবিজের নিউজ-ভিউজপ্রচারক এই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন কায়সুল হক; এরই ভিতরে ‘সারেগারে’ পার্টটা সম্পাদনা করতেন গোলাম ফারুক, প্রয়াত তিনি অতি অকালে; বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেডের পয়সায় এইটা ছাপা হতো বাংলাদেশের ক্যাপিট্যাল ঢাকা থেকে। বেক্সিমকো গ্রুপের তখন পুঁজিকীর্তিকলাপ রমরমা, বাংলাদেশের ব্যাঙ্কিং সেক্টরে প্রায় বারোটা বাজানোর আগ পর্যন্ত অতিকায় ঋণখেলাপি অর্থগৃধ্নু এই গ্রুপের মিনিমাম পাঁচটা-সাতটা কাগজ ছিল বাজারে, এর মধ্যে একটা বার্ধক্যঝোঁকা সাহিত্যসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ‘শৈলী’ এবং একটা এই বিনোদনপাক্ষিক ‘আনন্দভুবন’, ছিল আরও দৈনিক-ফ্যাশনাইকোনিক-স্পোর্টস মিলিয়ে ভ্যানতারা নানা কাগজ ঝলমলে লেবাসের। হেন বিজনেস তখন কমই ছিল ভূবাংলায় যা বেক্সিমকো গ্রুপের প্রিপে/গ্রাসে গরহাজির। কাদামাটি থেকে চিনামাটি, ভ্রুণরোধক বেলুন, মৃতসঞ্জীবনী মলম বেচার বিচিত্র ব্যবসা তাদিগের করপুটে ধরা ছিল। ধরা খাবার বাদে একে একে মিডিয়াব্যবসা তথা পত্রিকা তামাদি হয়ে যেতে থাকে; শেষমেশ শেয়ারচুরির হিস্যা সাবড়ানোর পর মহাডাকাতিতে সাময়িক ইস্তফা দিয়ে এখন জ্বরের বড়ি বিক্রিবাট্টায় মার্জিন অবশ্য মন্দ থাকে না। আর হ্যাঁ, বেক্সিমকোমালিক সালমান এফ. রহমান হুজুরলেবাসে শ্মশ্রুমণ্ডিত ধবধবা গেটাপে জ্যানুয়্যারি ২০১৪ ও কন্সিকিউটিভলি ডিসেম্বর ২০১৮ ভোটরাহাজানির পরে এখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। যা-হোক, ‘আনন্দভুবন’ পত্রিকাটা সার্ভ করেছে এক-সময় বাংলা কালচারের বেশকিছু জমিজিরেতের ক্ষেতখামার উন্নয়নে। এরা ‘সারেগারে’ নামে একটা আলাদা পার্ট প্রবর্তন করেছিল পত্রিকাভ্যন্তরে স্পেশ্যালি ডেডিকেইটেড টু বাংলা মিউজিক অ্যান্ড মিউজিশিয়্যান্স। পত্রিকা-উইদিন-পত্রিকা, দারুণ হচ্ছিল, বলা বাহুল্য। ঘটনাটা আজও স্মরণীয়; অদ্যাবধি দ্বিতীয় নজির, আনন্দভুবনতুল্য প্রোফেশন্যাল বিনোদনম্যাগ, লোকসমক্ষে অ্যাবসেন্ট।

তো, ওই পত্রিকায় বেরিয়েছিল তখনকার বাংলা ব্যান্ডসংগীতের সঙ্গে অ্যাটাচড ছোটবড় অলমোস্ট সবগুলো দলের সচিত্র বায়োস্কেচ এবং আদ্যোপান্ত ক্যারিয়ারগ্র্যাফ। ব্যান্ডের অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম্বারগুলো নিয়া অ্যান্যালিটিক্যাল্ লেখাও প্রকাশের প্রয়াস লক্ষ করা যেত নিয়মিত। জনপ্রিয় গানের আঁতুড়কথন ও ভূমিষ্টক্ষণ নিয়া আদ্যোপান্ত রচনা ছাপা হতো গুরুত্বের সঙ্গে। দেশের বাইরেকার ব্যান্ড, ইংরেজি গান, রক্ ও অন্যান্য মিউজিক, মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস্ নিয়া ফিচার, এমনকি বাংলাদেশি ব্যান্ডসিঙ্গার-রকস্টারদের ফ্যাশন নিয়াও সম্ভ্রান্ত স্বতন্ত্র রচনা ছাপা হয়েছে এই কাগজটায়। ইন্টার্ভিয়্যু ছাপা হতো অনেক ইন্-ডেপ্ত। পত্রিকাটার একাধিক বিশেষ সংখ্যায় মাকসুদুল হক লিখেছেন ব্যান্ডম্যুভের ফিলোসোফিক্যাল্ অ্যাস্পেক্ট নিয়া একাধিক দীর্ঘকায় লেখা। গানমহাজনেরাই ছিলেন ‘সারেগারে’ বিভাগের মুখ্য ব্যক্তিত্ব। গোলাম ফারুক সম্পাদনাটাও করতেন অত্যন্ত তন্বিষ্ঠ। গোছগাছ করে লেখার সঙ্গে গানের নির্ভুল লিরিক্স, সংশ্লিষ্ট গানের গিটারকর্ড সমেত, সযত্ন প্রকাশিত হতো হপ্তাদুয়েকের বিরতিতে নিয়মিত। অদ্যকল্য হয়তো আপনি ইউটিউবে এইসব সাংগীতিক সেবাশুশ্রূষা লাভ করতে পারছেন অনায়াসে, সেই সময় এইটা ভাবাই যেত না। মাত্র বছর-পনেরো আগের অতীত সেসব দিন। লিরিক্স কর্ডসমেত রিটেন ফর্মে এখন তো মুড়িমাখার মতো সুলভ, এবং কর্ণে শুনিয়া সাউন্ড-কর্ড-নোট সমস্তই রিকন্সট্রাক্ট করা আদৌ কঠিন কিছু তো না আজকের মিউজিকামোদীর জন্য, তখন এইটাই ছিল মহার্ঘ পাওয়া। কাজেই যারা এই কাজগুলোর সঙ্গে ছিলেন দিবারাত সশ্রম প্রেমে জড়িয়ে, স্যাল্যুট তাদেরে জানাতেই হবে যেদিন এদেশের ব্যান্ডসংগীতের জেনেসিস্ লিখতে বসবেন আপনি।

 

গানের মেধাসম্পদ স্বত্ব, কপিরাইট, রয়্যাল্টি ইত্যাদি বিষয়ে

একটা সময়ে একলষেঁড়ের ন্যায় ফিডব্যাকের মাকসুদ সোচ্চার হয়েছিলেন, অল্পকালের এবং খুবই লিমিটেড পাল্লার উচ্চারণ ছিল যদিও, কন্টিনিউ করে নাই ব্যাপারটা পরে আর। কন্টিনিউ করে নাই মিউজিশিয়্যানদের একাট্টা না-হবার কারণে। অ্যালবাম করতে গেলে ব্যবসায়ীদিগেরে তো তোয়াজ করা লাগে, রেকোর্ডিং কোম্প্যানিগুলোকে হাতে রাখা লাগে, স্টেরিয়ো প্লেয়ারের যুগে একটা ক্যাসেট বার করতে যেয়ে হ্যাপা কম ছিল না আর্টিস্টদের, এবং অডিয়োবণিকেরা ফায়দা তুলেছে ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানদের এহেন শ্যেইকি বিহেইভিয়্যরের। ফলে ক্যাসেট বিক্রিবাট্টার মুনাফা বা লাভের গুড় পুরাটা যায় বিপণনপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে। ম্যাক আওয়াজ তুলেছিলেন এইসবের বিরুদ্ধে; এখনও স্বরচিত প্রবন্ধে-নিবন্ধে এই ইন্টেলেকচুয়্যল্ প্রোপার্টি রাইট, কপিরাইট, রয়্যাল্টি ইত্যাদি নিয়া মাকসুদ আলাপ তোলেন অবশ্য। কথাগুলো বলা দরকার আবারও জোরেশোরে, বলা দরকার সংগঠিত শক্তিসামর্থ্য নিয়ে, এবং এখন কোকস্টুডিও ধরনের মনোপোলি বিগক্যাপিট্যাল্ ইনভেস্টমেন্টের কারণে এবং এফএম রেডিও সম্প্রচার আর ইউটিউবে-ইন্টার্নেটে ফ্রি ডাউনলোড ইত্যাদির কারণে সিচ্যুয়েশন্ অনেক জটিল হয়েছে আগের চেয়ে। আমাদের কপিরাইট অ্যাক্ট এবং কপিরাইট রুল্ সম্পর্কাদি নিয়া আলাপসালাপ করার জায়গাজমি তৈরি করা দরকার গোটা গানেরই বিকাশের স্বার্থে।

এমনিতে এইসব নিয়া আমাদের দেশে হেলদোল কোথাও নাই। নিমের পেটেন্ট করে নিচ্ছে কে কিংবা বাংলার নক্ষত্রসুরভী চিকন চালের শেষ বীজটাও ঢুকেছে যেয়ে কাদের সিডস্টোরেজে, এইসব নিয়া ভাবার টাইম আমাদের নাই। নিৎশে নিয়া ভাবা যায়, হেইড্যাগার নিয়া ভাবা ওয়ার্থোয়াইল্, ফুকোলাকাঁড্যারিড্যাভাবনা দারুণ সার্কুলেইটেড। কপিরাইট, রয়্যাল্টি কি ইন্টেলেকচুয়্যল্ প্রোপার্টি রাইট কিংবা কনজ্যুম্যর রাইট কেন, কোনো রাইট নিয়াই বিশেষ দুশ্চিন্তা আমরা করি না। না, ভুল বললাম, সারাক্ষণ বেহুদা গালিগালাজ করি আর ‘কথা বলার অধিকার’ নিয়া আজিব কিসিমের আব্দারে লেপ্টায়া রাখি লিখন-কথন। ‘কথা’ হলো বলবার জিনিশ, কোনো উজিরনাজিরের দ্বারে ধর্না দিয়া আব্দার করবার জিনিশ না। রাইট বলতে আমরা মার্চপাস্টের শৃঙ্খলও বুঝি বটে।

জেনারেল নলেজের আওতায় এইটুকু অবশ্য আমরা জানি যে একদম গোড়ার বিচারে মিউজিশিয়্যান্স দুই টাইপের; — এক, স্যংরাইটার্স বলতে আমরা যা বুঝি এবং দুই, সিঙ্গার বা যাদেরে আমরা পার্ফোর্মিং আর্টিস্ট বলি। মিউজিকট্র্যাকগুলোর ক্ষেত্রে, যে-কোনো সংগীতকাজে, একেবারেই পৃথক দুটো কপিরাইটের ব্যাপার থাকে। লিরিক্স এবং মেলোডির জন্য স্যংরাইটাররা রাইট হোল্ড করেন বা আইনত হোল্ড করার হকদার, আর পার্ফোর্মিং আর্টিস্টরা গানের/বাদনের/কম্পোজিশনের বিশেষ রেকোর্ডকৃত অংশ তথা ভার্শনটির স্বত্ব অধিকারে রাখেন যে-রেকোর্ডটাকে আমরা মাস্টার রেকোর্ডিং বলেই চিনি। কিন্তু গোটা গানকম্পোজ যদি গীতিকার করে থাকেন, সংগীতযোজনা সমেত, যাদেরে আমরা বাগগেয়কার বলি বাংলায়, সেক্ষেত্রে কথাভাগের স্বত্ব ও সংগীতভাগের/রেকোর্ডিংভাগের স্বত্ব অভিন্ন ব্যক্তি অধিকার করেন। দুই ভিন্ন কপিরাইট চিহ্নিত হয়ে থাকে ইংরেজি ‘সি’ এবং ‘পি’ হরফ দিয়ে, এনসার্কোল্ড এবং স্মল্ লেটারেই © এবং ℗, যেখানে স্যং-কপিরাইট ‘সি’ চিহ্ন দিয়ে এবং সাউন্ডরেকোর্ডিং-কপিরাইট ‘পি’ চিহ্ন দিয়ে মার্ক করা হয়ে থাকে। ট্র্যাডিশন্যাল্ মিউজিক বিজনেসে দ্বিতীয়োক্ত কপিরাইট সাধারণত রেকোর্ডকোম্প্যানিগুলো অধিকৃত করে রাখে, যেইটা আসলে থাকার কথা কম্পোজারের অধিকারে। এর ফলে সংগীতরচয়িতা প্রাপ্য রয়্যাল্টি থেকে বঞ্চিত হন চিরতরে। এই বিপদ এড়াতে এখনকার মিউজিশিয়্যানরা উভয় স্বত্বই নিজের অধিকারে নিবন্ধিত করার ব্যাপারে সচেতন হয়েছেন। তবে এরপরও প্রচুর ফোকর থেকে যায় আর্টিস্টের অধিকার হরণের। ধরা যাক ©-কপিরাইট ঠিকঠাকই নিবন্ধিত হলো, ওদিকে -কপিরাইট নিয়া ঘাপলা আছে ব্যাপক, বিশেষত জনপ্রিয় গানগুলোর ক্ষেত্রে রেকোর্ডিং তো গোনাগুন্তিতে রাখাও মুশকিল, তাছাড়া কাভার ভার্শনগুলোর বেলায় এই বিপত্তিটা আরও অধিক। এখন তো নেটিজেনিক্ মিউজিক ওয়ার্ল্ডে এই সংকট অনেকান্ত।

কপিরাইট নিবন্ধিত হলো, ভালো কথা, রয়্যাল্টি কীভাবে কালেক্ট হবে? কড়ায়গণ্ডায় ক্যাল্কুলেইট করে মিউজিশিয়্যান যদি পয়সা জেবে নিতে শুরু করেন, তো সংগীতটা তার হবে কখন? দুনিয়ার দেশে দেশে পার্ফোর্মিং রাইটস্ অর্গ্যানাইজেশন্ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানকাঠামো রয়েছে এই কাজে ব্যাপৃত। সংগীতকার/শিল্পীরা অ্যাপোয়েন্ট করেন সেই পিআরও অ্যাজেন্সিগুলোকে বছরভর তাদের গানের লভ্যাংশের জাব্দাখাতা মেইন্টেন্ করার জন্যে। এরাই শিল্পীকে এবং কোম্প্যানিকে যার-যা-প্রাপ্য বণ্টন করে দেয়। নিশ্চয় মাগনা নয়, সার্ভিসচার্জের বিনিময়ে। অ্যামেরিকায় এই পিআরও সংস্থার ছড়াছড়ি। সবাই যার যার ক্লায়েন্টের সেবাসুবিধা সর্বোচ্চ নিশ্চিতকরণে কাজ করে চলে। এহ বাহ্য! বাংলাদেশে মেধাস্বত্ব তো মরুভূমিদূর, কোনো স্বত্ব নিয়াই স্বত্বাধিকারীর পক্ষে লড়বার কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। ক্লেইম্ করতে চান? আইনের ঘরে যান, আর বিজ্ঞাপনদালাল সাংস্কৃতিক নাট্যজোটের কেউকেটাদের রোষানলে পড়ুন, ক্যারিয়ারের বারোটা বাজান।

আইন অবশ্য আছে দেশে। মেধাসম্পদ ও তৎসংক্রান্ত স্বত্ব নিয়া বাংলাদেশে বেশকিছু সরাসরি আইন আছে। ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯, দ্য পেটেন্ট অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্ট ২০০৩ (১৯১১ সালের মূল আইন), কপিরাইট আইন ২০০৫ (অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে) এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। বুদ্ধিজাত সম্পদ ও মেধাস্বত্বাধিকারের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়্যল প্রোপার্টি অর্গ্যানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও)। সংস্থাটির সদস্য রাষ্ট্রসমূহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বুদ্ধিসম্পদ সুরক্ষার ব্যাপারে। বাংলাদেশ ১৯৮৫ সাল থেকে এর সদস্য হয়। কাজের বেলায় এখনও লবডঙ্কা।

আজকাল মেকানিক্যাল্ রয়্যাল্টি ক্লেইম্ করেন এবং পেয়ে থাকেন মিউজিশিয়্যানরা। সাধারণত অন্যান্য মাধ্যমে একটা গান বা বাদ্যরচনা রিপ্রোডিউসড হলে সেক্ষেত্রে এমআর প্রযোজ্য হয়ে থাকে। এমপিথ্রি, সিডি, মিউজিকসাইটে আপলোড, এফএম রেডিও প্রচার প্রভৃতি উৎস থেকে এই রয়্যাল্টি এসে থাকে। এর জন্যও মেকানিক্যাল রাইটস্ অ্যাজেন্সি রয়েছে দেশে দেশে। এমনিতেই সেসব জায়গায় মিউজিক পাব্লিশাররা এইসব নিয়া ঘাপলায় যায় না আর্টিস্টদের সঙ্গে। এদেশেই শুধু বই বেচে লেখকের রয়্যাল্টি মেরে প্রকাশক লাল হয়ে বাড়ির আঙিনায় লাখের বাত্তি জ্বালায়, আর মিউজিশিয়্যানদের ঠকিয়ে মিউজিকপ্রকাশক গ্লাসপ্যালেস কেনে নারিন্দায়। নিম্নবর্গের গানের মেধাস্বত্ব নিয়া আমাদের অ্যাকাডেমিয়ার আর্কাইভে কিছু প্রবন্ধপ্রতিম গবেষণাপত্তর হয়তো-বা পাওয়া যাবে খুঁজলে, ব্যান্ডগানের ব্যাপারে এক ওই ম্যাকের কিছু সক্রোধ রচনাপত্র ছাড়া আর-কিছুই দৃষ্টিসীমানায় আসে নাই।

 

ব্যান্ডস্পিরিট, ম্যাক ও ফিডব্যাকমেইটস্

ম্যাকের ফিডব্যাকমেইটদের গাওয়া যে-গানগুলো শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল, তন্মধ্যে “একা একা চলেছি এ-পথ / মনে মনে জ্বেলেছি শপথ / এখন আমি বিদ্রোহী / এখন আমি আর নহি অভিমানী” লিরিক্সের গানটা আজও অনবদ্য। লাবু রহমান গেয়েছেন, গীতিকার সম্ভবত আহমেদ ইউসুফ সাবের। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে এইটা পাওয়া যায় প্রথম। অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় গান একটা। একই অ্যালবামে পিয়ারু খান গেয়েছেন “ও আশা / তোমার ভালোবাসা / ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমায় / শেষ সীমান্তে / জীবনের প্রান্তে” — এইটাও আহমেদ ইউসুফ সাবের লিখিত ও যথারীতি ফিডব্যাক  কর্তৃক সুরারোপিত ও সংগীতায়োজিত। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ ছিল ফিডব্যাকের পঞ্চম প্রয়াস, অ্যালবাম হিশেবে, এর আগে-পরেও ফিডব্যাকসঙ্গীদের গাওয়া গান শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে ব্যাপকভাবে। ব্যাপারটা প্রমাণ করে ব্যান্ড হিশেবে ফিডব্যাকের সামর্থ্য, প্রমাণ করে ব্যান্ডের টিমস্পিরিট কতটা আইডিয়্যাল্ ছিল, সর্বোপরি ফিডব্যাকের ক্রিয়েটিভ কম্পিটেন্স অফ মেইকিং মিউজিক ছিল সত্যিই রিচ। শুধু ম্যাকের কথাকীর্তন দিয়াই ফিডব্যাক সেলেব্রেইট করা কাজেই ঠিক হবে না।

ব্যান্ডগুলোর ভিতরে, বিশেষভাবে মেইনস্ট্রিম বড় সার্কুলেশনের ব্যান্ডগুলোতে, এই স্পিরিটের ঘাটতি ছিল প্রকট। ফলে ব্যান্ড-লাইনআপ চেইঞ্জ হতো ঘনঘন। ঔদার্যের অপ্রতুলতা, আধিপত্য দলপতির, অটোক্র্যাটিক প্র্যাক্টিস ইত্যাদি কারণে ব্যান্ডের পার্ফোর্ম্যান্স ব্যাহত হওয়া ছিল কমন্ ঘটনা। ব্যান্ডের লিড্-ভোক্যালের বাইরে কেউ খুব-একটা গাইবার সুযোগ পেত না, ভালো লিরিক্স ও ভালো টেম্পোর গানগুলো ভয়েস-কোয়ালিটি বিচার ছাড়াই লিডের গলায় ঝুলতে দেখা যেত। ফলে বেঁধে যেত অসন্তোষকোন্দল। দল যেত ভেঙে। যেসব দল বড়, সেগুলো ভাঙন বাঁচিয়ে চলতে পারলেও অন্তিমে এনরিচড্ মিউজিকটা মার খেত। অন্তত ব্যান্ডটাকে ব্যান্ড মনে হতো না, মনে হতো একক প্রদর্শনী লিড্-ভোক্যালের, ব্যক্তিক প্রতিভা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যেত। সুবিধে একটাই ছিল যে, এর ফলে এক ব্যান্ড ভেঙে একাধিক ব্যান্ড গঠিত হতে দেখেছি আমরা। যার ফলও ফলেছে বেশ। উদাহরণের দিকে এ-যাত্রা যাচ্ছি না আর।

ফিডব্যাকে ম্যাক প্রধান ভোক্যাল হলেও অপ্রধান ছিলেন না বাকিরাও। গোড়া থেকেই ফিডব্যাক টোট্যাল ব্যান্ডের আমেজ দিয়েছে শ্রোতাদেরকে। যেমনটা আমেজ আমরা লাভ করেছি ‘সোলস’ এবং ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ডের মধ্য দিয়েও। গোড়ার দিককার ফিডব্যাকঅ্যালবামগুলোর একটাতে ভোক্যালদের একজন ছিলেন রুমেল, পরে যিনি কন্টিনিউ করেন নাই, তার কণ্ঠে “কেন খুলেছ তোমার ওই জানালা / কেন তাকিয়ে রয়েছ জানি না তো / মনে যে কি আছে জানি না / আমি না-জেনে সে-কথা যাব না ফিরে যাব না” — গানটা সাংঘাতিক শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল। অনবদ্য সংগীতযোজনা আর গায়নের কারণে গানটা আবহমান বাংলা রোম্যান্টিক গানে জায়গা পাবার যোগ্য। ‘ভল্যুম্-১’ হিশেবে ডেব্যু-অ্যালবামে এই গানটা পাওয়া গিয়েছিল। ‘উল্লাস’ বা ‘মেলা’ অ্যালবামে, ‘জোয়ার’ অ্যালবামে, একাধিক গান পিয়ারু খান এবং লাবু রহমানের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন ‘ওগো ছোট্ট পাখি’, কিংবা ‘ঝাউবন’ : “ঝাউবনের পথ ধরে / চলেছি আমি একা / কতদূরে যাব আমি জানি না / কতদূরে যাব জানি না / নদীর স্রোত যেখানে থেমে গেছে / সে-ই কী আমার সীমানা?” ইত্যাদি। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে তেমনি একটা গান, “ফিরে এসো / কেন অভিমানে আজ রয়েছ দূরে / এমনই যদি হলো আজ / ছিল ভালো তোমায় না-চেনা” — লাবু রহমানই গেয়েছিলেন ইয়াদ হয়।

কিন্তু একটা গান আলাদা করেই বলা দরকার এখানে, যেমন অন্যত্র অনুচ্ছেদে ‘একঝাঁক প্রজাপতি’ নিয়া আমরা স্মৃতিচারণ করেছিলাম, এইভাবে একে একে ফিডব্যাকের সব-কয়টা গান নিয়াও বলা যায় অবশ্য। তবে এইখানে একটাই শুধু, প্রসঙ্গক্রমে এক-দুইটা বাড়তি বাক্য খর্চা হবে হয়তো। বলা দরকার, এই গানটাতেও ভোক্যাল ম্যাক নন। তবু গানটা আমরা প্রায় অ্যান্থেমের ন্যায় গাইতাম, আজও গাইতে পারি, সম্মিলিত বাদনের ঐকতান গানটাতে একটা আলাদা এফেক্ট এনেছিল। “দিন যায় দিন চলে যায় / রাত যায় রাত চলে যায় / সময় তো বাধা মানে না / এই মনকে বোঝানো যে গেল না / এই মনকে বোঝানো যে গেল না” — গানের কথাভাগ মুখড়ায় এইমতো। অসম্ভব শ্রুতিমধুর সুর ও গতিসাবলীল গান। এই গানটারই টিউন ভিত্তি করে এরপর ভারতের অধীনস্থ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিল্পী নচিকেতা তার সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ‘নীলাঞ্জনা’ গানের প্রথম পর্বটি টিউন করেছিলেন এবং বাম্পার ব্যবসা হয়েছিল দুই বাংলায়। কৃতজ্ঞচিত্তে নচিকেতা পরে একাধিক ইন্টার্ভিয়্যুতে অ্যাক্নোলেজ করেছিলেন, ইন্ডিয়ান বাংলাদের ক্ষেত্রে প্রায় বিরল এই স্বীকারোক্তির কারণে নচিকেতা আমাদের কাছে তখনই প্রশংসিত হয়েছিলেন।

অবশ্য নচিকেতা অ্যাক্নোলেজ্ না-করলেও অসুবিধা ছিল না, আমরা তো জানতাম ঠিকই এবং ইতিহাসে এর উল্লেখও করতাম আজকে অন্যভাবে। “হাজার কবিতা বেকার সবই তা / তার কথা কেউ বলে না / সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা” — গানটা আসলেই ধারকর্জ ছাড়িয়ে অসাধারণ উচ্চতায় আসীন একটা গান। নচি গেয়েছেনও উজাড় করে। উল্লিখিত অংশটুকু হুবহু “দিন যায় দিন চলে যায় / রাত যায় রাত চলে যায় / সময় তো বাধা মানে না / এই মনকে বোঝানো যে গেল না” — এই অংশের প্লেটে বসানো। ঘটনাটা বলার একটা বিশেষ কারণ এ-ই যে, ইন্ডিয়া মার্কেটিং মোড়কের ফজিলতে বাংলাদেশের ব্যান্ডগান থেকে এন্তার নিয়েও মুকুট মাথায় পেয়ে যায়। এর পেছনে আমাদের বশংবদ-ধরনের মুরব্বিপ্রীতির কারণটাও কম দায়ী নয়। আমরাই নিজের নাক কেটে প্রতিবেশীর নথ ও নরুন বিক্রি নিশ্চিত করি।

কিন্তু নচিকেতা সততাটা দেখিয়েছিলেন, যেমন দেখিয়েছিলেন অঞ্জন দত্তও। দুজনেই বাংলাদেশের ব্যান্ডের গান শুনেছেন বিভিন্ন সময়ে এবং সপ্রশংস উল্লেখও করেছেন এর শক্তিমত্তা। আমাদের বিনোদনদৈনিকীর জ্ঞানী সাংবাদিকেরা পারলে ব্যান্ডগান বেরিয়ে এসেছে জীবনমুখীর পেট থেকে, এহেন গাঁজাখুরি লিড্ দিয়ে ফ্যালে পত্রিকায়! এতটাই ইন্দোচৈতন্য রঙ্গভরা বাংলাদেশের! রেনেসাঁর গোটা অ্যালবাম লোপাট করে দ্যায় ইন্ডিয়ার ‘উজান’ নাম একটা ব্যান্ড, মাইলসের গান কপি হয়, সোলস  কপি হয়, কিন্তু হুঁশ হয় না আমাদের যে পেছনদিকপানে কতটা রক্তপাত হচ্ছে। অ্যানিওয়ে। নচিকেতা প্রসঙ্গেই স্মৃতিটা মনে পড়ে গেল বলে উল্লেখ করেই রাখি এখানে। ব্যাপারটা ফিডব্যাক  নিয়ে। একবার ইন্টার্ভিয়্যুতে নচিকেতা চক্রবর্তীকে জিগ্যেশ করা হয়েছিল যে তিনি ব্যান্ডগ্রুপ যদি গড়েন কোনোদিন, তো কেমন হবে সেইটা? উত্তরে নচি বলেছিলেন, তিনি যেভাবে গান করেন তাতে ব্যান্ডের দরকার হবে না হয়তো, তবে ব্যান্ড গড়লে অবশ্যই ফিডব্যাকের মতো হবে সেইটা, মানে সেই ফিডব্যাকের ন্যায় বিদ্রোহচৈতন্য ও সময়ান্দোলক সংগীতের মাতোয়ালা পার্ফোর্ম্যান্স হতো নচির ব্যান্ডের আইডল।

 

১৪০০/১৯৯৪

নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশজ পোলিটিক্যাল পালাবদলের অব্যবহিত পরের জগঝম্প পরিস্থিতির একটা ভালো দলিলায়ন ফিডব্যাকের ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামটা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অব্যবহিত প্রতিক্রিয়া হিশেবে বাংলাদেশের গোটা সামাজিক পরিমণ্ডলে, বিশেষভাবেই আর্বান্ লোকজ অনুষঙ্গ ফোকাস্ করে, সেই সময়ের রিয়্যাকশন্ ও রেস্পোন্সেস্ ব্যান্ডগানে জায়গা পেয়েছে। ফিডব্যাকের কাজ এক্ষেত্রে ব্যাপকমাত্রিক বৈচিত্র্য ও শক্তিমত্তাবাহী। ফিডব্যাকের লিরিক্স থেকে একভাবে সেই সময়ের স্বপ্ন ও স্বপভঙ্গ, বাসনা ও বদমায়েশি, অবক্ষয় ও অন্তর্যাতনার ইতিহাসচিত্র তুলে আনা সম্ভব হতে পারে। এখানে আমরা সেই চেষ্টা করছি না যদিও, ফিডব্যাকের লিরিক্স নিয়া আলাদাভাবে একটা কাজ প্রিপেয়ার করা আমাদের অনেকদিন ধরেই বকেয়া হয়ে আছে; যেখানে আবহমান বাংলা গানে গদ্যস্পন্দী লিরিক্স ইন্ট্রোডিউস্ করার ক্ষেত্রে ফিডব্যাকের এবং বাংলাদেশের আরও অনেকানেক ব্যান্ডের পায়োনিয়্যরিং কন্ট্রিবিউশন্ উইথ প্রোপার এভিডেন্সেস্ প্রমাণ করা যায় কি না দেখা যাবে। সেজন্যে একটু যুতমতো বসা চাই। এই নিবন্ধে, এবং সহসা, সেই সুযোগ হচ্ছে না মনে হয়।

লাস্ট সেঞ্চুরির নাইন্টিজে বাংলাদেশে এসে প্রবেশ করছে দুনিয়াবাতাস হু হু করে, মুক্তবাজার অর্থনীতি নিশান গাঁড়ছে গেঁয়ো শহুরে মহল্লার ছাপড়া চাদোকানের বেঞ্চিতে, টেলিভিশনের এবং সংবাদপত্রের জেল্লা বাড়ছে বহরে-গতরে। অটোক্র্যাটের বুটের তলায় চিড়েচ্যাপ্টা মানুষের চোখেমুখে একটু স্বস্তিঝিলিক দেখা দিয়েই ফের মিলিয়ে যেতে লেগেছে ডেমোক্র্যাটিক্ ডেমোনদিগের পরাক্রমী পীড়নে। ন্যাশন্যাল্ সিনারিয়োর পাশে এসে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে ইন্টার্ন্যাশন্যাল্ খিলাড়িদিগের পুংটামির অবশেষ। সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙার পরে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে অ্যামেরিকা রাজপাট গুছিয়ে তুলছে। ল্যাটিন্যামেরিক্যান্ ল্যান্ডগুলোতে ড্রাগডিলিং বিকটভাবে ব্যাপকতর হচ্ছে। ইথিয়োপিয়ায়, বসনিয়া-হার্জিগোবিনায়, রুয়ান্ডায়, জাতিদাঙ্গা আর বিশ্বরাজনৈতিক অবরোধের ফেরে পড়ে হাড্ডিসার হাজার হাজার মানুষের জ্যান্ত মুখ খুবলে খাচ্ছে শকুন আর চিল। মধ্যপ্রাচ্যে লেগেছে গেস্টাপোস্মৃতি-পিছনে-ফেলা মানুষহননযজ্ঞ। ওয়ারলর্ড আর ড্রাগডিলারদের ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে দেশে দেশে। এবং বাংলাদেশেও এসবের অভিঘাত পড়তে শুরু করেছে অচিরে। এইসবের একটা ভালো উপস্থিতি, যথেষ্ট প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভঙ্গিসমেত, মিলবে তখনকার ব্যান্ডগানে। নাটকে-সাহিত্যেও, — যদিও বঙ্গসাহিত্যে, লেখাপত্রের বাংলাদেশে, — সেই প্রেজেন্স পরিমাণ ও মাত্রা-তাৎপর্যগত দিক থেকে ভিন্নতর ছিল বটে গানের তুলনায়। অ্যানিওয়ে। মিউমিউ-করা সাহিত্যই বাংলারাজ্যে প্রোডিউস হয় বেশি। কিন্তু আমাদের সময়ের তরুণ শ্রোতাদের মধ্যে এসব ব্যাপারে একটা প্রতিরোধী ভাবনা ও ভাব ছিল বলেই তো কম্যার্শিয়্যাল্ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এর একটা উপযোগ ও উৎপাদন-উদ্যোগ হাজির ছিল — এইটাও সত্য। ওই সময় তো অত বুঝতে পারতাম না, অনেক পরে এসব ভেবে বের করেছি। ইন্ দৌজ্ ডেইজ্ খালি নিজের একটা মন-কেমন-করা কারবারের নিষ্কৃতি চাইতাম গানের কাছে, পেয়েছিও প্রভূত।

তো, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যান্ডগানে বেশ উল্লেখযোগ্য শক্তিসামর্থ্য নিয়েই রিফ্লেক্টেড হতে দেখা গেছে সে-সময়। এবং সবচেয়ে শিল্পসফল এক্ষেত্রে ফিডব্যাক, এখন পর্যন্ত, অথবা ওয়ারফেইজ, এবং নোভাও। অবশ্য তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু মোটিফ সব দলের গানেই ফুটে উঠত। পুরনো ও সফল ব্যান্ডগুলোর মধ্যে পোলিটিক্যালি স্ট্রং ভয়েস্ ও লিরিকের গান করত এমনকিছু ব্যান্ডের মধ্যে মেনশন করা যায় এলোমেলোভাবে : নোভা, চাইম, ড্রিমল্যান্ড, এলআরবি, ওয়ারফেইজ এবং সর্বোপরি ফিডব্যাক । এরা-যে তাই বলে একেবারে মিশনারি কায়দায় পোলিটিক্যাল্ গান করার দল ছিল, তা নয়। প্রেমের গানই গাইত মুখ্যত, যদিও অ্যাপোলিটিক্যাল্ বলতে যা বোঝায় তা-ও নয় তারা। তাদের গানগুলো শুনে যে-কেউ ধরতে পারবে সেই ইন্টেনশন্, অবশ্য লিরিকের ইন্টেন্সিটি ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা আমরা করতে যাচ্ছি না। আমরা বলতে চাইছি, প্রেম ও প্রতিবাদ তখন হাত-ধরাধরি ছিল অনেকদিন। ওই সময়ে, লাস্ট সেঞ্চুরির নাইন্টিজে, সেই আমাদের সময়ে। যেমন ছিলাম আমরাও, প্রতিবাদে-প্রেমে এমনকি বিষাদে এবং গজলে ও গানে। কেবল প্রমোদের মেলায়, কেবলই ফাইজলামি কিংবা জ্ঞানের গোঁসাইগিরি, কেবলই কবিতাফ্যাশনের কুতুবশাহি ছিল না আমাদিগের নসিবে। এবং কমেন্টে কম্ব্যাটিং অ্যাগেইন্সট্ দেশকালসমাজসভ্যতা, নাঢ়াই ছাড়াই জিতিয়া যাইবার হাউশের স্টারট্রেক ওয়ারিয়র্স, যুগপৎ স্লিপিং অ্যান্ড কোয়ারেলিং উইথ দ্য এনিমি, আমাদের কালে এমনধারা আব্দার সেইভাবে প্রেজেন্ট ছিল না। ভাগ্যিস, অত একবগ্গা ছিল না আন্তর্জালহীন অন্তরতম ঘনতরঙ্গ সময়টা আমাদের।

কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পোন্সিবিলিটির এই প্যাট্রন্-ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপের জামানায়, এই মক্কেল-মুরুব্বি অন্বয়ের  জামানায়, ইম্যাজিন্ করা খানিকটা কঠিনই হবে সেই-সময়ের ব্যান্ডগ্রুপগুলো কতটা সোচ্চার ও অগ্রণী ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে! এই গল্প অন্যদিন করা যাবে। এখন বরং সংক্ষেপে এটুকু বলেই বিরতি দিই যে সেকেলে ব্যান্ডগানের লিরিক্স লক্ষ করলে দেখা যাবে নব্বইয়ের গণম্যুভমেন্ট, গোটা আশি-দশকজুড়ে স্বৈরাচার ও দমনপীড়ন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ সমস্তই এসেছে। সবাই ঠিক ভালো লিরিক্স ডিল্ করতে না-পারলেও সব্বাই সমান সচেতনতা থেকে ব্যাপারগুলো নিজেদের গানসৃজনকালে মনে রেখেছে। ফিডব্যাক, ওয়ারফেইজ, এলআরবি, রেনেসাঁ, নোভা ব্যান্ডগুলো খুবই ভালো করেছে এক্ষেত্রে। অন্যদের এফোর্টগুলোও অবজ্ঞা করবার নয়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। এরশাদপতনের জন্যে যে-আন্দোলন হয়েছিল, সেইটার একটা ভালো ডক্যুমেন্টেশন্ ব্যান্ডগান থেকে বের করা সম্ভব। অন্য কোনো গান থেকে, এই বাংলাদেশে, সেই উত্তাল সময় উপজীব্য করে লেখা একটা লাইনও তো বের করা যাবে না। ব্যান্ডগানেই এসেছে সেই সময়টা, আধুনিক টিভিশিল্পীদের ভদ্রসংস্কৃত গানে এইসব জায়গা পায় নাই। এমনকি অধুনা-বিকৃত প্রোমিথিউস্ ব্যান্ডের একটা অ্যালবাম পাওয়া যাবে সেইসময়টাকে নিয়ে, যেখানে নূর হোসেন নিয়া গান তো রয়েছেই, লিড্-ভোক্যাল্ বিপ্লবের কথা-ও-সুরে ‘শাবাস নূর হোসেন’ গানটি রিলিজ পায় ৯৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে একটা অ্যালবামে; যেখানে সেই দুর্ধর্ষ গানটাও আছে এরশাদবাহিনীর গুলিতে নিহত ডাক্তার মিলনকে নিয়ে : “ওগো মা তুমি কেঁদো না / মিলনের রক্তে আমি / হটিয়েছি স্বৈরাচারী / উড়িয়েছি স্বাধীনতার পতাকা।” বা নব্বই-পরবর্তী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক গোঁজামিল ও গোয়ার্তুমি নিয়াও ব্যান্ডগান নীরব ছিল বলা যাবে না। ওয়ারফেইজ ভালো কাজ করেছে এই ফিল্ডে। এবং ফিডব্যাক, উল্লেখ বাহুল্য, অভাবনীয় চুড়োস্পর্শী মিউজিক্যাল্ প্রোটেস্ট চালায়েছে ওই-সময়টায়। এবং ওই নব্য গণতান্ত্রিকতা নিয়ে, প্রেসফ্রিডম ভায়োলেশন নিয়ে, সেইসময়কার ইয়াংজেন অ্যাঙ্গার নিয়ে ফিডব্যাক ও তার ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামটা মাইলস্টোন্। পরে ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন মাকসুদ, গড়লেন ফের ব্যান্ড-কনসেপ্টের ভেতরে থেকে ক্যারিয়ার নতুন করে, ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যানারে ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ গোটা বাংলা গানের ইতিহাসে একটা দুর্ধর্ষ ঘটনা।

ফিডব্যাকের ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে একডজন গানের ব্যালাড আঙ্গিকের দীর্ঘ কথাভাগের গদ্যস্পন্দী লিরিকগুলোর মধ্যে মেনশন করা যায় ম্যাকের লেখা ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’ এবং ‘সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য’ গানদুইটার কথা, যেখানে বাংলা আবহমান গানবাজনার পরম্পরায় পোলিটিক্যাল্ লিরিক্স কম্পোজ্ করার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এরপর ম্যাকের এইধারা আউটার-ফিডব্যাক গানবাজনাসৃজন বেগবান হয় বহুলভাবে। ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের জন্য নিষিদ্ধ’ এবং বিশেষভাবে ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবাম দুইটাতে ম্যাকের প্রোজেইক্ লিরিক্স রচনা ম্যাচিয়োরিটির চূড়া স্পর্শ করে। এই ব্যাপারটা পরবর্তীকালের ‘আর্টসেল’ এবং ‘শিরোনামহীন’ ব্যান্ডদ্বয়ের কাজে আরও ব্যাপকতা নিয়ে এসেছে। ব্যান্ডমিউজিকের সবচেয়ে সিগ্নিফিক্যান্ট অবদান অন্ত্যমিলপর্যুদস্ত সহস্রবর্ষী বাংলা গানে এই গদ্যস্পন্দ। ঘটনাটা আলাদাভাবে আলোচনাকেন্দ্রে আনতে হবে আমাদেরকে একদিন।

অন্যান্য গানের মধ্যে, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে, ম্যাকেরই লেখা ‘মামা’ গানটাতেও নব্বইয়ের একটি বিশেষ ট্রেন্ড রম্য-কমিক ধাঁচে এসেছে উঠে। এছাড়া ম্যাকের অনবদ্য কথাবয়নের নজির ‘গীতিকবিতা-১ (মনে পড়ে তোমায়)’ এবং ‘গীতিকবিতা-২ (ধন্যবাদ হে ভালোবাসা)’ গানদুইটাতে মেলে। ‘টেলিফোনে ফিসফিস’, ‘ভীরু মন’, ‘পালকি ২য় পর্ব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘আশা’, ‘সুখী মানুষের ভিড়ে’, ‘আপন দেশে চলো’ প্রভৃতি ফিডব্যাকের রকসৃজনী ইমেইজটাকে একবাক্যে শ্রোতার কাছে আদৃত করে তোলে।

 

আজি হতে বহুবর্ষ আগের এক বঙ্গাব্দ

দুইযুগ হয়ে গেছে, দেখতে দেখতে, এখনও তরতাজা যদিও। বলছিলাম একটা অ্যালবামের কথা। গানের অ্যালবাম। সংক্ষেপে ব্যান্ডগানের অ্যালবাম বললে বেশিরভাগ লোকের চিনতে সুবিধা। আমরা বাংলা গানের অ্যালবাম বলতে চেয়েছি, নিশ্চয় একদিন কম্পার্টমেন্টালাইজড পরিচয় জ্ঞাপনের দরকার আর থাকবে না, কিন্তু বর্তমানে যে-ধারায় এবং যেমন কিসিমে জ্যান্ত গানবাজনা হয় তাতে এই অ্যালবামটাকে ব্যান্ডগানের অ্যালবাম বললেই ডিস্টিংক্ট ফিচারটা আন্দাজ করতে সুবিধা হবে। এইটা লারেলাপ্পা ভাবান্দোলক গানের অ্যালবাম নয়, এইটা রাজনৈতিক বীক্ষণ ও বিবেচনাঋদ্ধ সংগীতের সবচেয়ে গোছানো সংকলনের একটা। বাংলায়, বাংলাদেশে এবং অন্যান্য বঙ্গে, এর জুড়ি আগে যেমন ছিল না আজও জুড়ি বিরল। ফলে এই অ্যালবামটা আবহমান বাংলা আধুনিক গানের অ্যালবাম যতটা-না তারচেয়ে বলা সংগত হবে এইটা যেন চোরাগোপ্তা হামলা। আগে এবং পরে এমন উদ্যোগ শুধু একটাই, যেইটা এই অ্যালবামেরই উদ্গাতা ব্যান্ড থেকে বেরিয়ে বছর-আড়াইয়ের মাথায় নিয়েছিলেন। পরে কখনো, অন্যত্র, সবিস্তার বলা যাবে এইসব নিয়া। আপাতত আমরা আলোচ্য অ্যালবামের নামপরিচয় ইয়াদ করব শুধু।

‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ আলোচ্য অ্যালবামের নাম। বোধহয় বাকিটুকু বলা লাগবে না। ব্যান্ডের নাম ফিডব্যাক। নয়া বাংলাদেশের গানের ইতিহাসে এই ব্যান্ড এবং এদের এই অ্যালবামটা মাইলেজের হিসাবে বহু দূরপাল্লার স্পিড নিয়া বাংলায় আবির্ভূত হয়েছিল ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে। সেই খ্রিস্টীয় বছরটা বাংলায় ছিল শতাব্দীর শুরু এবং নবতর আরেকটা বাংলা সহস্রাব্দেরও সূচনালগ্ন। ১৪০০ বঙ্গাব্দের আরম্ভ। বলা বাহুল্য, এর ঠিক ছয় বছর বাদে শুরু হতে যাবে খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দ। সব মিলিয়ে অ্যালবামটা ছিল যুগপৎ বঙ্গসহস্রাব্দ ও খ্রিস্টসহস্রাব্দ কোমেমোরেইটিং একটা অ্যালবাম। সংকলনের নামকরণ থেকে শুরু করে এর প্রচ্ছদচিত্রণ, নকশা ও বাহির-ভিতর অলঙ্করণ, কথিকাভাষ্য নির্মিতি ইত্যাদি সব দিক দিয়ে একইসঙ্গে গনগনে এবং গম্ভীর। অভাবিতপূর্ব। চমকে যেমন দিয়েছিল, অস্বস্তিতেও ফেলেছিল; মনে হয়েছিল, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ আবার কেমন নাম বাবা? গানের অ্যালবামের নাম হবে আমি তোমায় ভালোবাসি কিংবা আমি তোমাকে চাই ইত্যাদি, তা না, এরা দেখি রীতিমতো বস্তায়-বেহদ্দ প্রবন্ধ নামিয়ে ফেলেছে অ্যালবামনাম দিয়া! তারপর যারা একবার অ্যালবামটা হাতে নিয়া নাড়াচাড়া করেছেন, ফিতার ক্যাসেটের সেই ইউটিউবসভ্যতাপূর্ব সময়ে এই অ্যালবাম যারা একবার শুনেছেন, গোটা জিন্দেগি জুড়ে এর জুড়ি খুঁজে চলেছেন তারা বাংলায় তারপর থেকে। এ এমন কাজ, প্রকাশ্যে এর তারিফ করা আর না-করায় কিচ্ছু যায় আসে না। আবহমানতা নাই এমন একটা কাজ। পরে এর একটামাত্র জুড়ি দেখতে পাবো আমরা, ১৯৯৯ দিকটায় বোধহয়, ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ সংকলন প্রকাশিত হলে পরে। এইটা ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের অভিষেক নিবেদন ছিল। আরডিএক্স, ডিনামাইট, ব্যালাস্টিক মিসাইল শুধু। বলা ভালো, ধূমকেতু, বিষের বাঁশি। এই ধরনের যুগন্ধর রেবেলিয়াস ইনিশিয়েটিভগুলোর কথা আলাপচক্রে এলে কাজী নজরুল ইসলাম তো পুনঃপুনঃ স্মৃত হবেনই। কিন্তু পরে যেসব ইনিশিয়েটিভ হয়েছে এই ধারায়, একেবারেই হয় নাই তা না, সেগুলি ছিল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ঝাঁকের কৈয়ের মাঝখানে একেকটা আচমকা লাফমারা ঘাঁই। ফিডব্যাক এবং মাকসুদ-ও-ঢাকা ব্যান্ডদ্বয়ের প্রোক্ত দুই সংকলনই বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞাভাষ্যঋদ্ধ পরিকল্পিত দুইটা পূর্ণাঙ্গ কাজের নিশানবাহী।

নিবন্ধের এই বৈঠকে আমরা শুধু ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ সংকলনের ক্যাসেটখাপ থেকে এর ইনলে-কার্ড বা ব্লার্বটুকু সংরক্ষণ করব। বইয়ের যেমন ভূমিকা, বা বইপরিচিতিমূলক ব্লার্ব, ক্যাসেটের খাপের ভিতরে সেই-সময় তেমনি ইনলে-কার্ডে ক্যাসেটের নির্মাণনেপথ্য তথ্যাদি প্রকাশের চল শুরু হয়েছিল। ইন-ফ্যাক্ট, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ থেকেই জিনিশটা চালু হয়েছিল যদ্দুর ইয়াদ হয়। এরপর থেকে তো পোস্টার থেকে শুরু করে রীতিমতো ব্যুকলেট-বই ছাপিয়ে ক্যাসেটের সঙ্গে সেঁটে দেয়াটা ট্রেন্ডি হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ অ্যালবামপ্রচ্ছদের সঙ্গে সেই ইনলে-কার্ডগুলোতে ব্যান্ডের আত্মবিজ্ঞাপক কথাবার্তা, পারিবারিক-ব্যবসায়িক স্বজন ও বউ-প্রণয়িনী কি ইয়ারবখশির নামোচ্চার, আল্লা-ঈশ্বরের নিকট দোয়াখায়ের ও কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি স্বীকার করাই ছিল মুখ্য। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামের এই লিট্রেচারে একটা ভাষ্য জুড়ে দেয়া হয়েছিল ভূমিকা হিশেবে, যেইটা পাঠকৃতি হিশেবে উল্লেখযোগ্য। অনুরূপ ফিডব্যাকের পরবর্তী প্রয়াস ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবামেও ভূমিকাভাষ্যটি ছিল অনবদ্য। অথবা ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের দু-দুটো সংকলন ‘(অ)প্রাপ্ত বয়স্কের নিষিদ্ধ’ ও ‘ওগো ভালোবাসা …’ অ্যালবামেও ভূমিকাসম্বলিত প্রচ্ছদপোস্টার দুইটিই ছিল সমস্ত বিবেচনায় পাঠযোগ্য ও গুণমানোত্তীর্ণ। বর্তমান নিবন্ধে আমরা শুধু ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ সংকলনের পোস্টারফ্ল্যাপে লেখা বাক্যাবলি প্রিজার্ভ করব।

সংকলনটা হাতে নেয়ার সময় কারো মুখাবয়ব দেখি না আমরা, অ্যাট-লিস্ট সেই সময়টায় ফিতার ক্যাসেট হাতে নিয়া যা বা যেভাবে দেখেছি তার বিবরণ বলছি, প্রায় প্রত্নজীর্ণ পুরানা রাজবাড়িসদৃশ একটা দালানের ইমেইজই দেখি। বিল্ডিং ইমেইজের ঠিক উপরের দিকে বাঁ কোণা ঘেঁষে অ্যালবামের নামলিপিটুকু। হরফ বড়সড়। বঙ্গাব্দ ১৪০০। চোখ নিচের দিকে নেমে এলে দেখতে পাই, ফিডব্যাক, ব্যান্ডের নামটা। ব্বাস, আর কিছু না। খাপ খুলে ফিতা স্টেরিয়োতে দিয়ে কার্ডটা আস্ত হাতে নিয়ে মেলান করে ধরতেই বোঝা গেল চমকপ্রদ ঘটনাটা। মাঝারি সাইজের একটা আস্ত পোস্টারই বলা যায়। একপিঠে প্রচ্ছদ, ভিতরডানে ব্যান্ডমেম্বার পাঁচজনের পূর্ণাবয়ব স্থিরচিত্র, সর্বডানে অ্যালবামভূমিকার রিটেন টেক্সট একটানা চারটা প্যারাগ্র্যাফে। দেখি তো, বঙ্গাব্দ ১৪০০, ভূমিকাভাষ্যটা :

“আজ হতে শতবর্ষ আগে কোনও-এক নববসন্তের প্রভাতে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ পরের ছবি তাঁর অলোকসুন্দর ছন্দোময় সুরে বাঁধতে চেয়েছিলেন। সেদিনের যৌবনের রাগে রাঙানো পৃথিবী ও পুষ্পরেণুগন্ধমাখা দখিনা বাতাস কবির কল্পনাকে চঞ্চল করে তুলেছিল। সে-কথাই শতবর্ষের পরের এই আমাদের অধীরচিত্তে জানাতে চেয়েছেন কবি। আমরা যেন তাঁকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও মনে করি। ধন্য আমরা। সে-১৪০০ সালের হাওয়ায় আমাদের দেহযাত্রা চলছে। সময়ের টানে অনেককিছু হয়তো মলিন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কবির সে-বসন্তবর্ণনা কী করে মলিন হবে? যেমন মলিন হবার নয় আমাদের কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন। কে বলবে, যে-জরাজীর্ণ দালানের সামনে আমরা ক-জন দাঁড়িয়ে তা রবীন্দ্রনাথের অজেয় আকাঙ্ক্ষার মতোই কোনও স্মৃতিখণ্ডের অংশ হয়ে নেই?

এই এক জীবনে আমরা দেখার সুযোগ পেয়েছি অনেক। ১৪০০ সাল পুরো হতে দেখেছি। আর কী আশ্চর্য! কিছুকাল পর আসছে খ্রিস্টীয় নতুন শতাব্দী। তাও দেখতে পাবো আমরা। যুগলভাগ্য বলতে হয় আমাদের।

আমরা দেখেছি যুদ্ধ, খরা, ঝড়, দুর্ভিক্ষ, মহাপ্লাবন, রক্তক্ষয়, সন্ত্রাস, এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনও। একাত্তরের মতো এক উত্তুঙ্গ ইতিহাস রচিত হতে দেখেছি। একইসঙ্গে দেখেছি মনুষ্যধর্মের চরম অবনমন।

কিন্তু আর নয়। আজ আমরা মুছে ফেলতে চাই পুরনো সব গ্লানিবোধ। তুচ্ছ করে দিতে চাই সব হিংসা ও বিরোধ। নতুন স্বপ্ন নতুন আয়োজন আর নতুন মন নিয়ে তাকাতে চাই সামনের দিকে। সে-আশা বুকে করে আমাদের এই নিবেদন — বঙ্গাব্দ ১৪০০।”

উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদসমূহের কথাগুলো বঙ্গাব্দ-কোমেমোরেইটিং ফিডব্যাকের কিংবদন্তি সেই অ্যালবামের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছিল। পরে কখনো, হয়তো অন্য কেউ, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ সংকলনের গানগুলো এবং ম্যাকের অন্যান্য ব্যালাডধর্মী গানে গদ্যস্পন্দনের অভিনবত্ব নিয়া আলাপ তুলবেন। সংকলনের পুটের দিকটায়, যেমনটা থাকে আর-দশটা অ্যালবামে তেমনি, ফিতার দুইদিককার গানগুলো শিরোনামক্রমান্বয়ে লেখা। বারোটা গান মোটমাট। ক-পিঠ আর খ-পিঠ। ছয়টা করে গান প্রতি পিঠে। একডজন বিস্ফোরক। আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিস্ফোরকগুলো।

“ক-পিঠ : টেলিফোনে ফিসফিস ।। মামা ।। গীতিকবিতা-১ ।। উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি ।। ভীরু মন ।। পালকি – ২য় পর্ব
খ-পিঠ : বিদ্রোহী ।। আশা ।। গীতিকবিতা-২ ।। সুখী মানুষের ভিড়ে ।। আপন দেশে চলো ।। সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য”

প্রচ্ছদপৃষ্ঠার উল্টা সাইডে অ্যালবামের বারোটা গান গীতিকার ও সুরকারের নামতথ্য সহ গুছিয়ে লেখা। গানগুলোর লিরিক ছাড়াও দুইমাথায় দুইটা কলাম বক্স করে একটায় নেপথ্য কুশলীদের তথ্য ও অন্যটায় ব্যান্ডসদস্যদের ফোটোগ্র্যাফসমেত কার কি ভূমিকা এই ব্যান্ডে এবং এই অ্যালবাম নির্মিতিতে সেইসব তথ্য লভ্য। সর্ববাঁয়ের কলাম থেকে দেখা যাক নিচের অংশটা :

“সাউন্ডটেক সংস্থা বাজারজাতকৃত ও অডিও আর্ট স্টুডিয়োতে ধারণকৃত ফিডব্যাকের পঞ্চম প্রয়াস ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’।

শব্দধারণ ও সংমিশ্রণে আজম বাবু ও পান্না আজম, সহায়তায় শামীম।
আবৃত্তি ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
আলোকচিত্র চঞ্চল মাহমুদ।
প্রচ্ছদ, পোস্টার, গ্র্যাফিক ডিজাইন ও পরিকল্পনা আনীলা হক।
কম্পিউটার গ্র্যাফিক্স আতিকুর রহমান, ডিজিগ্রাফ লিমিটেড।
শিফট বের করে দেয়ার জন্যে রতনভাইয়ের কাছে আমরা সবিশেষ কৃতজ্ঞ।
সাউন্ডটেকের বাবুলভাই অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন, সেজন্যে আমরা কৃতার্থ।

ফিডব্যাকের মঞ্চানুষ্ঠানে শব্দ সংমিশ্রণ ও প্রক্ষেপণের সঙ্গে জড়িত মাসুদুল হাসান (শব্দপ্রকৌশলী), অনিন্দ্য কবির অভিক (সহযোগী শব্দপ্রকৌশলী) ও ফিডব্যাকের ব্যবস্থাপক কাজী মাহবুবুল আলম বাচ্চুকে আমাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ। একইসঙ্গে প্রো-সাউন্ডের মোক্তার, সাঈদ, মানিক ও ফিডব্যাকের মঞ্চানুষ্ঠানে আলোকবিন্যাস-প্রকৌশলী দিশা হাসানের কাছে আমরা ঋণস্বীকার করছি।

ফিডব্যাককে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করার জন্যে এলভিস স্টুডিয়ো ও জাহাঙ্গীর কবিরকে ধন্যবাদ।

আমাদের পোশাক পরিকল্পনা ও আয়োজনের জন্যে রুমী, ডোরা, রুশো ও ‘ক্যাটস্ আই’-কে সাধুবাদ।

কোকাকোলা কোম্পানির খালিদ রাজার কাছে ফিডব্যাকের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যে আমরা অশেষ ঋণী।

উৎসর্গ ১ : দেশে ও বিদেশে ফিডব্যাকের অগণিত শ্রোতা ও ভক্ত এবং এদেশের ব্যান্ডসংগীত আন্দোলন ও বাংলাদেশকে যারা অকুণ্ঠচিত্তে আন্তর্জাতিক সম্মান ও স্বীকৃতির আসনে দেখতে চান তাদের

উৎসর্গ ২ : ফিডব্যাক পরিবারকে। নিবু হক, ডিও হক, আরজু আহমেদ, কারিশমা অয়শী আহমেদ, স্মিতা রহমান, আনুশকা অরিত্রি রহমান, দীনা নাসের, পূর্ণা নাসের ও শাহনাজ খান।

ব্যর্থতা : অনেক ভক্তের চিঠির উত্তর দেয়া হয়ে ওঠেনি বলে আমরা ক্ষমা চাইছি; তবে উত্তর দেবার চেষ্টা চলছে।

যোগাযোগের ঠিকানা : ফিডব্যাক, ১৮১ বড় মগবাজার, ঢাকা, বাংলাদেশ।”

সর্বডানের কলামে ব্যান্ডমেম্বারদের ছবি দিয়ে নিচে নামপরিচয় লিপিবদ্ধ :

ফোয়াদ নাসের বাবু; কিবোর্ড, দলনেতা
পিয়ারু খান; রিদম প্রোগ্র্যামিং ও কণ্ঠ
মাকসুদুল হক; প্রধান কণ্ঠ
সিকান্দর আহমেদ খোকা; বাস্-গিটার
লাবু রহমান; গিটার ও কণ্ঠ

কোকাকোলা পানীয় কোম্প্যানির পৃষ্ঠপোষকতায় অ্যালবামটা বার হয়েছিল বোধহয়, যে-কারণে অ্যালবামের গানগুলো লিপিবদ্ধকরণের শেষে ফ্ল্যাপের নিম্নকোনায় এম্বোল্ডেন লোগো রয়েছে বেভারেজ কোম্প্যানিটার; তাতে লেখা ‘সবসময় কোকাকোলা’। আন্দাজ খুব দূরবর্তী হবে না বোধহয় যে, এই সময় থেকেই ব্যান্ডের অ্যালবামগুলোতে দেদার স্পন্সর পাওয়া যাইতে শুরু করে। পেপসি-ইউনিলিভার ইত্যাদি বিগ কর্পোরেটের ক্যাপিট্যাল সংগীতসংকলন থেকে শুরু করে ব্যান্ডকন্সার্টগুলোতেও লগ্নি হতে দেখি এই সময়েই। সিগ্রেটবিড়িওয়ালারাও স্পন্সর হয়। অ্যামেরিক্যান আর ব্রিটিশ টোব্যাকো কোম্প্যানিগুলোকেও নজরে পড়ে। এক-সময় ব্যান্ডতৎপরতা আবারও থুবড়ে পড়ে। সেইটা আলাদা আলাপ। বর্তমান নিবন্ধে আমরা শুধু ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ সংকলনের ইনলে-ফ্ল্যাপটুকু ডক্যুমেন্টেড রাখতে চেয়েছি, ক্রিটিক বা ইভ্যাল্যুয়েইট করা আপাতত অভিপ্রায়ের বাইরে আমাদের।

কিংবদন্তি-হয়ে-ওঠা অ্যালবামটার প্রথম প্রকাশচেহারা কেমন ছিল, আশা করি সেই সিন্যারি কিছুটা হলেও বোঝা গিয়েছে। এখন তো ফিতার ক্যাসেট নাই, এখন সিডিযুগও অবসিত হতে চলেছে যেন। সবাই বিবিধ অনলাইন মিডিয়ায় পাইরেসিকৃপায় বিস্তর গান শোনেন, পণ্ডিতিও করেন অনেকে দেখতে পাই, অডিয়ো ক্যাসেটের যুগেও পাইরেসি ছিল তবু মনে হয় না তা এতটা টেইকেন-ফর-গ্র্যান্টেড মহামারী ছিল। ওই সময়ে একটা অ্যালবামকাভারেও কতটা নান্দনিক শিল্পসৌকর্য উপস্থিত ছিল, কতটা দায়বোধ থেকে একটা অ্যালবামকাভারের নকশা-নামচয়ন করা হতো, হয়তো অল্প পরিচয় নিবন্ধের এই অংশে রইল।

অনাগত বঙ্গাব্দগুলোতেও ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ স্মরণ করবে এই বাংলার লোকসকল, প্রজন্মান্তরে এই মিউজিক-লিরিক ইন্সপিরেশন যোগাবে জ্যান্ত সময়ের বাংলা গানরচনায়, যেমন অবিস্মরণীয় একই ব্যান্ডের ‘মেলা’ অ্যালবামটা/গানটা বাংলার বৈশাখবরণ ও অন্যান্য সমস্ত সম্মেলক উৎসবে। সেই জাদুবাস্তবের অভিজ্ঞতা আবারও নিয়া আসবে নয়া জেনারেশনের কোনো সংগীতদল, ঝাঁকুনি দিয়া জাগাবে বেহাত বাংলা গানবাজনার দুনিয়া।

 

বৈশাখ, ঝড়, রাত্রি…কিংবা আলামতবিহীন এককে ম্যাক

কবে কোন বছরে এইটা আজ আর ইয়াদ নাই, নিশ্চয় নেটসার্ফিং করে এইসব তথ্য জোগাড় করে নেয়া যায়, কিন্তু অনুমান করি ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামটি রিলিজের বেশ কয়েক বছর পরে ম্যাকের একটা সোলো সংকলন বার হয়েছিল, ইয়াদ হয় অ্যালবামটির নাম ছিল ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’। এই একটাই এখন পর্যন্ত মাকসুদুল হকের একক গানের স্টুডিয়োসংকলন।  অবশ্য যদি আমরা ‘মাআরেফাতের পতাকা’ অ্যালবামটাকে ম্যাকের একক ধরি তাইলে আলাদা কথা। ‘মাআরেফাত…’ বোধহয় ম্যাকের সোলো বলা যাবে না, আবার ব্যান্ডের ব্যানারেও ‘…পতাকা’ বাইর হয় নাই, মাকসুদুল হক ‘গরিমা গানের দল’ নামে একটা আলাদা প্রোজেক্ট করেছিলেন, সেই ব্যানারেই ‘…পতাকা’ বাইর হয়েছিল, ওইটাও পরীক্ষামূলকভাবে একবার মাত্র। গরিমার বাংলা আবহমান লোকগানগুলো নিয়াই ছিল প্রোজেক্টটা। ক্যারেক্টারের দিক থেকে এইটা ম্যাকের অন্যান্য সংকলনগুলোর মতনই উল্লেখযোগ্য। মুর্শিদি আর ফকিরি ধারার আন্ডারকারেন্ট ‘ফোক’ গানগুলোই প্রোজেক্টেড হয়েছিল অ্যালবামে। একটো-দুটো স্থলে বৈষ্ণবধারা বাউলগানের ছোঁয়া থাকলেও সব মিলিয়ে এইটাকে যেন সুফি টিউনের দিকেই ঝোঁকানো মনে হয়েছিল। অ্যানিওয়ে।

এইখানে লক্ষ করবার মতো একটা ব্যাপার এ-ই যে, ম্যাকের এন্টায়ার ক্যারিয়ারে চর্বিতচর্বণ প্রায় নাই বললেই চলে। একই হিটের পুনরুৎপাদন বা পুনঃপুনরাবর্তনের ছিটগ্রস্ত বাংলা গানবাজারে ম্যাক এইদিক বিবেচনায় বিরল নিরীক্ষাব্রতী ছিলেন আগাগোড়া। আজও তা-ই, নিশ্চয়। কিন্তু সংগীতশিল্পী হিশেবে একটানা চারদশক পারায়ে আসার পরে এইভাবে একটু সমগ্রদর্শনের টোনে এই নিবন্ধে বাক্যালাপ চালানো যেতেই পারে বোধহয়। ম্যাকের সংগীতযাত্রা থামিয়া যায় নাই কিন্তু! নয়া অ্যালবামেরও মুক্তিধ্বনি কানে আসছে বেশ অনেকদিন হলো, সামনে আসে নাই এখনো, অচিরে নিশ্চয় নয়া স্টুডিয়োসংকলন পেতে চলেছি আমরা। তাছাড়া লাইভ কন্সার্টে, টেলিভিশনকামরায়, এবং ইউটিউবে ম্যাকের আওয়াজ হামেশা কানে আসে। অ্যাক্টিভ ম্যাক নিজের ধরনে। এনগেইজড, ইনভোল্ভড, মিউজিকেই।

ঠিক আছে। এইখানে শুধু ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ নিয়া আলাপ করা আমাদের ইচ্ছা। আলাপ মানে অ্যালবামরিভিয়্যু বলতে যা বোঝায় তা না; ক্যাসেটের ফিতায় অ্যালবামটা বার হবার পরে এই নিবন্ধকারের মতো অনেকেই কিনেছিল, শুনেছিল, হকের পয়লা ব্যক্তিক সংকলন। অভিজ্ঞতা আনন্দের হয় নাই।  কিছুদিন আগে এই ফিতার একটা কপি খুঁজিয়া পাওয়ায় এইখানে কেবল ফিতার ফ্ল্যাপ বা যাকে বলে ইনলে-কার্ড সংরক্ষণ করবার মানসে এই মুসাবিদা।

মাকসুদুল হক ‘ফিডব্যাক’-এ যে-ধারায় কাজ করছিলেন, ‘মাকসুদ ও ঢাকা’-য় এসে সেই ধারার অভিপ্রেত অংশটুকু গুছিয়ে এনে এবং দেশদুনিয়ার রাজনীতিবিজড়িত রোজকার বিবৃতিবাচকতাটাকেও নতুন দিনের সংগীতের নন্দনশর্ত ক্ষুণ্ণ না করে একটা আলাদা আদল দিতে পেরেছিলেন। ওই অবদানটুকু যুগান্তরী/যুগান্তকারী বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে? এবং আরেকটা কথা এ-ই যে, ম্যাকের মিউজিশিয়্যান সত্তাটা আদৌ গজদন্তমিনারবাসী ছিল না কোনোদিনই, মিউজিক করতে এসে মার্কেটের খোরাক তিনি নিজেকে হতে দেন নাই, আবার বাজার অস্বীকারও করেন নাই। নিছক গানের জন্য গান করেন নাই তিনি, লিপ্ত ও তৎপর ছিলেন সবসময় মিউজিকের বিপণন ও মিউজিশিয়্যানের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং মেধাস্বত্বের হিস্যা আদায়ের আন্দোলনে। এতকিছু তৎপরতার পরেও ম্যাক গানসৃজনে হেলাফেলা করেন নাই, মিউজিক এবং লিরিক দিয়াই বিশেষত নব্বইয়ের তারুণ্যঝঙ্কৃত বদ্বীপের মন জয় করেছিলেন। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত ‘ফিডব্যাক’ ছিল বাংলাদেশের সেরা ব্যান্ড, ম্যাক আর ফিডব্যাক মিলে স্টেজথ্রব একটা কালের সাক্ষি তিরিশ-পার-করা আজকের মধ্যবয়সী লিস্নাররা।

“মাকসুদুল হক নামটি শোনা মাত্রই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে অদম্য এক প্রতিভাবান শিল্পীর মুখাবয়ব। বাংলাদেশে ব্যান্ডমিউজিকের জনপ্রিয়তার পেছনে যে-কয়জন তরুণ অসাধারণ অবদান রেখেছেন মাকসুদুল হক তাদের অন্যতম। বিশেষ করে ব্যান্ডসংগীত নিয়ে যারা নানা মৌলিক ও নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন, মাকসুদ তাদের পথিকৃৎ। তার গানে সময়ের বাস্তবতার উপস্থিতি অত্যন্ত সরব লক্ষ করা যায়। এজন্য বহুবার তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা বিতর্কের। ‘ফিডব্যাক’ ও ‘ঢাকা’ ব্যান্ডের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মাকসুদের নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা এখনো থেমে নেই। মূলত ব্যান্ডমিউজিক নিয়ে এসব সৃজনশীল পরীক্ষানিরীক্ষার কারণেই তাকে বারবার সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা বৈরী পরিস্থিতির।

অসম্ভব জনপ্রিয় এই শিল্পীর স্বপ্ন ও ভরসা এদেশের তরুণ প্রজন্ম। তাই সবসময়ই তিনি তরুণ সহযাত্রীদের নিয়ে এসেছেন পাদপ্রদীপের সামনে। তার এই প্রথম একক অ্যালবাম ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’-ও তরুণ লেখকদের গান তিনি কণ্ঠে নিয়েছেন, বাণী ও সুরের ব্যঞ্জনায় যা অবশ্যই আগের মাকসুদকে ছাড়িয়ে নতুন এক মাকসুদকে তুলে ধরবে শ্রোতাদের সামনে।”

উদ্ধৃত কথাগুলো ‘বৈশাখী’-র ব্লার্ব থেকে নেয়া হয়েছে। এই কথা-কয়টি লিপিবদ্ধ রয়েছে অ্যালবামপ্রযোজকের জবানিতে। সেলিম খান প্রেজেন্টস্ ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ লেখার নিচে একজোড়া প্যারাগ্র্যাফে এই শিল্পীপরিচিতি ছিল। তবে যে-দাবিটা বিজ্ঞাপিত হয়েছে এইখানে, সেইটা আখেরে এস্ট্যাব্লিশ হয় নাই। মাকসুদকে নতুন চেহারায় এইখানে পাওয়া যায় নাই যে এইটা তো বলা বাহুল্য, সন্দেহও হয়েছিল অনেকেরই যে ম্যাক কি সত্যিই এই অ্যালবাম করেছেন? ফ্লপ যদি কিছু থেকে থাকে ম্যাকের ক্যারিয়ারে, এই একটাই।

কিন্তু দুইটা গান তারপরও মন্দ হয় নাই, ম্যাকের নাম সেই দুই গানের সঙ্গে না-থাকলেও মনে হয় না আসত-যেত কিছু, মনে আছে এখনও সুরটুকু ওই দুই গানের, অন্য আটটা গানের একটারও সুর/কথা হারাম মনে নাই। টাইট্যল  গানটা, আর ‘ফিরে পেতে চাই’ ছিল আরেকটা। আরও বলা যায়, ‘বিষের ঊর্মিমালা’ গানটায় ‘ওগো ভালোবাসা’ টাইমের লিরিকের ছোঁয়া পাওয়া যায়। যা-হোক, মোটমাট দশটা গানের তালিকা আমরা ফ্ল্যাপ থেকে এইখানে টুকিয়া রাখি :

বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে ।। কথা ও সুর : এস.এম. খালিদ ।। সংগীত :টফি ।। গিটার : সোহেল ।। রিদম : ফান্টি
কিভাবে বোঝাবো ।। কথা : মাকসুদুল হক ।। মূল সুর : বিদেশী গান ।। সংগীত : রুবাইয়াৎ ।। রিদম : ফান্টি
বাস্তবতা ।। কথা : স্বপন ।। সুর : চঞ্চল ।। সংগীত : তন্ময় ।। রিদম : ফান্টি ।। গিটার : সোহেল
গ্রীস্মের রোদেলা দুপুর ।। কথা ও সুর : এস.এম. খালিদ ।। সংগীত :টফি ।। গিটার : সোহেল ।। রিদম : ফান্টি
ফিরে পেতে চাই ।। কথা : দিদার ও মাকসুদ ।। মূল সুর : বিদেশী গান ।। সংগীত : রুবাইয়াৎ ।। রিদম : ফান্টি
সুজনা ।। কথা ও সুর : এস.এম. খালিদ ।। সংগীত : টফি ।। গিটার : সোহেল ।। রিদম : ফান্টি
বিষের ঊর্মিমালা ।। কথা: দিদার ও মাকসুদ ।। সুর : মাকসুদুল হক ।। সংগীত : তন্ময় ।। রিদম : ফান্টি ।। গিটার : সোহেল
কত সহজেই ।। কথা : সকাল ।। সুর ও সংগীত : বাসুদেব ঘোষ ।। কিবোর্ড : বাপ্পা মজুমদার ।। রিদম : লিটন ।। গিটার : সোহেল
অচিরেই ।। কথা : রনিম সুর : তন্ময় ও মাকসুদ রিদম : লিটন গিটার : সোহেল
কোথায় হারালে ।। কথা : দিদার ।। সুর : মাকসুদুল হক ।। সংগীত : ঢাকা

অ্যালবামের কাভার ডিজাইন করেছেন সজল সমদ্দার, কম্পিউটার গ্র্যাফিক্স সম্পাদন করেছেন জুয়েল। আরও কতিপয় ইনফো রয়েছে, সেগুলো সবই ইংরেজি ভাষায় এবং হরফে, যেমন অ্যালবামনাম বাংলার পাশাপাশি ইংলিশেও রয়েছে, এমনকি শিল্পীনাম ছাড়াও ‘ইটস্ ব্রিলিয়্যান্ট’ কথাটাও লেখা আছে দেখব প্রচ্ছদে, এখন তো কৌতুক লাগে এই জিনিশ দেখতে, লেগেছিল তখনও, ম্যাকের আগের অ্যালবামগুলোর একটাতেও এই জিনিশ দেখি নাই, সম্ভবত এই অ্যালবামের নকশা বাজারসর্দারের হাতেই হয়েছিল। অনুমান মিথ্যা হবার চান্স অল্পই। যাকগে, যে-বাড়তি ইনফোগুলো ছিল বিলো-অ্যালাইনমেন্টে, সেগুলো হচ্ছে :

“রেকর্ডেড অ্যাট সাউন্ড গার্ডেন স্টুডিয়ো ইন ডিজিটাল সিস্টেম। সাউন্ড : আসাদ অ্যান্ড দূরে। মিক্সিং : মবিন। দ্য স্যং ‘কত সহজেই’ ইজ্ রেকর্ডেড অ্যান্ড মিক্সড অ্যাট ডিজিটোন স্টুডিয়ো। হার্ড ডিস্ক মাস্টারিং : ডি.কে.এম. শান্ত। ফোটো : বিপ্লব, ইকবাল। অ্যালবামটা প্রযোজনা করেছে সংগীতা, বাজারজাতও করেছে তারাই। ঠিকানা আছে : সংগীতা কমপ্লেক্স, ৩৭ পাটুয়াটুলী, ঢাকা; সংগীতা প্লাস, ১৬০ নবাবপুর রোড, ঢাকা।”

মাকসুদুল হকের একক নিয়া আগ্রহ ছিল অনেকেরই, কিন্তু মুক্তির পরে আগ্রহের বাতি নিভিয়া যায় দপ করে। ম্যাকের এই একটা অ্যালবাম ছাড়া আর কোনো অ্যালবামের ক্ষেত্রে এমন কথা বলা যাবে না। এমনকি মিক্সড নামে যে-মচ্ছবগুলো ওই-সময় ছিল এবং সেগুলোর যে-কয়টাতে ম্যাক পার্টিসিপেইট করেছেন কোথাও অবনমিত মানের ম্যাককে দেখানো যাবে না। কাজেই, ইন ওয়ান সেন্স ‘বৈশাখী ঝড়ের রাত্রিতে’ ম্যাকের আলাদাভাবে মেনশন করার জোখা অ্যালবাম। বৈশাখ, ঝড়, রাত্রি … শিরোনামে আছে শুধু, শরীরে গরহাজির।

 

২৯ এপ্রিল ১৯৯১, ফিডব্যাক, ম্যাক এবং একটা গান

“মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না / আইতাসে ভাইঙ্গা এত বড় ঢেউ / সারা বাংলাদেশ জানল মাঝি তুই তো জানলি না রে” … এই গানটার জন্ম হতো না যদি আজ থেকে ঠিক তিরিশ বছর আগে এই দিনটির করুণ ও করাল গ্রাস বাংলাদেশটাকে ছেয়ে না ফেলত। ১৯৯১ সনের ২৯ এপ্রিল উপকূলীয় অঞ্চলে ধেয়ে এসেছিল ভয়াল ঘূর্ণিঝড়। প্রয়লয়ঙ্করী বিশেষণপদটার অর্থ বুঝতে শিখি ঠিক এই বছরেই ‘ইত্তেফাক’ আর ‘সংবাদ’ প্রভৃতি দৈনিকীর হেডলাইন্স পড়তে যেয়ে। সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলভাগের চট্টগ্রাম, হাতিয়া, সন্দীপ, চরফ্যাশন, মহেশখালী ইত্যাদি দ্বীপাঞ্চলের প্রায় দেড়লক্ষাধিক মানুষের অসহায় মৃত্যু হয় এবং অতর্কিত ঝড়ের তাণ্ডবে এককোটিরও অধিক মানুষ চিরতরে তাদের ভিটামাটি ও সহায়-সম্পদ সর্বস্ব হারান। জলের স্ফীতি ছিল এতই যে এর সাধারণ উচ্চতা হয়েছিল অট্টালিকার মাপে ৩/৪-তলাস্পর্শী। গোটা দেশের বিদ্যুৎ, গ্যাস, যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত হয়ে গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। বহির্বিশ্বের সঙ্গেও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। তখন সবেমাত্র নবগঠিত গণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘ দশবছরের এরশাদশাহি স্বৈরশোষণ সরিয়ে এক/দেড়মাস হবে এসেছে, এরই মধ্যে এই ঘূর্ণিতাণ্ডব। সংবাদপত্রের শীর্ষস্থান তখন মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধজঙ্গ নয়, কীর্ণ হয়েছিল নিজেদের ভূখণ্ডের মানুষের মৃত্যুলুণ্ঠিত ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর আর ভাগ্যবলে-বেঁচে-যাওয়া মানুষের আহাজারিবিস্মৃত স্তম্ভিত চেহারায়। বিদেশের পত্রপত্রিকায় এই ঝড়সংবাদ কয়েকদিন ধরে গম্ভীর সমবেদনার সঙ্গে দেখেছে দুনিয়া।

আমরা তখন সেভেনে পড়ি। টিভিতে দেখি ইরাক-কুয়েত নিয়া আমেরিকার বিচারসালিশ, শুরুতে আমরা আমেরিকার মধ্যস্থতা স্বাগত জানায়েছিলাম সোল্লাসে এবং সাদ্দামের ইনভ্যাশন বরদাশ্ত করতে পারছিলাম না, যুদ্ধের খবরাখবর পড়ে পত্রিকার পাতার সঙ্গে রাত্তিরের বিটিভিনিউজে দেখানো ফ্যুটেজ মিলিয়ে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছিলাম। ম্যাকগাইভার ছিল। ম্যুভি অফ দ্য উইক ছিল। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধাভিযান ছিল। যথেষ্ট রগরগে দিন। সেইসঙ্গে ব্যান্ডমিউজিকের মূর্ছনায় বিলীন। এরই মধ্যে একসকালের পত্রিকাপাতায় ‘উপকূলীয় অঞ্চলে স্মরণকালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি’ শীর্ষক খবরে ইশকুলের শিক্ষকদের কামরায় নিস্তব্ধ ঘণ্টা কাটে বেশ কয়েকদিন। পড়াশোনা হয় না সেভাবে কেবল রোল্-কল্ ছাড়া। স্যারেরা সাদ্দাম আর বুশ নিয়া পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছুদিন ক্ষান্ত দেন। শোকের একটা ছায়া কাটে ত্রাণসংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হলে পাড়ায় পাড়ায়। সেইবারই জীবনে পয়লা ত্রাণসামগ্রী শব্দটার সঙ্গে এবং ত্রাণসংগ্রহ প্রোসেসটার সঙ্গেও পরিচিত হই জীবনে প্রথমবারের মতো। অনেককিছুই ঘটে ব্যক্তিগত ইতিহাসে এই বছরে এবং বলা বাহুল্য সমস্তই কিন্তু প্রথমবারের মতো! অচিরে এই অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির বছরের একটা স্মারক হয়া আসবে ম্যাকের লেখায় এবং ফিডব্যাকের সুরে ও সংগীতায়োজনে একটা গান ‘মাঝি ৯১’।

ক্রিস্টিয়ানা আমানপৌর্ সেইসময় সিএনএন চ্যানেলের হয়ে বাংলাদেশে নিউজ্ কাভার করতে আসেন। ক্রিস্টিয়ানাকে আমরা ভালোবাসতাম, যেমন বাসতাম স্টেফি গ্রাফকে, লম্বাচওড়া ব্যক্তিত্ব ও শরীরস্বাস্থ্য সমেত উপস্থাপনার জন্য। ক্রিস্টিয়ানা তার ভিশ্যুয়ালে দেখান বিস্তারিত ভয়াবহতা বাংলাদেশের উপকূলের। উল্লেখ করেন, সমুদ্রের জেলেজীবিকার লোকজন এবং মাঝিরা আর-দশটা সাধারণ দিনের ন্যায় এই দিনেও বেরিয়েছিলেন তাদের কর্মক্ষেত্রে তথা সাগরে। ফেরেন নাই কেউই। দিনটি ছিল সমুদ্রপ্রশান্ত, রৌদ্রকরোজ্জ্বল, সুন্দর ও স্বাভাবিকতামণ্ডিত। যদিও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতীয় গণমাধ্যমে তথা বাংলাদেশের রেডিও-টেলিভিশনে আগে থেকেই বিপদসংকেত প্রচার করে আসছিল, মাঝি এবং জেলেরা ছিলেন এতই গরিব যে তাদের কারোরই ছিল না রেডিও শোনার সুযোগ, এই তথ্যটিও ক্রিস্টিয়ানা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে ভোলেন না।

মাকসুদের কালজয়ী গানের রচনাটা আরম্ভ হয় এই তথ্যেরই হৃদয়নিংড়ানো উপস্থাপনার মধ্য দিয়া। “মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না / আইতাসে ভাইঙ্গা এত বড় ঢেউ / সারা বাংলাদেশ জানল মাঝি তুই তো জানলি না রে” … এরপর গোটা গান জুড়ে এবড়োখেবড়ো গতি মিশিয়ে গলার হাই-পিচ লো-পিচ উপর্যুপরি সন্নিবেশ ঘটিয়ে এমন এক সুরসংশ্রয় ক্রিয়েট করতে দেখি ফিডব্যাককে যে ঢেউয়ের উত্তলাবতল দশা সাগরের অঘটনঘটনপটীয়সী নিশানা আমাদের চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। এবং সমুদ্রজীবী সেই সাহসী মানুষসম্প্রদায়ের সলিল সমাধিটি চিরস্মরণীয় হয়ে গেঁথে যেতে থাকে এই গানেরই ভিতর দিয়ে আমাদের হৃদয়ে। পঁচিশ বছর পরেও সমান সুরশৌর্য ও অভাবিত বক্তব্যদ্যোতনা নিয়া গানটা আমাদেরে বিহ্বল করে, আমাদেরে ভাবায়।

ত্রাণসংগ্রহের কাজে সেইসময় শামিল হয়েছিল সর্বস্তরের সর্বপেশার মানুষগোষ্ঠী। দাঁড়িয়েছিল দুর্গতদের পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ব্যান্ডমিউজিশিয়্যান সকলেই কন্সার্ট করেছেন ত্রাণকার্যক্রমে তহবিল যোগানের নিমিত্তে একেবারেই বিনা পারিশ্রমিকে। বামবা  তখনও সক্রিয়, সবেমাত্র জন্ম হয়েছে বামবার, জন্মলগ্নের বামবা অত্যন্ত কন্সার্টতৎপর, উদ্যোগী ছিল পুরোদমে একানব্বইয়ের ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চলের ত্রাণকার্যক্রমে। বেশকিছু উদ্ভট কর্মকাণ্ডও তখন সংঘটিত হয়েছিল রিলিফওয়ার্কের নাম ভাঙিয়ে। এর মধ্যে একটা ছিল, পত্রিকায় নিউজ্ প্রকাশের পর প্রচুর সমালোচিতও হয়েছিল ঘটনাটা, পয়সাওয়ালারা পাঁচতারায় ডিস্কো নেচে এবং নাচিয়ে ডোনেশন্ উত্তোলনের আয়োজন করেছিল দুর্গতদের সহায়তাকল্পে। ব্যাপারটার সার্কাস্ সনাক্ত না-করার বান্দা মাকসুদ না, যিনি লিখেছেন ‘মাঝি ৯১’ এবং গেয়েছেনও অনুকরণদুঃসাধ্য গলা আর গায়কী দিয়া, বাংলা গানে গনগনে আগ্নেয় অনেক স্যাটায়ারপঙক্তির উদ্গাতা যিনি। ডিস্কো কেন, কোনোকিছু কিংবা কাউকেই ছেড়ে গা বাঁচিয়ে রেয়াতি টিউনে লেখবার বা গান গাইবার বান্দা মাকসুদ না। তারপরও গোটা গানের অন্তিম স্তবকে যেয়ে এটুকু অপারগের আর্তি ভোলেন না জানাতে : “এক সাধারণ শিল্পী হইয়া দুঃখ জানাই ক্যামন কইরা / গানের সুরে চক্ষের জলে শোধ হয় কি দুঃখের দেনা / মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না” … হ্যাঁ, ইয়াদ রাখতে হবে সেইটা একানব্বই সন, বাজারে সুমন চট্টোপাধ্যায় এবং তার জীবনমুখা গান এবং তার আত্মসমালোচনামূলক গীতিধাঁচ শুরু হবে এরও বছরখানেক পরে থেকে। এসবের অনেক আগেই ধাঁচটা বাংলাদেশের গানে এসেছে এবং শিল্পসমন্বিত উপায়ে ব্যবহৃতও হয়েছে ব্যান্ডগুলোর গানে-বাদনে। এই একটা গানেই ফিডব্যাক এইটা করেছে, তা না; এরও আগের অ্যালবামগুলোতে ম্যাকের গলায় সেল্ফক্রিটিক্ পুনঃপুনঃ এসেছে এবং পরে তো বটেই আরও প্রভূতভাবে। সে-বছরেই ‘মাঝি ৯১’ রিলিজ্ পায় এবং রিলিফতৎপরতায় এর থেকে প্রাপ্ত অর্থ উৎসর্গ করা হয়; এরপরে, অব্যবহিত পরেই, কলকাতা থেকে বেরোনো ফিডব্যাকের ‘জোয়ার’ সংকলনে গানটা যায় এবং তখন পর্যন্ত ‘তোমাকে চাই’ কিংবা আর-কোনো জীবনমুখের দেখা বাংলাদেশ অন্তত পায় নাই।

কিংবা ‘মাঝি ৯১’ সৃজনের আগেও ফিডব্যাক  তথা মাকসুদ মাঝি  নিয়া আরেকটা গান করেন যে-গানটা ব্যঞ্জনায় এবং শ্রোতাগ্রাহ্যির বিবেচনায় আজও অমলিন; গানটা ‘মাঝি ৮৮’ শিরোনামেই চিরপরিচিত। অষ্টআশির জলোচ্ছ্বাসবন্যায় ভেসে-যাওয়া মাঝি ও মানুষের স্মৃতি এবং প্রকৃতির আকস্মিক আক্রোশের সঙ্গে লড়াকু জনজীবনের গাথা গানটার হরফে এবং সুরে বিধৃত। “মাঝি তুমি বৈঠা ধরো রে / চলো যাই দূরে সুদূরে / মাঝি তুমি পাল উড়াইয়ো রে / চলো যাই দূরে সুদূরে” … এই হলো সূচনাস্ট্যাঞ্জা সেই গানের। গোটা গানস্থিত মুখ্য দুই স্তবক গুছিয়ে দেখা যাক নিচে :

“কী হে মাঝি! জলে নৌকা ভাসাই দিলি সুদূর দিগন্তে / নাও বুঝি তোর ফিরল না রে ফিরল না তীরে / ও মাঝি রে! পরনে তোর ছেঁড়া কাপড় সাগর কী জানে / ঘরে তোর আহার নাই রে মানুষ কী বোঝে # কী হে মাঝি! ভোরবেলা তোর ঘুম ভাঙিল গাঙচিলের ডাকে / ওই ডাকে তোর মরণ আইব মানুষ কী জানে / ও মাঝি রে! জলে দেহ ভাসাই নিলো কঠিন সমুদ্রে / নাও বুঝি তোর ভাঙল তীরে সঙ্গে আইলো কে …”

যে-ব্যাপারটা প্রোক্ত দুইটা গানেই লক্ষ করবার তা এদের লোকবাচনিক ভাষা। তারপরও এরা আধুনিক টানটান। দশকখানেক পরে এই নির্বাধ ভাষার ব্যবহার আমরা ফলিয়ে তুলতে দেখব বাংলাদেশের লিখিত সাহিত্যে একদল নতুন লিখিয়েকে। এবং অব্যবহিত অনুবর্তন দেখি বিশেষ লোকোচ্চারের সেই বাচিকতা বাংলা নাটকে, টেলিফিকশনে, নেহায়েত অনুল্লেখ্যও নয় এমন কয়েকটি সিনেমায়। এই-যে প্রমিত বাগবিধিটির প্যারাল্যাল একটা বাগবিধি নির্মাণ করবার তাগাদা, ব্যান্ডগানে এইটা আগাগোড়াই ছিল। গুরুচণ্ডালির উপর দিয়াও যদি কোনো চণ্ডালিকীর্তন থাকে, ব্যান্ডমিউজিক সেইটা স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় সেরেছে এবং সফলভাবেই উৎরেছে পরীক্ষায়। ফিডব্যাক, পরবর্তীকালে একলা-একা মাকসুদ, অবলীলায় এইসব বস্তিলিঙ্গুয়া মার্জিত সমাজের সদস্যদের কানে ঢুকিয়েছে এবং এমন কায়দায় যে সেই সমাজের প্রাগ্রসর তরুণ তুর্কিরা তা কানে এবং মনে টেনে নিয়েছে। একেবারেই রিসেন্টলি টিভিফিকশনে যে-একটা বাগভঙ্গির উদ্বোধন ও উত্থান দেখা যাইছে, এর বীজতলা বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে। এই ইশ্যু নিয়া, বাংলাদেশের ছোট-মধ্যম-বড় সমস্ত ব্যান্ডের গানের কথাভাগে ব্যবহৃত ভাষার স্পর্ধাস্পন্দ নিয়া, আরেকটু গুছায়ে বসে আলাপ তোলা যাবে একদিন অচিরে।

 

বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে প্রেজেন্স অ্যান্ড অ্যাবসেন্স অফ আর্বেইনিটি

কিন্তু আর্বেইনিটির সংজ্ঞাটা আগে দেয়া দরকার কি না, আসলেই ঠিক বুঝতে পারছি না। আর্বেইনিটির সংজ্ঞা? আচ্ছা, ব্যাপারটা এভাবে বলা যাক, আমরা জসীম উদদীন আর জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাশাপাশি রেখে দেখতে পারি। জীবন ও জসীম উভয়েই বিশাল বাংলারাজ্যির লুপ্তপ্রায় জিনিশপত্তর ডক্যুমেন্টেড রেখে গেছেন তাদের কাজে। এবং উভয়েই তদানীন্তন মধ্যবিত্তবলয়ে ব্যবহৃত সুসংস্কৃত যোগাযোগের বাইরেকার ভাষা ব্যবহার করেছেন নিজেদের কাজে। সেকালের গ্রামীণ মোটিফগুলো উভয়ে দেদার নিয়েছেন দুইহাতে, সেসবের প্রয়োগও ঘটিয়েছেন গদ্যে এবং বিশেষত কবিতায়। কিন্তু দুইজনের ব্যবহারনিরিখেই পৃথক পরিচয়ে চিহ্নিত হয়েছেন পাঠকের কাছে। জীবনকে জেনেছি আমরা নাগরিক কবি হিশেবে, সেকালের এবং একালের যে-কোনো প্র্যাক্টিসিং ট্যালেন্টেড কবির তুলনায় জীবনের ডিকশন সদর্থে গ্রাম্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি সিভিক সারাৎসার উপস্থাপনকারী কবিপ্রতিভা, একই জিনিশ উপস্থাপন সত্ত্বেও জসীম আমাদের কাছে প্যাস্টোরাল পোয়েট। একজন নাগরিক কবি, অন্যজন পল্লিকবি। ঠিক যে-গুণপনা থাকার কারণে জীবন সিভিক এবং যে-গুণটা মিসিং থাকার কারণে জসীম প্যাস্টোরাল, সেই গুণটাই আর্বেইনিটি। তিরিশের অতিমূল্যায়িত কবি অনেকেই নাগরিক বলিয়া আখ্যা পাইলেও অন্তরাত্মায় আদতে তারা প্যাস্টোরাল। জীবন নাগরিক। সেইটা আন্সার্টেইন্টি, অবসাদ, অনিশ্চয়তা, আত্ম-অনাত্ম দ্বন্দ্ব, মর্বিডিটি ইত্যাদি কিছু সূচকের মাধ্যমে মেপে নেয়া যায়। এলিয়টের প্রুফ্রক যেমনটা আংরেজি কবিতায় এর উজ্জ্বল উদাহরণ।

কথা সেইটা না। কথা হচ্ছে, — ব্যান্ডগানে আর্বেইনিটি হাজির, না প্যাস্টোরালিটি? এই সার্চের অ্যান্সার একবাক্যে দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। অ্যাট-লিস্ট এই নিবন্ধকারের পক্ষে এ-মুহূর্তে সম্ভব নয়। এলোমেলো কথায় একটু তলায়ে দেখা যাক শুধু। প্রথমত, গত চার দশকের বাংলাদেশজ শহুরে সংগীতে বেশ ভালো পরিমাণে দেখা গিয়েছে গ্রামরেখা। গ্রামায়ন নয়, গ্রামপতনের রেখাজোখা ব্যান্ডগানে এসেছে বেশ উল্লেখযোগ্য হারে। যেটুকু গ্রাম তা-ও মুখ্যত শহুরে নয়নে গ্রামদেখা। ভাঙাচোরা গ্রামনৈসর্গিকতা। আউটসাইডারের চোখে দেখা গ্রামের বর্ণনা। ব্যান্ডগানে গ্রামবন্দনা যেমন পাওয়া যাবে না, তেমনি গ্রামনিন্দাও নয়, পাওয়া যাবে না গ্রামভাবালুতা। শাহরিক কঙ্ক্রিট-সিমেন্ট-বিটুমিন-ডিজেলপেট্রোলের পোড়া ঘ্রাণটা নিয়া ব্যান্ডগানের কোনো ইনহিবিশন নাই। জীবনানন্দে যেমন নগর কলকাতার বিসর্পিল ট্রামলাইন নিয়া স্বাভাবিকতার পঙক্তি সুলভ, বরিশালের মাইল-মাইল শান্তিকল্যাণশোভিত সুপারিসারি সত্ত্বেও, জসীম উদদীনে যে-স্বাভাবিকতার নিশানা মেলে না, ব্যান্ডগানে আধা-শাহরিক সমস্ত চিহ্নাদি উদযাপিত হতে দেখা যাবে গোড়া থেকেই। লিরিকের কমজোরি নিয়া আপত্তি থাকলেও অভিপ্রায়ের দিক থেকে ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য। শুধু স্যুপারম্যলের কনজ্যুমার লাইফ অ্যান্ড লিভিং কিংবা স্লাম এলাকার দুঃখদৈন্য নিয়া রাগ-রগড় করার মধ্যেই সীমায়িত নয় নাগরিকতার তত্ত্ব।

শুধু বস্তি চিত্রিত হলেই আর্বেইন, এমন নয় কখনো। যদিও বস্তি এসেছে বাংলা গানে, শ্রেণিবৈষম্য ও বঞ্চনা-মাৎস্যন্যায় ইত্যাদি পিকচারাইজ করার গরজে, সেই বস্তিও তো ভৌত অবকাঠামোগতানুগতিকতার সীমানায় ঘুরপাকরত বস্তি। বিদেশে হোক বা দেশে, ভারতে বা বাংলাদেশে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গজ কবীর সুমনের গানের বস্তিতেও যতটা আবয়বিক অস্তিত্ব মনুষ্য প্রজাতির, ততটা হার্দ্যিক জটিলতা নাই যেন। সুমনগানে যতটা শরীর আছে ততটা হৃদয় নেই বস্তিমানুষের, যতটা সামষ্টিক উপস্থিতি আছে ততটা ব্যষ্টিক পর্যায় নিমহাজির, বিপ্লব ও যৌথখামার প্রভৃতি অভীপ্সার পার্পাস সার্ভ করতেই যেন সুমনের বস্তিজনমনিষ্যি ব্যস্তসমস্ত। এরচেয়ে অঞ্জনের বস্তিতে বরং হৃদয়সংবাদ লভ্য। অঞ্জন অনেক বেশি ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল অ্যাপ্রোচ ধরে ডিল করেছেন তার বস্তিমানুষগুলোকে। এতদিনকার বাংলা গানে, সেইটা বাউল-ফোক-ফকির-সুফি-কীর্তন-গণসংগীত যত-যা-কিছুই হোক, এই বস্তিহৃদয় মিসড-আউট ছিল। বলতে কেন দ্বৈধ হবে যে এমনকি কবীর সুমনের গানেও প্রত্যাশিত বস্তিহৃদয় এক্সক্লুড রয়ে গেছিল।

বস্তি ছিল বরং বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে, বেশ লক্ষযোগ্য রকমেই ছিল, এখন অবশ্য ক্রমশ উধাও বলতে হবে। সেই-সময়, বিগত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে, ব্যান্ডগানে একটা আর্বান স্লাম-অ্যারিয়া কাভারেজে এসেছিল লক্ষ করা যাবে। সেইটা আবছাভাবে হলেও, অর্ধপরিস্ফুট কথাভাগের ননলিরিক্যাল লিরিক্স হলেও, বোঝা যাইত ওইটা স্লাম নগরচিত্র। সত্তরের গোড়া থেকে আজম খান, নাজমা জামান, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই কিংবা জানে আলম ও ফেরদৌস ওয়াহিদ প্রমুখের পরিবেশনায় এই চিত্র যতটা হাজির, ক্রমে এটি থিতিয়ে এলেও, অলমোস্ট স্তিমিত হয়ে এলেও, নব্বইতে এসে বেশ-কয়েকটা ব্যান্ড যথেষ্ট দরদের সঙ্গে একটা স্লাম-আর্বেইনিটি লিরিক্সে এনেছে। এক্ষেত্রে চাইম, সিম্ফোনি, ফিডব্যাক, নোভা এমনকি প্রমিথিউস  ও এলআরবি-ও উল্লেখ করা যাবে। এবং কৌতূহলকর ব্যাপার এইখানেই যে, সেই স্লাম-স্পেসিফিক অনুষঙ্গবহুল কথাচিত্রের গানবাজনা ঢাকা সহ অন্যান্য ডিভিশন্যাল ও ডিস্ট্রিক্ট টাউনগুলোর মিডলক্লাস ড্রয়িঙরুমগুলোতে গৃহীত হয়েছিল; — মূলত ওরাই ছিল ওই গানের ক্রেতা(শ্রোতা)গোষ্ঠী/অডিয়েন্স। তখনকার ঢাকায়, এবং অন্যান্য ডিস্ট্রিক্ট টাউনগুলোতে, যে-বস্তি ছিল এখনও ওই বস্তিই আছে, বরং বহরে-গতরে বেড়েছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত-বলয়ের ব্যান্ডগানে এই বস্তির/গেটোর হাজিরা/রেপ্রিজেন্টেশন উধাও; পরিবর্তে ব্যান্ডগুলো ঝুঁকেছে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ খুঁজবার বেমক্কা লালনগিরিতে/লালনানুশীলনে। হেন মরমিপনা কাজের-কাজ কি না, তা আজিকেই জিজ্ঞাসা-আকারে এখানে উঠছে না। আর এই নিবন্ধে এতদপ্রসঙ্গে অধিক বাক্যখর্চা বাহুল্য ও অতিপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এইটেই স্বীকার্য যে এই অনুচ্ছেদ অত্র রচনায় একদম প্রক্ষিপ্ত। শুধু লক্ষ করিয়া যাওয়া যাক যে সেই-সময়কার মধ্যবিত্তের সঙ্গে বস্তিবিত্তের লোকেদের একটা আশনাই না-হোক মুখ-দেখাদেখি ছিল, পরস্পর পরিচয়াভিপ্রায় ছিল, বর্তমানে যা নাই।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় ইন্ডিয়ায় অঞ্জন নিজে তার গানবাজনাকে ‘নাগরিক লোকগান’ বলতে চেয়েছেন, বলেছেনও, লক্ষ করা যায়। সেদিক দিয়া ভাবতে গেলে নগরের অক্ষরদক্ষ/বর্ণজ্ঞানী ইন্টেলেক্টদের কথা মাথায় রেখে এই গান, না অনক্ষর-অল্পাক্ষর গরিষ্ঠাংশের ছবি বিবেচনায় রেখে এইটেকে দেখব? ফোক মিউজিক, তথা লোকগান, অঞ্জনকথিত নাগরিক লোকগানের বাইন্যারি অপোজিশন তবে? এই প্রশ্নটা আপাতত না-তুললেও চলে। যে-ব্যাপারটা ভাবায় সেইটে এ-ই যে, নগরে-বাস-করা ব্যাপকাংশ জনগোষ্ঠী গ্রামপতনের প্রত্যক্ষ ফল হিশেবে গেল-শতকের আশির দশক পর্যন্ত উদ্বাস্তু-উন্মূল, অন্তত বাংলাদেশের রাজধানী ও অন্য গুটিকয় জেলাশাহরিক সচিত্র প্রতিবেদন মাথায় রেখে এই চিত্রটা ভাবিতব্য, ফলে তাদের ভেতর লোকমানস-লোকচৈতন্য-লোকৈতিহ্যগুলো অগোচর নয়। নগর কলকাতাতেও এহেন প্রতিবেদনের অন্যথা হবে না আন্দাজ করা যায়। এবং মনে রাখতে হবে যে ম্যাকের বা বাংলাদেশজ রকমিউজিক/ব্যান্ডসংগীত অথবা ভারতীয় অঞ্জনের সৃজনপ্রস্তুতি, বিকাশ ও বেড়ে-ওঠার যাবতীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট তাদের, ওই সময়টাতেই। কিন্তু অচিরে এপার-ওপার দুইপারের বাংলাতেই নিরঙ্কুশ গ্রামস্মৃতিশূন্য/শেকড়ভাবালুতাবর্জিত শুদ্ধ-অর্থে শাহরিক যুবাগোষ্ঠীর দেখা পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে এমনকি ছিঁটেফোঁটা গ্রামপ্রেম নাই, গ্রামফ্যাসিনেশন থাকবার কোনো যুক্তিবাস্তবিক ভূমি তাদের নেইও। ওই শ্রেণির জন্য গান বাংলায়, বিশেষত নগর কলকাতায়, কই? আছে, এদ্দিন ছিল না যদিও, এসে যাচ্ছে অচিরেই চন্দ্রবিন্দু, ফসিলস, ক্যাক্টাস, পরশপাথর, ভূমি প্রভৃতি ব্যান্ড। কলকাতার চিত্রপ্রতিবেদন এইটা। বাংলাদেশে এই চিত্র অবিকল অনুরূপ নয়, এ নিয়ে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধকারের কতিপয় বীক্ষণ ও আন্দাজ রয়েছে বলা যায়, বিস্তারে কহতব্য পরবর্তীকালে কখনো কোথাও সময় ও সুযোগ ঘটে উঠলে। এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলে রাখা যাক যে মেট্রো কলকাতায় সেই-অর্থে গ্রাম গরহাজির, অনেকদিন হয় সেখানকার গ্রামচিহ্ন অন্তর্হিত, মহানগর ঢাকায় এখনো অগোচর নয় গ্রামচিহ্ন।

 

বাংলা গানের লোকায়ত গরিমা, বাউলিয়ানা, ব্যান্ডগানাবাজানা

বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত নিয়া হাজারটা আপত্তি ছিল যাদের এককালে, এখনও উন্নাসিকতা উবে গেছে বলা যাবে না বরং ফর্ম বদলে সেই নাসিকাকুঞ্চিত সমুজদারদল ইংরেজি-হিন্দুস্তানি মিউজিকে ক্ল্যাসিক্যালে রসাতলায়িত লক্ষ করব আজকাল, সেইসব আপত্তির মধ্যে একটা ছিল যে ব্যান্ডসংগীতের অনুশীলক-পরিবেশকেরা নাকি বাংলা গানের বাংলা কালচারের ঐতিহ্যানুগত নয়, আবহমান বাংলা হেরিটেজ্ নিয়া ব্যান্ডসংশ্লিষ্টদিগের কারোরই নাকি বিশেষ শিক্ষাদীক্ষা-জানাশোনা-আশনাই-প্রীতিপ্রণয় নাই; বিদেশী বিশেষভাবেই ইংরেজি মিউজিকের একটা অনুকারবৃত্তিই নাকি ব্যান্ডের গানবাজনার বেসাতি। কিন্তু লক্ষ করব যে ব্যান্ডসংগীতের গোড়ার দিন থেকেই বিবৃতিটার পক্ষে এক্সাম্পল্ মেলে না। আজম খানের ‘আলাল-দুলাল’, ‘সালেকা-মালেকা’ বা ‘বাংলাদেশ’ ইত্যাদি কিংবা জিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠীর গানে এবং অব্যবহিত পরের পিলু মমতাজ বা নাজমা জামান বা ফেরদৌস ওয়াহিদ প্রমুখের প্যপগানে যে-সুরকাঠামো তা সবই কিন্তু ওয়েস্টার্নাইজড প্রেজেন্টেশনরীতি ফলো করেও ঐতিহ্যানুগ। মোটা দাগেই পাওয়া যায় আবহমান বাংলার লতানো ধুন। পরবর্তীকালে ব্যান্ডসংগীতপরম্পরায় হেরিটেজের নবরূপায়িত উপস্থাপনা আরও গতি নিয়েছে বেশ বৈচিত্র্য ধরেই। এমন একটা ব্যান্ডগানের অ্যালবাম পাওয়া যাবে না যেখানে একডজন গানের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ফোক্-স্ট্রাকচার অবলম্বন করে নাই। ফিডব্যাক, সোলস, মাইলস, এলআরবি, রেনেসাঁ, নোভা, চাইম, আর্ক, এমনকি ওয়ারফেইজও ঐতিহ্যানুবর্তী মিউজিক করেছে তাদের প্রত্যেকটা অ্যালবামে।

একদম পূর্ণাঙ্গ ফোকঅ্যালবাম করা ব্যান্ডের তখনও শুরু হয় নাই। ফিডব্যাক প্রথম ঘটনাটা হাজির করল ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তাদের ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবাম দিয়ে। এই অ্যালবাম রিলিজের পরে সেই বিকটপ্রজাতি ক্রিটিকরা তাদের পিন-আটকে-যাওয়া ভাঙা রেকর্ড পুনরায় বাজাতে শুরু করে, এইবার তাদের গলায় হেরিটেজ্ বিপদাপন্ন বলিয়া আওয়াজ শোনা যায়; ব্যান্ডের পাল্লায় তাদের সাধের ঐতিহ্য কৌলীন্য খোয়াতে চলেছে, এমনটা হাহাকার বাতাসে বেশ কিছুদিন প্রকম্পিত শব্দে ঘুরে বেড়ায়, ফের মিইয়েও যায়। তারপর তারা বলতে থাকে, ব্যান্ডের হাতের সব তাস দেখানো হয়ে গেছে বলেই এখন নাকি লোক-ঐতিহ্যের এই রেস্টোরেশন। যদিও শ্রোতার রেস্পোন্স বলছিল অন্য কথা। ‘বাউলিয়ানা’ ব্যাপক শ্রোতাগ্রাহ্য হয়েছিল। পরে (ম্যে-বি আগে, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ ও ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবামদ্বয়ের মাঝামাঝি, একদম ভুলে গেছি ক্রোনোলোজি) এই ফিডব্যাক থেকেই ‘দেহঘড়ি’ শীর্ষক একটা অ্যালবাম বাইর হয় আব্দুর রহমান বয়াতীর সঙ্গে একটামাত্র গান দিয়ে, একগানে একটা আস্ত সংকলন বাংলায় সেইবারই প্রথম, এবং ব্যবসাসাফল্যে বাজার সরগরম করে তোলে। এর পরপরই শুরু হয় বাউলিয়ানাধাঁচে একক ও দলীয় সংকলন বার করবার ব্যাপকতা। আইয়ুব বাচ্চু থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যান্ডসিঙ্গারদের কম্পোজিশনে বেহদ্দ ফোকের টিউন শুনতে শুনতে রেগ্যুলার রকশ্রোতাদের নাভিশ্বাস উঠতে থাকে ক্রমে। একসময় ব্যাপারটা যথেষ্ট মনোটোনির কারণও হয়ে ওঠে। এমনকি জেমসের কণ্ঠেও পূর্ণাঙ্গ ফোক একটা গান বাইর হয় সেই-সময়, “বেলা গেল রে / ভবের মায়ায় রইলি রে তুই ভুলিয়া” লাইন্স দিয়া আরম্ভ সেই গানটি, মিক্সড অ্যালবাম ‘রঙ্গমেলা’-য় সেই গান বাজারে আসে, টেরিফিক রেন্ডিশন হয়েছিল সেইটা। কাজেই, বাউলিয়ানা অ্যালবামের ইম্প্যাক্ট বাংলাদেশের নতুনদিনের নাগরিক গানের বাজারে ব্রেইক-থ্রু এনেছিল বললে অল্পই বলা হয়। এই নিবন্ধে আমরা সেই দিশারী অ্যালবামের ইনলে-কার্ড থেকে টেক্সট প্রিজার্ভ করব শুধু।

সংকলনের প্রচ্ছদে অ্যালবামনাম এবং ব্যান্ডনাম দুইটারই লোগো ছিল মনকাড়া দৃষ্টিনন্দন। প্রচ্ছদগাত্রে অ্যালবামনাম বাংলায় ফের ইংরেজিতেও প্রতিবর্ণীকৃত, তলায় চিকন হরফে লেখা ছিল ‘প্রথম খণ্ড’; যদিও পরের কোনো খণ্ড আর বাইর হয় নাই, ফিডব্যাক থেকে প্রধান কণ্ঠ এবং জায়ান্ট সমস্ত প্ল্যানের উদ্গাতা মাকসুদুল হক বেরিয়ে    যেয়ে ব্যান্ড গড়েন আলগ। অ্যালবামনামের নিচেই আয়তক্ষেত্রাকারে ব্যান্ডমেম্বার্স সকলে চিত্রিত বহুবর্ণিল পাঞ্জাবি পরিধান করে ন্যাচারাল সহাস্য দাঁড়ায়ে। এর তলায় বিলো-অ্যালাইনমেন্টে ব্যান্ডনাম বাংলায়-ইংলিশে এবং বাঁদিক ঘেঁষে ‘সবসময় কোকাকোলা’ স্পন্সর। এর দুইবছর আগে এই স্পন্সরকেই ফিডব্যাকের ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামের ইনলে-কার্ডের ভিতরগাত্রে গেছিল পাওয়া। ফারাক শুধু এইবার স্পন্সর সটান প্রচ্ছদে।

কার্ডের একদিকে সর্ববামে ক ও খ দুই পিঠে পাঁচ-দু-গুণন দশটা গানের শীর্ষশব্দ/শব্দগুচ্ছ, তলায় ‘প্রযোজনা ও পরিবেশনায় সাউন্ডটেক’ লেখা। তার ঠিক পরের ভাগে কাভারফোটো, অতঃপর দুইশ শব্দের একটা প্রিফেইস্, এই পৃষ্ঠার সর্বকর্নারে আটজন শিল্পী-কলাকুশলীর ডাকটিকেটসাইজ ছবি ছাপানো, পরপর তারা হলেন : হিরু শাহ, সন্তোষ বাউল, ফোয়াদ নাসের বাবু, মো. পিয়ারু খান, মাকসুদুল হক, সেকান্দার আহমেদ, লাবু রহমান এবং ফিডব্যাক-ব্যাবস্থাপক কিউ.এম. আলম বাচ্চু। কোকাকোলা সাইনবোর্ড এই পৃষ্ঠাতেও রক্তলাল জ্বলজ্বল করছে।

“ডিজিটাল মাধ্যমে রেকর্ডকৃত ও সম্পাদিত এ-অ্যালবামে ধরা আছে বাংলাদেশের লোকগানের অক্ষয় ও সপ্রতিভ এক ধারা। আর এ আয়োজন ফিডব্যাকের অনেক দিনের। গানের আসরে এ-বছরই ফিডব্যাকের কুড়ি বছর পূর্ণ হলো। এদেশের লোকপরম্পরার গৌরবকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে আমরা তা উদযাপন করতে চাই। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-থাকা আমাদের তরুণ মনের শ্রোতাদের হাতে তুলে দিতে চাই এ-সংকলন। আমরা আশা করি বিচিত্র রুচির নানা বয়সী আরও বহু শ্রোতার কাছে সংকলনটি পৌঁছে যাবে।

মূলত বাউলাঙ্গের গান ও স্তরে স্তরে গড়ে-ওঠা আমাদের সুরবোধ মিলেমিশে নাম নিয়েছে ‘বাউলিয়ানা’। এসব সুরগরিমার যারা অধিকারী তারা সত্যিকার অর্থে বড় ধরনের সাধক ও জ্ঞানী। সে-গরিমার স্পর্শে ফিডব্যাকের সৌকর্য আরও বেড়েছে। একটানা সাত বছর ধরে চলেছে গবেষণা ও সংকলন। মুখে মুখে ফেরা লোকসংস্কৃতি থেকে সংগৃহীত হয়েছে মূল্যবান সব রচনা। খসড়াভাবে তা রেকর্ড করা হয়েছে। যেসব বাউল আমাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন, এ-মলাটে আমরা তাদের ঋণস্বীকার করছি … যদিও অনেক গানের স্রষ্টা আমাদের অজানা।

বাউল সাধক ফকির লালন শাহ্-এর কিছু গান এ-অ্যালবামে ঠাঁই পেয়েছে। জীবিতদের মধ্যে সন্তোষ বাউল ও হিরু শাহ্ আমাদের সঙ্গে গানে কণ্ঠ দিয়ে ধন্য করেছেন। গানের সুর ও কথা উদ্ধারের জন্যে হিমাংশু বিশ্বাসের কাছে আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।

গানগুলোকে পরিবেশনগত ভিন্ন এক মাত্রা দেবার জন্যে আমরা জ্যাজ্, রক্ ও রেগের সাহায্য নিয়েছি। যথাসম্ভব মূল সুরের কোনও অঙ্গহানি না-করেই তা করা হয়েছে।

এ-ক্যাসেটের গানগুলোতে পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তবলা, বেহালা, বাংলাঢোল, একতারা, খঞ্জনি ও মন্দিরার উপযুক্ত সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। আর এগুলো বাজিয়েছেন এদেশের প্রখ্যাত সব বাদ্যযন্ত্রী। বিশেষ করে বাউলশিষ্যরা কোরাস কণ্ঠদানে আমাদের পরিবেশনকে সমৃদ্ধ করেছেন।”

শুভেচ্ছা জ্ঞাপনান্তে ফিডব্যাকের পাঁচ মাঝিমাল্লার নামস্বাক্ষরের আগে “আশা করি আমাদের এ-নিবেদন আপনাদের ভালো লাগবে” — এই বিনয় সেরে ‘ফিডব্যাকের ছিয়ানব্বইয়ের নিবেদন বাউলিয়ানা ১ম খণ্ড’ শীর্ষক ইনলে-কার্ডের চিলতে ফ্ল্যাপকথিকা তামামশোধ করা হয়েছে। এই প্রিফেইস্ কে লিখেছেন বলা না-হলেও বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে এইটা মাকসুদুল হক লিখেছেন। ইতিস্বাক্ষরের জায়গায় ‘শুভেচ্ছা সহ’ ফোয়াদ নাসের বাবু, মো. পিয়ারু খান, মাকসুদুল হক, সেকান্দার আহমেদ, লাবু রহমান : এই পাঁচের নাম লেখা। তার তলায় “যোগাযোগ / ফিডব্যাক / ১৮১ বড় মগবাজার, ঢাকা ১২১৭, বাংলাদেশ।” ডানকোনায়, বাহুল্য বলা, ‘সবসময় কোকাকোলা’।

ফ্ল্যাপের পৃষ্ঠা উল্টালেই বিশাল বোল্ডেন হরফে ‘ফিডব্যাক-এর বাউলিয়ানা’। তারপর দশটা গানের নাম-পরিচয় গীতিকার-সুরকার ইত্যাদি তথ্যতালিকা। গানতথ্য হুবহু নিচে রেখে এগোনো যাক :

করি মানা ।। ফিডব্যাক ও বাউল-শিষ্য ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ
দিবার কিছু নাই ।। ফিডব্যাক ।। কথা : আখতার ফিরোজ ।। সুর : ফিডব্যাক
লোকসান ।। ফিডব্যাক ও সন্তোষ বাউল ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ
গুরুর ভাব ।। ফিডব্যাক ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ
শ্যামকালিয়া ।। ফিডব্যাক ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ ।। কৃতজ্ঞতা : হিমাংশু বিশ্বাস, হ্যারল্ড রশীদ ও ‘ওজান’
কেহই করে বেচাকেনা ।। ফিডব্যাক ।। কথা : ড. মো. মনিরুজ্জামান ।। সুর : আলী হোসেন
ধুঁয়ার দানা ।। ফিডব্যাক ।। কথা : মো. পিয়ারু খান
প্রাণ কান্দে ।। ফিডব্যাক ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ
জনমদুখী ।। ফিডব্যাক ও বাউল-শিষ্য ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ
হাওয়া আদমে ।। ফিডব্যাক ও হিরু শাহ ।। কথা ও সুর : সংগ্রহ

প্রশ্নটা কাউরে করি নাই, কিন্তু প্রশ্নটা আছে সেই ছিয়ানব্বই থেকেই নিবন্ধকারের ভিতরে যে ব্যাপকভাবে যে-গানগুলো লালনের নামে পরিচিত বা রাধারমণের নামে, সেই গানগুলো ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবামে ক্রেডিটলাইনে কেন ‘সংগ্রহ’ বলিয়া চালানো হলো? যদিও ভূমিকায় লালনের নাম উচ্চারিতও হয়েছে, বেনামে রাধারমণের গান চালানো হয়েছে এবং বেচারার নামটা অ্যালবামের কোত্থাও উচ্চারিত হয় নাই। নিশ্চয় এর পেছনে একটা কারণ থাকতে পারে অ্যালবামকর্তাদের, কোথাও খোলাসা করা হয় নাই। কিন্তু কি এমন কারণ থাকতে পারে যে ক্রেডিট দিতে এই কার্পণ্য করা হলো? অন্তত ‘শ্যামকালিয়া’ গানের ভনিতাপদ শুনেও তো স্যংরাইটার-কম্পোজার হিশেবে রাধারমণজিকে ক্রেডিট দেবার ব্যাপারে সার্টেইন হওয়া যাইত। ভনিতাপদে নাম থাকলেই কি সেইটা লালনের হয় সবসময়? কিংবা ভনিতাপদে-নাম-না-থাকা লালনের গান কি নাই একটাও? অনুরূপ রাধারমণেরও? মনে হয় এমনটা ভাবা হয়েছে যে একই গানের বিভিন্ন ভার্শন থাকে লিরিকের এবং সুরের, লোকের মুখে মুখে ফেরে একেক জায়গায় একেকটা ডালে একই গান; সেক্ষেত্রে পদকর্তার নামটা নিশ্চিত হয়ে কোত্থেকে এবং কার কাছ থেকে এইটা কালেক্ট করা হয়েছে তা বলে নিলে বেহতর হতো। হয় নাই। ফিডব্যাকের কাছ থেকে ব্যাখ্যা-না-দেয়া এই নামচোপানো কাজটা মানানসই মনে হয় নাই। কেননা আমরা দেখেছি ফিডব্যাক ক্রেডিট দেবার ব্যাপারে সবসময় সচেতন ছিল। বাউলিয়ানা অ্যালবাম হাতে নিয়ে এই কাঁটাটা আজ থেকে বাইশ বছরে আগে যেমন আজও তেমনি পীড়িত করে। এখন একটু কমলেও ওই-সময় একটা ব্যাপার করতে দেখা যেত শহুরে ক্যাসেটশিল্পীদেরকে যে গ্রামীণ পদকর্তা-সুরকারের নামের জায়গায় ‘সংগ্রহ’ শব্দটা বসিয়ে দেদার গানের সার্কুলেশন।

ইনলে-কার্ডের এই পৃষ্ঠস্থ পরবর্তী ভাগে অ্যালবামনেপথ্য কলাকুশলীদিগেরে ক্রেডিট দেয়া রয়েছে, ক্রেডিটলাইনগুলো নিম্নরূপা :

“সহযোগী যন্ত্রী : মিলন ভট্টাচার্য (তবলা ও মন্দিরা), সাদেক আলী (ঢোল ও খঞ্জনী), সুনীল চন্দ্র দাস (বেহালা), আলমাস (বেহালা), নজরুল ইসলাম (বাংলা ঢোল)
সহযোগী কণ্ঠ : শুক্লা, রীতা, কনি, সাবিনা, নার্গিস, আমীর হোসেন, জব্বার মিয়া, মো. আলম
শব্দধারণ ও সংমিশ্রণ : ইমরান আহমেদ ও চারু
স্টুডিয়ো : সাউন্ড গার্ডেন
ফিডব্যাকের পোশাক ডিজাইন : কাজী রকিব ও মাসুদা কাজী
বাউলিয়ানা ও ফিডব্যাক লোগো : এনায়েত হোসেন
বিশেষ ধন্যবাদ : নাঈম হাসান, ক্যাথরিন মাসুদ ও তারেক মাসুদ
ফোটোগ্র্যাফি, প্রচ্ছদ ও পোস্টার পরিকল্পনা : জাভেদ আক্তার সুমন
কনসেপ্ট : ফিডব্যাক
কম্পিউটার গ্র্যাফিক্স : হুমায়ূন কবির, ডিজিগ্রাফ লিমিটেড, ঢাকা
প্রচ্ছদ ও পোস্টারের ছবি বাংলা অ্যাকাডেমির বটমূলে তোলা”

বাউলিয়ানা অ্যালবামটা বাংলাদেশের গানে-বাজনায়, বিশেষভাবে ব্যান্ডসংগীতের অ্যারেনায়, একটা ফেনোমেনা। নাগরিক তরুণ-যুবাদেরেই শুধু নয়, এই অ্যালবাম আকৃষ্ট করেছিল তাদেরেও যারা ব্যান্ডসংগীতের রেগ্যুলার শ্রোতা নন। সেই-সময় ইন্ডিয়ান বাংলায় রিমেক আর রিমিক্সের একটা হাওয়া এসেছিল, হুল্লোড় শুধু, বাউলিয়ানা অ্যালবামটা আজও প্রথম শ্রবণে যে-কেউ বুঝবেন এইটা রিমেক-রিমিক্স নয়। সেই-সময় ফিডব্যাক যে-টার্মটা আমদানি করেছিল ‘ফোক্-ফিউশন্’ বলিয়া, আজকের গানদরিয়ায় নেস্ক্যাফে-কোক্ প্রভৃতি কিসিমের স্টুডিয়োগুলোতে সেই ফিউশন্ সেই ফোকেরই দিশাহারা কারবার। ইট ওয়্যজ্ টুয়েন্টি ইয়ার্স ব্যাক্, কথাটা খালি ইয়াদ রাখি যেন। অমলিন, অনিন্দ্য, আজও।

সবশেষে যে-কথাটা আপাতত বলে রাখতে চাইছি, কথাটা আন্দাজেরই হিসাব যদিও, ঠিক এই অ্যালবামটা ব্যান্ডসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী মাকসুদ তথা ম্যাকের গানজীবনে ব্যাপক অভিঘাত রেখে গেছিল। ভূমিকায় “একটানা সাত বছর ধরে চলেছে গবেষণা ও সংকলন। মুখে মুখে ফেরা লোকসংস্কৃতি থেকে সংগৃহীত হয়েছে মূল্যবান সব রচনা” … কথাগুলো বলা আছে খেয়াল করব; পরবর্তী জীবনে ম্যাক দীক্ষাই নিয়ে নেবেন বাউল তরিকায়, বাউলাঙ্গ হয়ে উঠবে তার জীবনেরই অংশ নয় একেবারে কেন্দ্র। ‘গরিমা’ শব্দটার ব্যবহারও নজর এড়ায় না প্রারম্ভিকাভাষ্যে, যেখানে ‘সুরগরিমা’ শব্দটা আমাদের করোটিভুক্ত হয়ে যাবে বাকি জিন্দেগির জন্যে, ম্যাক পরে একটা গানের দলই গড়ে তুলবেন এই শব্দযোগে, ‘গরিমা গানের দল’, যেখান থেকে ‘মাআরেফাতের পতাকা’ নামে একটা অ্যালবাম বাইর হয়েছিল প্রায় আখড়া-মেজাজের আবহ বজায় রেখে, দারুণ একটা কাজ হয়েছিল ‘গরিমা’ আয়োজনটা। বাদে এর কোনো দ্বিতীয় সংকলন হয় নাই, যেমন হয় নাই বাউলিয়ানারও। রকারের ধর্মই কি তা? মানে, একজায়গায় থিতু না হওয়া? সাফল্যের কন্টিন্যুয়েশন রেখে একই জিনিশ বোতল ও লেবেল পাল্টে পুনরুৎপাদন না করা? ব্যান্ডশিল্পীদের রথী-মহারথী সকলেই নিজেদের চর্বিতচর্বণ দিয়া বাজারসদাই ভালোই করেছেন, শুধু মাকসুদ ছাড়া।

 

বাংলাদেশের ফোকসাফল্য ও ফোকভুলচুক

১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের কোনো-এক শুভদিনে বেরোয় ফিডব্যাকের ফোক্-ফিউশন্ রেকর্ড ‘বাউলিয়ানা’। অ্যালবামের প্রচ্ছদপটে লেখা ছিল ‘বাউলিয়ানা প্রথম খণ্ড’, যদিও পরবর্তী ইনিশিয়েটিভ কিছু থাকলেও শ্রোতাদের হস্তগত হয় নাই আর; দ্বিতীয় খণ্ড বাউলিয়ানা বাজারে না-এলেও ফিডব্যাকের এই অ্যালবামটার প্রভাব তখনকার সেই কানার হাটবাজার জুড়ে ব্যাপকভাবে পড়েছিল অস্বীকারের জো নাই। ভীষণ জোয়ার এসেছিল অডিয়োইন্ডাস্ট্রিতে ম্যাক ও ফিডব্যাকের ‘বাউলিয়ানা’ ভেঞ্চারের দেখাদেখি ফোকঅ্যালবাম করার। ব্যান্ড-ননব্যান্ড সবার মধ্যেই হিড়িক উঠেছিল ফোক্ রেকর্ডস্ বার করবার। দুনিয়াদারির বাকিসব ভুলে যেয়ে এই হুজুগে ক্যাসেটকোম্প্যানিগুলো কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা কামায়ে যেতে থাকে। ব্যান্ডসংগীতের ব্যাপক শ্রোতাপ্রাপ্তি ঘটলেও ফোকের মোহন চোরাবালিতে পড়ে যেয়ে এই সময়েই বাংলাদেশের সুঠাম ব্যান্ডম্যুভ সলিল সমাধি নিশ্চিত করে ফ্যালে হুঁশে ফেরার আগে।

ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দেখা দরকার হবে এক-সময় যে, পশ্চিমবঙ্গজ ফোক-রিমেইকের বেনো ঢলে শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনীল প্রমুখ যা ক্যালানে কীর্তিকাণ্ড করতে থাকেন সেই-সময়ে, ব্যান্ড তথা বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত সেদিক থেকে ছিল সমস্ত-সীমাবদ্ধতা-সত্ত্বেও সিগ্নিফিক্যান্ট ও নতুনত্ববহ। শুধু ওই বিশেষ সন্ধিক্ষণেই নয়, বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকে স্টার্ট-আপ্ পর্যায় থেকে ফোক্ টিউনের ইনোভেটিভ প্রয়োগ লক্ষ করব যেখানে হেরিটেইজ্ নিয়া খামোক্কা কান্নাকাটি ট্রিবিউটের নাট্যপনা নাই। আজম খান থেকে শুরু করে ফিডব্যাকের গানে, জেমসের গানে, রেনেসাঁর গানে, নোভার গানে সেইসব সত্যিকারের নতুনতাবাহী মেধাদীপ্তি নিরিখ করে দেখবার জোখা। ম্যাকেরই ফিডব্যাক-ডিউরিং ‘মাঝি-৮৮’, ‘মাঝি-৯১’, ‘পালকি ২য় পর্ব’, ‘আপন দেশে চলো’ প্রভৃতি টিউন্ লক্ষণীয়। রেনেসাঁর ‘চকিদার’, ‘তুমি কি আজ বন্ধু যাবে আমার সাথে’ কিংবা ‘হৃদয় কাদামাটি’, ‘ভালো লাগে জোছনারাতে’ প্রভৃতি গানের মিউজিকভাগে বেঙ্গলি টিউনের মেধাদীপ্ত প্রয়োগ পথদর্শী বিবেচিত হবার যোগ্য অনেকানেক বিচারে। জেমসের আগাগোড়া গানের গগনবিদারী সৃজনোল্লাসে বেঙ্গলি সিগ্নিফায়ার-সাইন্ খুঁজতে লেগে এইখানে ব্যাপ্তি না-বাড়াই। ‘সোলস’ প্রভৃতি ব্যান্ডের উল্লেখ তো করা যাচ্ছেই না আপাতত রচনার বহর বেড়ে যাবার ভয়ে। এছাড়া প্রায় প্রত্যেকটা ব্যান্ডের অ্যালবামভুক্ত ডোজেনখানেক গানের মধ্যে একজোড়া গান থাকতই মিউজিক্যালি মেঠো সুর ও আবহের। ফিডব্যাকের ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবাম এক্ষেত্রে একটা আলাদামাত্রিক অভিনবতা এনেছিল অন্যত্র।

“আমি যখন বাউলিয়ানা  নিয়ে কাজ শুরু করি তখন অনেকেই রিস্কি এক্সপেরিমেন্ট বলে এটাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। পরে তারা এর সাফল্য দেখেছে। আসলে উচ্চমধ্যবিত্তরা আমাদের ফোককে মনে করে ‘ক্ষ্যাত’। ফিউশনকেও তারা মেনে নিতে রাজি নয়। কোনোকিছুই সহজে গ্রহণ করার প্রবণতা এদের নেই। এরা হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। এদের কারণে আমরা আমাদের মূল সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রমোট করতে পারছি না।

বাউলিয়ানার অনুসন্ধান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এটা প্রচুর শ্রমসাধ্য ব্যাপার। গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সাথে মিশতে হবে। আসলে বাউলরা তো কমিউনাল না। এটা বুঝতে হবে। আর দেশের ৯৫ ভাগ লোক যে-গান শোনে তাকে দূরে ঠেলে রাখার প্রবণতা কেন? নেশাগ্রস্ত, গাঁজাখোর সব উপাধি দিয়ে এদের দূরে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে। একে রুখতে হবে।”

উপরোক্ত কথাগুলো টুকে নেয়া গেল ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত নববর্ষ সংখ্যা ‘আনন্দভুবন’ থেকে, যেখানে ম্যাকবক্তব্য ছাড়াও সংগীতজাগতিক বাংলাদেশের বিভিন্ন ধারার শিল্পী-কলাকুশলীদের কথাবার্তা ধারণ করা হয়েছিল ফোকগানের পুনরুৎপাদন, পুনর্নির্মাণ, আধুনিকায়ন এবং সর্বোপরি শিকড়ের অবমূল্যায়ন বনাম মৌলিক সৃজন বেগবান অথবা ব্যাহতকরণ ইত্যাদি কিছু প্রসঙ্গ ধরে তৎকালীন প্রোমিনেন্ট পার্ফোর্মিং আর্টিস্টদের মতামত রেকর্ড করা হয়েছিল। ফরহাদ মজহারের বক্সট্রিটমেন্ট বক্তব্যও রয়েছে এই ইশ্যুতে, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য।

 

ম্যাক অন জ্যাজ-রক ফিউশন

অডিয়োসংকলনগুলোতে ম্যাকপ্রণীত রচনা আমরা পেয়ে এসেছি আগাগোড়া, আগের কালে সেসব রচনার লেখকটিকে চেনার উপায় ছিল না নামদস্তখত না-থাকার কারণে, একসময় ক্লিয়ার হয়ে এসেছে সেসব ক্ষুদে লেখার নেপথ্য লোকটির মুখ। রচনাগুলোতে থাকত সংকলন উপস্থাপনের জন্য ভূমিকাসুলভ তথ্যাদি। ইনলে-কার্ড নামেই জিনিশগুলো আমরা চিনেছি। ইনলে-কার্ডগুলো থেকে সেই সময়টায় আমরা বিস্তর উপকৃতও হয়েছি স্বীকার করব। বর্তমান নিবন্ধের এতদাংশে একটি ইনলে-কার্ডের লেখা আমরা পাঠ করতে চলেছি।

নিবন্ধের নিম্নস্থ অংশটা পাঠের অব্যবহিত পূর্বে এই ইন্ট্রো পর্বে একটু নজর বুলিয়ে গেলে এর প্রণেতা মাকসুদুল হক ওর্ফে ম্যাকের প্রতি কিছুটা জাস্টিস হয়। কেননা ম্যাকের এই সংক্ষিপ্ত কলেবরের দ্রুতলেখ রচনাটা আমরা পাচ্ছি একটা গানসংকলনভুক্ত প্রচ্ছদপরিচিতিমূলক ভাঁজপত্রের উল্টো পিঠে মুদ্রিত মুখবন্ধ হিশেবে। অ্যালবামের নাম ‘ওগো ভালোবাসা…’, প্রকাশকাল ১৯৯৯, বাংলাদেশে এবং বাংলা গানে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জ্যাজ-রক ফিউশন অ্যালবাম হিশেবে এইটা আজও তুলনারহিত ও অবিস্মরণীয়। বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন ব্লার্ব, সাধারণ্যে ফ্ল্যাপ বলিয়া যার পরিচয়, যেখানে সেই বইটির একটা চটজলদি পরিচিতি পেয়ে যান গ্রন্থাগ্রহী সম্ভাব্য ক্রেতা বা পাঠক, ফিতার ক্যাসেটের যুগে বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতে একই কায়দায় ব্লার্ব/ফ্ল্যাপকথিকার সাক্ষাৎ পাই আমরা এবং লাভবান হই মিউজিক ও মিউজিশিয়্যান সম্পর্কিত খুঁটিনাটি কৌতূহল নিবৃত্তির উৎস নাগালে পেয়ে। জ্যাজ সম্পর্কে, রক সম্পর্কে, ফিউশন সম্পর্কে, কিংবা জ্যাজ-রক ফিউশন সম্পর্কে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনো রচনা এইটা না, ক্যাসেটের খাপে সেই সুযোগ ছিল না বা দরকারও ছিল না প্রাথমিক পরিচয়কথিকায় পাণ্ডিত্য ফলানোর।

কাজেই যে-লেখাটা আমরা এখানে পেতে চলেছি, এইখানে ম্যাকের সংগীতজ্ঞান সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে ভেবে কেউ পড়তে যেয়ে ম্যাকের প্রতি এবং অবধারিতভাবে নিজের প্রতিও অবিচার করবেন। এইটা ব্লার্বকথিকা বা ফ্ল্যাপের লেখা। প্রাথমিকী বিবেচনাবাহিত ঝটিতি রচনা এইটা। জ্যাজ সম্পর্কে, রক সম্পর্কে, ফিউশন সম্পর্কে ঢের জ্ঞানগম্যি ইত্যবসরে আমরা হাসিল করেছি হয়তো; তবে, মনে রাখতে হবে, এই লেখাটা প্রথম প্রকাশের কালে, সেই ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, জ্যাজ/রক/ফিউশন প্রভৃতি সম্পর্কে তেমন-একটা জানাশোনার সুযোগ সংগীতানুশীলনের সংশ্রবহীন আমাদের জন্য অন্তত অবারিত ছিল না। আজকে যেমন হড়বড়িয়ে জেনে ফেলতে পারি পৃথিবীর পদ্মফুল থেকে শুরু করে স্বর্গপুষ্প পারিজাত অব্দি একক্লিকে, সেকালে সেই ’৯৯ সালে উইকি ছিল না বা নানাবিধ বৈষয়িক অফিশিয়্যাল ওয়েবসাইট স্বপ্নেও ছিল না, ম্যাকপ্রণীত এই চিলতে লেখাটা আদ্যিকালের সেই নিষ্প্রযুক্তিঋতুতে এসেছিল দোরগোড়ায় আমাদের এবং অধিকতর সুনিবিড় জানাশোনার অ্যাপিটাইট বাড়িয়েছিল বৈকি।

কিন্তু রচনাটা তা-বলে হেলাফেলারও নয় একেবারে; কেননা এইটা লিখেছেন আমাদের সংগীতভাষায় চার-দশকেরও অধিক সময় ব্যাপিয়া নিয়োজিত একজন সংগীতশিল্পী, মাকসুদুল হক ওর্ফে ম্যাক, যিনি আধুনিক বাংলা গানে জ্যাজ-রক ফিউশন নিয়া হাতে-কলমে এবং গলায়-গানায়োজনে ব্যাপকবিস্তারী কাজ করেছেন। পরিমাণে সেসব কাজ খুব সংখ্যাবাহুল্যের প্রমাণ না-রাখলেও গুণমানে একেকটা পাক্কা ছাপ অবশ্যই। প্রায় দ্বিদশক পুরো হতে চলল ‘ওগো ভালোবাসা’ রিলিজের পরে, ‘মাকসুদ ও dHAKA’ ব্যান্ডের ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ সংকলন প্রকাশের দ্বিদশকপূর্তি তো হয়েই গেল বলতে হবে, এইসব হিসাবকিতাব মাথায় রেখে লেখাটা পাঠ করার ফজিলত বাংলাদেশের গানান্বেষী শ্রোতা/পাঠকেরা পাবেন আশা করা যায়। বিশেষ করে যারা বাংলা ব্যান্ডসংগীত সংক্রান্ত সমুদয় চিত্রাবলি পেতে চান, খোঁজপাত্তা চালান বাংলা রকের অনুপুঙ্খের, তাদের কাছে ম্যাকের এই এবং অন্যান্য বং-ইং লেখাপত্রাদি বিষয়গুণেই সমাদৃত হবে।

এইখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে ম্যাকের একাধিক কাগুজে মুদ্রিত গ্রন্থাবলির মধ্যে একমাত্র বাংলা বইটির দ্বিতীয় ও বর্ধিত কলেবরের সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে দীর্ঘদিনের ছাপা-দুষ্প্রাপ্য দশা কাটিয়ে ২০১৬ সনের ফেব্রুয়ারিতে। বইটা, ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ শীর্ষক ঠাসবুনিত হরফসজ্জার প্রায় চারশ পৃষ্ঠার বই, ছাপিয়েছে বাংলাদেশের ঢাকাস্থ প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠান অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্প্যানি। কিন্তু বক্ষ্যমাণ রচনাটা, ম্যাকপ্রণীত আরও অনেক হ্রস্বায়ত-মধ্যদৈর্ঘ্য রচনাপত্তরের মতো, ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ শীর্ষক পুস্তকের আওতায় পাওয়া যায়নি। রক্ সম্পর্কে, ব্যান্ডমিউজিক সম্পর্কে, ফোক সম্পর্কে, ফোক-রক সম্পর্কে একাধিক রচনা স্থান করে নিয়েছে যদিও; গ্রন্থপ্রণেতা মাকসুদুল হক হয়তো সচেতনভাবেই ক্যাসেটফ্ল্যাপের ওরিয়েন্টেশন্যাল ওভার্ভিয়্যু টাইপের রচনাকে স্বতন্ত্র রচনামর্যাদা দিতে চান নাই। কিন্তু একজন মিউজিশিয়্যানের জ্যান্ত অভিজ্ঞতার বয়ান হিশেবে এই রচনাটাও সমান অভিনিবেশে পাঠ্য বলিয়া পাঠকের কাছে মনে হতে পারে।

এখানে, এইবার, একটানে ম্যাকের মূল রচনাটা পাঠ করে নেব। রচনাটা ক্যাসেটের ইনলে-কার্ডে ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’ উপশিরোনামে আরও কতিপয় উপ-রচনার সঙ্গে মুদ্রিত, ‘অন জ্যাজ-রক ফিউশন’ শীর্ষনামটা আমরা এর নতুন পাঠকালে বাড়তি পাঠসংযোগসুবিধা পাবার আশায় রাখছি। মুখ্য রচনাপাঠান্তে ফের কিছু সংযোজনী ভাষ্য জুড়ে দিয়ে চেষ্টা করব ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামের একটা দালিলিক স্মৃতি সংরক্ষণ করতে; এছাড়া অ্যালবামের গোটা ব্লার্বকথিকাটা কালেক্ট করতে পারলে ভালো হতো, তবে সেইটা আরেক জায়গায় একই নিবন্ধকার কর্তৃক সংরক্ষিত রয়েছে; যেন মহাকালের অভিলেখাগারে ব্যান্ডসংগীত ম্যুভমেন্টের ছোটখাটো প্রত্যেকটা স্টেপ্ সুরক্ষিত রয় এইটা আমরা কায়মনোবাক্যেই কামনা করি। অলমিতি বিস্তরেণ। অভিনিবিষ্ট হই ম্যাকের কথায়, লেট্’স্ সি, ম্যাক অন জ্যাজ-রক ফিউশন!

“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু-শ’ বছর আগে ‘পাশ্চাত্যি শাস্ত্রীয়’ বা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালের ভিত থেকেই জন্ম হয় আজকের জ্যাজ সংগীতের। অ্যাফ্রিক্যান্ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা এই নয়া সংগীত উপস্থাপন করেন। মার্কিনী ইতিহাসের বর্ণবৈষম্যের সেই কলঙ্কময় অধ্যায়; — শ্বেতাঙ্গরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সংগীত ছাড়া আর-কোনো মানসিক উন্নতির প্রয়াসকে প্রশ্রয় দিত না। সেই কৃষ্ণাঙ্গরাই আজ ‘বিশ্বসংগীতের’ পৃথিবীতে রাখছে অকল্পনীয় অবদান। ক্রীতদাসদের দুঃখ বেদনা ভালোবাসা ও কষ্ট সবকিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই সংগীতের মাঝ দিয়ে এবং তা প্রতিফলিত হয় তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনীতিক চেতনার মধ্যে। অ্যাফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছন্দ বা রিদমের ইম্প্রেশন বা ছাপ পাশ্চাত্য সংগীতের প্রথমদিককার সংগীতজ্ঞদের কাজে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। বাকিটা ইতিহাস।

মানবজাতির সময় ও ধৈর্য যখন টানাপোড়েন ও পরীক্ষার মুখে, ঠিক তখনই জ্যাজসংগীত ছন্দ, লয়, মাত্রা, উপস্থাপনা ও সুরের আবহাওয়াকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে। দ্রুতলয়, সোলো, ইম্প্রোভাইজেশন, যুগলবন্দি ইত্যাদিতে এগিয়ে নিয়ে আসে এক অভাবনীয় নতুন ধারা। জ্যাজ সেই ‘তখন’ বা ‘এখন’ … কখনোই কমার্শিয়্যাল বা বাজারীয় সংগীত ছিল না, যদিও-বা জ্যাজকে ভাঙিয়ে অনেক নতুন সংগীত সৃষ্টি হয়, যার অন্যতম রক, যা শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের অনুসরণে আবিষ্কার করে।

এ-কথাও বলে নেবার প্রয়োজন বোধ করছি যে জ্যাজ আমাদের দেশের শাস্ত্রীয় বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীতের মতো শুধু সম্ভ্রান্ত সামাজদারদের সংগীত নয়, কোনোকালেই ছিল না। যেহেতু এ-সংগীতের জন্ম কোনো রাজপ্রাসাদের দরবারে হয়নি বা ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি, তা সাধারণ মানুষের সব স্তর ভেদ করে এসেছিল বলেই আজ এর বিশ্বজোড়া ব্যাপ্তি ও চাহিদা। মিল শুধু এতটুকুই যে জ্যাজ আমাদের শাস্ত্রীয় বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীতের মতো চর্চার খুব অভাব।

জ্যাজ তাই সকল বিবেচনায় খুব উঁচুমাপের সংগীত এবং যে-কোনো সংস্কৃতির উঁচুমাপের সংগীতের সঙ্গে খুব সহজে ও সফলভাবেই সংমিশ্রণ বা ফিউশন করা সম্ভব। যেমন আমরা করার চেষ্টা করেছি মুর্শিদী, মারফতি এমনকি রবীন্দ্র সংগীত ছাড়াও আমাদের শাস্ত্রীয় কিছু ধারার সঙ্গে। কথাটা খুব হাল্কা শোনালেও সত্য, এই জ্যাজ-রক ফিউশন খুব ভালো জাতের আলু যা যে-কোনো তরকারিতেই মানানসই।

এই শতকের শেষে বিশ্ব যখন বর্ণ, জাত, স্তর বা ধর্মকে মানুষের যোগ্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি বলে আর মনে করছে না, যখন সংগীত কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলছে না, এই পরিবর্তিত পৃথিবী যেখানে কোনো আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সংস্কৃতি নয় বরঞ্চ বিশ্বসংস্কৃতির বা গ্লোব্যাল কালচারের দিকে এগোচ্ছে, জ্যাজকে ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে সেমিক্ল্যাসিক্যাল বা আধাশাস্ত্রীয় সংগীত বলে গণ্য করা হচ্ছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী যখন ষাট দশকের আমাদেরই পথিকৃৎ বিটলস-এর সংগীতকে আধাশাস্ত্রীয় সংগীত বলে মনে করা হচ্ছে, দু-শ’ বছরের পুরনো জ্যাজ্ সংগীতকেও এখনো সেমিক্ল্যাসিক্যাল বা আধাশাস্ত্রীয় বলে গণ্য করা হয়, তাতে এই সত্য প্রমাণিত হয় জ্যাজ তার নিজস্বতা এতগুলো বছরেও হারিয়ে ফেলেনি। তার মূল কারণ, এই সংগীতধারা সময়কে ধারণ করেছে সঠিকভাবে ও অন্যসব সংস্কৃতির মাঝে নিজের একাত্মতা বা অস্তিত্ব দুই-ই সদর্পে বজায় রেখেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে জ্যাজের সংমিশ্রণ বা ফিউশনশাস্ত্রের দর্শনের কারণে।

জ্যাজ-রক ফিউশন কখনোই ঐতিহ্যবাদী বা রক্ষণশীলদের সংগীত ছিল না। জ্যাজ-রক ফিউশন খুব গুরুগম্ভীর শোনালেও বাংলা ভাষাভাষীদের কানে, বিশেষ করে ব্যান্ডসংগীতের শ্রোতাদের কাছে, তেমন নতুন কিছুই নয়। কারণ জ্যাজের আদলে আমি এর আগে অনেক গান সৃষ্টি করেছি ‘ফিডব্যাক’-এ থাকাকালীন; ‘…নিষিদ্ধ’-তেও তার অনেক প্রমাণ মেলে। পার্থক্য এইটুকুই যে ‘ওগো ভালোবাসা’ সেই অর্থে সম্পূর্ণাঙ্গ একটি জ্যাজ-রক ফিউশন অ্যালবাম, সংকলন বা ফিতা। আমার ধারণা, বাংলা সংগীত শ্রবণের ক্ষেত্রে শ্রোতাদের কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা বলেই বিবেচিত হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি এখানেই লিপিবদ্ধ করলাম। আশা করি আপনারা যা শ্রবণ করছেন তা ভালো লাগবে। তদুপরি শুভ শ্রবণ, হ্যাপি লিসেনিং!”

উল্লেখ্য, ‘ওগো ভালোবাসা…’ অ্যালবামে ধৃত গানসংখ্যা মোটমাট দশ। প্রত্যেকটা গানের গীতিকথা, গানের ধাঁচ, যন্ত্রানুষঙ্গ ও যন্ত্রী, কথাকার ও সুরকারের নামোল্লেখ ছাড়াও সংকলনের সঙ্গে যুক্ত সুপরিসর ইনলে-কার্ডে আরও পাঁচটা ভাগে বিন্যাস্ত খণ্ডগদ্য রয়েছে, যেখানে এই এফোর্টের বিস্তারিত জ্ঞাতব্য তথ্যাদি লিপিবদ্ধ। ক্রমান্বয়ে সেই চিলতে গদ্যগুলো হচ্ছে : ‘dHAKA সম্পর্কিত’, ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’, ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ’, এবং সবশেষে ব্যান্ডের লিডপার্সোনা মাকসুদুল হকের সংযোগঠিকানা ছাড়াও কন্সার্ট সংক্রান্ত যোগাযোগের জন্য ফোক্যাল্ পয়েন্ট হিশেবে রয়েছে সেকান্দার খোকার ঠিকানা। মাকসুদুল হকের টিপসহি/ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ফ্ল্যাপের দীর্ঘ ভ্রমণ সমাপ্ত হয়।

এইখানে মূল রচনা হিশেবে প্রোক্ত পঞ্চখণ্ড স্বল্পায়ত গদ্যকথিকার মধ্য থেকে ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’ অংশটিকে ‘অন জ্যাজ-রক ফিউশন’ শিরোনামার আন্ডারে একটু আগে আমরা পড়ে এসেছি। কিন্তু অন্যান্য অংশ চতুষ্টয়ের মধ্যে তিনটে এখন সংযোজনী হিশেবে এই মোহাফেজখানায় নিচে রেখে দিচ্ছি; সিরিয়্যালি এরা হচ্ছে : ‘dHAKA সম্পর্কিত’, ‘আমাদের সহশিল্পীরা’, এবং ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ’। উল্লেখ্য, গোটা অ্যালবাম উৎসর্গ করা হয়েছে ক্যান্সারে-অকালপ্রয়াত চিত্রশিল্পী দীপা হক (১৯৫৩-১৯৯৯) ও তাঁর স্মৃতির সম্মানে, যেমন মাকসুদের পূর্ববর্তী প্রোজেক্ট ‘নিষিদ্ধ…’ উৎসর্গিত হয়েছিল এসএম সুলতান ওর্ফে লাল মিয়ার নামে।

লক্ষণীয়, সংযোজিত অনুচ্ছেদগুলোতে যেসব শিল্পী-কলাকুশলীবৃন্দের নাম এসেছে, এরা ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপের সঙ্গে নেই অধিকাংশতই, কিংবা এক/আধজন ছাড়া বাকিদের সবাই ভিন্ন ভিন্ন পাটাতন থেকে ক্যারিয়ার করেছেন যার যার, ভালো করেছেন অনেকেই, কেউ কেউ লোকান্তরিতও হয়েছেন এরই মধ্যে — যেমন, ট্র্যাভিস জেঙ্কিন্স এবং ইমরান চৌধুরী মবিন প্রমুখ; প্রথমোক্তজন তথা ট্র্যাভিস জেঙ্কিন্স দলে স্যাক্সোফোনবাদক হিশেবে কন্ট্রিবিউট করে গেছেন আন্টিল হিজ ডেথ, আর ইমরান মবিন নব্বইয়ের ব্যান্ডসংগীতের শতেক অ্যালবামে এবং স্টেজপ্রোগ্র্যামে শব্দপ্রকৌশলী হিশেবে অবদান রেখেছেন প্রভূত। মবিনও রোড-অ্যাক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করেছেন অনেক বছর হলো। শুধু প্রকাশ থাকুক এইটুকুই যে, ব্যান্ডের স্বর্ণযুগে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এইধারা আদব চালু হয়েছিল অলমোস্ট সমস্ত ব্যান্ডঅ্যালবামেই, বিস্তারিত তথ্যাদি লিপিধৃত রইত বিশেষত সহশিল্পীদের। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ব্যাপারটাও সুন্দর ও সহজিয়া কালচারের সচলায়তন গড়ে তুলেছিল ওই মিউজিকোজ্জ্বল সময়টায়।

 

হাজার বছরের বাংলা ভালোবাসাবাসি

চিরন্তন বলি আমরা, শাশ্বত শব্দটাও বলিয়া থাকি হামেশা, হাজার বছর ধরিয়া যা-কিছু চলিয়া আসছে তা-কিছুরে একটু গ্লোরিফাই তো করিই আমরা, করি না? ভালোবাসাবাসি ঠিক তেমন একটা ব্যাপার, আবহমান। তারচেয়েও অধিক আবহমান ভালোবাসার গান। কবেকার সেই গুহাজামানা থেকে এই একটা বাক্য বহু কায়দায় ইনিয়েবিনিয়ে আওড়ে চলেছে মানুষ, পুরা বাক্যও বলতে হয় না, একশব্দে একটা বাক্য পূর্ণ হয়ে যায় — ভালোবাসি; মিথ্যে জেনেও, অবধারিত প্রবঞ্চনা জেনেও, এই এক ব্লান্ডার মানুষ আজও করে চলেছে। এর অন্যথা নাই। নিরুপায়। নিরবধি। ধরা খাইতে খাইতে এই এতদূর, এই হাজার বছরের হিরণ্য রেটোরিক, তবু ধরা-খাওয়া হাসিস্ফূর্ত অফুরন্ত, তবু ক্লান্তি নাই। জীবন যেমন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কয়েন ধার নিয়া বলি, মনোরম মনোটোনাস।

এই বহুব্যবহৃত কম্ম নিয়া গান বাঁধা দুনিয়ার সবচেয়ে সোজা কাম, অন্য বিবেচনায় ব্যাপক ডিফিকাল্ট। সোজা, কারণ চর্বিতচর্বণ হলেও শ্রোতার অভাব হয় না; ভালোবাসায় বিধ্বস্ত মানুষ পেরেশানির মুহূর্তে আগপিছ না-দেখিয়া যা সামনে পায় তাইতেই মাদুলি গলায় ঝোলায়। ডিফিকাল্ট, যদি কিছুটা বাঁকের রাস্তা টার্ন করানোর কোশেশ করে কেউ প্রণয়গীতিকায়। মাকসুদুল হক তেমন একটা কাজ করেছেন ১৯৯৯ সনে বের-হওয়া তার ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামে। একটু ভুল হলো অবশ্য, ‘ওগো ভালোবাসা’ মাকসুদের সোলো সংকলন নয়, এইটা ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ প্রকাশিত সংকলন, একটা টিমওয়ার্ক। তবে এই নিবন্ধে অ্যালবামের অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা নয়, ইনলে-কার্ড থেকে টেক্সট কালেক্ট ও প্রিজার্ভ করব শুধু। উনিশশ নিরানব্বইয়ের হাওয়ায় রিভিজিট কিছু হলেও হয়তো হতে পারে এইভাবে। এছাড়া বাকিটুকু অন্য কখনো, অন্য কোথাও, হয়তো অন্য কেউ করবেন। জরুর করবেন, নিশ্চয়।

হাজার বছরের বাংলা ভালোবাসাবাসির গানে এর আগে এবং এর পরেও অনেক পালক যুক্ত হয়েছে, সেসবের কিছুই যাবে না ফেলা, ম্যাক কোথায় কি এবং কতটুকু কন্ট্রিবিউট করেছেন এই অ্যালবাম দিয়া তা আলাপে আসে নাই একটা কারণে বোধহয়। ঠাকুরের প্রোমো-অ্যাজেন্টরা ভালোবাসার থোড়াই পরোয়া করে। ম্যাক একটা ঠাকুরস্যং গেয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ ২০১০’ শীর্ষনাম শিরোপরে হ্যাং করিয়ে সেই ১৯৯৯ সনে, অ্যাজেন্টরা খাপ্পা হয়ে তেলেসমাতি যা-কিছু ঘটিয়েছে তা আবার খুঁচিয়ে না-আনি এই আলাপে। যেইটা হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি, — ম্যাকের ক্যারিয়ারের কি হয়েছে না-হয়েছে তাতে বিচলিত না হইলাম আমরা, — বাংলাদেশের গানবাজনায় অ্যাট-লিস্ট তিনটা দুর্ধর্ষ লিরিক প্রত্যাশিত শ্রোতাগোচরে গেল না, আড়ালে থেকে গেল দুই-ডিকেড ধরে। অ্যানিওয়ে।

এই অ্যালবামে গান আছে দশটা। আমরা হাতে নিচ্ছি তিনটা। কারণ আছে এই সিঙ্গল-আউটের। শোনামাত্র বোঝা যাবে বলেই বিশ্বাস হয়। গানত্রয় হচ্ছে : গীতিকবিতা-৩ (ওগো ভালোবাসা), অভিশাপের পালা, গীতিকবিতা-৪ (হে প্রবঞ্চনা)। বাংলায় প্রেমের গানে যে-একপদের পুতুপুতু কোঁকানোফোঁপানো, ওইটা আবহমান বৈশিষ্ট্যই বলা যায় বাংলায় ভালোবাসাগানের, উল্লেখ-করা গানতিনটায় তা পাওয়া যায় না। বা, পাওয়া যায় ডিফ্রেন্টলি, পাওয়া যায় আলগ দার্ঢ্যসমেত। নতুনতা আছে এ-গানত্রয়ের লিরিকে, সুরে, সাংগীতিক স্ট্রাকচারে। রেন্ডিশনে তো অবশ্যই। কিন্তু এইসব তো এ-বদ্বীপের লোকের চোখে পড়ে না, গালমন্দ হয় না বাংলার শহুরে জেনারেশনের লিরিকসৃজনের ভবিষ্যৎ নিয়া, ঠাকুরের কাভার ভার্শন করতে গেলেন কেন উনি ইত্যাদি নিয়া বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা-সুরমা গাঙের পারে জটলা করে লোকে এবং আশ্চর্য সহিংস হয়ে ওঠে। এরা এবং এইগুলা আমাদের এই নিবন্ধে গৌণ। অতএব কাজে ফিরি, ইনলে-কার্ড আর্কাইভে রেখে যাই।

অ্যালবামের নাম ‘ওগো ভালোবাসা’, প্রকাশকাল ১৯৯৯, বাংলাদেশদুনিয়ায় বাংলা গানে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জ্যাজ-রক ফিউশন অ্যালবাম হিশেবে এইটা আজও তুলনারহিত ও অবিস্মরণীয়। বইয়ের ক্ষেত্রে যেমন ব্লার্ব, সাধারণ্যে ফ্ল্যাপ বলিয়া যার পরিচয়, যেখানে সেই বইটার একটা চটজলদি পরিচিতি পেয়ে যান গ্রন্থাগ্রহী সম্ভাব্য ক্রেতা বা পাঠক, ফিতার ক্যাসেটের যুগে বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতে একই কায়দায় ব্লার্ব/ফ্ল্যাপকথিকার সাক্ষাৎ পাই আমরা এবং লাভবান হই মিউজিক ও মিউজিশিয়্যান সম্পর্কিত খুঁটিনাটি কৌতূহল নিবৃত্তির উৎস নাগালে পেয়ে। জ্যাজ সম্পর্কে, রক সম্পর্কে, ফিউশন সম্পর্কে, কিংবা জ্যাজ-রক ফিউশন সম্পর্কে বেশকিছু কথাবার্তা ম্যাকের জবানিতে এই ইনলে-কার্ডে পেয়ে যাই আমরা, পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনো রচনা এইগুলা না, ক্যাসেটের খাপে সেই সুযোগ ছিল না বা দরকারও ছিল না প্রাথমিক পরিচয়কথিকায় পাণ্ডিত্য ফলানোর। দুনিয়ায় এই একটা জিনিশই ফলাইবার দরকার হয় না, পাণ্ডিত্য ফলাইতে গেলেই লাগে ঘাপলা। যা পেয়েছি, যেটুকুই, নিরানব্বইয়ের সেই সময়টায় আমরা অ্যাপেটাইট নিবৃত্ত করতে পেরেছি ইয়াদ হয়।

অ্যালবামে ধৃত গানসংখ্যা মোটমাট দশ। প্রত্যেকটা গানের গীতিকথা, গানের ধাঁচ, যন্ত্রানুষঙ্গ ও যন্ত্রী, কথাকার ও সুরকারের নামোল্লেখ ছাড়াও সংকলনের সঙ্গে যুক্ত সুপরিসর ইনলে-কার্ডে আরও পাঁচটা ভাগে বিন্যাস্ত খণ্ডগদ্য রয়েছে, যেখানে এই এফোর্টের বিস্তারিত জ্ঞাতব্য তথ্যাদি লিপিবদ্ধ। ক্রমান্বয়ে সেই চিলতে গদ্যাংশগুলো হচ্ছে : ‘dHAKA সম্পর্কিত’, ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’, ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ’, এবং সবশেষে ব্যান্ডের লিডপার্সোনা মাকসুদুল হকের সংযোগঠিকানা ছাড়াও কন্সার্ট সংক্রান্ত যোগাযোগের জন্য ফোক্যাল পয়েন্ট হিশেবে রয়েছে সেকান্দার খোকার ঠিকানা। মাকসুদুল হকের টিপসহি/ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ফ্ল্যাপের দীর্ঘ ভ্রমণ সমাপ্ত হয়।

এপিঠ-ওপিঠ জুড়ে সাকুল্যে দশটা গান। সেগুলোর শীর্ষক ও অন্যান্য তথ্যাদি নিচে রেখে একবার দেখে নিই :

এপিঠ ::
ভালোবাসা দিবস ’৯৯ ।। কথা ও সুর : মাকসুদুল হক ।। ধাঁচ : জ্যাজ-ফাঙ্ক রক ফিউশন
কাঁদবে ।। মূল সুর : যুবরাজ মাহমুদ ঠিকাদার ।। কথা : ঠিকাদার/মাকসুদ ।। ধাঁচ : জ্যাজ-রক ফিউশন
গীতিকবিতা-৩ (ওগো ভালোবাসা) ।। কথা ও সুর : মাকসুদুল হক ।। ধাঁচ : জ্যাজ-রক ফিউশন ইন্দো-ক্ল্যাসিক্যাল
অভিশাপের পালা ।। কথা ও সুর : মাকসুদুল হক ।। ধাঁচ : ব্লুজ-ফাঙ্ক ফিউশন
রবীন্দ্রনাথ ২০১০ (না চাহিলে যারে পাওয়া যায়) ।। কথা ও সুর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।। ধাঁচ : জ্যাজ-রক ফিউশন ইন্দো-ক্ল্যাসিক্যাল

ওপিঠ ::
রঙতামাশার এই ভুবনে ।। কথা ও সুর : সায়ান আহমেদ ।। ধাঁচ : মারেফতি-ফাঙ্ক ফিউশন
আমি তার কিছু পাবো কি না ।। কথা : অপু/মাকসুদ ।। ইংলিশ লিরিক্স : ম্যাক ।। সুর : নাসিরউদ্দিন আহমেদ অপু ।। ধাঁচ : বোস্যানোভা-স্যাম্বা ফাঙ্ক ফিউশন
গীতিকবিতা-৪ (হে প্রবঞ্চনা) ।। সুর : তন্ময় ।। কথা : মাকসুদুল হক ।। ধাঁচ : জ্যাজ-ফাঙ্ক ফিউশন
চিঠি ব্যক্তিগত (অতি জরুরি) ।। কথা : মাকসুদুল হক ।। সুর : বিদেশী গান ।। ধাঁচ : র‍্যেগে-ফাঙ্ক ফিউশন
পিঞ্জর ।। কথা ও সুর : প্রচলিত ।। ধাঁচ : মুর্শিদি জ্যাজ-রক থিয়েটার

গোটা কার্ডে/ক্যাসেটফ্ল্যাপে একাধারে চারটুকরো গদ্যকথিকা পাওয়া যায়। এইসব কথিকার ফাঁকে একেকটা গানের লিরিক বক্সট্রিটমেন্টে দেয়া আছে। এইখানে মূল রচনা হিশেবে প্রোক্ত চারখণ্ড স্বল্পায়ত গদ্যকথিকার মধ্য থেকে ‘Jazz-rock fusion সম্পর্কিত’ অংশটিকেই বিবেচনা করব, অংশটা আগের একটা ভাগায় ‘ম্যাক অন জ্যাজ-রক ফিউশন’ শীর্ষকের আওতায় এই নিবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গত, জ্যাজ-রক ফিউশন নিয়া ম্যাকের সেই গদ্যকথিকা আমরা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেব পূর্ববর্তী একটা পার্টে।

এর বাদবাকি অংশত্রয় এখন সংযোজনী হিশেবে এই মোহাফেজখানায় নিচে রেখে দিচ্ছি; সিরিয়্যালি এরা হচ্ছে : ‘dHAKA সম্পর্কিত’, ‘আমাদের সহশিল্পীরা’, এবং ‘কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ’। লক্ষণীয়, সতীর্থ সংগীতকার সহশিল্পীদের পরিচয়জ্ঞাপক কথাগুলোয় মাকসুদ প্রত্যেকের ট্যালেন্ট কীভাবে অ্যাপ্রিশিয়েইট করছেন। প্রত্যেকেরই কিছু গুণ, অনন্য বৈশিষ্ট্য, প্রত্যেকেরই ডিস্টিংক্ট ফিচার্স উপস্থাপনে ম্যাক কার্পণ্য করছেন না। ‘ঢাকা সম্পর্কিত’ শীর্ষক অংশে ম্যাক পরিচয় করায়ে দিচ্ছেন তাদেরেই যারা ব্যান্ডের রেগ্যুলার মেম্বার। এর বাইরেও রয়েছেন সহশিল্পীরা, যাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেইক হবে ‘আমাদের সহশিল্পীরা’ অংশে যেয়ে। এইখানে দেখব শুধু ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডমেম্বার্স যারা :

dHAKA সম্পর্কিত :: অক্টোবর ১৮, ১৯৯৭ dHAKA-র জন্ম। ফিডব্যাক থেকে আমি অব্যাহতি নেবার পর আমরা ক’জন বন্ধু মিলে এই ব্যান্ডটি গঠন করি।

ফিডব্যাক থেকে আমার সঙ্গে এসেছিল পুরনো বন্ধু খোকা। যোগ্য এই Bassবাদক বাংলাদেশের Bandসংগীত আন্দোলনে শরিক হয়ে বিগত প্রায় ২৬ বছর যাবৎ একনিষ্ঠতার সাথে বাজিয়ে আসছেন ও তার নিজস্ব অবদান রেখেছেন। খোকা dHAKA ব্যান্ডে বাজানো ছাড়াও সদস্য-শিক্ষানবিশদেরকে জ্যাজের তালিম দিয়ে থাকেন।

মন2 dHAKA ব্যান্ডের গোলরক্ষক অর্থাৎ ছন্দের ধারক বা ড্রামার। প্রায় বারো বছর ধরে বাংলাদেশ ছাড়াও বিদেশে অনেক ক্ষ্যাপ বা gig মেরে বেড়িয়েছেন অনেক নামীদামী শিল্পীর সঙ্গে। dHAKA-ই তার জীবনের প্রথম ব্যান্ড। অত্যন্ত বিনয়ী, স্বল্পভাষী এবং রসিক এই শিল্পীর সম্পৃক্ততা মূলত রক ঘরানার ড্রামিঙের সঙ্গে হলেও dHAKA ব্যান্ডে তিনি জ্যাজ ড্রামার হয়ে ওঠার অপরিসীম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তন্ময় অসাধারণ মেধাবী ও সুস্থির গতিসম্পন্ন এবং হাড়ভাঙা শ্রম দিতে অভ্যস্ত আমাদের এই কৃতী কিবোর্ডবাদক। শৈশবে হার্মোনিয়্যম্ হাতাতে-হাতাতেই আপনাআপনি তার দখল চলে আসে কিবোর্ডে। তিনি যে সুরবিন্যাসেও দক্ষ, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘হে প্রবঞ্চনা’ গানটা।

আমাদের পার্কাশনবাদক শাহেদ। প্রায় এক দশক জড়িত ছিলেন মরহুম ফিরোজ সাঁইয়ের সঙ্গে। বাজনার অভিজ্ঞতাতে তিনি সম্পূর্ণ ইস্টার্ন হলেও dHAKA-য় যোগ দেওয়ার পর আমাদের ব্যান্ডের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়্যান্ জ্যাজ পার্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।

পিকলু আমাদের ব্যান্ডের সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ সদস্য। বনানীর নর্থ-সাউথ য়্যুনিভার্সিটির সমাপনী বর্ষের ছাত্র। পাশ্চাত্যীয় রক ও হেভি-মেটাল ঘরানার গিটারিস্ট ও ‘দ্য জলি রজার্স’-এর মতো দুর্ধর্ষ ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মাঝখানে তিনি উচ্চতর শিক্ষা নেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখানে মিশিগ্যান টেক্নোলোজিক্যাল য়্যুনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাইক আইরিশের কাছে জ্যাজের উপর তালিম নেন। বর্তমানে তিনি dHAKA ব্যান্ডের জ্যাজ ও রক উভয় স্বতন্ত্র ধারাতেই কৃতী বাদিয়ের ভূমিকা রাখছেন।

সেলিম, রুবাইয়াত ও নীলিম — এই তিন গিটারিস্ট আমাদের সঙ্গে অনেক শ্রম এবং মূল্যবান সময় দিয়েছেন। সেলিম আমাদের সঙ্গে আর পথ চলার ইচ্ছা পোষণ করলেন না, রুবাইয়াতের সঙ্গে পথ চলতে ব্যর্থ হলাম আমরা এবং নীলিম গিটারবাজনায় উচ্চতর তালিম নেওয়ার জন্য চলে যান লন্ডনের গিটার ইন্সটিট্যুট অফ টেক্নোলোজি (GIT)-তে। এই ত্রয়ীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।

আমি মাকসুদ পেশায় ইংরেজি ও বাংলা ভাষার গায়ক, কবি, গীতিকার ও ফ্রিল্যান্স প্রাবন্ধিক (নিয়মিত, ‘এই নিষিদ্ধ সময়ে’, সাপ্তাহিক ‘চলতিপত্র’), dHAKA ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, দলনেতা, প্রধান কণ্ঠশিল্পী ছাড়াও এই প্রথমবারের মতো সংগীতপরিচালক এবং শিল্পনির্দেশক হিশেবে আত্মপ্রকাশ করলাম। ব্যান্ডসংগীতে আমার অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে ২৬ বছরেরও বেশি। এই অ্যালবাম অর্থাৎ সংকলন বা ফিতার পোস্টার, ক্যালেন্ডার ও প্রচ্ছদের মলাট অর্থাৎ কাভার ও ইনলে-কার্ড ইত্যাদির সম্পূর্ণ ডিজাইন আমারই করা। ডিজাইনের ব্যাপারে ‘সমলয়’-এর হুমায়ূনের সহযোগিতা আমার এই চেষ্টা হয়তো-বা সার্থক (?) করেছে।”

ম্যাকপ্রণীত গদ্যকথিকাগুলো পড়াশেষে তেমন দরকার নাই টীকাভাষ্য জুড়ে দেবার, জিনিশগুলো যথেষ্ট সেল্ফ-এক্সপ্ল্যান্যাটোরি, তবু আমরা এই নিবন্ধে বেশকিছু যোজনা প্যারাগ্র্যাফ রাখছি ভিশ্যুয়্যালাইজেশনের সুবিধায় এবং আশপাশের কিছু সুতো ধরিয়ে দেবার অছিলায়। এখানে ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামের ইনলে-কার্ডে ম্যাকপ্রণীত অন্যান্য গদ্যকথিকাগুলো পরপর রাখা :

আমাদের সহশিল্পীরা :: যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জ্যাজ-নগরী ক্যান্সাস সিটির বাসিন্দা ট্র্যাভিস জেঙ্কিন্স। প্রায় ৩৮ বছর থেকে তার নিজের দেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে বহু গুণী ও নামীদামী শিল্পীদের সাথে বাজিয়েছেন এবং রেকর্ড করেছেন। বারিধারার ‘ঢাকা জ্যাজ এন্সেম্বল’ নামের বিদেশী নাগরিকদের ব্যান্ডে তিনি বাজাতেন। সংগীতশিক্ষকতাই বাংলাদেশে তার মূল পেশা। তিনি টেনোর, সোপ্র্যানো স্যাক্সোফোন, সিল্ভার ফ্ল্যুট ইত্যাদি যন্ত্র বাজাচ্ছেন। এদেশে আসার আগে তিনি পাপুয়া নিয়্যু গিনিতে অবস্থান করছিলেন। খ্যাতির চাইতে সংগীতে জীবনের ছাপ রাখার ব্যাপারে যারা বেশি আগ্রহী ট্র্যাভিস তাদের দলের। তাঁর মতো গুণী শিল্পীর সঙ্গে অনেক আগেই পরিচিত হওয়া উচিত ছিল আমাদের।

দিল্লীনিবাসী উর্মী ঢাকা য়্যুনিভার্সিটিতে অধ্যয়নকালীন আমার সহপাঠী। শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রায় দু-যুগেরও বেশি সময় থেকে। বাংলাদেশে একাধিক বরেণ্য ওস্তাদের কাছে তালিম নেয়ার পর ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্রথমে লক্ষ্মৌয়ের ভাতখান্ড কলেজ অফ হিন্দুস্তানি মিউজিক-এ এবং পরে দিল্লীর শ্রী রাম ভারতীয় কলাকেন্দ্র থেকে তাঁর সংগীতশিক্ষা সমাপন করেন। বর্তমানে মুম্বাইয়ের বিশ্ববরেণ্য শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী শ্রীমতী শোভা গুর্তু-র কাছে খেয়ালের কঠোর তালিম নিচ্ছেন তিনি।

রমা ধানমণ্ডির ইন্টার্ন্যাশন্যাল মিউজিক স্কুলের ছাত্রী। সম্পূর্ণ পশ্চিমা গায়কীর উপর তার তালিম চলছে। তার অবদান আমাদের অনেক সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করেছে।

ডালিয়া উঠতি গায়িকা। বেশকিছু ফিতা তার বের হয়েছে। আমাদের সঙ্গে সহকণ্ঠ হিশেবে কাজ করেছেন একনিষ্ঠা নিয়ে।

মেহরীন অনেক গুণে গুণান্বিতা। একাধারে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষার গায়িকা, উপস্থাপিকা এবং সফল মডেল। গানের প্রতি তার আগ্রহ ও নিষ্ঠা আমাদের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেছে।

নীতিরঞ্জন তবলার উপরে ভারতের বরোদা এমএস য়্যুনিভার্সিটির সম্মান ও স্নাতকোত্তর উভয় পর্যায়েই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট উইথ ডিস্টিঙ্কশন নিয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ গোল্ড মেড্যাল পাওয়ার পর এখন ভিনদেশে পিএইচডি অর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশের তবলাজগতে বেশ বড় ধরনের হৈচৈ ফেলেছেন। dHAKA ব্যান্ড এবং জ্যাজ ও ফিউশন সংগীতে শিক্ষানবিশ।

স্কটল্যান্ডের অধিবাসী লিন্ডসে বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশে আছেন। ‘পোচড্ ব্যুগি’ নামের বারিধারাস্থ বিদেশী নাগরিকদের একটি ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী তিনি। আমাদের সঙ্গে একটি গানের বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় কণ্ঠ দিয়েছেন।

বরোদা এমএস য়্যুনিভার্সিটির আরেক কৃতী ছাত্রী রূপশী যিনি ভায়োলিনে উচ্চতর তালিম নিচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে একটি গানে সঙ্গ দিয়েছেন। ভায়োলিনবাদক হিশেবে ইতোমধ্যে এই উপমহাদেশে বেশ নামডাক হয়েছে তার।”

অ্যালবামটা বাইর হয়েছে ‘সিডি সাউন্ড’ থেকে। মেমোরি রিকালেক্ট করে দেখতে পাচ্ছি, ‘সিডি সাউন্ড’ তখনকার ঢাকাকেন্দ্রী অডিয়োজগতে একদম নতুন। বনেদওয়ালা কোম্প্যানিগুলোর মধ্যে সারগাম, সাউন্ডটেক, সংগীতা ইত্যাদি ছিল তখন টপমোস্ট; ম্যাকের ও তার পূর্ববর্তী ব্যান্ড ফিডব্যাকের অ্যালবামগুলো সেসব খান্দানি লেবেল থেকে বেরোলেও এইটা বাইর হচ্ছে কম্পারেটিভলি অখ্যাত নয়া লেবেল থেকে। এইটা তাৎপর্যবহ। পরে এই আলাপে যেতে হতে পারে, এই নিবন্ধ-আওতার বাইরে, এখন শুধু তথ্যটুকু টুকে রেখে দেবো।

প্রচ্ছদে ম্যাকের মুখচ্ছবি শুধু। লম্বাচুলওয়ালা, প্রাণদীপ্ত, রৌদ্রকরোজ্জ্বল ম্যাক। ডানদিকে ফ্ল্যাপ স্প্রেড করে গেলে একহাত লম্বা আস্তিনে বাকি শিল্পী ও কলাকার-কুশলীদের সহাস্য স্থিরচিত্রগুলো। গোটা ব্যান্ডের মেম্বার্স ম্যাক সহ ছয়জন; বাকি পাঁচ একে একে পিকলু, তন্ময়, খোকা, মনটু ও শাহেদ। একই পিঠে বিলো-অ্যালাইনমেন্টে ট্র্যাভিস, লিন্ডসে, মেহরীন, ঊর্মি, ডালিয়া, রমা, রূপশী ও নীতিরঞ্জন। প্রচ্ছদপিঠের পেইজ টার্ন করলেই পৃষ্ঠাজোড়া পোকাবুনটের একটানা ঠাসা টেক্সটস, প্রায় ম্যাগ্নিফায়িং কাচ লাগবে পড়তে যেয়ে এমন ঘনসন্নিবদ্ধ হরফের অরণ্য। প্রচ্ছদে ম্যাকের মুখচ্ছবির উপরে এবং নিচে অবশ্য রয়েছে ব্যান্ডনাম ও অ্যালবামনাম; রয়েছে ‘জ্যাজ-রক ফিউশন ফ্রম বাংলাদেশ’ এবং ‘সাউন্ড স্যাম্পল # ১’ বাক্যদ্বয় লেখা। সাউন্ডস্যাম্পল-১ মানে কি সিডিসাউন্ডের পয়লা অ্যালবামনিবেদন? যা-হোক, সিডিসাউন্ডের ঠিকানা দেয়া আছে : আল-সুলতান কমপ্লেক্স, ৮৪ নিউ সার্কুলার রোড, ঢাকা ১২১৭। ও হ্যাঁ, সিডিসাউন্ডের ক্যাসেটগাত্রে লেখা দেখি ‘মিউজিক হোয়ারেভার য়্যু গ্য’ স্লোগ্যানটি।

ভিতরপৃষ্ঠায় একদম শেষে যেয়ে ব্যান্ডসংশ্লিষ্ট দুইটা অ্যাড্রেস দেয়া আছে যোগাযোগের জন্যে, একটা ম্যাকের এবং অন্যটা সেকান্দার খোকার। প্রথমটা : মাকসুদ ও ঢাকা, পল্লবী ৮-১/এ, মীরপুর, ঢাকা ১২২১, বাংলাদেশ। দ্বিতীয় : কন্সার্ট সংক্রান্ত যোগাযোগ / খোকা, ১৯৩ নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা। আরও দেয়া আছে দূরালাপনি, ইমেইল ও ওয়েবঅ্যাড্রেস। সর্বশেষে ম্যাকের টিপসই। থাম্বপ্রিন্ট।

কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ :: সর্বপ্রথম বিনীত কৃতজ্ঞতা আমাদের সকলেরই সর্বশক্তিমান, ক্ষমাশীল ও দয়াবান সৃষ্টিকর্তার কাছে যিনি আমাদেরকে অনেক ধৈর্য ও পরীক্ষার মাঝ দিয়ে এই নতুন ব্যান্ড নিয়ে এই অ্যালবাম/সংকলন বা ফিতার কাজ শেষ করবার তওফিক দান করেছেন। ধন্যবাদ জানাতে চাই খোকার সম্পূর্ণ পরিবার ছাড়াও তার স্ত্রী শামীমা আরজুকে তার অনেক সাহায্যের জন্য। ধন্যবাদ এলিফ্যান্ট রোডে আমাদের প্র্যাক্টিস প্যাড-সংলগ্ন সকল বাসিন্দাদের যারা আমাদের সময়-অসময়ের উচ্চশব্দের মহড়া ও আমাদেরকে সহ্য করেছেন। ধন্যবাদ পল্লবীতে আমার মহল্লার বাসিন্দাদের যারা সময়-অসময়ে আমার উচ্চ ভল্যুমে আমার টেইপ বাজনা সহ্য করেছেন। কৃতজ্ঞতা কবি ফরহাদ মজহার, ফরিদা আপা ও UBINIG-কে, উনাদের অতি মূল্যবান কিবোর্ডটি আমাদেরকে ব্যবহার করতে দেবার জন্য; Miles-এর হামিন আহমেদ টোকনকে তার Crate গিটার অ্যাম্পলিফায়ার ব্যবহার করতে দেবার জন্য, Renaissance-এর ফয়সল সিদ্দিকী বগী ও ইমরানকে Ovation acoustic guitarpercussion bag  ব্যবহার করতে দেবার জন্য। কৃতজ্ঞতা সাউন্ডগার্ডেন স্টুডিয়ো-র প্রকৌশলী ইমরান আহমেদ চৌধুরী মবিনকে তার শব্দ-সংমিশ্রণের জন্য এবং তার সহযোগীদ্বয় চারু ও দূরেকে শব্দধারণের জন্য। একই স্টুডিয়োর মনোরঞ্জনদা, পরিমল, টিংকু ও মোহনকে রেকর্ডিং চলাকালীন অনেক ঝড়ঝাপ্টা হাসিমুখে সহ্য করার জন্য। কৃতজ্ঞতা পুরনো দোস্তো জানে আলমকে তার উপদেশের জন্য, ‘সিডি সাউন্ড’-এর আরিফ ভাইকে, আমার সংগীত বিশ্বাস করার জন্য এবং ধন্যবাদ অগণিত শ্রোতা ও গুণগ্রাহীদের যারা আমার জীবন পূর্ণ ও ধন্য করেছেন তাদের অনেক ভালোবাসার অভিব্যক্তির মাধ্যমে। ইন্টার্নেটযুগের বন্ধু (যার সাথে এখনও সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘য়্যুনিভার্সিটি অফ ন্যুইয়র্ক অ্যাট বাফালো’-তে কম্প্যুটার সায়েন্সে অধ্যয়নরত আমাদের ওয়েবসাইটম্যানেজার জয় গৌতমকে ধন্যবাদ, সে তার মূল্যবান সময় দিয়েছে আমাদের ইন্টার্নেটযোগ্য একটি ওয়েবসাইট সৃষ্টি করে দিতে। ধন্যবাদ আমাদের লাইভ সাউন্ডকোম্প্যানি সাউন্ডস্টর্ম ও শিহাবকে, SAS-এর সোহেলকে, এবং ‘সাউন্ড মেশিন’-এর মং তিথি ছাড়াও আমাদের roadie আব্দুর রহমানকে। ধন্যবাদ আমাদের ভিডিয়ো মেইকার অর্ণব ব্যানার্জি রিংগো, রূপশা ও বায়োস্কোপ প্রোডাকশন্স-কে, নিগ্যাটিভ প্রোডাকশন্স-এর পান্না খোকন ও আপিককে, ভিয়্যুমিডিয়া-র জিয়াউদ্দিন রিপন ও কাঞ্চনকে, কম্প্যুটার গ্র্যাফিক্স ও ডিজাইনের জন্য হুমায়ূন ও সমলয় এবং ধন্যবাদ চিত্রগ্রাহক মন্টি ও ট্র্যাভিসকে।”

এইখানে একটু লক্ষণীয়, সংযোজিত অনুচ্ছেদগুলোতে যেসব শিল্পী-কলাকুশলীবৃন্দের নাম এসেছে, এরা ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপের সঙ্গে নেই অধিকাংশতই, কিংবা এক/আধজন ছাড়া বাকিদের সবাই ভিন্ন ভিন্ন পাটাতন থেকে ক্যারিয়ার করেছেন যার যার, ভালো করেছেন অনেকেই, কেউ কেউ লোকান্তরিতও হয়েছেন এরই মধ্যে — যেমন, ট্র্যাভিস্ জেঙ্কিন্স এবং ইমরান চৌধুরী মবিন প্রমুখ; প্রথমোক্তজন তথা ট্র্যাভিস্ জেঙ্কিন্স দলে স্যাক্সোফোনবাদক হিশেবে কন্ট্রিবিউট করে গেছেন আন্টিল্ হিজ্ ডেথ, আর ইমরান মবিন নব্বইয়ের ব্যান্ডসংগীতের শতেক অ্যালবামে এবং স্টেজপ্রোগ্রামে শব্দপ্রকৌশলী হিশেবে অবদান রেখেছেন প্রভূত। মবিনও রোড-অ্যাক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করেছেন অনেক বছর হলো। শুধু প্রকাশ থাকুক এইটুকুই যে, ব্যান্ডের স্বর্ণযুগে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এইধারা আদব চালু হয়েছিল অলমোস্ট সমস্ত ব্যান্ডঅ্যালবামেই, বিস্তারিত তথ্যাদি লিপিধৃত রইত বিশেষত সহশিল্পীদের। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ব্যাপারটাও সুন্দর ও সহজিয়া কালচারের সচলায়তন গড়ে তুলেছিল ওই মিউজিকোজ্জ্বল সময়টায়।

 

ফিডব্যাক, ম্যাক এবং যন্ত্রানুষঙ্গে অ্যাম্বিয়্যান্স রচনায় ব্যান্ডসংগীতের নতুনতা

ইন্ট্রেস্টিং ও খানিকটা অ্যাস্টোনিশিং মনে হতে পারে শুনে যে বাদ্যযন্ত্রযোজনার ক্ষেত্রে বাংলা গানে ব্যান্ডমিউজিকের কিছু অভিনতুন অবদান আছে। এই কথাটা খালি গিটার্স-ড্রামস-কিবোর্ডস ব্যবহারের জন্যই বলা হচ্ছে তা না, যদিও কিবোর্ডস-গিটার্স ইত্যাদির ব্যবহার আগে থেকে বেঙ্গলে থাকলেও বাদ্যযন্ত্র হিশেবে এগুলো সরোদ-সেতারের মতো কৌলীন্য লভেছে ব্যান্ডযুগে, এর আগে প্লেব্যাকে একেবারেই ইনসিগ্নিফিক্যান্ট একটা ব্যবহার ছিল লক্ষ করব। নব্বইয়ে এসে বাংলাদেশের ব্যান্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক সিঙ্গারস্যংরাইটারের সুবাদে ওয়েস্টার্ন ইন্সট্রুমেন্টসের কদর বাড়ল। খুবই সিগ্নেচারের মতো কোনো কোনো শিল্পীর কাজে একেকটা মাস্ট বাদ্যযন্ত্র। অঞ্জন দত্ত অন্তত একটা-হলেও শ্রবণাকর্ষক অনন্য যন্ত্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন, কবীর সুমন যেমন একচ্ছত্রভাবে গিটার ও হার্মোনিকার সৃজনদীপ্ত ও বহুল ব্যবহার ফলিয়ে তুলেছেন বাংলা গানে, যে-ব্যাপারটা সুমনের আইকোনিক অরিয়েন্টেশনমার্ক হয়ে উঠেছে এবং সুমনকে এক-ঝটকায় ভিড়ের বাইরে এনেছে একেবারে গোড়া থেকে, স্যাক্সোফোন যন্ত্রটাও অঞ্জনকে তেমনিভাবে চেনায়ে দ্যায় এক-লহমায়। স্যাক্সোফোন যন্ত্রটা বাংলায় মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট হিশেবে প্লেব্যাকে কমিক ইউজ হলেও মূলধারা গানবাজনায় এর ব্যবহার বলতে গেলে একেবারেই ছিল না। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে, যেমন বিবাহানুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলা বা মহাসমারোহে-প্রেক্ষাগৃহে-মুক্তিপ্রাপ্ত-নাচেগানে-ভরপুর বাংলা ছায়াছবির রিকশাযোগে প্রোমোশন্যাল লিফলেট বিতরণ প্রভৃতি কাজে এবং যাত্রাপ্যান্ডেলে, ট্র্যাম্পেট-ক্ল্যারিনেটের সঙ্গে স্যাক্সোফোন যন্ত্রটাও কখনো কর্ণগোচর হতো বটে। সেইটেকে প্যারোডির বেশি কিছু হইতে তেমন উদ্যোগী দেখা যায়নি, দেখা যাবার কথাও না। অঞ্জনই প্রায় প্রথম বলা যায় বাংলা গানে স্যাক্সোফোন বাদ্যযন্ত্রটাকে কৌলিন্যের আসন করে দেন। অসংখ্য গানে, ‘স্যামসন’ থেকে শুরু করে একাদিক্রমে ‘ম্যারিয়্যান’ কিংবা ‘জেরেমির বেহালা’ প্রভৃতি ইম্প্রোভাইজেশনে, স্যাক্সোফোন দুর্দান্তভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাবে। একটা আনকা বাদ্যযন্ত্র বাংলা গানে সুচারু ব্যবহারের পথিকৃতের দাবিদার অঞ্জন দত্ত। সম্ভবত অঞ্জনই বাংলা গানে এ-পর্যন্ত প্রথম ও একমেবাদ্বিতীয়ম স্যাক্সোফোনপ্যাশনেইট সিঙ্গার। স্যাক্সোফোনের এমন বুদ্ধিসৃজিত ব্যবহার/প্রয়োগ বাংলা গানে অক্ষয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। যদিও তথ্যসুতো হিশেবে হলেও উল্লেখ কর্তব্য হবে যে স্যাক্সোফোন ইন্সট্রুমেন্টের অসাধারণ সুপ্রয়োগ অঞ্জনেরও আগে থেকে বা কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের একটা ব্যান্ডের গায়ন-বাদনে দেখা যাবে, সেই ব্যান্ডের নাম ফিডব্যাক,  সেই ব্যান্ডের তৎকালীন লিড্-ভোক্যালের নাম মাকসুদুল হক। স্মর্তব্য ‘গীতিকবিতা-২’ তথা ‘ধন্যবাদ হে ভালোবাসা’ গানটা, মাকসুদেরই লেখা ও গাওয়া, তাছাড়া আরও কতক গানে স্যাক্সোফোন প্রযুক্ত হয়েছে দুর্দান্ত সুন্দরভাবে। এরপর মাকসুদ যখন ফিডব্যাক থেকে বেরিয়ে নিজের কায়দায় ব্যান্ড-সোলো সংমিশ্রণে ক্যারিয়ার রিশেপ-আপ করবেন, তখন লক্ষ করা যাবে স্যাক্সোফোনপ্রীতির কারণে ট্র্যাভিস জেঙ্কিন্স নামের একজন বিদেশী বাদককে দলে ভেড়াতে একদম পুরোদস্তুর ব্যান্ডসদস্য হিশেবে — এক্সপায়ার করেছেন অনেকদিন হয় ইনি — যিনি ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ স্যাক্সোফোনপ্লেয়ার। কাজেই ফিডব্যাককালীন এবং পরবর্তীকালে ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডে স্যাক্সোফোনপ্রয়োগ বাংলা গানের স্মৃতিনিষ্ঠ শ্রোতা ইয়াদ করে উঠবেন নিশ্চয়।

 

কাল্পনিক চরিত্রমুখর জীবনকাহিনি

বাংলা গানে ব্যক্তিনামরূপ ধরে ক্যারেক্টার দাঁড় করানো, কথাসাহিত্যে যেমনটা হামেশা করা হয়ে থাকে, খুব নতুন না-হলেও পুরনোও বলা যাবে না। বাংলা গানে অঙ্কিত বলিষ্ঠ চরিত্রগুলো নিয়া আলাদা অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। এই নিবন্ধের অভিমুখ ওইদিকে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না আপাতত। পুরনো নয়, যে-অর্থে ইংরেজি কান্ট্রিমিউজিকে এইটা আদি থেকেই চলে-আসা ট্রেন্ড হিশেবে দেখতে পাওয়া যায় সে-অর্থে তো নয়ই, বাংলা গানে এইটে ট্রেন্ড হিশেবে নতুনই বলতে হবে। যদিও রবীন্দ্রনাথের গানে এক-দুইটা উদাহরণ লক্ষ করব, রবিগানে এ-ধারার উজ্জ্বলতর উদাহরণ সম্ভবত একটিই : ‘কৃষ্ণকলি’; জুড়ি মেলানো মুশকিল ওই-সময়ের গানে এই কৃষ্ণকলির। নজরুলের হামদ্-নাত্ পর্যায়িক লিরিকে এবং শ্যামাসংগীতে এসেছে মিথিক্যাল ক্যারেক্টার বেশকিছু। চল্লিশের পর স্বদেশিয়ানার অভিঘাতে এক-দুইটা গানে ‘ক্ষুদিরাম’ প্রমুখ রিয়্যাল-লাইফ হিরোদের নিয়া গান বাঁধা হয় দেখতে পাই। গণসংগীতে ব্যক্তিনামপদ লতিয়ে গান রচা হয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। ওই-সময় ইংরেজি গানের ক্যারেক্টারগুলো বাংলা গানে বেশ সুচারুভাবে অভিযোজিত হয়েছে, যেমন — জন হেনরি, বোকা বুড়ো প্রভৃতি। সলিল চৌধুরীর কয়েকটা ক্যারেক্টারচিত্রণ গোচরীভূত হয়। মান্না-ভূপেনেও দুইয়েকটা আছে। এর পরবর্তীকালিক নতুন দিনের বাংলা গানে এই ধারাটা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য পুষ্টি পেতে শুরু করে। বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে গোড়া থেকেই এর নজির পাওয়া যায়। আজম খানের উত্থানপর্বেই আছে এইটা। ‘সালেকা-মালেকা’, ‘আলাল-দুলাল’, বা বিরতিকালের পরে ফিরে এসে ‘অনামিকা’ আজম খানের এ-ধারার কাজে ঔজ্জ্বল্যের চিহ্নবাহী। ফিডব্যাকের ‘মৌসুমী’, হ্যাপি আখন্দ স্মরণে শ্রদ্ধাগান ‘পালকি-১’ এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য। এমনকি এলআরবি-রও ‘ঊর্মিলা চৌধুরী’ শিরোনামের গান সহ ‘মাধবী’, ‘মেঘনাদ মজুমদার’ ইত্যাদিও উদাহরণযোগ্য। ‘নগরবাউল’/‘ফিলিংস’ তথা জেমসেরও রয়েছে এ-ধারার ‘মান্নান মিয়া’, ‘হুমায়রা’, ‘সুস্মিতা’, ‘নাগরআলি কুঙ্কুম’ প্রভৃতি। এছাড়া প্রায় সমস্ত ব্যান্ডেরই রয়েছে এ-ধারার গানমালা। কবীর সুমন অন্য ধাঁচে ক্যারেক্টার অ্যানিমেইট করেছেন, অত্যন্ত বলিষ্ঠ ক্যারেক্টারাইজেশন, যদিও কবীরের ক্যারেক্টারগুলো ব্যক্তিবিশেষের বাইরে বেরিয়ে সমষ্টিই হয়ে উঠেছে সব-সময়। যেমন কবীর সুমন যখন ‘অর্চনাদের পাশেই যেন আয়েশারা থাকতে পারে’ বলেন, তখন অর্চনা বা আয়েশা যতটা-না ব্যক্তি তারচেয়ে বেশি কওমের দ্যোতক হয়ে ওঠে। কিন্তু কবীর সুমন অনন্য আরেকটা জায়গায়, সেইটে এ-ই যে, তার মতো এত ট্রিবিউট-স্যং দুনিয়ায় দ্বিতীয় কেউ বেঁধেছেন বলা যাবে না আরও বহুকাল। সুমন বাংলার প্রায় সমস্ত লোকজ-লোকান্তরিত কবি ও রাজনীতিবিদ, স্বদেশের ও বহির্দেশের কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গ, সামাজিক অন্যায় ও নিগ্রহ-দুর্নীতির ভিক্টিম ব্যক্তিসাধারণ নিয়ে একের-পর-এক অনবদ্য সব গান হাজির করেছেন; সেসব গানে ইম্যাজিনেশন নয়, ফ্যাক্ট প্রাধান্য পেয়েছে ও মান্যতা আদায় করে নিয়েছে; একেকটা সামাজিক-রাজনৈতিক সন্দর্ভ হয়ে উঠেছে সেই গানগুলো, উপস্থাপিত ব্যক্তিরা বাহন হয়েছেন সুমনের তথা আমাদের বক্তব্য প্রকাশের। অঞ্জন দত্ত এ-ধারার গান রচনায় ভিন্নতা আনয়নের দাবিদার এখানে এবং এ-মর্মে যে, তার গানে ক্যারেক্টারগুলো যেন কল্পনা আর বাস্তবতার মিলমিশ নিয়ে একদম ঘরোয়া, আদর-অনাদর-প্রেম-অপ্রেম-স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ-হতাশ্বাস সবকিছু নিয়েই রক্তমাংশের অতিসাধারণ মানুষের চেহারাই ফুটিয়ে তোলে শেষমেশ, ছোটগল্পের সপ্রাণ চরিত্রগুলোর মতো। নচিকেতাও সমসাময়িক গানে এই কাজটা করেছেন সুচারু। ‘শতাব্দী’, ‘রাজর্ষি’, ‘নীলাঞ্জনা’, ‘অনির্বাণ’ প্রভৃতি নচিকেতা চক্রবর্তীর কাজ হিশেবে উল্লেখাবশ্যক অনবদ্য। অঞ্জনের গানে দেখা-পাওয়া বেশকিছু চরিত্রের নাম উল্লেখ করা যাক : দেবলীনা, মালা, স্যামসন, জেরেমি, মিস্টার হল্, মিসেস মুখার্জি, কাঞ্চন, আলীবাবা, রাজা রায়, হরিপদ, রমা, ম্যারিয়্যান, রঞ্জনা প্রভৃতি একেকটা নাম উপজীব্য করে একেকটা গান, একেকটা আলাদা আখ্যান।

 

গদ্যকাব্যিক বাংলা গান ও ব্যান্ডবিতান

বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে সবকিছু মিলিয়েজুলিয়ে এমন কতিপয় ইউনিক ব্যাপার সংঘটিত হয়েছে, যেগুলো অতুলনীয় সো-ফার এবং উল্লেখের যোগ্যতা রাখে; যেমন অভ্যস্ত গীতসৃজনের বাইরে যেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন সিন্ট্যাক্সিং, সম্বোধন ও বিশেষণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অজস্র বোকাহাবা আচরণের পরেও উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের কাজে হৃদি-ঝিল্কানো অনন্য রচনাদৃষ্টান্ত, সর্বোপরি বাংলাদেশের টোট্যাল ব্যান্ডগানে আবহমান বাংলা গানের অন্ত্যমিলাভ্যাসের বাইরে বেরিয়ে এসে অমিলান্ত ও অমিত্রাক্ষর গদ্যস্পন্দের ব্যবহারজনিত স্পর্ধা এবং সাফল্য, — এই সমস্তকিছু নিয়া আলাপ তোলা দরকার, কুর্নিশ করা দরকার আমাদের পথিকৃৎ ব্যান্ডমিউজিশিয়ানদেরে। এমনও দেখা যাবে যে, এমনকি ইন্ডিয়াবাংলার কবীর সুমনও অন্ত্যমিলাভ্যাস থেকে একটাবারের জন্যও বেরিয়ে আসতে পারেন নাই, তিনি নিশ্চয় ভাবতেও পারেন নাই যে হাজার বছরের গীতরচনার অন্ত্যমিলাত্মক টেন্ডেন্সি থেকে বেরিয়েও সম্ভব বাংলা গানসৃজন! যদিও কবীর সুমন শুরুর আগেই বাংলাদেশের ব্যান্ডগানের ব্রেইকাউট মাইলস্টোনগুলো ময়দানে হাজির হয়ে গিয়েছে। এইসব কথাবার্তা শুরু হলে পরে দেখা যাবে এখানকার ব্যান্ডগান অনেকানেক দুষ্কৃতির পরেও অনেককিছুতে ট্রেন্ডসেটারও ছিল। পশ্চিমবঙ্গের ব্যক্তিশিল্পী কয়েকজন আমাদের কাছে নমস্য হলেও ব্যান্ড হিশেবে এক মহীনের ঘোড়াগুলি  ছাড়া আর-একটাও ধর্তব্য নয়। চন্দ্রবিন্দু  নিঃসন্দেহে মেধাদীপ্ত ব্যান্ড, কিন্তু ওই অন্ত্যমিল আর ছড়াগানের মাধ্যমে স্যাটায়ার ছাড়া মালসামান কই যা দিয়া তারে আলাদা অবলোকনের কেন্দ্রে নেয়া যায়? শেষমেশ অনেক ভালো গানেও চন্দ্রবিন্দু  প্যারোডি-ব্যাধিদুষ্ট। রইল বাকি রূপম ইসলাম। দেখবেন যে রূপমের গানে সেই ব্যঙ্গ ঘুরিয়াফিরিয়া যা কিনা নচিকেতাস্টাইলের, সেই আদ্দিকালিক রদ্দি অন্ত্যমিল, সেই কবীর সুমনের আদলতাড়িত সমাজচেতনা, আর রূপমের গানে ও গলায় ব্যক্তিত্ব পাবেন না আপনি, যদিও গলায় স্ট্রেন্থ অনেক, শুনতে যেয়ে মনে হয় যেন শুনছি এইটিজের ফিল্মি ক্যাবারে-ড্যান্সমিউজিক অথবা হালের আইটেমগানার কোনো মিউজিক সিক্যুয়েন্স। অনুপম রায়? লিরিক্স কয়েকটা খারাপ লেখেন নাই তিনি, সদ্যতন এই শিল্পী একজন নিয়মিত অনুশীলন-চালানো কবি ছিলেন কৌরব  গ্রুপে এ-কথাটা মনে রাখি, কিন্তু ওই অন্ত্যমিলমর্মরিত রোম্যান্তিক গীতিকাই তো শেষ-পর্যন্ত। মন্দ না। আমাদের ফিলিংস/নগরবাউল, ওয়ারফেজ, ফিডব্যাক  কিংবা পরবর্তী পর্যায়ের আর্টসেল, শিরোনামহীন, মেঘদল  প্রভৃতির সঙ্গে তুলনীয় একটা ব্যান্ডও কি দেখেছি আমরা ওইদিকে? এবং আমাদের সর্বসাম্প্রতিক অর্ণবের সঙ্গে তুলনীয় মিউজিশিয়্যান্? কবীর সুমন ও অঞ্জন দত্ত প্রমুখ কয়েকজন মুরুব্বি হিশেবে টেনে আনার ব্যাপারটা বাতিক ভেবে এবার থেকে একটু ভুলিয়া যাইলেই ভালো। নব্বইয়ের দশকে যে-তুঙ্গস্পর্শী ব্যান্ডমিউজিক বাংলাদেশ দেখিয়েছে, এর বিলয়ও ওই দশকের প্রান্তভাগে, পশ্চিমবঙ্গের নতুন বাংলাগানের ভোর শুরু হয়েছে সুমনের গিটারবাহিত হয়ে সেই সন্ধিক্ষণেই। এইসব হিসাবকিতাব মেলানো দরকার মনে হয়। কেউই দেখি বিপুল সৃজনোল্লাসমুখরিত আমাদের ব্যান্ডগান নিয়া কথা বলে না, খালি সুমন-অঞ্জন-চন্দ্রবিন্দু জপনাম করে বেড়ায়, এমনকি ক্যাকটাস-পরশপাথর-ফসিলস্ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যরহিত ব্যান্ডেরও উল্লেখ করতে দেখি স্মিতপণ্ডিত-মুখে কাউকে কাউকে, সেই গোত্রে এই নিবন্ধকারও পড়ে বটে। হেন গুনেগারি থেকে বেরোনোর সময় হয়েছে এবেলা সন্তানসন্ততিদের সম্মানপ্রশ্নের খাতিরে। একই মিথ মুখস্থ করা, স্ট্যাটাস্-ক্যু, কদ্দিন চলতে পারে এভাবে! এই নীরবতা ভাঙা আশু দরকার আমাদের নিজেদেরই বিকাশের স্বার্থে, এপার-ওপার দুইপার এবং দুনিয়ার সর্বপারাপারের বাংলা গানের দিশার স্বার্থে, একচেটিয়া খণ্ডিত সত্য তথা সাব্লাইম মিথ্যের মণ্ড প্রচারণা রোখার স্বার্থে। বাংলাগানের, বাংলাদেশের ব্যান্ডের, বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের বাইরের বাংলা গানের, একটা ব্রেকথ্রু আসুক এইটা কায়মনোবাক্যে চাই। স্থিতাবস্থা কাটুক বাংলা গানের, বাংলা কথার, বাংলা সুরের, বাংলা কবিতার।

অন্ত্যমিল একটা শাসনপ্রণালি, অন্ত্যমিলের অনুশাসনে বাংলা গান গোড়া থেকে চূড়া অব্দি মোড়া, এহেন প্রথানুবর্তিত অন্ত্যমিলানুশাসন থেকে বাংলা গান একবার বেরিয়েছিল এবং উদাহরণীয়ভাবে সাক্সেসও দেখিয়েছিল, সেইটা ওই সময়ের বাংলাদেশের ব্যান্ডগান। অথচ বাংলা কবিতা অনেক আগে থেকেই অন্ত্যমিল-অধীনতা থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং এর ফল নগদে ভোগ করেছি ও করে চলেছি আজও। অন্ত্যমিলাধীনতা কবিতাকে/গানকে ডানা মেলতে দেয় না, খানিকটা নয় বলা উচিত অধিকাংশটা আপোস করতে হয় ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে কথাবয়নকৌশলের কনভেনশন মান্য করতে যেয়ে। এইটা হাতের পাঁচ হিশেবে কবি/গীতিকারের করায়ত্ত থাকবে নিশ্চয়, কেবল এইটি নির্ভর হয়ে গেলেই বন্ধ্যা। এহেন প্রথা মানবার জায়গা থেকে যেদিন বাংলা কবিতা বেরিয়েছে, সেদিনই বস্তুত কবিতার নতুনতর মহাসাগরদেশাকাশগুলো এক্সপ্লোর করার সম্ভাবনা আমাদের হাতে এসেছে। এবং খোদ প্রথানুশীলিত ছন্দের/অন্ত্যমিলেরও ফ্যুল-পোটেনশিয়্যাল পেতে গেলে, ছন্দের উজ্জ্বল উদ্ধার দেখতে চাইলে, ছন্দোমুখাপেক্ষা কমানো দরকারি, অন্ত্যমিলনির্ভরতা তো অবশ্যই পরিত্যাজ্য। এইগুলো যেমন টেক্সট্যুয়াল রিলিফ আনে, তেমনি রিজিডিটিও তৈয়ার করে। একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার যে দীর্ঘদিনের আচরিত অভ্যাস থেকে বেরোনোর অর্থই প্রথমত মুক্তি, এবং মুক্তি মানেই তো নতুন দিগন্তোদ্ভাস, নিউ হোপ এবং হরাইজন্। এইটা বাংলাদেশের ব্যান্ডগান দেখিয়েছিল বলেই মনে হয় আমার। বয়স যত বাড়ছে, তত আরও বেশি করে মনে হচ্ছে এই কথাগুলো। বড় দীর্ঘকাল আমরা কলকাতাকীর্তনে কাটায়েছি, নিজেদের আলোবাতাসগুলোর প্রশংসা না-করে মুখিয়ে থেকেছি ভিনদেশী মৌসুমবায়ুর পানে। হে ব্রুটাস, এ বড্ড পাপ হে!

 

ম্যাক, পোয়েট্রি, প্যপমিউজিক এটেসেট্রা

দুনিয়ার সমস্ত মধু শুধু অক্ষর গলাধঃকরণের মধ্যেই নিবদ্ধ নেই মর্মে যারা আস্থা রাখেন তারা জানেন যে গান কখনো কবিতা নয়। গানের একটা ডেলিবারেইট চেষ্টা যদি না-থাকে কবিতামতো বস্তু হইবার নিয়তি প্রত্যাখ্যানের, তাহলে যা হয় তার নজির আমরা দেখেছি বিগত অর্ধশতাব্দীর ইন্ডিয়ান বাংলা গানে। ‘জীবনমুখো’ অথবা ‘আধুনিক’, ব্র্যান্ডনেইম যা-ই হোক, ভূভারতের বাংলা গানে ব্যামো হিশেবেই লেপ্টে আছে আজও অন্ত্যমিলাবদ্ধতা। ব্যাপারটা জলাবদ্ধতার চেয়েও অসহনীয়। শুরুতে বেশ পিক্নিক ম্যুডে ব্যাপারটা মানতে পারলেও অচিরে আপনে টের পাবেন এই জীবনমুখা/আধুনিকঝোঁকা ভারতীয় গানাবাজানা আদতে একটা জায়গাতেই পেখম খুলছে পেখম বুঁজাচ্ছে। একটানা কয়দিন একটা মানুষ জলাবদ্ধ বনস্ফূর্তি নিয়া বাঁচতে পারে? এই মুখস্থ ময়ূরের পেখমখোলা নাচাগানাহাসাকান্না ভারতের সঙ্কীর্ণ ও পরাধীনতাজাত কমপ্লেক্স-মাইন্ডসেট-উদ্ভূত ক্ষুদ্র বঙ্গাংশের পপ্যুলার কালচারাল উৎপাদপণ্যগুলোকে একেবারেই নিঃশেষে ভ্যানিশ করে দিতে লেগেছে। এই নিঃশেষাবস্থা আপকামিং দিনগুলোতে আরও স্পষ্ট হবে আশা রাখি।

‘আধুনিক’ ইন্ডিয়াবাঙালি ‘জীবনমুখা’ গানে কবীর সুমনের মুখাপেক্ষিত; অন্ত্যমিলাঢ্য কবিতার পশ্চাদ্ধাবনে সেই জিনিশগুলা আর-যা-হোক কবিতা যে হয় নাই কথাটা পাঁড় ক.সু.ভক্ত ব্যতিরেকে সকলেই স্বীকারিবে। এর কুফল হয়েছে যেইটা তা আমার নজরে এ-ই যে, জয় গোঁসাইয়ের পরে ইন্ডিয়াবাংলার কাছাখোলা বাজারে একমেবাদ্বিতীয়ম পোয়েট অন্ত্যমিলচটুল চটপটি শ্রীজাত। অন্যদিকে ইন্ডিয়াবাংলার গানে অনুপম রায়ের মিষ্টি পিরিতপণ্য উৎপাদনের দেদার কাটতি। ইন দি অ্যাবাভ সার্কাম্সটেন্সেস না-হলো কবিতার বিকাশ তাদের, না-হলো গানের। ফলে, এই অন্ত্যমিলানুশাসনের ব্যাপারটাকে মহাকবিতা ও মহাগান মনে করবার জগদ্দল চৈতন্যদর্শনসঞ্জাত ভ্রমের কারণে, গ্রেইট ইন্ডিয়াবাংলা গান ও কবিতার ফ্লাইট আজি বিপর্যস্ত। ধুঁকে ধুঁকে বত্তমানে প.বঙ্গ মরন্ত। দুঃখ। মুখ-থুবড়ে বেচারাদিগের ন্যাজেগোবরে অবস্থা। বাংলাদেশে এই অবস্থা ভাগ্যিস হয় নাই। বিগত বছর-পঞ্চাশের বাংলাদেশে ব্যান্ডগান সহস্র অনবধানতা আর ইম্যাচিয়্যুরিটির পরেও এই জায়গাতে গ্রেইট। হয়তো অজান্তেই জিনিশটা ঘটে গেছে এদেশের কালেক্টিভ কপালে। একদম অনায়াসলব্ধ ঘটনাটা, বা দৈবের বশে পেয়ে যাওয়া, ব্যাপার মোটেও তা না। আপাতত মুলতুবি থাকুক এতদপ্রাসঙ্গিক আলোচনা।

ব্যান্ডগানে অন্ত্যমিলানুবর্তন নাই, এইখান থেকে একটা আলাদা নোক্তা বার করে ফের কথা চালানো হতে পারে। ইন ফিউচার। এবং ব্যান্ডগান/রকগান বলতে এতদঞ্চলে শ্রীলঙ্কা বা থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর বা ইন্ডিয়া না; ব্যান্ডগান/রকগান বলতেই বিগত চারদশক ধরিয়া বাংলাদেশ বোঝায়, নিপলচোষা শিশুটিও জানে এইটুকু তথ্য। ওভারনাইট অর্জিত হয় নাই এটুকু। অনেক ফ্যুয়েল্-ফ্যসিল্ পুড়িয়ে শেষে এহেন অর্জন হয়েছে সঞ্চিত। ফলে ডেলিবারেইটলি বিস্তর গঞ্জনা সয়েও বাংলাদেশের ব্যান্ডগান আলাদা ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পেরেছে। যে-ব্যক্তিত্ব ইন্ডিয়াবাংলার কথিত ‘রক’ রূপম ও তদানুসৃত গং অর্জিতে ব্যর্থ, সোজা কথায়, লম্ফঝম্প-করা হাজার অনুষ্ঠানান্তে।

এত লম্বাচওড়া বাতচিতের শেষে অতীব দুঃখের সঙ্গে আপনাকে কবুল করতেই হবে যে বাংলাদেশের ব্যান্ডগান তার ছেঁড়াফাটা স্যাডলব্যাগে ঢের মালমাত্তা নিয়াও দিনশেষে ব্র্যান্ডিং করে উঠতে পারে নাই ঠিকঠাক। কেন পারে নাই, নেপথ্যে নয়শত নিরানব্বই কারণ থাকলেও একটা খাসলতগত কারণ অধুনা আরেকবার আমাদিগের সামনে এসেছে। সেই খাসলতের নাম উপনিবেশায়িত অভ্যস্ততা, মানে, সাংস্কৃতিক ও সামূহিক মগজের অভ্যন্তরস্থ প্রভুনির্ভরতা।

বাংলাদেশের ব্যান্ডগান মূলত গদ্যকাব্যিক। অনেকানেক ইম্যাচিয়্যুরিটি সত্ত্বেও গদ্যস্পন্দে ব্যান্ডগান বাংলাদেশের এমনকি ইয়াং কবিদেরেও প্রথমাবধি উদ্বুদ্ধ করে এসেছে ট্র্যাডিশন ও কনভেনশনের বাইরে থেকে দেখতে জগতটারে। যেটুকু অনিয়মিত অন্ত্যমিল বাংলাদেশে ব্যান্ডগানের কথাভাগে দেখা যাবে, যেটুকু অন্যমনস্ক অথচ অনায়াস অন্ত্যমিলবিন্যাস, ব্যান্ডের বাংলা গানে এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট দশা আমরা আগা থেকে গোড়া অব্দি নিরখিয়া যাই। ছিল না ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্য হইবার উদ্ভট ও অদ্ভুতুড়ে খায়েশ বাংলাদেশের ব্যান্ডগানের; ছিল না বলেই নির্দ্বিধায় ব্যান্ডগানে ‘মোর’, ‘মোদের’ প্রভৃতি সর্বনামপদ নির্ভার-নির্ভারিক্কী-নির্বিকার ব্যবহৃত হয়েছে এবং উহার ফলে বাংলা আবহমানতায় পালক যুক্ত হয়েছে অন্যতর। প্রসঙ্গটায় প্রত্যাবর্তন করা যাবে একদিন নিশ্চয়।

 

অপসংস্কৃতির অপরূপায়িত উদযাপন

এখন কেউ একজন নিশ্চয় সেই আমাদের ব্যান্ডগানে অনুশীলিত অপরূপ অপসংস্কৃতির অবদান তুল্যমূল্যাঙ্কন সহ হাজির করবেন এই দোয়া করব। উদযাপন দরকার। পুনরুদযাপন। স্মরণ করব, ‘অপরূপ অপসংস্কৃতি’ কয়েনেইজ করেছিলেন ফিডব্যাকের মাকসুদ, সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি বাংলা গানে শুরুর দিককার কলকাতাগ্রাসন নিয়া, আমাদের নিজেদের জিনিশগুলোকে খারাপ সাব্যস্তপূর্বক কলকাতার মালসামানকে মহাভালো আখ্যা দেবার মাইন্ডসেট নিয়া, আমাদের নাক কেটে বেচে দিয়ে নোলক খরিদের হিড়িক নিয়া, মাকসুদ অনেকদিন একটানা লিখেছেন এতদবিষয়ক কলাম ‘চলতিপত্র’-‘আনন্দভুবন’-‘প্রতিচিত্র’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রে, পরে এইসবের কয়েকটা একত্র করে ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ শিরোনামে একটা বইও হয়েছিল দশককাল আগে, অ্যানিওয়ে। একটা-কোনো বছরের ঈদসংখ্যা আনন্দভুবন-এ বেরিয়েছিল মাকসুদুল হকের ‘এই আমাদের অপরূপ অপসংস্কৃতি’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ রচনা, আজও জ্বলজ্বল করছে সেই রচনাপাঠের স্মৃতিবিমুগ্ধতা। ব্যান্ডগানকে তখন মুরুব্বিরা সব্বাই সমস্বরে ‘অপসংস্কৃতি’ বলত, এমনকি মিডিয়াবাজ শাস্ত্রপোকা মাকালেরাও, যদি জানতেই চাও। ছোট্ট করে বলি এখানে, দেখব যে কবীর সুমন কথায়বার্তায় বাংলাগানের নতুন প্যারাডাইম নিয়ে বলতে যেয়ে কেবল তার নিজের গান ও নিজের নগরের দু-আধজনের নামোল্লেখ করেন। সুমনজি বাংলা গানে অতুলনীয় অবদান রেখেছেন কথাটা তো অনস্বীকার্য। নতুন বাংলা গানের ভোর এনেছেন কবীর সুমন, অতিরঞ্জন নয় একবর্ণও। তবে এই সমস্ত সত্যালাপের শেষে এখন আমার মনে হয় যে ব্যান্ডগান দিয়া বাংলায় গীতিসৃজন ও সংগীতায়োজনের ক্ষেত্রে যে-ব্যাপক কাজ হয়েছিল তা আগাগোড়া অভূতপূর্ব। মনে হয় যে এই দিকটা আমরা অবহেলে গেছি দীর্ঘকাল। কবীর সুমন ও কলকাতা কোম্প্যানি বাংলা গানে যে-ধারা গড়েছেন, সেই ধারার শীর্ষদেশ তো আমাদের ইতোমধ্যে দেখা সারা। আজকাল লক্ষ করে দেখবা তুমি যে এই ওয়েস্টবেঙ্গলীয়/কলকাতার অধুনা বাংলাগানে সুমনপন্থার চর্বিতচর্বণ হয়ে চলেছে বহুলভাবে এবং অবভিয়াসলি পীড়াদায়ক গোটা ব্যাপারটা। আর এক-দুই তো নয়, একাধারে অসংখ্য গানবাজনাকার সুমনের অনুসৃতি ঘটিয়েছেন এবং ঘটিয়ে চলেছেন; ওখানকার কবিতায় যেমন জয় গোস্বামীর ছায়ানুকারেরা প্রাইজ পেয়েটেয়ে কোনোমতে কায়ক্লেশে কবিতানুশীলনটা চালু রাখিয়া যাইছে। একটু বেশিই জেনারালাইজ করা হয়ে যাচ্ছে হয়তো। বলা বাহুল্য, সুমন একলাই নিজের প্রবর্তনাটাকে একদম পূর্ণ বিকশিত ও এতটাই ফুল্লপল্লবিত করে তুলেছেন যে সেখানে অমুক-তমুকের নিজের শিল্পীক্যারিয়ার গড়া ছাড়া বাংলা গানে তেমন কোনো নতুন সংযোজনের সুযোগ ছিলও না। এইসব বিবেচনা মাথায় রেখে যদি ভাবনাভাবনি চালানো যায় তো দেখা যাবে যে বাংলাদেশের ব্যান্ডগান অনেক নতুনের ইশারা-নিশানা সামনে এনেও কল্কে সেই-অর্থে পায় নাই স্রেফ আমাদের মাইন্ডসেটের কারণে। ব্যাপারটা মাঝপথে থেমে গেছে। এই থামার পেছনে দায়ী ফ্যাক্টরগুলো নিয়া আলাদা বাতচিত হতে পারে। সেইটা না-হয় অন্য কোনো সময়ের জন্য রইল তুলিয়া রাখা। আমার এই কথাগুলো শুধু মনগড়া আজগুবি মনে-হওয়াই নয়, নিছক আন্দাজপ্রসূত কথালাপ নয়, এইটা আজকাল অনেকটা প্রামাণ্য প্রকল্পের রূপ পরিগ্রহ করিবারে যেন বদ্ধপরিকর। মৌলা হায়াত যদি দেন তো কখনো জড়তা কাটায়ে এ-বাবতের স্বকীয় অনুসিদ্ধান্তগুলো তোমার সনে শেয়ার করা যাবে তোমার টিউটোরিয়ালের ফাঁকফোকরে, মামণি, মেরি বেটিয়া, ঠিক আছে? এবং তোমারই ন্যায় তিন-চার বা গোটা এগারা-বারা আর্শিনগরবাসীর নিকট ভবিষ্যতের কহতব্যগুলো গচ্ছিত রাখার বাসনা এইখানে যাই প্রকাশিয়া।

না, তুলনামূলক বিচারের কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না; আবার প্রচারণাকাজ এত জোরেশোরে এদ্দিন ধরে হয়েছে যে — আমরাই ব্যান্ডগান দূরছাই বলে এবং কলকাতাগান আ-মরি বলে সেই প্রচারণা চালায়েছি — কাজেই তুলনামূলকতার ভেতর দিয়ে যেয়ে একটা আগ-পিছ নির্ণয় ও প্রদর্শন দরকারও হতে পারে। সেইটা আমরা যখন কথা বলতে বসব, তখন ভঙ্গি ঠিক করে নেয়া যাবে। এখানে কেবল বলা যাক, সুমনগান প্রসঙ্গে যেসব দাবি — যেসব পায়োনিয়ারিং এফোর্ট এবং কন্ট্রিবিউশনের কথা/তথ্য — উত্থাপিত হতে দেখি, সেইগুলো ধরে ধরে ব্যান্ডমিউজিক ম্যুভমেন্টের নীরবে অপসংস্কৃতির অপবাদ সয়েও গোলাঘর ভরে শস্য সংগ্রহণের হিস্টোরিটুকু বিস্মৃতিবিলাসী/বিস্মৃতিমত্তা বাংলাদেশীদিগের মেমোরিতে ফেরানো যাবে এমন একটা আশা পোষণ করা যাক আপাতত। কীভাবে ফেরানো সম্ভবপর হবে? এক-দুইভাবে নয়, একডজনভাবে কমপক্ষে। একটামাত্র উদাহরণ টুকি সেই প্রকল্পিত-প্রস্তাবিত খসড়া থেকে। যেমন তুমি দেখবে এমন একটা দাবি সরব ও সচল এখানে যে কবীর সুমন বাংলা গানে ব্যালাড আঙ্গিকের নিরীক্ষা করেছেন ও সফলকাম হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে সুমনের ব্যালাডধর্মী গানের অনেক আগে থেকেই ফিডব্যাক  ব্যালাডফর্ম নিয়া কাজ করেছে সেই ‘জোয়ার’-‘মেলা’ প্রভৃতি অ্যালবামে এবং চূড়া ছুঁয়েছে ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ ও পরবর্তী পর্যায়ের ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ বা ‘ওগো ভালোবাসা’ ইত্যাদি অ্যালবামে, তখনও কবীর সুমন সবেমাত্র বাজার জুড়ছেন। ওয়ারফেইজ  করেছে, এলআরবিও করেছে। জেমস্ করেছেন যুগপৎ সোলো পরিবেশনায় এবং ফিলিংস/নগরবাউল দিয়া। বাংলা গানের প্রথানুবর্তী প্রকরণ তথা আস্থায়ী-সঞ্চারী ইত্যাদি কম্পার্টমেন্ট ছেড়ে বেরোনোর রাস্তা বাংলাদেশের ব্যান্ডগান সর্বাগ্রে দেখিয়েছে। এর বাইরেও অনেকানেক স্পর্ধা-সাহসিকতা আমাদের ব্যান্ডগান দেখিয়েছে। সেইসব অপরূপায়িত ঘটনা আমরা পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়া আসি নাই। উল্টা বাদ্য বাজায়েছি, উল্টা নামগানা গাহিয়াছি, মিছেমিছি। কিন্তু সাম্যের গান গাহিবার, যার যেইটা পাওনা তারে সেইটা বুঝাইয়া দিবার, সময় তো বহিয়া যায় নাই। বিলম্ব হইলেও প্রাপককে তার প্রাপ্য বুঝাইয়া দিয়া পাপক্ষালনের পথ খুঁজতে হবে হে! এইগুলি নিয়া বলতে হবে তো। পুত্র আমার, কন্যা অয়ি, তুইই তো বলবি। নিজেদের ভুলভালগুলো, বদমায়েশিগুলো, তোর পূর্বজের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো, লুকায়ে না-রেখে বরঞ্চ যথাসাধ্য স-মমত্ব বলতে হবে। ব্যান্ডের বদমায়েশিও লুকায়ে যেয়ে লাভ নাই। কিন্তু, আইজ্ঞা, কবীর সুমন নমস্য ব্যক্তি। কিন্তু ইতিহাস যখন বলবে তুমি, কিপ ইট অলোয়েজ ইন য়্যুর মাইন্ড, একদিকের কথা বলবা আর অন্য একটা দিক বেমালুম চেপে যাবা, তা তো হয় না। নব্বই দশকের কলকাতা ছিল হিন্দি ফিল্মিগানার বাংলা রিমেকের মোচ্ছব, কুমার শানু আর বাবুল সুপ্রিয় আর সনু নিগমের মেলোড্রামাগান ও কোঁকানিকীর্তন দিয়া সয়লাব। বাংলাদেশ ছিল ওইসময়ে বাংলা গানে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে উন্মাতাল। শুধুই ব্যান্ডমিউজিক আর দুর্ধর্ষ সব পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা সরগরম। এইটা স্বাজাত্যবোধ নয়, দেশাত্মবোধ বা জাতীয়তাবাদজাত আবেগ নয়, এইটা ফ্যাক্ট, এইটাই মিনিম্যাল স্টেইটমেন্ট এক্ষেত্রে। হতে পারে যে কবীর সুমন ওই সময়ের বাংলাদেশজ ব্যান্ডগান খুব-একটা শোনেন নাই, কিংবা শুনলেও সুমনের গানবোধ সেইসব ব্যান্ডগানকর্ম অনুমোদন করে না। কিন্তু বেমালুম চেপে যাওয়ার সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপারও তো জড়ানো। তোমাদের জেনারেশনে, হে আমার পুত্র হে সুনেত্র কন্যা, এইসব একচক্ষু-হরিণপনা আশা করি ভাত-বার্গার পাবে না। আপাতত এইটুকুই। তিলে তিলে ঢের দেনা জমেছে আমাদের, জবর দেরি হয়ে গিয়েছে। অ্যাট-লিস্ট সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না-পারলেও সেই ব্যাপক সৃজনসুফলা গানের সময়টাকে অ্যাক্নোলেজ করা আশু কর্তব্য। তোমার ও তোমাদের সময়ের মহোদয়বৃন্দের গানমজমা সানন্দ হউক।

 

আন্দোলিত সময়ের সমুদ্র সফেন

সেই সময়টায় এইসব ঘটেছিল। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ ঘটেছিল। মন্দ ছিল না সময়টা। যা-ই হোক। তবে কেবল বঙ্গাব্দই তো নয়, ফিডব্যাকের প্রত্যেকটা অ্যালবামই ছিল মাইলফলক, অবশ্যধর্তব্য ব্যান্ডমিউজিকে ফিডব্যাক  একটা ভালো ও উদাহরণীয় ঘটনাপ্রপঞ্চ, হোক সেইটা ‘উল্লাস’, ‘জোয়ার’ অথবা ‘মেলা’ বা ‘বাউলিয়ানা’ বা সেই আব্দুর রহমান বয়াতির সঙ্গে একজুটি সিঙ্গেল্স ‘দেহঘড়ি’, ফিডব্যাক  নানানভাবেই সেই সময়টাকে আন্দোলিত করে গেছে। এই আওয়াজ তো ফিডব্যাকই দিয়াছিল : ‘ধন্যবাদ ভালো দিয়া গেলেন’;  উঠেছিল হাঁকিয়া তারুণ্যের এই অন্তর্জ্বালা : ‘আর এরপরও কেউ যদি চাপাবাজি করেন / ঢাকার ছেলেরা চিৎকার করে বলেন — / ধন্যবাদ, ভালো দিয়া গেলেন / ধন্যবাদ ভালোই দিয়া গেলেন’ … এইসব ডিটোনেটর সাপ্লাই দিয়েছে সেই-সময় আমাদেরে এই ব্যান্ড। সময়টাকে এনকোড করে যাবার কাজটা ফিডব্যাক ব্যাপক সফলতার সঙ্গে সেরে গেছে, এবং করেছে কম্পোজিশনের শিল্পশর্ত ক্ষুণ্ন না-করেই। ফিডব্যাকের লিগ্যাসি তো অনেক পুরনো, অনেক লম্বা; মাকসুদের আগে/পাশাপাশি যিনি ভোক্যাল ছিলেন এবং ভালো লাগত গলা-গায়কী যার, তার নাম যদ্দুর ইয়াদ হয় ছিল রোমেল, অত্যন্ত অল্পকালের জন্য হলেও; রোম্যান্টিক লিরিক্সই ছিল তখন ফিডব্যাকের তুরুপের তাস। ম্যাক এসে যে-একটা বাড়তি তাস দেখালেন, সেইটাই হয়ে উঠল ফিডব্যাকের এবং গোটা ব্যান্ডসংগীতের গরিমার একটা জায়গা। আগেও ফিডব্যাক  পোলিটিক্যাল কনশ্যাসনেস থেকে গান করেছে, সলিডারিটি এক্সপ্রেসের জায়গা থেকে গেয়েছে, বঙ্গাব্দতে এসে ব্যাপারটা দানা বাঁধল এবং ব্যান্ড উন্নীত হলো অন্য উচ্চতায়। এরপরে দুইটা ফোক-বেইজড অ্যালবাম করে ম্যাক ফিডব্যাক থেকে বেরিয়ে গেলেন; ফিডব্যাক আবার ফিরে গেল ‘বন্ধুর খোঁজে জোছনায়’ প্রভৃতি প্রেমরোম্যান্সমূলক লিরিক্সের দ্বারে, ‘আয় আয় আয় সবাই / আবার আমরা মেলায় যাই’ ইত্যাদিতে; ম্যাক গড়লেন ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ এবং ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ ও ‘ওগো ভালোবাসা…’ বার করলেন সেই মিউজিকট্রুপের ব্যানারে এবং অন্যতর পরিকল্পনা থেকে ‘গরিমা গানের দল’ গড়লেন ও অনতিবিলম্বে ‘মাআরেফাতের পতাকা’ নামে একটা অ্যালবাম করলেন নিজের ধারার স্ট্রং কন্টিন্যুয়েশন রেখে, ‘গরিমা গানের দল’ শীর্ষক পৃথক একটা গানদল গড়ে নিতে দেখব আমরা তাকে এই সময়টায়, ‘ঢাকা’ সত্ত্বেও সম্পূর্ণ আখড়ার মেজাজে হেরিটেইজ-এক্সপ্লোরকারী ফিউশন মিউজিকের প্রয়োজনে। সেসব অন্য ইতিহাস, অন্যত্র কখনো বলা যাবে। যেইটা বলার তা এ-ই যে, এদেশের বাইরে পরাধীন বঙ্গ কলকাতায় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ কিংবা আরও যদি কোনো সমধর্মী ব্যান্ড থেকে থাকে, ফিডব্যাকের সঙ্গে এসব কারোরই তুলনা চলে না। বাংলা গানে, কবীর সুমন মাথায় রেখেও বলা যায় এই কথাটা, লিরিক্সের পোলিটিক্যাল স্ট্রেন্থ বিবেচনায় নিলে, ডাইরেক্টনেস্ যদি লিরিক্সের কোয়ালিটি হিশেবে মেনে নিতে কারো আপত্তি না-থাকে, ফিডব্যাক  অনুপম ও অতুলনীয়। সময়কে এনকোড করেছে এরা শিল্পসফলভাবে সরাসরি; কিংবা আন্দোলিত একটা সময়েই ফিডব্যাকের উত্থান-আবির্ভাব-বিকাশ যেভাবেই বলি না কেন। সময়টাই হয়তো আন্দোলিত করেছে তাদেরে, এবং তারা তাদের পথ করে নিয়েছে সেই সময়্দুয়ার-পেরোনো সদররাস্তায়। ম্যাক তথা ফিডব্যাক  নিয়ে, জেমস তথা ফিলিংস্/নগরবাউল  নিয়ে, পৃথক পরিসর ও আয়োজনে আলাপ জুড়তে হবে। এইসব ইঙ্গিত বিধৃত রয়েছে ব্যান্ডগানে, বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে, রেনেসাঁ-ফিডব্যাক-ওয়ারফেইজের মিউজিকে, এলআরবি-ফিলিংস-নগরবাউলের গানে।

 

প্রোফাইল অফ অ্যা পোয়েট অ্যান্ড গেরিলা অ্যাক্টিভিস্ট

পরিচয় তার একটা নয়, কয়েকটা। গায়ক, কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিবীক্ষক ও সম্প্রচারবিশেষজ্ঞ। মাকসুদুল হক, ওর্ফে ম্যাক হক, বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম ‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডের সাবেক লিড-ভোক্যাল; ১৯৯৭ সালে ফিডব্যাক থেকে বেরিয়ে ব্যান্ড ফর্ম করেন ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ নামে, সেইসঙ্গে বাংলাদেশের ফকিরিধারার গানের ফিউশনধর্মী নিরীক্ষা চালানোর জন্য গড়ে তোলেন ‘গরিমা গানের দল’ শীর্ষক পৃথক গানদল। আবহমান বাংলা গানে জ্যাজ-রক ফিউশন উপস্থাপনের জন্য ম্যাক যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত। ফিডব্যাকে থাকাকালীন মাকসুদুল হকের গীতিকবিতায় এবং অনবদ্য গায়নে অ্যালবামগুলোর মধ্যে ‘মেলা’, ‘জোয়ার’, ‘উল্লাস’, ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’, ‘বাউলিয়ানা ১ম খণ্ড’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য; ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যানারে উল্লেখযোগ্য সংকলনের মধ্যে ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের জন্য নিষিদ্ধ’ তৎকালীন সাংস্কৃতিক স্থিতাবস্থায় মারাত্মক অস্বস্তির ঢেউ তুলেছিল। বাংলা গানে এই অ্যালবাম রাজনৈতিকতাদীপ্তির জন্যই দিশারী। ঠিক অব্যবহিত পরেই ডিক্লেয়ার হয়েছিল ‘রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০’ শিরোনামে একটা অ্যালবাম বেরোবে ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের ব্যানারে, এবং ঘোষণাটা আসে ১৯৯৯ সনের দিকে, যদিও পরে অ্যালবামটা আর আলোর মুখ দেখে নাই। কিন্তু পরিকল্পনা পাল্টে ম্যাক যে-কাজটা আমাদেরে উপহার দেন, সেইটা বাংলা গানভুবনে এক ভিন্নদুয়ারী কিলোমিটারস্টোন। ‘ওগো ভালোবাসা…’ নামফলকের সেই অ্যালবাম বাংলা গানে জ্যাজ্-রক্ ফিউশনের উন্নত নজির। যদিও ‘ওগো ভালোবাসা…’ অ্যালবাম ম্যাকের মিউজিশিয়্যান ক্যারিয়ারে এবং ব্যক্তিজীবনে একটা ফাঁড়া হয়ে দেখা দেয় ট্যাগোরের কুল্লে একখানা গান গাইবার কারণে। এই নিয়া পানি কম ঘোলা হয়নি। কিন্তু ‘ওগো ভালোবাসা…’ বাংলা গানশ্রোতার কানে এখনও অনুরণন তোলে। অ্যানিওয়ে। ম্যাক গানবাঁধার পাশাপাশি নিয়মিত করেন অন্যান্য কয়েক ফর্মের লেখালেখি। লিখনকর্ম বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায়, বেশি ইংরেজিতেই যদিও, ম্যাকপ্রণীত বাউল ও ফকিরি ধারার সুলুকসন্ধানী বিদ্যায়তনিক ইংরেজি প্রবন্ধগুলো অনুসন্ধিৎসু সকলের অবশ্যদ্রষ্টব্য। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গদ্যবই ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’, কবিতাবই ‘দি বাংলাদেশ পোয়েট অফ ইম্প্রোপ্রায়েটি’, গবেষণা-আখ্যানগ্রন্থ ‘বাউলিয়ানা, ওয়্যর্শিপিং দি গ্রেইট গড ইন ম্যান’ প্রভৃতি। রিসেন্ট অ্যাক্টিভিটির মধ্যে ম্যাকের কোনো স্টুডিয়োঅ্যালবাম পাওয়া না-গেলেও, ২০১৬ সন পর্যন্ত, ‘শব্দচিত্র’ শিরোনামে একটা অনলাইন-অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে। এছাড়া বাউল গানের ভার্শন, টিভিলাইভে নিজের পপুলার গানগুলোর রিপ্রোডাকশন, কন্সার্টে দেশে-বিদেশে মিলিয়ে অ্যাক্টিভ রয়েছেন ম্যাক। সম্প্রচারবিশেষজ্ঞ হিশেবে দেশের একটা এফএম-রেডিয়োতে ম্যাক কাজ করেছেন। জন্ম ১৯৫৭ সনে, সেপ্টেম্বরে, নারায়ণগঞ্জে। অ্যামেচারিশ ‘ফিয়াস্কো’ ব্যান্ডে গোড়ার কিছুকাল কাটিয়ে যোগ দেন ‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডের সঙ্গে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ফিডব্যাকের লিড-ভোক্যালিস্ট হিশেবে ম্যাক বাংলা ব্যান্ডসংগীতের আন্দোলনে কথায়-সুরে-গলায়-মঞ্চপরিবেশনায় অপ্রতিহত অবদান রাখেন। ১৯৯৭ সনে ‘ফিডব্যাক’ থেকে বেরিয়ে ফর্ম করেন ‘মাকসুদ ও ঢাকা’, ম্যাকের ক্যারাভ্যান্ অব্যাহত রয়েছে এই মিউজিকট্রুপের মাধ্যমে। এছাড়া তার সাংগীতিক, সাংস্কৃতিক ও সমাজরাজনৈতিক সক্রিয়তা তাকে এক সদাতৎপর সচলায়তনের সংস্পর্শে রেখেছে সবসময়। বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন তথা বামবার ফাউন্ডার-সভাপতি মাকসুদুল হক দায়িত্ববাহক হিশেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত। ১৯৯০ সনের বিজয় দিবসে বাংলাদেশের ইতিহাসে পয়লাবারের মতো ওপেন-এয়ার কন্সার্ট অনুষ্ঠিত হয় বামবাউদ্যোগে ম্যাকের তত্ত্বাবধানে। এরপরবর্তী গোটা নাইন্টিস জুড়ে দিনব্যাপ্তির অসংখ্য সফল কন্সার্টের আয়োজন হয় ম্যাকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সক্রিয়তায়। এর বাইরে ম্যাক উভয়ত অন-স্টেজ এবং অফ-স্টেজ তৎপরতায় মিউজিশিয়্যানদের কপিরাইট ও রয়্যাল্টি নিয়ে উল্লেখযোগ্যরকমেই ছিলেন সোচ্চার। পূর্বসময়ের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ম্যাকের কালচারাল গেরিলা ওয়ার্ফেয়ার স্তিমিতরূপে হলেও অব্যাহত রয়েছে।

 

উই মেইড দ্য রোড বাই ওয়াকিং

ইতিহাসটা পায়ে হেঁটে গায়ে খেটে মেহনতের ঘাম ঝরায়ে এগোনোর, পড়ে-পাওয়া বারোআনা চোদ্দআনা ভাগ্যের ইতিহাস নয়, বাংলাদেশের ব্যান্ডগান পদব্রজে এগিয়েছে। কেউ উঠিয়ে দেয় নাই, লিফট করায় নাই, নিজেরেই নিজের হিম্মতে যেতে হয়েছে হেঁটে হেঁটে। এর ফলে, দেখা যাবে, একেকটা ব্যান্ড অনেক চড়াই-উৎরাই পারায়েও শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং একটা দাগ তো প্রত্যেকেই রেখেছে এদেশের মিউজিকে কমিবেশি। কিন্তু যদি হতো দুম করে একটা হাইপ ওঠানো জনপ্রিয়তা, তাইলে এত বুদ্ধিঢিবিদের অবজ্ঞা সয়ে ব্যান্ডমিউজিক এতটা রাস্তা আসতে পারত না। আজকের দুনিয়ায় ইউটিউবার মিউজিশিয়্যান পাওয়া যায় এমন গণ্ডায় গণ্ডায় যারা লাইকের বুদবুদে জন্মায় ফের পরক্ষণে উবে যায় কর্পূরের মতো। শুধুই নিজের হিম্মতে ভরসা রাখতে পেরেছে ব্যান্ডগুলো যতদিন, শ্রোতাবাজারের প্রেশার মাথায় না নিয়া গান করে গেছে যতদিন, ততদিনই জীবন্ত সংগীত করে যেতে পেরেছে।

 

রক অ্যারাউন্ড দ্য ক্লক

টিক-টক টিক-টক টিক-টক … ‘আর একমিনিট নীরবতায়’ — এইভাবে শেষ হয় ‘গীতিকবিতা ১ (মনে পড়ে তোমায়)’ শীর্ষক ম্যাকের কালজয়ী সেই গান। “মনে পড়ে, অকালে আমার মনের শান্তি মরে যায় / মনে পড়ে এই মানুষনিংড়ানো সংসারে বেঁচে থাকা যে কত দায়” … এইসব পঙক্তিমালার অনর্গল উৎসারের সমাহার আশ্চর্য সেই গানে এনেছে অনবদ্য ঝর্ণাপানির স্বতশ্চলতা। মাকসুদের গাওয়ায় চিরে চিরে যায় আকাশবাতাসপানি, ফালাফালা হয় একাকিত্ব ও অন্যান্য ভজকট বিরহবিচ্ছেদ, নিদারুণ প্রত্যাখ্যানও হয়ে ওঠে উদযাপনযোগ্য। শুধু এই একটাই নয়, শিরোনামি গীতিকবিতাগুলায় মাকসুদের স্বরপ্রক্ষেপণ, উচ্চারণ ও গায়কির উড়ান তাজ্জব হয়ে দেখবার মতো। সম্ভবত ছয়টা আছে এমন গীতিকবিতা শিরোনামের গান, এছাড়াও আছে বেশকিছু ব্যালাড প্যাটার্নের লিরিকের কম্পোজিশন। কনভেনশন্যাল কানে ম্যাকের কণ্ঠ কর্কশ শোনাতে পারে, সেক্ষেত্রে সেই কান রকলিটারেইট নয় জানব। সুললিত গলায় সারেগামা সাধলে সেইখানে রক উৎপন্ন হয় না।

 

জাগরণ হেমবর্ণ : ১৯৮৫-১৯৯৫

ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাংলাদেশে রেনেসাঁসের ঘটনা যদি কিছু ঘটেই থাকে, এস্পেশ্যালি কালচারাল অ্যারেনায়, সেইটা ব্যান্ডমিউজিকের মাধ্যমে সংঘটিত। নো ডাউট, ব্রো! স্বর্ণদশক যদি চিহ্নিত করতেই হয় সেই ঘটনাধারার, সেইটে এইটিফাইভ টু নাইন্টিফাইভ। ঘটনার সূত্রপাত অনেক আগে থেকে হলেও বা তার পরেও ঘটনা আরও গড়ালেও ওই দশবছর ব্যান্ডসংগীতের পরিপক্ক সময়, বিকাশের চূড়াকাল, নাইন্টিসের লেজেন্ড ব্যান্ডগুলা তাদের সেরা কাজগুলা বাজারজাত করেছে এই সময়টায়। ১৯৮৫-১৯৯৫ দশকসীমায়। নাইন্টিসের কাল্ট ব্যান্ডগুলার সিগ্নেচার অ্যালবামগুলা আমরা এই সময়টায় পাই। কিন্তু পরবর্তী ডিকেইডে, সেইটা ভাবা যাক ১৯৯৬-২০০৬ খ্রিস্টাব্দসীমায়, ব্যান্ডগুলি নিজেদের সিগ্নেচারের অনুরূপায়ণ অনুবর্তন ঘটিয়ে গেছে স্টেজে অ্যালবামে একদম কব্জি ও কণ্ঠ কনফিডেন্ট রেখে। টেলিভিশনে টেরেস্ট্রিয়ালে এফেমে ব্যান্ডগুলা তাদের সাক্সেস সেলিব্রেইট করবার সুযোগটা পায়। এই ফাঁকে ব্যান্ড ম্যুভমেন্ট কর্পোরেটের চিপায় গিয়ে সেঁধায়। হেমবর্ণ পুনর্জাগরণ অদ্যাবধি আর ঘটে নাই।

 

প্লেব্যাকে ম্যাক এবং ঢাকাই ফিল্মইন্ডাস্ট্রিতে ব্যান্ডগানের এন্ট্র্যান্স

যদিও “তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে হৃদয়ের কুঠুরিতে রাখব” কিংবা “আবার এল যে সন্ধ্যা শুধু দুজনে / চলো না ঘুরে আসি” ইত্যাদি কিছু গানের মধ্য দিয়া ঢাকাই সিনেজগতে চোরাগোপ্তাভাবে ব্যান্ড/প্যপ মিউজিকের প্রবেশ ঘটে গিয়েছিল আগেই, কুমার বিশ্বজিৎ বা ‘সোলস’ এবং হ্যাপি আখন্দ প্রমুখ বাংলাদেশের ছায়াছবিভুবনে যেন হঠাৎ করেই এন্ট্রি পেয়ে ফের উধাও হয়ে যান বলা যায়, কিন্তু অনবচ্ছিন্ন বলা না-গেলেও নব্বইয়ের মধ্যপাদে এফডিসিতে ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানদের ইনক্লুশন অধিকতর জোরালো লক্ষ করা যায়। জেমস্, আইয়ুব বাচ্চু, বিপ্লব, আগুন প্রমুখের রক/ব্যান্ডফ্লেভ্যর্ড সংগীতের অধিষ্ঠান ঢাকাই ফিল্মসিনে এই সময়েই। কিন্তু এরও কিছু পূর্বে ম্যাক এন্টার করেছেন সমারোহের সঙ্গে প্লেব্যাকে। একটা ছায়াছবিতে একজোড়া গান গেয়ে ম্যাক মাৎ করে দেন প্রেক্ষাগৃহবিমুখ তরুণতর  শ্রোতাদর্শকদেরে। সেই সিনেমাটা, নাম ইয়াদ নাই, কিংবা ‘অঞ্জলি’ ইয়াদ হয়, বানায়েছিলেন অভিনেতা-কাম-পরিচালক দারাশিকো তার পুত্র নবাগত সুস্ময়কে ব্রেইক দিতে। “তোমাকে দেখলে একবার / মরিতে পারি শতবার / তুমি নও তো কভু হারাবার / জীবনে, মরণে / বিরহের এই নিশিলগনে / জেগে আছি শুধু দুজনে” — এই লিরিক্স যেভাবে রেন্ডার করেন ম্যাক সেই ৯৬/৯৭ ঈসায়ীতে, এখনও ২০১৭-অতিক্রান্ত সনে এসেও শরীরে-হিয়ায়-রক্তকণিকায় কাঁটা দ্যায় শিহরণের। পাক্কা বাইশ/বিশ বছরে এতটুকু প্রভাক্ষুণ্ণ হয় নাই ভীষণ রকিং সেই রেন্ডিশন! ইউটিউবে এই গানটা আজকে যে-কেউ শুনে জাজ করুক, আজকের বিচিত্র রক্যারল্যা-শোনা তারুণ্যঝঙ্কৃত শ্রোতা, বুঝতে পারবে তার পূর্বজের প্রণয়ার্তনাদ কতখানি নিখাদ।

অ্যানিওয়ে। একই সিনেমায় ম্যাকের প্লেব্যাকে যে-আরেকটা গান, — “লোকে বলে পাগলামি / আমি বলি ভালোবাসা”, — সেইটাও সমান অনবদ্য। মনে পড়বে সে-সময়ের অনেকেরই যে, এই দুইটা গান দিয়াই সিনেমা হাউজফ্যুল গিয়েছে। সে-সময়কার তরুণ অনেকেই দ্বি-অধিকবার ছায়াছবিটা ব্ল্যাকে টিকেট কেটে দেখেছেন। ম্যুভিটিতে দেখানো নয়া নায়ক সুস্ময় কিংবা নায়িকা শাহনাজ নয়, কিংবা নয় সিনেরেইনে ভেজা নায়কনায়িকার বিরহক্রন্দনের দুর্বল অভিনয়, পাব্লিকের প্রেক্ষাগৃহ-উপচানো সমাগম ঘটেছিল ওই দুইটা গান শোনার জন্যে। এবং গানদ্বয়ের স্রষ্টা ম্যাক। ম্যাকের কণ্ঠ হলেও গানদুইটা আলাউদ্দীন আলীর করা সম্ভবত। ওই-ই প্রথম এবং বাংলা সিনেমায় ম্যাকের প্লেব্যাকে এহেন সফলতা সত্ত্বেও ওই গানজোড়া দিয়াই ইতি ঘটেছিল। অজ্ঞাত কারণ বলা যাবে না নিশ্চয়। বিএফডিসিনির্মিত মূলধারা ছায়াছবির গানবাজনার অলিগলির খোঁজ যারা হালনাগাদ রেখে গিয়েছেন তারা জানবেন এইধারা ব্যাপক সাফল্য পেয়েও কন্টিনিউ না করার নেপথ্য কারণ। কথা না বাড়াই।

“ইট’স্ অ্যা হ্যাপি ডে / হ্যাপি বার্থডে টু য়্যু!” ডু য়্যু রিমেম্বার যে এই-রকম লাইনসম্বলিত একটা গান ম্যাক এবং ফিডব্যাক  গেয়েছিল বহুকাল আগে একটা নাটকে? সেই টেলিনাটকে, বিটিভি ছিল তখন একমাত্র চ্যানেল বাংলাদেশে এবং ঘটনাটা ২২/২০/৩২ বছর আগের তো হবেই, যেখানে ‘ফিডব্যাক’ গোটা ব্যান্ডটাকে দেখানো হয়েছিল গল্পের ভেতরে একটি বিশেষ দৃশ্যে, যদিও ঘুরিয়েফিরিয়ে এই রিফ্রেইনের মতো কয়েকটা লাইনই আমরা শুনেছিলাম ম্যাকের গলায়। কিন্তু পরে এইটা অ্যালবাম/মিক্সড কোথাও পাই নাই। লিরিক্স তো অলভ্য। গোটা গানটা আদৌ কম্পোজ্ করা হয়েছিল, নাকি নাটকের প্রয়োজনে ওই দুই-আড়াইটা লাইনই শুধু? সম্ভবত ‘বাবার জন্মদিন’ নাম ছিল সেই টিভিড্রামাটার। সম্ভবত বলছি, বিকজ্ স্মৃতি বিট্রে এখনও করে নাই কিন্তু করতে কতক্ষণ? সময় তো বসে নেই একঠাঁয়। অ্যানিওয়ে। এর বাইরে ম্যাক দুইয়েকটা সামাজিক অ্যাওয়ার্নেস রেইজিং টিভিসিতে চেহারাসমেত গলা দিয়েছিলেন ইয়াদ হয়। ইতিহাস এইটুকু, এ-বাবতে জ্ঞাত, অতি সংক্ষেপে।

 

লেখক ম্যাক এবং বাংলায় লেখালেখির অফস্ট্রিম-মেইনস্ট্রিম

‘অগ্রদূত বিডি লিমিটেড’ সম্প্রতি ইংরেজিতে লেখা ম্যাকের বাউলচর্যাসংক্রান্ত বুঝসমুজদারিতার একটা বই পাঠকসমক্ষে হাজির করেছে। ‘বাউলিয়ানা : ওর্শিপিং দ্য গ্রেইট গড ইন ম্যান’ বইয়ের নাম। ম্যাকের এই পাণ্ডুলিপির কথাটা মাথায় রাখব আমরা, আপাতত বইরিভিয়্যু ধরনের কথাবার্তা চালাতে পারব না। ঢাকা ট্রিবিউন্  অনলাইন ভার্শনে এবং অন্যান্য পত্রিকায় এর বাইরেও অনেক লেখা পাওয়া যায় ম্যাকের, আজম খানকে নিয়া ম্যাকের সিরিজ্ ট্রিবিউট ওইরকম কোনো অনলাইন পত্রিকাবাহিত পয়লা পেয়েছিলাম সম্ভবত। বছর-কয় আগেকার বইমেলায় ম্যাকের ইংরেজি কবিতাবইটাও পড়ে দেখতে পারি। ‘The Bangladesh Poet of Improprieties’ কবিতাবইটার নাম। কিংবা ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ বইটার বর্ধিত কলেবর সংস্করণ? বই তিনটারই প্রিন্ট ছাপা হয়েছে ‘অগ্রদূত বিডি লিমিটেড’ থেকে। দেখতে যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি পড়তেও মন্দ লাগে নাই আমার কাছে। ইন ফ্যাক্ট, কথিত মেইনস্ট্রিম্ বাংলা লেখকদের অহংভরা বাগবিস্তারগুলোর রাশ টেনে ধরার গরজে হলেও সংগীতজীবী ম্যাকের ন্যায় এহেন অনিয়মিত লেখকদের লেখা চারপাশে প্রচারিত হওয়া আশু দরকার বলে মনে হয় আমার হামেশা। মানুষ কত পরিশ্রম করে লেখে, কত প্রেমের কলমে লেখে, দেখেন! অথচ ভাইবিরাদরি নিয়া রাইটারসমাজে কথিত মেইনস্ট্রিমেরা খালি নরক গুলজার করে বেড়ায়। কাজের বেলায় পাঁজির পা-ঝাড়া। কামের নামে ভেরেণ্ডা।

বাউলিয়ানা নিয়া ম্যাকের লেখাজোখায় আমরা বেশকিছু নতুন লাইট এবং ইন্সাইট দেখতে পাবো, সুধীর চক্রবর্তী কিংবা শক্তিনাথ ঝা বা ফরহাদ মজহার প্রমুখ সক্কলের লেখাপত্র একদিকে রেখেও কথাটা আমরা সাহস করে বলতে পারব; জন্মাবধি-সিটিডুয়েলার মধ্যবিত্ত মুসলমানের আর্বান টোনে বাউলাচরণ নিয়া ভাবনা, ভেবেছিলাম পুরা ব্যাপারটা বাংলায় নামিয়ে নেব খোঁড়া ভাষান্তর প্রক্রিয়ায়, নিতান্ত অলেখকসুলভ আমার জীবনাচরণের কারণে ব্যাপারটা আমারে দিয়া আর হবে মর্মে ভরসা প্রায় নিল্ হয়ে এসেছে ক্রমে। ম্যাকের সংগীতকর্ম শ্রবণের পাশাপাশি মিউজিকের এবং বৃহদার্থে বাংলা কালচারের একাগ্র পাঠক হিশেবে ম্যাকলিখিত বইত্রয় মাঝেমধ্যে উল্টেপাল্টে দেখলে সেইসব তড়পানো ব্রহ্মদত্যি কথিত মূলধারা লিখিয়েদের প্রতি মিচকি হাসি আরও সুস্থায়ী হবে, আমার ন্যায় আপনারও, আই বিলিভ। যুক্তির সঙ্গে অ্যাঙ্গার এবং খরশান দেখনভঙ্গি মিলেমিশে একটা রচনা কেমন তুখা হয়ে উঠতে পারে এর উদাহরণ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো মাকসুদুল হকের লেখাপত্র থেকেও সম্ভব দেখানো।

 

বং থেকে বাংলা, ব্যান্ড থেকে রক

ঘটনাটা, বা হালফ্যাশনের ঘাপলাটা, নামডাক নিয়া। ডাকনাম ছিল পোলার ব্যান্ডগান, বড়জোর ব্যান্ডসংগীত, খুব বেশি পাঙ্কু শ্রোতা হলে ব্যান্ডমিউজিক বলত হয়তো। তুচ্ছতাচ্ছিল্যের স্বরে কেউ হয়তো প্যপমিউজিকও বলত এমনকি নাইন্টিসের মধ্যভাগে এসেও! পোলায় এখন ডাঙ্গর হইসে, বেজায় বিদ্যাবুদ্ধির জাহাজ হইসে, কাজেই বাপদত্ত নামে স্ট্যাটাস বজায় রাখা পোলার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। পাল্টাও নাম, পাল্টাও বিশ্বাস, স্লোগ্যান পাল্টে হয়ে যাও ফিসফাস। লক্ষ করে দেখি, রক না ডেকে ব্যান্ডমিউজিক ব্যান্ডসংগীত এইভাবে ডাকার মধ্য দিয়ে সেইসময়ের অডিয়েন্স বড় একটা কাজ করেছিল, ঘরানা আত্তীকরণের কাজ, রকের নানান জন্রার মিশেলে একটা আলাদা জিনিশ হয়ে উঠেছে এইভাবে ব্যান্ডসংগীত। পরে এই নামে ডেকে ট্রেন্ডি থাকা যাচ্ছিল না বলেই হয়তো মিলেনিয়াল ব্যান্ডগুলা আর ব্যান্ডসংগীত করে না, তারা রক করে, হেভিমেটাল করে, থ্রাশ করে, এই করে সেই করে কিন্তু ব্যান্ডসংগীত নয়। একটা ব্যাপার আজকাল ভাবি যে বং থেকে যদি হয় বাংলা, তাইলে তারপরে? মানে, বাংলা থেকে কী হয়, বুড়া আংলা? আর, ব্যান্ড থেকে ম্যাচিউর মনে হয় যদি রক বলা, তাইলে রকের পরে কী বলবা? আনলিমিটেড স্টক?

 

এখন যৌবন যার…

ক্লিশে হেলাল হাফিজ ভুলিয়া যান, প্যারোডি ইজ সাপোজড টু বি দি বেস্ট ক্যাথার্সিস রাইট নাউ, ডিস্কো নাচুন। ডিস্কো। যৌবন যার, এখন, শ্রেষ্ঠ সময় তার ডিস্কো নাচবার। লেজার লাইট, ডিজে, হ্যানত্যান অনুষঙ্গের খর্চা আজকাল তো অল্প এবং লোকালয়ে ব্যবস্থাদিও অত্যন্ত অনায়াসলভ্য। সো, এভ্রিবাডি লেট’স্ ডান্স, ইট’স্ ডিস্কোটাইম, লেট’স্ বি হাই! ইউটিউবে প্যারোডি লিরিকের লারেলাপ্পা আজকে র‍্যাপ বলিয়া জ্ঞাপিত হতে দেখি।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে সেইভাবে এখনও বাংলায় ডিস্কো লিরিক্স নাই। লিরিক্স অবশ্য ডিস্কোতে না-থাকলেও চলে, লিরিক্স থাকাটা নট সো নেসেসারি, একটি বিশেষ টেম্পোর বিট বাজিয়ে একটি বিশেষ গ্রুভ ধরে ব্ব্যাস বিন্দাস শোর মাচাও ইয়ার! তবে এক-আধটুকরো কথায় ঠেস দিয়া হলেও তো কম্পোজিশন করা লাগে, যেমন বন্দিশ করি আমরা ক্ল্যাসিক্যাল ইন্ডিয়ান আপারক্লাস মিউজিকে।

সেজন্যেই বলছিলাম যে, অয়ি মিউজিকক্রেইজি মেয়েরা আমার, এখনও যদি ডিস্কোটা আয়ত্তে আনতে পারো তো ডোমেস্টিক পোলিটিক্স-ইকোনোমিক্স অত্যন্ত উপকৃত হয় তোমাদের মেধাদীপ্ত কন্ট্রিবিউশন পেয়ে। এমনকি ইন্টার্ন্যাশন্যাল স্পটলাইটটা পাবার জন্য খর্চাপাতিও করব তখন আমরা। ফান্ডিং নিয়া ভাবিও না। আই উইল মেইক ডিস্কো ডিফিকাল্ট ফর দি ডান্সার্স। মনে পড়ে, সেই পোলিটিশিয়্যান-বনতে-চাওয়া মেজরজেনারেলটিকে, সেই রোদচশমার স্মৃতি?

তিশমা বা মিলা, বা আলতুফালতু হোক যতই ফুয়াদ ইত্যাদি ফিচারিং অংবংচং, বাংলায় ডিস্কোবিট ক্যাপ্চার করতে চেয়েছেন। মৌজ হয়েছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অংশে। মেহরীন অবশ্য শুধু ডিস্কো অবস্থানের সিঙ্গার নন, একটু হলেও অধিক কিছু। ডিস্কোর আদি নমুনা নোটিস করা যাবে পিলু মমতাজ আর নাজমা জামান প্রমুখ নমস্যদের কাজে।

বেশ অনেক বছর আগে একটা-কোনো লেখায় ম্যাক তথা মাকসুদ কথাটা হাল্কা চালে উঠায়েছিলেন মনে পড়ে। সে-সময় মুরব্বিরা চারপাশ থেকে বলাবলি করছিল যে ব্যান্ডসংগীত ফোকমিউজিকের দিকে যেভাবে এবং যে-হারে নির্ভরশীল এখন তাতে এইটা নিশ্চিত যে ব্যান্ডের অন্তিম সময় যাইতেছে। ব্যান্ডসংগীত মরিয়া যাইবে। বেচারা ব্যান্ডসংগীত বেশিদিন বাঁচিবে না। ম্যাক তদুত্তরে এক্সাম্পল দিতে যেয়ে দেখায়েছিলেন যে এখনও শতপ্রকারেণ ব্যান্ড বাংলায় জন্ম নেবার অপেক্ষায়, এরই মধ্যে ডিস্কোফ্লোরে বাজানোর জোখা গানের ব্যান্ডের কথা যেমন তুলেছিলেন তেমনি মিডল-অফ-দ্য-রোড প্রভৃতি কিসিমের ব্যান্ডের নেসেসিটি বাংলায় আছে দেখায়েছিলেন।

তবে শেষরক্ষা কি হবে? যে-কারণে এখানে এখন-যৌবন-যার-ডিস্কো-গাইবার-তার-শ্রেষ্ঠ-সময় কথাটা আমরা চাইছি দেশের যুবাশ্রেণির মধ্যে জোরেশোরে প্রচারিবারে, সেই কারণজাত কর্মকাণ্ড কি বন্ধ হয়ে যাবে এই প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী ডিস্কো শুরু করে দিলে? অ্যাট লিস্ট ভাগ্নের জন্য ছোট্ট সাইকেলটি কিনে দেশগাঁয়ে ফিরতে পারবে কি নবযুবকটি? ডিস্কোই কি সল্যুশন?

বহু অতীতের একটি দিনে একবার রাহমান জিগায়েছিলেন আপন দেশমাতৃকারে, সেই এক ঘোর অন্ধকারের ক্রান্তিকালে, ধেই ধেই নেচে কোমরের কাপড় তুলে সে কোথায় চলেছে কোন বিরানায় আজদহা অতিকায় গহ্বরের পানে, ফেরার আহ্বানও জানিয়েছিলেন কবিতাটিতে। বেঁচে নেই তিনি। কিন্তু কবিতাগুলো বইতেই আছে। বেঁচে আছে কি না, নাকি তারা বইয়ের ভিতরেই নির্জীব মৃত, খুঁজে দেখা হয় নাই। খুঁজিবার ফুরসত কোথা পাই, বাছা, তিনইঞ্চি নিকটেই নিহিত চাপাতি, তাক-করা আমারই দিকে ব্যারেলে-তেল-মর্দানো বন্দুকের বুলেটগর্বিত মুখ।

তবে কি কিটসের পঙক্তিটাই রিয়্যালিটি অধুনা? ভাবনাচিন্তা আলগোছেও প্রকাশ করা মাত্রই যেখানে ভাবনাপ্রকাশকারীটিকে বেদনায় বিদ্ধ হতে হয়? বিপন্ন হতে হয় জিন্দেগি-বন্দেগি তার? হতে হয় ঘুমাতে যাবার আগে ঘাতকের শিকার? তিরিশজনকে দেশ ছেড়ে যেতে হয়, অ্যাসাইলামের সেল বর্ধিত করার তোড়জোড়ও সুসম্পন্ন হয় মানবতাচৈতন্যধারী বিদেশের সদয় উদ্যোগে, এই পথেই মুক্তি তবে? হ্যাঁ, নির্বাসন নন্দিত অতি এই দেশে, য পলায়তি স জীবতি। বাসী হলেও ফলে বটে পুরাণের কথা! আজ্ঞে, কত্তা!

আহ্! বুলবুলি পাখি ওগো! কোথা যাই, কি করি আমি, গিয়া কারে-বা নালিশ করি বলো? … where men sit and hear each other groan; / Where palsy shakes a few, sad, last grey hairs, / Where youth grows pale, and spectre-thin, and dies, / Where but to think is to be full of sorrow … অতএব, ঠিক করেছি, ডিস্কো নাচব, ডিস্কো গাইব। বাঁচতে পারব? বাঁচো, বাপ, যতদিন পারো, তবে নিজ দায়িত্বে। ব্যান্ডমিউজিকের নামে স্রেফ চোস্ত্ পোশাকপরা গানাবাজানা গাওয়ায় ক্ষান্ত দাও, দোহাই, অতীতে ব্যান্ডধারায় কেমন রগত্যাড়া কারবার ছিল, কোথায় কেমন অ্যাঙ্গার মেনিফেস্ট হয়েছে, এইসব বুঝেশুনে এগোনো চাই, ক্লিয়ার? ওভার অ্যান্ড আউট।

 

ম্যাকের খোঁজে জ্যোছনায় এবং ব্যান্ডগানে সর্বনাম তথা আমি-তুমি

ফিডব্যাকের একটা গান আছে এই গীতিপঙক্তি নিয়া — ‘বন্ধুর খোঁজে জ্যোছনায়’ — মাকসুদ দল থেকে ক্যুয়িট করার পর যে-কয়টা নাম্বার, কড়ে-গোনা গুটিকয় অবশ্য, ফিডব্যাকের পূর্বসুনাম মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল, এই গানটা তাদের মধ্যে একটি। কিন্তু ম্যাক ছাড়া ফিডব্যাক  কল্পনা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখনও হয়নি, আজও নয়; একাধিকবার ভোক্যাল পাল্টানো পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়া ফিডব্যাক  চেষ্টা করেছে দাঁড়াইতে, দেখেছি আমরা, পারে নাই। বিভিন্ন উৎসবপার্বণে এতাবধি ফিডব্যাকের মঞ্চপরিবেশনায় ভিন্ন ভোক্যালের কণ্ঠে-রেন্ডিশনে-জেশ্চারে এবং বডিল্যাঙ্গুয়েজে আমরা ম্যাকেরই জীবন্ত ছায়া দেখতে পাই। ফিডব্যাক মানেই কিন্তু ম্যাক নয়, এইটা জানা থাকা সত্ত্বেও ফুয়াদ নাসের বাবু বা লাবু রহমান বা পিয়ারু খান নিজেরা ম্যাকস্মৃতি কাটায়ে উঠতে পারেননি, আমরাও পুরোটা পারি নাই। কিছুদিন রেশাদকে চেষ্টা করা হয়েছিল, কিছুদিন পিয়াস নামে একজন, বেশ স্পন্টেনিয়াস পার্ফোর্ম করছিলেন তারা, ব্যান্ডের টোট্যাল স্পিরিটটা যদিও যুৎসইভাবে তারা পারছিলেন না ধরতে, ম্যাকের ম্যানারিজম ও গায়কীর ভিতর তাদেরে চাপা পড়তে দেখা যাচ্ছিল। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, জেশ্চার ইত্যাদি সর্বত্র বড় বেশি ম্যাকের ছায়া। কাজেই ফিডব্যাক অক্যাইশন্যালি কিছু সুন্দর গান করলেও শ্লথ হয়ে পড়ে ব্যান্ডের গতি। বিটলস  যেমন প্রত্যেককে নিয়েই বিটলস, ফিডব্যাকও তেমনি। ফিডব্যাকের ক্রেইজ আমাদের সময়ে কেমন ছিল, তথা মাকসুদের ক্রেইজ, কোনোদিন এই স্মৃতি নিশ্চয় কেউ চারণ করবেন। তবে এখানে একটা কথা বলেই প্রসঙ্গান্তর হওয়া যাবে এখন। ফিডব্যাক থেকে ম্যাকের বেরিয়ে আসা, বেরিয়ে এসে সোলো ক্যারিয়ার না-নিয়ে নয়া ব্যান্ড গড়া, এইটা কি ম্যাক ও ফিডব্যাকমেম্বারদের মধ্যকার আমিত্বদ্বন্দ্ব? যে-কোনো ইউনিটি ভাঙার ক্ষেত্রে যে-দ্বন্দ্ব মুখ্য মনে করা হয় সাধারণ্যে। এক-অর্থে ব্যাপার কতকটা তা-ই, কিন্তু খুলে বললে এর পেছনকার কিছু গর্ত-ফোকর বোঝা যাইতেও পারে। এইটা আমিত্বের দ্বন্দ্বসংঘাত হিশেবে দেখিয়ে যেই মিনিং প্রেজেন্ট করা হয়, কিংবা আমরাই করে থাকি, এর মধ্য দিয়া আমির বিকাশটা আমরাই নিরুৎসাহিত করি। ফিডব্যাকের ভাঙন, মনে হয়েছে যে, ব্যান্ডমেম্বারদের সকলে সমানভাবে যার যার আমিটাকে আইডেন্টিফাই করতে না-পারার কারণে উদ্ভূত সঙ্কট। ম্যাক চেয়েছেন পোলিটিক্যাল টোনের গান গাইতে, কন্টেম্পোরারি একটা ভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন গানে, একটা স্পার্ক, স্টার্কিং স্পার্ক, একটা ঝাঁকুনি। ফিডব্যাক  চেয়েছে স্রেফ গানের জন্য গান বানাইতে, মানে প্রেমট্রেম দিয়া ক্রেতা বাড়াইতে, এইসব আমরা নানাভাবে জেনেছি তখনকার পত্রপত্রিকায়। এখন, দিনাবসানে দেখা গেল যে ম্যাক খানিকটা আপন আমিটাকে পেরেছিলেন লোকেইট করতে। বঙ্গাব্দ ১৪০০  সংকলনের অভাবিত সফলতার পরও ফিডব্যাক ভাবতে পেরেছে যে তারা ক্লাসপালানো জুটি-যুগলের প্রেমগান সাপ্লাই দিবার ব্যান্ড, এইটা ভাবতে এখনও অবাক লাগে। এর আগের ফিডব্যাকপথচলার গ্রাফ নজর করে দেখা যাবে যে আগাগোড়া ফিডব্যাক কিন্তু পোলিটিক্সটাকে এনেছে গানে, চেষ্টা করেছে আনতে, সেই ৮৮-র বন্যাপরবর্তী জোয়ার, বা মেলা  সংকলনের গানগুলো, সবখানেই এর প্রমাণ হাজির। সমস্ত গানই কিন্তু জনপ্রিয়ও হয়েছে। প্রেমের পুতুপুতু লিরিক না-হওয়া সত্ত্বেও এই দেশে একটা ব্যান্ডের এমন জনপ্রিয়তা, স্টেইজ্ পার্ফোর্ম্যান্সে ক্রেইজ্ তৈয়ার করা, চাট্টিখানি কথা নয়। এরপর বঙ্গাব্দ ১৪০০, অবিভক্ত লাইনাপের ফিডব্যাক  থেকে শেষ পূর্ণাঙ্গ মৌলিক গানের সংকলন, (যদিও ‘দেহঘড়ি’ এবং ‘বাউলিয়ানা’ পাব্লিশ্ হয়েছে এরপরে, ফিডব্যাকের আরও একজোড়া ম্যাসিভ হিট, যেইগুলা আদৌ মৌলিক সৃজন তো বলা যাবে না) বাংলাদেশের অডিওইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ চূড়াস্পর্শী। কিন্তু এমন তো না যে ফিডব্যাক  প্রেমলিরিক রাখত না তাদের সংকলনে। রাখত, এবং দুলিয়ে দিত আমাদেরে। সেই ফিডব্যাকের পয়লা আমলের ভোক্যাল্ রোমেল থাকাকালীন “কেন খুলেছ তোমার ওই জানালা / কেন তাকিয়ে রয়েছ জানি না তো / মনে যে কী আছে জানি না / আমি না-জেনে সে-কথা যাব না, না, ফিরে যাব না” ইত্যাদি আমরা হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্টে আরোহনকালে গেয়েছি দিবারাতি। কিংবা মাকসুদের ‘ডাকপিয়ন’, ‘মৌসুমী’, ‘জীবনজ্বালা’, ‘ফিসফিস’ ইত্যাদি অনেক গানই তো আমাদের প্রেমে ফ্যুয়েল যুগিয়েছে সেইসময়। এতদসত্ত্বেও ফিডব্যাক সেই-অর্থে প্রেমগানের দল ছিল না, মাইলস  ছিল যেমন, বা সোলসউইনিং  প্রভৃতি। ফিডব্যাক,  কাজেই, নিজের জায়গাটা ডিটেক্ট করতে ব্যর্থ হলো। মাকসুদ কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন নিজের শনাক্ত-করা আমিটা আদৌ-যে ভুল ছিল না তার, যদিও অল্পকালের মধ্যেই মাকসুদের ক্যারিয়ার ধসে যেতে দেখি আমরা, ‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ সংকলনে ম্যাক তার জেদ ও জজবাতিয়ার দুর্ধর্ষ প্রকাশ ঘটায়েছিলেন। এরপরেও ‘ওগো ভালোবাসা’ বা ‘মাআরেফাতের পতাকা’ নামের দুইটা ভালো সংকলন করেছিলেন। ফিডব্যাক  কিন্তু ম্যাকবিহীন নির্বীষ প্রেমগানে এক/দুইটে অ্যালবাম বের করেছে, এক/দুইটা সুন্দর গানও পেয়েছি, ব্ব্যাস। কথা হলো, ধুঁকে ধুঁকে ক্যারিয়ার চালানো, অথবা তার-তন্তু-খুঁটি ছিঁড়ে ফেলা ক্যারিয়ারের, ইফ নেসেসারি, কোনটা আপনার স্বভাব চাইছে প্রেফারেন্স দিতে। সেই-মোতাবেক আপনি আপনার আমিটার কথা শুনবেন, সায় দেবেন, মদত যোগাবেন, বা টুটি টিপে ধরবেন। আর, আপনি যদি শিল্পী, ক্যানভ্যাসের বিধবাথানের ন্যায় নির্বর্ণ পটের পানে একবার দৃষ্টিপাতেই আপনি মিউজিক শুনতে পান অনাগত মূর্তি-বিমূর্তিচিত্রের, কাজেই আপনি জানেন যে, আমির ভেতরেই সে, “তোমার ঘরে বাস করে কারা”, এবং করে কয়জনা তার ইয়ত্তা তো নাই, কিন্তু একজনে ছবি আঁকে এবং আরেকজন মন্দিরাতে তাল তোলে, এবং নট আনলাইক্লি যে একজন হয়তো বসে বসে ফেসবুকে কমেন্ট ঠুকে এর-ওর লেজে আগুন দিতে এবং পাকায় সিন্ডিকেটের ঘোঁট। তো, এইসব তো আছেই। কিন্তু আপনার ভেতরে ধরেন মেফিস্টোফেলিস ও ফাউস্ট দুইজনেই তো আছে, বিরাজে সর্বদা তারা, এখন যদি মেফিস্টোফেলিসের প্রাধান্যবহ হন আপনি, তাহলে ফাউস্ট কন্ট্রোল করুন। রবীন্দ্রনাথ আত্মপরিচয়  প্রবন্ধে একটা বাক্য ছুঁড়েছিলেন এই বলিয়া : সাহিত্য রচনায় লেখকের প্রকৃতি নিজের অগোচরে নিজের পরিচয় দেয়। এখন, গুরুবাক্য শিরোধার্য করে এর এক্সটেনশন ঘটিয়ে দেখুন, কোনোকিছু রচনাকালে আপনি আপনার ন্যাচার/প্রকৃতি হাইড করতে পারবেন না, তা আপনি চেষ্টা যত-যা-ই করুন। লুকাতেই যখন পারছেন না, তাহলে এত লুকোছাপা কেন! ভণ্ডামিকীর্ণ বঙ্গসাহিত্যমত্ত প্রবন্ধে-নিবন্ধে এত নৈর্ব্যক্তিকতার ব্রাহ্মণ্য জিকির কেন! মালুম আল্লা। আপনার ভেতরটা যদি হয় সাব্জেক্টিভিটির বারামখানা, তাইলে যে-অব্জেক্টিভিটি আপনি পয়্দাইবেন তা ফার্স না-হলেও ভার্স হবে না। তারচেয়ে এই আমিটাকে ব্যেটার ট্রিটমেন্ট দিন, নার্চার করুন, বিচিত্র সব শেইড ও ডায়মেনশনের আমি  উৎসারিত হবে। অজস্র কনফিডেন্ট কালার, স্ট্রোক, ব্রাশের ট্যুয়িস্ট। রবীন্দ্রনাথকে খেয়াল করে দেখুন, কতশত রঙবাহারী আমির উৎসার রবীন্দ্রকবিতায়-গানে-গল্পে-প্রবন্ধে-চিঠিপত্তরে! দুনিয়ার কান্ধে ভর রেখে আপনি লিখতে যান যদি, অন্যের স্কন্ধে বন্দুক রেখে শিকার করার নিগেটিভ লোকবচন মনে রাখুন, লিখতে নিশ্চয় পারবেন, বাহবাও কুড়োবেন, তবে রবীন্দ্রনাথ বা গ্যেটের ন্যায় বিস্তারী দৃষ্টি পেতে ও ব্যাপ্তভুবনের কাজকর্ম রেখে যেতে হলে আপনার আমিটাকে বাহন বানাতে হবে। সে-ই বয়ে নেবে আপনাকে। দেখুন, ইন্টারেস্টিং না! আমি  কেমন করে এক-লহমায় সে  হয়ে যায়! এখন, আপাতত, আমিসে  দ্বৈরথ মুলতবি রাখা যাউক। ওয়েল, ভুলেই গিয়েছিলাম, এ রাম, ওদিকে তুমি আবার মুখ-গণ্ড ফুলিয়ে ফেলো নাই তো! দ্যাখো, তুমি  তো বাজারের ভিড়ে আলোচ্য নও। তুমি  ইজ ড্রিমপ্রিন্সেস, ল্যান্ডলেইডি অফ মাইন, তোমারে নিয়া তাজমহল ও কবিতা হয় সিন্স ডন টু ডাস্ক। তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমারও সাধেরও সাধনা, মম আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করে চলেছি রচনা প্রতিদিন, প্রতিটি অক্ষরে, প্রতি পদক্ষেপে আমার। তুমি তো আমিই, তাই না? রাগ করে না, সোনা, এভাবে রাগ করে রোজা রাখলে তো রোজাও কবুল হয় না। তা, তোমারে হাটে বের করা মাত্রই তো পাবলো নেরুদা এসে চুরি করে নে যাবেন, এই ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকি। টোয়েন্টি ল্যভ স্যংস্ অ্যান্ড ওয়ান অফ ডিস্পেয়ার  বইয়ের সুশোভন পৃষ্ঠায় তোমারে নিয়া রাখবেন তিনি। কাজেই ইট ইজ্ বেটার অ্যান্ড সেইফ দ্যাট তুমি রহো হৃদয়ে মম। তুমি তো নোটের না, কবিতার, ভালো ভালো ঘরের কবিদের কাব্যগ্রন্থের, তুমি সংগীতের, তুমি মিউজিক্যাল অপেরার, তুমি ইনবক্সের। তোমার গরিমা তুমি নিজেও তো জানো না। আমিও যে জানাব তোমারে সেই তৌফিক আল্লা আমারে দিচ্ছি-দিব করেও দিতেছেন না। আমার তো অবস্থা প্রায় জ্ঞানকপর্দকহীন। গব্বর সিং বলতে পারো বড়জোর, লিমিটেড ভোক্যাব্যুলারি ও ডায়লগ, ইয়ে হাত মুঝে দ্যে দে ঠাকো, আর ব্ তেরা ক্যায়া হো-গা রে কালিয়া …

 

মুক্তডানা ব্যান্ডবাদ্য বনাম অন্ত্যমিলাবদ্ধ কবিতাকাঙাল আধুনিকত্ব

দুনিয়ার সমস্ত মধু শুধু অক্ষর গলাধঃকরণের মধ্যেই নিবদ্ধ নেই মর্মে যারা আস্থা রাখেন তারা জানেন যে গান কখনো কবিতা নয়। গানের একটা ডেলিবারেইট চেষ্টা যদি না-থাকে কবিতামতো বস্তু হইবার নিয়তি প্রত্যাখ্যানের, তাহলে যা হয় তার নজির আমরা দেখেছি বিগত অর্ধশতাব্দীর ইন্ডিয়ান বাংলা গানে। ‘জীবনমুখো’ অথবা ‘আধুনিক’, ব্র্যান্ডনেইম যা-ই হোক, ভূভারতের বাংলা গানে ব্যামো হিশেবেই লেপ্টে আছে আজও অন্ত্যমিলাবদ্ধতা। ব্যাপারটা জলাবদ্ধতার চেয়েও অসহনীয়। শুরুতে বেশ পিক্নিক ম্যুডে ম্যাটারটা মানতে পারলেও অচিরে আপনে টের পাবেন এই জীবনমুখা/আধুনিকঝোঁকা ভারতীয়া গানাবাজানা আদতে একটা জায়গাতেই পেখম খুলছে পেখম বুঁজাচ্ছে। একটানা কয়দিন একটা মানুষ, বলেন তো, জলাবদ্ধ বনস্ফূর্তি নিয়া বাঁচতে পারে? এই মুখস্থ ময়ূরের পেখমখোলা নাচাগানাহাসাকান্না ভারতের সঙ্কীর্ণ ও পরাধীনতাজাত কমপ্লেক্স-মাইন্ডসেট-উদ্ভূত ক্ষুদ্র বঙ্গাংশের পপ্যুলার কালচারাল উৎপাদপণ্যগুলোকে একেবারেই নিঃশেষে ভ্যানিশ করে দিতে লেগেছে। এই নিঃশেষাবস্থা আপকামিং দিনগুলোতে আরও স্পষ্ট হবে আশা রাখি।

বিরাটবপু ভারতদেশের ছোট্ট ফুটকির মতো অপাঙক্তেয় অঙ্গ ওয়েস্টবেঙ্গল বর্তমানে শেষ মরিয়া চেষ্টাটা চালাইছে এই বিশাল বাংলাদেশের একটা কোনায় একটু গমের বস্তা বিছাইয়া বাজারের আসনব্যবস্থা লাভ করতে। ‘অভিসন্ধিতে লিরিকে’ শান দিয়া ফায়দা নাই, লিরিকের মধ্যেই শিরদাঁড়াসমস্যা, বিষয়টা বুঝতে হবে দাদা। আজকের ইন্ডিয়ান বাংলা বাজারে ‘সেরা’ কবি কে? কেন ভাই, শ্রীজাত! আচ্ছা। আজকের ইন্ডিয়ান বাংলা বাজারে সেরদরে ‘শ্রেষ্ঠ’ সংগীতশিল্পী কে? কেন ভাই, অনুপম! বুঝে দেখেন অবস্থা। ভারতীয় ক্ষুদ্রবঙ্গের কবিতা এবং গান উভয়েই সেকেলে ‘স্বর্ণযুগ’ নিয়া দাদাগিরি ফলাতে না-পেরে এমন “উন্মাদ, ক্ষিপ্ত, রিক্ত, পথ চেনা নেই” সিচ্যুয়েশনে প্রায় নেঙ্গুটিয়া পাগলবদ্ধ দশা।

‘আধুনিক’ ইন্ডিয়াবাঙালি ‘জীবনমুখা’ গানে কবীর সুমনের কবিতাপশ্চাদ্ধাবনে সেই জিনিশগুলা আর-যা-হোক কবিতা যে হয় নাই কথাটা পাঁড় ক.সু.ভক্ত ব্যতিরেকে সকলেই স্বীকারিবে। এর কুফল হয়েছে যেইটা তা আমার নজরে এ-ই যে, জয় গোঁসাইয়ের পরে ইন্ডিয়াবাংলার কাছাখোলা বাজারে একমেবাদ্বিতীয়ম পোয়েট অন্ত্যমিলচটুল চটপটি শ্রীজাত। অন্যদিকে ইন্ডিয়াবাংলার গানে অনুপম রায়ের মিষ্টি পিরিতপণ্য উৎপাদনের দেদার কাটতি। ইন্ দি অ্যাবাভ সার্কাম্সটেন্সেস না-হলো কবিতার বিকাশ তাদের, না-হলো গানের। ফলে, এই অন্ত্যমিলানুশাসনের ব্যাপারটাকে মহাকবিতা ও মহাগান মনে করবার জগদ্দল চৈতন্যদর্শনসঞ্জাত ভ্রমের কারণে, গ্রেইট ইন্ডিয়াবাংলা গান ও কবিতার ফ্লাইট আজি বিপর্যস্ত। ধুঁকে ধুঁকে বত্তমানে প.বঙ্গ মরন্ত। দুঃখ। মুখ-থুবড়ে বেচারাদিগের ন্যাজেগোবরে অবস্থা। বাংলাদেশে এই অবস্থা ভাগ্যিস হয় নাই। বিগত বছর-পঞ্চাশের বাংলাদেশে ব্যান্ডগান সহস্র অনবধানতা আর ইম্যাচিয়্যুরিটির পরেও এই জায়গাতে গ্রেইট। হয়তো অজান্তেই জিনিশটা ঘটে গেছে এদেশের কালেক্টিভ কপালে। একদম অনায়াসলব্ধ ঘটনাটা, বা দৈবের বশে পেয়ে যাওয়া, ব্যাপার মোটেও তা না। আপাতত মুলতুবি থাকুক এতদপ্রাসঙ্গিক আলোচনা।

 

অন্ত্যমিলধস্ত আবহমানতা এবং বাংলাদেশজ ব্যান্ডগানের ব্যক্তিত্বসংহিতা

ব্যান্ডগানে অন্ত্যমিলানুবর্তন নাই, এইখান থেকে একটা আলাদা নোক্তা বার করে ফের কথা চালানো হতে পারে। ইন ফিউচার। এবং ব্যান্ডগান/রকগান বলতে এতদঞ্চলে শ্রীলঙ্কা বা থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর বা ইন্ডিয়া না; ব্যান্ডগান/রকগান বলতেই বিগত চারদশক ধরিয়া বাংলাদেশ বোঝায়, নিপলচোষা বাচ্চালোকটিও জানে এইটুকু তথ্য। ওভারনাইট অর্জিত হয় নাই এটুকু। অনেক ফ্যুয়েল্-ফ্যসিল্ পুড়িয়ে শেষে এহেন অর্জন হয়েছে সঞ্চিত। ফলে ডেলিবারেইটলি বিস্তর গঞ্জনা সয়েও বাংলাদেশের ব্যান্ডগান আলাদা ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পেরেছে। যে-ব্যক্তিত্ব ইন্ডিয়াবাংলার কথিত ‘রক’ রুপম ও তদানুসৃত গং অর্জিতে ব্যর্থ, সোজা কথায়, লম্ফঝম্প-করা হাজার অনুষ্ঠানান্তে।

একলপ্তে ইন্ডিয়াবাংলার যে-কয়টা ব্যান্ডের নাম আপনে নেবেন, সেগুলো যা পয়দা করে চলেছে সেসব সুমন ও নচি প্রমুখ একলাই ভীষণ শক্তিমত্তাবহ করে রেখেছেন আগেই। ইন্ডিয়াবাংলায় ব্যান্ড/রক বিষয়ক হুজুগে সেন্স কেমন, চটজলদি এর একটা উদাহরণ দিতে যেয়ে মনে পড়বে যে এককালে লোপামুদ্রা মিত্র দুম করে একদিন একটা ‘ব্যান্ড’ বানায়ে ফেলেন। অনেক মনন ও আবেগ লগ্নি করেও বুঝে উঠতে পারি নাই উনার সোলো আর দলগত পরিবেশনার ডাইমেনশন্যাল্ ডিফ্রেন্সেস্। লোপা নিজেও হয়তো অচিরে এই জিনিশ বুঝে কিংবা না-বুঝেই মাথার বায়ু নেমে গেলে ফের রাবীন্দ্রিকতায় ফেরেন। শুধু লোপা নন, সেইসময় একা-একা গাইয়ে হিশেবে সুমন-অঞ্জন-নচি-মৌসুমীর সঙ্গে এঁটে উঠতে না-পেরে এবং বাংলাদেশের সাফল্য দুইদিনেই বিনা আয়াসে হাসিল করা সম্ভব ভেবে নিয়ে ‘ব্যান্ডবাজি’ শুরু করেন অনেকেই। হিড়িক পড়ে যায় ইন্ডিয়াবাংলায়, সেই-সময়, ব্যান্ড গঠনের। পরে ব্যান্ডচালনার শারীরিক শ্রমবিনিয়োগের ব্যাপারটায় ভড়কে যেয়েই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে ফের হার্মোনিয়্যম কোলে তুলে নেন সকলে। এবং প্রকাশ্য জনসভায় স্বীকার না-করলেও বুঝতে নিশ্চয় সক্ষম হন যে বাংলাদেশের ব্যান্ডসাফল্য দুই-তিনসন্ধ্যায় হাসিল হয় নাই। ইন্ডিয়াবাংলায় ‘একলব্য’, ‘ক্যাকটাস’, ‘ফসিলস’, ‘পরশপাথর’, ‘আগন্তুক’ প্রভৃতি তিনদশকে-গড়ে-ওঠা প্রায় তিন-আঙুলে-গণনীয় দলগত সংগীতানুশীলনের ইতিহাসে এক ‘চন্দ্রবিন্দু’ ছাড়া আর-কেউ সংগীত সৃজনে এবং পরিবেশনায় ব্যক্তিত্ব অর্জন করে উঠতে পারে নাই। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ অন্য একটা কারণে এই হিসাবখাতার বাইরে রেখে যাওয়া যাচ্ছে, ব্যাখ্যা না রেখে, আপাতত।

অত লম্বাচওড়া বাতচিতের শেষে অতীব দুঃখের সঙ্গে আপনাকে কবুল করতেই হবে যে বাংলাদেশের ব্যান্ডগান তার ছেঁড়াফাটা স্যাডলব্যাগে ঢের মালমাত্তা নিয়াও দিনশেষে ব্র্যান্ডিং করে উঠতে পারে নাই ঠিকঠাক। কেন পারে নাই, নেপথ্যে নয়শত নিরানব্বই কারণ থাকলেও একটা খাসলতগত কারণ অধুনা আরেকবার আমাদিগের সামনে এসেছে। সেই দুঃখে বেদনার নদী বইয়ে দিয়ে ‘এই রাত তোমার আমার’ নষ্ট করার দরকার নাই। কিন্তু কথাগুলো বলতে হবে একদিন। কোলরিজের সেই অ্যানশিয়েন্ট ম্যারিনারের ন্যায় বিবাহভোজসভায় আগন্তুক ‘মদিরা-চালে’ ভেসে ভেসে বেড়ানো নরনারীদিগের ‘কামনা-বাসনা দুরন্ত’ পথচলা অ্যাব্রাপ্টলি থামায়ে দিয়ে তাদের কানে ঢেলে যেতে হবে এই দিনগত পাপক্ষয়ের খতিয়ান। শুধু নোক্তা হিশেবে এইটুকু বর্তমানে বলে রেখে যাওয়া যাক যে ওয়ারফেজের এই ‘পথচলা’ গানের লিরিক্সে যে-অন্ত্যমিল দৃষ্ট তা বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে সর্বত্র দৃষ্ট নয়। বাংলাদেশের ব্যান্ডগান মূলত গদ্যকাব্যিক। অনেকানেক ইম্যাচিয়্যুরিটি সত্ত্বেও গদ্যস্পন্দে ব্যান্ডগান বাংলাদেশের এমনকি ইয়াং কবিদেরেও প্রথমাবধি উদ্বুদ্ধ করে এসেছে ট্র্যাডিশন ও কনভেনশনের বাইরে থেকে দেখতে জগতটারে। যেটুকু অনিয়মিত অন্ত্যমিল উপর্যুক্ত কথাভাগে দেখা যাচ্ছে, ব্যান্ডের বাংলা গানে এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট দশা আমরা আগা থেকে গোড়া অব্দি নিরখিয়া যাই। ছিল না ‘আধুনিক’ বাংলা কাব্য হইবার উদ্ভট ও অদ্ভুতুড়ে খায়েশ বাংলাদেশের ব্যান্ডগানের; ছিল না বলেই নির্দ্বিধায় ব্যান্ডগানে ‘মোর’, ‘মোদের’ প্রভৃতি সর্বনামপদ নির্ভার-নির্বিকার ব্যবহৃত হয়েছে এবং উহার ফলে বাংলা আবহমানতায় পালক যুক্ত হয়েছে অন্যতর। প্রসঙ্গটায় প্রত্যাবর্তন করা যাবে একদিন নিশ্চয়। এতাবধি ফি-আমানিল্লা। মাইলস টু গ্য বিফোর য়্যু এনস্লেইভড বাই ইন্ডিয়াবাংলা, মাইন্ড ইট ব্রো! ওয়েল, য়্যু নো সিস্, মিউজিকের নামে প্যারোডিমেইকিং কোয়ালিটি দিয়া বড়জোর তুমি হতে পারো নচিকেতাস্টাইলের কপিক্যাট ডিস্কোড্যান্সার ফসিলস। ওই হালুয়া আমরা খাই না। সাল্সা ধারার প্রবর্তনায় বাংলা সাউন্ডস্কেপে একটা হাল্কাপাৎলা স্বাদবদল একদা আনিয়াছিল বলিয়াই মাইলস মিয়াদিগেরে এখনও বর্তনের কোনায় খেতে বসে রেখে দিতে চাইব। অন্য গল্প অন্যসময়ের জন্য রইল তোলা।

 

রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০, ২০২০, …আদিম দেওদানোর আবর্তন

‘(অ)প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ’ অ্যালবাম রিলিজের অব্যবহিত পরে ম্যাক ঘোষণা করেন তাদের পরবর্তী প্রোজেক্ট ‘রাষ্ট্রক্ষমতা ২০১০’, কাজ চলছে, শিগগিরই বেরোবে। তখন সাতানব্বই সাল। ১৯৯৭। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এখন সতেরো সাল। ২০১৭। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এবং রাষ্ট্র ক্রমশ সঙ্কীর্ণ। অসহায়। চারিদিকে কেবলই ভিশন টোয়েন্টিফোর্টির গমগমা আওয়াজ শোনা যায়। আর কোনো ক্রন্দন কোনো নবতর নন্দন শ্রুতিদৃষ্টিসীমানায় নাই। রাষ্ট্রক্ষমতা আপাতত ২০৪০ পর্যন্ত জনগণের হাতছাড়া। মাকসুদের পূর্বঘোষিত সংকলনটা আর আলোর মুখ দেখে নাই। তথাপি নব্বইয়ের বাংলাদেশ মাকসুদের গানে ব্যাপকভাবে মেলে। যেমন নব্বইয়ের ব্যান্ডের গানে তৎপর্যন্ত বাংলাদেশের হাজিরা পাওয়া যায়, অ্যাবান্ড্যান্টলি পাওয়া যায়, ক্ল্যাসিক ও পপুলার আর্টফর্মগুলোর ভিতরে ব্যান্ডগানেই হৃদিধকধকা বাংলাদেশটাকে সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে মেলে। এই একই কথা নব্বই-পরবর্তী ব্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রে একদমই বলা যাবে না। বাংলাদেশের দুইহাজার-পরবর্তী মিউজিক, রক হোক বা ননরক ফোক ক্ল্যাসিক, কোনদিকে গেল অনুসন্ধান করে দেখবার মতো ব্যাপার। তবে দেড়দুই ব্যতিক্রম বাদে গেল-দুইদশকের গানে বাংলাদেশের হাজিরা ঝাপসা প্রায়। এর মধ্যে নেমেসিসের ‘গণজোয়ার’ বা আরও অমন কিছু ব্যক্তি বা ব্যান্ডের উদাহরণযোগ্য উদ্যোগ বাদ দিলে এখানকার ব্যান্ডগুলার গানে এখন আর সমকাল গ্র্যাব করবার গরজ দেখা যায় না বেশি। কীভাবে বেরোবে তবে নতুনের আওয়াজ? নতুন নিশানা? বাংলাদেশ ক্যাপচারে ব্যান্ডগুলো ক্রমে ব্যর্থ হচ্ছে, ম্যাক ও তার সতীর্থরা কামিয়াব হয়েছিলেন। সেই কামিয়াবির লিনিয়ারিটি থেকে বেরিয়ে একটা মাল্টিলিনিয়ারিটির দিকে যেতে পারবার কথা ছিল পরবর্তীকালের ব্যান্ডগুলোর, পারে নাই যেতে। এখন বোধহয় হিপহপ গ্রুপগুলোর হাজিরানায় একটা ভাঙাচোরা বাংলাদেশের ধুকপুকটুকু শোনা যায়। এভাবে চলতে থাকলে এককালের গণপ্রতিরোধের ভাষা ব্যান্ডমিউজিক ক্রমে সেকেলে ও গণবিচ্ছিন্ন বনেদিয়ানার গালগপ্পোগরিমার জিনিশ হয়েই ইতিহাসে বিরাজিবে। ব্যান্ডমিউজিক সময়ের সংক্রামে সাড়া দিয়ে আরও প্রম্পট আরও শার্প হতে না পারলে একদিন তার গরিমার কন্টেম্পোরানিটি হারাবে।

 

আন্দোলিত সময়, ফিডব্যাক এবং সময়নির্মাতা ব্যান্ডম্যুভ

“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় — বিচ্ছেদ নয় / চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন-ছিন্ন-করা আর্ত রজনী / চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে / আমার না-থাকা জুড়ে।” — এই রুদ্ররচিত কবিতাটা আর ফিডব্যাকের ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ তো অবিচ্ছেদ্য। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এইটা আবৃত্তি করেছিলেন ওই অ্যালবামের ‘পালকি’ গানটার সঙ্গে। “এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে / দেহের মাপের মাটির ঘরে শুতে হবে”  … ইত্যাদি ছিল মুখড়া সেই গানের। শম্ভু মিত্র ছাড়া এই একজনের আবৃত্তি তখন মন্দ লাগত না তাদের নাট্যন্যাকামিবিহীন যথাস্বাভাবিক পড়ার গুণে। সেই সময়টায় তো বাংলার দেশে এবং বাংলার বিদেশে গাদাগুচ্ছের লোক রোজ বিকেলে একটা করে আবৃত্তির ক্যাসেট বের করছিল। মজা করে হেঁকে বলতাম আমরা, আমাদের আড্ডা-ইয়ার্কিবিলোড়িত সন্ধ্যাগুলোতে, — দোস্তো, ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা আমায় বলেছিল’ অথবা ওই ‘বাসন্তী এখন ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী হয়েছে’ এই দুইটার একটা এট্টু সুরেলা কইরা আবৃত্তি করো দেখি! তয়, ইয়ার, সর্দিটা এট্টু বাড়ায়া দিও কইলাম! সর্দি ছাড়া হার্ড করা যায় না আবৃত্তি, মিউজিকের কাম করে কবিতা-আবৃত্তিতে এই সর্দি, জিনিশটা খারাপ না কিন্তু! কড়া কৈরা সর্দি মাইরা কবিতাটা কৈরো কইলাম, কিপ্পন্ন/কার্পণ্য কৈরো না। তাতে কাজ হইত কখনো, সর্দিসন্ধ্যা জমিয়া উঠিত, যথাযোগ্য ওয়াহ-ওয়াহ ক্যায়া বাত প্রভৃতি সমুজদারি হাস্যহর্ষ সমেত। কখনো কেউ কেউ, কোনো কোনো বন্ধু, বৈকালিক ডেটিঙকালীন উদ্ভূত অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা-হেতু কবিতাপাঠকালীন সহসা পূর্ববিজ্ঞপ্তিহীন অতি সিরিয়াস হয়ে গেলে একটা ক্যাঁচাল-যে একেবারেই বাঁধত না তা নয়। সেইটা সামলাতে একটা আলাদা ম্যাকানিজম নিতে হইত বটে। অ্যানিওয়ে। সেই সময় বিএ ফেল করে লোকে পেরাইভেটে দেদারসে এমবিএ করছিল, গজিয়ে উঠছিল মোড়ের কিনারে কিনারে একেকটা আজব কিসিম পাড়াবিদ্যালয়, যেখানে কেতাদুরস্ত বস্ত্র ও বিজলিবাত্তি দেখতে দেখতে আমরা আমাদের সারাদিনের ষণ্ডামি সেরে ডেরায় ফেরাকালে সান্ধ্য চুরট-চা চাবাইতাম চারজনপ্রতি একটাই হিস্যা ভাগ করে, এই বিদ্যালয়গুলো ক্রমে ভুবন-মশহুর বাংলাভোলানো বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপলাভ করিল। পথ যত বন্ধুরই হউক, উস্তাদ, আগে বাঢ়ো! মঞ্জুরি কমিশনগুলা আছে কেন, বসে বসে লেবেঞ্চুশ চুষিবার জইন্য! ওরা পাড়ায় পাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় বসাইবার বন্দোবস্ত মঞ্জুর করিব নয়তো কি টিউবোয়েলের ঠিকাদারি করিব! বলাবলি করতাম আমরা, তখন, এইসমস্ত। অন্যদিকে গ্রুপথিয়েটারে বা বিটিভি-অডিশনে ডাব্বা মেরে বাপের বিজনেসবাকশো হইতে পয়সা সরিয়ে ক্যাসেট বের করত আবৃত্তির। উদীচী  তো তখনও সর্বস্তরে সাংস্কৃতিকভাবে বেশ ভিজিবল ছিল, ওরা আবৃত্তির কোর্স বছরভর চালাইত দেখতাম। তবে এরা ছাড়াও তখন গণ্ডায় গণ্ডায় আবৃত্তির সংগঠন গড়িয়া উঠছিল, কোর্স ডিজাইন ও ইমপ্লিমেন্ট করছিল তারা, গাহকও পাচ্ছিল নিশ্চয়। এবং তখন জাতীয় কবিতা পরিষদ জিনিশটার কাঁচা ক্রেইজ তো ছিলই দেশমুলুক জুড়িয়া, গাদাগাদি লিস্টিভুক্ত কবি কিক-বক্সিং বাগিয়ে মাইক্রোফোনে যেয়ে একটা আপনরচিত কবিতার একাংশ পড়তে-না-পড়তেই মালীর ঘাড়ে এসে মহিষের নিঃশ্বাস ফেলিত অপরাপর বিভিন্ন গ্রেইড ও অ্যাইজের কবি। ঠিক একই কায়দার ছিল গড়ে-ওঠা আবৃত্তি-সংগঠনগুলো। কোর্স পার্টিসিপেটর ও গ্রাজুয়েটদের একটা আলাদা ম্যানারিজম, বোলচালভঙ্গিও, অচিরে নোটিস করা যাইত। একভাগে গজাইত শ্মশ্রু ও পরিধেয় হইত পাঞ্জাবি অ্যান্ড অবভিয়াসলি শ্রীনিকেতনী কাঁধঝোলা, আর অন্যভাগে রবীন্দ্রোপন্যাস হইতে উঠিয়া-আসা সাজপোশাক ও তদসঙ্গে গ্রহতারারবি-সদৃশ মোটাগাট্টা টিপ। অনেক ভালো ভালো কবিতাও দেখেছি আবৃত্তিকারদের নাসিক্য বলাৎকারে কেমন করে অকালে সর্দিগ্রস্ত হয়ে বেঘোরে পড়ে থাকতে, দেখেছি কবিতার কলেরা ও অন্যান্য বারোটা বাজাতে আবৃত্তিকারেরা কেমন অসামান্য অবদান রেখেছে! সেই সময়টায় এইসব ঘটেছিল। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ ঘটেছিল। ইত্যাদি। মন্দ ছিল না সময়টা। যা-ই হোক। তবে কেবল বঙ্গাব্দই তো নয়, ফিডব্যাকের প্রত্যেকটা অ্যালবামই ছিল মাইলফলক, হোক সেইটা ‘জোয়ার’ অথবা ‘মেলা’ বা ‘বাউলিয়ানা’ বা সেই আব্দুর রহমান বয়াতির সঙ্গে একজুটি সিঙ্গেল্স ‘দেহঘড়ি’, — ফিডব্যাক  নানানভাবেই সেই সময়টাকে আন্দোলিত করে গেছে। কিংবা আন্দোলিত একটা সময়েই ফিডব্যাকের উত্থান, আবির্ভাব, বিকাশ, — যেভাবেই বলি না কেন। সময়টাই হয়তো আন্দোলিত করেছে তাদেরে, তেমনি সময়নির্মাতাও তাদেরে বলা যায়, এবং তারা তাদের পথ করে নিয়েছে সেই সময়্দুয়ার-পেরোনো সদররাস্তায়।

 

আপাত অন্তিম অনুচ্ছেদ

দুইহাজারসতেরোর উনতিরিশ মে ডেইটের পরে এই প্রথম অন্তিম এই অনুচ্ছেদে কিবোর্ড ধরেছি পঁচিশের পয়লা নভেম্বরে। এর মধ্যে এক নয় দুই নয় আট বছর কেটে গেছে! এইবার এই অডিসির অন্তিম অনুচ্ছেদ। আপাত অন্তিম। অর্থাৎ, টু বি কন্টিন্যুড। অঘোষিত হলেও। এপিক নেভার এন্ডস। তবে এখানে যেহেতু পূর্ণযতি টানতে চলেছি, কিছু খুবই ইরেলিভেন্ট কথা তাহলে এখানেই বলি। দীর্ঘ নিবন্ধমালার গরিষ্ঠ অংশ দুইহাজারতেরো থেকে সতেরো সময়ভাগে ফেইসবুকে নোট আকারে শেয়ার হয়েছে। এরপর সতেরোর ওই দিনের আগ পর্যন্ত ভূমিকা সমেত গোটা রচনাটা যা-পর্যন্ত লেখা হয়েছিল তার বাইরে আর একটা লাইনও আগায় নাই। কৃৎকসরতে চেষ্টা কম করি নাই, কিন্তু লেখাটা আগানো যায় নাই। নিবন্ধমালার বিভিন্ন জায়গা থেকে প্ল্যানড সাবহেডগুলা কাট করে এখানে এনে এখন দেখতে পাচ্ছি বিস্তর অনুষঙ্গ ধরে ম্যাক ও মিউজিকের গোল্ডেন টাইমটাকে দেখবার কাজ বাকি আছে, তা থাক, একেকটি সিঙ্গেল প্যারেন্থেসিসের আন্ডারে সেই না-লেখা সাবহেডগুলা আর্কাইভ করে রাখা যায় : ‘ব্যান্ডগানে দেশাত্মবোধ ও মাকসুদ’, ‘ম্যাক, ফিডব্যাক অ্যান্ড অনোয়ার্ডস’, ‘অ্যালবামতামামি’, ‘ম্যাক অন রক’, ‘ম্যাক অন ব্লুজ’, ‘ম্যাক অন ওভারঅল ব্যান্ডসংগীতশিল্প’, ‘বাংলাদেশে ব্যান্ড/রক টু বি রিভিজিটেড’, ‘দ্য অ্যাওয়্যক্নিং নট বিন টেলিভাইসড’, ‘গুরু গিল এবং অন্যান্য মিল-অমিল’, ‘অহঙ্কারদৃপ্ত, দুর্বিনীত ও প্রণয়ার্ত যৌবনবাউলের হাহাকার’, ‘সোনার কাঠি, রাক্ষস, রকমিউজিক ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘রকদর্শন, রকযাপন, সহি বড় বঙ্গজ রকতরিকা’, ‘বহিছে ধরায় শান্তিবারি, মিউজিকে ধেই ধেই’। দাঁড়ি। কিন্তু, অনুমেয়, উপশিরোনামগুলির আওতায় কী লিখতে চেয়েছিলাম। ধরা যাক, রকমিউজিক নিয়া রবীন্দ্রনাথের পজিশন কেমন হতে পারে তার একটা আন্দাজ মেলে উনার বিভিন্ন সময়ের মার্গসংগীত নিয়া আলাপগুলায়। প্রাক্কলিত অনুচ্ছেদের গোড়াতেই ঠাকুরের একটা প্রবন্ধ থেকে একাংশ/কতেকাংশ উদ্ধার করা যাবে দেগে রেখেছিলাম। প্রবন্ধটা আমরা তার ‘সংগীতচিন্তা’ অ্যান্থোলোজিতে পেয়ে যাব। তেমনি গিল-স্কট হেরন সূত্রে ম্যাকের গানের একটা আলাপ করতে চেয়েছিলাম দুই-দুইটা আলাদা শিরোনামের ছাতায়, এর মধ্যে একটা হচ্ছে হেরনের ‘দ্য রেভোল্যুশন উইল নট বি টেলিভাইসড’ গানের সূত্রে ম্যাকের লিরিকের ধারালো জায়গাগুলার পুনর্পাঠ। দুইহাজারসতেরো পর্যন্ত বাংলাদেশের গানবাজনার সিনে যে-মেগা কন্সার্টগুলি হয়েছে, সেগুলি তির্যকভাবে দেখতে হয়েছে এই নিবন্ধমালায়, কেননা সময়টি ছিল অপরিকল্পিত প্রকল্পরাশির বল্গাহারা হাওয়ায় বেসামাল, মেগা মেগা মাইফেলের মজমায় হাপিশ হয়ে যাচ্ছিল লোক্যাল লোকপ্রজ্ঞা। বাইরাচ্ছে ব্যাপক আর্ট। রোজ রোজ। বস্তা বস্তা ডার্ট। ‘বহিছে ধরায় শান্তিবারি, মিউজিকে ধেই ধেই’ শিরোনামের আওতায় এই রিগার্ডের কথাগুলো কনক্লুড করতে চেয়েছিলাম। হয় নাই। কিন্তু হয়েছে যেটুকু, রইল গোছানো। হয় নাই যা, তা আবার কখনো হবে কিংবা না। দুইহাজারসতেরোয় হারানো স্ট্রিং ধরে এই নিবন্ধমালার অলিখিত উপশিরোনামগুলো সশরীর হবে। একদিন, নিশ্চয়। কেউ না কেউ করবে। ম্যাকের শিল্পীজীবন ছুঁয়ে যেমন নব্বইয়ের মস্ত সময়টাকে এক্সপ্লোর করা যায়, একভাবে, জেমসের বাচ্চুর সঞ্জীবের শিল্পীজীবন ছুঁয়ে তেমনি ভিন্ন ভিন্ন শেইডের নব্বই ফিরে দেখা যায়। গানের ভিতর দিয়া টাইমের গতায়াত যত স্বতঃস্ফূর্ত, অন্য কোনো আর্টের ভিতর দিয়া আদৌ তত নয়। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্ধশতকের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক খতিয়ান নিতে গেলে এই আর্টফর্মটায় ফলিত শস্যগোলায় আলো ফেলতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আর্বান কমিউনিটির শিক্ষাদীক্ষা শাদিশাঙ্গা আদৌ বোঝা যাবে না। আর, আবার বলি, এই রচনার ভূমিকা পার্টটা হাজারসতেরোয় লেখা হলেও বাকি পার্টগুলো দুইহাজারতেরো থেকে সতেরোর ভিতরে একেক সময়ে লেখা। কালচিহ্ন অগোচর নয় লেখার বর্ণনায় পাসিং রিমার্কগুলায় পাঞ্চিং ইমেইজগুলায়। লেখাকালানুক্রমে এই নিবন্ধমালা সাজানো হয় নাই। বিক্ষিপ্ত সজ্জায় এর বিন্যাস। তদুপরি বিপুল কলেবর। ফলে চেক-রিচেক করে এর রিপিটেশনগুলো এড়ানো অসম্ভব না হলেও তা করা হয় নাই। জীবনের মতো পুনরাবৃত্তিপ্রবণ গোটা রচনাটাই। থাকুক। শুধু, উল্লেখ থাকুক, অন্তিমের এই অনুচ্ছেদটাই দ্বিসহস্রপঁচিশে লিখিত; সম্পূর্ণ রচনাটা গড়ে উঠেছে তেরো থেকে সতেরো অব্দসীমায়। এর ফলে ন্যারেশনের অনেক রেফ্রেন্স চট করে ধরতে পারা টাফ হবে এমনটা আশঙ্কা থাকিয়া যায়। কিছু করার নাই, রিপিটেশনগুলো রইল। অনেক অনেক প্রচ্ছন্নতা আর পরোক্ষতাও। ওয়েবক্ষেত্রে লেখাবিন্যাস করবার সময় টাইপোগ্র্যাফিক টেন্ডার্নেস কম্প্রোমাইজড হলেও কখনো গ্রন্থরূপে গেলে এই নিবন্ধমালা আরও অভিপ্রেত পড়াবান্ধব করা যাবে। এইটুকু বলে ‘ম্যাক দ্য রকার’ রচনাটা সাইনড, সিলড অ্যান্ড ডেস্প্যাচড ডিক্লেয়ার করা হলো।

রচনাকাল  ২০১৩-২০১৭ প্রকাশসাল  ২০২৫ গানপারপ্রকাশ  ২০২৫ নভেম্বর ব্যানার ডিজাইন বাই  উসমান গনি


জাহেদ আহমদ রচনারাশি
গানপারে মাকসুদুল হক

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you