সুফি কবি মাহমুদ শাবিস্তারি-র কবিতা || মঈনুস সুলতান

সুফি কবি মাহমুদ শাবিস্তারি-র কবিতা || মঈনুস সুলতান

সুফি কবি সা’দ আল দীন মাহমুদ শাবিস্তারি-র জন্ম ১২৮৮ সালে, হালজামানার ইরানের তাব্রিজ অঞ্চলের নিকটবর্তী শাবেস্তার শহরে। পারস্যে সুফি মতাদর্শ নিয়ে যারা কবিতাচর্চা করেছেন, তাদের মধ্যে মাহমুদ শাবিস্তারিকে (১২৮৮-১৩৪০) অন্যতম বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে মরমিবাদকে কাব্যকলায় তিনি বিকশিত করেছিলেন। এ-কারণে তাঁর ‘গুলশান-ই-রাজ’ বা ‘গোলাপের পবিত্র বাগিচা’ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থটি কালে কালে অসামান্য জনপ্রিয়তা পায়। কবি মাহমুদ শাবিস্তারির জীয়ৎকালে মোঙ্গলরা পারস্য আক্রমণ করেছিল। এ-সময় পারস্য সমাজ ছিল আক্রমণকারী সৈনিকদের অত্যাচারে বিক্ষত। এর প্রতিঘাতে সর্বত্র উদ্ভুত হচ্ছিল হরেক রকমের ধর্মীয় বিভেদ ও সংঘাত। একই সময়ে শুরুয়াত হয় সুফিমতাদর্শের স্বর্ণালি যুগের।  কবি শাবিস্তারি রচিত ‘গোলাপের পবিত্র বাগিচা’ গ্রন্থটি স্বর্ণালি যুগের বৈশিষ্ট্য নির্মাণে অবদান রাখে। গোলাপের পবিত্র বাগিচায় প্রকাশিত তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে পরবর্তী যুগের বিদগ্ধ সমাজ মহান সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবির সাথে তুলনা করে থাকেন। তবে আরাবির রচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দর্শন, কবি শাবিস্তারি তাঁর ছন্দধ্যানী প্রকাশে সংযুক্ত করেছেন মরমি মাত্রা। তাতে একই সাথে সমৃদ্ধ হয়েছে সুফি মতাদর্শের বিকাশ ও ফার্সি কবিতার সনাতনী ধারা।

এখানে কবি মাহমুদ শাবিস্তারির তিনটি কবিতার ভাবতর্জমা উপস্থাপিত হচ্ছে। প্রথম কবিতাটির ফার্সি থেকে ইংরেজি অনুবাদকের নাম অজ্ঞাত। দ্বিতীয় কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন যৌথভাবেএন্ড্রু হারভি ও এরিক হানুট। শেষ কবিতাটি অনুবাদ করেছেন ফ্লোরেন্স লেডারার।

প্রস্তুতি
যাও — ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করো হৃদমহলের বৈঠকখানা
মথিত করো পারিজাত পুষ্পের সুরভিতে,
সাজাও দিব্য কিংখাবে — ঋদ্ধ হোক প্রস্তুতির উপাসনা
দয়িতের অনিকেত নিবাস ভরিয়ে তোলো মরমি সংগীতে;
ঈপ্সিতজন আসবে কেবল — যখন তুমি করবে প্রস্থান
ভরে উঠবে তোমার শূন্য নিলয়,
পত্রপল্লবে পূর্ণতা পাবে হাজার যুগের অনুর্বর বাগান।
কুন্দকুসুমে পুষ্পিত হবে সুস্মিত সময়।

 

তুমি আর আমি
আমি কিংবা তুমি
কিবা আমাদের পরিচয়?
পিলসূজের চারদিকে জড়ানো স্রেফ ঝালর
যা পেরিয়ে আঁধারের সাথে ঘটে আলোর পরিণয়;
তুমি আর আমি
স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে এ অদৃশ্য ভূমি
আদতে পর্দা বিশেষ,
সরালে অবগুন্ঠন — দেখবে প্রতিটি ধর্ম বাঁধা একই সূত্রে
কোথাও নেই বিভেদের ক্লেশ।
তাই বলি — সরিয়ে পর্দা জিজ্ঞেশ করো
আমি আর তুমি বলে
যদি না থাকে কোনোকিছুর অস্তিত্ব অবয়ব ও আকার,
তখন কোথায় মসজিদ কিংবা সিনেগগ
উপাসনা করছে কে কোন ছলে,
কোন পথ ধরে চলে গেছে গন্তব্য কার,
হলোইবা উপসনাস্থল অগ্নিউপাসকের মন্দির
ভাবো তো দেখি — মরুদাহে কে পাঠায় স্নিগ্ধ সমীর?

 

জলের ফোঁটা
চিন্তা করো — সমুদ্রজলের একটি ফোঁটা নিতেপারে কত ভিন্ন নাম, পেতে পারে কত বিচিত্র রকমের আকার,
পানির একটি বিন্দু কখনো কুয়াশা, কখনো মেঘ বা বৃষ্টি ও শিশির; এমনকি রূপান্তরিত হতে পারে কর্দমে,
তারপর উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষজনে — সর্বত্র উপস্থিতি জলের। সামান্য একফোঁটা জল — তা থেকে রূপ নেয় কতকিছু…
এমনকি বিশ্বব্রম্মান্ডের যৌক্তিকতা, আত্মা, স্বর্গ ও শরীর — সমস্তকিছুর আদি ও অন্তে প্রবহমান জল,
যখন তরঙ্গরাজি হানবে আঘাত — লোপ পাবে বিশ্ব,
এমনকি সুনির্ধারিত সময়ে
স্বর্গনিচয় ও নক্ষত্ররাজি — তাবৎকিছুর অস্তিত্ব বিনাশ হয়ে
জেগে থাকবে নিরাকার অনস্তিত্ব।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you