‘লীলাচূর্ণ’ থেকে ‘মধু ও মশলার বনে’ এবং সেখান থেকে ‘জেব্রামাস্টার’ হয়ে ‘বাল্মীকির কুটির’-এ প্রবিষ্ট মজনু শাহর কবিতা স্থানিক অনুষঙ্গে নিজেকে জড়ালেও হারিয়ে-ফেলা জীবনরহস্যের চাবি ফিরে পাওয়ার মনোবাসনা কবিকে বাস্তবাতীত পরাবিশ্বে গমনে বাধ্য করে। ‘গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞাময় সংলাপের দিকে’ ‘স্বপ্নরিক্ত নটরাজনের মতো’ হেঁটে যাওয়া কবি অন্তে এসে স্থানিকতা-অতিরিক্ত দেশকালে নিজেকে বিচরণশীল টের পায় :—
বিদ্যুচ্চমকের মতো সত্যেরা কোথায় পালিয়েছে,
স্বপ্নের, জ্ঞানের, আদিতম বীজ রয়েছে কোথায়…
(লীলাচূর্ণ–৭)
…
দেখছ শম্বর আর কর্ণ পাশাপাশি ভাসমান
ওদিকে তখন ভিজে যায় মাঠে তোমার বাহন…
প্রেতলোক থেকে কেউ জুম করে দেখে সবকিছু,
কোন্ গান সমাপ্তির মতো ভাসে নয়ন তারায়।
(লীলাচূর্ণ–১০)
…
এই মহী মণ্ডল, তোমার দেহরূপ,
এক আদি ঘুম-চকলেট।
তোমাকে গিলে খায় যা-কিছু চিরন্তন।
তোমাকে অতিক্রম করে বিশাল কোনো দস্যু মেঘ।
তখন সব কিছু তিমির বলে মনে হয়,
শিউলি গন্ধ-মাখা মাটি ফিরে পাব আর!
পুঁতে চলেছ আতঙ্কের বীজ। তোমার স্বপ্নে ঢুকে
তবু ঘুরে বেড়াবার কাল না ফুরায়,
না ফুরায় হিম, শিশির পতন।
(গহন)
…
কী চাও এখানে, পান্না-কোকিল?
এই বিধ্বংসী নীরবতায় ঘুম শুষে নিচ্ছে রাবার গাছেরা।
ঘুমোচ্ছে ব্যান্ডবাদকের ছোট বউ, জাগিও না তাকে। যে-জগৎ
গানের, বিপুল অন্তর্ধানের, সেইদিকে তাকিয়ে মাথা আর দুলিও না।
এইবার সভ্যতার সবখানে বসে থাকা প্রেত হও একটু বরং।
(পান্না–কোকিল)
নব্বইয়ের সূচনা দশক থেকে মজনু শাহ-র বাকবিভূতি পাঠককে আপনা থেকে টেনে নিয়ে যায়! জীবনবীক্ষণের প্রতি পরতে বিরাজিত অনুষঙ্গে তাঁর বিজড়ন এবং প্রকৃতি ও আবহমান বৃত্তে জেনসুলভ নিস্পৃহতায় প্রবেশ ইত্যাদি কারণে কবিতায় গুঞ্জরিত ভাষা স্থানিকতায় জড়ানো অনুভ‚তিকে স্থিতিস্থাপক তন্তুর মতো মহাকালের সীমানায় সম্প্রসারিত করে। জাগতিক পৃথিবীতে ভ্রামণিক হলেও অনুভূতির সূতা সেখানে ‘মায়াপৃথিবী’-র বিভ্রম জাগায়! রূপের খনি এ-জগৎ মজনু শাহর বয়নে অরূপের আবেশ জাগিয়ে তোলে আর ওদিকে কবিসত্তা সেই অরূপ সায়রে ক্ষণে-ক্ষণে ডুবে আর ভাসে। ‘আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়, জেব্রা যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা করে।’ (দ্রষ্টব্য : আমার ভাষা; জেব্রামাস্টার) — কাব্যভাষা সম্পর্কে কবির উক্তি বুঝিয়ে দেয় মজুন শাহ পরিপার্শ্বকে কেন্দ্র করে বিরচিত অস্তিত্বের অতলে ভ্রামণিক হতে ইচ্ছুক, যেখানে প্রাচীন ও অলৌকিক থেকে সমকালীন ও লৌকিক চিহ্নসূত্রে যাওয়া-আসার ক্ষণে তাঁর সত্তা সময়হীনতার বোধিবিশ্বেই তলায় :—
বজ্রনির্দেশিত পথ খুলে যাচ্ছে পাপড়ির মতো, নাকি এও কোনো তত্ত্ব অভিনয়!
ঈগলের বাসা খুঁজে, জহরের দানা খেয়ে এ গহন আমিত্ব ফুরায়।
(নভোসংকেত)
…
যে-কোনো সুদূরকে আজ অপরাহ্ন বলে মনে হয়। যে-কোনো প্রণয়, বল্মীকস্তূপের
প্রায়। অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ ছুটে যায় কার পানে! মনে রেখ ঘাসেদের
বিপুল অভ্যর্থনা, পতঙ্গদের মৃত্যুনাচ। আমার সবুজ অক্ষরগুলো ধুলোয় ঘুমায়।
বাঁকা পথে যেতে যেতে কিছু শশীবাক্য আজ তোমায় শোনাতে হলো। আগামী
কোনো ঝড়ে হাতি, হিতোপদেশ সবই হয়ত একসঙ্গে উড়বে।
(অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ)
…
… এক অনিশ্চিতের জগৎ অসীম ভ্রমে হেঁটে দেখা। কোনো দারুস্পর্শ মৃত্যু আমাকে সৃষ্টি করে চলে, নষ্ট জানালায় আছড়ে পড়া চাঁদ আজ আমার অপর।
(অপর)
…
কোনো তত্ত্বনির্ণয় করি নি। শুধু কোনো ক্লাউন যখন গুটিয়ে নেয় তার
পেখম, তার ইশারার ছন্দ, চাবুক, ঝুড়িভর্তি ডুমুর বয়ে নিতে থাকি।
তার অর্ধউচ্চারিত পঙক্তিমালা আমারই, আমাতে বিলীন হতে দেই
তার মৃত্যুরঙিন অবয়ব।
(এই সুফি–রাস্তার ওপর)
কবিতার অর্থস্তরে বহমান সংকেত উদ্ধারে কবি মজনু শাহর ভাষার রূপময় চোরাটান এক বড়ো বাধা! নব্বইয়ের কালপর্বে জীবনের রং বিচিত্র ইহজাগতিক পণ্যের সমাহারে বর্ণিল হলেও ধাঁধা-চমকিত বিভ্রম আর আত্মিক শূন্যতার কারণে রোগাক্রান্তও বটে। কবির চেতনসত্তা এইসব রঙে নিজেকে রঙিন রাখে এবং উৎফুল্ল ভ্রমরের মতো সেখানে উড়তে চায়, অন্যদিকে অবেচেতন সত্তা থেকে উঠে আসা সন্ত-ভাবনার প্রভাবে তাঁর সত্তা অচিহ্নিত সর্বনামে পরিণত হয়, যে কিনা উপসংহারে পৌঁছে চিরকালের অমায় হারায়। সময়ের বিবিধ ছিদ্রে গমন করলেও মজনু শাহর পঙক্তিমালা বিস্মরণের দেশে খেই হারানোর মাঝে স্বস্তি খুঁজে মরে! বিগত তিন দশকের মানববিশ্বে সক্রিয় বাস্তবতার ঘোলাটে গর্ভ থেকে এই পরাভাষার জন্ম হলেও বায়বীয় বাস্তবতায় তার নিষ্ক্রমণ সন্তসুলভ নিস্পৃহতা সহকারেই ঘটেছে। জাগতিক অস্তিত্ব মহাজাগতিক ফেনায় নির্বাপিত হওয়ার কারণে মানব সংসারে বিদ্যমান রূপ-রস-গন্ধ শোষণের পালা সাঙ্গ হলে সময়হীন মহাকালের কিনারায় কবিকে একা দাঁড়িয়ে পড়তে হয়; — মজনু শাহর বাকপ্রতিমায় বিচ্ছুরিত এই বার্তাটি জলতরঙ্গ হয়ে অবিরত বেজে চলে। তাঁর কবিতায় মিথ, ঐতিহ্য ও আবহমানের নবীকরণ তাই সতীর্থদের থেকে একেবারেই পৃথক। ভাষা ও অর্থস্তরে যত মর্ম সেখানে ফোটে সেগুলোর আত্তীকরণ অন্য কবির পক্ষে সত্যি কঠিন।
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS