প্রশাসনের সাহিত্যমেলা আয়োজন ও বয়কটকারী লেখকদের অবস্থানপত্র

প্রশাসনের সাহিত্যমেলা আয়োজন ও বয়কটকারী লেখকদের অবস্থানপত্র

‘কেন আমরা সিলেট বিভাগীয় সাহিত্যমেলায় অংশগ্রহণ করব না’ মর্মে লেখকদের একটা অবস্থানপত্র সমাজসংযোগ মাধ্যমে অনেকেরই দেয়ালে অ্যাপিয়ার করে জুনের ০২ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। স্ক্রিপ্টটা আমাদের অনেকেরই নজরে এসেছে এরই মধ্যে। এই স্ক্রিপ্ট আমরা প্রথমত সংরক্ষণ করতে চাই, দ্বিতীয়ত পর্যালোচনা করতে চাই স্ক্রিপ্টটা এবং ঘটনার পূর্বাপর নিয়া আমরা সামনের দিনগুলায় আলাপ সচল রাখবার ইচ্ছাটারে এইখানে প্রকাশ করে যাই।

স্ক্রিপ্ট যেইটার কথা বলতেসি তা কার লেখা বোঝা না-গেলেও এইটুকু স্পষ্ট যে অ্যাডমিন/প্রশাসন থেকে আয়োজিত ‘মহতী’ সাহিত্যসেবার দুইদিনব্যাপী ইভেন্টের গোটা আয়োজনপ্রক্রিয়ার অসাধুতার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ এই স্ক্রিপ্টের উপজীব্য। তবে এর ফেসবুকশেয়ার কাউন্ট করলে এইটা ঠাহর করা যায় যে এক নয় অনেক লেখক এই স্ক্রিপ্টেড ভাষ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সিলেট এই সাহিত্যমেলার মূল আয়োজক, সঙ্গে আছে বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ইভেন্টটা জুনের ০৩ ও ০৪ শনি-রবি ২০২৩ দুইদিনের ব্যাপ্তি নিয়া আয়োজিত।

বহুদিন বাদে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেল যে কেউ অনুষ্ঠানআয়োজকদের ‘অগণতান্ত্রিক’ অধিপতিসুলভ চিন্তা ও আচরণের প্রতিবাদ করল, যে-‘অগণতান্ত্রিক’ আধিপত্য ও নৈরাজ্যাচার অধুনা বাংলাদেশের নির্বিকার প্রশ্নহীন আচরণ হয়ে উঠেছে। এতে নির্বিকার নির্বিচার নিশ্চিন্ত ‘অংশ’ নিচ্ছেন সবাই। জীবিকা আর্ন করছেন কেউ কেউ, বুদ্ধিও বাৎলাচ্ছেন, প্রশাসনের দয়াপরবশে। এমতাবস্থায় বয়কট! কাজেই জিনিশটা আমাদের কাছে একশব্দে ইন্ট্রেস্টিং। তা এই বয়কটের ডাক যতই লেইম, নায়্যিভ আর আগাপাশতলার আলাপ না-উঠায়া আকস্মিক হোক, আমাদের ইন্ট্রেস্ট তাতে কমে না। আমরা বরং এই সুযোগে ফুলপাখিব্যথাবেদ্না নিয়া বাউলিকাটা সাহিত্যপদ্য ফুটাইবার পাশাপাশি নিজেদের গরজে একটু পুণ্যার্জন-পাপাচার করে নিতে পারি, মানে একটু কথাবার্তা চালাইতে পারি লিখনের কীর্তিকলাপ নিয়া, সাহিত্যসংঘষণ্ডামি নিয়া, সাহিত্য বলতে যেই জিনিশটা আমরা করে থাকি সেইটা নিয়া, সাহিত্য শুধু নয় গোটা ‘রাজনীতি’ ও সমাজের শরমহায়ালাজলজ্জা নিয়া।

আপাতত অনুষ্ঠান-বয়কটকারীদের অবস্থানপত্র পড়ি এবং অনুষ্ঠান ও অবস্থানপত্র ইত্যাদির বাইরে পড়ে থাকা মানবজীবন ও বঙ্গসমাজ নিয়া আলাপটা আরেকটু সবিস্তার করি। যদি তা না করতে পারি, ক্ষীণ যদিও সম্ভাবনা আমাদের পারাপারির, তাইলে তো অনুষ্ঠানমাচায় আরোহণ করে গাবরের মতো ঘোঁতঘোঁত বক্তৃতাবাজির সুযোগ পাওয়া আর না-পাওয়াদের প্রায় শাশ্বত দ্বন্দ্ব হিশেবেই চিহ্নিত অথবা আচিনা থাকবে ব্যাপারটা। দেখা যাক।

নথিবদ্ধ থাকুক, ২০২৩ জুনে ট্যাক্সপেয়ারদের পয়সায় আয়োজিত প্রশাসনের এই মিলনমেলায় যারা, যেইসব ‘মান্যবর’ লেখকেরা, আমন্ত্রিত অতিথি হিশেবে স্টেজে উঠবার সম্মতি দিলেন তারা আমাদের তরফ থেকে একটি বিশেষ ধন্যবাদ চিরদিন যেমন পেয়ে এসেছেন আজও ও ভবিষ্যতেও পাবেন। এই ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ তাদেরে আমরা অকৃপণ দিয়া যাই, ষোলোকোটি রিডার ও আবহমান মানবেতিহাসের পক্ষে, এছাড়া আমাদের আর কী-বা আছে দিবার? আর যারা স্যারদের ডাকে সাড়া দিলেন না, খুঁত বাইর করলেন প্রোগ্র্যামের, উপরন্তু বয়কট করলেন — তাদের নিয়া আমরা কী করব বুঝতে পারতেসি না। আশু প্রকাশ্য। — গানপার

কেন আমরা সিলেট বিভাগীয় সাহিত্যমেলায় অংশগ্রহণ করব না


আমরা মনে করি, গোটা আয়োজনটি জনগণের টাকায় (সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়) হলেও তা স্থানীয় একটি ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ কারা? যাদের কাছে লেখক-কর্মীর সৃষ্টি-সৃজনীশক্তি থেকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীর স্বার্থ বড়ো। আরও বলা যায়, যাদের দালালিতে সিলেটে বারবার বিশেষত শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠান/কর্মকাণ্ড ব্যক্তিস্বার্থ, বন্ধুতোষণে প্রভাবিত হয়। যাদের সঙ্গে লিয়াজোঁসূত্রে সিলেট অঞ্চলের গোটাকয়েক লেখক-সংস্কৃতিকর্মী সরকারি কিংবা কর্পোরেট লাইনে মোড়লিপনা দেখান কিংবা সুবিধাভোগী হন। স্থানীয় পর্যায় প্রস্তুতি/পরামর্শ সভায় সলাপরামর্শের ভূমিকায় থাকা লেখক/ব্যক্তিবর্গই নিজেরা অনুষ্ঠানে আলোচক, সঞ্চালক কিংবা অংশগ্রহণকারী ইত্যাদি থাকছেন, যা মূলত লেখকীয় যোগ্যতায় নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা যোগাযোগের সূত্রে!

‘তৃণমূল পর্যায়ের সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার লক্ষ্যে’ এই আয়োজনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি সমন্বয়কের ভূমিকায় থাকলেও আমরা বুঝতে পারি, বাংলা একাডেমির তরফে সিলেটে (স্থানীয় পর্যায়ে) কর্তৃপক্ষের বাইরে থেকে যারা ইতঃপূর্বে লেখকদের সঙ্গে সমন্বয়ের ভূমিকায় ছিলেন, তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন কর্তৃপক্ষের আড়ালে এযাবৎ (ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বার্থে) যেনতেনভাবেই করেছেন। এইসব বিষয়ে সুপারভিশন/মনিটরিং কী রকম, তা নিয়ে সিংহভাগ লেখক-সংস্কৃতিকর্মী ধোঁয়াশায় রয়েছেন। আয়োজনে ‘তৃণমূল’ কথাটার ব্যবহার শুধু কাগজে-কলমেই আছে, আর আছে একটা গোষ্ঠীর মধ্যে।

বর্তমানে সিলেট বিভাগে সহস্রাধিক লেখক-সংস্কৃতিকর্মী আছেন, বিভাগীয় শহর সিলেট ও শহরতলিতে আছেন শতাধিক। মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জের প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের এ আয়োজনের অন্তিম মুহূর্তেও সংযুক্ত করা তো দূরের কথা, প্রচুরসংখ্যক লেখক-সংস্কৃতিকর্মী জানেন না সিলেটে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় (তৃণমূল পর্যায়ের) একটি বিভাগীয় সাহিত্যমেলা হতে চলেছে।

> ১২,৫৯৫.৯৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি বিভাগে গোটাকয়েক লেখক মঞ্চে উঠে ৩ মিনিটের একটা কবিতা পড়লে কিংবা পাঁচ/দশ মিনিট বক্তব্য রাখলেই কি তৃণমূলের লেখকদের জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরা হয়?

> এই আয়োজনে প্রকৃত অর্থে তৃণমূলপর্যায়ের লেখক কারা, এর কোনও ব্যাখ্যা/উত্তর আছে কি?

> কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষাকারী হলেই কি তৃণমূলপর্যায়ের লেখক হওয়া যায়? প্রকৃত অর্থে, এই আয়োজনে তৃণমূলের লেখকরা উপেক্ষিত।

> আমরা মনে করি, কোনও সরকার/কর্তৃপক্ষই চায় না, জনগণের টাকায় কোনও কর্মকাণ্ড ব্যক্তিস্বার্থ বা স্বজনপ্রীতিধর্মী কিছু হোক। কিন্তু, ঔচিত্য-গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মাথাব্যথাই-বা ক’জনের? সুতরাং, যেখানে ঔচিত্য-যোগ্যতা থেকে ব্যক্তি/বন্ধুস্বার্থ বড়ো — সেখানে আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই না। আমরা জানি, সৃজনশীল/লেখকীয় যোগ্যতা কারও সঙ্গে কোনও বিশেষ সম্পর্ক বা পদ-পদবির মাপকাঠিতে নির্ধারিত হয় না।

COMMENTS

error: