শ্রমজীবী সমাজে কোনও কাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত মোট অর্থ-সম্পদের ভাগের অংশীদারকে ভাগালু বলা হয়। সেক্ষেত্রে ভাটি-অধ্যুষিত হাওরাঞ্চলের একমাত্র বোরো ফসল কেটে দেওয়ার কাজটা যারা ভাগের বিনিময়ে সম্পন্ন করে থাকে তাদেরকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘ধানকাটার বেপারী’ বা ‘ভাগালু’ বলা হয়ে থাকে।
সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলগুলোতে বোরো ফসল কাটার জন্য একসময় ফরিদপুর, বাজিতপুর, মাদারিপুর সহ দেশের অন্যান্য জেলা থেকে ভাগালুগণ নৌকাযোগে আসতো। বিশেষ করে সত্তর-আশি থেকে নব্বই দশকের দিকে হাওরাঞ্চলের প্রতিটি গিরস্তপরিবারের ধান কাটার দায়িত্ব এসব অঞ্চলের ভাগালুদের উপরই নির্ভর ছিল। তখনকার সময় যোগাযোগমাধ্যম এতো উন্নত ছিল না বলে গিরস্তরা ফাল্গুন মাসেই ভাগালুদের বাড়িতে গিয়ে তাদের সঙ্গে বৈশাখী ধান কাটার মৌখিক চুক্তি সম্পন্ন করে আসতেন। অনেক সময় ভাগালুরাও গিরস্তের বাড়িতে চলে আসতো চুক্তি সম্পন্ন করতে। আবার বংশপরম্পরায় এ চুক্তি দীর্ঘদিন বারোয়ারি নিয়মেও চলতে থাকে অনেক গিরস্তপরিবারে।
ভাগালু চুক্তি দলনেতার সাথে সম্পন্ন হয়। ভাগালুদলের দলনেতাকে আঞ্চলিক ভাষায় বেপারী বলা হয়। যিনি গিরস্তের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতো এবং কখন কোন জমির ধান কেটে কোথায় আনতে হবে তার পরিকল্পনা ও দায়িত্ব পালন করতো। ফলে বেপারীর সঙ্গে গিরস্তের একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠতো।
ভাগালুরা সাধারণত চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় হাতে-বাওয়া বড়োবড়ো নৌকাযোগে হাওরাঞ্চলে আসতো। ময়ালে এই নৌকা ‘বেপারীর নাউ’ বা ‘ভাগালুর নাউ’ নামে পরিচিত ছিল। কাঠের তৈরি নৌকা। বাঁশের ছৈ। নান্দনিক গলুই। পরিপাটি পাটাতন। মজবুত চৌখাট। বড়ো চারিবৈঠা। চিকন বাঁশের মজবুত লগি। লম্বা লম্বা দাঁড়। বাদামী-লাল-নীল রঙের কপেড়ের পাল। খাড়া মাস্তুল। গ্যারাফি। গুন। ঠেলা কলের সেঁউথ। আরও কত কী!
সাধারণত বড়ো ডিঙি বা বাজিতপুরি নাউ বেশি ছিল। এ নৌকা নিয়ে ভাগালুদের ৭-১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতো ভাটির ময়ালে আসতে। গাঁয়ের পাশের নদীতেই নোঙ্গর ফেলতো এসব নৌকা। তারা ময়ালে এসে প্রথমদিন গিরস্তের বাড়িতেই নিমন্ত্রণ খেতো। নানান আয়োজনে গিরস্তরা তাদের ভোজনের ব্যবস্থা করতেন। ‘বেবার’ আদান-প্রদানও হতো। অনেকটা ‘ভাগালু আগমন’ উৎসব বলা চলে। পরদিন থেকে তারা নিজেরাই রান্নাবান্না করতো। তাদের নৌকাতেই সংসারী উপকরণ সহ রান্নাবান্নার সুব্যবস্থা থাকে। গিরস্তগণ আনাজপাতি ও চাল দিয়ে বেপারীদের সহযোগিতা করতেন। সাধারণত বেপারী নিজেই পাটা’য় মশলা বেটে নদীর জলে ধুয়েমুছে দলের রান্নাবান্নার কাজটা সম্পন্ন করে।
একটি ভাগালুদলে ২০-৫০ জন পর্যন্ত শ্রমিক থাকতো। যারা এক বা একাধিক গিরস্তপরিবারের ধান কেটে দিতো। সে-অনুপাতে তারা ২০০-১০০০ মণ পর্যন্ত ধান বহন করতে পারে এমন নৌকা নিয়েই আসতো। আসার সময় মাটির আড়া ভর্তি খেজুরগুড় (আড়াগুড়), পিঁয়াজ ও রসুন সহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতো। যা গিরস্তবাড়িতে ধানের বিনিময়ে বিক্রি করে অধিক মুনাফা লাভ করতো। তখনকার সময় ভাটি-অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না বলে বেশিরভাগ গিরস্তরাই বেপারীর কাছ থেকে এসব পণ্য ক্রয় করে নিতো।
ভাগালুরা নদীর তীরে নৌকার কাছাকাছি খুব সুন্দর করে খলা (উঠান) তৈরি করতো। শুরুতে ধানকাটার খুব ব্যস্ততা থাকতো না বলে বিকালবেলায় মাঠে হাডুডু খেলার আয়োজন হতো। গ্র্রামের সবাই আসতো সে-খেলা দেখতে। হারজিতের আনন্দবেদনা শুধু ভাগালু নয় গ্রামবাসীর মধ্যেও প্রভাব ফেলতো। যার সূত্র ধরে গ্রামবাসী ও ভাগালুদের মধ্যে গড়ে উঠতো হৃদয়ের সম্পর্ক। নদীর পাশে সারি সারি নৌকাগুলোকে দেখলে মনে হতো যেন নদীর বুকে গড়ে ওঠা নৌপল্লী। তবে অনেক সময় ভাগালুরা মাটিতে ক্ষণস্থায়ী ঘরও তৈরি করতো, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হতো ‘উরা’ বা ‘গোয়ালা’।
আমরা ছোটবেলায় ভাগালুনৌকায় বেড়াতে যেতাম। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নৌকায় উঠতাম। ছৈ-এ বসে মজা করতাম। পানিতে ঝাঁপ দিতাম। বেপারী খেজুরের গুড় দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করতো। আমরা হাতের তালুতে খেজুরগুড় নিয়ে জিহ্বা দিয়ে পরম আনন্দে চেটে চেটে খেতাম।
অবসরে সন্ধ্যাবেলায় ভাগালুরা গিরস্তের উঠানে কিচ্ছাগানের আসর জমাতো হাতেতালি দিয়ে কখনওবা লোকবাদ্য বাজিয়ে। আমরা সবাই মজা করে তা উপভোগ করতাম। এসব কিচ্ছাগান ভাগালুরা ভাটির মহাজনদের কাছ থেকেই দীর্ঘদিনের আসা-যাওয়ার ফলে শিখে নিতেন। বিশেষ করে গানের কিচ্ছা (আয়নামতি, মধুমালা, মদনকুমার, কমলা সুন্দরী, জরিনা সুন্দরী), বাউলগান, ঘাঢুগান, বানেছার গান, বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের পালা, নিমাই সন্ন্যাসের পালা, বিনোদের কুড়া শিকাড়ের পালা সহ নানা গানের আসর বসতো। ছেলে-বুড়ো সহ গায়ের সকলেই নিঃশব্দে তা উপভোগ করে আসরে অংশীদার হতো। এক্ষেত্রে গানের কিচ্ছা বা পালাগানে বিয়ের নববধূ সাজানোর গান হতো খুব মজা করে জৌলুসের সাথে। কিচ্ছার কাহিনিতে বিয়ে, বিয়ের গান ছিল মূল আকর্ষণ। সবাই গাইতো হাতে তালি দিয়ে। যতদূর মনে পড়ে গামছা দিয়ে বউ সেজে আবেদ বেপারী কৈন্যা সাজানির গান গাইতো আর আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে দোহার দিতাম।
বিয়ের সাজনি সাজ কৈন্যা ল / বিয়ের সাজনি সাজ।।
এক শাড়ি পিন্দিয়া কৈন্যা অঙ্গের পানে চায়,
দিলপছন্দ হয় না শাড়ি দাসীরে বিলায়।। (ঐ দিশা)…আরেক শাড়ি পিন্দে কৈন্যা রঙে চটক মারে
গচরমচর করে শাড়ি খুল্যিয়া রাখে তারে।। (ঐ দিশা)…
এক শাড়ি পিন্দিলো কৈন্যা মাকড়েরও আঁশ,
জলেতে ভিজাইলে শাড়ি হয় যে সর্বনাশ।। (ঐ দিশা)…
আরেক শাড়ি পিন্দিয়া কৈন্যা মুখে দিলো পান,
ঘর’তনি বাই’র অইল পূর্ণিমারই চান।। (ঐ দিশা)…
জীবন আর জীবিকার তাগিদে কাজে আসা ভাগালুরা শুধু হাওরপারের গিরস্তের ধানকাটার দায়িত্বই পালন করতো না, তারা শিল্পী না-হয়েও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে উঠান-আসরে ভাগালু হিসেবেই গপ্প-কিচ্ছা-গানে রাতের পর রাত সারাগাঁও মাতিয়ে রাখতো। যার বিনিময়ে তারা পেতো একসিলুম তামাক আর ভাটির মাটির মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসা।
উঠান-আসরের সূত্র ধরে অনেক সময় ভাগালুদের সাথে গিরস্তমেয়েদের গোপনে গোপনে প্রেমের বন্ধন তৈরি হয়ে যেতো। যা তখনকার সমাজব্যবস্থায় ছিল অতি নিন্দনীয় ও লজ্জাজনক বিষয়। তাই এক্ষেত্রে প্রেমের প্রকাশ ঘটলে বেপারী তার ভাগালুকে শাস্তি প্রদান করে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দিতো। ফলে প্রেমঘটিত ব্যাপার সহজে ঘটতো না। এককথায় বলতে গেলে গিরস্তের মান-সন্মান রক্ষায় বেপারী থাকতো অনড়।
মাঠের ফসল যখন পুরোপুরি কাটার উপযুক্ত হয়ে যেতো তখন তারা দিনরাত বিরামহীন কাজ করতো। ভোরের সূর্যের লাল আভায় ভুবন রাঙানোর আগেই তারা পাখিদের সাথে জেগে উঠতো এবং নিঃশব্দের সকালে কাস্তে ও রশি হাতে নিয়ে জমির আইল ধরে সারি বেঁধে ফসলের মাঠে যেতো। দিনের প্রথমার্ধের ধানকাটা শেষ করে সকালবেলায় তারা সাধারণত পিঁয়াজ-পান্তা খেতো। পানির পিপাসায় কখনো কখনো পান করতো হাওরের মিঠাপানি। পরমানন্দে জমির ধান কাটতো নানান লোকগান গেয়ে। বেপারী দুপুরের খাবার জমিনে নিয়ে এলে তারা একসাথে জমির আইলে বসে বা দাঁড়িয়ে খেতো। বেপারী একেএকে সুশৃঙ্খলভাবে একসঙ্গে সমস্ত ভাত ভাগালুদের থালায় সমানভাবে ভাগ করে দিতো। তারপর আড়চি দিয়ে আলুর-দম/ছোটমাছের-ঝোল ভাতের উপর অল্প পরিমাণে দিয়ে দিতো যা ভাতের পরিমাণের সাথে যথেষ্ট নয়। খাবার পরিবেশনের পর শুরু হতো পাঁচ-আঙ্গুলের বড়োবড়ো গ্রাসে গাপুসগুপুস খাওয়া। দেখে মনে হতো, সমস্ত স্বাদ যেন এসে মিশেছে আজি ভাগালুর সস্তা খাবারে। থালা চেটে, অঙ্গুল চেটে খাবারের সমাপ্তি দেখলে মনে হতো আরও কিছু হলে ভালো হতো।
চৈত্রের প্রচণ্ড রোদে ধানকাটার পরিশ্রম-অনুপাতে তাদের খাওয়াদাওয়া তেমন হতো না। তারা অতিদূরবর্তী মাঠের ফসল কেটে মাথায় অথবা ভারবাঁশ দিয়ে বহন করে মাড়াইখলায় (উঠানে) নিয়ে আসতো। ক্ষেতের সরু আইল দিয়ে ভারবোঝা বহন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিশ্রমের কাজ — যা তারা প্রতিদিন করতো। কর্মবিভোর মানুষগুলো নাওয়াখাওয়া ভুলে গিয়ে সারাদিনের কাজের শেষে রাত্রিবেলায় নদীর জলে সাবান ছাড়া গতরে হাত চাপটিয়ে গোসল করতো আয়েশে। তারপর পরমানন্দে রাতের খাবার খেয়ে খোলা আকাশের নিচে, নৌকার ছৈ-এর উপর অথবা খলায় (উঠানে) ঘুমিয়ে পড়তো। দখিনা সমীরণ সারারাত তাদের গায়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিতো আদরে আদরে। মনে হতো এই বিশ্বটাই তাদের ঘর, আকাশ ঘরের ছাদ। মাঝে মাঝে প্রকৃতির বৈরী আবহওয়া তাদের সুখের নিদ্রা ভেঙে দিতো।
গিরস্তরা তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি সবসময় বিবেচনায় রাখতেন। কাটাধান ধারির চক্করে গরু দিয়ে মাড়াই হলে ভাগালুদের প্রাপ্য অংশ গিরস্তরা সযতনে আলাদা করে রেখে দিতেন। সেক্ষেত্রে বেপারীদের কেউ উপস্থিত থাকতো না। বিশ্বাসেই ছিল এখানে দায়বদ্ধ। ভাগালুদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকতো গিরস্তের প্রতি। অঞ্চলভেদে, জমির দূরত্ব বা ধানের রকমভেদে ৬ ভাগ থেকে ৯ ভাগ পর্যন্ত ধানের অংশ তাদের দেওয়া হতো। সন্ধ্যাবেলায় ভাগালুরা তাদের অংশের ধানমাড়াই খলা থেকে মাথায় করে নিয়ে যেতো নৌকায় বা গোয়ালায়। হাওরপারের ফসল তোলার ব্যস্ততায় দিনরাত্রির ব্যবধান তখন ভাগালুরা ভুলে যেতো। ভুলে যেতো লাভ-লোকসানের হিসেব। হাওরপারের ফসল অনেক সময় অসময়ে পাহাড়ি ঢলের পানিতে যখন তলিয়ে যেত তখন ভাগালুরা তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যতটুকু সম্ভব ফসল কেটে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতো। এক্ষেত্রে তারা বিপদ মুহূর্তে কোনোরকম অতিরিক্ত সুবিধাভোগের দাবি করতো না। যার বর্তমান রূপ ভিন্নতর। দুর্যোগমুহূর্তে এখন ফসলের অর্ধেক অংশ বা তার চেয়ে বেশি দিয়েও ফসল কাটতে হয়।
তবে ভাটি-অঞ্চলে বোরোফসল কাটার সময় শুধু ভাগালুরাই বা ধানকাটার বেপারীরাই আসতো না, আসতো হাড়িপাতিল বিক্রয়ের বেপারী ও মিষ্টিআলু বিক্রয়ের বেপারীরাও। যদিও ভাটি-অঞ্চলে আলুবেপারীদের সামাজিক মূল্য কম ছিল তবুও তাদের ব্যবসাটাই ছিল সবচেয়ে লাভজনক। বেপারীদের প্রত্যেকেই বহিরাগত ও মৌসুমী।
একদিন এক মজার ব্যাপার ঘটলো আমাদের খলায় (উঠানে)। পরপর ধানকাটার বেপারী, আলুবেপারী ও পাতিলবেপারী এসে হাজির। তারা পরস্পরে কুশল বিনিময় করে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলো। জানা গেল তারা পরস্পরের আত্মীয় ও একই গ্রামের লোক। সে যা-ই হোক, অনেক খোশগল্পের পর ধানকাটার বেপারী তার অংশের ধান নিয়ে নৌকায় চলে গেল। তারপর আলুর বেপারী কিছু মিষ্টিআলুর বিনিময়ে খড়কুটু সমৃদ্ধ ধান নিয়ে সেও চলে গেল। এবার হাড়িপাতিলের বেপারীর পালা। এ ব্যবসার ধরন একটু ভিন্ন। বেপারী একটি পাতিল তার বামহাতের তালুতে বসিয়ে ডানহাতে সজোরে ঠাস ঠাস মেরে টংটং আওয়াজ তুলে বললো, ‘বাবু এইটা নেন, পোড়ামাটি, অনেকদিন যাবে।’ মাটির তৈরি লাল কলসি, কালো কলসি, দুধের পাতিল, সরা, হানকি, চালের মটকা, চাড়ি, মুড়ি ভাজার ডকি-পাতিল ইত্যাদি রাখা হলো। বিনিময়ে ধান নয়। ধানের চুঁচা। তবে এক্ষেত্রে দরদামের সময় চুঁচা পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। সেজন্য গিরস্তের ধানের খলায় জমিয়ে রাখা চুঁচার ডিবিতে বেপারী হাত ঢুকিয়ে একমুষ্টি চুঁচা এনে দুইহাতের তালুতে নড়াচড়া করে মুখে ফুঁ দিয়ে ধানের অস্তিত্ব জেনে তারপর হাড়িপাতিলের দরদামের চূড়ান্ত ফয়সালা করে নিতো। এক্ষেত্রে হাড়িপাতিল ক্রয়বিক্রয়ের বিষয়টি ছিল খুবই মজার। তারপর হাড়িপাতিল বেপারী চুঁচা নিয়ে চলে যায় তার নৌকার পাশে। চুঁচা বাতাসে উড়িয়ে তা থেকে ধান সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত চুঁচাগুলো তারা নদীর জলে ভাসিয়ে দিতো। কারণ পরবর্তীকালে যেন গিরস্তরা আবার এগুলো সংগ্রহ করে তাকেই দিয়ে না দেয়। তাই তারা নদীর পাশে নৌকায় না গিয়ে কখনও চুঁচা থেকে ধান সংগ্রহ করতো না। তবে সকল বেপারীদের মিলনমেলায় ধানকাটার বেপারীদের সাথেই গাঁয়ের লোকদের সামাজিক ও আন্তরিক সম্পর্ক বেশি গড়ে উঠতো। কেবল তারাই পেতো সামাজিক অধিকার ও আচার-অনুষ্ঠান ভোগ করার বেশি সুযোগ। কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে আলুর বেপারীরাই বেশি লাভবান হতো বলে জানা যায়। তাই আলুর বেপারী সস্তা সাধারণ কোনো হাস্যরসের নাম হলেও কাম ছিল তার ষোলোআনা।
ভাটির সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে ভাগালুদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকতো। সাধারণত চৈতপরব ও নববর্ষে তারা গিরস্তদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিত। নববর্ষের আড়ং-এ তারা কুস্তিখেলায় অংশগ্রহণ করে জয়ী হলে আনন্দমিছিল করে গিরস্তের বাড়িতে আসতো। গিরস্তরা খুশি হয়ে তাদের ধান-দূর্বায় আশীর্বাদ দিয়ে নানা আচারে বরণ করে নিয়ে আপ্যায়ণ করে খাওয়াতেন। ভাগালু ও গিরস্তদের মধ্যে সামাজিক সর্ম্পকের বাহিরেও গড়ে উঠতো দায়িত্ববোধের দায়বদ্ধতা। এ ব্যাপারে না বললেই নয়। একদিন মাঝরাতে এক গিরস্তের ঘরে চোর ঢুকল। ধানচোর। গিরস্ত টের পেয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করলেন। পাড়াপ্রতিবেশী সবাই ছুটে এল চোর ধরতে। তার সঙ্গে যুক্ত হলো ভাগালুরাও। শুরু হলো রাতের আঁধারে চোর খোঁজাখুঁজি। একপর্যায়ে গ্রামের সবাই বিফল হয়ে ফিরে এল, কিন্তু হাল ছাড়লো না ভাগালুরা। তারা অবশেষে চোরটাকে ধরে ফেললো। এবার শাস্তি দেয়ার পালা। হাতের নখের নিচ দিয়ে সুঁই ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আর, উত্তম-মধ্যম? তার তো হিসেব নেই। গাঁয়ের সবাই এল চোর দেখতে। চোর দেখে গাঁয়ের সবাই বলাবলি করছে, ভিনদেশি চোর। আমিও গেলাম বাবার কোলে উঠে চোর দেখতে। আমার বয়স তখন পাঁচ-ছয় বছর হবে। চোর দেখে ভয় পেয়ে বাড়ি ফিরলাম। দাদামহাশয় ঠাট্টা করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদুভাই চোর দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘হ্যা দাদু, কালো কুচকুচে ইয়া বড়ো চোর।’ দাদু বললেন, ‘চোরের লেজটা কেমন দাদুভাই?’ আমি খুশিতে হেসে বললাম, ‘ইয়া লাম্বা।’ সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সবাই হাসতে শুরু করলো। আমি কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই মা আমাকে কোলে নিয়ে বললেন, ‘বাবা, চোরের লেজ হয় না, ওরা আমাদের মতো মানুষ, তবে যে-কাজটা করে তা ভালো না। তাই তারা চোর।’
সে যা-ই হোক, ভাটির সামাজিক দায়িত্ব, প্রতিরক্ষা ও জীবনাচারে ভাগালুরা এই এক-দেড়মাসে মায়ার বন্ধন তৈরি করে ফেলতো। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাদের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যেতো। তাদের বিদায়বেলায় গিরস্তরা তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দিতেন। বিদায়-অনুষ্ঠানে বেজে উঠতো বেদনার সুর। গিরস্তরা তাদের বিদায়ের দিন নিমন্ত্রণ করে নানান আয়োজনে খাওয়াতেন এবং একটি খাসি দান করতেন যাত্রাপথে তাদের ভোজনবিলাসের জন্য। অনেকসময় পোশাক-পরিচ্ছদও দেওয়া হতো।
হাওরাঞ্চলের কৃষিব্যবস্থায় ভাগালুবিদায় ছিল এক বেদনাদায়ক মুহূর্তের নাম। যার শোক কাটতো না অনেকদিনেও। তাছাড়া এই অল্পসময়েই অতি গোপনে গোপনে প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারও ঘটে যেত। সেক্ষেত্রে অন্তরের রক্তক্ষয়ী বেদনার খবর নগরের কেউ জানতো না।
তোমার আমার ভালোবাসা থাকবে চিরকাল।
মন মিলে মানুষও মিলে
সময় মিলে না।
আমি একখান পিরিত করলাম
কার-বা করলাম ক্ষতি
গোকুলনগর-মাঝে কার-বা মা-বইন সতী।…
পিরিত রয়ে গেল গোপনে। বিরহে। নগরে সবাই রয়ে গেল সতী। ততদিনে সময় হয়ে এল ভাগালুবিদায়ের। তাই অনন্ত জিজ্ঞাসা আর অসমাপ্ত ভালোবাসার তৃষ্ণা বুকে নিয়ে ভাগালুপ্রেমিকের নৌকা পাল উড়িয়ে ময়াল ছাড়লো। বিদায়বেলায় গিরস্তকৈন্যা জলের ছলে নদীর ঘাটে গেল। প্রেমিকের সোনালি মুখখানা একবার পিপাসিত নয়নে হেরিতে। দৃষ্টিবিনিময় আর বাতাসে হৃদয়ের গন্ধ অনুভব করে জলের ঘাটে কাটলো কৈন্যার ততক্ষণ, যতক্ষণ ছিল ভাগালুনৌকার শেষ অস্তিত্বটুকু দরশনে।
- ফিউরিয়োসা - September 26, 2024
- অনবরত অনুসন্ধান || সজীব তানভীর - September 26, 2024
- অ্যাক্টর্স জার্নাল : শতেক পাতার লাইনটানা ব্ল্যাঙ্ক নোটবুক - September 26, 2024
COMMENTS