গত ২২ বছরে এ-রকম প্রশ্নের উত্তর অনেক দিয়েছি যে মেঘদল কীভাবে হলো, মেঘদল নামটা রাখার নেপথ্যের ভাবনা কি, এখনো আমি ক্লান্তিবিহীন এর উত্তর দিয়ে থাকি। মেঘদলের অন্যরাও একইভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গেই আসি।
মেঘদল নামটা তো হলো তবে বর্তমান ছবির হাট বলে পরিচিত জায়গাটাকে আমাদের ছাত্রাবস্থায় আমরা মোল্লার দোকান হিসেবেই চিনি, যা কিনা একটা টং রেস্তোরাঁ। চারুকলার তৎকালীন দুপুরের আহার, চায়ের আড্ডা, মজমা যা-ই বলি না কেন এই স্পেসটা ছিল সেটা। সোহরাওয়ার্দী পার্কের এই কোনাটা তখন আজকের মতো শানবাঁধানো ছিল না। বলা যায় উঁচুনিচু মাটির পথ। এর মধ্যেই কত হুল্লোড় কত তর্কবিতর্ক। অমুক ইজম তমুক ইজম। এই জায়গাটার ভাইব্র্যান্ট একটা ব্যাপার ছিল ফলে সেটা ছবির হাটের মতো একটা বিশেষ জায়গা হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। চারুকলায় আমাদের একটা ক্যান্টিন ছিল কিন্তু সেটি ছাপিয়ে এই জায়গাটি সমস্ত ক্যাম্পাসের মধ্যে সিগ্নিনিফিক্যান্ট একটা স্পেস হয়ে উঠেছিল। এই মোল্লার দোকানের সম্মুখে আমরা তিনবন্ধু আড্ডা দিতে দিতেই আমাদের গানের দলের নাম নির্বাচন করি মেঘদল। নাম প্রস্তাবনাটা আমারই ছিল।
যা-ই হোক নাম তো একটা হলো কিন্তু এর লোগো করবে কে? তখন আমাদের তিনবন্ধুর (সুমন উজ্জ্বল আমি) একজন মেন্টর ছিলেন, বা বলা যায় আমাদের আরেকজন সিনিয়র বন্ধু, বড়ভাই ছিলেন যার নাম সব্যসাচী হাজরা। জগন্নাথ হলে তার কক্ষে আমাদের সম্মিলিত উৎপাত ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমার বহুকিছুর হাতেখড়ি সেই কক্ষে। সব্যদার একটা ১৭ ইঞ্চি মনিটর সহ পিসি ছিল। ২০০০/২০০১ সালে এইরকম পিসি সেটআপ বিশাল ব্যাপার ছিল। তো সেই পিসিতে সব্যদা সব আন্দোলন সংগ্রামের পোস্টার লোগো প্রচ্ছদ ইত্যাদি করতে শুরু করেছেন তখন। সেই সাথে নিত্য উপহার নামে একটি দোকানের জন্য নিয়মিত টিশার্ট ডিজাইন করছেন তিনি। মনে রাখতে হবে সেই সময় নিত্য উপহারের বাহারভাই, সব্যদা, ধ্রুবদা এরা সবাই মিলে টিশার্টে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির নানা মোটিফ নিয়ে কাজ করা শুরু করেছেন। আজ যা হরদম দেখতে পাই সমস্ত তরুণতরুণীদের গায়ে। সে-সময় সেটি এ-রকম ছিল না। বিদেশি নকশার আর তাদের উপাদান দিয়ে বানানো টিশার্টেরই ছিল চল। সেই ধারাটা এরা ভাঙলেন তাদের চিন্তা ও শ্রম দিয়ে। ফলে সব্যদার সেই কক্ষে শুধু যে তখন আড্ডা দিচ্ছি তা নয় তার ওই দামি পিসিটা আমাদের সকলের জন্য হয়ে উঠেছিল একটি গণমেশিন। সবাই তখন সেই পিসি ব্যবহার করার অধিকার পেয়ে গেছি। এদের মধ্যে আমাদের আরেক বন্ধু সব্যসাচী মিস্ত্রী সবচেয়ে এগিয়ে ছিল। সে আমাদের অনেককে ধরে ধরে কোরেল ড্র সফটওয়্যার শেখাতে শুরু করল। ডিজাইন, পত্রিকার মেকআপ এ-সকলকিছুর জন্য কোরেল ড্র প্রসিদ্ধ ছিল। ফলে দুই সব্যর নেতৃত্বে আমরা ডিজাইন শেখা শুরু করলাম।
মেঘদলের লোগোর বিষয়টা প্রাসঙ্গিকভাবে তখন সব্যসাচী হাজরাদার কাঁধেই অর্পণ করলাম আমরা। সব্যদা তখন কাজের চাপে পিষ্ট তার উপর নানা উৎপাত আব্দার আমাদের কিছুক্ষণ ধমকাধমকির পর কাজটা করতে রাজি হলেন। তারপর লোগোটা হলো, অ্যালবাম প্রকাশিত হলো।
সব্যদার বানানো লোগোটার মেইন ফাইলও আমরা হারিয়ে ফেলেছি আজ। হয়তো সে-কারণে মূল ডিটেইলস থেকে এখন কিছুটা বদলে গেছে তারপরও এই লোগোটি দেখে আমরা তিনবন্ধু প্রথম রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে এই হচ্ছে আমাদের ব্যান্ড এই নামলিপিটাই তখন মেঘদলের প্রথম ভিজুয়াল। এরপর সব্যদা ‘শহরবন্দী’ অ্যালবামের টাইপোটা করেন। দুটো টাইপোগ্রাফিতেই একটি সাজুয্য লক্ষ করা যায়।
এত কথা বলার পেছনে ব্যক্তিগত আবেগ আর স্মৃতিকাতরতাই মূল সে আমি জানি তবে একটাকিছু করতে গেলে এ-রকম কত কত মানুষের অবদান থাকে সেখানে এসব ব্যক্তিগত গল্পে হয়তো তার কিছুটা উঠে আসে। গতকাল এক বন্ধু সব্যসাচী হাজরাদার ওয়ার্কশপ থেকে একটা মজার ছবি তুলে পাঠিয়েছেন যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি কি প্রসেসের ভেতর দিয়ে মেঘদলের লোগোটি বানিয়েছিলেন সেটি বর্ণিত আছে। এই একটা ইমেজ ব্যক্তিগতভাবে আমার ও মেঘদলের জন্য ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এবং আমি খেয়াল করলাম আমি এর আগে এই ইমেজটি দেখিনি। কারণ তখন মূল আকর্ষণ ছিল লোগোটি এর প্রসেস নয়। আজ এতকাল পর এই ছবিটির কল্যাণে কিঞ্চিৎ স্মৃতি রোমন্থন করা গেল।
সব্যদার সাথে মেঘদলের সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা বলার প্রেক্ষাপট তৈরি হলো এর জন্য বন্ধু ত্বিষাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
২৭ এপ্রিল ২০২৫
শিবু কুমার শীল রচনারাশি
টুকটাক সদালাপ সমস্ত
গানপারে মেঘদল
- টুকটাক সদালাপ ১৯ - June 24, 2025
- টুকটাক সদালাপ ১৮ - June 14, 2025
- দুইটি দেহের একটি সফর || শিবু কুমার শীল - May 19, 2025
COMMENTS