পশ্চিমে হিজরত করনেওয়ালা এমন কারো সহিত সংলাপ || মেহেরাব ইফতি

পশ্চিমে হিজরত করনেওয়ালা এমন কারো সহিত সংলাপ || মেহেরাব ইফতি

পশ্চিমে হিজরত করনেওয়ালা এমন কারো সহিত সংলাপ

পারিবারিক স্মৃতিচারণার কথ্য ইতিহাস
[আমার ভালো নাম নীলা, নীলা মুখার্জী। বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আমার বাবা ‘নিউ’ বলে ডাকতেন; নিয়তি (ডাকনাম) নামটি বাবা পছন্দ করতেন না। কলকাতায় এসে স্কুলে ভর্তির সময় কাগজে-কলমে নাম হয়ে গেল নীলা। আমার জন্ম…কাগজপত্রে তো অন্যরকম; আসল হল ’৫৫ সালে। আর এখানে ’৫৯ সাল দেওয়া কাগজপত্রে। বাংলাদেশ থেকে চলে আসি ৮/৯ বছর বয়সে। এখন আমার বয়স ঊনষাট বছর। সুর ভালোবাসি খুব; ভালো সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। নাচের কিছু বুঝি না কিন্তু ভালো যেকোনো জিনিস দেখতে ভালো লাগে। আঁকতে তেমন পারি না; কিন্তু ছেলে (শাশ্বত মুখোপাধ্যায়) ভালো আঁকত। আমার ভাই ভালো আঁকতেন। আমার স্বামী (শম্ভুনাথ মুখার্জী) আজ থাকলে হয়ত এই পারিবারিক মাইগ্রেশনের ইতিহাস আরও ভালো বলতে পারতেন; যেহেতু সে তখন পর্যন্ত ওখানেই (পটুয়াখালী, বাংলাদেশ) ছিল। আমার অত ভাল মনে নেই। যা শুনেছি, যা মনে আছে; এখন আর বেশিকিছু মনে থাকে না। তবুও স্মৃতির শরণ নিয়ে বলছি…আমাদের কথা।]                                 

***

বিসমিল্লা
নিঃশব্দ কোরাসের গন্ধবাস—

তোমার কাকুর জন্ম (শাশ্বতের বাবা, শম্ভুনাথ মুখার্জী) ১৯৫০-এ আসল। সার্টিফিকেটে আছে ’৫২ সাল। তো, দেশভাগের ব্যাপারগুলো তো আসলে আমরা কতটুকু জানি কী জানি! ’৬৪-র রায়টের ব্যাপারে কিছু জানি…সেটা…[নীরবতা, আবার বলতে শুরু করলেন] আমার জন্ম আসলে হচ্ছে ’৫৫ সালে; জন্ম আমার। তারপর সার্টিফিকেটে একটু কমানো হয়েছে। দেশভাগ হইছে [’৪৭-এর দেশভাগ] যখন তখন তোমার কাকুই জন্মায়নি আমি কোত্থেকে জন্মাবো! আমার বাবা-মা’র বিয়েই তো হয়নি—আমার বাবা-মা’র বিয়ে হয়েছে নাইন্টিন ফিফটি ফোরে। হ্যাঁ, আমার…দেশভাগের অনেক পরে বিয়ে হয়েছে আমার বাবা-মা’র।

আমার জন্ম তো নারায়ণগঞ্জে হইছে…[চাষাড়ায়?] চাষাড়ায় না, নারায়ণগঞ্জে হইছে; বন্দরে। দেশভাগের ব্যাপার হলে ওর মধ্যে আমরা পড়ি না। কেননা আমাদের অনেক পরে জন্ম…[নানানভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম যে দেশভাগের সাথে উনার সংযোগটা কোথায়]…ওর (শাশ্বত—নীলা মুখার্জীর ছেলে—এলেন তার রুম থেকে) তো জন্ম এখানে! আত্মীয়-স্বজন (দেশভাগ) ফেইস করেছে। আমি কিছু ফেইস করিনি। আমি অই পরিস্থিতিতে কোনো সময় (অস্ফুটস্বরে), কিছুতে পড়িনি তো আমি! আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে বলতে আমার বাবা-মা সুদ্ধ আমরা এসেছিলাম। তারপর বাবা-মাকে ফিরে যেতে হয়েছে। আমার মামারা মাইগ্রেশন করে আগে চলে এসেছে…সিক্সটি ফোরে। আমি সিক্সটি ফাইভে এসেছি; তখন ছোট। তখন থ্রিতে পড়ি; [আবার কি যেন ভাবলেন খানিক]…বাবা আসেনি, বাবা আসতে পারেনি। মা ভাই-বোনকে নিয়ে ফিরে গেছে। এগুলো অবশ্য না লেখাই ভালো। তারপর আমি মামাবাড়ি চলে এসেছিলাম। মা, আমরা তিন ভাই-বোন। আমি মামা বাড়িতে থেকে গেলাম। ওদের—বাবা যেহেতু আসতে পারল না—ওরা…সংসার চালাতে হবে তো! ইনকামের লোক কোথায়? আমরা তো সব ছোট। আমার ভাই নাইনে পড়ত (স্বগতোক্তি)…ফিরে গেল। বোনও ক্লাস ফোরে বোধহয় উঠেছিল। মা ওদের নিয়ে এমনিও ফিরে গেল; আগরতলা দিয়ে ফিরে গেল। হুম! বর্ডার তো বন্ধ হয়ে গেছিল। রায়টের পরে, আমরা যখন…না আমরা যখন সিক্সটি ফাইভে আসলাম। আসার পরে বোধহয় ভারত আর চিনের যুদ্ধ লেগেছিল [শাশ্বত এবার কথা বলে উঠলেন…“সেতো ’৬২ তে। সিক্সটি টুতে ভারত চীনের যুদ্ধ”]। তাহলে ভারত-পাকিস্তান। [সালটা বুঝবার জন্য পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম]…সিক্সটি ফোরে দাদু আইছে মাইগ্রেশন করে। আমরা সিক্সটি ফাইভে এসেছি। আসার কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল বর্ডার। হ্যাঁ, আমরা যেতে পারলাম না; ফিরতে পারলাম না। নরমাল রেগুলার ভিসা অফিসে গিয়ে ভিসা, এই করে যেতে হত। রেজিস্ট্রেশন প্রত্যেকটা ধরে…[কথা খুব অস্পষ্ট। জড়িয়ে যাচ্ছে কথা। বোধহয় তিনি স্মৃতিখুঁড়ে কিছু বের করে আনছেন]।

তারপর অনেকদিন পরে ইয়ে হয়ে গেল সব। তখন সে ব্ল্যাক আউট হত, কী অবস্থা! ফ্যাক্টরি ছিল (সেখানে) আমরা ইছাপুরে যে থাকতাম। ওখানে দুইটা বাড়ি স্টিল ফ্যাক্টরি, রাইফেল ফ্যাক্টরি। সন্ধ্যা হলেই ব্ল্যাক আউট! পাকিস্তান আর ভারত; চীন নয়। চীন তো…, [আগরতলা বর্ডারটা খোলা ছিল কি না জিজ্ঞেস করলাম] মনে হয়। এটা আমার সঠিক খেয়াল নেই আইনিভাবে গিয়েছিল না লোক পয়সা নিয়ে পার করে দিয়েছিল—[অস্বস্তিবোধ করছেন এটা জিজ্ঞেস করাতে]—সেই ব্যাপারটা আছে। ভিসা সংক্রান্ত কাগজপত্রের ব্যাপার আমার সব খেয়াল নেই; মাকে যেতে হয়। মা যেত, সঙ্গে হয়ত দাদু যেত বা মামা যেত। আমরা পাসপোর্ট করেই এসেছিলাম। আমরা তো মাইগ্রেশন করে আসিনি (হাসি)। আমরা তো ফিরে যাব সেইজন্য। দাদুরা যেমন চলে আসবে বলে মাইগ্রেশন করে চলে আসল পরে। দাদু যে কোম্পানিতে কাজ করত তার নাম ছিল বেলিং কোম্পানি। কোম্পানির পার্টি অফিস ছিল ব্রিটিশদের। তা উনি—ব্রিটিশ ব্যবস্থাপক—বলেছিল, ‘তুমি যেও না। আমি ২০০ টাকা স্যালারি বাড়িয়ে দিচ্ছি।’ দাদু বলল, ‘না; আমার ছেলেরা…।’ মামারা এদিকে তিন মাস ধরে এমনি এমনি বাড়ি-ভাড়া করে রেখেছিল। কেনো, যেকোনো দিন যদি চলে আসে! আর আমরা তো ফিরে যাব বলে পাসপোর্ট করে এসেছিলাম। [উনাদের জমিজমা বসতভিটার কথা জিজ্ঞেস করলাম]…না বিক্রি করেনি; কিছুই করতে পারেনি।

আমার মামাবাড়ি ছিল…আর শ্বশুরবাড়ি যেখানে মামাবাড়িও সেখানে—বিক্রমপুর। গ্রামের নাম স্বর্ণগ্রাম। তা দাদু তো অই যেয়ে যেয়ে নারায়ণগঞ্জে চাকরি করত। দাদু জমিজমা কিছু বিক্রিও করেনি। দাদু চলে এসেছে। বেলিং কোম্পানিতে চাকরি করত; ওটা পার্টির অফিস। পাটকল তো আদমজী জুটমিল…। আমার সব রাস্তাঘাটের কথা এখন অতো মনে নেই। আমরা অইদিকে অনেকটা গিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলে যেতাম যখন তখন মাসি আসত। চিৎকার করে ডাকত। সব পাড়ায়-পাড়ায়ই যেত সবাইকে স্কুলে ডাকার জন্য। আমরা সবাই—কোয়ার্টারের যারা যারা—স্কুলে যাবার জন্য বেরোতাম। আমাদের একসঙ্গে নিয়ে যেত। [পূর্বের এক আলাপে তিনি আমাকে একজন মুসলিম নারীর কথা বলেছিলেন, তার কথা তুললাম]…হ্যাঁ, ফুলমতি নাম ছিল তার। সে বেঁচে নেই এখন। অতো ছোটবেলার কথা সব মনে নেই। আমি তো উনাকে চিনতেই পারিনি। আমি যখন ’৮২ সালে গেলাম আমার বিয়ের পরে তখন মা বলতাছে, ‘দ্যাখ! কে, দ্যাখ কে!’ তখন চিনতে পারছি না। কেনো, আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে তার কম বয়সের ছবি। আর আমি যখন ’৮২ সালে গেছি তখন তার বয়স হয়ে গেছে অনেক। আমার মাথার মধ্যে সেটা নাই। মা বলছে, ‘এই দ্যাখ ফুলমতি।’ আমার বাবা-মাকে মা বাবা ডাকত তো অইজন্য আমি তাকে ফুলমতিদি বলতাম। তখন ’৮২ সালে বেশ বয়স। এখন আর বেঁচে নেই ও।

[ব্ল্যাকআউট প্রসঙ্গ আবার টেনে আনলাম]…ব্ল্যাকআউট তো রোজই হত। সন্ধ্যাবেলা রোজ হত। অনেকদিন বোধহয় চলেছিল। এইসব আমার ছোট মামা-টামা ভাল বলতে পারবে। তখন ইছাপুরেই থাকতাম, এখানে নয়। তখন ভাড়া-বাড়িতে মামাদের সাথে; তখন বাড়িঘর নাই। উত্তর চব্বিশ পরগনায় [শাশ্বত চুপ ছিলেন; কথা বলে উঠলেন—“ব্যারাকপুর, ইছাপুর। যেখানে তোর বেশিরভাগ রাইফেল আর গান তৈরি হত”]। শাশ্বতের মা বলে উঠলেন, “না! গান তৈরি হয় কাশীপুর। কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল।” [শাশ্বত বললেন, “হুম গান অ্যান্ড শেল…অস্ত্র তৈরি হয় অই চত্বরে। ইছাপুর, ব্যারাকপুর”]। [রিফিউজি লেবারদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে]…“না, ব্যারাকপুরে কখনো…” [শাশ্বত বললেন, “ওখানে মাইগ্রেটেড লেবার আগে ছিল। মানে বাংলাদেশি কলোনি ওখানে অনেক ছিল, এখনো আছে।” আবার জোরে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ তারা তো আর সেভাবে নেই, তারা…”] শাশ্বতের মা এই ফাঁকে আমাকে বললেন…“পাউরুটিটা শক্ত হয়ে যাবে খেয়ে নাও…” [শাশ্বত বলছেন, “জেনারেশন টু জেনারেশন…তারা এখন ইভলভ করে গেছে। তারা নিজেদের স্ট্রাকচার তৈরি করেছে। তাদের ওখানে আইডেন্টিটি তৈরি হয়েছে।”] শাশ্বতের মা বললেন, “ব্যারাকপুরে কোনো ফ্যাক্টরি নেই। ফ্যাক্টরি আছে ইছাপুরে। রাইফেল আর মেটাল। মেটাল এবং স্টিল ফ্যাক্টরি আর রাইফেল।”

[পরে আবার দেশে ফেরার সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হল]…আগরতলা দিয়ে আমি ফিরিনি। আমি তো এখানে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি। আমাকে বাবা সিক্সে ভর্তি করে ফিরে গেলেন। মাঝখানে গ্যাপ গেল, স্কুল নিতে চাইছিল না। বললাম, না! আমি পারব সিক্সে। ওখানে (বাংলাদেশে) ক্লাস থ্রি পাস করে ফোরে উঠেছিলাম। তখন তো ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শেষ ছিল। তারপর এখানে এসে বসে থাকলাম। ভর্তি হওয়া-টওয়া হল না। শুধু ভাইকে সঙ্গেসঙ্গে ভর্তি করে দিয়েছিল। এজন্য ভাই আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে রয়ে গেল। হ্যাঁ, না! সেভেনে ভর্তি করায়নি (একটু ভেবে)…ভাইও তখন ফোরে, হ্যাঁ! তারপর ভাই ফাইভে উঠল। তারপরে নাইন অব্দি…নাইনে ওঠার পর চলে গেল। কমার্স নিয়ে নাইনে ভর্তি হয়েছিল। নাইনে উঠে গেছিল; কিন্তু থাকতে পারল না চলে গেল (বাংলাদেশ)। আমি আর বোন বসেছিলাম। আমরা গ্যাপ দিয়ে ভর্তি হয়েছি। আমার মা ভাই-বোনকে নিয়ে ফিরে গেল। তারপরে ওখানে গিয়ে…সেগুলো নিয়েও সমস্যা হয়েছে অনেক। কলকাতার কথা বলছে ভাই-বোন। এখানে যে ক’বছর থাকল! সমস্যা। কুমিল্লায় বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে বোনকে রেখে এসেছিল। (পাড়ার লোকজন) বলছে, ‘ওরা সবাই এতদিন কোথায় ছিল!’ [আমি প্রশ্ন করলাম, “না, যদি বলত এতদিন কলকাতায় ছিল তাহলে কী হত?”]…কিছু অসুবিধা নিশ্চয়ই হত। এমনিতে সবসময় বলত ব্যানার্জী ফ্যামিলি…(নিজে নিজে স্বগতোক্তি)। আমার বাপের বাড়ি ব্যানার্জী। [আবার প্রশ্ন করতে হল প্রসঙ্গটি বুঝবার জন্য: “পরে আপনি যখন দেশে ফিরলেন…এরপরে আপনি আর কখনো দেশে ফিরেননি? মানে পার্মানেন্ট”]…না। আর ফিরিনি তো! তারপরে তোমার কাকু (শাশ্বতের বাবা) বিয়ের পরে ফার্স্ট নিয়ে গেল ’৮২ সালে। আর তোমার কাকু এসেছে—আমার থেকে পরে—’৭১-এ এসেছেন। মানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, হুম! কীভাবে যে এসেছে—খুড়তুতো ননদ—আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল ওরা। তারা আবার পাথরের বাটি ধরাইয়া দিছে তোমার কাকুর হাতে (অট্টহাসি)। তাদের নিয়ে তোমার কাকু এসেছে কত ভয়ে ভয়ে। তার বয়সটাও কম ছিল তখন। আরেকটা খুব ছোট ননদ ছিল; আমার থেকে ছোট বয়সী। কোথায় চলে গেছে তাকে খুঁজে পাচ্ছে না, কী সাংঘাতিক! জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দিয়ে কত কষ্ট করে… উনি ত্রিপুরা দিয়ে ঢুকছিল সম্ভবত। এসেছে বালিগঞ্জে; ফুটপাতে থেকেছে। পরে বালিগঞ্জে ভাড়া বাড়িতে থাকত।

পটুয়াখালীতে খুড়শ্বশুরের বিশাল ব্যবসা ছিল। দু’টো দোকান ছিল। একটাতে লেপ-তোষক, বিছানা তৈরি হত। আরেকটা কাপড়-জামার ছিল। উনি কি করেছে আমি সঠিক অতো জানি না, অতো খেয়াল নেই। তবে উনি ’৭১-এ যখন প্রবলেম হইল না তখন উনি একাই নদী সাঁতরে পটুয়াখালী থেকে পরিবার রেখে চলে গেছিলেন। তারপরে মুসলিম এক ভদ্রলোক সন্ধ্যাবেলায় আসেন। এসে আমার খুড়শাশুড়িকে বলছে যে, ‘বৌদি উমম…দাদা নিরাপদে আছে। আপনি চিন্তা কইরেন না।’ মানে, আমার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে খুব খাতির ছিল সেই লোকটার। দোকানে বসত, পেপার পড়ত, চা খাইত। উনার নাম ছিল মুসলিম খলিফা। প্রচুর করছে উনি সত্যি কথা বলতে। তারপরে বললেন, ‘বৌদি আপনি দেরি করবেন না। ওদের নিয়া আপনি আমার সঙ্গে চলেন।’ তারপরে উনার বাড়িতে নিয়া গেল। নিয়া আশ্রয় দিল। এবার খালি চারিদিকে রব ‘কে আসছে, তোমাগো বাড়ি কে আসছে?’ উনি বললেন, ‘আমার আত্মীয়।’ তারপর অনেকদিন থাকার পর দেখল যখন যাচ্ছে না,  তখন তারা (এলাকার লোকজন) ঢুকবেই বাড়িতে! লোকজন বলছে, ‘দেখব আমরা।’ আর এমনিতেই ভদ্রলোক অই আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে বলে রেখেছিল যে, ‘বৌদি সিঁদুর পইরেন না।’ আর এরকম কইরা (হাত দিয়ে ওড়না পরার ভঙ্গিতে), তোমাদের যেমন এমন কইরা ঘোমটা দেয় না? বলছে, ‘এমন কইরা একটু ঘোমটা দিবেন। আপনাদের বাঁচানোর জন্যই আমি এসব করছি।’ তখন সেইভাবেই শুনত। কিন্তু যখন আর পারছিলেন না উনি মানে ঢুকবেই বাড়িতে; ঢুকে দেখবেই কোন আত্মীয় স্বজন আছে। তখন ওনার জামাইকে উনি খবর দিলেন। জামাই কোথায় যেন থাকত।

অই আমার দেওরই একদিন গল্প করছিল। বলে,—এইসব ঘটনা তো ও তখন কমবয়সী। ওর মনের মধ্যে গেঁথে আছে, না!—বলে, ‘বাংলাদেশ যেতে আমার আর ইচ্ছা করে না। আমার অনেক জায়গা দেখার, বেড়ানোর আছে।’ তারপরে ওরা সেই গরুর ঘরে, শীতের রাত আর গরুর ঘরে মহিষও ছিল। উমম গর্ত গর্ত…কী ঠাণ্ডার মধ্যে এইভাবে সারাটা রাত পড়ে রইল ওখানে। উনারা আইসা ঘরটর…গরুর ঘরে যে থাকব বুঝতে পারেনি। তারপরে উনারা সব ঘরটর দেইখা গেল; দেখল যে কেউ নেই। খলিফা বলল, ‘বৌদি আমি বোধহয় আপনাগো আর বাঁচাইতে পারুম না।’ তারপর উনার জামাই খুব ভোর ভোর চারটের দিকে এসে…উমম ওদের গাড়ি করে—অবস্থা ভাল ছিল—মেয়ের বাড়িতে নিয়ে গেল। তারপর ’৭১-এর প্রবলেম মিটে যাবার পর আমার শ্বশুর মশাই গিয়ে—প্রথমে ভাইকে যেতে দেননি—আমার শ্বশুর মশাইয়ের আবার মামাতো ভাই (খুড়শ্বশুর) উনি যার ব্যবসাটা ছিল। (কিছুটা অস্পষ্টতা)…না, তখনো উনি আসেন নাই। খুড়শ্বশুর মশাই অনেকটা পরেই আসছে। আর আমার শ্বশুর মশাইরাও…উনার তো অন্য কিছু না। উনি…, তখন আমরা এখানে থাকতাম। এবার উনারা বয়স্ক মানুষ উনাদের জন্য তো চিন্তা হয়, না! অসুস্থ হয় কী হয়…আমার মা খালি বলত, ‘নিয়া যা।’ আমাদের লাকসামে কিন্তু কিছু প্রবলেম হয় নাই। এখানে যেমন রায়ট-টায়ট হইছে। লাকসামে কিন্তু কোনো…তখন তো আমি ছোট আমি তো বাড়িতে সিক্সে পড়ি। আমার ঠাকুরদাদা মারা গেছিল; গলায় ক্যানসার হয়েছিল। আমার দাদু মারা গেলেন; দাদুকে সমাধি দেওয়া হল। আমাদের বৈষ্ণব বাড়ি তো। বৈষ্ণব মতে…, উমম আমার বড় পিসিমা আসতে পারেনি; নারায়ণগঞ্জে ছিল। ওখানে কিন্তু কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিচ্ছু নেই। এখানেও যেমন আছে কিছু কিছু জায়গায় খুব গণ্ডগোলের জায়গা আছে। আবার ভালো জায়গাও আছে। সেরকম ওখানেও আমাদের ওখানে কিচ্ছু হয়নি। [দাঙ্গার কথা মনে পড়ে কি না জিজ্ঞেস করতে]… না, আমি তো কোনো দেখিনি কিছু। আর আমার মামারা…অই যে অই কোম্পানির যে মালিক বেলিং কোম্পানির—উনি তো রাইফেল নিয়ে ছাদের উপর উঠে—উনার বাংলোতে সবাইকে জায়গা দিয়েছিলেন। উনার দু’পাশের যতগুলো কোয়ার্টার, ধরো এগারোটা এগারোটা করেও যদি হয় বা দশটা করেও যদি হয়, বিশটা কোয়ার্টারে কুড়িটা ফ্যামিলি। মানে সবাইকে নিয়ে ওখানে; বলেছে, ‘আমি আর আমার ছেলে আমাদের জীবন থাকতে আপনাদের কিচ্ছু হবে না।’ রাইফেল নিয়ে ঘুরেছে আর ইন্ডিয়াতে মিলিটারি সাহায্যও চেয়েছিল। বেলিং কোম্পানির মালিক ব্রিটিশ নাগরিক ছিল। তারপরে বললেন, ‘আমরা যদি ফেল করি তখন মহিলাদের বলবেন যে আপনারা সম্মান নষ্ট করবেন না। আপনারা ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের শেষ করে দেবেন।’ এটাই বলেছিল। কিন্তু সেরকম কিছু করতে লাগেনি। সিক্সটি ফোরের কথা বলছি। আর আমার দিদিমা তো একটু অন্যরকম। সে…, ওখানে তো গঙ্গাজল পাওয়া যায় না। তো সে (হাসি) হাতের মধ্যে গোবর নিয়ে, একটা ধোয়া কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আর বলছেন, ‘কাইন্দো না কাইন্দো না গোবিন্দ আছে কিচ্ছু হইব না। কিছু হইব না।’ সবাই কাঁদছে ভয়ে কমবয়সী যারা। যায়নি তো কেউ! একা কোয়ার্টারে ছিলাম। আমাদের আবার পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠাপুলি হয়। এইসব কত…সবাই রান্না করেছে। কিছুতেই আসুম না। ছোট মাসি আর ছোট মামাকে নিয়ে চলে গেছে দারোয়ান এসে। দিদিমা যাবে না। তারপরে দাদু এসে দারোয়ান এসে জোর করে নিয়ে গেল।

এবার অই দেশভাগের ব্যাপারগুলো…সেগুলো খুব একটা আমার জানা নেই। [মায়ের কাছ থেকে কী শুনেছে জিজ্ঞেস করলাম]…আমি মায়ের কাছে থাকতে পেরেছি কোথায়! আমি তো এখানে থেকে গেলাম আমার দিদিমার কাছে। মামাদের কাছে যেটুকু শুনেছি। অই যে আসলাম তারপরে যে মা চলে গেল তারপর তো আর যাওয়া হয়নি আমার। মায়েরা এসেছিল, বাবা-মা এসেছিল, ছোট মাসির বিয়ের পরে কিংবা ছোটমামার বিয়ের পরে। তো তখন আমাদের এত আত্মীয়-স্বজন এত ঘোরাঘুরি এসব গল্প করার সময়…। আমার মা-বাবা তারা কখনোই এখানে একবারে চলে আসেনি। তারা ওখানেই ছিল। হ্যাঁ, লাকসামে। আমাদের বাড়িরই ওখানে। আমার সাথে যোগাযোগ চিঠি…হ্যাঁ, চিঠির মাধ্যমে। প্রচুর চিঠি লেখালেখি হত। আমার বাবা তো ভীষণ…। আমার লেখা চিঠি তো বাবা-মায়ের কাছে ছিল। বাবার চিঠি, মায়ের চিঠি নিশ্চয়ই সব আছে। আমার বাবার লেখা খুব সুন্দর ছিল। তখন চিঠি লেখার অভ্যাস ছিল তো প্রচুর; নববর্ষ, বিজয়াতে এইসব প্রণাম জানিয়ে। এই করে করে আছে চিঠি অনেক। আমাদের দুর্গাপূজার পরে বিজয়া দশমীর চিঠি পাঠাত।

[দুর্গাপূজার কথা প্রসঙ্গে] …হ্যাঁ, মামাবাড়িতে যখন ছোটবেলায় যেতাম সেটা মনে আছে। তারপর তো বিয়ের পরে গেছি। তোমার কাকু পাসপোর্ট করে নিয়ে গেল। আর শ্বশুর মশাই প্রত্যেকবারই লিখত—‘শেষপূজা, আর করতে পারুম না।’ ওর কথা বলত (শাশ্বতকে দেখিয়ে), ভাইদা বলত তো! ভাইদারে নিয়া চইলা আসো। তারপর তো আসবে না কিছুতেই জোর করে আনা হইছে (শ্বশুর-শাশুড়িকে ভারতে নিয়ে আসবার কথা বলছেন)। আমার মা খালি বলত…, আমার মামা বাড়ির দিকে আবার ওদের (স্বামীর) বাড়ির দিকে একটা দুঃসম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। সেজন্য আমার মায়েরা কখনো বেয়াই-বেয়াইন বলতেন না। ছোড়দা বলেই ডাকত। বয়সের অনেক তফাৎ ছিল। আমার মা-বাবা অনেকটাই ছোট ছিল। বলত, ছোড়দারে-বৌদিরে নিয়া যা। আর সত্যি কথাই উনারা অই কামারখাড়ার অতবড় বাড়িতে দু’জনে থাকত একটা কাজের মেয়ে নিয়ে। খুবই খারাপ লাগত। আমার বাপের বাড়ি তো ঠিক সেরকম না। বাপের বাড়িতে প্রচুর লোক। আমার কাকু আছে, খুড়তুতো ভাইরা আছে, অনেক লোকজন। আর বাবা আবার যখন কোনো কাজে ঢাকায় যেত তখন মা মানসিক…(স্বগতোক্তি)। আমার শাশুড়ি সাধাসিধা বলেই ওরকমভাবে কাটাতে পেরেছে। নাহলে অতবড় বাড়িতে কাটানো সম্ভব ছিল না।

তোমার কাকু যখন গেছিল দেশে…(একটা ফোন বেজে উঠল ঘরের কোথাও)। শাশ্বতের মা বললেন, “তুমি খেয়ে নাও খেয়ে নাও।” আমি বললাম, “খাচ্ছি।” [কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম, “তো মা যখন আসত তখন আপনি মাকে বলতেন না যে তুমি থাইকা যাও আমার কাছে, যেও না। মানে, আপনি তো ছোট ছিলেন।”]…(খেতে খেতে কথা বলছি)…না, তখন যখন মা এসেছে তখন আর আমি ছোট নই। তখন আমি মাধ্যমিক, স্কুল ফাইনাল পাস করে গেছি। [সেই যে আপনি সিক্সে ভর্তি হলেন, চারপাঁচ বছর আপনার মায়ের সাথে কোনো দেখা হয়নি!]…না, কী করে হবে! তখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা কি! একাত্তরে যে সব শেষ হয়ে গেছে, না! ঘরবাড়ি ভেঙ্গে-চুরে, জিনিসপত্র তছনছ, সিন্দুকভর্তি জিনিসপত্র সব চুরি। অর্থনৈতিক অবস্থা কী সাংঘাতিক। আর সব তখন আমাদের বয়স্ক মানুষ। আমার ঠাকুমা, ঠাকুমার মা, ঠাকুমার মামা-মাসি  হ্যাঁ…তখন তো সাংঘাতিক পরিস্থিতি। এটা আবার একাত্তরের কথা বলছি; একাত্তরের কথা।…এমনিতে আমি বিয়ের পর যখন গেলাম, ১৭ বছর পর আমার বাড়িতে গেলাম। প্রথমে শ্বশুরবাড়িই গেছি। বিয়ের পর তো দুর্গাপূজা ওখানে। যাওয়ার পর…হ্যাঁ শ্বশুরবাড়িতেই তো যাওয়া উচিত। বিয়ে হয়ে গেছে না আমার? আমি দুর্গাপূজায় গেছি তো। দুর্গাপূজার বোধহয় দু’তিনদিন আগে গেলাম। তা পূজাটা শেষ করে, তখন আমার মায়েরাও ওখানে এসেছে। পূজার সময় শ্বশুর মশাই গিয়ে অনেক সময় নিয়ে আসত মাকে। দুর্গাপূজায় বিশাল কাজকম্ম।

তো লোকজনের দরকার হয় তো! আমার খুড়তুতো ভাই-টাইরা আসত। বাড়ির থেকে সব কাজের লোকদের নিয়ে আসত। তারপরে ওখানে থেকে তারপর বাড়ি গেলাম। লক্ষ্মীপূজা হয়ে গেল, তারপর বাড়ি গেলাম; লাকসামে গেলাম। বেশিদিন থাকতে পারিনি; সাতদিন মাত্র। সে তখন আমার ঠাকুমার কী কান্না (ভাসমান স্মৃতির আবছা আর্তনাদ চোখের সামনে ভেসে ওঠায় যেমনতেমন হাসলেন)। আর তোমার কাকু (শাশ্বতের বাবা) মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি যেত। কেনো, তখন তো বিয়ে-টিয়ে হবে জানে না। মানে মামা বাড়ির দিকের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। এবং, বাংলাদেশের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সবার যোগাযোগ ছিল। যাওয়া-আসা করত। ঐজন্য ঠাকুমা বলত, আমার নাতিন জামাই আমি দেখুম না, আমার নাতিনরে আমি দেখুম। খুব কান্নাকাটি। তারপরে সব থেকে বড় কথা মন তো ভরেনি, না! সাতদিন মাত্র থেকেছি বাড়িতে। আর আমাদের বাড়ির পরিবেশই এমন এখানকার লোকেরা গেলেও খুব খুশি হত। বলে, ‘আমরা দিল্লি-বম্বে সব অনেক জায়গায় ঘুরি। অইরকম আনন্দ কোথাও পাই না।’

আর বাবা-মা অন্যরকম মানুষ ছিল। খোলামেলা কতবড় বাড়িঘর…যৌথ পরিবার না!

উম্মম…কাকু ছিল, বাবা ছিল। অন্য সবাই তো এদিকে (ভারতে)। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো প্রতিষ্ঠিত রাধামাধব আশ্রম। তারপরে, আমাদের ফ্যামিলি থেকে দীক্ষা দেয়। এই রাধামাধব বিগ্রহ কতবার চুরি হয়ে গেছে! চুরি করে অরা ইসকনে পাচার করে। পয়সার জন্য বিক্রি কইরা দিত। সব মন্দির-টন্দির সবই তো আছে এখনো। রাধামাধবের বিগ্রহ ছিল পিতলের তৈরি, বড় বড়। দু’বার বোধহয় চুরি হয়েছে। পিতলের জিনিস বানানোর ওখানে লোক ছিল। সে তো থাকবেই…থাকবেই তো। তারপর অই যে পুজো করে সে একটা ঠাকুর মশাই থাকতেই হয়। সারাদিনে সকাল থেকে পুজো। তারপরে এই যে যারা মারা যায় তাদের—তোমাদের যেমন কবর দেয়—আমাদের সমাধি বলে; দাহটা আমাদের করে। আমাদের বাড়িতে যে এটা…ওটা চৈতন্য মহাপ্রভুর বৈষ্ণব ধর্মানুসারে। তবে চৈতন্য মহাপ্রভু উনি উনার ফ্যামিলির কাউকে কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মটাকে প্রচারের জন্য দায়িত্ব দেয়নি। সেটা দিয়েছিল অদ্বৈত মহাপ্রভুকে। উনারই দশম বংশধর যারা তাঁদের দুই ভাইয়ের (গঙ্গারাম গোঁসাই ও বৃন্দাবন চন্দ্র গোস্বামী) সমাধি আছে আমার বাপের বাড়িতে। তারপরে পরপর কয়েকবার গেছি দুর্গাপূজায়। কেনো, শ্বশুর মশাই বারবার বলতেন। আর বাবা তো আসেননি আর। মা তাও এসেছেন (শ্বশুর-শাশুড়ির কথা বলছি)। আর বাবাকে তারপর জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। নিজেদের পূজামণ্ডপ ছিল। বলি হত; বাবা নিজে (শ্বশুর মশাই) বলি দিত। কিন্তু, বিষয়টা জমি-জায়গার না। শোনো, এই যে রায়টগুলো হত। এই যে সাংঘাতিক পরিস্থিতি। সেটা তো হিন্দুদের একটা ভীতি ছিল, না! মানুষ এমনি এমনি চলে আসে! হ্যাঁ, আর আগেকার ঘটনা তো আমরাও অত জানি না, তোমরা তো এক্কেবারেই জানবে না। খুব অত্যাচার হত, সাংঘাতিক ব্যাপার। এখন গেলে বাংলাদেশে কারো ভয় লাগবে না, কিছু না। এখন অন্যরকম একটা ব্যাপার। তাও কিছু-কিছু জায়গায় প্রবলেম হয়। হ্যাঁ…আমার মা চিন্তা করত। বাবা অতটা চিন্তা করত না। চিন্তা করলেও বাবার কিছু করার ছিল না। যেহেতু আশ্রমের দায়িত্বটা বাবার কাঁধে ছিল (বাবা আশ্রমের সেবায়েত ছিলেন)। সেবায়েত বলতে এটা আমাদের ফ্যামিলি ব্যাপার ছিল না; কিন্তু জড়িয়ে পড়েছে। জড়িয়ে পড়েছে মানে বাবার দাদু…হ্যাঁ তাকে তার গুরু (উজ্জলমণি গোস্বামী) যে, মহিলা ছিলেন উনি। উনি দায়িত্বটা দিয়ে গিয়েছিলেন আশ্রমের। তখন দাদু মারা যাবার পর বাবার যে দিদিমা, সে তখন বাবাকে বলল, তুই সংসারের—(কাকু একটু অন্যরকম ছিল, কাকু নিজের সাজগোজ নিজের ব্যাপার নিজেরটা বেশি ভাবত)—বাবা ওরকম ছিলেন না; আমার বাবা। আমার বাবা ছেঁড়া ধুতি পরে, ছেঁড়া চটি পরে থাকতেন। বাবার অইসব কোনো…দিদিমা বুঝেছিল যে এই হালটা ধরতে পারবে। আরেকটা গল্প করেছে আমার ভাই। (নবাব) ফয়জুন্নেছা, একজন সম্রাজ্ঞী ছিলেন। উনি অনেক জমি দান করেছিলেন আমাদের ঐ  আশ্রমের জন্য। আশ্রমের নাম ছিল রাধামাধব সেবা আশ্রম। এখনো নাম তো আছে; ট্রাস্টিবোর্ড আছে। এইজন্য আমার বাবা আসতে পারেননি; বাবা পারেনি। আর মা ভয় পেয়েছিল যে আমাদের কী হবে! তাদের তিন ছেলেমেয়ের কী হবে। এইসব চিন্তা করেই আমাদের নিয়ে মা এসেছিল পরিস্থিতিটা বোঝার জন্য। সব পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেল। আমি আটকে গেলাম যেতে পারলাম না। কাজেই আমাদের ভাবনা-চিন্তা করার যে ওখানে আরামে থাকব, ওখানে তো আরামের থাকা নয়। অনেক ফেইস করতে হয়েছে। আমার বোন অনেক বছর পরে সেদিন গল্প করল যে বালিশের নিচে হাত-দা নিয়ে ঘুমাত। অনেকে আমার খুড়তুতো ভাইদের বলত, ‘তোর দিদিরে তুইলা নিয়া যামু।’ মা-বাবা যদি বাড়ি না থাকত; কোথাও আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেলে, সেই আতঙ্ক নিয়া বাস করা! বোন কলেজে যখন কুমিল্লায় গ্র্যাজুয়েশন করল তখন তো ঐ মৃণালিনী দত্ত ছাত্রী নিবাস, অই হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছিল। তারপর তো চলে আসল, বিয়ে হয়ে গেল। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাদের ওখানে গিয়ে—সে আবার আমার শ্বশুর মশাই এর মামাতো বোন হয়—পছন্দ হয়েছিল আমাদের বাড়ির পরিবেশ দেখে, আমার বোনকে দেখে তার চালচলন দেখে; তারপর বিয়ে হল। এখানে এসেই বিয়ে হয়েছে। আমরা যে ভাড়া থাকতাম সে ভাড়া-বাড়িতে থেকেই বিয়ে হয়েছে। কাজেই এগুলো সব হচ্ছে পরিস্থিতির শিকার। ওখানে (বাংলাদেশে) অত বড় বাড়িতে থাকব, এই থাকব, তার সঙ্গে অনেক আতঙ্ক-ভয় অনেক কিছু ছিল তো! এই যে আমার মেজো মাসি যে তাকে আগে পাঠিয়ে দিল। মেজো মামা, বড় মামা সব চলে এসেছে। কাদের কাছে এসেছে? আমার বড় মাসি যে—তখন কিন্তু আত্মীয়-স্বজন খুব হেল্প করত;  বলছে যে—আমার বড় মাসির শাশুড়ি বলছে, ‘কেনো, আজকে আমার একটা মেয়ে থাকলে!’ মেয়েরা ওখানে থাকলে ভয়ের ছিল তো; অনেক ভয়ের ছিল। তারপরে সে চলে আসল এখানে।  এখানে এসে ভর্তি হল।

হ্যাঁ, নানারকম তেমনই ভোগও করতে হয়েছে। ফ্যামিলিগত ব্যাপার হয় না? [আচ্ছা, আপনি যে স্কুলে ভর্তি হলেন। এবার তাতে ভাষার কোনো সমস্যা হয়েছিল কি না!]…না, ভাষার কিচ্ছু সমস্যা হয় নাই। আমরা পাল্টে ফেলতে পারি, জানো তো! যেমন, আমাদের সঙ্গে একটা মেয়ে পড়ত। ওরাও ওখান থেকে এসেছে। তখন তো এরকম অনেকেই এসেছে। তখন এইটা নিয়ে অত আইনি  জটিলতা ছিল না। এই যে মাইগ্রেশন করে আসাতে ছোট মাসির তো পুরো সারা বছরের স্কুলের ফিসটা ফ্রি ছিল; মাইগ্রেশন করে যেহেতু এসেছে। তাদের তো জায়গা-জমি দিয়েছে, অনেক কিছু করেছে সরকার অনেক হেল্প করেছে। আমার ছোট মামা তো সেইবার, সিক্সটি ফোরে তো ছোট মামা মেট্রিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট করল; খুব ভাল করল। তখন অনেক বন্ধুরা বলেছে, ‘তোরা চলে যা, তোরা এখানে থাকতে পারবি না।’ হ্যাঁ, তো ছোট মামা এসে বঙ্গবাসীতে আইএসসি—তখন  আইএসসি-বিএসসি ছিল—ভর্তি হল। তারপর কাশীপুরে গান অ্যান্ড শেলে চাকরি হল। তো ক্লাসে যে এসে ভর্তি হয়েছিল ওরকম অনেকেই ছিল। তা ওর কথা বলতে গিয়ে…,ওর কথা কিন্তু পাল্টায় নাই (হাসি)। ও খেচুড়ি বলত খিচুড়িকে। খেচুড়ি, বান্ধাকপি। আমি বলতাম, ‘এই তুই পাল্টাবি না তুই!’ অন্যরা এগুলা নিয়ে মজা করলেও সেভাবে আঘাত করে নাই। [তারমানে সেইসময় কেউ আঘাত দিত না এই ভাষা নিয়ে?] না, না। [মানে, এই মাইগ্রেশনটাকে তারা খুব একটা খারাপ চোখে দেখত না?] না, না! আর বাংলাদেশের লোক, হ্যাঁ…কিন্তু কিছু যারা পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা তারা খোঁচাইত। এখনো তো তারা কমেন্ট করে যে বাংলাদেশিগুলি যদি বাংলাদেশে যায় তাহলে আমরা একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকব, বাঁচব। এ’রম কমেন্ট করে। তোমরা তো পড়োনি অইসব পরিস্থিতিতে তাই তোমরা তার মূল্যেও বুঝো না। কিন্তু আমার মাইমা ছিল; মাইমা পশ্চিমবঙ্গের। মাইমা একজন টিচার ছিল। খুব শখ ছিল আরকি বাংলাদেশ দেখার। তা ঘুরিয়ে এনেছে। আমার মামা নিয়ে গেছিল। আর আমার ভাই একজন—কামারখাড়ায় তো এখন অই আমার শ্বশুরবাড়িতে এখন গাড়ি ঢুকে যায়। এখন ব্রিজ-টিজ রাস্তা-টাস্তা তো সব জায়গাতেই পরিবর্তন হয়েছে, না! মুন্সিগঞ্জ থেকে ঐদিকে বোধহয় রাস্তা হইছে। একদম বাড়িতে মাইমাকে নিয়ে গেছিল। মাইমার খুব আকাঙ্খা, খুব দেখার ছিল। মেজো মামা বলে, ‘জানিস যাওয়ার পর খুব ভয় পেয়ে গেছে সব।’ যারা ঐ দখল করে আছে। হাসিনা ইয়ে করেছে না যে যারা কাগজপত্র দেখাতে পারবে তাদের—কিন্তু কে আর কাগজপত্র রাখছে (অট্টহাসি)! অত যুদ্ধ করছে এখানে আইসা তখন আর কাগজপত্রের কথা কারো মনে…তারপরে মামা বলে, ‘আমি তারপরে বললাম যে আমার বৌ খুব বাংলাদেশ দেখতে চায় তো তাই নিয়া আসছি তাইরে।’ তখন শান্ত হইল। তাড়াতাড়ি কইরা চেয়ার-টেয়ার দিল। ডাব কাইটা দিল। বলে—মাইমা বলে, ‘জানিস আমাকে আবার বোতলের মধ্যে আচার ভরে দিয়েছিল।’ এগুলো কিসের থেকে করে? আন্তরিকতা থেকেই তো করে। প্রথমে ভয় পাইছিল…ভয় পাইছিল সেটাও স্বাভাবিক। সবারই তো…এত বছরের শিকড় গেড়ে নিছে হুমম…আমাদের ঐ কামারখাড়ার অই বাড়িটা দুইশ বছরের ছিল। এই যে ঢাকুরিয়ার বাড়িটা পড়ে আছে…শরিকী প্রবলেম! তোমার কাকু চাইছিল যে প্রোমোটারকে দিলে পরে সবাই তো থাকতে পারত। গ্রাহ্য করে নাই (কেউ)। [কাকুর বাংলাদেশের প্রতি অনেক টান ছিল…] হ্যাঁ, ভীষণ তো…এই যে ঘুইরা আসল একা-একা গিয়া, বাবা! কাস্টমস অফিসাররা খুব রেগে গেছে। বলে, ‘আপনি একা যাবেন?’ বলে, ‘হ্যাঁ যাব আমি একা।’ তখন বলে যে—কেনো, তখন হাত-পা কাঁপে তো এরকম…এরকম করে হাত-পা কাঁপছে তো—একজন বলছে, ‘বসুন চুপ করে।’ আরেকজন বলছে, ‘ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও।’ তা কাকু একদম একা যায়নি। এখান থেকে যেমন একজন গেছিল বিক্রম ব’লে, আমাদের ওইদিকেই থাকে। সে গিয়ে একদম বনগাঁ বর্ডারে দিয়ে এসেছে। কেনো, সে তো আর ভেতরে ঢুকতে পারবে না। আর ওখানে আবার লোক আছে। বর্ডারে জানাশোনা লোক ছিল। সে আবার গিয়ে বাসে তুলে দিয়ে এসেছিল। প্রথমে পটুয়াখালীই গেছিল। আবার, আমার ভাই তখন এখানে ছিল। ভাই বলল, ‘আমি বাড়ি নাই তুমি যাইবা?’ বলে, ‘না, তুই যাইতে যাইতে আমি যামু গা।’ তারপরে আমাদের বাড়িতে যখন গেছে তখনো ভাই যায়নি; তারপর গেছে। কিন্তু আমাদের যারা সব বাড়িতে থাকে, কাজকম্ম করে; ওরা তো সব চেনে তো। খুব যত্ন করছে। বলে, ‘আমারে পিঠা কইরা খাওয়াইছে’—(উচ্ছল হাসি)। তা এর বন্ধু বান্ধবের বাড়ি—তোমার কাকু তো পড়াশোনা করছে পটুয়াখালী থেকে। বিএসসি ওখান থেকে। এখানেও তো অ্যান্ড্রুজে আইসা ভর্তি হইল ভালো রেজাল্ট করল। স্টুডেন্ট তো ভাল ছিল। আবার ফিরে গেল। যদি অইখানে বিএসসিটা কমপ্লিট না কইরা এখানে করতে পারত, এখানে যখন থেকেই গেছিল…তাহলে যেই লাইনে ছিল সেই লাইনে না থাইকা অন্য লাইন ঢুকতে পারত। আর তখন চাকরির এত হাহাকারও তো এখানে ছিল না।…(অ্যাই তোমার পাউরুটিটা শক্ত হয়ে গেছে)…হ্যাঁ!

[আপনার কখনো মনে হইছে যে ইন্ডিয়াতে থাকা একরকম আবার বাংলাদেশে থাকা তো আরেক রকম। দুইটা দুইরকম। তো এইটা নিয়া আপনার মধ্যে কোনো মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে কি না। আপনার মনের মধ্যে কোনো অনুভূতি!]…না, বাড়ি গেলে তো…দেখো জন্মভূমির প্রতি টান ওটা আপসে হয়। এই যে আমি যখন যেতাম তখন তো একটা আনন্দ নিয়া যাইতাম। কিন্তু, আবার যখন ফিরে আসতাম—বোনেরও, আমারও—বোন তো আরও বেশি থেকেছে।  গ্র্যাজুয়েশন করে, এই করে ও তো বিয়ের জন্য চলে আসে। তখন খুব কষ্ট হত তো! জন্মভূমির প্রতি টান সবার থাকবে, প্রত্যেকের থাকবে। এই যে আমার বোন এখন বলে। বলে কি, এই যে এনসিস—কী একটা হচ্ছে না? [আমি বললাম, ঐ যে এনআরসি?]…হ্যাঁ, এনআরসি…এনআরসি। তো বোন বলে, ‘আমারে যদি পাঠায়ে দেয়, আমি নাচতে নাচতে যামু গিয়া (খিলখিল হাসি)।’ হাসতে হাসতে…কোনো অসুবিধা নাই হা হা। কিন্তু আমি ইকোনমিক্স না সিভিক্সে পড়লাম যে— বিবাহসূত্রেও তো নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, তাই না! হ্যাঁ, তা বোন বলছে, ‘আমারে যদি পাঠায়ে দেয়’—এটা আমার ভগ্নিপতিকে বলতাছে—‘তোমার চিন্তা নাই। আমি যামু গিয়া (আবার হাসি)।’ তাদের তো জন্মকর্ম সব এখানে! তাদের…তোমার কাকুর যেমন একটা ভীষণ টান ছিল। কেনো, আনেকটা বড় হয়েই তোমার কাকু এখানে এসেছে। আমার ছোট মামাও মেট্রিক পাস করে এখানে আসল। এখানে আইএসসি, বিএসসি করে ইয়ে করল। প্রত্যেকেরই, থাকবে না! ওখানে আমাদের বাড়িতে বিশাল বৈষ্ণব সম্মেলন হয়েছে, এটা সেটা আমার ভাই করেছে। সবাইকে নিয়ে গেছিল; আমার মাসি-টাসিদেরও। রোজই হয় সন্ধ্যাবেলায় নামসঙ্কীর্তন…এইসব। আমার বাবা-ভাই তো এতদিন সামলেছে। এখন তো আর তারা বেঁচে নেই। তো আমার খুড়তুতো ভাই-টাইরা ভাল না।  তাদের মানসিকতা খুব খারাপ। আমার মা যেমন একটা শিক্ষিত ফ্যামিলির মেয়ে তো, আমার দাদু (শ্যামাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়) খুব সৎ শিক্ষা দিত। এই যে নারায়ণগঞ্জ কোয়ার্টারে বিশাল বিশাল কোয়ার্টার আর উঁচু উঁচু পাঁচিল দেওয়া। কারো বাড়ি থেইকা কারো বাড়ি দেখা যাইব না। আর ধরো এরকম কোয়ার্টারের মাঝখান দিয়ে রাস্তা আর ছোট ছোট এরকম গেট। মানে তুমি এক কোয়ার্টার থেকে আরেক কোয়ার্টারে অই গেট দিয়ে দিয়ে যেতে পারবে। কারো প্রয়োজনে…আর বিশাল বড় গেট একটা, একদম লাস্ট কোয়ার্টারের মধ্যে বিশাল গেট থাকত। তো ধরো ওদের বাড়ির আতাগাছের ফল আমাদের (দাদুর) কোয়ার্টারে পড়ল। দাদু বলত, ‘যাও, দিয়া আসো’— আমাদেরকে পাঠিয়ে দিত। এরকম সবকিছু সততা, ভাল কিছু শিখিয়েছিল দাদু। দুপুরবেলা জোরে কথা বললে, ‘আস্তে কথা কও, আস্তে কথা কও। তুমি ঘুমাইতেছ না কি হইছে! তোমার পাশের বাড়ির লোক তো ঘুমাইতেছে।’ ‘চিৎকার করবা না’—এইসব শিখাত। বাচ্চাদের সাথে জোরে কথা বললেও রেগে যেত। ‘আস্তে আস্তে কথা কও—যেমন দিবা তেমন ফিরাইয়া দিব।’ মানে, তুমি তার সঙ্গে যেরকম আচরণ করবে, সে সেরকম স্বভাবটা…বাচ্চাকাচ্চারা কেউ খারাপ থাকে? থাকে না তো! আমরা তাদের খারাপ করি, পরিবেশের কারণে। চিৎকার করে কথা বলে, চিৎকার করে মারধোর করে…মারধোর করলেই কি মানুষ হয়! সেটা বুঝিয়ে বলতে হয়।

এখানে (যাদবপুর) এসেছি ২০০২ সালে। এর আগে তোমার কাকু সোনারপুরে বাড়ি করছিল। সেটা বিক্রি কইরা দিয়া এখানে আসতে হইল। আর সোনারপুরে ভাড়াও ছিলাম। দু’টো বাড়িতে ভাড়া ছিলাম। আর আমার বিয়ের আগে তোমার কাকু, তার দাদা, তার বৌদি, ওরাও একটা বাড়িতে ভাড়া থাকত। আমার ভাসুর তো বহুদিন এখানে। আলমোড়ায় আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম আছে ওখানে থাকত। [যদি আপনার বাবা-মা প্রথমে চলে আসত তাহলে কী জীবন অন্যরকম হত?] (হাসি) সেইটা তো বলতে পারব নাহ…বাবা-মা’র থেকে দূরে থাকার কষ্ট থাকে কিন্তু এটা কাউকে দোষারোপ করা কিছু করার ব্যাপার নাই। আমার মা তো যুদ্ধ করেছে, আমার মা তো চেয়েছিল আমরা এখানে এসে স্বাধীনভাবে দাঁড়াই, ভালো হই। ওখানে কী ছিল? বাড়ির মধ্যেও তো কোন্দল ছিল, না! কাকুর শিক্ষা-দীক্ষা কম ছিল। যেটা বাবার ছিল; বাবা খুব দুর্দান্ত স্টুডেন্ট ছিলেন। সে আমার পিসিমা গল্প করেছে। এত কিছু তো জানার কথা না। যখন বাবা মেট্রিক পাস করল অনেক লেটার নিয়ে এই করে…বাবাকে গ্রামের লোকেরা সবাই মিলে কাঁধে কইরা ঘুরাইছে লাকসামে। তারপরে কুমিল্লাতে যে কি…সংস্কৃত কলেজ, নামটা ভুলে গেছি। আজকাল মনে করতে পারি না; নামকরা সংস্কৃত কলেজ ছিল একটা…ভিক্টোরিয়া না। সেখানে চট্টগ্রামের এক মাস্টার মশাই এসে আমাদের বাড়িতে থাকত। চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া-আসাও সম্ভব নয়। ওখানে পড়াতেন। কি বেশ নামটা ছিল একদম ভুলে গেছি। পিসিমা আমাকে বলেছে, তখন ওখানে ভর্তি হতে গেছিল বাবা। তখন নিল না। কেনো, কি কারণ? তিনপুরুষ থাকতে হবে। লাকসামে তিনপুরুষ থাকতে হবে। কিন্তু আমার বাবারা তিনপুরুষ ওখানে ছিল না তো। আমাদের আদিবাড়ি ছিল খিলপাড়া, শ্রীনগর থানা। এবার আমার ঠাকুরদাদা যখন ছোট্ট এইটুকু তখন ঠাকুরদাদা’র বাবা মারা গেল। বাবা মারা যাওয়াতে জ্ঞাতিরা বিধবা মা আর দাদুকে, ছোট্ট বাচ্চা নিয়েই তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে। সেই কারণে জায়গা-সম্পত্তি কিছুই পায়নি। বাবা ঐ ব্যাপারটা জানেও না। বাবারা মামাবাড়িতেই বড় হল। সেজন্য ওখানে আর পড়া হল না; সংস্কৃত কলেজটার নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। নামকরা ছিল, এখনো লোকের মুখে মুখে…ইয়ে হয়। মা মারা গেছে আগরতলায়। ওখানে সব শিষ্যবাড়ি আছে; গিয়েছিল বেড়াতে। হার্ট অ্যাটাক, হ্যাঁ! হাই প্রেশার ছিল…রাস্তাতেই (শূন্যে তাকিয়ে আছেন চশমার রিমের উপরের ফাঁকা যায়গাটা দিয়ে)…আগরতলাতেই তো হসপিটালে নিয়ে গেছিল নাকি ত্রিপুরা! হসপিটালে বলল, ‘উনি আধঘণ্টা আগে শেষ হয়ে গেছেন।’ আমরা কেউ দেখতে পারি নাই তো শেষদিন। ভাইও না আমরাও না। আমাদের এখানে টেলিগ্রাম করা হয়েছে…টেলিগ্রাম আসতেও দেরি হয়েছে। বোন— বিয়ে হয়ে গেছে তখন—আমি সব এখানে। ভাই বাড়িতে ছিল। আরেকটা অসুবিধা হয়েছিল। লাকসাম থেকে ত্রিপুরা-আগরতলা আসা তো কোনো অসুবিধা ছিল নাই। ওখান থেকে সোনামুড়া অল্প রাস্তা। সোনামুড়া থেকে দেখা যায় কুমিল্লার ট্রেনগুলো যে যাচ্ছে। আর বাবারা বোধহয় পাসপোর্ট নিয়ে আসেনি। এমনি এসেছিল। সেজন্য আইনি জটিলতা ছিল; মাকে—যার জন্য মা’র ডেডবডি ওখানে নিয়ে যেতে পারেনি। সোনামুড়ায় দাহকাজ করে দিয়েছে (প্রগাঢ় বৃদ্ধার বিষণ্ণতা কাটজুনগরের দেয়ালে দেয়ালে চেপে বসেছে যেন)। [অনেকক্ষণ নীরবতা]…সেইকারণে, আমার বাবাও একটু ভীতু, আমার অই কাকুও একটু ভীতু। তারজন্য উনারা খুব ঘাবড়াইয়া গেসিল। মা সাহসী ছিল খুব। [মায়ের সারাজীবনের যুদ্ধ প্রসঙ্গে] …কিন্তু কিছু করতে তো পারেনি! একটা মহিলা চাইলে তো আর হবে না। পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলোও থাকতে হয়। কিছু করার ছিল না (এতক্ষণ ধরে তিনি যে আবেগ চেপে রেখেছিলেন সেটা এবার ওনার কণ্ঠস্বরে পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত)। [মায়ের প্রসঙ্গে আরও একটা কথা পাড়লাম; এড়িয়ে গেলেন…কথা আটকে আসছে ওনার]…তারপরে আমার দাদু—মায়ের বাবা আরকি—উনিও অনেক অন্যরকম ছিলেন। মানে আমাদের জন্য খুব চিন্তা। আর, ‘তুমি একটা মেয়ে হয়েছ বলে তোমারে একটুখানি লেখাপড়া শিখেই বিয়ে দিয়ে দেব’—এরকম মানসিকতা উনার ছিল না কিন্তু।

আমি যখন স্কুল ফাইনাল দিয়ে বসে আছি তখন তো আর কম্পিউটারের যুগ না যে…‘ক্যান বইসা আছ ক্যান, ক্যান সময় নষ্ট করতাছ!’—এসব বলত। তো আমার মাসতুতো দিদির বন্ধু, ও ভাল গান জানত আরকি; গান শিখত ও। ঐ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর ছাত্রী। উনার বাড়ি তো শ্যামনগরে। আর আমরা ইছাপুরে থাকতাম। ও আচ্ছা, আমার দিদিমণির নাম ছিল মৃদুলা দে। তাই এখন খুব খারাপ লাগে। যোগাযোগ রাখতে পারি না। এখন তো যাওয়াও সম্ভব না…বেঁচে আছে না মরে গেছে! খুব ভালবাসত। ‘মৃদুলার কাছে যাও, মৃদুলার কাছে যাও’—দাদু জোর করে পাঠাল গান শেখার জন্য। হ্যাঁ, মায়ের হারমোনিয়ামটাও ছিল।

ওটা দাদুদের সঙ্গে এসেছিল (বাংলাদেশ থেকে)। যেহেতু দাদুরা মাইগ্রেশন করে এসেছিল; আমরা দাদুদের একবছর পরে এসেছি। দাদুরা সিক্সটি ফোরে… [প্রশ্ন করলাম, তাহলে ওরা হারমোনিয়াম নিয়ে এল কেনো?] দাদুদের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হল, দাদুরা মাইগ্রেশন করে এসেছে বলে নিয়ে আসতে পারবেন। পাসপোর্টে তো তোমার বাধ্যবাধকতা আছে। তাও…বাবা পরে গল্প করছে; বলে, ‘কী যে আমার অবস্থা ভাবতে পারবি না। অনেক কাঠের পিঁড়ি ছিল, দিদিমা বলে এগুলি যাইব এগুলি বান্ধো।’ এবার, শ্বশুর-শাশুড়ির কার কথা ফেলবে! দাদু বলে, ‘না ওগুলি সরাও তুমি ওগুলি যাইব না।’ (হাসি) কত মাল নিয়ে আসবে! সেভাবে মনে নাই কি নিয়া আসছে…হারমোনিয়াম পাঠানো অই যে মা’র মনে প্ল্যান! মা’র মনে তো প্ল্যান ছিল এগুলো, না! যে আমার মেয়েরা ওখানে যাবে, ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওখানে যাব। ওরা ওখানে লেখাপড়া করবে এই করবে।

এসব ভাবনা চিন্তাগুলো ছিল বলেই তো মা এইটা দাদুদের সঙ্গে পাঠিয়েছিল। ঐ হারমোনিয়াম দিয়ে বিয়ে পর্যন্ত শিখেছি; ’৮২ সাল পর্যন্ত। ক্লাসিক্যাল, ক্লাসিক্যালটা না শিখলে কি করে হবে! ক্লাসিক্যাল মেইন তার সঙ্গে নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমার বেশি পছন্দ নজরুলগীতি। নজরুল তো সুরের বেশি…কাউকে অসম্মান না, যার যার জায়গায় সে সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি সুরকে ভালোবাসি। ওনার (অজয় চক্রবর্তী) বাড়ি তো ময়মনসিংহে ছিল! ওনার জন্ম এখানে, ওনার বাবা চলে এসেছিল এখানে। ওনারা এসে প্রচুর যুদ্ধ করেছে। সেসব বলে তো! উনি ডাব বিক্রি করেছে; চিন্তা করতে পারো! শ্যামনগর স্টেশনে। ওনাকে সামনাসামনি দেখেছি। আমার দিদিমণির বাড়িতে আসত তো উনি, তখনও পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী হয়নি। আমার দিদিমণির মেজোদি, তার বিয়ে হল তখন এসেছিল। তখন আমি পায়ে হাত দিয়ে ওনাকে প্রণাম করেছিলাম। ঐ দিদিমণিদের আর ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারত না। তখন মানে উনার যুদ্ধ চলছে, কলকাতায় গুরুজীর বাড়িতে থাকত। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ হচ্ছেন ওনার গুরু। হ্যাঁ, তারপরে কানাই দাস বৈরাগী; তাঁদের নামে রাস্তা করে দিয়েছেন নৈহাটিতে। উনি কিন্তু ভুলেননি; এই সবকিছুকে ভুলে যাননি। [গান কন্টিনিউ না করার বিষয়ে]…কী করে সম্ভব! [কাকু মানা করেছে?] না, না মানা করবে কেনো! মানা করার প্রশ্ন আসে না। তোমার কাকুর যে ধরণের কাজ ছিল গার্ডেন রিচে, ইমার্জেন্সি ব্যাপার! রাত-বিরাত নাই কেবল কাজ। তারপরে আমার দু’জন বয়স্ক মানুষ শ্বশুর-শাশুড়ি। এ (শাশ্বত) ছোট। আমি গানবাজনা নিয়ে থাকলে কী করে হবে! ওটা হয় নাকি, অন্যরকম পরিবেশ থাকলে অন্যরকম। [দেশভাগ না হইলে কেমন হইত?] দেশভাগ না হ’লে তো ভাল হত। সবার জন্যই ভাল হত। এই যে ধরো ঐ যে ত্রিপুরাটা…আগে তো কুমিল্লা জেলা ছিল না; আগে তো পুরোটাই ত্রিপুরা ছিল। সেটাও তো আমরা ভাবি যে, ত্রিপুরা যদি…আমাদের বাড়িটাও যদি ত্রিপুরায় থাকত তাহলে তো আমরা এদিকেই পড়ে যেতাম। আর অসুবিধা হত না। হুম! ত্রিপুরা জেলা…আগে ত্রিপুরা জেলাই লিখতাম আমরা। তারপর তো কুমিল্লা হল। সত্যি কথা বলি, আমার বুদ্ধি খুব নিম্নমানের (খিলখিল হাসি)…আমি গভীরভাবে অত ভাবনাচিন্তা, আমার জ্ঞানগম্যি কম তো! আমি কি অত কি সেইভাবে…ধরো, রাজনীতি নিয়ে যেকোনো কিছু নিয়ে অত কি পড়াশোনা করেছি! লাভ লস হইল কী না…তাও বুঝি না আমি। কিন্তু আমাদের বাড়িঘর আমাদের ইয়ে সেগুলো তো চাইবই। হইলে হয়ত ভাল হইত। [সমস্যাটা কী শুধু হিন্দু-মুসলমানের?] না, এখন মানুষের মানসিকতা অনেক পাল্টে গেছে তো! আগে তো আমাদের বাড়িতে ধরো মুসলমানরা না প্রসাদ নিত না। ভয় পেত। সমাজ, অন্য মুসলমানরা তাদের ইয়ে করবে। যারা আমাদের ধরো ক্ষেতে লাঙ্গল চাষ করেছে, বাড়িতে কাজ করেছে, বেশিরভাগই তো মুসলমান। হিন্দু আর ক’জন ছিল! তারাই তো কাজ করত।

তারপরে পরবর্তীকালে আমার বাবা সাহস দিয়ে, তাদের আলাদা একটা ঘর ছিল ওখানে দরজা বন্ধ করে ওদেরকে খেতে দিত। হ্যাঁ, যারা খাচ্ছে ওদের মনে কিন্তু কোনো আড়ষ্টতা নাই। সমাজ তো! তাকে নিয়ে…না ধরো, একটু তো গরিব মানুষ; লোকের বাড়ি যখন কাজ করছে তা পয়সা-কড়ির অভাবেই। তাই পেটের দায়ে কাজ করছে। তো তারা উচ্চশ্রেণীর মানুষদেরকে ভয় পাবে, না! সেজন্য তারা সমাজের লোককে ভয় পেত। অইজন্য যে, খাইলে যদি কিছু করে, আমগো কিছু…মারে…কোনো কিছু করে। সব-জায়গায়ই এমনটা আছে।  [প্রশ্ন করলাম, এমনি মুসলিমরা, যারা ছিল খেটে-খাওয়া, রাখাল, জমিতে কাজ করত, বাসাবাড়িতে—তারা কি নির্যাতিত ছিল? হিন্দু জমিদার যারা অবশিষ্ট ছিল, যাদের জোতজমি এত্ত বেশি ছিল—জমিদারি না থাকতে পারে, জায়গা জিরোত তো কম ছিল না। কারণ…]

অই যে এখানে অনেকে বিশ্বাস করব না। ঐ যে আইসা বলে আমার এত জমি ছিল এই অই ছিল, এগুলা বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে মিথ্যা কথা বলে। কিন্তু, ছিলই তো! হ্যাঁ, আমাদের বাড়িটা শুধু সাতাশ কাঠা। শুধু বাড়িটা…বাস্তু। তারপর ঠাকুরবাড়ি আলাদা, তারপরে তো আরও জায়গা জমি আছে, আবার সমাধি যাদের হয়েছে তাদের ঘর, রাধামাধবের ঘর। তারপরে বড় করে পঞ্চবটী ভিটি…তোমাকে ফটো পরে দেখাবো আমি। আর জমি তো অগুনতি ছিল! ঐ যে লাকসামে অনেক সিনেমা হল হয়েছে, বিড়ির ফ্যাক্টরি হয়েছে ইয়ে হয়েছে। ঐ যে আমাদের বাবা আমাদের বিয়ে-টিয়ে দিয়েছে এই দেশে। তা কি করবে? বাবাকে তো চাকরি করতে দেয়নি বাবার দিদিমা। নিকলীতে…নিকলীটা কোথায়, ফরিদপুর? না, আমি জানি। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম। নিকলীতে দাদু বাবাকে চাকরি দিয়েছিল। বাবার হাতের লেখা অসম্ভব সুন্দর ছিল, পড়াশোনায় ভাল ছিল। ওটা অফিস ছিল। তখন দিদিমা ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। ‘আমার নাতি চাকরি করব! আমার জমিদারি তাইলে কে দেখব!’ বাবাকে গিয়া…এটা আমার দাদু, দাদু খালি ভাবত এ তো পড়াশোনায় ভাল, এ তো ইয়ে সেই… দাদু বলছে, ‘তুমি আরও পড়লা না কেনো!’ পড়ল না…এইটা উম্ম অই অসুবিধার কারণেই আর এগোনো হল না। যাইহোক। এখনকার দিনে হয়ত লোকে অন্য জায়গায় গিয়ে চেষ্টা করত অই করত। তখন তো এসব ভাবনা চিন্তার…কে ছিল! আর, বাবার বাবাও অন্যরকম ছিল। অর্থনৈতিকভাবে সে উইক ছিল, না! কেনো, তার জ্ঞাতিরা তাকে ঠকাইছে। জায়গা-সম্পত্তি কিছুই দেয় নাই। মাকে, বাচ্চাকে বের করে দিয়েছে। সেই কারণেই বাবার আর…তাই এখন লোকে শুনলে হাসবে যে, চাকরি করতে দেয় নাই। আমার দাদুও তো করেছে; সে ডাক্তারি পড়েছিল, ডাক্তারি পড়তে পড়তে ডাক্তারি ছেড়ে দিল। মনে হয় প্রিন্সিপালের সঙ্গে…আমার দিদিমা বলেছিল আমাকে, আমার সব খেয়াল নাই—কোনো প্রবলেম হইছিল হয়ত। মানে অন্য কোনো ছাত্রের হয়ে কিছু বলতে গেছিল। ডাক্তারি পড়া ছেড়েছিল…এখনকার দিনে কেউ ডাক্তারি পড়া ছাড়ে! [আপনার বাবার চিঠি দেখান আমাকে, আছে…?] না, হাতের কাছে নাই। পরে দেখাচ্ছি, দাঁড়াও! কোথায় কখন কি রাখি মনেও থাকে না…[এই বাসায় আছে?] হ্যাঁ, এখানেই আছে…আর কোথায় থাকবে

***

আরও কত গমগিন পালিত হতাশার

[অনেকটা সময় বকবক করে ক্লান্ত। আমি শব্দ জব্দ করার যন্ত্রটি বন্ধ করতে করতে আরও কিছু খুচরো প্রশ্ন করব কি না ভাবছিলাম; তিনি শুধালেন, “খাবে না? মাছ করেছি।” আমি বললাম, শুনেন না কাকি কয়েকটা জিনিস বাদ পড়ে গেছে।]

সোনারপুর নিয়ে আপনি কিছু বললেন না।

হ্যাঁ! না, সোনারপুরের জীবনটা…বাড়িটা ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে। এত কাছে স্টেশনের, অত ভাল পজিশনে বাড়িটা ছিল, অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যেত তো! স্টেশনে যে অ্যানাউন্সমেন্ট করত…হুম! আমি তখন যাদবপুরে এসে খুব মার্কেটিং করতাম। এখনই আসলে অত যাই না। এতগুলি রিকশা ভাড়া দিয়া গায়ে লাগে।

সোনারপুরে আপনাদের আশেপাশে বাঙালরা ছিল?

হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত ওখানকার স্থানীয়রা। তারা আমাকে পরে গল্প করেছিল—যে এখন তো অনেক শিক্ষিত লোক এসেছে, এই এসেছে, অন্যরকম হইছে। কিন্তু, (আগে) তারা পুকুরে নামতে দিত না।

কেনো?

না, বাংলাদেশের লোক মানেই অস্পৃশ্য মানুষ…বাঙাল! হ্যাঁ, এরকম ধরণের ধ্যান-ধারণা থেকে।

আপনাদের সঙ্গে কখনও এরকম বিহেভ? মানে যারা…

না, না! আমাদের সাথে না। আমি তো আসলে ছোট্টবেলায় এসে গেছি এখানে।

আপনাকে আর আলাদা করে ইয়ে করত না এটা?

…কথা-বার্তাও তো ছিল না! এখন বরং যাদবপুরে আসার পর বাঙালরা তাদের নিজেদের মত…  এখানে সবাই বলে-টলে অসুবিধা নাই। এখানে শুঁটকি মাছ-টাছ খায় সবাই রান্না করে।

ওখানে শুঁটকি যারা খাইত তাদেরকে কি কোনোরকম সামাজিক

না, না! ওসব করতে পারত না। যারা খাওয়ার ঠিকই খাইত…(স্বগতোক্তি)। হ্যাঁ, নিন্দা করত আড়ালে। শুঁটকি মাছ খায় বাঙ্গালরা…কিন্তু, আমার মেজ মাইমা পশ্চিমবঙ্গের। আমার মামা নিয়ে আসত চট্টগ্রাম থেকে। এনে সবাইকে, যারা যারা খায় সবাইকে দিত। আর আমার মাইমা বলত কি, ‘মেজদি,’—আমার মা তো মেজ বৌ ছিল—‘মেজদি আপনি রান্না করুন।’ মাইমার মধ্যে অই জিনিসটা ছিল না যে বাংলাদেশের লোক…বাঙাল (কি যেন বিড়বিড় করে বললেন)।    বরং বলত যে বাংলাদেশের লোকেরা রান্নাঘরে অনেক সময় কাটায়। মানে নানারকম রান্না করে। এবার আমাদের…সত্যি কথাগুলো বলত আরকি। মাইমা একজন স্কুল-টিচার ছিল। খুব আগ্রহ ছিল, দেখিয়ে এনেছে তো! কামারখাড়ায়ও গেছে। ভাই একদম গাড়ি করে নিয়ে গেছে লাকসাম থেকে। এখন তো সুবিধাই। এখন তো আর অত ব্রিজ-টিজের ব্যাপার নাই। গাড়িটা একদম বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে। আমার বাবার বাড়িতেও ঢুকে যাবে।

যখন জানত যে আপনি বা কাকু আপনারা বাঙালআপনারটা তো অনেকদিন এখানেই ছিলেন সেটা আর বোঝার অবস্থা নাই কিন্তু কাকুকে দেখে অনেকটা বোঝা যেত?তার কথাবার্তা!

না, না। তারও কথাবার্তা পাল্টে গেছে; অত টান নেই।

কিন্তু সে একটা আইডেন্টিটি বহন করত তার মধ্যে?

না, কাকুর অত…কেনো, কাকু তো শহরে ছিল। ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ এসব জায়গায়। কাকু তো শহরে রয়েছে। শহরের লোকেরা এসব নিয়ে কম মাথা ঘামায়।

আচ্ছা। এমনি ধরেন আপনাদেরকে বাদ দিয়ে মানেবাঙাল কমিউনিটি’র ব্যাপারে ওনাদের ধারণাগুলো কী ছিল?

শুনো, একটা ঘটনা বলি। নিউ ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্স—ওটা বোধহয় এলআইসি’র কোনো কোম্পানি—এখন আছে নাকি জানি না। শিয়ালদায় অফিসটা ছিল। আবার আমার পিসতুতো দাদা সেখানে চাকরি করত। দাদা একদিন হাসতে হাসতে আমাদের গল্প করছিল; খুব সুন্দর দেখতে। উনি হচ্ছেন আমার বড় পিসিমার দেওরের ছেলে। ওরা…চাঁদপুরে ওদের বাড়ি ছিল।  হীরালাল গাঙ্গুলি বলে ওনার নাম। বয়স্ক যারা আছে তারা এখনও চিনবে। সার্জারিতে খুব নাম ছিল ওনার। ওনার একটা সাইকেল ছিল আর ওরকম টুপি ছিল। মানে এখনকার লোকেরা চিনবে না। পুরনো যদি খুব বয়স্ক কেউ থাকে তারা ঠিক চিনবে। তা অই উনার ছেলে আরকি বলছে, ওই দাদা নিউ ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্সে চাকরি করত। তখন এক ভদ্রলোক, অফিসেরই এক ভদ্রলোক বলছে, ‘গাঙ্গুলিবাবু আপনি না আমার মেয়ের জন্য একটা সম্বন্ধ দেখবেন, হ্যাঁ! একটা ভাল ছেলে-টেলে এরকম…বাঙাল দেখবেন না কিন্তু, হ্যাঁ! বাঙালরা খুউব আনকালচার্ড হয়।’ তখন পাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেসে ফেলেছেন উনি। তখন ওই লোক বলছেন, ‘হাসছেন কেন আপনি?’ বলছেন, ‘আপনি কারে কইতাছেন? কারে কইতাছেন আপনি বাঙালরা আনকালচার্ড? উনি নিজেই তো বাঙাল।’ তখন [লোকটি] থতমত হয়ে গেছে। এই যে ধ্যান-ধারণাগুলো কত খারাপ এগুলো! কিন্তু কোনো বাংলাদেশের লোক কিন্তু আর এখানকার লোককে অত হেয় করে কথা বলেনি। এরকম খুব…এটা ছিল আগে ভীষণ। এখন আর নেই। এখন সবাই বিয়েও দিচ্ছে সবই করছে। এখন সেই জিনিসটা উঠে গেছে। তবে আমাদেরও কিন্তু একটু আছে সত্যি কথা বলতে। এই দেশিদের আচার-আচরণ আমাদের পছন্দ হয় না। তাদের মানসিকতা…

কীরকম?

বাঙালরা হয়ত…তুমি আমি খুব ঝগড়া করলাম। কিন্তু আমাদের খোলামেলা! গ্রামের লোকেরা যেমন; ঝগড়া করে, বিপদে কিন্তু ঝাঁপায়ে পড়ে। হ্যাঁ, খোলামেলা। কিন্তু ওদের মধ্যে কীরকম বল তো? কুচুটে। উপরে তোমাকে খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে, দিয়ে পেছনে…(স্বগতোক্তি)।  [বাঙালদের মধ্যে] ওইটা নাই।

আপনি বললেন না যে আমাদেরও এদেরকে দেখার একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে

 অই যে মনটা ছোট একটু; কিপটে। হ্যাঁ, ওদের মধ্যে আন্তরিকতার ব্যাপারটা খুব কম। অভিনেত্রী সাবিত্রী চ্যাটার্জী, উনার ইউটিউবে একটা প্রোগ্রাম…উনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন কোন সালে যেন। সে বলছিলেন সবার আন্তরিকতার কথা…কিন্তু উনি কষ্ট পাইছে, কি বল তো উনিও…উনার বোধহয় কুমিল্লায় জন্ম। পরবর্তীকালে বাবার কর্মসূত্রেও বোধহয় কোথায় ঢাকায়-টাকায় বা বিক্রমপুরে কোথাও ছিলেন হয়ত। মানে (উনি বলছিলেন), ‘আমি গাছের ডালে…আমি ছেলেদের মতো ছিলাম। গাছের ডালে উঠে শুয়ে আমি ঘুমাতাম এরকম।’ সাংঘাতিক ব্যাপার। তা বলছে, ‘না গেলেই বোধহয় ভাল হত।’ উনি উনার ছোটবেলার সেই দিনগুলিকে খুঁইজা বেড়াইছেন। উনাদের বাড়ি-ঘর তো আর সেরকম নাই। এখন অন্যরকম হইয়া আছে; পইড়া গেছে। যা’হোক। কিন্তু সবার যে আন্তরিকতা, সবাই—যারা উনার বাড়ির আশেপাশে, তারা সবাই ছুইটা আসছে। যে, ‘সাবিদি আসছে।’ সেই (আকাঙ্খা) উনার পূর্ণ হইছে। বিয়া তো করে নাই। ভীষণ খোলামেলা; উনার মনও খুব খোলামেলা।

আরেকটা কথা বলি, এখন এই যে আমাদের আত্মীয়-স্বজন। এখন আমার বাড়িতে ক’টা আসে? আমার ভাইটাও চলে গেছে; আগে তো তাও ওর যখন এখানে মাথা গোঁজার জায়গা হয় নাই…আসত এখানে এক মাস থাকত। সেরকম সবার একটা আসা-যাওয়া ছিল। এখন কর্মব্যস্ততার কারণে সবাই…যেমন, বোনের বাড়িতে; বোনের ছেলেমেয়েরা আমার কাছে এসে থাকত। সেদিন আমার বোনের নাতি-নাতনি হইছে। তো তাদের একটু জামা-টামা কিনে দিলাম। সেই বোন এসছিল, পাঠিয়ে দিয়েছি। তখন বোনের ছেলে হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছে, ‘ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। আমরা তো ছোট ছিলাম কিছু বুঝতাম না। কিন্তু তুমি যখন আসতে তখন একটা অন্যরকম ব্যাপার হত। আর ছোটবেলার সেই দিনগুলো তো আর ফিরে আসবে না।’ (দাঁত বের করে হেসে) আমার বোনের ছেলে আর তোমার দাদা (শাশ্বত) দু’জনে স্বাধীনতা সংগ্রামী সাজত। দুই হাতে দুই বন্দুক নিয়া দরজার পিছনে লুকায়ে থাকত।

কোন স্বাধীনতা সংগ্রাম?

 মানে ‘দেশ আমার দেশ’ বইলা একটা সিরিয়াল হইত। সেটা তো ওরা দেখত! দেখে ওগুলো খুব ওদের মনে ধরত।

‘দেশ আমার দেশ’ বলতে পূর্ববঙ্গ?  

না না, পার্টিশনের। স্বাধীনতা সংগ্রামী বলতে সেটার কথা বলছি। তারপরে দরজার আড়ালে দাঁড়ায়ে থাকত…কিং ফোর্ড হত্যা করছে কিং ফোর্ডকে (অট্টহাসি)…বন্দেএএএ মাতরম্ করে দু’জনে (হাসির বেগ বাড়ছে)…তোমার কাকু ঢুকত অফিস থেকে আর দরজার আড়ালে লুকাইয়া দু’জনে বলত বন্দেএএ মাতরম্! (আবারও হাসছেন) ওই যে দেখত সিরিয়ালটায়…দেখে সেইসব আরকি মনের মধ্যে; এইসব হতে থাকত। তারপর থেকে আস্তে আস্তে সবার পড়াশোনা, চাকরি। আগে যেমন খুব আত্মীয়-স্বজনদের যাওয়া-আসা ব্যাপারটা ছিল। তখন লাইফস্টাইলটাও অন্যরকম ছিল। এত ব্যস্ততা ছিল না। এখন আর এটা করা কঠিন!

আপনি সিরিয়ালের কথা বললেনকলকাতায় যে সিরিয়ালগুলো চলে, সেখানে কিছু টাইপক্যারেক্টার দেখায় শাদা চুলওয়ালা, বুড়ি মহিলা, ‘বাঙাল’ ভাষায় কথা বলে সেখানে ভাষাটাকে একরকম বিকৃত করে। মানে লোক হাসানোর মত করে এক ধরণের কমেডি বানানো হয়। কলকাতায় প্রায়শই আশেপাশে বান্ধব যারা আছেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেন অই বানানোবাঙাল’ ভাষায় 

আর দ্যাখো, এইখানেও মুর্শিদাবাদের একরকম টান; বহরমপুরে একরকম টান; মালদা, শান্তিপুর, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর—নানান জায়গায় একেরকম টান।

আবার কলকাতা সাউথে একরকম টান; সোনারপুর কিংবা বারুইপুর

হ্যাঁ। এরা বলে ‘দেইরে’ আছি, ‘দউরে’ যাও। এই যে আমার কাজ করে, ও তো ঐদিকে থাকে; আর তোমার কাকু ওকে বলত, ‘এই তুই কবে পাল্টাবি কথা!’ রান্নাঘরকে বলে আন্নাঘর, র-এর উচ্চারণ করে না।

ইনি কোন দিকে থাকতেন?

অই ক্যানিং লাইনে। তো সেরকম বাংলাদেশেও তো চট্টগ্রামের কথা আমরা বুঝতে পারি না; সিলেটের কথা বুঝতে পারি না। নোয়াখালীর কথা…কিন্তু ঢাকা, বিক্রমপুর, পাবনা, খুলনা; তারপর ময়মনসিংহ, ফরিদপুর—সব কথা বোঝা যায়, কোনো অসুবিধা হয় না। এই আমার বিয়ের পর সোনারপুরে একজন চট্টগ্রামের মহিলা আসতেন বয়স্ক। এসে [কথা] বলতেন অনেক। এবার আমি যদি হ্যাঁ হু না করি, মাথা না নাড়ি…আমার তো অভদ্রতা হয় হা হা! আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ, কী মুশকিলের কথা।

সে চাটগাঁও এর ভাষায় কথা বললে তো কিচ্ছু বুঝবেন না

হ্যাঁ! [তোমার] দাদার (শাশ্বত) ছোটবেলায় কোনো একটা পোলিও-এর কোর্স ছিল। ইঞ্জেকশন দিতে গেছি। তো সোনারপুরের মেইন রাস্তার মধ্যে সব দোকানগুলো ছিল চট্টগ্রামের লোকেদের। একজন ছিল আমার বাবার বন্ধু, নারায়ণগঞ্জের। তার নামটা আমি ভুলে গেছি। লক্ষ্মী নারায়ণ বস্ত্রালয়—সোনারপুরে দোকান ওনাদের। আর চট্টগ্রামের লোকেরা কিন্তু এরকম;  নিজে ঢুকলে চট্টগ্রামের আরেক লোকই নিয়া যাইব সাথে। তা ওখানে দোকানগুলো তো ওরকম। এবার আমি ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছি। ডাক্তার তখনও আসেনি বলে ভিতরে না বসে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। এবার ওনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। আর ও ছোট ছিল। তো ও গিয়া পড়ছিল মাঝখানে ঢুইকা (হাসি)! এরকম হা কইরা দুইজনের মুখের দিকে তাকায়। দুইজনেই চট্টগ্রামের ভাষা বলছে। ও তো কিছু বুঝতে পারছে না! আমি তো লজ্জায় পড়ছি। আমি ওরে হাত ধইরা মাঝখান থেকে টাইনা আনতে পারতাছি না (জোরে জোরে হাসি)। পরে বেরিয়ে এসে আমাকে বলছে, ‘ও মা, মা! ওরা এরকম কী ভাষায় কথা বলছে?’ তো আমি বলছি ওনারা চট্টগ্রামের লোক তো তাই। সব কথা তো সবসময় বুঝি না। আমার ভাই যেমন ডাক্তারির ট্রেনিং নিতে নানা জায়গায় গেছে। অনেক কিছু জানে এবং বলতে পারে। তোমার কাকুরও ছিল; লেবাররা যেহেতু বহরমপুর থেকে আসত। মুর্শিদাবাদ-মালদা উম্ম ঐদিক থেকে সব এরা আসত। গার্ডেন রিচে যখন মিস্ত্রি আসত তোমার কাকু ওদের সঙ্গে ওদের ভাষায় কথা বলত। চট করে সবকিছু ইয়ে করে ফেলত…

তামাম শোধ                                                                             

শ্রুতলিখন, সাক্ষাৎকার, সম্পাদনা :  মেহেরাব ইফতি

বোধিনী

ক) সাক্ষাৎকারে সংযুক্ত ফটোগ্রাফ এবং চিঠিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নীলা মুখার্জীর ব্যক্তিগত ভাণ্ডার ও  পারিবারিক অ্যালবাম থেকে। যার ফলে আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। হারমোনিয়ামের ছবিটি তুলে দিয়েছেন নীলা মুখার্জীর ছেলে শাশ্বত মুখোপাধ্যায়। এসবের কপিরাইট তাদের দ্বারা সংরক্ষিত রইল। এই সাক্ষাৎকারটি ক্রিয়েটিভ কমন্স এট্রিবিউশন-নন কমার্শিয়াল-শেয়ার এলাইক ৪.০ আন্তর্জাতিক লাইসেন্সের আওতাধীন।

খ) অসংখ্য চিঠি এবং ফটোগ্রাফ কলেবর বৃদ্ধি পাবার শঙ্কায় সাক্ষাৎকারে যুক্ত করা হয়নি। কিছু অতি-ব্যক্তিগত পারিবারিক চিঠি শেষমুহূর্তে ছেঁটে ফেলা হয়েছে।

গ) চিঠি-যুগে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, প্রাপ্তি স্বীকারে বিলম্ব এবং চিঠির নির্দিষ্ট আয়তনে তথ্যের সবটুকুকে আঁটিয়ে নেবার তাড়না লক্ষণীয়। নীলা মুখার্জীর ভাইয়ের (খোকন) লাকসাম থেকে পাঠানো ১৯৯৬ সনের একটি চিঠি (এই সাক্ষাৎকারে সংযুক্ত নয়) সমাপ্ত হবার পর ছোট করে নিচে লেখা: “অরুন কাকু (অনখেন দাদুর ছেলে) মারা গেছেন, এর ১ মাস পর ওনার মাও মারা গেছেন। বরুন কাকুর লিভারে কঠিন রোগ৷”

আবার, বাবা নিত্যরঞ্জন ব্যানার্জীর একটি চিঠিতে (সাক্ষাৎকারে যুক্ত) জামাই এবং কন্যাকে একই চিঠির কলেবরে দু’জনকে আলাদা ভাবে উল্লেখ করে লেখা হয়েছে। মা সতী রানীর পাঠানো চিঠিতেও এই আখ্যান কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছে।

ঘ) সাক্ষাৎকারে সংযুক্ত দু’টি চিঠি (লাকসাম থেকে বাবার পাঠানো বিজয়ার চিঠি; রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে পাঠানো ভাইয়ের চিঠি) ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। বিজয়ার শুভেচ্ছা জানানো চিঠির পোস্টকার্ডে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের ফিলিস্তিনের জন-মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি নিরবিচ্ছিন্ন সমর্থনের দালিলিক প্রমান হিসেবে সরকারি ডাকবিভাগের স্ট্যাম্প রয়েছে। স্ট্যাম্পে লেখা : WE SALUTE THE VALIANT FREEDOM FIGHTERS OF PALESTINE.

বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানায় ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী’ সংকট ২০১৭ সালে হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। পূর্বেও টেকনাফে শরণার্থী শিবির ও এনজিওভিত্তিক বিদেশি অর্থায়ন ছিল। শরণার্থী শিবির থেকে নীলা মুখার্জীর ভাইয়ের পাঠানো চিঠি তার প্রমাণ। ফলে ‘বিসিএস’ টাইপের সরকারি চাকুরির প্রস্তুতিমূলক বইগুলোতে পাওয়া ‘জাতীয় তথ্য’কে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখা বিউপনিবেশিত-রাষ্ট্র গঠনের বিবিধ শর্তের  আরও একপ্রকার শর্ত।


গানপারে মেহেরাব ইফতি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you