চাঁদে-হাঁটা লোক, তুমি চলে গেলে এত অসময়ে
. চন্দ্রাভিযান ফেলে!
খামারবাড়ির ছাদে একখানা ফড়িঙকপ্টার
বামপাশে পার্ক-করা ফ্লায়িং স্যসার
চাঁদে হেঁটে হেঁটে বুঝি ক্লান্ত হয়ে ছিলে!
নানান নেশার ঘোরে ছিলে নাকি আপাদনখর
. নিমজ্জিত, ডোবা!
তারপর, চলে গেলে চিরচঙ্ক্রমিত চিলেদের দেশে
চন্দ্রগ্রস্ত মানুষের এ-ই হলো পার্ফেক্ট প্রস্থান
কবে ও কোথায় তুমি জন্মেছিলে — কোষ্ঠীপত্রে হিজিবিজি কাটা;
আমরা তো জানি তুমি অবতীর্ণ হয়েছিলে এথা —
অন্য কোনো গ্রহ থেকে, নৈসঙ্গনম্র অচেনা আলো মুখে নিয়ে;
বিপন্ন এ-পৃথিবীটিকে দেখিয়েছ বহু দুর্দমনীয় নাচ
শিখিয়েছ মোহিনী মৃত্যুমুদ্রাগুলো
আর উপহার দিয়েছ উৎকৃষ্ট উড়ালকৌশল
বিদায়, মাইকেল, প্রিয় অ্যালিয়েন!
মুক্তি তোমার আলোয় আলোয়, অন্ধকারে, চিরকালান্তরে …
কর্পোরেটকূটিল এই পৃথিবীর বাইরে এবার দেখতে পাবো
তোমার গহন নাচ, অতুল গতির গান, চন্দ্রহণ্টন
বিশেষ না-হলেও দ্রষ্টব্য ঘটনাটা হলো, ২০০৯ সালের ২৫ জুন মাইকেল জ্যাকসন মরে গেলেন। পঞ্চাশস্পর্শ তো এমন কোনো বয়স নয় যে মরে যেতে হবে। এমজে গেলেন পঞ্চাশের বুড়ি ছুঁতে-না-ছুঁতেই, বিলকুল বুঝতে না-দিয়ে একদম দুম করে, অ্যাব্রাপ্ট এন্ডিং এইটেকেই তো বলে, হয়তো। স্বদেশের সরকারি টিভিতে সেই খবরটুকু শুনে খুব মনখারাপ হয়েছিল মনে পড়ে। ছেলেবেলার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ লোপ পেয়ে যাওয়াজনিত মনখারাপ। তো, পরে, এর পরদিন তথা ২৬ জুন, সারাদিন আপিশকাচারির ফাঁকে কান্নাধারার মতো দমকা আবেগ বোধ করছিলাম ভেতরে ভেতরে, ইচ্ছে করছিল পুরনো সেই মিউজিক্যাল আর্টপিসগুলো, অপার্থিব সেই নৃত্যম্যুভমেন্টগুলো দেখি আরবার, শুনি তাঁর কিন্নরকণ্ঠের সেই শোর-মাচানো শৌর্যের সংগীত, দুর্ধর্ষ গতির ম্যাজিক, অনুপম গতিজাদুবাস্তবতা। তা, উপায় ছিল না, কারণ আমাদের বাসায় বেসরকারি কোনো টিভির কারবার নাই, জাতীয় সরকারি টিভির সবকিছুই তো নমঃনমঃ ধর্মীয় কায়দার। বেসরকারি টিভি ইস্তেমাল না-করবার পেছনেও ওই একই কারণ, ছেলেবেলা সংরক্ষার সুকঠিন সঙ্কল্প। ছোটবেলায় ছিল ভাড়া-করে-এনে ভিসিআর দেখবার কালচার। মাসে একবার, সাধারণত মাসান্তের বৃহস্পতিবারগুলোতে, ছোটচাচা ভাড়ার ভিসিআর আনতেন বাসায়। সেই ভিসিআর আমাদেরকে দেখতে দেয়া হইত রাতের ঘুমের আগের ঘণ্টাখানেক, তারপর ভোরবেলা জাগার নসিহত সহ আমাদেরকে জবরদস্তিমূলকভাবে বের করে দেয়া হতো কামরা থেকে, এবং ছোটচাচা আর তার ইয়ারদোস্তের দখলে চলে যেত স্বপ্নের ভিসিআরখানা।
এইভাবেই, এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই, চিনপরিচয় হয়েছিল মাইকেলের সঙ্গে। যেমন আরও অনেকের সঙ্গেই। কিন্তু গল্প আজকে মাইকেলকে নিয়ে। সেইসময় ভিসিআরওয়ালা দোকানি হিন্দি ও ইন্ডিয়ান বাংলা বইয়ের সঙ্গে এক-দুইখানা ক্যাসেট দিয়ে দিত বোনাস, ওই ক্যাসেটগুলোর ভাড়া আদৌ গুনতে হতো না কাস্টোমারকে, রেকর্ডেড ড্যান্স নাম্বার বা ডেভিড কপারফিল্ডের ম্যাজিক শো অথবা রিপ্লি’স্ বিলিভ ইট অর নট অনুষ্ঠানের নির্বাচিত অংশ দিয়ে সেই অ্যান্থোলোজি নির্মিত হতো। কমন আইটেম ছিল, এইসব সংকলনে, এমজে। এইভাবে সেই শৈশবদিনগুলোতে দেখা হতো মাসে-চান্দে এমজের সঙ্গে। অ্যানিওয়ে।
সেদিন, ২০০৯ সালের ২৬ জুন, স্বগৃহে বেসরকারি টিভি না-থাকাজনিত আমার দুরবস্থায় স্পৃষ্ট হয়ে এক সমব্যথী কলিগ আমাকে নিয়া যান তার বাসায়। এরপর সন্ধ্যারাত থেকে ঘনযামিনী অব্দি সেই বাসার বেসরকারি বিচিত্র-সব অনুষ্ঠানকারবারি চ্যানেল সার্ফ করে দেখতে থাকি প্রিয় মাইকেল ও তাঁর ম্যুনওয়াক ইত্যাদি। শুনতে থাকি তাঁর যাপনগতি ও জীবনকাহিনি। ফিরে এসে একটা খাতার কোণার অংশে একটুকরো গদ্য লিখি এবং ঘুমাইতে যাই। ঠিক তার চার বছর বাদে সেদিন সন্ধ্যায় সেই খাতা সহ অন্যান্য জঞ্জাল ফেলতে যেয়ে চোখে পড়ে এই গদ্যাংশ। মনে পড়ে, কোইন্সিডেন্টালি, মাইকেলের মৃত্যুদিন ২৫ জুন এবং কৌতূহলবশত উইকিপৃষ্ঠার ওভার্ভিয়্যু থেকে জেনে নিই তাঁর জন্মদিন ২৯ আগস্ট। তো, ফেলতে যেয়ে মনে হলো যে, এমজের সঙ্গে তো আমার জেনারেশনের মানুষগুলোর শৈশব-কৈশোর জড়িত, ওই পার্টটুকু তো ফেলে দিতে পারছি না, কাজেই তিষ্ঠোলাম ক্ষণকাল, এবং ভাবলাম যে ফেলে দেয়ার চেয়ে বরং লিখে রাখি নাম একটি তৃণে — এমজেরই মৃত্যুদিনে! যেই ভাবা সেই কাজ। উপরে এপিগ্র্যাফের আদলে এমজে শিরোনামে সেই চিমটি-গদ্যটুকু শুধু টুকে রাখলাম। দুঃখ এ-ই যে, এমনতর গদ্যে সেভাবে সেলিব্রেইট তো করা যায় না আমাদের অবর্ণনীয় অপরূপ সেই দিনগুলো। মহাকাব্যের যুগ তো অবসিত, নইলে এপিক ফর্মে একটা ইনিশিয়েটিভ নিয়ে একবার দেখা যাইত ঠিকঠাক উদযাপন করা যায় কি না আমাদের সেই অপরূপায়িত শৈশব-কৈশোরক নিশিদিনগুলো। অগত্যা। আহা! মাইকেল জ্যাকসন : জন্ম ২৯ আগস্ট ১৯৫৮, মৃত্যু ২৫ জুন ২০০৯।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এই দেশে ডিশ-অ্যান্টেনা মারফত টেলিভিশনে দেশবিদেশ ও জাতি-বিজাতি সংস্কৃতি ও অন্যান্য অনেককিছু — যথা মারামারি-যুদ্ধজঙ্গ-যৌনযাত্রা-শাদাকালোসৌহার্দ্যশুভঙ্করবৃত্তি ইত্যাদি — অবলোকনের ও উপভোগের মওকা আসে অজপাড়াগাঁয়েরও ড্রয়িঙরুমে-দাওয়ায় বসে। একসময়, অল্পকালের মধ্যেই, সুলভ হয়ে ওঠে এই ফ্যাসিলিটিস্ অলমোস্ট ঘরে ঘরে। এমটিভি ছিল তখন মাইকেল-ম্যাডোনা ম্যাজিক দর্শনের একটা নির্ভরযোগ্য উৎসসূত্র। কোনো-না-কোনো সময়ে প্রায় প্রত্যেকদিন এমজেম্যাজিক দেখাতই সেই টিভিচ্যানেলে। সেইসঙ্গে এর ভিজে তথা ভিশ্যুয়ালি-অ্যাপিলিং খুকিদের শ্বাসফাটানো অপাঙ্গে ইশারাভাষার ডাকাডাকি তো ছিলই। কিন্তু এইসবই ইগ্নোরেবল হয়ে যেত, গৌণ হয়ে যেত, অন্য-অন্য সমস্তকিছু মুছে যেত দৃশ্যপট হইতে এমজে-অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে। এবং লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা আমাদের এমজে-এক্সপেডিশনের সেই দিনগুলোতে এমজেমিউজিক যত-না শুনেছি-দেখেছি, তারচেয়ে বেশি ছিল এমজে বিষয়ক জল্পনাকল্পনা, স্টারডাস্ট-সিনেব্লিৎস্ ম্যাগাজিনে এমজে সংক্রান্ত গসিপ পড়াশোনা, এমজে কেলেঙ্কারিগুলোর ফলো-আপ রেখে যাওয়া। দ্য কিং অফ পপ তো গত তিন দশকেরও অধিক কালব্যাপী টক-অফ-দ্য-গ্লোব ছিলেন। ফলে আমাদের রসদেরও অভাব ঘটে নাই।
কিন্তু তখন ছিল স্টেরিয়োপ্লেয়ার ডিভাইস দিয়া ফিতার ক্যাসেটে গান শোনার যুগ। জ্যাকসনের গান সেইসময় খুব শুনেছি বললে ভুল বলা হবে। শোনার সুযোগ সেইভাবে ছিল না। অ্যালবাম হিশেবে পূর্ণাঙ্গ ভার্শন এমজেক্যাসেট মফস্বলের অডিয়োসামগ্রী বিক্রেতার কাছে পাওয়া যেত কালেভদ্রে। আর আমরাও তখন কোনো অ্যালবামই পুরো খরিদ করতাম না, অ্যাফোর্ড করার ব্যাপারটা ছিল বরাবরই সীমিত, ক্যাসেট কপি করানো খুব জনপ্রিয় ও প্রোফিটেবল একটা ব্যবসাই ছিল তখন। সিলেটের গীতঘর, গানের কলি, সিম্ফোনি ইত্যাদি দোকানপাটে সেইসময় দিনরাত ক্যাসেট কপি করানোই ছিল দোকানিদের বড় ব্যস্ততা। ষাট মিনিট ও নব্বই মিনিট দৈর্ঘ্যের ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট নগদ টাকায় কিনে দোকানির হাতে পছন্দবাছাই গানের লিস্টিটা ধরিয়ে দিয়ে নির্ধারিত সময়ে এসে ডেলিভারি নিতে হতো। টিডিকে নামে একটা কোম্প্যানির ব্ল্যাঙ্কক্যাসেট ছিল মজবুত ও টেকসই হিশেবে মশহুর। অন্যান্য কোম্প্যানির ক্যাসেটও ছিল, এমনকি বাংলাদেশের পটুয়াটুলির সাউন্ডটেক বা সরগম-সংগীতা কোম্প্যানির ক্যাসেটও ছিল, মূল্যে একটু সাশ্রয়ী, মন্দ ছিল না তাদের আউটপুট। তো, এইভাবে একেকটা ব্যক্তিগত চয়নিকা আমরা বানায়ে নিতাম পছন্দের গানের। এক ক্যাসেটের ভেতর হিন্দি-বাংলা-উর্দু-ইংলিশ গানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। “তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যেদিন যাবে” বা “আমার পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে তুমি যেন ভুল বোঝো না” গানের পরেই “রা রা রাশপুটিন” বা অ্যাবা ব্যান্ডের কোনো জলি ড্যান্সবিট। শুধু বাংলাদেশের বাংলাভাষার ব্যান্ডের ক্যাসেট বেরোলে পূর্ণাঙ্গ অ্যালবামখানাই খরিদ করতে হতো, কেননা ধরা যাক সোলস বা ফিডব্যাক বা ওয়ারফেজের একখানা অ্যালবাম বেরোত তখন পাঁচবছর বিরতি দিয়ে কিংবা তারও বেশি। ফলে কিনে ফেলে বছরের-পর-বছর ধরে সেই ক্যাসেট ভলিয়্যুম বাড়ায়ে-কমায়ে একাধারে শুনে যাওয়া। অবশ্য বন্ধুদের কেনা ক্যাসেট কর্জ এনে নিজের টেপরেকর্ডার দিয়া কপিও করা হতো। হোমরেকর্ডিং স্টুডিয়ো তখন তো প্রত্যেকেরই ছিল, সুচারু স্মুথ রেকর্ডিং করার নানাবিধ প্রণালিও করায়ত্ত ছিল তখন আমাদের। দোকানে রেকর্ড করানোর হাদিয়া আলাদা ধার্য হতো, ব্ল্যাঙ্কক্যাসেট কেনার পর সেই হাদিয়া ক্যাশে দিয়া আসতে হইত। একেকটা ক্যাসেটে বিশ-পঁচিশটা গানও সংকলন করা যাইত কখনো-কখনো, সব গানদৈর্ঘ্য তো সমান না।
গান শোনার জন্য গঞ্জনাও কম ছিল না আমাদের সেই কৈশোরযুগে। এমজে শ্রবণকালীন গঞ্জনা তো অধিক অকহতব্য। টিমটিমে নিভুনিভু আওয়াজে শুনতে হতো মাইকেলের মর্মান্তিক মিউজিকবিটগুলো। এ তো শুধু ঘরের ভেতরকার পরিস্থিতি। বাইরের, তথা সমাজের সাহিত্যের সংস্কৃতির কাল্চারের বাপমায়ের, গঞ্জনার ফিরিস্তি দিতে গেলে এক-রিম কাগজেও মনে হয় না আঁটানো যাবে। এমজে তো চক্ষুশূল ছিলেনই আমাদের পারিবারিক মুরুব্বিদিগের নিকট, সমাজসাহিত্যপ্রাতিষ্ঠানিক মুরুব্বিদের কাছে এমজেমিউজিক ছিল নাসিকাশূল। উনারা এমজে নামশুনিবামাত্তর নাক কুঁচকাইতেন। এইখানে থামলেই কথা ছিল না, আরও অধিকতর চালাইতেন উনাদের গানগম্যিহীন নাসিকাদাপট। সেইসব দৌরাত্ম্য ও দাপট ছড়িয়ে আছে ওইসময়কার সিনেমায়-নাটকে-নভেলে। ভ্যাংচানো হতো সমস্ত নতুন তরুণগৃহীত উদ্যোগগুলোকে। এর অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে আশির দশকের এফডিসিনির্মিত বাংলা ছায়াছবিগুলোতে। দেখা যাবে যে, টেলিসামাদ বা দিলদার প্রমুখ কমেডিয়ান অ্যাক্টরদিগের কিম্ভূত গা-মোচড়ানিমূলক কাতুকুতু অভিনয়ের বরাত দিয়া মাইকেলশ্রোতাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে বা কটাক্ষ করা হচ্ছে। কিংবা খলনায়ক বা খলনায়িকা দুপুরবেলা ভাতঘুমের আগে বা পরে একটা গান স্টেরিয়ো বাজায়ে শুনছে এবং সেই গানটা ইনভ্যারিয়েব্লি মাইকেলের। এসবের মধ্য দিয়ে ডিরেক্টর মশাই জনগণরে বোঝাইতেন যে দ্যাখো এমজেমিউজিক শোনে কেবল স্পয়েল্ড লোকজন। আমাদের গানেও মাইকেল জ্যাকসন কীভাবে রিডিকিউল্ড হচ্ছেন তার একটা নমুনা সৈয়দ আব্দুল হাদীর প্লেব্যাকে সেই সিনেমাগানখানা : “আউল-বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলো রে / সবার মাথা খাইল রে / আমার প্রাণের দোতারা কান্দে রে / আমার সাধের সারিন্দা কান্দে রে” … ইত্যাদি।
কিন্তু এইসব ব্যঙ্গবিদ্রুপ-ভ্যাংচানো তো কোনো উপকার করেই নাই, উপরন্তু এক্সপোজ করে দিয়েছে আমাদের পূর্বসূরিদের অল্পবিদ্যা, নতুনকে স্বাগত না-জানানোর বদ্ধমূল বুড়াগিরি তাদের। কিন্তু বুড়ারা যদি চোখকান খোলা রেখে একটু শুনতেন, একটু গ্রহিষ্ণু মন নিয়ে দেখতেন, তবে কোনোদিনই তো বুড়া হইতেন না তারা। যা-ই-হোক, এইসবের অভিঘাতে সেইসময় আমাদের শৈশব অনেক বিপর্যস্ত হয়েছিল, অনেক দুর্বিষহ দিনাতিপাত করতে হয়েছে আমাদিগেরে, আবার এসবের ফলেই একটা কাউন্টার রেজিস্ট্যান্সও তো গড়ে উঠেছে ভেতরে ভেতরে আমাদের, তারুণ্য নিয়া মশকরা করার সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদিগেরে কথিত বদনামি সবকিছু অনেক ভালোভাবে এক্সামিন করার বা উপভোগ করার ভেতরতাগিদ যুগিয়েছে, গরল বলিয়া সাব্যস্ত সবকিছু ছেনেছেঁকে দেখতে উদ্যমী করেছে।
এমজেমিউজিক তো শোনার নয়, দেখার — বলেন বঙ্গীয় মুরুব্বিরা। তা, কথাটা মন্দ বলেন না বটে, খানিকক্ষণ কথা চালায়ে গেলেই আপনি বুঝতে পারবেন সেই মুরুব্বি এমজেলিরিক্সের একটা লেটারও কোনোদিন শোনেন নাই বা পড়েন নাই। কিন্তু যদি শুধু দেখার গানই হতো, তা-ও এই এমজে এই এমজেই থাকতেন, সমাদৃত হইতেন আমাদের কাছে একইভাবে। কেননা আমরা তো প্রথমপ্রথম যখন এমজে শোনা শুরু করেছি, লিরিক্স বুঝে তো আর তা শুনি নাই, একবর্ণও বুঝতাম না, কিন্তু ওই বিট, ওই রিদম, ওই রক্তোচ্ছ্বাসজাগানিয়া গায়নভঙ্গি ছুঁয়ে যেত আমাদেরে। দেখার সুযোগ তো পেয়েছি অনেকানেক পরে, এই সেদিন, কাজেই আমরা মাইকেল শুনে-শুনেই প্রেমে পড়েছিনু তাঁর, দেখে পরে বিস্ময়ে বিপন্ন হয়েছি, তদ্দিনে আমাদেরও বুড়ো হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে যদিও, তবু অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে গেছেন এমজে দেখিবামাত্তর, আজও বুড়াধুড়া আমাদের শিরাধমনির ভিতর মাইকেলের প্রত্যেকটা স্টেপিং প্রত্যেকটা জেশ্চার প্রত্যেকটা ম্যুভমেন্ট দোলা জাগায়া যায় অন্য জনমের, অন্য দুনিয়ার, অন্য বিদ্রোহ ও বুকফাটা ত্রাহি বিষাদের।
দেখার আগে, লিরিক্স বোঝার মতন ইংরিজি রপ্ত করে ওঠার বয়সে পৌঁছাবার আগেই, আমরা মাইকেলের কয়েকটা গান ঘুরিয়েফিরিয়ে শুনে গেছি প্রাকৃতজনের এই বিলোল ভুবনে প্রদোষে-প্রত্যুষে-প্রমত্তনিশীথে। অ্যালিয়েনের মতন, ভূতগ্রস্তের মতন, কিচ্ছুটি-না-বোঝা সেই ভাষাসংকেত সেই প্রলয়দোল সেই সৃজনমাতন তখন আমাদেরে রুধিরে-মজ্জায় নিমজ্জিত করে রেখেছে। বেশি শুনতাম তখন ‘জাস্ট বিট ইট’, ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’, ‘বিলি জিন’, ‘ব্যাড’, ‘শু-বি-ডু-বি-ডু-ডা-ডে’ … এই কয়টা গান ক্যালাইডোস্কোপের মতন। এরপর তো বোঝার বয়স। এরপর তো পাকামি ও পচিয়া যাওয়ার শুরু। ‘অফ দ্য ওয়াল’, ‘থ্রিলার’, ‘হিস্টোরি’, ‘ব্লাড অন দ্য ড্যান্সফ্লোর’ প্রভৃতি একের-পর-এক অ্যালবামের কোন গানটা শুনি নাই উৎকর্ণ, কোনো ক্যুইজ কন্টেস্টে গেলে সেইটা নিজেই বুঝতে পারব।
তবু, আজ বুঝি যে, শোনা নয়, দেখাটাই শিল্পসম্ভোগের সবচেয়ে বড় পথ। সেই-যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন জীবনানন্দকে, অনেকটাই তরুণ মুখচোরা সেই কবিকে সান্ত্বনার্থে, “তোমার কবিতায় একটা তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে” ইত্যাদি, এই তাকিয়ে দেখার আনন্দই শিল্পের শীর্ষ। এই আনন্দ অল্প পরিমাণে লগ্নি করেছিলেন বলেই রবিকবিতা বা বিষ্ণু-সুধীন ধরাটা খাইলেন, আর উজাড় দুইহাতে এই দেখনদারির আনন্দের কারবার করেছিলেন বলেই জীবনের আজ রবরবা ব্যবসা। কাজেই তাকিয়ে দেখতে পারাটার মধ্যেই নিহিত সত্যিকারের শিল্পসম্ভোগ। এমজেমিউজিক এই জিনিশ প্রভূত পরিমাণে রেখেছে ধরে। অ্যাজ অ্যা রেজাল্ট এমজে, দ্য মোনার্ক অফ পপ, নাইন্টিন ফিফটি এইট টু ফরএভার।
অসংখ্য বাংলা গানে, স্পেশালি বাংলা ব্যান্ডসংগীতে, এমজে উঁকি দিয়েছেন। তাঁর গানের মাঝখান থেকে মিউজিকট্র্যাক কপি করে সেঁটে নেয়া হয়েছে আমাদের গানে, সেসব মন্দও হয় নাই, ব্যান্ডগানের সেইসময়ের এইসব এক্নোলেজমেন্টবিহীন কম্মধম্ম অনেক পরে এমটিভিযুগে এসে আমাদের কাছে বেশি বেশি ধরা পড়তে থাকে। কেবল এমজে তো নয়, ইংরিজি মিউজিক সুর থেকে লিরিক পর্যন্ত ধুমিয়ে নকলনবিশির একটা ধুম পড়ে গেছিল নব্বইয়ের দশকটায়, যেমন কবিতায় এই দশকে ইন্ডিয়ান বাংলা বিনয়-উৎপল-রণজিৎ প্রমুখের ছায়াবলম্বন-কায়াবলম্বনের হিড়িক লক্ষ করা যাবে। অ্যানিওয়ে। অচিরে দুনিয়ার সাউন্ডস্কেইপ সকলের তথা সর্বসাধারণের গোচরে আসার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হইলে পরে একসময় সেই কপিবৃত্তি স্তিমিত হয়ে আসে ধীরে। এমজেমিউজিকের এবং অন্যান্য ইংরিজি গাইয়েদের কুম্ভীলকবৃত্তি কীভাবে করা হয়েছে সেসবের স্পেসিমেন হাজির করতে পারলে ভালো হতো হয়তো, তবে এক্ষণে এখানে তা অনিবার্য কারণে সম্ভব হচ্ছে না।
খালি-যে এমজে শুনছিলাম তখন, তা তো নয়, ‘অ্যাবা’, ‘ক্যারেন কার্পেন্টার্স’ বা নির্বাচিত ‘বিটল্স’ তো ঘরে-ঘরেই ছিল বঙ্গীয় সন্তানাদিগের ক্রোড় ভরে, মুরুব্বিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই। পিঙ্ক ফ্লয়েড গুটিকয়। ক্যালিপ্সোসম্রাট হ্যারি বেলাফঁত প্রমুখের অ্যালবাম একখানা তো অনেকেরই বাপের আমলের, সেই জ্যামাইকা ফেয়ারোয়েল, সেই ডাউন দ্য ওয়ে হোয়ার দ্য নাইটস আর গে অ্যান্ড সানশাইন্স ডেইলি অন দ্য মাউন্টেনটপ, বা জন ডেনভার খান-কয়েক, ববদ্বয় তথা ডিলান ও মার্লে একটু দিরং হয়ে গেছে অবশ্য শুনতে শুনতে, কিন্তু ব্রায়ান অ্যাডাম্স বা বন জোভি বা ম্যাডোনা এদের চালু নাম্বারগুলো তো শোনা হয়েই যেত ওই হোমরেকর্ডিং ক্যাসেট-টু-ক্যাসেট কপি প্রক্রিয়ায়। এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ও বাউলগানপ্রশাসিত সংস্কৃতিদিগন্তে চুপকে-চুপকে এমজে এসে ঢুকে পড়েছিলেন। নো এক্সিট, সো-ফার, মনে হয়। এই পথ ধরেই একসময় দেখার আনন্দের আরেক শিল্পসুষমারাধিকা শাকিরা এসে উদ্ভাসিত হলেন আমাদের বুডঢা-হো-গিয়া কানের-মনের চোখে, সিম্পলি ব্রিলিয়ান্ট, অ্যারাব-লাতিনো লিরিকের ঝঙ্কার আর তার দৃপ্ত ঘোড়ার দাবনা, লোলচর্ম হবার আগ পর্যন্ত জীবনপ্রেরণা আমাদের।
এমজে সেলেব্রেটি লিভিঙের সঙ্গে ইউজড-টু অলমোস্ট তাঁর আর্লি দিনগুলো হইতেই। ‘জ্যাকসন ফাইভ’ পর্যায় থেকে তাঁর সাংগীতিক পারদর্শিতা আর মাতোয়ারা নাচের প্রতিভা সম্পর্কে আমরা জেনেছি বিভিন্নভাবে, বইটই-নিউজফিচার প্রভৃতি পড়ে, বেশি জেনেছি রিউমারাস রিপোর্টাজগুলোর মারফতেই, জ্যাকসনের অটোবায়োগ্র্যাফি বাংলান্তরিত হয়ে বেরিয়ে গেছে মধ্য-নব্বইয়ের প্রান্তিকে। এমন নয় যে জ্যাকসন আগাগোড়া মুগ্ধ রেখেছেন আমাদিগেরে। এইটাই বক্তব্য যে, আমাদের বেড়ে-ওঠার দিনগুলোতে জ্যাকসনও অন্যতম দ্রষ্টব্য ছিলেন। মিডিয়াফেটিশিজম সম্পর্কে আমাদের বুঝসমুজ তৈয়ার হওয়ার মামলা আরও অনেক পরের দিকের ঘটনা। পাপারাৎসিদৌরাত্ম্য সম্পর্কে চেতনা তৈরি হয়েছে ঢের বাদে। তার আগে জ্যাকসন সম্পর্কে যেসব ঘটনা-অঘটনা আমরা জানছিলাম, তাতে মুষড়ে পড়ার মতো অনেককিছুই ছিল, যদিও সেলেব্রিটি আর্টিস্টদের নিয়া জাজমেন্টাল হওয়ার নায়্যিভিটি ছিল না বলেই ভাগ্যিস এমজের কাজ নজরে রাখতে অসুবিধা হয় নাই।
কত-সমস্ত এমজে সংক্রান্ত খবরে মোড়ানো ছিল আমাদের বেড়ে-ওঠার গত তিনটে দশক! নতুন নতুন নৃত্যমুদ্রা আবিষ্কারের উত্তেজ-উজ্জীবক খবর, প্রিস্লিতনয়ার সঙ্গে প্রেম ও পরিণয় এবং বিচ্ছেদ, ব্রুক শিল্ডসের সঙ্গে বন্ধুতা, রেকর্ডকোম্প্যানির সঙ্গে এভার-এক্সপেন্সিভ চুক্তি, ডায়মন্ড দস্তানা ও হাওয়াপাদুকা, নিউ হেয়ারকাট, অভাবিত সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট ও নিগ্রোত্ব উত্তরিত হয়ে শ্বেতকায় এবং ক্রমে রেইস-নিউট্রাল অ্যালিয়েন হয়ে-ওঠা, চাইল্ড অ্যাবিউজিং পার্ভার্শনের সঙ্গে যুক্ততা বিষয়ক অভিযোগ একাধিকবার তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপন ও আদালত পর্যন্ত গড়ানো, ওয়ার্ল্ডট্যুর, শিশুসন্তানকে খেলাচ্ছলে অ্যাপার্টমেন্টউইন্ডো দিয়ে ফেলে দেবার ভঙ্গিসমেত মিডিয়া এক্সপোজার ও সমালোচিত হওয়া, আরব শেখদের আতিথ্য গ্রহণ ও হিউজ অ্যামাউন্ট অফ পেট্রোডলার আর্ন, কন্সার্টে নতুন নৃত্যকৌশল অবমুক্তকরণ, মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে মমি, হল্ অফ ফেইম অর্জন, নেভারল্যান্ড পার্চেজ ও প্রায় দেউলিয়াদ্বারপ্রান্তে যেয়ে গেট-ব্যাক, অচেনা ড্রাগ টেইকিং, অক্সিজেনচেম্বারে ঘুমানো, নতুন কন্সার্টের প্রস্তুতি, দিস্ ইজ ইট … এইসবেই ছিল গত শতকের শেষার্ধ সরগরম সর্বদা।
এইসব খবরাদি এই ইন্টার্নেট-অ্যাভেইলেবিলিটির যুগে লেখা বাহুল্য। সকলের আঙুলের একচাপ দূরে এমজের সারাজীবন, তাঁর নৃত্যজাদু, তাঁর গানকর্ম, তাঁর শিখরভেদী উত্থানগাথা। আপনার অঙ্গুলিডগায় ইউটিউবে একবার শুনে নিতে পারেন তাঁর নাচ, দেখে আসতে পারেন তাঁর গান, বুঝিয়া রাখতে পারেন তাঁর অলমোস্ট অ্যালিয়েন যাপনধারা। আমরা কেবল এইখানে স্মরণ করে নেব একবার আমাদের কৈশোর ও পয়লা তারুণ্য বুনো উদ্দাম দিনগুলো, আমাদের শিবস্বভাব প্রলয়নৃত্যপর বন্ধুদের মুখগুলো, আমাদের কালীমূর্তি বিদ্রোহিনী বন্ধুদের চপল ছন্দগুলো, সুরে-তালে পার-করা আমাদের গতজন্মের আগুন ও জলস্ফূর্তিগুলো। এমজে সম্পর্কে যত-ইচ্ছে জেনে নেন আপনি আপনার টিউবে চেপে, উইকিবিহার করে, আর এমজে অফিশিয়্যাল সাইট তো রয়েছেই।
এমজে কেবল তরুণদের শোনার, পুঁচকেদের দেখার, মনে হয় না তা। আপনি রোজকার জীবনে এত বেশি নিগৃহীত হয়ে চলেছেন, নাস্তানাবুদ হয়ে চলেছেন, উচ্চাসীন নানা বর্গীয় ব্যক্তির কাছে প্রতিষ্ঠানের কাছে, এমজের মিউজিক আপনাকে সেই দশা থেকে উত্তরণের একটা তাগিদ যোগায় শিরার গহনে। এখন বুড়ো হবার আগে আপনি যদি প্যারালাইজড উচ্চাসীন বনে যেতে পারেন, যদি আপনার ভৃত্যগিরি ঘুচিয়া যায়, দ্যান হয়তো এমজে আপনার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ও অনবলোকনের ব্যাপার হয়ে উঠলেও উঠতে পারে। এছাড়া তাঁর গানের শারীরিকতার বাইরেকার সুরের অন্তরের যে-একটা আবেশ, তাঁর কিন্নর স্বরের যে-একটা ম্যাজিক ও স্পেলবাইন্ডিং এফেক্ট, সেইটুকু তো এভারগ্রিন, সর্বকালের সর্ববয়সের না-হইবার কোনো দুনিয়াবি যুক্তি-ফিৎনা তো আমি অন্তত দেখি না। তারপরও বলতে হবে যে, বুড়া না-হওয়া পর্যন্ত তো বুড়া বয়সের ভাবসাব বিষয়ে কিছু বলা গ্র্যামাটিক্যালি পসিবল হচ্ছে না, আর তো মাত্র গোটা-কয় বছর, সবুর করলে কার-না গাছে মেওয়া ফলে, এ-সম্পর্কে একটা ফার্স্টহ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স অর্জন করা যাবে। তখন না-হয় লিখে ফেলা যাবে ফের এমজে-খারিজি কোনো নিবন্ধরচনা। তারিফি নিবন্ধ যাদিগের মনঃপুত হইল না, তাদিগের জন্য আগেভাগে এইখানে গেল সম্ভাব্য সেই খারিজি নিবন্ধ পড়ার আমন্ত্রণ রাখা। তার আগ পর্যন্ত রক্তগ্রন্থির নৃত্য শুনি উদয়শঙ্করের দেশে বসে, দেখি গোলামির শেকলছেঁড়া ছলের ধান্দাবাজি-বিকল-করা মাইকেলের ম্যুনওয়াক ও অন্যান্য অপার্থিবতা, আর মুখিয়ে থাকি বুড়ো হইবার তরে।
লেখা : জাহেদ আহমদ ২০১৪
… …
- ফিউরিয়োসা - September 26, 2024
- অনবরত অনুসন্ধান || সজীব তানভীর - September 26, 2024
- অ্যাক্টর্স জার্নাল : শতেক পাতার লাইনটানা ব্ল্যাঙ্ক নোটবুক - September 26, 2024
COMMENTS