অঞ্জনের পরিচয় এখন বহুধা বিস্তৃত। চলচ্চিত্রের পরিচালক অঞ্জন, অভিনয়শিল্পী অঞ্জন, ছোটপর্দায় টেলিফিল্ম বানিয়েও রোজগার করেন অঞ্জন। সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে শেষমেশ অঞ্জন দত্ত সংগীতের জন্য স্মরণীয় হয়ে রইবেন, বোধহয় আগ বাড়িয়ে এই কথাটা বলে রাখলে এমনকিছু অত্যুক্তি হয় না। ছায়াছবি তিনি যা বানিয়েছেন সেসবের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অবশ্য। তবু যেন অঞ্জনের শাঁসটা পাওয়া যায় বাংলা আধুনিক গানে করা তার কাজগুলোতে। এছাড়া ছায়াছবিগুলো, অলমোস্ট সবগুলো, অঞ্জনের গানেরই গল্পের সম্প্রসারণ যেন।
অঞ্জন দত্ত ইন্ডিয়ান বাংলা গানে গেল-শতকের নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত জনপ্রিয় সংগীতকার ও কণ্ঠশিল্পী। নিজের গানের কথা, সুর ও সংগীতায়োজন নিজে করেন। সিঙ্গার-স্যংরাইটার বলতে যা বোঝায়। নিজেই গিটার বাজিয়ে গেয়ে থাকেন অন্যান্য বাদ্যযোজনার সঙ্গে। স্যাক্সোফোন যন্ত্রটা তার গানে একটা আলাদা মাত্রা আনে। অ্যালবাম রয়েছে দশটিরও অধিক। নিজের গানের একক অ্যালবাম সবগুলো। রয়েছে এর বাইরেও ম্যুভি ইত্যাদিতে প্লেব্যাক বেশকিছু। চলচ্চিত্রের জগতে এই শিল্পী নিজে যেমন চরিত্রাভিনেতা হিশেবে গ্রেইট ফিল্মমেইকারদের সঙ্গে কাজ করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণে ক্যামেরার পিছনে ডিরেক্টর হিশেবে কাজ করছেন অনেকদিন হলো।
মূলত অভিনেতাই ছিলেন, রাজকাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ ম্যুভিতে শিশুশিল্পী হিশেবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে অভিনয়ক্যারিয়ার শুরু অঞ্জনের, মৃণাল সেন প্রমুখ অন্যধারা ছায়াছবিনির্মাতাদের প্রোজেক্টগুলোতে এবং বাদল সরকার প্রমুখের মতো প্রথিতযশা নাট্যরচয়িতাদের কাজের সঙ্গেই ছিল অঞ্জন দত্তের আগাগোড়া যুক্ততা। বাংলা গানে এলেন হুট করেই এবং পেলেন প্রভূত শ্রোতাপ্রিয়তা। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক অঞ্জন দত্ত ১৯৫৮ সনের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী ছন্দা দত্ত পেশায় স্কুলশিক্ষিকা এবং একমাত্র সন্তান নীল দত্ত মিউজিশিয়্যান হিশেবে ক্যারিয়ার শুরু করে ব্যাপক গ্রাহ্য পশ্চিমবঙ্গের সিনেমাপাড়ায়। অঞ্জন নিজেও গত দুইদশকের সময়সীমায় সিনেমা বানানোয় ব্যস্ত হয়েছেন এবং বানিয়ে চলেছেন একের পর এক বাণিজ্যিক বাংলা ছায়াছবি। নিজের ছবিতে এবং অন্যের ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি কালেভদ্রে প্লেব্যাক ছাড়া গানে এখন অঞ্জন দত্ত গরহাজির বললেও হয়।
রিসেন্টলি অবশ্য অঞ্জনপরিচালিত একটা মিউজিক্যাল ম্যুভিতে নিজের নয়া গান নিয়া হাজির হয়েছেন, ২০১৮ অব্দে, ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ ম্যুভিরই সিক্যুয়েল মনে হচ্ছিল ম্যুভির টিজার/ট্রেইলার দেখে, ‘আমি আসব ফিরে’ নামের এই ম্যুভিটা বাংলা গানে যেন অঞ্জনের কামব্যাক ঘোষণা করছে। ম্যাচিয়্যুর অঞ্জন। সমস্ত স্বাক্ষর সত্ত্বেও অঞ্জনের গানের লিরিকে একটা ষাটোর্ধ্ব পরিপক্বতার নতুনতা হাজির হতেছে যেন। ‘ঊনষাট’ অ্যালবামে এই জিনিশটা আগেই দৃষ্টিগোচর হয়েছিল যদিও। অঞ্জনের সমস্ত চলচ্চিত্র ঘুরেফিরে গানেরই গল্প বলে। এবং তার গানগুলো গল্প বলে পাহাড়ের, পাহাড়িয়া মানুষের, বোর্ডিং স্কুলের, পথশিশুদের, কলকাতার বস্তিবাসী ব্যক্তিমানুষের, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংখ্যালঘু কলকাতাবাসীদের, একলা নারীর, বয়ঃসন্ধিনীল কিশোরকিশোরীর, শত বিচ্ছেদ ও বঞ্চনা সত্ত্বেও বেঁচে থাকবার ফুর্তির।
সংগীতের জগতে অ্যালবাম দিয়া নাইন্টিফোরে এলেন অঞ্জন দত্ত। অভিষেকবর্ষ ১৯৯৪ থেকে একটানা ২০০১ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে অ্যালবাম প্রকাশ করে গেছেন অঞ্জন দত্ত; পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সংগীতরচয়িতা এই শিল্পীর স্টুডিয়োঅ্যালবামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘শুনতে কি চাও’, ‘পুরনো গিটার’, ‘ভালোবাসি তোমায়’, ‘কেউ গান গায়’, ‘চলো বদলাই’, ‘হ্যালো বাংলাদেশ’, ‘কলকাতা-১৬’, ‘বান্দ্রা ব্লুজ’, ‘অসময়’ এবং ‘রং পেন্সিল’। এরপরে এই শিল্পী অ্যালবাম প্রকাশে বিরত থাকেন দীর্ঘ প্রায় একযুগ; ২০১৪ সনে একটানা ১৪ বছর অন্তরালবাসের শেষে ‘ঊনষাট’ অ্যালবাম দিয়ে ফেরেন স্টুডিয়োরেকোর্ডিঙে। অ্যালবামটা বাংলাদেশ থেকে বেরিয়েছিল মনে পড়ে। এইটাই এ-পর্যন্ত অঞ্জনের সর্বশেষ স্টুডিয়োঅ্যালবাম। অবশ্য লম্বা এই বিরতিকালে সিনেমা বানিয়েছেন অঞ্জন বেশ-কয়েকটা, আপন সিনেমার জন্য টুকটাক গান তৈয়ার করেছেন, প্লেব্যাক করেছেন, বেশ কয়েকটি সিঙ্গেল্সও বের হয়েছে ইতিউতি, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ স্টুডিয়োঅ্যালবাম একটাও না।
বাংলাদেশে এই কিছুদিন আগেও ট্যুরে এসেছিলেন অঞ্জন। প্রথমবার এসেছিলেন সম্ভবত ১৯৯৮ সনে, এর পরেও এসেছেন, এবং সব মিলিয়ে এক বা দুইবার। পয়লাবার এসে শো করেছেন কয়েকটা। অ্যালবাম করেছেন অন্তত দুইটা, ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ নামে নিজের গানের একটা এবং শ্রুতিনাটকের একটা অ্যালবাম ‘ভালোবাসা’ বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পী নিমা রহমানের সঙ্গে। সেইবার অঞ্জনের সঙ্গে কলকাতার ব্যান্ড ‘পরশপাথর’ স্টেজ শেয়ার করেছিল। দুইটা অ্যালবামই, বিশেষত শ্রুতিনাটকেরটা, ভীষণ শ্রোতাগ্রাহ্য হয়েছিল অঞ্জনের অন্যান্য সংকলনের মতো বাংলাদেশে। অ্যানিওয়ে। দুইদশকের একটানা ক্যারিয়ারে অ্যালবাম যুক্ত হয়েছে অনেক, যুক্ত হয়েছে নিজের পরিচালিত ও প্রযোজিত ম্যুভি ইত্যাদি। কিন্তু অঞ্জনের মূল পরিচয়টা, বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্তত, বাংলা গানের শিল্পী হিশেবেই।
রিসেন্টলি রিলিজড ‘আমি আসব ফিরে’ ম্যুভির গানগুলো ইউটিউবে শুনে যে-কেউ অঞ্জনের নয়া গানসৃজনের টিপছাপ যেমন পাবেন, তেমনি সেই তরুণদিনের তুখোড় অঞ্জনের স্মৃতি ইয়াদ করে নস্ট্যালজিয়ায় স্নিগ্ধও হয়ে উঠবেন। অঞ্জনের সমস্ত প্রোডাকশনে যেমন বরাবর তার পুত্র নীল দত্ত থাকেন, এইবারেও ব্যতিক্রম হয় নাই, সংগীতপরিচালক হিশেবে এইখানেও নীল দত্ত কাজ করেছেন।
লেখা : মিল্টন মৃধা
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS