‘ছবি শুরু হতে দেরি আছে। মামা চা কিনলেন। আমার জন্য দু’পয়সার বাদাম এবং চানাভাজা কেনা হলো। মামা বললেন, এখন না। ছবি শুরু হলে খাবে। আমি ছবির শুরুর জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। চারদিকে লোকজন, হৈ চৈ কোলাহল নেশার মতো লাগছে। বুক ধক্ ধক্ করছে না জানি কি দেখব। ছবি শুরুর প্রথম ঘণ্টা পড়ল। সেই ঘণ্টাও অন্যরকম। বেজেই যাচ্ছে, থামছে না। লোকজন হলে ঢুকতে শুরু করছে — মামা ঢুকলেন না। আমাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হিসু কর। ছবি শুরু হবে, আর বলবে হিসু তাহলে কান ছিঁড়ে ফেলব’ (প্রিয় পাঠক, মামা অন্য কিছু ছেঁড়ার কথা বলেছিলেন। সুরুচির কারণে তা উল্লেখ করছি না।)’ — ছবি বানানোর গল্প : হুমায়ুন আহমেদ ১
মর্ত্যের কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ শৈশবে প্রথমবার সিনেমা হল দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বর্ণনা করেছেন, এরকম অভিজ্ঞতা আমরা আরো শুনে থাকব বয়োজ্যেষ্ঠ বা পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্যদের কাছে। আচ্ছা, এইটা কি শুধুই অভিজ্ঞতা নাকি একটা রিচুয়ালের বর্ণন? সিনেমা দেখার এই যে প্রস্তুতি বা নিজেকে পর্দায় সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত করে দেয়ার আয়োজন তা একটা ‘তন্ত্রের’ মতোই শোনায়, না!
সারি সারি আসন, বড় পর্দা, আঁধারে মোড়া বিশাল হলঘর আর এককাপ নিস্তব্ধতা হাতে নিয়ে চুপচাপ সিনেমাতন্ত্রের আরশিনগরে প্রবেশ করার যে শাস্ত্রীয় আচারপালন তা-ই বোধহয় সিনেমাকে নিয়ে যায় ‘লার্জার দ্যান লাইফের’ উচ্চতায়। এই অনুভূতিকে ঘরে বসে ডিভিডি বা টরেন্ট বা সার্ভার থেকে ডাউনলোড করে দেখার সাথে তুলনা করা কী জায়েজ হবে, শুধুমাত্র হাতটা বাড়ালেই হার্ডড্রাইভবন্দি করা যাচ্ছে — এই দোহাই দিয়ে … পাঠক-পাঠিকা বাকিটা আপনার বিবেচনা।
এখন, প্রশ্ন হলো আপনি/আমি তো হলে গিয়েই ছবি দেখতে চান/চাই কিন্তু সেইরকম ঝাঁ-চকচকে, বিনোদনে ঠাসা, ইক্টু চিন্তাজাগানিয়া আপনার ধরনের সিনেমা কই? তাকে তো উপর্যুপরি কল দিয়েও ধরা যায় না, সব কলই কেবলি হয়ে যায় মিসড্ কল সেই নতুন সিনেমার তরে। তাহলে, কোথায় পাই তারে!
চিন্তার কিছু নাই, হালফিলে আপনার টাইপের এইরকম অনেক ছবির ‘আওয়াজ’ আমরা পাচ্ছি গণমাধ্যমের কল্যাণে। কিছু ছবি তো অলরেডি আমরা দেখেও ফেলেছি। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের বদৌলতে এই ছবিগুলির আগমনী বার্তা আমরা যতটা পেয়ে থেকেছি আড়ম্বরভাবে ঠিক ততটা কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর সেসব ছবির অর্জন নিয়ে তেমন-একটা আহ্লাদ করতে পেরেছি কি, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
এইসব দিনরাত্রির দূরবীনে চোখ লাগিয়ে আমরা যদি পেছনপানে তাকাই তবে দেখতে পাবো বিএফডিসি যেটি এক সময় বছরান্তে ৭০-৯০টি সিনেমা উৎপাদন করত, তার সংখ্যা বর্তমানে ঠেকেছে ৪০-৫০টিতে। সংখ্যার অবনমনের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অধঃগতি ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য। তবে, এইটাও হলফ করে বলা সম্ভব নয় সংখ্যার আধিক্য থাকলেই বিএফডিসি গুণমানে অসাধারণ ছবিমালা উপহার দিয়ে দর্শকদের ব্যস্ত রাখিত।
তো, ইদানীংকালে এফডিসি নির্মিত যেসব সিনেমা আমাদের নজরকে বন্দি করেছে সেগুলোর মধ্যে এমএ জলিল প্রযোজিত ‘দ্য স্পিড’ ও ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ দুইমাত্র ইন্ডাস্ট্রি প্রোডাক্ট যা কিনা গ্রামীণ ও আর্বান দর্শকগোষ্ঠী তথা আমাদেরকে হলমুখী করেছে, যারা আর-কি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইদানীং ভেবে থাকি বাংলাদেশ মানে ঢাকা! বাংলাদেশ তো আর ভ্যাটিকেন নয় যে একটাই শহর আর ঐটাই দেশ কিন্তু আমাদের মিডিয়া-কথিত নতুন সিনেমার মিথস্ক্রিয়া দেখে মনে হয় ঢাকাতেই সব, ঢাকার বাইরে আরো যে ক্রোশের পর ক্রোশ গাঁওগেরাম বিস্তৃত রয়েছে তাদের কথা কি ভাবছি আমরা? তাদের কি নতুন সিনেমার ভোক্তা হওয়ার অধিকার থাকতে নেই!
গত বছর-কয়েকের মধ্যে আরো যে সিনেমাগুলি শহুরেদের হল পর্যন্ত টেনে এনেছে তার মধ্যে বলা যায় গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মনপুরা, নোমান রবিনের কমন জেন্ডার, হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা, গেরিলা, রেদওয়ান রনির চোরাবালি, মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন — এই ছবিগুলি কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সুবিধায় বানানো ইন্ডাস্ট্রির বাইরের ছবি বা আরো সুশীল জায়গা থেকে বলা যেতে পারে স্বাধীন ধারার ছবি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা। আমাদের রুচির(?) চাহিদা অনুযায়ী যাবতীয় উপকরণ নিয়ে হাজির আছে এই সিনেমাগুলি। গণমাধ্যমের বরাতে বলা যায়, এই সিনেমাগুলির আলোয় লিখিত হতে যাচ্ছে বা হচ্ছে নতুন বাঙলা সিনেমার বয়ান। আর নির্মাতারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বলতে চাইছেন তারা আর থাকবেন না সিনেমা ‘আর্ট না বাণিজ্য’ — এই দোলাচলের বদ্ধঘরে। তারা নির্মাণ করতে চান একটা ‘ভালো ছবি’ যা ছবিঘরে-আসা দর্শকদের ফেরত দিবে বিনোদনে পরিতৃপ্ত ক্লোজআপ হাসি।
এক্ষণ প্রশ্ন আসে, নতুন সিনেমা আসলে কি বস্তু?! নতুন সিনেমা মানে কি অর্থে নতুন সিনেমা — এই অর্থে কী যে এখানে তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্মের’ মতো একটু জটিল কাহিনি ও ধীর তাল-লয়ের প্রোডাকশন হবে না আবার মূলধারার বা ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমার মতন স্বল্প বাস্তবতায় মোড়ানো মারদাঙ্গা কোনো চলচ্চিত্রিক পরিবেশনাও নয়। নাকি আসলে তারা চাইছেন আর্ট ও বাণিজ্যের যৌগিক মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশে ছায়াচিত্র নির্মাণের নতুন সড়ক উন্মোচন করতে? আচ্ছা যদি বাংলায় আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি দুইটার জন্য একটি শব্দ ‘শিল্প’ ব্যবহৃত না হতো তাহলে সিনেমা ‘আর্ট’ না ‘বাণিজ্য’ এই তর্কের সম্যক সুরাহা হইতো কি? হয়তো ব্রহ্মা কইতে পারেন!
আপাতদৃষ্টিতে, আমা(দে)র কাছে মনে হচ্ছে যৌগিক মাধ্যম হিসেবে সিনেমার পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণে ‘শিল্প’ ও ‘বাণিজ্যে’র মধ্যে সমঝোতার প্রশ্নে বিকল্প কোনো পথে না হেঁটে বরং তারা সমঝোতায় আসতে চাইছেন; যেনবা আর্টের মধ্যে বাণিজ্যটারে ‘কালচার’ করা যায় নিরাপদভাবে সেই ফিকিরই করছেন।
পাঠক, সমঝোতা শব্দে আপনার আপত্তি থাকলে আমার দুইটা কথা আছে।
তো, এতে কি বলা সম্ভব বাঙলা সিনেমা নতুন ভাষা বা অভিমুখ খুঁজে পেয়েছে বা পাচ্ছে বা পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমা(দে)র কাছে নেই, আছে সময়ের কাছে; তবে আমরা এইটা বলতেই পারি আর-কিছু-না-হোক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এই সিনেমাগুলির প্রকাশ আমাদের মনে এই প্রণোদনাই জাগায় যে সিনেমা বানালেই একদম মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে যাওয়ার মতো লসের সম্মুখীন হতে হবে না বা মেকিঙের কালে পকেটের লালবাত্তি জ্বলার অবস্থা হলেও কুচ পরোয়া নেহি, পরিবেশবান্ধব এনার্জি সেভিং বিজ্ঞাপন ঠিক ঠিক ঘর আলোয় ভাসিয়ে দেবে। অর্থ যা দাঁড়াইল তা হলো একটা মূর্তিমান ইন্ডাস্ট্রি থাকা সত্ত্বেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বিকল্প আরেকটি ইন্ডাস্ট্রির দিকে। যার রিংমাস্টার লোকাল টিভি চ্যানেলগুলির নির্মাণ সংস্থা।
ওকে,ফাইন!
এইটা কোনো সমস্যা না। ভালো তো! সিনেমা করে যদি কোনো টাকাই না আসে তাহলে নতুন ছবির টাকা গৌরীসেন যোগাবে কোত্থেকে?! হক কথা।
এও প্রকাশ থাকুক — নতুনদের সিনেমার পোস্টার থেকে শুরু করে ছবির কাহিনি এবং নির্মাণেও রয়েছে নতুনত্ব।
এই নতুনত্ব যতটা-না স্পষ্ট নির্মাণশৈলীর প্রযুক্তিগত দিক থেকে তারচেয়ে অধিক স্পষ্ট নয় আঙ্গিক বা গল্প বলার ঢঙের দিক থেকে এবং ফিল্মল্যাঙ্গুয়েজের যথাযথ ব্যবহারের প্রশ্নে। যেভাবে আমরা সাদেক খানের ‘নদী ও নারী’, একটা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সেই সময়ের পটে নতুন ও সাহসী সিনেমা বলে ট্যাগ করতে পারি, এখন কি তা বলতে পারছি সহজেই!
ধরা যাক, জহির রায়হান — যিনি বুঝতে পেরেছিলেন নতুন দিন আসছে, তাই নতুন ভোরের আগেই তিনি তৈরি হয়ে গেলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিয়ে ১৯৭০-এ; ’৭১-এর আগেই তিনি ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করে ফেললেন তাঁর সিনেমায়। সাংঘাতিক এক দূরদর্শী ঘটনা! আবার এই জহির রায়হানই বানিয়ে ফেলেন তৎকালীন পাকিস্তানের ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক সিনেমা ‘বাহানা’ (১৯৬৫)। ‘জীবন থেকে নেয়া’-কে যদি নতুন সিনেমা হিসেবে ভাবা যায় তবে এইটা স্পষ্ট যে নতুন ‘সিনেমার ভাষা’ হতে হবে নয়া জার্গনঋদ্ধ; উল্লেখ্য, এই ভাষা সিনেমার কুশীলবদের মুখের বুলি নয়।
জহিরকে দেখে আমাদের বুঝতে হবে যদি সিস্টেম পাল্টাতে/নাড়া দিতে চাই, যদি নিজের কণ্ঠস্বরকে সময়ের লাউড স্পিকারে এলান করতে হয় তবে সিস্টেমে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনের দম থাকা চাই কলিজায়, সিস্টেমের সাথে সমঝোতা করে বা এফডিসি-র সড়কদ্বীপের উপর অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গলা ফাটানোতে সময়ের প্রয়োজনে নতুন সিনেমার আবির্ভাব হবে না।
সর্বোপরি, জহির রায়হানের উপস্থিতি আমাদের বলে যায় লড়াইটা নিজের, প্রযোজক এই ফাইট দিবে না বরঞ্চ তাকে বাধ্য করা যেতে পারে এই ফাইটে শামিল হওয়ার জন্য। তাকে বাধ্য করার সমূহ অস্ত্র নির্মাতার তূণে যখন প্রস্তুত আছে সেখানে নির্মাতা কেন আপোসকামী ভূমিকা নেবেন; তবেই-না প্রতিবাদের নতুন ভাষা তৈরি হবে, প্রাণ পাবে নতুন সিনেমা।
আর যদি বলেন পাল্টাপাল্টির মধ্যে আমি নাই, আমি দিনবদলে বিশ্বাসী তাহলে আর কি ‘দুপুরের খাবারের’ বদলে তবে ‘লাঞ্চটা’ সেরে ফেলুন চট করে … জানবেন — বদলে দেবার মধ্য দিয়ে সমাজে ডিনামিক্স বা ডায়ালেক্ট তৈরি করা যায় না তথাপি কোনো নহলী এনার্জির উদগীরণ হয় না। সমাজের তলে তলে তল্লাটে তল্লাটে তখনই সামাজিক গতিশক্তির সঞ্চার হয় যখন একটি পোক্ত ফেনোমেনার হাজিরা থাকে প্রচলিত চলের বিপরীতে।
মহামান্য ওং কার ওয়াই মনে করেন, “একজন ফিল্মমেকার তো বটেই শিল্পী মাত্রই তাকে ‘সময়ের’ প্রতি এবং নিজের সাথে সৎ থাকতে হয় অর্থাৎ সিনেমা বা কাজটা একটা দায় নিয়ে করতে পারতে হয়। এই দায় ঈশপের দায় নয় যা আমাদের নির্মাতারা হরহামেশাই নিয়ে থাকেন; এই দায় মূলত নির্মাতার নিজকে উদ্ধারের দায় বৈ ভিন্ন কিছু নয়।”২
পরবর্তী প্রশ্নের ঘরটা ফাঁকা আছে পাঠক-পাঠিকা আপনাদের তরে …
আপনি কি টের পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীদের লগ্নি ফেরত আনার দায়ে নির্মাতাদের ঝুঁকতে হচ্ছে ‘নব ফর্মুলা সিনেমা’ বা মিডিয়া-কথিত ‘নতুন সিনেমা’-র পানে? এবং এই সিনেমাগুলি আদতে নতুন কোনো তরিকায় গল্প বলে উঠতে পারছে না যেমতি সুরাহি বদল করলেই সুরার চরিত্র পুনর্বিন্যাস্ত হয় না। আমরা তো জানি, দু-কলম লিখলেই যেমন তা কবিতা হয়ে যায় না তেমনি কিছু অমায়িক বা দুর্ধর্ষ মুহূর্ত ঘটনার বিনি সুতোয় গাঁথলেই তা সিনেমা হয়ে যায় না — সিনেমাটাকে দিনান্তে সিনেমা হয়ে উঠতে পারতে হয়। আর এইটা তখনই সম্ভব হয় যখন নির্মাতার শিল্পকৌশল ও নৈপুণ্যের মেলবন্ধন ঘটে। নতুবা দেখা যাবে যে, দর্শকবৃন্দের আড্ডা একটা আস্ত সিনেমার অজস্র ফ্রেমের বদলে শুধুমাত্র ‘ঐ ফ্রেমটা খেয়াল করছেন’-এর মধ্যে সীমায়িত রবে।
আপনার কী মনে হয় ঐ একটা ফ্রেমের জন্যই প্রযোজক/নির্মাতার এত এন্তেজাম বা উপভোগের নিমিত্তে আমাদের এত আমোদ করে ছবিঘরে যাওয়ার চল রয়েছে!?
দর্শক হিসেবে আমরা কিন্তু সাংঘাতিক বুভুক্ষু দশায় দিনাতিপাত করছি এবং এটাও সত্য বাঙালির ক্ষুধার রাজ্য বরাবরই গদ্যময়; তাই সামান্যতেই আমাদের উদরপূর্তি না হলেও মনটা কিন্তু ভরে যায় ভরপুরভাবে। আমরা বারংবার দেখেছি আমাদের দর্শকদের উচ্ছ্বসিত হতে সামান্য সিনেমাটিক মোমেন্টের ছোঁয়ায়, তা থেকে ধারণা করার স্পর্ধা পাই পুরো সিনেমাটাই যদি সিনেম্যাটিক মোমেন্টে ডুবুডুবু হতো তাহলে নির্ঘাৎ ধুন্ধুমার বেঁধে যেত! বহুজাতিক কোম্পানির মোড়কে পরিবেশিত ‘নতুন সিনেমা’-র এই বৈশিষ্ট্যটি চোখে বালির মতন খচখচ্ করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো — ‘নতুন সিনেমা’-র কারিগরগণ একদিকে যেমন সরাসরি আসছেন সিনেমা বানাতে আবার আরেকদিকে আছেন অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার অন্যান্য শাখার মাঠকর্মে অভিজ্ঞ নির্মাতারা। অন্যান্য বলতে বলছি টিভিনাটক, টিভিসির কথা।
তবে একজন নতুন নির্মাতার চাইতে বিনিয়োগকারীদের অধিক মনোযোগ থাকে এদের উপর। শহুরে চাওয়া-পাওয়ার নিম্নচাপে ভোগা ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’ও ঐসকল ইমেজ-কারিগরের উপর ঈমান রাখতে চায়, কারণ — তাদের সিনেমাগন্ধী টেলিভিশনপ্রোডাকশনগুলি আমাদের ভাববার আহ্লাদ জাগায়, ঠিকঠাক সুযোগ পেলে তারা [হয়তো] পর্দাকাঁপানো সিনেমা পয়দা করতে পারেন! এরূপ উত্তেজনা আর কাঁপা-কাঁপা হিয়া নিয়ে দর্শক যখন ছবিঘরে বসে, তখন … এ কী! কী কাণ্ড!! এবার সিনেমার মতন সি-নে-মা-র বদলে যেন নাটকগন্ধী ছায়াচিত্রের অবতারণা সারা পর্দাজুড়ে, সাথে তিনআঙুল পরিমাণ একচিমটি সিনেম্যাটিক মোমেন্টের ফোড়ন! তখন মনে হয় ঘরের রিমোট কন্ট্রোলওয়ালা টেলিভিশনটাই ভালো। আর ভাবনার ফ্রিকোয়েন্সি মড্যুলার (এফএম)-এ যুগপৎ বেজে ওঠে পিট সিগারের ফুলগুলো সব গেল কোথায়ের সুরে ‘আমাদের ছবি নাই বলেই গুলিস্তাঁগুলি সব বহুতল বিপণীবিতানে ধর্মান্তরিত হয়ে গেল।’
নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপন নিয়ে মুখরোচক বিতর্কের এই দেশে কর্পোরেট নিবেদিত ছবিগুলি হতে পারে এই সময়ে নির্মিত, হতে পারে সেখানে হাল-আমলের গল্প হাজির থাকে কিন্তু সার্বিক বিচারে তা কোনো নয়া ভূয়োদর্শন দিয়ে আমাদের অভিজ্ঞানের জগতে জায়গা করে নিতে পারছে না। ‘নতুন সিনেমা’ না বলে আসলে এইরকমের সিনেমাগুলিকে পরিচিত করা হোক সিনেমা ব্যবসার নব ফর্মুলার প্রোডাক্ট হিসেবে যা ‘নতুন সিনেমা’ নয় কোনোভাবেই।
“যাই হোক, নতুন সিনেমায় যেন থাকে এই দেশের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। আর তা হোক শয়নভঙ্গির মতো সহজ স্বাভাবিক। বিশ্বগ্রামের মাঝে আবহমান বাংলার গ্রামটুকুও জেগে থাকুক। জেগে জেগে ঘুমানোর দিন শেষ হোক। নতুন সিনেমায় বাংলাদেশের মুখ জলের সারল্যে মুদ্রিত হোক। অন্ধকার পর্দায় ফুটে উঠুক আলোর গান, প্রাণের কথা, মননের ভাষা।”৩
পাঠক-পাঠিকা, বাংলা সিনেমার উজ্জ্বল আঁধারের মাঝে নতুন সিনেমার সন্ধানে আপনার যাত্রা স্বাস্থ্যকর হোক!
………
দোহাই
১. হুমায়ূন আহমেদ , ছবি বানানোর গল্প, পৃ. ১৩, ১৯৯৬, সুবর্ণ, ঢাকা। ISBN: 9844590213
২. লরেন্তঁ তিরার্দ , মুভিমেকার্স মাস্টার ক্লাস/প্রাইভেট লেসনস্ ফ্রম দ্য ওর্য়ল্ড ফোরমোস্ট ডিরেক্টরস, পৃ. ১৯১, ২০০৪, ফেবার অ্যান্ড ফেবার,লন্ডন।
৩. নূরুল আলম আতিক, ‘নতুন সিনেমা, সময়ের প্রয়োজন’, ২০০৯ , পৃ. ৪০, পান্ডুলিপি কারখানা, ঢাকা। ISBN: 9789843301178
- লেখাটা লাল জীপের ডায়েরী সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে সংগৃহীত
… …
- পলিটিক্স অফ বেঙ্গল : দৃশ্যবাস্তবতার রাজনীতিতে কিছু গরহাজির আত্মা || অরিজিন্যাল : জেমস লিহি / অনুভাষ্য ও অনুবাদ : ইমরান ফিরদাউস - November 22, 2024
- চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া চলচ্চিত্র || ইমরান ফিরদাউস - September 29, 2024
- সুমন মুখোপাধ্যায় : এক মেইকার || ইমরান ফিরদাউস - September 25, 2024
COMMENTS