ছোটবেলায় মানে যখন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদে কর্মী হিসেবে হাতেখড়ি হইছে, তখন না-বুঝেই বলতাম ফিল্ম সোসাইটি করি, বাট ফিল্ম সোসাইটি কী বস্তু, খায় না মাথায় দেয় — সেইটা বোঝার একটা তাড়না যে ছিল, তা তো অস্বীকার করার জো নাই। তো, সেই তাড়না থেকে বড়ভাই-বোনদের পাত্তা না দিয়েই, সুলুক সন্ধানে আগ্রহী এ-মন বাজারে গিয়ে খুঁজতে থাকে কোনো পুস্তকের হদিশ। খুঁজে-পেতে মুহম্মদ খসরু বিরচিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শিরোনামধারী বইটা খরিদ করছিলাম। তো, বইটা পড়ি আর বিগতযৌবনা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে পরিচিত হইতে থাকি। অনেক নাম, অনেক ঘটনা, বিবিধ অভিমানের তোপখানায় দাঁড়িয়ে, নিজেরে যেন আবিষ্কার করি ইতিহাসের এক গুপ্ত দরজার সামনে। যা-ই হোক, পঠন-পরবর্তী অবিমিশ্র বোধের চোরা স্রোতের ভেতর আটকে যায় কতিপয় ভিনদেশি নাম, যেমন — সতীশ বাহাদুর, জেমস লিহি, ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ প্রমুখ সিনেমাশিক্ষা/সাক্ষরতা বিতরণ করতে এবং সিনেমাজ্ঞানের আলো জ্বালাতে ঢাকা এসেছিলেন। আর হা-পিত্যেশ হতে থাকে, হায়, এ-রকম মানুষদের সাথে হাল আমলের কর্মীদের কেন সাক্ষাৎ ঘটে না।
এরপর আর মনে নাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হইছি, তাও ছয় বছর হয়ে গেছে। এই বেলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে, একদিন যুগপৎভাবে বিরক্ত ও ভিড়মি খেলাম কোনো-এক শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট চেক করতে বসে! জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা অ্যাসাইনমেন্ট প্রায় পুরোটাই কপি-পেস্ট অন্যের কথামালা থেকে — এইটা হলো বিরক্তির কারণ। আর ভিড়মি খেলাম যখন দেখি স্টপ জেনোসাইড নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় শিক্ষার্থীটি কিউবার নমস্য সিনেমাকারিগর সান্তিয়াগো আলভারেজের নাম নিচ্ছে! কী সাংঘাতিক! মানে, বুঝতেছি না যে, এইরকম উরাধুরা তুলনা সে নিজে বুঝে করছে নাকি আকাশ থেকে পাইছে।
এরপর গল্পের সিন-পার্ট তো পালটায় গেল।
রায়হান আর আলভারেজের কানেকশন খুঁজতে গিয়ে যেন সাপ বের হওয়ার দশা! এ কী, এ তো সাক্ষাৎ জেমস লিহি! সেই জেমস লিহি, যিনি ঢাকা শহর বেড়ায় গেছেন (বাট লাল-নীল বাতি দেখে তার মন ভরছিলো কি না তা বড়ভাই-বোনরাই বলতে পারবেন), যার নাম আমি বইয়ে পড়ছি গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে। তিনি সেন্স অফ সিনেমা নাম্নী জাঁদরেল অনলাইন ফিল্মজার্নালে লেখাটা ছাপছেন। শিরোনাম দিয়েছেন ‘Films that Make a Difference… Santiago Alvarez and the Politics of Bengal: Ciclon’। পড়তে শুরু করার পর দেখি ও-মা-গো অবস্থা। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড নিয়ে এমন জরুরি একটা লেখা যা কিনা ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ওয়েবে অর্থাৎ একযুগ প্লাস দুই বছর আগে, সেইটা আমাদের এই এন্তার ফিল্মআলাপিদের নেক নজর ফাঁকি দিয়ে রায়হানের মতোই গুম হয়ে রইলো ক্যামনে?!
এরপর আর ফ্ল্যাশব্যাকের সুযোগ নাই।
ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের মতন এই সিম্পল অথচ অকপট লেখাটি খুলে দিতে থাকল অনেক প্রশ্নের জট। যেমন ধরা যাক, আমরা (?) মনে করে থাকি — টাকা কামানোর জন্য যে সিনেমা করে তার মাথায় চুল থাকলেও রুচি নাই, বিশ্ব ইতিহাস-সাহিত্য-রাজনীতি নিয়ে বোঝাপড়া নাই। সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনের সাথে কোনো পরিচয় নাই। তো, এখন দেখা যাচ্ছে জহির রায়হানও সিনেমা দিয়ে তথাকথিত টাকা কামাই করছেন, সো উনিও পাপ করছেন (?) স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে! তাহলে, যুদ্ধের মধ্যে শরণার্থী জীবন নিয়ে এইরকম সমসাময়িক ঘরানার সিনেমা কী উপায়ে পয়দা করলেন, এই শক্তি কই দিয়ে আসলো বা কোনো সিলসিলা ছাড়াও যদি আসে — সেটারও গোপন আলাপটা জানা দরকার। তারচেয়েও জরুরি মনে হয় আমার কাছে — সত্যিই কি আমরা (?) রায়হানের সিনেমাগুলো দেখেছি ঠিকঠাকমতো মানে উইদাউট অ্যানি প্রেজুডিস… ঘাবড়ায়েন না, এখুনি উত্তর দেবার কিছু নাই।
এরপর একটা ছোট্ট ইন্সার্ট যাবে জেমস লিহিকে নিয়ে।
জেমস লিহি একজন ফিল্মহিস্টোরিয়ান এবং স্ক্রিপ্টরাইটার। উনি নিকোলাস রে, কেইন ম্যাকমুলেন (যৌথভাবে লেখা ১৮৭১ সিনেমাটি ১৯৯০ সনে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অফিসিয়াল সিলেকশনে ছিল) এবং মেড হনডো-র সাথে কাজ করেছেন। সিনেমাবিষয়ক তার লেখালেখি নিয়মিত ছাপা হয়/হয়েছে দ্য গার্ডিয়ান, সাইট অ্যান্ড সাউন্ড, ক্যাইয়ে দ্যু সিনেমা ইন ইংলিশ, ভার্টিগো (ফাউন্ডিং কো-এডিটর) এবং পিক্স-এ। তাঁকে আফ্রিকান সিনেমার অথোরিটি হিসেবে গণ্য করা হয়। চলচ্চিত্রশিক্ষক হিসেবে তিনি জগৎ জুড়ে ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছেন শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে। আশির দশকের শেষভাগে ঢাকায় এসেছিলেন সিনেমার আঙ্গিক বিষয়ে কর্মশালা করাতে। সেই কর্মশালার অন্যতম শিক্ষার্থী তারেক মাসুদ বলে গেছেন লিহির পাঠশালার অভিজ্ঞতার কথা — “জেমস লিহি ব্রিটিশ।… জেমস লিহির অস্থিমজ্জায় ছিল আফ্রিকান সিনেমা, ল্যাটিন আমেরিকান সিনেমা। তার একটা মাসব্যাপী কর্মশালা হয়েছিল ঢাকায়। সেটা আমার চোখ একদম খুলে দিয়েছিল। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন সবারই কমবেশি চোখ খুলে দিয়েছে। সিনেমা তাত্ত্বিকভাবে দেখা, রাজনৈতিকভাবে দেখা, শৈল্পিকভাবে দেখা, নৃতাত্ত্বিকভাবে দেখা — মাল্টিপার্সপেক্টিভ, মাল্টিপ্লিসিটি ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। যেটার এখন চর্চা হচ্ছে সেটা আমরা ১৫-২০ বছর আগে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম।”
তারেক মাসুদের প্রতিটি পর্যবেক্ষণের নমুনা আমরা পাবো জেমস লিহির এই বক্ষ্যমাণ লেখাতেও। আমরা দেখব ঠিক যেমন আঁজলা ভরা মমতায় জহির রায়হান মানুষকে ভালোবেসেছেন, মেহনতি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, ঠিক তেমনই ভাবাবেগের পাগলা ঘোড়ার রথ ছুটিয়েছেন জেমস লিহি সিনেমার ইতিহাসের পথেপ্রান্তরে ও বনবাদাড়ে। সিনেমার আলাপের শেষে দুইজনের ভাবনার মোহনা গিয়ে যেন মিশেছে মানবিক মূল্যবোধের মোহনায়। বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসের বোঝাপড়ায় জেমস লিহির এই পর্যবেক্ষণ গুরুত্বের সাথে আমলের দাবি রাখে।
এরপর আর কী…সমাপ্তি দ্য এন্ড।
পলিটিক্স অফ বেঙ্গল : দৃশ্যবাস্তবতার রাজনীতিতে কিছু গরহাজির আত্মা
অরিজিন্যাল : জেমস লিহি; অনুভাষ্য ও অনুবাদ : ইমরান ফিরদাউস
‘Films that Make a Difference… Santiago Alvarez and the Politics of Bengal: Ciclon
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে রুদ্ধ গণতন্ত্র পুনঃপ্রচলনের জন্য পূর্বপাকিস্তানে চলছিল দীর্ঘ আন্দোলন। এই আন্দোলন জারি ছিল অবিরামভাবে বলবৎ থাকা সামরিক শাসনের অবসানের জন্য । অচলাবস্থা নিরসনের জন্য ১৯৭০ সনের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। পূর্বপাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর রূপে পরিচিত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। তবে, তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিমপাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো (যার দল ৮৮টি আসন লাভ করে) নির্বাচনের এই ফলাফল বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দর কষাকষি শুরু করে।
সরকারের এই ছিনিমিনি মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ করে বাঙালি আমজনতা। বাঙালিরা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে; ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ যখন শেখ মুজিবুর রহমান এবং মিলিটারি শাসকযন্ত্রের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছিল এবং আলাপ ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা উদিত হচ্ছিল…ঠিক এমন পরিস্থিতিতে বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সহ একাধিক শহরে নিরস্ত্র, বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা চালায়। এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হন ও ঢাকা হতে ১২০০ মাইল দূরে কারাবন্দী হওয়ার পূর্বেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্রুত অ্যাকশনে পূর্ববাংলার জনগণ বিপুল গণহত্যার শিকার হয়। প্রায় দশ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হাতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গে…এই তালিকায় ছিল কৃষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী মানুষ, লেখক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদরা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় ও কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। কলকাতায় সদর দপ্তর স্থাপন করা এই সরকারের অন্যান্য দপ্তরের পাশাপাশি একটি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরও ছিল। যা-হোক, শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত ফিল্মমেকারদের মধ্যে মাত্র একজন ফিল্মমেকারই ছিলেন, যিনি বিপ্লবী যুদ্ধ চলাকালীন একজন নির্মাতার ঠিক যেরকম রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ধারণ করা প্রয়োজন, তেমনটিই ছিলেন। তিনি হলেন পুরস্কারজয়ী কাহিনিচিত্রপরিচালক জহির রায়হান।
জহির রায়হান ১৯৭০ সনে নির্মাণ করে ফেলেছেন ঐ দাহকালের সবচেয়ে জ্বালাময়ী সিনেমা জীবন থেকে নেয়া , পূর্বপাকিস্তানের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সিনেমার বয়ান তৈরি করেন। দৃশ্যবাস্তবতার পরিসরে বাহান্নর ভাষাআন্দোলনকে লম্বা সময় ধরে পাকিস্তানি সামরিক সরকার নিষিদ্ধ করে রেখেছিল।
যা-ই হোক, জহিরের মতন একজন আজন্ম ফিল্মমেকার জানতেন কাগজ-কলম ব্যতিরেকেই কীভাবে একটি সিনেমার অস্তিত্ব পয়দা করা সম্ভব। তবে, পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্ম ব্যতীত তার আর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি বুঝতে পারছিলেন না এই বেপরোয়া যুদ্ধকালীন অবস্থায় কীভাবে সিনেমাকে ব্যবহার করা যায় বা নির্মাণপদ্ধতি কী হতে পারে। সৌভাগ্যবশত কলকাতায় তাঁর নজরে আসে পূর্বইউরোপ এবং কিউবার সিনেমাসমূহ। এই সিনেমাগুলো যেন তাঁর দৃষ্টির সীমানা প্রসারিত করে, এক নবমাত্রার উদ্বোধন ঘটায়, তথাপি সমসাময়িক বাস্তবতায় জহির রায়হানের সিনেমা-অনুশীলনের নতুন আঙ্গিকের বোধন ঘটে।
সেই সময়ে তাঁর দেখা সিনেমাগুলোর মধ্য থেকে আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিউবান নির্মাতা সান্তিয়াগো আলভারেজ-এর সিনেমা। আলভারেজ-এর সিনেমা পরিষ্কারভাবে প্রভাব ফেলেছিল জহির রায়হানের সে-সময়কার প্রগাঢ় আবেগী ও চলন্ত প্রতিবাদের জ্বলন্ত স্বাক্ষর স্টপ জেনোসাইড-এ। স্টপ জেনোসাইড-এ আলভারেজের শক্তিশালী কাজগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। যদিও, জহির রায়হানের কাজ দেখে বা আলভারেজের ফিল্মিক ভাষার ব্যবহার অবলোকন করেও, কিউবা বা বাংলা কোনো অঞ্চলের জনগণের পক্ষেই আঁচ করা সম্ভব হয় নাই কীভাবে একের ক্যামেরা অপরের হাতে রাইফেল হয়ে উঠতে পারে বা হয়ে ওঠে।
তৎকালীন পরিস্থিতিতে ফিল্মিক ম্যাটেরিয়ালের খামতি সত্ত্বেও…কার্যত, এই সিনেমাটি স্টক ফুটেজ, নিউজ রিল এবং ফাউন্ড ফুটেজের সমন্বয়ে সম্পাদনার টেবিলে প্রসব লাভ করে। এহেন দশায় আমরা স্মরণ করতে পারি আলভারেজের বানানো হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়েম্প্রে (১৯৬৭)-র কথা; এটি তৈরি করা হয়েছিল বিপ্লবী চে গুয়েভারা নিহত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। ফিদেল ক্যাস্ত্রো আহুত সমাবেশে জনগণের উদ্দেশ্যে চে গুয়েভারার মৃত্যুর ঘোষণা প্রচার/প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এটি নির্মাণ করা হয়। এই সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে এটি মনে করা ন্যায়সঙ্গত হবে না যে, বিষয়বস্তুর গুণে সিনেমা দুটি উৎরে গেছে — বরং স্মরণ রাখা ভালো যে — নিবিড় কাঠামো ও বিষয়বস্তু উপস্থাপনে নির্মাতাদ্বয়ের দক্ষতা সিনেমাগুলোকে করেছে কালোত্তীর্ণ।
স্টপ জেনোসাইড নির্মাণে বাংলাদেশের জন্য সহানুভূতিশীল ভারতীয় বন্ধুরা টাকাকড়ি যোগাড় করে দিয়েছিল। নির্বাসিত রাজনীতিবিদ এবং তাদের চলচ্চিত্র বিভাগ এই উদ্যোগে গরহাজির ছিল। যা-ই হোক, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ স্টপ জেনোসাইডের গুরুত্বটা দেখতে পেরেছিলেন; ইন্ডিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও দেখলেনস্টপ জেনোসাইড, তিনি রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছিলেন। এবং ইন্ডিয়ার ফিল্ম ডিপার্টমেন্টকে নগদ নগদ অর্ডার দিলেন সিনেমাটি ক্রয় করে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানোর জন্য।
সিনেমাটির ধারাভাষ্য বাংলায় না হয়ে ইংরেজিতে থাকায়, পাকিস্তানিদের বর্বরতার খবর আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার ইশারা তৈরি করে। ভিয়েতনামের ‘মাইলাইয়ের মতো একশো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে’ — স্টপ জেনোসাইড-এর এই বার্তা আলোর বেগে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষুরধার গতিতে। ১৯৭১ জুনে, মুজিবনগর সরকারের নিজস্ব চলচ্চিত্র বিভাগের প্রতিবাদ সত্ত্বেও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার জহির রায়হানকে আরো তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা নির্মাণের দায়িত্ব সঁপে দেয় — লিবারেশন ফাইটার্স (আলমগীর কবির), যুদ্ধপীড়িত শিশুদের নিয়ে ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স (বাবুল চৌধুরী) এবং অ্যা স্টেইট ইজ বর্ন (জহির রায়হান)। যদিও, এ-ত্রয়ীর কোনোটিই শক্তি ও প্রভাবের দেমাগের প্রশ্নে স্টপ জেনোসাইডকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। এও প্রকাশ থাকুক যে, এসবের কোনোকিছুই হয়তো ঘটানো সম্ভব হতো না, যদি জহির রায়হানের পরিচয় না ঘটে থাকত কিউবান নির্মাতা আলভারেজের অনুসরণীয় কাজের সাথে।
জহির রায়হানের নিজের আয়ু ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হয় নাই। ১৯৭২ সনের জানুয়ারি মাসে, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক সপ্তাহ বাদে, তিনি তাঁর ঔপন্যাসিক বড়ভাই ও গুরুকে (যিনি নিখোঁজ হন স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ঠিক যে-সময়টায় হানাদার বাহিনী শেষ গণহত্যা চালিয়েছিল) খুঁজতে ঢাকার এক এলাকায় (মিরপুর) যান, যা দেশভাগের পর থেকে একাত্তরের যুদ্ধপরবর্তী সময়েও বিহারি মুসলিম শরণার্থীদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল; যারা বাংলার তুলনায় পাকিস্তানিদের প্রতি অধিক অনুগত ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এই এলাকাটি পাকিস্তানি বাহিনীর কোলাবরেটরদের অন্যতম ঘাঁটি বলে চিহ্নিত ছিল। জহির রায়হানকে এরপর আর দেখা যায় নাই, তার বডির হদিশও আর মেলে নাই। কেউ জানে না তাঁর সাথে কী ঘটেছিল। বাংলাদেশিদের মারফত আমার কানে বেশকিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আওয়াজ এসেছে, যেমন — অনুসন্ধান অভিযানে জহির রায়হানের সাথে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যে-সদস্যরা ছিলেন, তারাও (সম্ভবত হিন্দু) বিহারি ছিলেন এবং এলাকায় ঢোকার পর তাদের সাথে জহির রায়হানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যথা এও শুনেছি যে, যেসব রিফ্যিউজি রাজনীতিবিদরা কলকাতায় দহরম-মহরম করে জীবনযাপন করছিল, জহির রায়হান আন্দোলনের ছবি তুলবার সময় তাদের কীর্তিকলাপও ফিল্মবন্দি করেছিলেন; ফলত, জহির রায়হানের উধাও হয়ে যাওয়াতে তারা খুশিই হয়েছেন। জহির রায়হানের অন্তর্ধানের সাথে সাথে কিউবার আইসিএআইসি (The Cuban Institute of Cinematographic Art and Industry)-এর মতন বাংলাদেশে ন্যাশনালাইজড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ হয়ে যায়, যা তিনি এবং তারঁ কতক সহকর্মীবৃন্দ নির্বাসনকালীন পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এই প্রস্তাবের সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠের সমর্থক ছিলেন।
ফিল্মফর্ম বা সিনেমার আঙ্গিকের উপর ধারাবাহিকভাবে কিছু কর্মশালা সম্পাদন করার উদ্দেশ্য হেতু প্রথমবারের মতো আমার বাংলাদেশে আসা হয়। কর্মশালায় প্রদর্শনের জন্য সেসময় আমার হাতের নাগালে থাকা সিনেমাসমূহ থেকে বেছে বেছে একটি ডাইভার্স কালেকশনের সিনেমামালা নিয়ে এথায় হাজির হই। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফিল্মমেকার এবং কিউবান প্রামাণ্যচিত্রকারের মধ্যকার সংযোগ সম্বন্ধে তখন পর্যন্ত আমি নিজেও অজ্ঞাত ছিলাম। তো, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের সাথে তাঁর কাজের ও সিনেমাভাষার পরিচয় ঘটিয়ে দেবার জন্য, বাছাই-করা সিনেমামালায় আমি আলভারেজের সিক্লোন রেখেছিলাম। (কারণ, আমি দেখেছি যে) ভিন্ন ইতিহাস ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের শর্তমূলক পরিবেশের মধ্যে বিকশিত হওয়া দৃষ্টিপাতের ভেতর দিয়ে একটি সিনেমা দেখাটা বরাবরই মঙ্গলদায়ক, শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। মধ্য-ষাটের দশকে কিউবায় যা ছিল নতুন এবং অনুকরণীয় সিনেমা নির্মাণধারা (যেমন সিক্লোন-এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতি কীভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটি দেখাতে বারবার লোকেশনে গিয়ে শ্যুট করা, এর মাঝে ক্লাইমেক্স ঘনায় তুলতে উপদ্রুত এলাকায় ফিদেল ক্যাস্ত্রোর পরিদর্শনের একঝলক), সেটিই আশির দশকের প্রান্তে এসে বাংলাদেশের টিভিপর্দায় একটি ক্লিশে কনফর্মিস্ট নিউজ ব্রডকাস্টিঙের চেহারা নিয়েছে। জেনারেল এরশাদ, যিনি কিনা ক্যু ও গুপ্তহত্যার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাকে প্রায়ই জাতীয় টিভির পর্দায় দুর্যোগ-উপদ্রুত এক বা একাধিক এলাকা পরিদর্শন করতে দেখা যেত; প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ-অঞ্চলের নিয়মিত ঘটনা। মাত্র সিকি শতাব্দীর ভেতরেই শ্যুটিঙের লাইটওয়েট যন্ত্রপাতি এবং লোকেশন শ্যুটিঙের গুরুত্বের বয়ানধর্মিতা ও রাজনৈতিকতার রূপান্তর ঘটে গেছে।
আরো একটি ইতিবাচক দিক আমার নজরে এসেছে, বাঙালি দর্শকরা দ্রুত খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন উভয় সিনেমায় দ্রষ্টব্য জাতিগত সমরূপতা। সিক্লোন সিনেমায় একটি জাতি হারিকেন নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিচ্ছে, স্টপ জেনোসাইড-এ একটি জাতি ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী থেকে সামরিক আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতিরত অবস্থায় আছে। আইসিএআইসির প্রযোজনায় সিক্লোন নির্মিত হলেও এই প্রকল্পের সহ-প্রযোজক ছিল সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগ। এক পর্যায়ে এই সহযোগিতা মোটেও বিস্ময়কর নয়। অধিকাংশ দেশে এটি প্রচলিত যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয় বা হবে। তথাপি, সিক্লোন মুক্তি পায় ১৯৬৩ সনে, বে অফ পিগস আক্রমণের (এপ্রিল ১৯৬১) মাত্র দুই বছর পরে এবং কিউবান মিসাইল সংকটের (অক্টোবর ১৯৬২) একমাস পর; এবং পরিশেষে এইভাবেই সিনেমা পঠনের ভেতর দিয়ে নির্মাতা(দ্বয়) স্পষ্ট করে তোলেন বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিনেমার লড়াই জমিনটুকুন।
স্টপ জেনোসাইড (সাদাকালো / ৩৫ মিমি) |
|
পরিচালনা | জহির রায়হান |
প্রযোজক | বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সহায়ক সমিতি |
চিত্রনাট্যকার | জহির রায়হান |
ধারাভাষ্য | আলমগীর কবির |
সম্পাদক
চিত্রগ্রহণ |
দেবব্রত সেনগুপ্ত
অরুণ রায় |
মুক্তি | ১৯৭১ |
দৈর্ঘ্য | ২০ মিনিট |
দেশ | বাংলাদেশ |
ভাষা | ইংরেজি |
টীকা
১. Alamgir Kabir, “Short Film Movement in Bangladesh: Search for Free Cinema,” From the Heart of Bangladesh, Bangladesh Short Film Forum (Dhaka, 1990)
২. An Interview with Bangladeshi Film maker Tareque Masud
- পলিটিক্স অফ বেঙ্গল : দৃশ্যবাস্তবতার রাজনীতিতে কিছু গরহাজির আত্মা || অরিজিন্যাল : জেমস লিহি / অনুভাষ্য ও অনুবাদ : ইমরান ফিরদাউস - November 22, 2024
- চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া চলচ্চিত্র || ইমরান ফিরদাউস - September 29, 2024
- সুমন মুখোপাধ্যায় : এক মেইকার || ইমরান ফিরদাউস - September 25, 2024
COMMENTS